Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পঞ্চম পুরুষ || Bani Basu » Page 20

পঞ্চম পুরুষ || Bani Basu

এষা বলল—‘আপনিও তো খেলেন দেখলাম। খেয়েছেন, মহানামদা, না?

‘হ্যাঁ খেলাম তো! ভালোই খেলাম। একুশ বাইশ বছর বয়স থেকেই খাচ্ছি। কিচ্ছু হয় না। নেশা-টেশা ধরে না। কোনও নেশাই না। এই পাইপ দেখো, এক কথায় ছেড়ে দিতে পারি, তুমি বললে।’

‘সত্যি?’

‘সত্যিই। আসলে চিন্তা করতে একটু সুবিধে হয়। সেই বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দেওয়া বলে একটা কথা আছে না? তবে অভ্যেসটা পাল্টে নেওয়াও যায়।’

‘আসলে’ পুরুষ ভূমিকাবর্জিত জীবন তো আমার। আপনাদের এইসব পুরুষালি বিনোদনকে ভীষণ অবিশ্বাসের চোখে দেখি। আমি কি নিশ্চিন্তে বসতে পারি?’

‘বাঃ ডেকে আনলাম, বসবে না? আচ্ছা এষা একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করব?

‘স্বচ্ছন্দে।’

‘তোমার জীবন এমন পুরুষবর্জিতই বা হল কেন? কেন ছাড়লে সেই ভদ্রলোককে। লোক কি খুব খারাপ ছিলেন?

‘না, মহানামদা, একেবারেই নয়।’

‘তবে?’

‘যেখানে যত অপরাধ সবই একা আমার। সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে, আমি একা হতেছি আলাদা।’

—‘বলো, বলো, আমাকে বলো কি তোমার সেই মুদ্রাদোষ!’

এষা চুপ করেই থাকে। চুপ করেই থাকে। অনেকক্ষণ পরে ছোট্ট গলায় বলে—‘বড় যান্ত্রিক মানুষ ছিলেন। তা-ও মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু উনি পিতা হতে চাইলেন।’

—‘অন্যায় কিছু, সেটা?’

—না অন্যায় নয়,’ এষা মুখ তুলে তাকিয়েছে, মহানামকে ভেদ করে, পেছনের দেয়ালে তার দৃষ্টি—‘অন্যায় নয়। কিন্তু আমি তো শুধু গর্ভ নই!’

মহানাম বললেন—‘ঠিকই এষা। পৃথিবীর যখন প্রজাবৃদ্ধির দরকার হয়েছিল, তখন মেয়েদের রক্তে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল মাতৃত্বেই তার চরম সার্থকতা। এখন সমাজের সে প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে, এখন নারীত্বে আর মাতৃত্বে সমীকরণ করা উচিত নয়।’

‘উচিত অনুচিত জানি না,’ এষা বলল, ‘শুধু জানি হৃদয় না ভরলে ক্লান্তিকর অভ্যাসের যান্ত্রিকতায় আমার গর্ভ ভরে না। ওভাবে আমি সন্তানের জন্ম দিতে পারি না। পারিনি। কারখানা থেকে কি পুপুর মতো অমন অনবদ্য সৃষ্টি হয়, আপনিই বলুন না!’

মহানাম কটাক্ষে চাইলেন। পাইপটা রেখে দিলেন পাশে ছাইদানির ওপর। বললেন— ‘পুপুর জন্মবৃত্তান্ত তুমি জানো?’

‘জানি।’

‘আগে থেকেই জানতে?’

‘না! কদিন আগে জেনেছি।’

‘কাঁদছ কেন এষা?’

এষা মুখ তুলে তাকাল—‘কই, কাঁদছি না তো!’

‘আমার মনে হচ্ছে তুমি কাঁদছ, কাঁপছ।’

‘কাঁদছি না। বিশ্বাস করুন কাঁপছিও না। নীলমকে আপনি ধরে রাখতে পারলেন না কেন?’

‘হয়ত তেমন করে চাইনি। আসলে আমিও তো তখন অনেকটাই অপরিণত ছিলুম। নীলমই ছিল আমার কাছে একমাত্র নারী যাকে আমি বিনা পাপে স্পর্শ করতে পারতুম।’

‘মানে?’

মহানাম হাসলেন, বললেন—‘আমার জন্মবৃত্তান্তও তো পুপুর মতোই খানিকটা। পুপু বাবা-মা পেয়েছে। আমি নামগোত্রহীন। যাঁর স্নেহ ও সম্পত্তি পেয়েছি সেই ডকটর কস্তুরী মিত্র আমার আপন মাসিমা নন। হাসপাতালে পরিত্যক্ত শিশু মানুষ করেছিলেন। অল্প বয়সের চোখে যে কোনও মেয়েকে ভালো লাগলেই আমার মনে হত আমার সেই কুমারী মা-ই যদি একদিন বিবাহিত হয়ে এর জন্ম দিয়ে থাকেন, বা সেই বাবা; তাহলে এ তো আমার বোনই হবে রক্তের সম্পর্কে!’

‘নীলমকে দেখে সে কথা মনে হত না?’

‘উহুঁ! নীলম ছিল কস্তুরী মিত্রর বন্ধু সাবিত্রী যোশীর মেয়ে। সাবিত্রী গুজরাতি বিয়ে করেছিলেন। নীলমের পরিচয় পূর্বাপর আমার জানা। আর কস্তুরী মিত্র আমায় বলে যান আমার মা এক সম্পূর্ণ অপরিচিত বাঙালি মহিলা।’

‘কি রকম বয়স ছিল তাঁর, জানেন?’

‘নেহাত কাঁচা মেয়ে নয়।’

এষা বলল—‘আমার মা মাত্র ষোল বছর বয়সে আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। সীজার-বেবি ছিলাম। মায়াদেবীর মতোই বিদীর্ণ হয়ে যেতে হয়েছিল আমার মাকে, আমার জন্ম দিতে। আমি কোনক্রমেই আপনার বোন হতে পারি না মহানামদা।’

‘তোমার বাবা?’

‘আপনি যে কুলুজি নিতে শুরু করলেন! আমার বাবা তিন চার মাস নিখুঁত বৈধব্য পালন করেন। মাছ-মাংস খেতেন না। সাদা থান কাপড় পরতেন। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলতেন—“আমি মরে গেলে তো তোমরা তাকে দিয়ে এই সবই পালন করাতে। তাই করছি।”

‘তারপর?’

‘তারপর তিনি আর সহ্য করতে না পেরে ইচ্ছামৃত্যু বরণ করলেন। আর আমাকে মানুষ করল পরিবার।’

‘তার মানে তুমিও একটি নিটোল ভালোবাসারই সৃষ্টি? এবং তোমার মা ষোল বছর বয়সে, পুরোপুরি বিবাহযোগ্যা নারী হবার আগেই তোমার জন্ম? দ্রৌপদীর মতো, সীতার মতো তুমিও একরকম সোঁদা মাটির থেকে উঠে এসেছ?’ মহানাম সোজা হয়ে বসলেন—‘অথচ অরিত্র সেই ইম্যাকুলেটকে ফিরিয়ে দিল?’

‘অরিত্রর বোধহয় খুব দোষ নেই’—এষা আস্তে আস্তে বলল।

‘বলো কি?’

‘আমি এখন বুঝতে পারি। অরিত্র এমন পুরুষ যে তার আকাশে দ্বিতীয় সূর্য সইতে পারে না। সে-ই এক এবং অদ্বিতীয়। আমি বুঝতে পারিনি, কিন্তু ওর অন্তরাত্মা ঠিকই বুঝতে পারছিল ওর সম্মোহন, ওর কথার সম্মোহন আমি খুব দ্রুত কাটিয়ে উঠছি। আপনার সঙ্গগুণে। আমি আস্তে আস্তে মিথ্যা কাটিয়ে সত্যের দিকে ঝুঁকছি। আপনার দিকে ঝুঁকছি। অসতো মা সদ্‌গময়।’

‘সে কি কথা?’

‘হ্যাঁ তাই-ই বোধহয় নীলমকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে ও একই সঙ্গে আপনাকে আর আমাকে চূর্ণ করতে চাইল।’

হাওয়ায় মহানামের গায়ের চাদর ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। এষা বলল, ‘সে সময়ে অরি আমাকে ত্যাগ করতে আমি বোধহয় আসলে প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়েছিলুম। আমার আত্মবিশ্বাস, পৃথিবীর ওপর বিশ্বাস, আমার অহঙ্কার সব চুরচুর হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আপনি যখন আমায় চিনতে পারলেন না, আমিই তো প্রথম আপনার কাছে আসি, আমার জীবন ভরা সমস্ত প্রশ্ন নিয়ে এবং তার সঠিক জবাব আশা করে, অথচ আমাকে বাদ দিয়ে যখন নীলমকে আপনি অন্তরতম বলে বেছে নিলেন তখন আমার যা হয়েছিল তা সেই পদাবলীর হাহাকার—শূন্য মন্দির মোর। যদিও তখন তার চরিত্র আমি বুঝতে পারিনি। শুধু আমার কাজকর্ম, পড়াশোনা, বেঁচে-থাকা, অরির স্তব-স্তুতি শোনা সবই কেমন বিস্বাদ হয়ে গিয়েছিল। কিছু ভালো লাগত না মহানামদা, কিচ্ছু না।’

মহানামকে ঘিরে এই উক্তি ক্রমশই জলে বৃত্তের মতো বড় আরও বড় হয়ে যেতে থাকল। শূন্য মন্দির মোর, শূন্য মন্দির মোর।

মহানাম আবিষ্ট স্বরে বললেন—‘তোমার মন্দির ভরব বলেই এতদিন নিজের মন্দির শূন্য রেখেছি। সেই চির-প্রথমাকে কে না চিনতে পারে, শুধু ইতিহাস আর পুরাণ মাঝখানে একটা ভয়ের নদী বওয়াতে থাকে বলেই তাকে চাওয়া হয় না। অমৃতের তৃষ্ণা তাই অন্য পানীয়ে মেটাতে হয়। এষা, তুমি আমার সেই সমুদ্র সম্ভব অমৃতকুম্ভ।’

সমুদ্রের উচ্ছ্বাসকে ছাপিয়ে যাচ্ছে মহানামের উচ্ছ্বাস। সমুদ্রের বিস্তারকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে মহানামের বিস্তার। সমুদ্রের চেয়েও তিনি উত্তুঙ্গ। বুঝতে পারছেন কি প্রাপ্তির সম্ভাবনায় তাঁর দেহ স্পন্দিত হচ্ছিল। কিন্তু তিনি দেখলেন এ প্রাপ্তি তাঁর প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে রয়েছে অনেক গুণ। অবাক হয়ে তিনি দেখলেন এ তো একেবারেই সেই প্রাক্সিতালিসের পীনাঙ্গী রম্ভোরু ভেনাস নয়। যার মুণ্ডুহীন দেহে জড় পাথরের সফীতি এবং ভাঁজগুলোই এমন প্রাণময়, বাস্তব কামনাময় যে সম্মোহিত দর্শক পাথর জেনেও তাকেই আলিঙ্গন করতে ছুটে যায়! দেখলেন আহা! এযে সান্দ্রো বত্তিচেল্লির ভেনাস, যার সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি ব্যঞ্জনাময় কবিতার আলোছায়া দিয়ে গড়া। সা এষা। সে-ই এই। এষা সা। এই সে-ই। ধরিত্রীর কামনা-সাগরে অশ্রু টলটল শুক্তির ওপর পা রেখে সে ঊর্ধ্বে মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাটিতে পা, আকাশে মুখ তাই একে কেউ বুঝতে পারে না। মিশরী কল্পনার মৃণ্ময় দেহ আর অগ্নিময় প্রাণ। শুধু মৃত্তিকা, কিংবা শুধু আগুন, শুধু মর্ত্য কিংবা শুধু আকাশ দিয়ে যে ওর প্রত্যাশা পূরণ হবার নয়। বিষাদের কি এক রহস্য তাই ক্ষৌম বস্ত্রের মতো আবৃত করে রেখেছে ওকে। কি অতলস্পর্শ ওর নিবেদন! কিছুতেই তিনি তার গভীরতা মাপতে পারেন না! কিছুতেই তিনি তার পারে পৌঁছতে পারেন না। ঢেউয়ের পরে ঢেউ এসে তাঁর সমস্ত চেনা ভেলাগুলি ভাসিয়ে নিয়ে গেল। ভাঙা হাল, ছেঁড়া পাল, তিনি বুঝতে পারেন এ এক অপরূপ নিরুদ্দেশ যাত্রা, তিনি জানেনই না কি আছে এর শেষে। সমস্ত উপকরণের প্রাচুর্য সত্ত্বেও তিনি কিছুতেই এই যাত্রার জন্য পর্যাপ্ত নন।

ঘুমিয়ে পড়েছেন মহানাম। ডানহাত লম্বা হয়ে পড়ে আছে। হাতের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছেন। মুখে নিবিড় মৃত্যু। মহা পরিনির্বাণ। আস্তে আস্তে তাঁর অন্য হাতটা সজল মমতায় নামিয়ে রেখে উঠে বসল এষা। বাইরে এসে বুঝতে পারল তার যাত্রার শেষ পর্বে ‘কনডর’ এখন প্রচণ্ড রকেট-গতি নিয়েছে। অযুত-নিযুত লহরীমালায় আকাশ তার মেঘ, নীহারিকা, নক্ষত্রমণ্ডল নিয়ে ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে যাচ্ছে। আরব সাগরের জল টগবগ করে ফুটছে দুপাশে। আকাশী আলোয় ডেক ডোবা। যেন তার ওপর দিয়ে জলস্রোত চলেছে। ভেসে আছে শুধু সাগর ভাসা কাষ্ঠখণ্ডের মতো গুটিকয় চেয়ার। ভেসে চলে যাচ্ছে, আবার ভেসে চলে আসছে।

রেলিঙের ওপর দুই হাত রেখে সে সমুদ্র আর আকাশকে বলল, ‘আমার এই ঐশ্বর্য তবে আমি কাকে দেবো? দশ হাতে দান করলেও এ যে শেষ হবার নয়। আমি কি তবে চিরকাল এমনই উদ্বৃত্ত থেকে যাবো? চিরটাকাল? এ কেমন নিষ্ঠুর নিয়তি?’

ঠিক সেই সময়ে, যখন অসম্পূর্ণতার তীব্র দুঃখে তার নামহীন অভীপ্সাকে সে অপাবৃত করছিল। তখন অন্ধকার ‘কনডর’ এর ডেকে পেছন থেকে কে যেন তাকে হাওয়ার হাতে ছুঁয়ে, মন্দ্র স্বরে ডাক দিয়ে উঠল।

এষার গায়ে কাঁটা দিয়েছে। তার ভেতরের যবনিকা কাঁপছে। সমস্ত অবরোধ খসে পড়তে চাইছে। পেছন ফিরে তাকে দেখতে চাইলেই দেখার দুঃসহ আনন্দে সে বুঝি জ্বলে যাবে। দু হাত মুঠো করে সে প্রাণপণে তার বাইরে-বেরিয়ে আসতে চাওয়া হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, রক্তবহা নালীগুলোকে সামলায়। তারপর ফিরে তাকায়। কেউ নেই। শূন্য। মধ্যরাতের ডেক একেবারে শূন্য। কিন্তু সে নিশ্চিত যে কেউ এসেছিল। তার পরিচিত কেউ নয়। অথচ যেন বহুদিনের চেনা। একটা অস্পষ্ট আকার, পোশাকের অস্পষ্ট রঙ, গাঢ় একটা পুরুষালি সুগন্ধ। হাওয়ার চেয়েও দ্রুতবেগে সে কি চলে গেছে?

অস্থির হয়ে সে নেমে গেল। আপার ডেকের যাত্রীরা তখন প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় চাদর, কম্বল, যে যা পেয়েছে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে জাহাজের বেগে দুলছে। চতুর্দিকে ঘুম, শুধু ঘুম। সারি সারি পুরুষ, নারী, শিশু ঘুমিয়ে কাদা হয়ে আছে। কয়েকজন যুবক চাদর টাঙিয়ে খানিকটা আড়াল করে নিয়ে তাস খেলবার চেষ্টা করছিল বোধহয়। তাসের প্যাকেট মাঝখানে রেখে তারাও তখন ঘুমিয়ে। জাহাজের কোনও কর্মী, পোশাক পরা। পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। সে ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করল—‘আচ্ছা, এইমাত্র ওপর থেকে কাউকে নেমে আসতে দেখেছেন!’

‘একজনকে দেখলাম যেন, তিনি তো নিচে নেমে গেলেন।’

‘নিচে?’—নিচে যাওয়া খুব সহজ নয়। প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা মানুষ দিয়ে মোড়া। তার ওপর এই সাঙ্ঘাতিক হাওয়া। কিন্তু তাকে তো যেতেই হবে। তার মুখোমুখি হতেই হবে। লোয়ার ডেকে ভিড় আরও বেশি। যদিও হাওয়ার দাপট কম। প্রায় জনে জনে খুঁজে খুঁজে দেখছে এষা। কুরুক্ষেত্র মহাসমরের পর মৃত বীরদের বিধবারা যেমন তাঁদের স্বামীদের শবদেহ খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। কিন্তু এষা জানে সে মৃত নয়, প্রচণ্ড রকম জীবন্ত, সে তাকে এমন এক রোমাঞ্চ দিয়ে গেছে যা এখনও তার প্রতি রোমকূপে স্পন্দমান। সে এ-ও জানে, খুঁজে দেখছে বটে। তবে এমন তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখবারও দরকার নেই, কারণ তার সমীপবর্তী হলেই তাকে তড়িৎপৃষ্ট হতে হবে। তাই সে আবার আপার ডেক, এবং তারপর আরও সিঁড়ি ভেঙে নিজেদের কেবিনের সম্মুখবর্তী ডেকে উঠে এলো।

তখন রাত পাতলা হয়ে এসেছে। আকাশে বিভিন্ন আকৃতির মেঘ চেনা যেতে আরম্ভ করেছে। রাতের হাওয়া যেন একটু একটু করে নিজেকে সংবরণ করে নিচ্ছে। আর একটু পরেই ডাঙায় ভোরের পাখিরা কলস্বনে জাগবে। কেবিনের দরজা খুলে বেরিয়ে এসে মহানাম দেখলেন বিস্রস্ত, বিনিদ্র এষা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর দিকে পেছন ফিরে। মহানাম কাছে গিয়ে দেখলেন তার সমস্ত মুখ চোখের জলে ভাসছে। ডাকলেন— ‘এষা, এষা, একি তুমি ঘুমোওনি?’

এষা মুখ ফিরিয়ে তাকাল, বলল—‘কে যেন আমাকে হরষিত করে দিয়ে চলে গেছে।’

‘সে কি? কে?’ মহানাম অবাক হয়ে বললেন।

‘জানি না। সারা রাত খুঁজেছি। নিচে, আরও নিচে। এই দ্যাখো এখনও আমার গায়ে কাঁটা ফুটে আছে।’

মহানাম খুব মন দিয়ে শুনছিলেন। তখন রাত ভেঙে ভেঙে ভোর হচ্ছে। আকাশের রঙ কালোও নয়, পুরোপুরি নীলও নয়। বর্ণহীন, দ্যুতিময়। সেইদিকে তাকিয়ে তিনি বললেন—‘আর কেন খুঁজবে এষা! বুঝতে পারছো না? পেয়েছ তো! পেয়েই গেছো! সে এবার থেকে তোমার রক্তে রক্তেই বইবে, গাইবে। তোমার সমস্ত নিবেদন নিঃশেষে নিতে পারবে এবং আবার সহস্র গুণ রোমাঞ্চে ফিরিয়ে দেবে। এষা, তীর্থযাত্রা কখনও ব্যর্থ হয়?’

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20
Pages ( 20 of 20 ): « পূর্ববর্তী1 ... 1819 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress