পঞ্চম পুরুষ (Pancham Purus) : 19
ভোঁ দিয়ে দিয়েছে স্টীমার। এবার ‘কনডর’ তার অতিকায় পাখা মেলে আরব সাগরের দীর্ঘ আকাশে উড়বে। ডেকের রেলিং ধরে সারি সারি পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছে, যদিও পুতুল নয়— সীমা, অরিত্র, মহানাম, বিক্রম, এষা।
নীলম কেন এলো না? অত অনুরোধ উপরোধ? সবাই মিলে অত ডাকাডাকির পরও কেন অমন ফেলে আসা তীরে সুদূর, দুর্ভেদ্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। স্টীমারের পেছনে কলকল্লোলে সাদা হয়ে যাচ্ছে নীল জল। প্রপাতের মতো ফেনিল। ঘূর্ণিপাকের মতো ভয়াল। জলের দুই হাতে যেন কালের মন্দিরা বাজছে। নীলম কেন এলো না? এষা ভীষণ ভয় পাচ্ছে। শুধুই কি পুপুর জন্য? বিক্রমের বাড়িতে পুপু সীমার ছেলে টিটোর চেয়েও স্বচ্ছন্দ। টিটো আসে বছরে একবার, পুপু যতবার ইচ্ছে, যতদিন খুশি। বাবা মা ছাড়াই। অনেক সময়ে বন্ধু বান্ধব নিয়ে। অথচ নীলম আসতে চাইল না। যেন পুপুকে বুকে নিয়ে ও অরিত্রকে জন্মের মতো টা টা করে দিল। নীলম কি অরিকে একেবারেই ত্যাগ করল? লড়াই করার কথা ছিল, বঞ্চিত করে বাঁচাবার কথা ছিল, পরিত্যাগের কথা তো ওঠেনি! অরি বুঝতে পারছে না। কী ভয়ানক! এষা বুঝতে পারছে অথচ অরি এমন উন্মাদ হয়ে আছে যে ওর পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে ও টের পাচ্ছে না। অথই জলে হাবুডুবু খাচ্ছে। ও টের পাচ্ছে না। নীলম, নীলম, তুমি অনেকের প্রতি অনেক নিষ্ঠুরতা করেছ, প্রত্যক্ষভাবে, পরোক্ষভাবে। আর করো না। তুমি অন্ধ বিচারদেবীর দাঁড়িপাল্লা হাতে নেবে না কিছুতেই। কিছুতেই তুমি চণ্ডিকা হতে পাবে না! হয়ো না। এষা যেন শূন্য আকাশে দাঁড়ানো উদাসীন নীলমের পায়ে মাথা কুটতে লাগল। এবং কনডর তার রাজকীয় ভঙ্গিতে উড়েই চলল, উড়েই চলল। তার পক্ষপুটে, চঞ্চুপুটে কিছু মানুষ। তারা একটা ঘূর্ণ্যমান চক্রকে কিছুতেই থামাতে পারছে না। একটা প্রচণ্ড লাফ লাফিয়ে সেই চক্রের বাইরে আসতেও পারছে না। কর্মসূত্রে গ্রথিত হয়ে যাচ্ছে ওই অমোঘ চক্রের গায়ে গায়ে। জন্মান্তরের কোনও কর্মের দায়ে নয়। এই জন্মেরই। মাত্র এই জন্মেরই। এবং প্রত্যেকে, প্রায় প্রত্যেকে, চলোর্মি চঞ্চল সেই সাগরের নীলে নিঃশব্দে মেশাচ্ছে নিজের নিজের ব্যথার নীল। কেউ দেখছে না কত গাঢ় হয়ে যাচ্ছে তাতে আরব সাগর। এক তটরেখা থেকে আর এক তটরেখা পর্যন্ত নীল রক্তের সেই স্রোত ছড়িয়ে পড়ছে। তার ধারায় বৈদ্যুতিক টান। যে কেউ পড়লে তাকে চোরা টানে টেনে নেবে এমনি শক্তিশালী সেই ব্যথার বাসনার আগ্নেয় নীলধারা।
কমলা রঙের করুণ হাত বাড়িয়ে সীমা বলল—‘ওই দ্যাখো এষাদি উড়ুক্কু মাছ। ওই যে আরেকটা, আরেকটা।’
অরি চোখের কোণ দিয়ে রক্তাভ দৃষ্টি মেলে দেখল— ছোঁ মেরে জল ছুঁয়ে মাছ মুখে তুলে নিয়ে উড়ে চলে গেল গাঙচিল। তার ভেতরটা ছাঁৎ করে উঠল; কেমন শিউরে উঠল শরীর। দূর থেকে সে এষার দিকে তাকাল। এষা এদিকে তাকাচ্ছে না। অত মগ্ন হয়ে, নীল হয়ে এষা কি দেখছে, বলো তো! এষা কি আগে কখনও সমুদ্র দেখে নি, জল দেখে নি? এষা কি কখনও নীল রঙ, সবুজ রঙ, সাদা রঙ দেখেনি! না তাকে আর দেখবে না বলেই ওই সব দেখছে। সমর্পিতচক্ষু হয়ে দেখছে!
গাঢ় হয়ে উঠছে ক্রমশ দিনের রং। সমুদ্রের দিকে তাকানো যায় না। ধারাল সাদা ছুরি চমকাচ্ছে তার ঢেউয়ে, বন্দরের কাছ থেকে অনেক দূরে এখানে ঢেউ কম, দোলা কম অপেক্ষাকৃত, তবু কী রকম এক তীব্র সমুদ্র।
ডাইনিং হলে টোম্যাটো সুপ আর ড্রাই টোস্ট নিয়ে বসেছে এষা। অরিত্রর গা গুলোচ্ছে, সীমা তার ঝাঁপি খুলে বার করেছে ভালো ভালো খাবার দাবার। বিক্রম খাচ্ছে, মহানাম খাচ্ছেন। সীমা দেখছে, খাচ্ছে, এষা মন দিয়ে খাচ্ছে। অরিত্র সামনে বসে, নাড়ছে চাড়ছে। এত মন দিয়ে এষা কি খাচ্ছে? এষা কি আগে কখনও টোম্যাটো সুপ দিয়ে ড্রাই টোস্ট খায়নি? না তাকে দেখবে না, আর কোন দিন কিছুতেই দেখবে না বলেই এভাবে খাচ্ছে, এ রকম সমর্পিতপ্রাণ হয়ে খাচ্ছে!
আলাপ করছে এষা ও সীমা, দোতলার ডেকে এক পরিবারের সঙ্গে। জমে গেছে খুব। পাঞ্জাবী কি না বুঝতে পারা যাচ্ছে না। দুটো গাল ফোলা বাচ্চা, মেয়েটি বোধহয় সীমারই বয়সী। ওই রকম চুড়িদার কুর্তা পরা, সীমা কথা বলছে, এষা হাসছে, উঠে চলে গেল, চলে যাচ্ছে জাহাজের পেছন দিকে, যদি অরি জাহাজের পেছন দিকে যায় তো এষা কি করবে? নির্ঘাত সে সামনের দিকে চলে আসবে, অরি ওপরে এলে সে নিচে, অরি নিচে নামলে সে ওপরে, অনেক ওপরে, অনেক দূরে, মাঝখানের ব্যবধান ক্রমেই চওড়া হয়ে যাচ্ছে। পুনা স্টেশন থেকে সেই ঠাণ্ডা মিষ্টি রাতে এষাকে নিয়ে প্রিয়লকরনগর ফেরা কত দূরে পড়ে রইল, কল্যাণ স্টেশন থেকে সিদ্ধেশ্বর এক্সপ্রেসে পুনা, অরি দাঁড়িয়ে, এষা বসে, কোনমতে। মাঝখানে অনেক যাত্রী। তবু সে এমন ব্যবধান নয়। এষার গাল দেখা যাচ্ছিল, কখনও কপাল, মুখের আধখানা, তবু সে-ই সম্পূর্ণ এষা। অথচ এখন তার গোটা শরীর গোলাপী শাড়িতে মুড়ে এষা বিরামহীন ওঠানামা করছে, বসছে, দাঁড়াচ্ছে তার চোখের ওপর, কিন্তু এ টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া শতধা এষা। এষার মুখে অরির জন্য কোনও হাসি নেই, এষার চোখে অরির জন্য কোনও দৃষ্টি নেই। অরির এক চোখ বলছে বিচ্ছেদ পূর্ণ হয়েছে। আর এক চোখ বলছে— অসম্ভব, এ অসম্ভব।
ডেক চেয়ারে হেলান দিয়ে মহানাম পাইপ ধরিয়েছেন। মিঠে মিঠে গন্ধটা। সারা দুপুর ‘অবদানশতক’ নিয়ে পড়ে ছিলেন। সন্ধে লাগতে বই মুড়ে পাইপ ধরিয়েছেন। —অরিত্রকে আসতে দেখে বললেন, ‘অরিত্র, বিক্রম আমার তামাকটা একটু টেস্ট করে দেখবে নাকি? বাক্সে ডজন খানেক পাইপ আছে। বার করব?’
বিক্রম বলল— ‘গন্ধটা তো কড়া লাগছে না দাদা। আমার ব্র্যান্ড চারমিনার। মাঝে মাঝে ক্যাপস্টান। ওসব ডানহিল টিলও আমার চলে না। আচ্ছা দাদা। একটা কথা বলব? একটু স্কচ হোক না কেন, ওয়াইন দিয়ে রাঁধা গোয়ানীজ সুরমাই, আর চিকেন লিভার ভাজার সঙ্গে। আমি ব্যবস্থা করি।’
মহানাম বললেন— ‘হয়ে যাক। কি বলো অরিত্র?’
অরিত্রর এখন ছাতি ফেটে যাচ্ছে, বুক শুকনো মরুভূমি। একখানি মেঘ ধার দিতে পারো গোবি সাহারার বুকে? সে বলল— ‘হোক। তবে দেখো বেশি মাতলামি করো না।’
বিক্রম মহোৎসাহে নিজেদের কেবিনের দিকে চলে গেল। সীমার ঝাঁপি বার করে আনল। তারই ভেতর পোর্টেব্ল্ আইস-বক্সে তার পানীয়। হট বক্সে অনুপান, সহপান।
‘চীয়ার্স, চীয়ার্স!’ যথেষ্ট গ্লাস খালি হচ্ছে। সন্ধ্যে কাটছে। রাত হচ্ছে। চীয়ার্স, চীয়ার্স। উর্দিপরা জাহাজ কর্মী এদিক থেকে ওদিকে যায়। বিস্কুট, কফি, বাদাম-চাক্তি, কাজু, ঠাণ্ডা-অলা ওপর নিচ করে হেঁকে হেঁকে। চীয়ার্স, চীয়ার্স। বিক্রম বোতলটাকে চুমু খেয়ে বলল—‘কি চৌধুরীদা মাতলামি করছি নাকি!’ —কথা সামান্য এড়িয়ে গেছে। অরিত্রকে বড্ড খেতে হয়। খুব ধীরগতিতে খাওয়া অভ্যাস আছে। এখন সে উজ্জীবিত কিন্তু মত্ত নয়। বলল— ‘টেন হাই বল্স্ হল কি?’ এখন সবে কথা এড়াচ্ছে। এর পর জড়াবে। হাত পা সুদ্ধু জড়িয়ে যাবে, তারপরে বক বক করবে, অসহ্য বকবক, তারপরে⋯?
বিক্রম বলল—‘তাপ্পর শালা মরে যাবো। ধপাস করে আছড়ে পড়ব আর পা ধরে টানতে টানতে যমের চ্যালারা আমায় নিয়ে যাবে। রায়দা অ রায়দা। আপনি আমায় বাঁচাতে পারেন না? এ কি মেয়েরা কেউ খাচ্ছে না যে! খায় না, না কি! আমার বউ খায়, আপনাদের সামনে নজ্জা পাচ্ছে, খেলে সীমা যা জিনিস হয় না, চাবুক! চাবুক! একেবারে মুচমুচে কড়ানে চিংড়ি ভাজা। কুড়মুড়ে আচ্ছা রায়দা আপনি ব্যাচেলর হতে পারেন, সেলিবেট তো নন।’
মহানাম উচ্চহাস্যে বললেন, ‘কি মনের প্রাণের কথা বলবে মনে হচ্ছে বলেই ফ্যালো!’
‘আরে দাদা, তা নয় তা নয়। আপনাকে আমার বড্ড ভালো লেগে গেছে। এই চৌধুরীদার মতো ভান ভড়ং নেই। আচ্ছা দাদা, আপনি কখনও সাঁওতালনী টেস্ট করেছেন!’
হো হো করে হেসে উঠলেন মহানাম— ‘এই জিজ্ঞাসাটা তোমার ভেতরে অনেকদিন ধরেই ঘুরপাক খাচ্ছিল, না? আজ সুরার মুখে বলে ফেললে।’
—‘সুরা নয় দাদা, মদিরা মদিরা। আহা হাসবেন না, হাসবেন না। হাসির কথা নয়। সাঁওতালনী টপ। সভ্য মেয়েরা কক্ষণো সাঁওতালনীদের মতো হয় না। নো, নো, নেভার, নেভার। চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি, লড়ে যান। প্রুভ করুন, আমি, আমি বিক্রম শীল সব চিজ টেস্ট করেছি, আমি বলছি আদিবাসী সবসে বঢ়িয়া চিজ। এই তো সব ভাবীরা ভাবিনীরা রয়েছেন, ওঁদের ডেকে জিজ্ঞেস করুন না। এই সীমা হেই!’
অরিত্র ঠাণ্ডা হাতে একটা চড় কষাল বিক্রমের গালে। মহানাম বললেন—‘বোতলের বাকিটা ওর মাথায় ঢালো।’
অরিত্র বলল- ‘ঢালি? সত্যিই ঢালব? আমার চেয়ে খুশিতে আর কেউ ঢালবে না।’
মহানাম ডাকলেন—‘এই কফি, এই কফি, এই!’
বিক্রম হেঁচকি তুলছে ক্রমাগত। মহানাম গেলাস উল্টে স্কচ ফেলে দিয়ে তাতে কফি ঢাললেন ভর্তি করে, বললেন— ‘বিক্রম শীল, খেয়ে ফ্যালো তো বাবা এটা লক্ষ্মী ছেলের মতো।’
সীমা, এষা নিচে ছিল সারাক্ষণ, এখন ওপরে উঠে আসছে দেখা গেল। বিক্রমের অবস্থা দেখে সীমা তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বলল— ‘ইস্স্স্, মাটি করলে। তুমি আবার এতো খেয়েছ! অরিদা, ধরুন তো ওদিকটা, কেবিনে তুলে দিই, নইলে এমন যা-তা করবে!’
মহানাম বললেন— ‘আমি আর অরি তুলে দিচ্ছি, তুমি যাও।’
এষা এদিকে তাকাচ্ছেই না। সে যেন স্বপ্নে হাঁটছে। যেন কেউ নেই, আর কেই নেই। দক্ষিণে, বাঁয়ে, সামনে, পেছনে কোত্থাও কেউ নেই আর এই জলযানে। যত রাত বাড়ছে, তত উথাল-পাতাল হাওয়া দিচ্ছে। বসে থাকা যাচ্ছে না আর হাওয়ায়। এ ডেক ক্রমশ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। কেবিন যাত্রীরা সব যে যার কেবিনে ঢুকে গেছে। হাওয়ায় দরজা খোলা যাচ্ছে না। অরিত্র অনিচ্ছাসত্ত্বেও যতটা খেয়েছে ঘুম এসে গেছে তার। ঢোলানো চামরের মতো নেতিয়ে পড়েছে বিছানায়। ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যেতে যেতে স্বপ্নের হাত দিয়ে সে কিছু পেতে চাইছে। স্বপ্ন ফরমাশী হয় না কখনও। বিবেকানন্দ কি শ্রীঅরবিন্দকে স্বপ্নে দেখতে চেয়ে তুমি অনায়াসেই ড্র্যাগন দেখতে পারো। তাই অরিত্র সুখস্বপ্ন না দেখে, ভয়ের স্বপ্ন দেখছে। অ্যাকসিডেন্ট! স্থলে আর নয় জলে। তার ব্যক্তিগত জাহাজখানা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে, দু পাশ থেকে খুলে পড়ছে কাঠামো। খসে খসে পড়ছে আগ-গলুই, পাছ-গলুই, পাটাতন।
দরজায় কি কেউ ঘা দিল! হাওয়া? অরিত্র ভীষণভাবে জেগে উঠল। এষা এষা, আমাকে এতো দুঃখ দিয়ে তুমি কি শেষ পর্যন্ত তাহলে এলে? এলে? অরিত্র নিমীলিত চোখে দরজা খুলে দিল—‘এ কি সীমাচল?’ সীমা ভেতরে ঢুকতেই হাওয়া ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিল। সীমার দু চোখে জ্বলন্ত অঙ্গার।
বলল—‘বিক্রম কই? আমার বিক্রম? কোথায় ফেলে এসেছেন তাকে?’
‘বিক্রম? কি বলছো সীমা? আমি কি করে জানব? আমি ফেলে দিয়ে এসেছি?’
‘না তো কি? কত যত্ন করে শুইয়ে রেখে এলাম। এখন যেই একটু ঘুমিয়ে পড়েছি, অমনি দেখছি কোথায় চলে গেছে। অরিদা, যে খালি পতিত হবার জন্যেই তৈরি হয়ে আছে তাকে একদিক থেকে আপনার রূপসী স্ত্রী আর একদিক থেকে ওই সেক্সি বান্ধবী লেলিয়ে দিয়েই তো যথেষ্ট কাণ্ডজ্ঞানহীন মাতাল করে দিয়েছিলেন। আবারও কি মদের দরকার ছিল? একে ফেলে দেওয়া ছাড়া আর কি বলে! এখন ও আর কাউকে খুঁজতে চলে গেছে। আর কাউকে। এখন ও আর আমাকে চায় না। চায় না। চায় না!’
সীমা অরিত্রর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল—‘আমার তবে কি হবে বলুন? কি হবে?’
তখন অরিত্র স্তম্ভের মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কেবিনের আলো নিভিয়ে দিয়ে হিংস্র হৃদয়ে ভাবল— ঠিকই তো। এই-ই বা নয় কেন? অন্ধকারের শরীরে তো সমস্ত নারীই এক! সেই একই গাছ। একই ফল, ফুল, সেই একই শিকড় এবং একই কোটর। আসল হচ্ছে বুভুক্ষা। চাওয়া, এই তীব্রভাবে সমস্ত জীবন দিয়ে চাওয়া। সুতরাং সেই ভয়ানক অন্ধকারে সীমার শরীরের সব কমলা রং স্খলিত স্তূপীকৃত হতে লাগল, সুতরাং সেই হিমেল অন্ধকারে সীমার হাত ছিঁড়ে গেল, পা ছিঁড়ে গেল, বুক ছিঁড়ে গেল। সমস্ত পট ভর্তি করে ছিন্ন ভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে পিকাসো গৃহযুদ্ধের গুয়ের্নিকা খানা কাঁদতে কাঁদতে জ্বলতে জ্বলতে আঁকলেন, আঁকলেন সেই মুমূর্ষু অশ্বীর অন্তিম হ্রেষা সমেত। সীমাকে আকণ্ঠ পান করতে করতে অরিত্র এষাকেই পান করতে লাগল। মরুভূমির তৃষ্ণায় পান করতে লাগল। এষার পাত্রে রাখে আর পান করে, এষার রঙে চোবায় আর আঁকে। সীমার শরীরে অরিত্র প্রাণপণে এষার আবহমান প্রতিরোধের সঙ্গে যুঝতে লাগল। তারপর হঠাৎ তার গভীরের গভীরে যেই সে সীমার স্বতন্ত্র মানব-অস্তিত্বের তিক্ত-কটু কষায় স্বাদ অনুভব করতে পারল অমনি তার অন্তরাত্মা চিৎকার করে উঠল—এষা নয়, এষা নেই, এষা মায়া, এষা মরীচিকা! তার শরীর হাহাকারে কাঁপতে লাগল। সে সীমাকে অসমাপ্ত ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অন্ধের মতো টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। সীমা কান্নাভরা গলায় বলল— ‘কি হল? অরিদা, কি হল?’ অরিত্রর মুখ দুমড়ে ভেঙে যাচ্ছে, অনন্ত প্রিয়জন হারানোর শোকে তার মুখ প্লাবিত। শোকে, পরাজয়ে, অন্তর্দাহে। অরিত্র আর নিজের ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। গোঙানির স্বরে বলল—
‘আই ক্রায়েড ফর ম্যাডার মিউজিক অ্যান্ড ফর স্ট্রংগার ওয়াইন
বাট হোয়েন দা ফীস্ট ইজ ফিনিশ্ড্ অ্যান্ড দা ল্যাম্পস্ এক্স্পায়ার
দেন ফলস দাই শ্যাডো সায়নারা, দা নাইট ইজ দাইন
অ্যান্ড আই অ্যাম ডেসোলেট অ্যান্ড সিক অফ অ্যান ওল্ড প্যাশন
ইয়া, হাংরি ফর দা লিপ্স অফ মাই ডিজায়ার
আই হ্যাভ বীন ফেথফুল টু দী সায়নারা, ইন মাই ফ্যাশন’