পঞ্চম পুরুষ (Pancham Purus) : 15
অজন্তা দর্শনের প্রতিক্রিয়া এক-এক জনের ওপর এক-একরকম হল। বিক্রমকে সারাটা সময় কেউ কোনরকম মনোযোগ দেয়নি। এমন কি সীমাও না। সীমা হঠাৎ কোথা থেকে যেন নতুন শক্তি সঞ্চয় করে বিক্রমের পথের সামনে একটা চ্যালেঞ্জের মতো এসে দাঁড়িয়েছে। বিক্রম এটা এভাবে ভেবে-চিন্তে বোঝেনি। কিন্তু ইলোরা-ভ্রমণের সময় থেকেই একটা সীমা-সংক্রান্ত অস্বস্তি তার সমস্ত অস্তিত্বে ছড়িয়ে পড়ছে। সীমা যেন একটা কেউ, একটা রীতিমতো ইতিবাচক চরিত্রসম্পন্ন মানুষ। যে কাজলপরা, ছিঁচকাঁদুনে সীমাকে চুঁচড়োর বাড়ি থেকে সংগ্রহ করে সে পালিয়ে এসেছিল পনের বছর আগে, এই পনের বছর ধরে যার ঠোঁট ফোলানো ছিঁচকাঁদুনেগিরি সিধে করতে তার অনেক শক্তিই অপচয়িত হয়েছে, এবং যাকে এখন সে তার থানের বাড়ির সিঁড়ির ল্যাণ্ডিং-এ একটা ব্রোঞ্জের পুতুলের বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না, সেই সীমা তাকে খুব দক্ষ ভাষা ও ভঙ্গিতে ধমকাচ্ছে, ধমকের মতো শোনাচ্ছে না সেগুলো, সীমা কথা বলছে, এষা সীমার দিকে ফিরে, চোখে বিস্ময়, মহানাম, ডক্টর মহানাম রায় সীমার সঙ্গে কথা বলছেন যেন সমানে সমানে, যেন সীমা কোনও মঞ্চে তাঁর সহবক্তা। অরিত্র চৌধুরী সীমার কাঁধে হাত রেখেছে যেন খুব ভঙ্গুর, খুব মূল্যবান সেই কাঁধ। অজন্তার প্যানেলের মতো এইরকম একটা চিত্ৰপরম্পরা বিক্রমের চোখের সামনে জীবন্ত ফ্রেসকো হয়ে ভাসছে। সে এই ছবির চিত্রকর নয়, এমন কি দর্শক হিসেবেও তাকে কোনও মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না। ছবিগুলি পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াশীল। বিক্রমের দৃষ্টির পাঁচশ পাওয়ারের বাতিটা তাদের ওপর কোনও কাজ করছে না। অন্য কোনও আলোয় ছবিগুলো পরিচিতি পাচ্ছে। বিক্রম এই ফ্রেসকোর মানে বুঝতে পারছে না। অজন্তার ফ্রেসকোগুলো যেমন নগ্ন, এই জীবন্ত ফ্রেসকোর ফিগারগুলো আবার বস্ত্রের ওপর আরও কোনও সূক্ষ্ম স্বচ্ছ মসলিন বস্ত্রে আচ্ছাদিত। যার মধ্যে দিয়ে চেনাকে আধো-চেনা, আধো-চেনাকে একেবারে অচেনা বলে মনে হচ্ছে। সীমাকে তেমন ভালো করে চিনতে পারছে না সে। অরিত্র চৌধুরীকে তো একেবারে অচেনা লাগছে।
একমাত্র একটি গুহায় বিক্রম অন্যের স্বীকৃতির প্রেক্ষিতে নিজেকে খুঁজে পাবার চূড়ান্ত সুযোগ পেয়েছিল। গাইড বলল—‘এই গুহাটা সম্ভবত লেকচার হল হিসেবে ব্যবহার হত। মাঝখানে দাঁড়িয়ে কেউ একজন কিছু বলুন, বা গান করুন, দেখুন কিভাবে মাইক্রোফোন-বোর্ন গানের মতো শোনা যায়, একোসমেত।
এষা বলল—‘বিক্রমবাবু, আপনি যান।’
বিক্রম আজকাল গান-টান ভুলে যাচ্ছে। কতকগুলো বহুবার সাধা গান ছাড়া আর বিশেষ কিছুই মনে থাকে না। ইচ্ছে করে গায়ের জ্বালা মেটাতে সে মাঝখানে দাঁড়িয়ে স্বরচিত প্যারডি ধরল—
হায় জনানা তুমি গুরুর আড়ালে থাকো জরু হয়ে
লঙ্গুরের হাতে ঝোলো আঙ্গুর হয়ে
এই সুখারুটির সাথে খট্টি মিট্ঠি চাটনি কেন বনো না।
হায় জনানা।
গুহার কোণে কোণে ছড়িয়ে গেল সেই গান। কি দারুণ জমাটি বৌদ্ধদের তৈরি সেই অডিটোরিয়াম। যেখানে একদিন সন্ন্যাসীগুলো নিশ্চয়ই হ্যান করো না ত্যান করো না বলে কাঁচা বয়সের শিক্ষানবিশ শ্রমণগুলোর কান ঝালাপালা করে দিত সেইখানে তার গলা এতদিনে রসসঞ্চার করতে পেরেছে ভেবে বিক্রম খুব আত্মপ্রসাদ অনুভব করছিল। এমন সময় সীমা বলল—‘আমিও একটা গাই, গাইব?’ গাইড বলল—‘নিশ্চয়ই! যান।’ সীমা গিয়ে দাঁড়ালো যেন সবাইকার মনোযোগের বৃত্তে, তারপর গাইল—
“সকল কলুষ তামসহর জয় হোক তব জয়
অমৃতবারি সিঞ্চন করো নিখিলভুবনময়
মহাশান্তি মহাক্ষেম, মহাপুণ্য মহাপ্রেম।’
গেয়ে হঠাৎ হাতজোড় করে নতজানু হয়ে বসে পড়ল সীমা, ভিন্ন স্কেলে উঁচু গলায় গাইল ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি, ধম্মং শরণং গচ্ছামি।”
একটি লম্বা দশাসই চেহারার, নিষ্পাপ মুখের মেমসাহেব বুকের ওপর ক্রস আঁকল, নীল চোখ ঊর্ধ্বে তুলে। জাপানী ছেলে দুটি নতজানু হয়ে বসল, হাতজোড় করে, নিচুগলায় নিজেদের ভাষার কি মন্ত্র উচ্চারণ করল ওরাই জানে। গাইড জিজ্ঞেস করল—‘আর কেউ গাইবেন?’ বিক্রমের প্রথম গানটা গেয়ে মুড এসে গিয়েছিল সে একটা গজল গাইতে পারত, কিন্তু সমস্ত আবহাওয়াটাতে গঙ্গার জল ছিটিয়ে যেন স্যাঁতসেঁতে করে দিয়ে গেছে সীমা, তাই সে তার গান আর জমবে না বুঝে বিরস মুখে বাইরে চলে আসে।
এই বৌদ্ধ শ্রমণগুলো গুহার পর গুহা ভর্তি করে নুড এঁকে রেখেছে খালি। কোনও সন্দেহ নেই, প্রব্রজ্যা গ্রহণ করবার পর নির্জন গুহায় দিনের পর দিন নারীসঙ্গহীন কাটাতে কাটাতে লিবিডোর তাড়নায় এই সব চিত্রশিল্পের জন্ম। যেমন খাজুরাহো, যেমন কোনারক, যেমন জগন্নাথ-মন্দির। ওদের গুরুগুলো, অর্হৎ না ফর্হৎ তারাও এইসব ব্লু-ফিল্ম দেখে দিব্যি আহ্লাদে থাকতো। তাতে বিক্রমের বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। কিন্তু ব্লু ফিল্মকে ব্লু-ফিল্মই বল না বাছা! কে আপত্তি করছে! ধম্মের পোশাক পরিয়ে ধোঁকা দেবার চেষ্টা করলে যে গায়ে জ্বালা ধরে! বামাচারী তান্ত্রিকদের কারণবারি আর ভৈরবীচক্রের মতো আর কি!—তবে ছবিগুলোকে যথেষ্ট কামোদ্দীপক করতে পারেনি। খাজুরাহো চৌষট্টি যোগিনী দেখে যেমন ঘেমে নেয়ে যেতে হয়। এগুলো সেরকম নয়। কেমন ম্যাটমেটে, নিরামিষ নিরামিষ, কত্থক কি মোহিনীঅট্টম এর কাছে যেমন রবীন্দ্র-নৃত্য ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে!’ বেশ গরগরে মাটন দো পিঁয়াজা, মুর্গ মুসল্লম, নিদেনপক্ষে বীফ কাবাব না হলে বিক্রমের ঠিক জমে না। তার ওপর আর্ধেক রঙ উঠে গেছে, পলেস্তারা খসে গেছে, দিমাগ্ খারাপ না হলে কেউ এর জন্য গোটা একটা দিন নষ্ট করে?
বুদ্ধদেবের বিশালকায় মহাপরিনির্বাণের ভাস্কর্যটি নীলমকে অভিভূত করে ফেলেছে। দু পাশে দুই শালবৃক্ষ, পায়ের কাছে নতজানু শিষ্যদল, আনন্দর হাতে পরিত্যক্ত ভিক্ষাপাত্র। কুশীনগর। ছবির চেয়ে স্থাপত্য, স্থাপত্যের চেয়েও ভাস্কর্য যেন মুগ্ধ করেছে তাকে। যে নীলম একশটি সিঁড়ি অতিক্রম করে অজন্তা পাহাড়ে উঠেছিল, আর যে আবার একশ ধাপ ভেঙে নেমে এলো তারা যেন এক নয়। গুহাচৈত্যের অন্তরাল থেকে কে যেন গম্ভীর মধুর স্বরে নীলমকে লক্ষ্য করে বলছে ‘সম্মা-দিট্ঠ, সম্মা-সঙ্কপ্পো, সম্মা-বাচা, সম্মা-কম্মন্তো, সম্মা-আজীবো, সম্মা-বায়ামো, সম্মা-সতি, সম্মা-সমাধি⋯।’ একবার নয় বারবার।
সারনাথ। ধর্মচক্র মুদ্রায় আসীন সিদ্ধার্থ, সদ্য বুদ্ধত্ব লাভ করেছেন, বলছেন —হে পঞ্চ সন্ন্যাসী, এই বন্ধন দুঃখের মূল কারণ অবধান করো। কামনা-বাসনাই এ দুঃখের মূল। ইন্দ্রিয়জ সুখের কামনা, আত্মতৃপ্তির বাসনা। এ দুঃখের মূল উৎপাটনের উপায় কি? কামনা বাসনাকে নিঃশেষে পরিত্যাগ করাই এর মূলোচ্ছেদের প্রকৃত উপায়।
সত্যিই তো, সারাটা জীবন একটা কামনা থেকে আরেকটা বাসনায় ভ্রমণ ছাড়া আর কি করেছো তুমি? কী অশান্ত যৌবন কেটেছে, কী উত্তাল! কত শত মৃগয়ায় সমৃদ্ধ! না ক্লিন্ন! সেইসব নিবেদিত, কামাকীর্ণ মুখগুলো স্মরণে আনতেও এখন ভয় হয়! আড়াল থেকে কেউ লক্ষ্য রেখেছিলেন যাতে নীলমের যৌবন বিলাস তাকে সর্বনাশের পথে আর বেশি দূর এগিয়ে নিয়ে না যায়, তাই তিনি যা করবার করলেন। নীলম পুজো করে তার পর থেকেই। কিন্তু সে-ও এক কামনার পুজো ছাড়া আর কি? ভেতর থেকে একটা ক্ষতিপূরণের দাবী, কিংবা যা হারিয়েছে তা ফিরে পাওয়ার প্রার্থনা তার ফুল, ফল, এলাচদানা নিবেদনের মধ্যে কি অনুস্যূত হয়ে থাকে না! ওই পুজো সত্যি সত্যি পুজো নয়। একরকমের আত্মপ্রবঞ্চনা, লোক ঠকানোও। দেখো আমি কেমন পূজারিণী, দেবতাকে না দিয়ে জল খাই না। সত্যিকারের পূজা কাকে বলে অজন্তার দশটি গুহা পরিভ্রমণ করে নীলম বুঝতে পারছে। ছ’শ সাতশ বছর ধরে কত ভক্তের পূজা, আরতি, মন্ত্রপাঠ, সঙ্কল্প, ধ্যান, আত্মনিবেদন শিল্পসৃষ্টির ভাঁজে ভাঁজে রেখায় রেখায় প্রস্তরীভূত হয়ে আছে। তার তীব্র গভীরতা তেরশ বছর ধরে জীবন্ত হয়ে আছে—সম্মা-দিট্ঠ, সম্মা-সঙ্কপ্পো, সম্মা-বাচা। ওঁ নমো, বুদ্ধ দিবাকরায়, গোতম চন্দিমায়, শাক্যনন্দনায়, নমো নমঃ।
বুদ্ধদেব গৃহীদেরও বৌদ্ধ হবার অধিকার দিয়েছিলেন। অষ্টাঙ্গিক মার্গে চলবে তারা। বৌদ্ধ হওয়া না-হওয়াটা বড় কথা নয়। কোনও বিশেষ ধর্মে বাইরে থেকে নাড়া বেঁধে বসলে বা না বসলে কিছু যায় আসে না। কিন্তু সামনে ওই বিশাল মহাপরিনির্বাণ নিয়ে সেই একই সংসারে নীলম আর কি করে ফিরতে পারে? কি সঙ্কীর্ণ তার ঘর, কি অশুদ্ধ তার সজ্জা। কি ভীষণ বাসনাগন্ধ তার কোণে কোণে, সিগারেটের প্যাকেট, বিয়ারের বোতল, মাংস, পেঁয়াজ, রসুন, অতিথি পরচর্চা, সন্দেহ, ক্রোধ, ব্যভিচার। সেইখানে ওই বিরাট কিভাবে ঢুকবেন? দেহ না হয় তিনি সঙ্কুচিত করলেন, কিন্তু আত্মাকে সঙ্কুচিত করবেন কি ভাবে? নীলম মনে মনে বলল—এষা, তুমি আমার বাড়ি বেড়াতে এসে খুবই ভালো করলে। আমার চোখের ওপর একটা চকচকে পর্দা ছিল সেটা খসে পড়ে গেল। একেই বোধহয় বলে হিরন্ময়েণ পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম্। প্রত্যেকের নয়ন-সূর্যের সামনে এইরকম একটা মিথ্যা চাকচিক্যের আবরণ থাকে। চোখ চাইলেই সেটাকে দেখা যায়, মনে হয় আহা কি সুখে আছি। নির্বোধের স্বর্গে বাস করি আমরা। সত্য সেই পর্দা না খসলে তো দেখা যাবে না! এষা, অরিত্রকে আমি তোমায় দিলাম। একদিন তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলাম, খুব গর্ব, খুব আত্মপ্রসাদ, বিজয়বোধের সঙ্গে যে কলেজ স্ট্রীট চত্বরের সবচেয়ে উজ্জ্বল নারীলোভন মানুষটি তোমাকে ফেলে আমার কাছে চলে এসেছে, সে গর্ব কত স্বার্থপর। কি পাপ, কি ছেলেমানুষি তা এখন মর্মে মর্মে বুঝতে পারছি, অরিত্রকে আমি ফিরিয়ে দিচ্ছি। মহানামকেও আমি তোমায় দিলাম। মহানামকে একদিন আমি প্রবঞ্চনা, হ্যাঁ প্রবঞ্চনাই করেছিলাম। তিনি কোনও শাস্তি দেননি, কোনও ক্ষতিপূরণ দাবী করেননি। কিন্তু তিনি যদি চান; সত্যি সত্যি চান তো পুপুকেও আমি দিয়ে দেবো। পুপুকে আমি এবার ফিরে গিয়ে আস্তে আস্তে সব সত্যি কথাগুলো বলব। সে যে কি মহান ব্যক্তির সন্তান তা তার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখার অপরাধ আমি আর বাড়াব না। পুপু যথেষ্ট ধীর-স্থির, বুঝে সুঝে বললে সে নিশ্চয়ই ভালোভাবেই নেবে। আর যদি ভালোভাবে না নেয়, নীলমকে যদি ত্যাগ করে ঘৃণায়, অভিমানে তা-ও সে সহ্য করবে। বুক ভেঙে যাবে তবু সহ্য করবে। জীবনে কত কিছু পাওয়া হয়েছে যার কোনও মূল্য দেওয়া হয়নি। মূল্য দাও নীলম যোশী, মূল্য দাও নিজ হাতে, তারপর যা মহামূল্য, যা অমূল্য তার দিকে হাত বাড়িও। বস্তুত মার-কন্যা রতির সঙ্গে নিজেকে একেবারে মিলিয়ে, গুলিয়ে ফেলছিল নীলম। তার খালি মনে হচ্ছিল মহানামের সেই উক্তি: ‘দ্যাখো তপস্যা ভঙ্গ করতে এসে নিজেই না তপস্যায় বসে যায় মেয়েটা।’ স্বয়ং মার-কন্যার পক্ষে যদি তপস্যায় বসে যাওয়া সম্ভব হয়, তা হলে তার আনুপূর্বিক জীবনের শুদ্ধায়ন কি নীলম যোশী চৌধুরীর পক্ষে একান্তই অসম্ভব?
অরিত্র তার নিজের ভাবে এমন নিঃশেষে ডুবে ছিল যে নীলমের ভাবান্তর সে তিলমাত্রও বুঝতে পারেনি। সমস্ত অজন্তা তার কাছে এষাময়। প্রত্যেকটি নায়িকা, প্রত্যেকটি রাজকুমারী, প্রত্যেকটি নারী তার কাছে এষা প্রেষা। গুহাময় সুন্দরীদের এমনি কৃষ্ণবর্ণা করে করে আঁকলেন কেন শিল্পীরা! তাঁদের অন্তর্দৃষ্টি ছিল, দূরদৃষ্টি ছিল। মহানাম বলেছিলেন, —‘শক হুণদল পাঠান মোগল বহু জাতি বহু দস্যু এসেছে ভারতবর্ষে কিন্তু আমাদের নান্দনিক বোধকে তেমনভাবে প্রভাবিত বা বিকৃত করতে পারেনি, যেমন পেরেছে ইংরেজ। প্রকৃতপক্ষে এই ইংরেজরা আসার পর থেকেই আমরা গৌরবর্ণকে, একমাত্র গৌরবর্ণকে সৌন্দর্যের লক্ষণ বলে মনে করতে শুরু করি। ‘সর্ব দোষ হরে গোরা।’ এর চেয়ে সূক্ষ্ম দৃষ্টি আগে আমাদের ছিল। এই তো অজন্তা গুহাময় কত নারী, তার মধ্যে গৌরবর্ণাগুলি পরিচারিকা, সখী, অপ্রধান। পারসিক রানী সিরিন অবশ্য সত্যের খাতিরেই শ্বেতকায়া, কিন্তু সুন্দরী বলে খ্যাত মেয়েগুলি, নায়িকাগুলি সবই শ্যামলী, কেউ-কেউ তো রীতিমতো কৃষ্ণকায়া। শ্ৰমণরা তাঁদের চারপাশে যেসব রূপসীদের দেখতেন তাঁরা কেউই ইউরোপীয় অর্থে গৌরবর্ণা ছিলেন না, সেই বাস্তবকে তাঁরা মোটেই উপেক্ষা করেননি।’
অরিত্রর কিন্তু অন্য কথা মনে হচ্ছে। সৃষ্টি হবার তেরশ বছর পর শিল্প তো আর কখনোই শিল্পীর থাকে না। দ্রষ্টা-দর্শকদের কাছে তার বাণী যা, তাতেই তার মূল্য। শিল্পীরা তাঁদের চারপাশে কি বাস্তব দেখেছিলেন না দেখেছিলেন তার ঐতিহাসিকতা নিয়ে তার মাথা-ব্যথা নেই। তার মনে হচ্ছে তার চিরন্তনী এমন ছায়াময়ী হয়ে এসেছে তাকে পায়নি বলে। তাই সে বিষাদরূপিণী। অজন্তা গুহাচিত্রের মধ্য দিয়ে সূক্ষ্ম অতিসূক্ষ্ম উপায়ে সে তাকে তার ব্যথা জানাতে এসেছে। প্রত্যেকটি দুঃখিনী কৃষ্ণার সামনে সে গিয়ে দাঁড়ায়, আর তার মনটা ব্যথায় মুচড়ে ওঠে। মনে মনে সে বলে —‘হায় ছায়াবৃতা।’
যেদিন এষা প্রথম তাকে নীলমের সঙ্গে দেখেছিল, যেদিন বুঝতে পেরেছিল নীলমের সঙ্গে সে কতটা ঘনিষ্ঠ, সেদিন তার কি মনে হয়েছিল? কি সে তীব্র যন্ত্রণা, মনে করতেও অরিত্রর বুকে ছুঁচ ফুটছে, শেল বিঁধছে। উঃ, কি করে সে অমন নিষ্ঠুর হতে পারল? তারও পর এষা তাকে নিজ মুখে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে, মেয়ে হয়ে, আর অরি কি করেছে? সাজানো ভাষায় তাকে প্রত্যাখ্যান ছাড়া আর কি বলা যায়? তারপর? তারপর উনিশ বছরের সেই কাঁচা মেয়েটা, যে-অবশ্য নিজেকে খুব বড়, খুব বোদ্ধা ভাবত, সেই এষা-প্রেষা হারিয়ে গেল। বুদবুদের মতো শূন্যে মিলিয়ে গেল। রয়ে গেল শুধু এক খাতা কবিতা। একটা বই কি একটা মানুষের সঙ্গে সমান হতে পারে? এই সময়ে সে সপ্তদশ গুহায় মরণাহত রাজকন্যা জনপদকল্যাণীর ফিকে হয়ে আসা ছবিটি দেখছিল। তার প্রাণ তখন ব্যথায় মুচড়ে উঠছে। সে দেখল এষা ছবিটার সামনে স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছবিতে অনেক চরিত্র, মুকুট হাতে আছে ভগ্নদূত, কল্যাণীকে ধরে আছে তার সখীরা, এষা প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি দেখতে ব্যস্ত ছিল। অরিত্র দেখল নীলম একটু দূরে দাঁড়িয়ে এষার দিকে তাকিয়ে আছে। অরিত্র মনে মনে ভাবল—এষা যদি চায়, নীলমের কাছে সে ডিভোর্স চাইবে এবার। নীলমের নামে সে যথেষ্ট সম্পত্তি করেছে। নীলমের কোনই অসুবিধে হবার কথা নয়। তার জীবনটা নীলম এবং এষার মধ্যে ভাগ করে দেওয়ারই কথা। ভালো সময়টাই নীলম পেয়েছে। এবারের অংশ এষার। কিন্তু পুপু? সে-ও পর হয়ে যাবে? না, না, পর কেউ হবে না। নীলমও না। তারা সকলেই এখন এমন একটা বয়সে পৌঁছেছে যখন সঙ্গিনী বদলটা জীবনের ছকের একটা মস্ত ওলটপালট বলে আর গণ্য হওয়া উচিত নয়। পুপু বড় হয়েছে। তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে। নীলম যেমন পুপুকে নিয়ে আছে থাকবে। প্রকৃতপক্ষে নীলমের সঙ্গে তার সম্পর্ক তো এখন বন্ধুর মতো, ভাই-বোনের মতই। তবে আর বাধা কি? তবে পুনেয় থেকে ব্যাপারটা সম্ভব নয়। লোকাপবাদ এই বয়সে সহ্য হবে না। বম্বেতে সে ট্রানসফার নিয়ে নেবে। এমন কিছু অসুবিধে হবে না। জীবনের সমস্যা এবং নিজের ইচ্ছার এইরকম একটা বিলিব্যবস্থা করতে করতে অরিত্র মনে মনে খুব সুস্থ হয়ে উঠছিল। একদিন যে অস্থিরতা তাকে তাড়া করে ফিরছিল, সেটা একটু একটু করে অদৃশ্য হচ্ছিল। মাঝে মাঝেই সে চুপিচুপি এষার দিকে তাকাচ্ছিল। তরুণী শালতরুর মতো শ্যাম, স্নিগ্ধ, শুধু চিবুকের ডৌলটুকুই তাকে পাগল করে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। দেখতে দেখতে সে একেবারে নিশ্চিত বুঝতে পারছিল এষাও তাই-ই চায়। খালি পুপু আর নীলম দুঃখ পেতে পারে বলে প্রকাশ করে না। অনেক সময় দুটো ট্রেন ভিন্ন ভিন্ন স্টেশনের দিকে সমান তালে ছুটতে ছুটতে পাশাপাশি হলে দুটোরই মনে হয় অপরটা থেমে আছে। অরিত্র একেবারেই বুঝতে পারছিল না এষার গতি ভিন্ন স্টেশনমুখী, সে ভাবছিল এষা বুঝি থেমে আছে। তার পাশাপাশি। হাত বাড়ালেই তাকে ছোঁয়া যাবে।
সীমা চলছিল একটা ঘোরের মধ্য দিয়ে। অনেক সময়ে নিজের পরিচিত প্রতিবেশ ছেড়ে বেরোলে এরকম একটা মুক্তির বোধ হয়। বিশেষত সীমা এসেছিল এমন কয়েকজন মানুষের সঙ্গে যাদের কাছাকাছি হওয়া বা ভ্রমণসঙ্গী হওয়ার অভিজ্ঞতা তার আগে হয়নি। বিক্রমের পরিচিতের গণ্ডি ব্যবসাদার, এবং নানারকম ধান্দাবাজ লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। গান-বাজনার জগতের থেকেও বিক্রম এখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এষা, মহানাম এঁদের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে সে একটা সহজ মুক্তির স্বাদ অনুভব করছিল। যেন তার প্রকৃতিকে একটুও ব্যাহত না করেও আবৃত না করেও শুধু এই সঙ্গ তাকে তার রাক্ষসী ভাগ্যের হাত থেকে ক’দিন রক্ষা করে চলেছিল। সীমা নিজেকে প্রতি মুহূর্তে আবিষ্কার করছিল, এবং সে আবিষ্কারকে কাজে লাগাচ্ছিল। সে জানত না, কিশোরী বয়সে বিক্রমের শেখানো ‘চণ্ডালিকার’ গান তার এখনও মনে আছে। সতের নম্বর গুহায় বুদ্ধদেব, যশোধরা ও রাহুলের সেই বিখ্যাত চিত্র দেখে তার সমস্ত মন প্রাণ গাইছিল—‘জল দাও আমায় জল দাও।’ সে বুক ফাটিয়ে বলতে চাইছিল—‘আমি তাপিত পিপাসিত, আমায় জল দাও।’ বস্তুত এই গান বহুদিন আগে তাদের বাড়ির কাছে রবীন্দ্রভবনে বিক্রম গেয়েছিল তার নিজের পরিচালিত নৃত্যনাট্যে, আনন্দের গলায়, এবং প্রকৃতির কণ্ঠে সীমা প্রাণ ভরে গেয়েছিল—‘আমার কূপ যে হল অকূল সমুদ্র।’ এখন সেই গান যেন সীমার কণ্ঠ থেকে ফোয়ারার মতো উঠতে চাইছিল। গুনগুন করে মাঝে মাঝে গেয়েও ফেলছিল সে। তার এই জল পাবার আকুতি নিয়ে কিন্তু সে আদৌ পীতাভ বুদ্ধমূর্তিটির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল না। তার উদ্দিষ্ট ছিল বিক্রম, বিক্রম এবং বিক্রম। এই মানুষটির জন্য সে মায়াবিনী, ডাকিনী, যোগিনী, ভোগিনী, রোগিণী এমন কি সন্ন্যাসিনী হতেও রাজি ছিল। বিক্রমকে বুদ্ধদেবের জায়গায় দাঁড় করিয়ে সে এক গুপ্ত আবেগে আপাদমস্তক আপ্লুত হয়ে যাচ্ছিল। একবারও মনে হয়নি বিক্রমকে বুদ্ধদেবের ওপর বা বুদ্ধদেবকে বিক্রমের ওপর আরোপ করে সে কোনও অসামান্য ভুল করছে। তার আবেগের ভূমিতে যুক্তির একটি স্তম্ভও ছিল না। কাণ্ডজ্ঞানেরও কোনও নিয়ম সেখানে খাটছিল না। একটার পর একটা চিত্রে সে নিজেকে খণ্ডিতা নায়িকা এবং বিক্রমকে উদাসীন নায়ক সাজিয়ে দুঃখরূপ আনন্দ পাচ্ছিল, মনে মনে গাইছিল—‘দুখের বেশে এসেছ বলে তোমারে নাহি ডরিব হে।’ চলতে চলতে আরও একটা জিনিস ঘটছিল। সে যেন এষার কাছ থেকে তার কিছু ইন্দ্রজাল, নীলমের কাছ থেকে তার কিছু রূপ পরিগ্রহ করে পূর্ণতর নারী হয়ে উঠছিল। এবং মহানাম ও অরিত্রর কাছে যাচিয়ে নিতে চাইছিল তার পরিগ্রহ সম্পূর্ণ হল কি না। সম্পূর্ণ হলে তবেই বুঝি সে তার পূর্ণ মহিমায় দর্পী গ্রীবা উন্নত করে বিক্রমের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে। বলতে পারবে—‘দেখো তো চেয়ে আমারে তুমি চিনিতে পারো কি না!’
এষার কাছে সমগ্র অজন্তা-অভিজ্ঞতা একটা অলৌকিক বেদনা। যে কোনও শিল্পীই যদি মহৎ শিল্পী হন তাঁর সৃষ্টি বহুমাত্রিক হবেই। সেই বহুমাত্রিকতা তাঁদের জ্ঞান এবং সময়ে সময়ে ধ্যানেরও অগোচরে ঘটে। যে বৌদ্ধ শিল্পীরা পরম ভক্তিভরে তথাগত শাক্যমুনির জননান্তর— সৌহৃদ —স্মৃতিকাহিনী চিত্রার্পিত করেছিলেন তাঁরা কি স্বপ্নেও ভেবেছিলেন মহামানবের মহিমা ছাপিয়ে উঠবে তাঁর বঞ্চনার বিষাদ আজি হতে দ্বিসহস্র বর্ষ পরে কোনও দর্শকের কাছে?
সিদ্ধার্থ জননী মায়া স্তম্ভে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। লোকে বলে মহামানবের জন্ম দেবেন এই সংবাদে মায়াদেবী ভাবমগ্ন। এষা দেখল এই তরুণী জননী গর্ভভারে পীড়িত, অনাগত ভবিষ্যতের অমোঘ দায়ে ভারাতুর। মহামানব আসছেন, কিন্তু তাঁকে বিদীর্ণ করে। এই শুদ্ধোদন মাধুর্যে পূর্ণ, রাজঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ অপরূপ জীবন, এমন কি আসন্ন মাতৃত্বের আনন্দ ছেড়েও তাঁকে চলে যেতে হবে। না জানি কি কঠিন যন্ত্রণায়!
কপিলাবস্তুতে ফিরে এসে সিদ্ধার্থ তাঁর ভাই গৌতমীপুত্র নন্দকে প্রব্রজ্যা দিচ্ছেন। নন্দর বাগ্দত্তা জনপদকল্যাণী সংবাদ শুনে মৃত্যুমূর্ছায় এলিয়ে পড়ে আছে। অদূরে প্রত্যাখ্যাত রাজমুকুট হাতে ভগ্নদূত, রাজকন্যার মুখশ্রীকে করুণ মৃত্যু যেন উপহাস করছে। চোখে তার, যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার, স্তন তার করুণ শঙ্খের মতো—দুধে আর্দ্র—কবেকার শঙ্খিনীমালার। গুহার পর গুহায় কড়ির মতন শাদা মুখ, হিম হাত, বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা নারীরা বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত দু চোখ নিয়ে যেন এষার পেছন পেছন আসে, আকাশে হাত বাড়িয়ে বলে—চাই। তোমায় চাই। প্রতিধ্বনি বাজে এষার শূন্যগর্ভে, বুকের ফাঁকা প্রকোষ্ঠে। মহাজনক জায়া সীবালি, রাহুলকে কোলের কাছে ধরে করুণ নয়না যশোধরা। নিমীলনয়না কৃষ্ণা রাজকুমারী, এমন কি আকাশে উড্ডীন কৃষ্ণা অপ্সরা পর্যন্ত যেন একটিই করুণ গীতিকবিতা। সীতার কান্না, রতিবিলাপ, রাধার হাহাকার। কে যেন বিপুল প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছিল, কথা রাখেনি, চরাচর শূন্য করে চলে গেছে।
বেদনার যে তীব্র বোধ আচ্ছন্ন করছে, বিদ্ধ করছে চেতনা তাকে এষা কী নাম দেবে ভেবেই পায় না। অথচ এই বোধ তাকে পিষ্ট করছে না একদম। মাটির নিচ থেকে যেন শক্তিশালী ধূম্রজালের মতো উচ্ছ্রিত হয়ে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে শূন্যে, এখনই হয়ত সে অতিক্রম করে যাবে সেই আয়নোস্ফিয়ার যার পরে প্রকৃত মহাশূন্য এবং অগণিত গ্রহ-উপগ্রহ-তারার প্রতিবেশ। অ্যাস্টারয়েড-পিণ্ড সেখানে তীব্র বেগে ছুটে চলতে চলতে হঠাৎ জ্বলন্ত উল্কা হয়ে শূন্যের খাতায় জ্যোতির্লেখা এঁকে দেয়, গ্রহ নিচয়সহ সূর্য সেখানে অনন্ত অলাতচক্রে ঘুরে চলে, ঘুরে চলে আর রুদ্ধ কণ্ঠে বলে আমায় পৌঁছতে দাও, কোথাও পৌঁছতে দাও। হে নিয়তি, হে বিধাতা, এই চক্রাবর্তনের পৌনঃপুনিকতা আমায় ক্লান্ত করে, ক্লান্ত ক্লান্ত করে। এমন এক পথ সৃষ্টি করেছ, হায় যেখানে পিছিয়ে পড়ারও উপায় নেই। সচল পথ তার নিজের নিয়মে চলে, চালিত করে।
এই অনুভূতি এষাকে সকলের থেকে আলাদা করে দিচ্ছিল যেন এ তার কবিকথিত এক মুদ্রাদোষ। বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছিল সবার থেকে, তাই একরকম বিপন্নও করছিল। কারণ বিশ্বের সঙ্গে যোগে বিহার করতে না পারলেই নিরাপত্তাবোধ নষ্ট হয়ে যায়। এষার মনে হচ্ছিল বহু যুগ আগে থেকে শুরু হয়েছে তার এই একাকিত্বের বেদনা। এ কখনও এক জন্মের নয়!
অথচ সেই একই সময়ে মহানাম আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিলেন এক তুলনাহীন আনন্দে। তাঁর প্রত্যেক পদক্ষেপে যেন এক মহাপ্রাপ্তির সম্ভাবনা শতদল পদ্মের মতো ফুটে উঠছিল। অগগোহহম অস্মি লোকস্স। পৃথিবীতে আমিই অগ্র, আমিই সর্বপ্রথম যে তা পাবে। কি যে পাবেন, তা তাঁর স্পষ্ট করে জানা নেই। জানতে কৌতূহলও নেই। শুধুমাত্র প্রাপ্তির সংবাদই তাঁকে এমনভাবে অভিভূত করেছে, আপ্লুত করেছে যে তিনি তাঁর আনন্দকে মনের পশ্চাৎপটে নিয়ে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ জ্ঞানমার্গে লঘুপদে বিচরণ করছিলেন। প্রত্যেকটি চিত্রে বিধৃত জাতক-কাহিনীর বিশদ ব্যাখ্যা শোনাচ্ছিলেন সঙ্গীদের। কম্পিয়া-জাতক, বিশ্বান্তর-জাতক, পূর্ণ-ভাবিলার কাহিনী। কখনও গাইড স্বয়ং এবং দলের অন্যান্য শ্রোতারাও দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। থামের ওপর হাত রেখে তিনি তার নির্মাণ সৌকর্যের প্রতিটি ধাপ ব্যাখ্যা করছিলেন। অজন্তা ফ্রেসকো, মিকালেঞ্জেলোর বিখ্যাত লাস্ট জাজমেন্ট সিসটিন চ্যাপেলে, চীনের টুন-হুয়াং গুহাচিত্র। প্রাগৈতিহাসিক মানবও এই গুহাকেই কেন তার শিল্পসাধনার পীঠস্থান বলে মনে করেছিল। স্থান নির্বাচনে শিল্পীতে শিল্পীতে এই যোগসূত্র। আরও বলছিলেন কালিদাস সাহিত্যের চিত্ররূপ হিসেবে অজন্তাচিত্রকে দেখবার আলাদা আনন্দের কথা। কারণ অজন্তা চিত্র আর কালিদাসের কাল, অর্থাৎ কালিদাস প্রভাবিত ক্লাসিক্যাল সাহিত্যের কাল মোটের ওপর সমসাময়িক। ‘কুমারসম্ভব’, বিশেষ করে ‘মেঘদূতে’র চরিত্রগুলিই যেন শিল্পীর তুলিতে গুহায় গুহায় ফুটে উঠেছে।
‘হস্তে লীলাকমলমলকে বালকুন্দানুবিদ্ধং
নীতা লোধ্রপ্রসবরজসা পাণ্ডুতামাননে শ্রীঃ।
চূড়া পাশে নবকুরুবকং চারু কর্ণে শিরীষং
সীমন্তে চ ত্বদুপগমজং যত্র নীপং বধূনাম’
“হস্তে ধৃত লীলাকমল, কুন্তলে কুন্দকলি বিন্যস্ত,
মুখের মধুরিমা লোধ্রপ্রসরের পরাগে হয়ে যায় পাণ্ডুর,
কর্ণে শোভা পায় শিরীষ মনোহর, তরুণ কুরুবকে কবরী,
এবং তুমি যাকে ফোটাও, সেই নীপে সিঁথির প্রসাধন বধূদের।”
মন্দ্র-কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়ছিল গুহা থেকে গুহান্তরে। তাঁর আনন্দ তাঁর চারপাশে এমন একটা আলোর বলয় সৃষ্টি করেছিল যে তিনি সঙ্গীদের অবস্থান্তর, ভাবান্তর, লক্ষ্য করতে পারছিলেন না আদৌ। বিক্রমের ব্যঙ্গাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি, সীমার করুণ চঞ্চলতা, নীলমের অনুতাপ এবং সম্মিতি, অরিত্রর সিদ্ধান্ত, এষার বিষাদ কোনও কিছুই লক্ষ্য না করে তিনি অজন্তার জগতে সিংহশাবকের মতো বিচরণ করছিলেন। কানে বাজছিল কখনও ইন্দ্ৰবজ্রা, কখনও উপেন্দ্ৰবজ্রা, মন্দাক্রান্তা, কখনও বা শার্দুল বিক্ৰীড়িত।