পঞ্চম পুরুষ (Pancham Purus) : 12
‘টিকিট না পাই, কোই বাত নেই, গাড়িতেই যাবো’, হেঁকে বলল বিক্রম, ‘তোমরা রাত্তিরে কেন ব্যবস্থাটা করলে বুঝলুম না।’
‘ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায় যাবার জন্যে। ইলোরা অজন্তায় প্রচণ্ড গরম সহ্য করতে হবেই। তার ওপর এতটা রাস্তা গরমে যেতে হলে নেহাত নিরেট মাথা ছাড়া আর সব মাথাই ধরবে’—অরিত্র জবাব দিল।
নীলম অনেকক্ষণ থেকে চুপ করে বসে আছে। এষা রান্নাঘরে। মুরগী রান্নার খুব সুবাস বাতাসে। সীমা আর অরিত্র বিক্রমের সঙ্গে কথা কাটাকাটিতে মত্ত। অরির ইচ্ছে বিক্রম চেষ্টা করুক, যদি টিকিট পাওয়া যায়, নয়তো একটা ল্যান্ডরোভার ভাড়া করে নিক। বিক্রমের গোঁ সে ওই গাড়ি নিয়েই অরিত্রদের লাক্সারি কোচের পেছন পেছন যাবে। নীলমের মনে হচ্ছে সে কারও বাড়ি বেড়াতে এসেছে। অল্প-চেনা কারো বাড়ি। এখনও আড় ভাঙেনি। ওদের আগ্রহের সঙ্গে নিজের আগ্রহ মেলাতে পারছে না। ভীষণ একটা একাকিত্ব তার চারদিকে বৃত্ত রচনা করছে। শীগগীরই এমন একটা সময় আসবে যখন সেই যাদু-বৃত্তের মধ্যে অপর কেউ ঢুকতেও পারবে না, সে নিজে বেরোতেও পারবে না। কেমন হাঁপ ধরছে নীলমের।
পুপু স্কুটার পার্ক করে এসে দাঁড়াল। সকালবেলাই ও বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিল নিজের কাজে। বলল—‘আরে বিক্রমকাকু এসে গেছো? খুব দেরি করলে কিন্তু। কাকীমা! আগে এলে না কেন তোমরা? মাসির সঙ্গে আলাপ হয়েছে?’
বিক্রম হাত বাড়িয়ে খপ করে ধরল পুপুকে। গালভরা হাসি। সীমা বলল—‘তুই কি আরও লম্বা হয়ে গেলি?’
‘তুমি তো প্রত্যেকবারই আমাকে আরও লম্বা দেখো। ওই রেটে বাড়লে তোমাদের আর ফ্ল্যাগস্টাফের দরকার হবে না। আমার কানের সঙ্গে ফ্ল্যাগটা বেঁধে দিও রিপাবলিক ডে-তে। কি বিষয়ে কথা হচ্ছে তোমাদের।’
অরিত্র বলল—‘পুপ, কাল রাতে আমরা ঔরঙ্গাবাদ যাচ্ছি। তুই আর তোর মা থাকছিস। অসুবিধে হবে না তো? তোর পরীক্ষাটা বড্ড বেয়াড়া সময়ে পড়ল রে!’
পুপু বলল—‘মা যাচ্ছে না কেন? আমার জন্য?’
অরিত্র বলল—‘ন্যাচার্যালি।’
‘কোনও দরকার নেই। আমি হোস্টেলে থেকে যেতে পারি কদিন প্রীতার কাছে। মা কেন শুধু-শুধু আটকে থাকবে? আই উইশ আই কুড গো টু। খুব ভালো পার্টি হচ্ছে তোমাদের।’
অরিত্র বলল—‘তোকে ফেলে তোর মা যেতে চাইবে না, দ্যাখ।’
নীলম ম্রিয়মাণ গলায় বলল—‘হোস্টেলে থেকে পরীক্ষা দিতে তোর অসুবিধে হবে পুপু।’
‘হোস্টেলেই তো সবচেয়ে সুবিধে মা। আমি এমনিতে অজন্তা মিস করব তার ওপর তুমি যেতে না পারলে⋯এষা মাসি তো রোজ রোজ আসছে না।’
‘কিন্তু তোর মার তো টিকিটই কাটা হয়নি।’
‘কোই বাত নেই’, বিক্রম বলল— ‘আমার অতবড় গাড়িটা কি ফাঁকা যাবে?’
পুপু বলল—‘ইস্স্ বিক্রমকাকু তোমরাও যাচ্ছো, না? গান গাইবে নিশ্চয়ই। আচ্ছা বাবা, ডক্টর রায় শেষ পর্যন্ত কি ঠিক করলেন? তোমাদের সঙ্গেই যাচ্ছেন?’
‘যাচ্ছেন।’
‘ইসস। হাউ আই উইশ মাই টেস্ট কুড় বি ডেফার্ড!
অরিত্র বলল—‘বুড়োদের সঙ্গে বেড়াতে তোর ভালো লাগত?’
‘বুড়ো কে? তোমরা? আ মোস্ট ইন্ট্রেস্টিং লট’ এষা মাসি, ডক্টর রয়, উঃ! বিক্রমের গান, সীমার গান, সীমা আমাকে মনে করে গাস।’
নীলমের চোখে কি উড়ে পড়েছে। চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে। সীমা বলল—‘চোখে জল দাও, নীলমদি, ঘষাঘষি করো না।’ নীলম উঠে গেল। অরিত্র একেবারেই চায় না নীলম যাক।
দুপুর বারোটা নাগাদ নীলমের কাছে খেয়ে-দেয়ে মহানাম, সীমা আর বিক্রম এগিয়ে পড়ল। রাতে কোচ ছাড়বে। মহানামের টিকিটে নীলম। বিক্রম বলছিল—সীমা, এষা আর নীলম তিনজনেই তার গাড়িতে চলুক। অঢেল জায়গা। একটা টিকিট নষ্ট হয় হোক। কোই বাত নেই। অরিত্র শুনে বলল—‘হ্যাঁ তিন মহিলা তোমার সঙ্গে যাক, আর তুমি মস্তানি দেখাতে গাড়ি খাদে ফ্যালো আর কি।’ বিক্রমরা গিয়ে একটা রাত অপেক্ষা করবে। পরদিন সকালে সবাই একসঙ্গে ইলোরা দেখতে বেরোবে।
নীলম দেখল উঁচু-নিচু খাড়াই সব পেরিয়ে তারা অবশেষে দিগন্ত জোড়া সমতলে এসে পৌঁছেছে। রাতভর দীর্ঘ যাত্রার শেষে ঔরঙ্গাবাদের প্রান্তে সূর্য উঠছে। বাসি মাঠ দু পাশে, খেত। তার এক পাশে অরিত্র, আর এক পাশে এষা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। নীলম সারা রাত নিজেকে জাগিয়ে রেখেছে। আস্তে করে ডাক দিল—‘এষা, ওঠো। অরি, ঔরঙ্গাবাদ পৌঁছে গেছি।’ নীলমের মনে হচ্ছিল পুপুই সারা রাত মশাল জ্বেলে তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ওঃ কী দুঃস্বপ্নের রাত!
রেস্ট-হাউসে স্নান-টান সেরে ওদের যাবার কথা ইলোরা, পথে পড়বে দৌলতাবাদ ফোর্ট। মহারাষ্ট্র ট্যুরিজম-এর বাস ছাড়বে সাড়ে আটটা নাগাদ। ওরা নেমে দেখল বিক্রম, সীমা, মহানাম প্রস্তুত। বিক্রম বলল—‘গাড়িতেই আমরা সবাই বাসটার পেছন পেছন যাবো। গাইড়ের সঙ্গে কথা বলে রেখেছি।’
নীলম বলল—‘সেই ভালো, উঁচু বাস থেকে বারবার নামতে উঠতে ভীষণ কষ্ট হয়।’
একটু ঠাসাঠাসি হয়েছে। সামনে বিক্রমের কনুইয়ের জন্য জায়গা রেখে মহানাম বসেছেন বেশ খানিকটা স্থান নিয়ে। অরিত্রর কৃশতা সেটা পুষিয়ে দেবার চেষ্টা করছে। পেছনে সীমা আর এষা যেটুকু জায়গা ছেড়েছিল, নীলম ভালো করেই তাকে পুষিয়ে দিয়েছে।—‘বেশ আরাম করেই বসা গেছে,’ নীলম বেশ তৃপ্ত কণ্ঠে বলল। অরিত্র বলল—‘তোমার আরাম আবার অন্যের হারাম হচ্ছে কি দেখো একটু।’ বিক্রম বলল—‘কোই বাত নেই, ভাবী’, সীমা বলল—‘এষাদি, আপনি হেলান দিয়ে বসুন না, আমি একটু এগিয়ে বসছি’, মহানাম বললেন—পাঁচজনের কথা মনে করেও অন্তত তোমার একটু ব্যায়াম করা উচিত নীলম।’ নীলম বলল—‘এতো গঞ্জনা আর সহ্য হয় না।’ এষা চুপ। পিকুর সঙ্গে চুক্তি, যে যখন যেখানে যাবে অন্যজনকে চিঠিতে খুঁটিনাটি জানাবে। এষা এখনও পিকুকে চিঠি দেয়নি। আজ রাতে এসে প্রথম দেবে কি না ভাবছে।
গাড়ির অভ্যন্তরে প্রান্ত-যৌবনের আকাঙক্ষার গন্ধ। ভারাতুর করে রেখেছে হাওয়া। পুপের মতো কিশোরী থাকলে তার ব্যক্তিত্বের দুধে-গন্ধ দ্বারা পরিপ্লুত হতে পারত। সবাই, অন্তত অনেকেই, অস্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারছে তাদের মধ্যে একটা কামচক্র তীব্র ইচ্ছাশক্তিতে ঘুরছে। অরিত্র প্রচণ্ডভাবে চাইছে এষাকে, সীমা চাইছে তার স্বামীকে যাকে পাওয়ার মতো করে সে কখনও পায়নি, বিক্রম চাইছে সম্ভব হলে এষাকে, নইলে নীলমকে, নইলে তার অভ্যস্ত নারী সীমা ছাড়া অন্য যে কোনও রমণীকে। নীলম চাইছিল মহানামকে, মহানাম কাউকে স্পষ্ট করে চাইছিলেন না, অথচ তাঁর অস্তিত্ব জুড়ে একটা চাওয়ার প্রার্থনা নিঃশব্দে শরীর পাচ্ছিল, তিনি চৈতন্যের কুয়াশায় তাকে অনুভব করতে পেরে নাতিদূর ভবিষ্যতে কোনও বন্ধনের আশঙ্কায় ক্লিষ্ট হচ্ছিলেন আবার একই সঙ্গে, তাঁর শরীর-মন আত্মার চাহিদা থেকেই স্বত-উৎসারিত। এ প্রার্থনা বুঝে তার পূর্তি কি হতে পারে ভেবে শান্ত একটা প্রতীক্ষাবোধে স্তিমিত হয়ে ছিলেন। এষা চাইছিল অজন্তাকে তার সমস্ত ঐতিহাসিক, পৌরাণিক, শৈল্পিক এবং মানবিক রঙ-রূপের সূক্ষ্ম বর্ণিকাভঙ্গ সহ। এতো গাঢ় সেই চাওয়া যে সে পরিমণ্ডলের এই কামগন্ধ সম্পর্কে একেবারে অনবহিত ছিল। তার একপাশে নীলম, আর একপাশে সীমা। মাঝখানে যেন একটা অন্তরালের মধ্যে তার নিঃশব্দ বসে-থাকা টের পাওয়া যাচ্ছিল না। সে নিজেও অন্য কাউকে টের পাচ্ছিল না। জীবনের সব চূড়ান্ত পরিচ্ছেদের সম্মুখীন হলেই তার এইরকম গভীর আত্মমগ্নতা হয়। কথা বলতে ইচ্ছে করে না, জিভ যেন ঘুমিয়ে পড়েছে, কণ্ঠ স্বপ্ন দেখছে। হাত-পা ভারি হয়ে আসে। অনেক চেষ্টা করে নিজেকে চলাফেরায় সক্ষম করে তুলতে হয়।
দৌলতাবাদ ফোর্টের প্রাচীর আরম্ভ হয়েছে বহুদূর থেকে। বাইরে থেকে কিছু দেখা যায় না। ভাঙা-ভাঙা প্রাচীর-রেখা বইছে তো বইছেই। বাস থেমে গেছে। সান-গ্লাস, ছাতা, ফ্লাস্ক্, ক্যামেরায় সজ্জিত টুরিস্ট দল নেমে পড়েছে। বিক্রম গাড়ি রুখতে এষা নেমে একটু সরে দাঁড়াল। সে ভেতরে যেতে চাইছে না। অন্যরা এগিয়ে যাচ্ছে। কি হবে সেই ইতিহাসবস্তু দেখে যার সাক্ষ্য তুমি আগেই নিয়ে রেখেছো, যা তোমাকে জীবনসম্পদ হিসেবে কিছু দেবে না। দেবে না তুমি জানলে কি করে? সহজাত বোধ দিয়ে। ভুল করতে পারো। ইনটুইশন সহসা ভুল করে না। এই ধরনের একটা ছোট্ট বিতর্ক নিজের মধ্যে শেষ করে নিয়ে এষা ফোর্টের বাইরে। চালার নিচে দোকান, কয়েকটা কাঠের বেঞ্চি ফেলা। এই যাত্রায় এই প্রথমবারের মতো এষা মহারাষ্ট্রের বিখ্যাত আখের রস এক গ্লাস যত না তেষ্টা, তার চেয়েও বেশি সময় কাটাবার উপকরণ হিসেবে নিয়ে বসল। চুপচাপ বসে থাকা লোকের চোখে লাগে। দরকার হলে আরও এক গ্লাস নিতে হবে।
এষা অনেকক্ষণই একলা একলা বসে থাকার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল তার দলের কয়েকজন ফিরে আসছে। একত্রে নয়। নিম্ন বর্ণিত ক্রমে।
প্রথম বিক্রম। তার বপু একখণ্ড কাঠের ওপর রেখে সে গজল ধরল একটা। বিক্রম এষার সঙ্গে আলাপিত হয়েছে, কিন্তু পরিচিত হয়নি। যতটুকু দেখেছে শুনেছে তাতে তার প্রাণান্তকর কৌতূহল জেগেছে। কৌতূহল সংবৃত রাখাটা সভ্যতার শর্ত, বিক্রম তার ধার ধারে না, এষা তাকে একটু প্রশ্রয় দিলেই সে নগ্ন আকারে তার সমস্ত কৌতূহল প্রকাশ করে ফেলত কিন্তু এষা প্রশ্রয় দিচ্ছে না। অবহেলা বা অবজ্ঞাও করছে না, এটা বিক্ৰম বুঝতে পারছে, তাই তার রাগও হচ্ছে না। আসলে কুমীর যেমন বকুল গাছ, কিম্বা সপ্তর্ষিমণ্ডল চেনে না, বিক্রমও তেমনি এষাকে চিনতে পারছিল না। অথচ বহিরঙ্গে দুজনেই এক মনুষ্য জাতির বলে চেনাটা তার স্বাভাবিক অধিকারের অন্তর্গত বলে মনে করছিল।
দ্বিতীয় অরিত্র। বিক্রমের গান মাত্র আধখানা হয়েছে কি হয়নি দেখা গেল অরিত্র ফিরে আসছে। তার দুই ভুরুর মাঝখানে ভাঁজ। বিরক্ত গলায় সে বলল—‘খালি ধুলো খাওয়া। দূর দূর। সব পাষাণই কি ক্ষুধিত পাষাণ যে কথা বলবে!’
বিক্রম বলল—‘আন্ডার-এসটিমেট করছেন দাদা, এই দুর্গের মধ্যে এক একটা জায়গায় এক একরকম ডিফেন্স মেকানিজম। কোথাও থেকে পায়ের শব্দের প্রতিধ্বনি পৌঁছে যায় ওপরের গুপ্ত ঘরে, কোথাও দু দিক থেকে খোলা তলোয়ার এসে ঘ্যাচাং করে মুণ্ডু কেটে নেবে। গাইড আবার খুব রোমহর্ষক উপায়ে দেখায় কোনটা কোনটা। অন্ধকারে সবাইকার হাত থেকে দেশলাই নিয়ে নেবে, টর্চ নিয়ে নেবে। নাটকীয় ভাবে বলবে এইবার একটা দারুণ জিনিস দেখাবো, দর্শকরা যেই পা বাড়াতে যাবে, বলবে আর একপাও এগোবেন না কেউ। একটামাত্র দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালবে—সামনে অন্ধকূপ। এতো গভীর গর্ত যে তার তলা দেখা যায় না।’
এষা বলল—‘তাই না কি? আমার তো শুনেই গা ছমছম করছে! নিরাপদ তো! ওরা যে গেল!’
বিক্রম বলল—‘ওরা ঠিক থাকবে। এই চৌধুরীদা পড়ে যেতে পারতেন, যা ছটফটে আর অবাধ্য!’ তারপরই দু হাতে বরাভয়মুদ্রা করে বলল—‘না, না, এষাজী, কেউ পড়বে না, রেলিং দিয়ে জায়গাটা কবেই ঘিরে দিয়েছে।’
‘আপনি আগে দেখেছেন বুঝি?’
‘ন্যাচার্যালি। সেইজন্যই তো গেলাম না। কতগুলো ধাপ ভাঙতে হয় জানেন? লোকে ঘোড়ায় চড়ে উঠত—ওয়ান্স ইজ এনাফ।’
এষা বলল—‘অরি, তুমিও গেছো বুঝি?’
অরিত্র গম্ভীর মুখে বলল—‘না।’
‘তাহলে গেলে না? ইনটরেস্টিং জিনিস মনে হচ্ছে!’
‘তুমিই বা গেলে না কেন?’
বিক্রম প্রায় অট্টহাস্য করে বলে উঠল—‘এই তো এষাজী, আপনি গেলেন না, তাই চৌধুরীদাও গেলেন না।’
এষা শুধু বলল—‘আমি ইলোরা অজন্তার জন্য শক্তি সঞ্চয় করে রাখছি।’
একটু পরেই দেখা গেল নীলম ফিরে আসছে। মুখ লাল হয়ে গেছে পরিশ্রমে। গাছের ছায়ায় বসতে বসতে বলল—“বাব্বাঃ | এ আমার কম্মো না।’
সীমা ফিরল না কারণ সে নিশ্চিন্ত হতে পেরেছিল নীলম এষাকে এবং এষা নীলমকে পাহারা দিয়ে রাখবে। সে মহানামের পেছন পেছন উঠে যাচ্ছিল। মহানাম এগিয়ে যাচ্ছিলেন এক শান্ত অথচ অদম্য কুতুহলে, কোথায় এর শেষ, তাঁর দেখা চাই। এইভাবেই আস্তে আস্তে সরকারি গাইডের পেছন পেছন ইলোরার বৌদ্ধগুহা, জৈনগুহা, ত্রিতল বিহার দেখতে দেখতে কৈলাস-মন্দিরের প্রাঙ্গণে এসে মহানাম লক্ষ্য করলেন তাঁর দলের সবাই খুব আগ্রহের সঙ্গে দেখছে ইলোরা এবং সরকারি দল এখনও বেশ খানিকটা পিছিয়ে আছে, কারণ দ্রষ্টব্য গুহাগুলোর কোনও কোনওটার সামনে দাঁড়িয়ে গাইডকে বেশ বিশদ বক্তৃতা করতে হচ্ছে। দলে দুটি জাপানী ছেলে আছে, গাইডকে ভাঙা ভাঙা জাপানীরও আশ্রয় নিতে হচ্ছে। তিনি নোটবই বার করলেন। বিক্রম এবং অরিত্র ছবি নিচ্ছিল।
এষা বলল—‘মহানামদা, আমি খুব সামান্য সংখ্যক ছবি নেবো। আপনি আমাকে একটু গাইড করুন।’
মহানাম বললেন, ‘তুমি আমাকে ফলো করে যাও। আমিও খুব বেশি নিচ্ছি না।’
উঁচু রোয়াকের ওপর উঠতে নীলমের অসুবিধে হচ্ছিল, বিক্রম ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে দৌড়ে গিয়ে তাকে কোলে তুলে যথাস্থানে পৌঁছে দিল। এষার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে বলল—‘আমি আর এক হাতে আপনাকেও তুলতে পারি।’ সীমা হালকা লাফে সিঁড়ি টপকাচ্ছিল, বলল—‘লক্ষ্মণের গণ্ডি পেরিয়ে রাবণের হাতে সীতা কবার ধরা দ্যান?’ অরিত্র চেঁচিয়ে বলল—‘মহানামদা, অত এগিয়ে যাবেন না। গাইডকে তো দেখতে পাচ্ছি না। আপনি না থাকলে আমাদের দেখাবে কে?’
মহানাম এগিয়ে গিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু বিক্রমের ব্যাপারটা এবার তিনি ধরতে পেরে গিয়েছিলেন, নীলমকে ওরকম জাপটে ধরে রোয়াকে তোলার দৃশ্যটা তাঁর খুব খারাপ লেগেছিল। তিনি অরিত্রর সহযোগী হবেন বলে দাঁড়িয়ে পড়লেন। রোয়াকের প্রান্তে এসে একটু গলা তুলে বললেন—‘তোমরা একটু ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখো, এই মন্দির পাহাড় কেটে তৈরি। এই পাহাড় নমনীয় ব্যাসল্ট পাথরের। না দেখে শুনে স্থপতিরা মন্দিরের কাজে হাত দেননি। সাধারণ দেবালয়ের মতো নিচে থেকে গাঁথুনি দিয়ে তৈরি নয় এসব মন্দির বা গুহা। ওপর থেকে কেটে কেটে নেমেছেন শিল্পীরা। বাটালির দাগ, ছেনির দাগ ওপরদিকে তাকালেই দেখতে পাবে।’
বাঁ করিডর ধরে এগোতে এগোতে তিনি সীমাকে লক্ষ্য করে বললেন—‘শিব-পার্বতীর পাশা খেলার রিলিফটা লক্ষ্য করো, ভালো লাগবে। পার্বতী মাটিতে হাতের ভর দিয়ে উঠছেন একদম গ্রাম্য মেয়েদের ভঙ্গিতে। শিল্পী যে ভঙ্গিটা খুব ভালো করে চেনেন সেটাকেই ফুটিয়ে তুলেছেন। এই যে দেব-দম্পতির বিবাহ দৃশ্য। পার্বতীর মুখভাব দ্যাখো নীলম, এখানেও সলজ্জ নারী মূর্তি। বিক্রম এই দ্যাখো ত্রিপুরান্তক শিব। লক্ষ্য করেছো অরি চোল পিরিয়ডের যে নটরাজকে আমরা অগ্নিবলয়ের মধ্যে সাঙ্কেতিক মুদ্রায় নাচতে দেখি, বা লৌকিক কল্পনার যে স্থূলোদর আশুতোষ শিবকে আমরা দেখতে অভ্যস্ত তার থেকে এ কল্পনা কতো ভিন্ন! ইনি চতুর্ভুজ নন। আকৃতিও অনেক তরুণ। আর্য-অনার্য সংস্কৃতির মিশ্রণের ইতিহাসের কতকগুলো মিসিংলিঙ্ক খুব সম্ভব এই বিভিন্ন শিব। মহিষাসুরমর্দিনীর মতোই যুদ্ধকালেও মুখে প্রসন্ন বরাভয়ের হাসি।’
বিক্রম বলল—‘আসলে শিব তখন যুবাপুরুষ ছিলেন। দেখছেন না কেমন সিংহকটি! এই সময়েই পার্বতী ওরফে দুগ্গা ওঁর প্রেমে পড়েন। পরে যতই বয়স বেড়েছে, ততই ভদ্রলোক ভুঁড়োপেটা হয়ে গেছেন, পার্বতী ডিভোর্স না করলেও এই পিরিয়ডেই ওঁকে পাত্তা দেওয়াটা বন্ধ করলেন, ব্যাস শিব টার্নড ভিখারি শিব। দা বেগার গড। আমি ভিক্ষা করে ফিরতেছিলেম গ্রামের পথে পথে।’
সীমা বলল—বয়সের কথা তুলছো কেন? অনেক সো-কল্ড্ ইয়ং ম্যানও তো ভুঁড়োপেটা হয়ে যেতে পারেন। বিশেষত দেবতাদের মধ্যে যেরকম সুরাপানের চল ছিল!’
‘সেটা অবশ্য ঠিক’, মহানাম বললেন, ‘সমুদ্রমন্থনকালে সুরা উঠলে অসুররা তা প্রত্যাখ্যান করেন বলেই অসুর এবং দেবতারা গ্রহণ করলেন বলেই সুর বলে পরিচিত হলেন। তবে সেই সুরা আর্যদের মৈরেয়, মাধ্বী, গৌড়ী, আসব অর্থাৎ লিকিয়র, লিকর এবং ওয়াইন কি না এ বিষয়ে নানা জনে নানা কথা বলে থাকেন। প্রতীক হিসেবে নেওয়ারই চল।’
এষা বলল—‘প্রাচীন আর্য জাতির কিন্তু সুরাটাকে অবশ্য প্রয়োজনীয় পানীয় মনে করা অসম্ভব নয় মহানামদা। প্রচণ্ড শীতের দেশ থেকেই তো এসেছিল। সেই সুরাসক্তির লোকস্মৃতিকেই যদি মিথ দিয়ে প্রকাশ করে থাকে।’
অরিত্র বলল—‘আমার ধারণা সমুদ্রমন্থনের মিথটা আসলে একটা ফার্টিলিটি মিথ। সমুদ্র যোনি এবং মন্দর পর্বত লিঙ্গের প্রতীক। উত্থিত যা কিছু অর্থাৎ লক্ষ্মী, ঊর্বশী, অপ্সরা, ধন্বন্তরী —এসবই সেকশুয়াল অ্যাকটের ঐশ্বর্য প্রকাশক।’
বিক্রম হাঁ করে চেয়েছিল, বলল—‘ব্রাভো চৌধুরীদা, ব্রাভো! আপনি যে দেখছি লেটেস্ট আমেরিকান পর্নোকেও ছাড়িয়ে গেলেন!’
মহানাম আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে বললেন—‘অরিত্র, তুমি কি এটা কোথাও পড়েছ? না নিজস্ব মত এটা তোমার?’
অরিত্র বলল—‘কোথাও থাকতে পারে। তবে পড়েছি বলে মনে পড়ছে না। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক্ষুণি মনে হল।’
বিক্রম এই সময়ে তার মুখের শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলতে যাচ্ছিল। সীমা পেছন থেকে কনুইটা ধরে বলল—‘মন্দির প্রাঙ্গণ নোংরা করছো কেন?’
‘কোথায় ফেলব তাহলে এটা?’—বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করল বিক্রম।
‘দাও, আমার হাতে দাও’—সীমা সিগারেটের টুকরোটা তার ছাতার বাঁটে ঘষে ঘষে নিভিয়ে ফেলল, তারপর ব্যাগের মধ্যে থেকে একটা পলিথিন প্যাকেট বার করে তাতে পুরে রাখল।
মহানাম হেসে বললেন, ‘বাঃ, তুমি খুব রিসোর্সফুল মেয়ে তো! ওই রকম প্যাকেট কি তুমি সব সময়েই সঙ্গে রাখো?’
সীমা বলল— ‘কি করব বলুন, এঁর যা স্বভাব, কোথায় কি আবর্জনা ফেলবেন, আমি ছাড়া আর কে সে সব বয়?’
মহানাম আশ্চর্য হয়ে এষার সঙ্গে চোখাচোখি করলেন। অরিত্র বলল— ‘রিয়্যালি সীমাচলম, য়ু আর ফ্যানটাসটিক!’
এর পর ওরা মন্দির গাত্রের অজস্র রিলিফ দেখতে দেখতে অন্যদের সঙ্গে মিশল গিয়ে। পাথরে তৈরি অথচ পেলব, পাথরের গায়ে চিরকালের মতো শিলীভূত অথচ উড্ডীন। পাখা নেই ক্রিশ্চান ছবির দেবদূতদের মতো, অথচ তারা যে মর্ত্যলোকের মাধ্যাকর্ষণ বন্ধন থেকে সর্বৈব মুক্ত, তাদের ভঙ্গি দেখলে আর বিন্দুমাত্র সংশয় থাকে না। গুরুভার পদার্থকে বৈজ্ঞানিক যে উপায়ে শক্তিতে পরিণত করেন তাতে বিশ্বধ্বংসী বিস্ফোরণ হয়, শিল্পী যেভাবে করেন তাতে বিশুদ্ধ আনন্দের বিস্ফোরণ হতে থাকে, কত কাল ধরে এই উড়ন্ত জীবন্ত পাথর লঘুপক্ষ করছে মানুষকে!
অন্যরা এগিয়ে গেছে। এষা ফটো নেবার পরও নৃত্যপর শিবমূর্তিটির সামনে দাঁড়িয়ে রইল। মনে মনে নতজানু। দূর থেকে বিক্রমকে ফিরতে দেখেই সে আবার সচল হল। প্রায় ওই নটরাজের মতোই।
কৈলাস মন্দিরের বাইরে এসে নীলম বলল— ‘আমার ওই জৈন গুহা দেখবার আর শখ নেই। আমি গাড়িতে গিয়ে বসছি।’
গাইড ভদ্রলোক বললেন, ‘ম্যাডাম, ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে আসবেন এর পরে এলে। এমনিতেই ঔরঙ্গবাদ বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল বলে গরম, তারপর এ সমস্তই লাভা দিয়ে গঠিত অঞ্চল। মাটির ঘনত্ব খুব বেশি নয়।’
উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে চার জন। বিক্রম, অরিত্র গ্রুপ ফটো নিচ্ছে। এষা বলল, ‘মহানামদা, স্থাপত্য ভাস্কর্যের এতো ছবি নিলেন, আমাদের ছবি, মানুষের ছবি তো একটাও নিলেন না? মানুষের স্মৃতির তাহলে কোনও দাম নেই আপনার কাছে!’
মহানাম লজ্জিত বোকা ছেলের মতো ক্যামেরা তাক করতে বিক্রম সুদ্ধু হেসে উঠল। এষা মুখ আড়াল করে ফেলল দু হাতে, হাসতে হাসতে বলল— ‘আমার ছবি নিতে দেব না আপনাকে।’
অরিত্র বলল— ‘ভয় নেই। আমার ছবিতে তোমরা সবাই আছো। নীলম পালিয়ে গেল, কিন্তু আমার চেনা স্টুডিও আছে। ওকেও কি রকম ঢুকিয়ে নিই দ্যাখোনা।’
মহানাম বললেন—‘অরি, তুমি কি খুব ভালো ছবি তোলো? কি ক্যামেরা তোমার?
‘বহুদিন আগেকার রোলিফ্লেক্স।’
‘আমার কয়েকটা ছবি যদি ভালো না আসে তোমার প্রিন্ট থেকে দিতে পারবে?’
‘নিশ্চয়ই।’ অরিত্র বলল, ‘আপনার গাইড দক্ষিণা হিসেবেও দিতে হয়। আচ্ছা মহানামদা, আমার সত্যি কথা বলতে কি এই কৈলাসই সব চেয়ে অ্যাপীলিং মনে হল। কেন বলুন তো?’
মহানাম বললেন— ‘শিল্পকীর্তি যখন বিরাট হয়, তখন একটা আলাদা মাত্রা পায়। শ্রবণবেলগোলার মহাবীর বা মহাবলীপুরমের রথ দেখে আমার কথাটা আগেই মনে হয়েছিল। আকাশ, পৃথিবী, পাহাড়, সমুদ্র যা কিছু আমরা ঈশ্বরের সৃষ্টি বলে মনে করি, এই সব স্থাপত্য ভাস্কর্য যেন বিরাটত্ব দিয়ে তাদের কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করে।’
‘সৌকর্যটা কি কিছুই না?’ —এষা বলল—‘ধরুন মুখশ্রী, ভঙ্গি, হাতের মুদ্রা, উড়িষ্যায় যে মুক্তেশ্বর মন্দির আছে, কোণার্ক বা লিঙ্গরাজের কাছে খেলার পুতুল কিন্তু অপূর্ব।’
‘সেটাও কিছু। ধরো আকাশ, পাহাড়, সমুদ্র যদি পট হয় তো গাছপালা, সব রকমের প্রাণী, ফুল ফল ইত্যাদি তার খুঁটিনাটি। কৈলাস মন্দির সেই বিশাল বিশ্ব পটভূমির প্রতিরূপ। তার গায়ের সব কারু কাজ, রিলিফ, মূর্তি হল, ডিটেলস।’
এষা বলল— ‘দেখুন মহানামদা, পৃথিবীর, বিশেষ করে, প্রাচীন পৃথিবীর যত আর্ট সব ধর্মকে কেন্দ্র করে, অথচ সেই সুন্দরের আধারস্বরূপ ধর্মই এখন আমাদের সবচেয়ে বড় বৈরী।’
‘আসলে এষা, ধর্মও আমাদের জীবনে সেই ফাইন একসেসের জন্য আকাঙক্ষার আরেক প্রকাশ। ধর্ম আর শিল্পের পেছনে একই জাতীয় প্রেরণা কাজ করে বলে আমার ধারণা। বিস্ময়বোধ, সম্ভ্রমবোধ, বিশালের কাছে আমাদের আকিঞ্চন, সমর্পণ। এই সব কিছুর এক রকম প্রকাশ ধর্মে, আর এক রকম প্রকাশ শিল্পে, স্বভাবতই দুটো মিলে গেছে। কিন্তু যত দিন এগিয়েছে ধর্মে প্রাতিষ্ঠানিকতাদোষ, সংকীর্ণ আনুষ্ঠানিকতা ও নীতি দোষ এসে গেছে, শিল্পের সঙ্গে তার ফাঁক ততই চওড়া হয়েছে।’
অরিত্র বলল— ‘ধর্মের সংখ্যা তো ক্রমেই বেড়ে চলেছে। শুধু হিন্দু, ইসলাম, খ্রীষ্ট, বৌদ্ধ, শিখ ধর্ম নিয়ে তো চলছে না। শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব, অর্থোডক্স গ্রীক চার্চ, চার্চ অফ ইংল্যান্ড, ইউনিটেরিয়ান এ তো অজস্র ডালপালা। আজকাল আবার বাহাই ফেথ বলে একটা নতুন ধর্মের কথা শোনা যাচ্ছে। ইস্কনও তো পুরনো বৈষ্ণব সেক্ট্ বলে মনে হয় না।’
মহানাম বললেন—‘এই সব ব্যাপারগুলো যতটা সমাজতত্ত্বের আলোচ্য ততটা ধর্মতত্ত্বের নয় অরিত্র। তুমি যেগুলোর নাম করলে বেশির ভাগই অন্য একটা ধর্মের সংস্কারমূলক। খ্রীষ্টধর্ম তো আসলে জুডাইজমের সংস্কার করতে তৈরি হয়েছিল, ব্রাহ্মধর্ম, শিখধর্ম সবই হিন্দুধর্মের সংস্কারক আন্দোলন। বাহাই ফেথও ইসলামের সংস্কারমূলক বলেই আমার বিশ্বাস।’