Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পঞ্চম পুরুষ || Bani Basu » Page 11

পঞ্চম পুরুষ || Bani Basu

বিরাট রাজহাঁসের মতো সাদা ধবধবে আলো-পিছলোনো গাড়িখানা নিঃশব্দে প্রিয়লকরনগরের রাস্তায় পাশ ফিরছে। খুব রাজকীয় এই ধীর, শব্দহীন পাশ ফেরা। কিন্তু কেমন গা-ছমছমে। গাড়িটা চেনা নয়, কিন্তু বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। নীলমের এ গাড়ি বিক্রমের। কোনও গাড়িই বেশিদিন রাখে না ও, দুটো সব সময়ে মজুত থাকে স্বামীস্ত্রী দুজনের ব্যবহারের জন্য। নিজেরটা কিছুদিন অন্তরই বদলায় বিক্রম। সীমা যেটা ব্যবহার করে সেই স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড বোধহয় সে গত দশবছর ধরে ব্যবহার করছে। বিক্রমের প্রথম গাড়ি। এটা নিশ্চয় বিক্রমের সাম্প্রতিকতম সংগ্রহ। কনটেসা মনে হচ্ছে। ভেতরে সীমা আছে কি না কে জানে! দরজা খুলে সে পোর্টিকোয় দাঁড়াল। সকালবেলার ভেজানো চুল এখন শুকিয়ে গেছে। ক্লিপে আটকানো চুল। এষা আসার পর থেকে নীলম সকাল বিকেল শাড়ি পরেই থাকে। শুধু রান্না করবার সময়ে একটা এপ্রন গলিয়ে নেয়। ফিকে গোলাপি রঙের টাঙাইল শাড়ি, নীলম খুব সলজ্জ সাজ সেজেছে।

সীমা ভেতর থেকে মুখ বাড়িয়ে বলল—‘হ্যাল্‌ লো!’ এক ঝটকায় দরজা খুলে নেমে পড়ে এগিয়ে এল—‘চিনতে পারছো ড্রেসটা? নীলমদি!’

নীলম বলল—‘কেন, আমার চেনবার কথা?’

বাঃ। ছ সাত বছর আগে পুজোর সময়ে বানিয়ে দিয়েছিলে।’

ম্যাজেন্টা রং সিল্কের ওপর অলিভ গ্রীন সাটিন পাটকরা কাঁধের কাছ থেকে প্লিট দিয়ে দিয়ে নেমে এসেছে বাঁ দিক থেকে ডান দিকে। তার ওপর বাদলার কাজ। পায়েও দুরঙ।

নীলমের মনে পড়ল—সাদাতে কালোতে অবিকল এইরকম একটা পুপুকেও করে দিয়েছিল। খুব পছন্দ ছিল ওর সেটা। পরে পরে কবেই ছিঁড়ে ফেলেছে। সে আশ্চর্য হয়ে বলল—‘সাত বছর বোধহয় হল, তুমি এখনও এটাকে এইভাবে টিঁকিয়ে রেখেছো?’

সীমা বলল—‘তার আগের বছর, তার আগের বছর, তারও আগের বছরের জিনিসও নতুনের মতোই আছে। নষ্ট হবে কেন যত্ন করলে? এতো সুন্দর ড্রেস। প্রথম প্রথম পার্টি ড্রেস হিসেবেই ব্যবহার করেছি। এখন এইরকম দূরপাল্লা যেতে হলে পরি, সঙ্গে নিই।’ সীমার কথার ভঙ্গিতে খুব আত্মপ্রসাদ। বলল—‘নীলমদি, তোমাকে দারুণ দেখাচ্ছে। একটু বোধহয় রোগা হয়েছে। ভালো লাগছে। এটা কি শাড়ি? রাজকোট?’

‘উঁহু। টাঙাইল!’

‘টাঙাইল? একদম বোঝা যাচ্ছে না তো? কি মিহি খোলটা। কোত্থেকে পেলে গো?’

নীলম বলল—‘আমার বন্ধু যে এসেছে, সে-ই এনেছে।’

চওড়া টাই হাঁকিয়েছে বিক্রম। স্বভাব-ফর্সা রঙ আরও উজ্জ্বল হয়েছে। গাল-টাল থেকে যেন রক্ত ফেটে পড়ছে। নীলম বলল, ‘কি ব্যাপার, শীল সাহেব? সত্যি সত্যিই যে সাহেব হয়ে যাচ্ছেন দিন কে দিন?’

সীমা রুমাল দিয়ে মুখ মুছে বলল—রাখো রাখো, ওসব অ্যালকহলিক রঙ। প্রথমে জেল্লা দেবে, তারপর লিভার অ্যাফেক্‌ট্‌ করলেই অ্যাফ্রিকান।’

গাড়িটা থামিয়ে রেখেছিল বিক্রম। পার্ক করবার জন্য পেছোতে পেছোতে ভরাট গলায় বলল—‘খবর্দার গিন্নি, লিভার তুলে কথা বলবে না। তারপর ভাবী তোমার বাড়ি তো গেস্টে গেস্টে উপছে পড়বার কথা, এমন বাসি-বিয়ের কনের মতন একলা দাঁড়িয়ে?’

বিক্রম দুহাত ঝাড়তে ঝাড়তে নেমে এলো।

নীলম বলল—‘উপছে পড়বার কথা! সে আবার কখন বললাম। একজনই তো।’

‘বাঃ সেই একজনই যে একশজন এটুকু রীডিং বিটুইন দা লাইন্স বিক্রম শীলের করবার ক্ষমতা জরুর আছে। তেমন তেমন আদুরে-বিড়ালের মতো টেঁপা-টেঁপি গোছের কেউ এলে কি আর তুমি অধীনকে স্মরণ করতে? এ নিশ্চয়ই বাঘিনী।’ লাফিয়ে পোর্টিকোয় উঠে বিক্রম দু হাত দু পাশে রেখে বাঘিনীর মুদ্রা করল।

সীমা অপাঙ্গে দেখে বলল—‘নীলমদির বন্ধু বাঘিনী কিনা জানি না, তবে তুমি যে বাঘের বেশে শেয়াল এতে আমার কোনও সন্দেহ নেই।’

বিক্রম ছদ্ম রাগে নীলমের কাছে এগিয়ে এসে বলল—‘কথাটা তোমার বোন বা বন্ধু না জাকে ফিরিয়ে নিতে বলল ভাবী, নইলে ভীষণ ঝগড়া হয়ে যাবে, শেয়াল অতি ছ্যাঁচড়া জীব।’

নীলম হাসি চেপে বলল—‘ঝগড়াটা কার সঙ্গে করবে? আমার না সীমার?’

‘তোমার সঙ্গে ঝগড়া?’ বিক্রম হাসিতে মুখ ভরে বলল—‘আহাহা হা, ভাবী, সে তো সব সময়েই প্রণয়ের ঝগড়া। মানভঞ্জন, জয়দেব, গীত গোবিন্দ। আমার কি অত সৌভাগ্য হবে?’

দিনটা চমৎকার। রোদ এখনও গা-জ্বালা হয়ে ওঠেনি। আকাশে আজ পাতলা মেঘ আছে মনে হয়। তাই রোদের মধ্যে একটা জ্বালাহীন আলো-আলো ভাব।

বাঁক থেকে মুখ ঘুরিয়ে অরিত্রর স্কুটার এসে পৌঁছল। অরিত্র বলল—‘তুমি নেমে যাও এষা, তোমাকে থলে নামাতে হবে না। আমি বোঁ করে একবার মোড়ের দোকান থেকে আসছি।’

‘কি সিগারেট?’

অরিত্র হেসে ঘাড় নাড়ল। মুখ ঘুরিয়ে আবার চলে গেছে। বিক্রম বলল—‘চৌধুরীদা কি আমায় দেখে পিঠ্‌টান দিল নাকি ভাবী?’

এষা নেমে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন এষা পুপুর সঙ্গে বাজারে বেরোচ্ছে সকালে। আজ অরি ধরেছিল মুরগী আনতে ওর সঙ্গে এষাকে যেতেই হবে। অত বড়লোক প্রায় ঠোঁট ফুলিয়ে বসেছিল। এষার যত কথা নাকি নীলমের সঙ্গে, পুপুর সঙ্গে, অরি কি কেউ না? বানের জলে ভেসে এসেছে?

নীলম বলেছিল—‘বাব্‌বাঃ, স্টেশন থেকে প্রিয়লকরনগর এই ন দশ মাইল পথ নিয়ে এলে সেদিন একলা, পাটিলকেও তো পথের কাঁটা সরিয়ে দিলে তাতেও তোমার প্রাইভেট কথা শেষ হয়নি?’

সবাই হাসছিল। পুপু সুদ্ধু।

‘আমার কথা কোন দিন শেষ হবে না’, অরি গোঁজ হয়ে বলেছিল।

পুপু বলছিল—‘মাসি, মাসি, লুক হাউ হী ইজ পাউটিং! হী ইজ চেঞ্জিং কালার। অ্যাবসল্যুটলি গ্রীন নাউ উইথ জেলাসি। যা হয় কিছু করো মাসি। এ দুর্দশা দেখা যায় না।’

এষা বলল—‘ঠিক আছে। ঠিক আছে। তবে মুরগীর ছিটেফোঁটাও যেন আমি দেখতে না পাই। আমাকে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে হবে।’

এষা একদম মাংস খায় না। কিন্তু রাঁধতে ভালোবাসে। রবিবার ও রাঁধবে বলছিল কিছু একটা নতুন পদ। নীলমের দিকে তাকাল এষা একবার, বলল—‘নীলম, যত দূর সম্ভব তাড়াতাড়ি এসে যাবো। ভেবো না।’

‘না ওইভাবে না’—অরি তখনও গোঁজ।

‘কি হল আবার?’

ওকে সেজে আসতে হবে। গোল্ডেন সিল্কের শাড়ি। চুলে কায়দাকরা, রঙ-টঙ যা যা সব মাখো তোমরা, সেসব মাখতে হবে।

‘কি মুশকিল! গোল্ডেন সিল্কের শাড়িটা আমার লাট খেয়ে আছে। ইস্ত্রি হয়নি। সেদিন ট্রেনে পরেছিলুম’, এষা চলে গেল।

ঠিক দশ মিনিট পর কালো টিপ ছাপ গরদ রঙের পাড়হীন শাড়ি পরে, মাথার চুলে আলগা খোঁপা বেঁধে এষা বেরিয়ে এলো। কানে টলটলে মুক্তো। ঠোঁটে হালকা রঙ।

এখন ওকে সেই বেশেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল বিক্রম। পুরো একটা রসালো ক্রিমরোল। মিষ্টি ননীতে ভরা ভেতরটা, সুগন্ধে জিভে জল আসে। সূর্য সামান্য সেঁকেছে। কি নিপুণ পরিমাণজ্ঞানের সঙ্গেই যে সেঁকেছে। থাউজন্ড আই ল্যান্ড ড্রেসিং ছড়ানো চমৎকার স্যালাড এক ডিশ। মুচমুচে চিবুক। চীজ-স্ট্র-এর মতো নাকখানা, ছোট্ট ছোট্ট নাগপুরী কমলার কোয়ার মতো ঠোঁট। কানে অয়েস্টার, গালে ক্রিম পাফ কুকিজ। সব মিলিয়ে আবার ডুবো-ডুবো মাখনে বেশ নরম রসালো করে ভাজা লম্বা সোনালি বেকন এক টুকরো।

নীলম বলল—‘আলাপ করিয়ে দিই। ইনি বিক্রম শীল। বম্বের নাম্বার ওয়ান বিল্ডিং অ্যান্ড রোড কনট্র্যাকটর। আর ইনি তাঁর ভাগ্যবতী পত্নী সীমা। তোমরা তো বুঝতেই পারছ এইই এষা খান, আমাদের বন্ধু।’

‘তোমাদের বন্ধু?’ সীমা চোখ বড় বড় করে বলল। নীলম অস্বস্তিতে হাসছে। অরিত্র পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, বলল—‘এজ ক্যানট উইদার হার, নর কাস্‌টম স্টেল হার ইনফিনিট ভ্যারাইটি।’ তারপর বিক্রমের দিকে কূট চোখে তাকিয়ে বলল—‘কতক্ষণ এসেছ?’

বিক্রম কান ছোঁয়া হাসি হেসে বলল—‘আরে দাদা, ঘাবড়াইয়ে মৎ, আমি জাস্ট এইমাত্র এসে পৌঁছলাম। এখনও কিছু গড়বড় করবার মওকা পাইনি, এষার দিকে ফিরে বলল—‘বুঝলেন এষাজী, বিক্রম যায় বঙ্গে, বিক্রমের স্টেজ যায় সঙ্গে। বিক্রম এসে গেলে সেখানে আর সব জেন্টলম্যান ব্যাকগ্রাউন্ডে চলে যায়’, বুকটা চিতিয়ে বিক্রম বলল—‘তাই এইসব আতুপুতু জেন্টলম্যানরা আমাকে পছন্দ করে না একবারে। বলতে বলতে দু হাত আকাশের দিকে ছুঁড়ে বিক্রম গেয়ে উঠল—

“এলো এলো এলোরে দস্যুর দল

গর্জিয়া নামে যেন বন্যার ঢল—এল এল।”

এষা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠল—‘অদ্ভুত ভালো গলা তো!’

বিক্রম গাল কাত করে অরিত্রর দিকে চেয়ে হেসে উঠল—‘দেখলেন দাদা, দেখলে ভাবী, ফার্স্ট রাউন্ডটা কি রকম ফটাস করে জিতে গেলাম! আই কাম, আই সি, আই কঙ্কার।’

তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে অরিত্র সীমার দিকে তাকিয়ে বলল—‘তারপর সীমাচলম, তোমার খবর বলল।’

সীমা বলল, ‘বাব্‌বাঃ! আমি আবার খবর বলব কি? আমি তো জন্মের মতই এই রাহুর দ্বারা গ্রস্ত হয়ে রয়েছি। আমার কোনও আলাদা খবর হয়?’ বিক্রমের দিকে তাকিয়ে সীমা বলল—‘আমাদের আগে সব গুছিয়ে টুছিয়ে নিতে হবে তো।’

বিক্রম হাত নেড়ে বলল—‘ওসব তোমার কাজ তুমি করো গে যাও। আমি এখন একদিকে নীলম ভাবী আর একদিকে এষাজীকে নিয়ে জমিয়ে বসব। সামনে বসে চৌধুরীদা জুলজুল করে দেখবে।’

অরিত্র ছাড়া উপস্থিত সকলেই হাসতে পারল। বিক্রম প্রথম তার ব্যবসা শুরু করে পুনেতেই। সামান্য পুঁজি, আর খানিকটা অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছিল। অরিত্র ওকে অর্ডার পেতে প্রচুর সাহায্য করে। হাসি-খুশি জমাটি স্বভাবের ছেলে বলে চট করে ওকে পছন্দ হয়ে যেত সবারই। সে সময়ে অরিত্রর বাজার হাট, নীলমের সখের সভা-সমিতি, ওদের সিনেমা দেখা, ছোটখাটো ভ্রমণ সব কিছুতে বিক্রম-সীমা থাকতই। পুপুকে একরকম কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছে বিক্রম। কিন্তু অরিত্রর ধারণা, ধারণা কেন, দৃঢ় বিশ্বাস ওকে যে আস্থা ওরা দিয়েছিল তার মর্যাদা বিক্রম রাখেনি, নীলম ঠিক কতটা জড়িত ভাবতে গেলে অরিত্রর ভুরু কুঁচকে যায়। হার্ট আর ফুসফুসের মধ্যবর্তী অলিন্দটুকুতেও প্রচণ্ড টান পড়ে, ভাবতে সে চায় না তাই। কিন্তু নীলম ওকে আড়াল না করলে অরিত্র একসময়ে ওকে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দেবার কথাও ভেবেছিল, যাচ্ছেতাই অপমান করে। পারেনি। পুপু একটা মস্ত বাধা ছিল। সীমাটাও খুব নির্দোষ, মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে, ওকেও আঘাত দেবার কথা দুবার ভাবতে হয়। বিক্রমের ব্যবসা এখন ছড়াতে ছড়াতে মেন অফিস বম্বের শহরতলিতে চলে গেছে। থানে অঞ্চলে তার প্রাসাদোপম বাড়ি। কিন্তু পুনার ফ্ল্যাটও ছাড়েনি সে। অরিত্রদের সঙ্গেই এখানে জমি কিনেছিল। কয়েকটা ব্লক পরেই, ডি ওয়ান এ ফ্ল্যাট রয়েছে ওর। কেয়ারটেকার সহ। এলে সেখানেই থাকে। আসতে হয়ও মাঝে মাঝে।

একহাতে চাবি, আর একহাতে একটা সুটকেস তুলে নিয়েছে সীমা। কাঁধে ভারী ব্যাগ। অরিত্র বলল—‘চলো সীমাচল, আমি তোমাকে এগিয়ে দিচ্ছি।’

সীমা কৃতজ্ঞ চোখে চেয়ে বলল—‘দরকার নেই অরিদা, আপনি বসুন না।’

‘তা হয় না সীমা। বর্মা-চীন এসব জায়গায় শুনেছি মেয়েদের মোটঘাট বইবার ট্র্যাডিশন ছিল, আমাদের অভ্যাস অন্যরকম।’ ভালোমতো ঠেস দেওয়া হল মনে করে সে সীমার সুটকেসটা ছিনিয়ে নিল।

বিক্রম হা-হা করে হেসে উঠে বলল—‘যত গালাগালই দিন দাদা, বিক্রম শীল নড়ছে না। টাকা এনে দিচ্ছি ছপ্পর ফুঁড়ে, এতখানি পথ ড্রাইভ করে পৌঁছে দিলুম। আবার মোট বওয়াবওয়ি কি? অত পারব না।’

অরি সীমার কাঁধে হাত রেখে বলল—‘চলো সীমা।’

সীমা মেয়েটি খুব পাতলা, ছোটখাটো। ফোলা-ফোলা সাধারণ মুখচোখের মেয়ে। সাজে নিখুঁত। বম্বে পুনার বড় বড় বিউটি পারলারে গিয়ে গিয়ে মাথা থেকে পা অবধি পরিচ্ছন্ন সাজগোজের সমস্ত গোপনকথা ওর জানা হয়ে গেছে মনে হয়। কথাও বলে চটপট। কোথাও কোনও জড়তা নেই। খালি অরিত্রর মনে হয় সীমা একটা বর্ণিল বুদবুদ। যে কোনও সময়ে ফট করে ফেটে লুপ্ত হয়ে যেতে পারে। এতো ভঙ্গুর, এতো শূন্যতা দিয়ে ফাঁপানো। সে শূন্যতা চরিত্রের না অভিজ্ঞতার অতটা বলবার মতো ভালো করে সীমাকে সে কখনই জানবার তাগিদ অনুভব করেনি। খুব মমতার সঙ্গে ওর কাঁধে হাত রাখল অরি। পাতলা কাঁধ, ভয় হয় সামান্য চাপেই না ভেঙে যায়। একে সুটকেস হাতে দিয়ে পাঠাল কি করে বিক্রমটা? জানোয়ার একটা। একে এতো কষ্টই বা দেয় কি করে লোকটা? জানোয়ারও নয়, পিশাচ।

সীমা বলল, ‘কি এতো ভাবছেন অরিদা!’

‘কিছু না। তোমরা কি কেয়ার-টেকারকে খবর দিতে পেরেছো?’

‘ইদানীং আমাদের তো আলাদা কেয়ার-টেকার নেই। ডি ওয়ানের কমন দারোয়ান মোহন, ওরই কাছে আমাদের চাবি থাকে। ওকে ফোন করেছি কাল। ও-ই সব পরিষ্কার করে রাখবে। আপনাদের বাড়ি তো ছোট। ইচ্ছে করলে এষাদিকে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে পারেন। একটা বেডরুম পুরো পড়ে থাকবে।’

—‘না, না।’ আতঙ্কের সুরে অরিত্র বলল—তারপর একটু শান্ত হয়ে বলল—‘এষা আমাদের বাড়িতে এসেছে। তোমাদের ওখানে পাঠালে কি মনে করবে বলো তো? তার কোনও দরকারও নেই। আর এম টি ডি সি-র সঙ্গে যোগাযোগ করেছি—কাল পরশুর মধ্যেই আমাদের বেরিয়ে পড়ার কথা।’

‘কোথায় কোথায় যাচ্ছেন? কে কে?’

ওদের বাড়ি এসে গিয়েছিল। দোতলার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে, দরজা খুলে বেশ খুশি হয়ে উঠল সীমা। বলল—‘বসুন অরিদা, আমি একটু মোহনের সঙ্গে কথা বলে আসি, দরকার আছে।’

একটু পরেই ফিরে এলো সীমা। অরি দেখল ওর মুখে একটা ছায়া আসা-যাওয়া করছে। বলল—‘অরিদা, ওযে ইতিমধ্যে একবার এসেছিল আপনি জানতেন?’

অরিত্র বলল—‘না তো! আমাদের বাড়িতে তো দেখি নি! রাস্তা ঘাটেও না।’

—‘মোহন বলছে সাহেব এসেছিলেন।’

অরি বুঝতে পারছে সীমার গলা শুকিয়ে গেছে। সীমা চট করে হল পার হয়ে ওদিকে চলে গেল। শোবার ঘরের দরজাটা খুলল। অরির দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। অতি ভঙ্গুর এবং অসহায় বালিকার মতো দেখাচ্ছে। কি খুঁজছে সীমা? বিক্রম কি কোনও কিছুর প্রমাণ রেখে যাবে? গেলেই বা কি? সীমার কিছু করার আছে?

অরিত্র বলল—‘কি করছ সীমাচল? এবার কি আনপ্যাক করবে? আমি সাহায্য করতে পারি।’

সীমা পেছন ফিরেই বলল —‘না আমি করে নিচ্ছি। সবই ঠিক আছে। কিচেনটা একবার দেখে আসি।’

রান্নাঘর থেকে ঘুরে এলো সীমা। আসলে ও ছটফট করছে। বলল—‘আপনি বরং চলে যান অরিদা, বাড়িতে আপনার বন্ধু এসেছেন, আমি যেটুকু গুছিয়ে নেওয়ার নিচ্ছি।’

অরিত্রর মায়া হচ্ছে খুব, বলল—‘আমার তাড়া নেই। দুজনে এক সঙ্গেই ফিরব। তোমার এতো কি করার আছে? চট করে নাও। নীলমের কাছে গিয়ে চা-টা খাবে। তেষ্টা পেয়েছে তো?’

সীমা ওয়ার্ডরোব খুলে নিজেদের জামাকাপড়গুলো টাঙিয়ে রাখল। ফ্রিজ বোঝাই মদ এনে সাজিয়ে রেখেছে মোহন। কৌটোর খাবার। চট করে একটু কফি তৈরি করে ফেলল সে, অরিত্রকে অবাক করে দিয়ে রান্নাঘর থেকে ধূমায়িত কফি নিয়ে ফিরল। সামনে রেখে বলল—‘তেষ্টা আসলে আপনারই পেয়েছে না অরিদা?’

‘তোমার পায়নি?’

‘ভীষণ ভীষণ। এই কফি খেলেও আমার গলা ভিজবে না অরিদা।’ সীমাচলম্‌ কি রকম অদ্ভুত গলায় বলল।

‘ওঃ ভুলে গেছি’, সে আবার উঠে গেল রান্নাঘরে—এক প্লেট বিস্কুট নিয়ে ফিরল।

‘কফির সঙ্গে বিস্কিট নিন অরিদা, শুধু খাওয়া ঠিক না। তারপর বলুন কে কে যাচ্ছেন, কোথায় কোথায়।’

‘খুব সম্ভব আমরা কাল রাতের বাসে ঔরঙ্গাবাদ যাচ্ছি। ভোরে পৌছে ওদের টুরিজম-এর বাসটা নেবো। দুটো দিন। প্রথম দিন ইলোরা, দ্বিতীয় দিন অজন্তা। এই তো আপাতত প্রোগ্রাম। যাচ্ছি আমি, এষা, আর আমাদের এক পুরনো মাস্টারমশাই ডক্টর রায়, উনিও রয়েছেন এখন পুনেয়।’

‘নীলমদি যাচ্ছে না? পুপু?’

‘নাঃ। নীলম যাচ্ছে না পুপুর পরীক্ষা বলেই। পুপুর এ সেমিস্টারের পরীক্ষা রয়েছে।’

‘কালই যদি আপনারা বেড়াতে বেরোন তো আমাদের ডেকে আনার কি দরকার ছিল?’ অনুযোগের সুরে বলল সীমা।

‘নীলম ঠিক কি ভেবে কি করেছে আমি তো জানি না। তাছাড়া দুদিন পরই তো আমরা ফিরে আসছি। তোমরাও তো যেতে পারো।’

‘বাঃ, আমরা টিকিট কি করে পাবো? চলুন, তাহলে ওকে এক্ষুণি গিয়ে বলি।’

অরিত্রর মনে হল ও একটা দারুণ উভয় সঙ্কটের মধ্যে পড়ে গেছে। বিক্রমকে সঙ্গে নিতে ওর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। অথচ ওরা সবাই চলে যাবে বিক্রমকে পেছনে ফেলে, আবারও ওর ঘরসংসার প্রায় বিক্রমের কাছে গচ্ছিত রেখে, সেটাও তো সম্ভব নয়।

হঠাৎ অরিত্র খুব চঞ্চল বোধ করল। ভেতরের চঞ্চলতাকে যথাসম্ভব চাপা দেবার চেষ্টা করে সে বলল—‘সীমা, তোমার যদি খুব দেরি থাকে তো আমি এগোচ্ছি।’ উঠে দাঁড়িয়ে আবার বলল—‘তুমি কিন্তু তাড়াতাড়ি এসো।’

অরিত্র চলে গেলে দরজা বন্ধ করে দিল সীমা। দামী দামী জিনিসে ভর্তি হলঘর। মাঝখানে ঝাড়বাতি জ্বলছে। আলো ছড়িয়ে পড়েছে এনসাইক্লোপিডিয়ার সেটের ওপর ঘুরন্ত বুককেসে, প্রত্যেকটা দেয়ালে একটা করে মূর্তি কিম্বা গাছ। মাঝে মাঝে নীচু সোফা। মোরাদাবাদী পেতলের পরাতের মতো টপওয়ালা তিনপায়া টেবিল। হঠাৎ দেখলে মনে হবে কোনও শিল্পগতপ্রাণ মানুষের ঘরে এসে পড়া গেছে। কিন্তু এ বাড়ির মালিক মোটেই শিল্পরসিক-টসিক নয়। মালকিনও এসব খুব বোঝে না। যে গৃহসজ্জাবিশারদকে দিয়ে এটা করানো হয়েছিল সে তার সাধ-না-মেটা ভালোবাসাগুলো দিয়ে ঘর সাজিয়েছে। গৃহসজ্জার একটা কোর্স সীমাও নিচ্ছিল, তার কিচ্ছু করবার নেই বলে। কিন্তু যতক্ষণ সে তার কোর্স নিয়ে ব্যস্ত থাকত, বিক্রমের বিপথগামিতার সে সময়টা ছিল সুবর্ণসুযোগ। তাই মাঝপথে কোর্স ছেড়ে দিয়ে আবার বাড়ি এসে বসল সীমা।

সীমা দেখল সে কাঁদছে। চোখ দিয়ে জল পড়ছে, বুক জ্বালা করছে। অথচ সেটা সে প্রথমে বুঝতেই পারেনি। শোবার ঘরের মধ্যে সে এমন কিছু কিছু জিনিস পেয়েছে, তাতে তার স্বামীর বিশ্বস্ততাহীনতার খবর আবার নতুন করে তার কাছে পৌঁছেছে। মোহন প্রাণ গেলেও কিছু বলবে না। যেটুকু বলেছে না জেনে বলে ফেলেছে।

সীমা বাথরুমে গিয়ে তার গোলাপি বেসিনে বিদেশী সাবান দিয়ে মুখ ধুল। ফেনায় ফেনায় মুখটা ঢেকে যেতেই সামান্য চোখ ফাঁক করে আয়নার দিকে তাকিয়ে রইল। বাথরুমের গোলাপি টালি, মৃদু আলোর মহিমায় আয়নার ফেনা-ঢাকা মুখটিকে কোনও স্বপ্নের মুখ বলে মনে হচ্ছে, ফেনাগুলো ধুয়ে দিলে হয়ত বেরিয়ে পড়বে কোনও অসাধারণ মায়াবিনী কুহকিনী ব্যক্তিত্বময়ী মুখ যার চোখের ইঙ্গিতে পৃথিবীতে ভাঙাগড়া হয়। এদের কথা সবাই জানে, সীমাও জানে। ক্লিওপেট্রা, নূরজাহান, এমন কি মাতাহারি। প্রত্যেকবার মুখে সাবান লাগালে সীমার এদের কথা মনে পড়ে। আস্তে আস্তে খুব অনিচ্ছুক ভাবে মুখে জল লাগাতে লাগাতে সীমা দেখতে লাগল কি ভাবে একটি আশাহত বালিকা মুখ ক্রমশ আত্মপ্রকাশ করে।

গাছের ওপর দাদা বসে আছে। পেয়ারা ফেলছে আর বলছে—‘নে সীমা, ধর।’ কিছুক্ষণ পর সীমা বলছে—‘আমিও গাছে চড়ব।’

দাদা বলছে—‘হুঃ। উনি গাছে চড়বেন। যেখানে আছিস সেখানেই থাক বলছি।’ আসলে মাত্র দু বছরের বড় দাদাকে সব সময়ে উঁচুতে দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিল সীমা। নিজের মনের মধ্যে সবসময় একটা হীনতাবোধ। যেন দাদা চিরকাল উঁচুতে, দাতা। সে চিরকাল নিচুতে; গ্রহীতা। সেদিন পেয়ারা গাছে জোর করে উঠতে গিয়ে প্রচণ্ড কাঠ-পিঁপড়ের কামড়ে পা ফুলে ঢোল। দাদা বলছিল—‘আর কোনদিন উঠবি আমার গাছে? উঠবি আর? যা রয় সয় তাই করিস।’ সীমার বাবা আসছেন সপ্তাহশেষে। কিম্বা চলে যাচ্ছেন, ট্রেনে। জমি থেকে উঁচুতে। সীমার থেকে উঁচুতে। অনেক দূর থেকে আসছেন, অনেক দূরে চলে যাচ্ছেন। নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না।

বাবা বা দাদা কাছাকাছি থাকলেই সব নিরাপদ। আর যেন ভয় নেই। কেউ আর কিছু করতে পারবে না। বিক্রমের পাশেও সীমা একটা অণুর মতো। বিক্রম যা যা করবে সীমাকে তা নিঃশব্দে মেনে নিতে হবে। নয়ত এই নিরাপত্তার বৃত্ত থেকে সে দূরে, বহু দূরে গিয়ে ছিটকে পড়তে পারে। সে এক মহা ভয়। বিক্রম কী আশ্চর্য! ছিল মফঃস্বলের গানের মাস্টার। জলসায় গান গাইত খোলা গলায়, আর আশপাশের বাড়ি থেকে ঢালাও নেমন্তন্ন পেতো। মগরা থেকে বালি সাপ্লাই দিতে আরম্ভ করল। লরিও নিজের না। বালিও নিজের না। একদম খালি হাতে শুধু কথার জোরে কনট্র্যাক্টগুলো যোগাড় করত। তারপর সীমাকে নিয়ে সাহসে বুক বেঁধে একেবারে বম্বে মেল। কী অসাধারণ শক্তি, সাহস, ক্ষমতা! সীমা বম্বে ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়েছে, পুনেতে নিউট্রিশন কোর্স করেছে, বিউটিশিয়ান্‌স্ কোর্স করেছে, কিন্তু বিক্রমের সমকক্ষ হবার তার সাধ্যও নেই। সেই ছোটবেলার স্বপ্নে দেখা রাজপুত্তুরই জুটল, খালি রূপকথার মিলনান্ত শেষ অংশটায় একটা চিরকালীন প্রশ্নচিহ্ন থেকে গেল, যার জন্য সীমা মাঝে মাঝে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে যায়, মাথার চুলগুলো টেনে টেনে ছেঁড়ে, এত ব্যথা, এত অস্বস্তি তার সারা শরীরে, মনে। ছেলেটাকে পর্যন্ত কিছুতেই কাছে রাখে না বিক্রম, প্রথমে উটিতে পড়াচ্ছিল, এখন পাঠিয়ে দিয়েছে সুদূর দেরাদুন।

ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে দিনের বেলায় অন্ধকার মাড়িয়ে মাড়িয়ে দূরে শুধু অরিদার বাড়ির আলোর দিকে চোখ রেখে যেন ভূতাবিষ্টের মতো পথ চলতে লাগল সীমাচল। নীলমদি কি সুখী! অরিদা কি ভালো! কত স্নেহ, মায়া, মমতা! অরিদা বরাবর তাকে ভালোবাসেন। যখন তারা পুনেয় থাকত, পাশাপাশি বাড়িতে! অরিদার এততা বাড়বাড়ন্ত হয়নি, বিক্রমের তো হয়নি বটেই! অরিদা নিজের বোনের মতো স্নেহ করেন সেই থেকে। আজ এই সবাই বসে গল্প করছে। বিক্রমের অবহেলা স্পষ্ট। এই অপমানের মধ্যে অরিদা তার সুটকেস তুলে নিয়ে সঙ্গে এলেন, এতক্ষণ বসে রইলেন। মনে মনে সীমার জীবনের দুঃখ কি কিছু বোঝেন। বুঝলেও প্রকাশ করেন না। খালি স্নেহ আর দরদ দিয়ে মুছে দিতে চান। সীমার মনে হল তার বুকের সমস্ত কান্না অরিদাকে লক্ষ্য করে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছে। ওইখানে, একমাত্র অরিদার ওই দরদভরা বুকেই এই অপমান, অবহেলা, নিত্যদিনের এই দুঃসহ ঈর্ষার জ্বালা, যন্ত্রণার স্থান হবে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress