কঙ্কণার মুখুয্যেবাবু
কঙ্কণার মুখুয্যেবাবু ঠিক ওই কথাটা বলেন নাই।
দৌলত শেখকে তিনিই ডাকিয়াছিলেন। শেখজী অর্থশালী লোক; বর্তমানে তাহার চামড়ার ব্যবসায় সুপ্রতিষ্ঠিত এবং বেশ সমৃদ্ধ। স্বজাতি সম্প্রদায়ের লোক না হইলেও বর্তমান সমাজে ধনীতে ধনীতে একটি লৌকিকতার সম্বন্ধ আছে; সেই সূত্রে মুখুয্যেবাবুদের সঙ্গে, শ্ৰীহরির সঙ্গে এবং অন্য জমিদার, মহাজনের সঙ্গে হাজী সাহেবের সৌহার্দ্য আছে। এ ছাড়া শেখজী মুখুয্যেবাবুদের একজন বিশিষ্ট প্রজা; তাঁহাদের সেরেস্তায় দৌলত শেখের নামে খাজনার অঙ্কটা বেশ মোটা। ধনী দৌলতের সঙ্গে গ্রামের সাধারণ লোকের মনের অমিলের কথাও মুখুয্যেবাবুরা জানেন। তাই শেখজীকে তারা ডাকিয়াছিলেন।
জংশন শহরে থানার দারোগাবাবু ও জমিদারবাবু ক্রমবর্ধমান পাথরের মত ভারী এবং মূক হইয়া উঠিতেছেন। ডায়রি করিতে গেলে ডায়রি করিয়া লন—কোনো কথা বলেন না। মুখুয্যেবাবুদের বাড়ি হইতে একটা দশ-পনের সের মাছ পাঠানো হইয়াছিল, তাহারা ফেরত দিয়াছেন। নায়েবকে পরিষ্কার বলিয়া দিয়াছেনহাওয়া যে রকম গরম, তাতে হজম হবে না মশায়। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে টেলিগ্রাম গিয়েছে, কমিশনারের কাছে টেলিগ্রাম গিয়েছে। বাপ রে। আবার শুনছি নাকি মিনিস্টারের কাছেও যাবে টেলিগ্রাম। ওসব আর আনবেন না দয়া করে।
পরশু তারিখে সার্কেল অফিসার সফরে আসিয়াছিলেন ইউনিয়ন বোর্ড পরিদর্শনে। তিনি শুধু তিনি কেন, সরকারি কর্মচারীমাত্রই এসডিও, ডিএসপি, মধ্যে মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সাহেব পর্যন্ত এ অঞ্চলে আসিলেই কঙ্কণার বাবুদের ইংরাজি-কেতায় সাজানো দেবোত্তরের গেস্ট-হাউসে উঠিয়া আতিথ্য স্বীকার করিয়া থাকেন। সরকারের ঘরে বাবুদের নামডাক যথেষ্ট, লোকহিতকর কাজও তাহাদের যথেষ্ট আছে, স্কুল হাসপাতাল বালিকা বিদ্যালয় তাহাদের দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত। সরকারি কাজে সঁদার খাতায় তাঁহাদের নাম সর্বদাই উপরের দিকেই থাকে। তাহারা যে পথে চলিয়া থাকেন, সে পথটি বাহ্যত স্পষ্ট আইনের পথ। টাকা ধার দেন, সুদলন। খাজনা বাকি পড়িলে অমার্জনীয় কঠোরতার সঙ্গে সুদ আদায় করেন, নালিশ করেন। বৃদ্ধির ব্যাপারেও মুখুয্যেবাবুরা আদালতের মধ্য দিয়া চলিতেছেন! বেআইনী আদায় হয়ত কিছু আছে, কিন্তু সেও এমনভাবে আইনের গঙ্গাজল প্ৰক্ষেপে শুদ্ধ হইয়া যায় যে সে আদায়ের অসিদ্ধতা অশুদ্ধতার কথা কখনও উঠিতেও পায় না। যেমন দেবোত্তরের পার্বণী আদায়, খারিজফি বাবদ উদ্বৃত্ত আদায় ইত্যাদি; এই আদায়ের জন্য বাবুদের জবরদস্তি নাই। শুধু পার্বণী না দিলে টাকা আদায় লনও না, দেনও না। নালওয়া বা না-দেওয়াটা ইচ্ছাধীন, বেআইনী নয়। এবং পরিশেষে বাধ্য হইয়া আদালতে যান এবং অন্যকে যাইতে বাধ্য করেন; তাহাও বেআইনী নয়। সুতরাং আইনের ক্ষুরধারে যাহারা চলিয়া থাকেন—সঁহাদের নিকট মাথা কামাইতে আসিয়া দুই-এক বিন্দু রক্তপাত সকলে মানিয়া লইয়াছে। ইহার উপর সরকারের প্রতি বাবুদের ভক্তিশ্রদ্ধার কথা লর্ড কর্নওয়ালিসের আমল হইতে আজ পর্যন্ত এ জেলার প্রত্যেক সাহেব বিশেষভাবে উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। সেইজন্যই রাজভক্ত বাবুদের অতিথি-নিকেতনে আতিথ্য স্বীকার করাকে তাহারা কিছু অন্যায় মনে করেন না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, পরশু তারিখে সার্কেল-অফিসার এখানে আসিয়াও বাবুদের অতিথি-নিকেতনে আতিথ্য স্বীকার করেন নাই। মুখুয্যেবাবু দুইটা কারণে সচকিত হইয়া উঠিলেন। দেশ-কালের কোথায় কি যেন পরিবর্তন ঘটিয়া গিয়াছে এবং তিনি জানিতে পারেন নাই। প্রজাদের টেলিগ্রামের মূল্য যেন অনেক বাড়িয়া গিয়াছে। মামলার কূট-কৌশল প্রজাদের সঙ্ঘবদ্ধ শক্তির কাছে আজ যেন অত্যন্ত দুর্বল বলিয়া মনে হইতেছে। অথচ পঁয়ত্রিশ বৎসর পূর্বে এখান হইতে ছয় মাইল দূরবর্তী গ্রামের জমিদার প্রজাদের জনতার উপর গুলি চালাইয়া তৎক্ষণাৎ ঘোড়ায় করিয়া সদরে গিয়া সাহেবকে সেলাম দিয়া প্ৰমাণ করিলেন—তিনি ঘটনার সময় সদরে ছিলেন। প্রজাদের মামলা ফাঁসিয়া গিয়াছিল। ঘরে বসিয়া তিনি অনুভব করিলেন রাজশক্তি যেন এই সঙ্বদ্ধ প্রজাদের তার পাইয়া চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনিও চঞ্চল হইয়া পড়িলেন।
দেবুকে ইহাদের সঙ্গ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়াও বিশেষ ফল হয় নাই। একেবারে হয় নাই। তা নয়, তবে যেটুকু হইয়াছে তাহার মূল্য খুব বেশি নয়, অন্তত তাহার তাই মনে হইল। অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া তিনি দৌলত শেখকে আহ্বান করিয়া পাঠাইলেন।
শেখজীর বয়স ষাট বৎসর পার হইয়া গেলেও এখনও দেহ বেশ সমর্থ আছে। মাঝারি আকারের একটা ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হইয়া এখনও যাওয়া-আসা করেন, সেই ঘোড়াটায়। চড়িয়া শেখজী বাবুদের কাছারিতে উঠিলেন। বাবু সমাদর করিয়া তাঁহাকে বসাইলেন।
দৌলত শেখও রহম এবং ইরসাদকে ভাল চোখে দেখেন না। তিনি বলিলেন ভুল খানিকটা করেছেন কর্তা। চুরি করে তালগাছটা বেচলে একটা চুরির চার্জে নালিশ করে দিলেই ঠিক হত।
কর্তা বলিলেনসে তো করবই—এখন তোমায় ডেকেছি, তুমি কুসুমপুরের মাতব্বর লোক, তুমি ওদের বুঝিয়ে দাও যে, ব্যাপারটা ভাল করছে না। আমার কিছুই হবে না এতে। সাহেব তদন্তে এলেও বিনা মামলায় কিছু করতে পারবে না। মামলা হাইকোর্ট পর্যন্ত চলে। মিথ্যে নালিশ হাইকোর্টে টিকবে না। তা ছাড়া হাইকোর্টের মামলা ধান বেচে হয় না।
দাড়িতে হাল বুলাইয়া শেখ বলিল—দেখেন কর্তা, আমাকে বলা আপনার মিছা। রহম শেখ হল বদমাস বেতমিজ লোক; ইরসাদ দুকলম লিখাপড়া শিখে নামের আগে লিখে মৌলভী; ফরজ জানে না কলেমা জানে না নিজেরে বলে মোমেন। আমি হাজী হজ করে আসছি—বয়স হল। ষাট, আমাকে বলে—বুড়া সুদ খায়, লোকেরে ঠকায়-উ হাজী নয়, কাফের। আমি বললে উয়ারা শুনবেই না!
কর্তা বলিলেন—ভাল। তুমি গ্রামের মাতব্বর লোক—আমাদের সঙ্গে অনেক দিনের সুবাদ তোমার, তাই তোমাকে বললাম। এর পর আমাকে তুমি দোষ দিয়ো না। রহম-ইরসাদ আর তার দলে যাবা আছে, এ অঞ্চল থেকে আমি তাদের বাস তুলে ছাড়ব। বলিয়াই মুখুয্যে-কর্তা উঠিয়া গেলেন। দৌলত শেখের সঙ্গে আর বাক্যালাপও করিলেন না। তাহার মনে হইল হাজী ইচ্ছা করিয়াই ব্যাপারটা হইতে সরিয়া থাকিতে চাহিতেছে। কঙ্কণার তাহার ছোটখাটো সমধর্মীদের মত শেখজীও বোধহয় তিনি বিব্রত হওয়ায় আনন্দ উপভোগ করিতেছে।
দৌলত শেখ কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিয়া উঠিল। অবহেলাটা তাহার গায়ে বড় লাগিল। বুড়া ঘোড়ায় চড়িয়া ফিরিবার পথে বারবার তাহার ইচ্ছা হইল সে-ও রহম এবং ইরসাদদের সঙ্গে যোগ দেয়। সে জীবনে নিতান্ত সামান্য অবস্থা হইতে বড় হইয়াছে। বহু পরিশ্রম করিয়াছে, বহু লোকের সহিত কারবার করিয়াছে, বহুজনের মন তাহাকে রাখিতে হইয়াছে। মানুষকে বুঝিবার একটা ক্ষমতা তাহার জন্মিয়া গিয়াছে। সে বেশ বুঝিল—আজ রহম এবং ইরসাদ তাহাকে মানে না—সে তাহাদিগকে মানাইতে পারে না।ওই সত্যটা জানিবার পর মুখুয্যেবাবু আর তাহাকে মান্য করিবার প্রয়োজন অনুভব করিলেন না। আজ একটা বিপাকের সৃষ্টি করিয়া সামান্য রহম। ও ইরসাদ বাবুর কাছে তাহার চেয়েও বড় হইয়া উঠিয়াছে। হঠাৎ তাহার মনে হইল-রহম এবং ইরসাদকে সে যদি বাগ মানাইয়া আপনার আয়ত্তে আনিতে পারে তবে এ অঞ্চলের ধুরন্ধর কর্তাটিকে ছিপে-গাথা হাঙ্গরের মত খেলাইয়া লইতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে তাহার হাসি আসিল। মুখুয্যেবাবু শের ছিল, হঠাৎ যেন শিয়াল বনিয়া গিয়াছে। যখন তাহাকে বলিল রহম ইরসাদ। আর তার দলে যারা আছে এ অঞ্চল থেকে তাদের বাস তুলে ছাড়ববাবুর তখনকার গলার আওয়াজটা পর্যন্ত হালকা হইয়া গিয়াছিল। শাসনিটা নিতান্তই মৌখিক। মুখুয্যেবাবুর মুখখানা পর্যন্ত ফ্যাকাশে হইয়া গিয়াছে। আরে হায় রে, হায় রে মুখুয্যেবাবু! তুমি দেখিতেছি বাঘের খাল ( চামড়া) পরিয়া থাক—আসলে তুমি ভেড়া! রহম আর ইরসাদকে ভয় কর তুমি? ফুঃ ফুঃ!
ঘোড়ার পিঠে বসিয়া আপন মনে হাজী সাহেব বারকয়েক ফুঃ ফুঃ শব্দ করিল। ইরসাদরহম? তাদের মুরদ কি? মুখুয্যেবাবুদের মত তাহার যদি টাকা থাকিত, তবে সে কোনদিন ওই অসভ্য বেতমিজ দুইটাকে সাফ করিয়া দিত। মানুষের খাল (চাড়মা) দাগাবাত (পরিষ্কার করিতে নাই, নইলে উহাদের খাল ছাড়াইয়া দাগাবাত করিয়া তাহার কারবারের চামড়ার সঙ্গে মিশাইয়া দিত। ইরসাদ-রহমের মুরদ কি?
গ্রামে ঢুকিয়া দৌলত শেখ অবাক হইয়া গেল। গ্রাম লোকে-লোকারণ্য হইয়া গিয়াছে। শিবকালীপুর, মহাগ্রাম, দেখুড়িয়ার হিন্দু চাষীরা আসিয়া জমিয়াছে, গ্রামের মুসলমান চাষীরা সকলে হাজির আছে; মাঝখানে ইরসাদ, রহম, শিবকালীপুরের জগন ডাক্তার, দেখুড়িয়ার তিনকড়ি। সে ঘোড়ার লাগামটা টানিয়া ধরিল। দেবু ঘোষ নাই। মুখুয্যেবাবু ও-চালটা মন্দ চালে নাই! ওদিকে শ্রীহরি ঘোষও চালিয়াছে ভাল চাল; ঘোড়াটা বসিয়া গিয়াছে।
জগন ডাক্তার মুখফোঁড় লোক-ধনীর উপর তাহার অত্যন্ত আক্রোশ, সে দৌলতকে দাঁড়াইতে দেখিয়া হাসিয়া রহস্য করিয়াই বলিল—শেখজী কঙ্কণা গিয়েছিলেন নাকি হাওয়া খেতে? মুখুয্যে-বাড়ি? বেশ! বেশ!
উপস্থিত জনমণ্ডলীর মধ্যে সঙ্গে সঙ্গে বেশ একটি হাসির কানাকানি পড়িয়া গেল।
শেখের আপাদমস্তক জ্বলিয়া উঠিল। এই উদ্ধত ডাক্তারটির কথাবার্তার ধরনই এই রকম। কিন্তু এইসব নগণ্য চাষী—যাহারা সেদিনও ধান-ধান করিয়া কুত্তার মত তাহার দুয়ারে আসিয়া লেজ নাড়িয়াছে তাহারাও তাহাকে উপেক্ষা করিয়া হাসিতেছে। তাহার ইচ্ছা হইল মুখুয্যেবাবুর। সংকল্পের কথাটা একবার হতভাগ্যদের শুনাইয়া দেয়।
রহম এবার হাসিয়া বলিল—কি বড়-ভাই, কথা বলছেন না যি গো?
জগন ডাক্তার বলিল-শেখজী দেখছেন কে কে আছে এখানে। কাল আবার যাবেন তো, গিয়ে নামগুলো বলতে হবে বাবুকে। রিপোর্ট করতে হবে।
দৌলতের চোখ দুইটা জ্বলিয়া উঠিল। সে হাজী, হজ্ব করিয়া আসিয়াছে, মুসলমান সমাজে তাহার একটা সম্মান প্রাপ্য আছে। রহম-ইরসাদই এতদিন তাহাকে অমান্য করি; বলিত টাকা থাকলেই জাহাজের টিকিট কেটে মক্কা শরিফ যাওয়া যায়। হজ করে এসেও যে সুদ খায়, লোকের সম্পত্তি ঠকিয়ে নেয়-হজের পুণ্যি তার বরবাদ হয়ে গিয়েছে। তাকে মানি না। তাহাদের সেই অবজ্ঞা সমস্ত লোকের মধ্যে সঞ্চারিত হইতেছে। সে সঞ্চরণ তাহাকে কোন স্তরে টানিয়া নামাইতে চাহিতেছে, তাহা সুস্পষ্ট দেখিতে পাইল সে। চাকলার হিন্দুরা সমেত তাহাকে উপহাস করে, অশ্রদ্ধা করে।
ইরসাদ বলিল—কি চাচা, গরিবানদের সাথে কথাই বলেন নি গো!
দৌলত বলিল—কি বুলব ইরসাদ, বুলতে শরম লাগছে আমার।
জগন বলিয়া উঠিল—আরে বাপরে! শেখজীর শরম লাগছে যখন তখন নাজানি সে কি কথা!
দৌলত বলিল তুমার সাথে আমার কোনো বাত নাই ডাক্তার। আমি বলছি রহমকে আর ইরসাদকে-আমার জাতভাইদিগে। আমাদিগের বড় সর্বনাশ! এখানে কি সাধে দৌড়াইছি? শুন। হে রহম, তুমিও শুন ইরসাদ, আজ মুখুয্যেবাবু আমাকে বললে—তুমি বলিয়ে দৌলত, তুমাদের জাতভাইদিগে হাঙ্গামা সহজে মিটিয়ে না নিলে, তামাম কুসুমপুর আমি ছারখার করে দেব।
গ্রামের লোকের পরিবর্তে জাতভাই এবং যাহারা হাঙ্গামা করবে তাহাদের পরিবর্তে তামাম কুসুমপুর বলিয়া দৌলত নিজেও রহম-ইরসাদের আত্মীয় হইবার চেষ্টা করি।
রহম গোয়ার-গোবিন্দ লোক, সে সঙ্গে সঙ্গে বলিল—তামাম কুসুমপুর ছারখার করে দিবে?
ইরসাদ হাসিয়া বলিল—আপনি—আপনি তো মিয়া মোকাদিম লোক, বাবুদের সঙ্গে দহরম-মহরম—তামাম কুসুমপুর গেলেও আপনি থাকবেন। আপনার ভয় কি?
–না। আমিও থাকব না। আমারেও বাদ দিবে না রে! আমি বুললাম-আমি বুড়ো হলাম কর্তা, আমার আর কয়টা দিনঃ মুসলমান হয়ে মুসলমানের সর্বনাশ আমি দেখতে পারব না। বাবু বুললে—তবে তুমিও থাকবা না দৌলত, কুসুমপুরে আমি হিদুর গা বসাব। ওই জগন ডাক্তারই তখুন ই গাঁয়ে এসে ভিটে তুলবে। দেবু ঘোষও আসবে। দেখুড়ার তিনুও আসবে। ব্যাপারটা বুঝেছ?
সঙ্গে সঙ্গে ভেলকি খেলিয়া গেল।
সঙ্ঘবদ্ধ জনতা দুই ভাগ হইয়া পরস্পরের দিকে প্রথমটা চাহিল বেদনাতুর দৃষ্টিতে, তারপর চাহিল সন্দেহপূৰ্ণ নেত্রে।
জগন প্রতিবাদ করিয়া একবার কিছু বলিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু শুধু—কক্ষণও না—এই কথাটি ছাড়া আর কোনো কথা খুঁজিয়া পাইল না।
রহম উঠিয়া দাঁড়াইল। দেহে তার প্রচণ্ড শক্তি, উদ্ধত কোপন স্বভাব তাহার উপর রমজানের রোজার উপবাসে মস্তিষ্ক উষ্ণ, স্নায়ুমণ্ডলী অত্যন্ত তীক্ষ্ণ হইয়া আছে—সে যেন ক্ষেপিয়া গেল। চিৎকার করিয়া সদম্ভে বলিল—তা হলে চাকলার হিদুর গগুলানও আমরা ছারখার করে দিব।
দারুণ হট্টগোলের মধ্যে মিটিং ভাঙিয়া গেল।
রমজানের পবিত্র মাস। রমজের অর্থ জ্বলিয়া যাওয়া। রমজানের মাসে রোজার উপবাসের কৃচ্ছ্বসাধনের বহ্নিতে মানুষের পাপ পুড়িয়া ভস্ম হইয়া যায়। আগুনে পুড়িয়া লোহার যেমন জংমরিচার কলঙ্ক নষ্ট হয়—তেমনি ভাবেই ক্ষুধার আগুনে পুড়িয়া মানুষ খাঁটি হইবে এই শাস্ত্রের উদ্দেশ্য। এই সময়টিতে উপবাসক্লিষ্ট মুসলমানদের মনে দৌলতের ওই কথাটা বারুদখানায় অগ্নিসংযোগের কাজ করিল।
হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেও উত্তেজনা নেহাত অল্প ছিল না। গ্রামে গ্রামে লোক জটলা পাকাইতে আরম্ভ করিল।
ইহার উপর দিন দিন নূতন নূতন গুজব রটিতে লাগিল—ভীষণ আশঙ্কাজনক গুজব। কোথা হইতে ইহার উদ্ভব তাহার সন্ধান কেহ করিল না, সম্ভব-অসম্ভব বিচার করিয়া দেখিল না। উত্তেজনার উপর উত্তেজনায়—দুই সম্প্রদায়ই মাতিয়া উঠিল।
থানায় ক্রমাগত ডায়রি হইতেছে। টেলিগ্রামের পর টেলিগ্রাম যাইতেছে, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে, কমিশনারের কাছে, মুসলিম লীগের অফিসে, হিন্দু মহাসভায়। বাবুদের মোটর গাড়িটা এই বর্ষার দিনেও কাদাজল ঠেলিয়া গ্রামের পর গ্রাম ছুটিয়া বেড়াইতেছে। গাড়িতে ঘুরিতেছে—বাবুদের নায়েব ও বাবুদের উকিল। সমস্ত হিন্দু সম্প্রদায় বিপন্ন। প্রকাণ্ড এক মিটিং হইবে বাবুদের নাটমন্দিরে। কুসুমপুরের মসজিদে মুসলমানেরা মজলিশ করিতেছে। আশপাশের গ্রামে যেখানে মুসলমান আছে—খবর পাঠানো হইয়াছে। দৌলত শেখ রহমকে পাশে লইয়া বসিয়াছে।
একা ইরসাদ কেবল ক্ৰমশ যেন স্তিমিত হইয়া আসিতেছে। সে কথাবার্তা বিশেষ বলে না। নীরবে বসিয়া শুধু দেখে আর শোনে। অবসর সময়ে আপনার বাড়িতে বসিয়া ভাবে। ইরসাদ সংসারে একা মানুষ, তাহার স্ত্রী স্বামীর ঘরে আসে না। ইরসাদের বিবাহ হইয়াছে কয়েক মাইল দূরবর্তী গ্রামে এক বর্ধিষ্ণু মুসলমান পরিবারে। শ্যালকেরা কেহ উকিল, কেহ মোক্তার। তাহাদের ঘরের মেয়ে আসিয়া ইরসাদদের দরিদ্র সংসারে থাকিতে পারে না। তাহার এবং তাহার বাপভাইয়ের দাবি ছিল ইরসাদ আসিয়া শ্যালকদের কাহারও মুহুরির কাজ করুক। শহরে। তাহাদের বাসাতেই থাকিবে রোজগারও হইবে। কিন্তু ইরসাদ সে প্রস্তাব গ্রহণ করে নাই। মেয়েটি সেই কারণেই আসে না। ইরসাদও যায় না। তালাক দিতেও তাহার আপত্তি নাই। তবে সে বলে—তালাকের দরখাস্ত সে করিবে না, করিতে হয় তার স্ত্রী করিতে পারে। আপনার ঘরে একা বসিয়া সে সমস্ত ব্যাপারটা তলাইয়া বুঝিবার চেষ্টা করে। রহম চাচা আজও বুঝিতে পারিতেছে না-কি হইতে কি ঘটিয়া গেল! সমস্ত গ্রামটা গিয়া পড়িয়াছে দৌলত শেখের মুঠার মধ্যে।
দৌলত অকস্মাৎ প্রচণ্ড ধার্মিক হইয়া উঠিয়াছে। রমজানের উপবাসের সময় গৃহস্থকে দান করিতে হয়, দীন-দুঃখী মুসলমানকে গম, ময়দা, কিসমিস, বা তাহার মূল্যের পরিমাণ চাল কলাই দান করিয়া ঈশ্বরের দরবারে ফেতরা আদায় দিতে হয়। সম্পদশালী ব্যক্তিদের উপর শাস্ত্রের নির্দেশ তাহারা সোনারুপা দান করিয়া ফেতরা আদায় দিবে। ধনী দৌলত ফেতরা আদায় দিত তাহার রাখাল কৃষাণ মারফত। সেরখানেক করিয়া চাল দিয়া সে এক দিলে দুই পাখি মারিত। পর্ব উপলক্ষে রাখাল কৃষাণদের বকশিশ দেওয়াও হইত, আবার খোদাতালার দরবারে পুণ্যের দাবি জানানো হইত। এই লইয়া গ্রামে প্রতিজনে দৌলতের সমালোচনা করিয়াছে, তাহাকে ঘৃণা করিয়াছে। সে সবই দৌলতের কানে যাইত। কিন্তু এতকালের মধ্যে সে এসব গ্রাহ্য করে নাই। এবার সেই দৌলত ঘোষণা করিয়াছে, লোকেরা সেই কথা নিৰ্ণজ্জের মত সগৌরবে বলিয়া বেড়াইতেছে—শেখজী এবার খাঁটি আমিরের মত ফেতরা আদায় দিবে। শেখের দলিজা হইতে অর্থী-প্রার্থী শুধু হাতে ফিরিবে না। রমজানের সাতাশ রাত্রিতে শবে কদর উপলক্ষে সে সমস্ত রাত্ৰি জাগিবে, গোটা গায়ের লোককে সমাদর। করিয়া খাওয়াইবে। বুদ্ধিহীন লোকগুলি হাঁ করিয়া আছে সেই রাত্রির অপেক্ষায়। রহম চাচা পর্যন্ত উৎসাহিত হইয়া উঠিয়াছে। সে বলিতেছে—শেখের এতদিনে মতি ফিরিয়াছে। সে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। দৌলত শেখ রহমকে বলিয়াছে মামলা হয় টাকা লাগে—আমি দিব। তুয়াদিগে!
ইরসাদের হাসি আসিল। মনে পড়লি—ছেলেবেলায় সে একখানা ছবিওয়ালা ছেলেদের বইয়ে পড়িয়াছিল—কুমিরের বাড়ির নিমন্ত্রণের গল্প। গল্পের শেষের ছবিটা তাহার চোখের উপর জ্বলজ্বল করিয়া ভাসিতেছে, নিমন্ত্রিতদের খাইয়া স্ফীতোদর কুমির বসিয়া গড়গড়ার নল টানিতেছে।
–ইরসাদ! বাপজান! ইরসাদ! উত্তেজিত কণ্ঠে ডাকিল রহম। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া ইরসাদ সাড়া দিল—আসুন, ভিতরে আসুন, চাচা!
–আরে বাপজান—তুমি বাইরিয়া এস। জলদি এস। দেখ দেখ!
–কি? ইরসাদ ব্যস্ত হইয়া বাহির হইয়া আসিল।
–দেখ!
ইরসাদ কিছু দেখিতে পাইল না। শুধু বহুজনের সমবেত পদধ্বনির মত একটা শব্দ কানে আসিল। পরক্ষণেই রাস্তার বাঁক ঘুরিয়া আবির্ভূত হইল-খাকী পোশাক-পরা আর্মড কনস্টেবল। দুই-চারিজন নয় প্রায় জনপঁচিশ। তাহারা মার্চ করিয়া পথের ধুলাউড়াইয়া চলিয়া গেল; কঙ্কণার জমাদারও তাহাদের সঙ্গে ছিল—সে ইরসাদ এবং রহমকে দেখিয়া আর্মড কনস্টেবলের নেতাকে কি বলিল।
রহম বলিল-আমাদিগে দেখায়ে কি বুললে বল তো?
ইরসাদ ঈষৎ হাসিল, কিছু বলিল না।
রহম বলিলপঞ্চাশজনা ফৌজ আসছে বাপজান। সঙ্গে ডিপুটি আসছে একজনা। দেখ কি হয়!
হইল না বিশেষ কিছু।
ডেপুটিসাহেবের মধ্যস্থতায় বিবাদটা মিটিয়া গেল। কঙ্কণার মুখুয্যেবাবু পঞ্চাশ টাকার মিঠাই পাঠাইয়া দিলেন কুসুমপুরের মসজিদে। রহমকে ডাকিয়া তাহাকে সম্মুখে বেঞ্চিতে বসাইয়া বলিলেন–কিছু মনে কোরো না রহম।
দৌলত শেখও গিয়াছিল। সে বলিল—দেখেন দেখি, জমিদার আর প্রজা-বাপ আর বেটা। বেটার কসুর হলে বাপ শাসন করে, যুগি বেটা হলে—তার গোসা হয়। বাপ আবার পেয়ার করলি পরেই-সে গোসা ছুটে যায়।
রহমও এ আদরে গলিয়া গেল; সেও বলিল হুজুরকে অনেক সালাম আমার। আমাদের কসুরও হুজুর মাপ করেন।
ইরসাদকে ডাকা হয় নাই, ইরসাদ যায়ও নাই; রহম অনুরোধ করিয়াছিল, কিন্তু ইরসাদ বলিয়াছিল—মুরুবি শেখজী যাচ্ছেন—তুমি যাচ্ছ, আমার শরীরটা ভাল নাই চাচা।
দৌলত এবং রহম চলিয়া গেল।
খানিক পরে ইরসাদের ডাক আসিল। একজন কনস্টেবল থানা হইতে জরুরি তলব লইয়া আসিল। ইরসাদ একটু চকিত হইয়া উঠিল। পরক্ষণেই সে জামাটা গায়ে দিয়া মাথায় টুপিটি পরিয়া কনস্টেবলের সঙ্গে বাহির হইয়া গেল।
থানায় গিয়া দেখিল—আরও একজনকে ডাকা হইয়াছে। দেবু থানার বারান্দায় দাঁড়াইয়া আছে।
—দেবু-ভাই! থানার বারান্দায় মুখোমুখি দাঁড়াইয়া অসঙ্কোচে সে দেবুকে ভাই বলিয়া সম্বোধন করিল। সেদিনের কথা মনে করিয়াও তাহার কোনো সঙ্কোচ হইল না।
দেবু হাসিয়া বলিল—এস ভাই।
ইরসাদ খানিকটা চুপ করিয়া থাকিয়া, একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল—সব ঝুট হয়ে গেল দেবু-ভাই, সব বরবাদ গেল।
দেবু বলিলতার আর করবে কি বল? উপায় কি?
ইরসাদ আবার কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল—তোমার কাছে আমার কসুর হয়ে আছে, দেবু-ভাই!
দেবু তাহার হাতখানি নিজের হাতে টানিয়া লইয়া বলিল-আমাদের শাস্ত্রে কি আছে, জান ভাই? সুখে, দুঃখে, রাজার দরবারে, শ্মশানে, দুর্ভিক্ষে, রাষ্ট্রবিপ্লবে যারা পাশাপাশি থাকে তারাই হল প্রকৃত বন্ধু। বন্ধুর কাছে বন্ধুর ভুলচুক হয় বৈকি, তার জন্যে মাপ চাইতে নাই। দেবু তাহার স্বভাবসুলভ প্রীতির হাসি হাসিল।
ইরসাদও তাহার মুখের দিকে চাহিল। ঠিক এই সময়েই তাহাদের ডাক পড়িল।
ডেপুটি সাহেব দুজনের মুখের দিকে কিছুক্ষণ এক বিচিত্র স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলেন, তারপর বলিলেন–লিডারি হচ্ছে বুঝি?
দেবু আপত্তির সুরে কি দুই-এক কথা বলিতে গেল।
ডেপুটি বলিলেন–থাম।
তারপর বলিলেন–এবার খুব বেঁচে গেলে। কিন্তু ভবিষ্যতে সাবধান!
দুজনে একসঙ্গে থানা হইতে বাহির হইল। থানার ব্যাপারটা দুইজনের অন্তরেই আঘাত দিয়াছিল। কথাবার্তা ওই কঠিন শাসনবাক্য ছাড়া আর কিছুই হয় নাই, কিন্তু যে বিচিত্র দৃষ্টিতে ডেপুটি সাহেব তাহাদের দিকে চাহিয়াছিল—সেই দৃষ্টি দারোগাবাবু, জমাদার, কনস্টেবল, এমনকি চৌকিদারদের চোখেও ফুটিয়া উঠিয়াছিল।
নীরবেই দুইজনে পথে চলিতেছিল। ক্ষুদ্র শহরের জনাকীর্ণ কলরবমুখর পথ নীরবেই অতিক্ৰম করিয়া তাহারা আসিয়া উঠিল ময়ূরাক্ষীর রেলওয়ে ব্রিজে। ব্রিজ পার হইয়া তাহারা ময়ূরাক্ষীর বন্যারোধী বাঁধের পথ ধরিল। নির্জন পথ। বাঁধের দুই পাশে বর্ষার জল পাইয়া শরবন ঘন সবুজ প্রাচীরের মত জমাট বাঁধিয়া গিয়াছে। পথে চলিতে চলিতে অকস্মাৎ ইরসাদ উপরের দিকে মুখ তুলিয়া হাত বাড়াইয়া উচ্ছ্বসিতভাবে বলিয়া উঠিল—খোদা, তুমি তো সব জানছ, সব দেখছ! বিচার করো তুমি এর বিচার করে। অন্যায় যদি আমার হয়, হে খোদাতালা, তুমি আমাকে সাড়া দিয়ো আমার চোখের দৃষ্টি নিয়ো; আমি যেন পথে পথে ভিক্ষে করে বেড়াই। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্। তুমি ছাড়া আমার কেউ নাই। তুমি বিচার করো! রোজা করে তোমার গোলাম-আমি তোমার কাছে হাত জোড়া করে বলছি—তুমি এর বিচার করো। তোমার ইনসাফে দোষী সাব্যস্ত হবে যারা, সেই বেইমানদের মাথায়–
ইরসাদের কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া আসিল।
দেবু পাশে দাঁড়াইয়া ছিল। ইরসাদ ভাইয়ের মর্মদাহের জ্বালা সে অনুভব করিয়াছিল। মৰ্মাহ তাহারও কম নয়। কিন্তু তাহার যেন সব সহিয়া গিয়াছে। কানুনগোর অপমান, জেল, বিলু এবং খোকন-মণির মৃত্যু, সদ্য সদ্য তাহার দুই-দুইটা জঘন্য পবাদ, ছিরু ঘোষের চক্ৰান্ততাহাকে ক্রমশ যেমন সংবেদনশূন্য তেমনি সহনশীল করিয়া তুলিয়াছে। এই সেদিনও তাহার মনে আগুন উঠিয়াছিল অকস্মাৎ নিষ্ঠুর প্রজ্বলনে; কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই তাহা নিভিয়া গিয়াছিল। সেদিন হইতে সে যেন আরও প্রশান্ত হইয়া গিয়াছে। দেবু বুঝিল-ইরসাদ বিপক্ষদিগকে নিষ্ঠুর অভিসম্পাতে অভিশপ্ত করিতে উদ্যত হইয়াছে; সঙ্গে সঙ্গে—সে তাহার পিঠে হাত দিয়া গাঢ় স্নেহস্পর্শ জানাইয়া স্নিগ্ধস্বরে বাধা দিয়া বলিল—থাক, ইরসাদ-ভাই, থাক।
ইরসাদ তাহার মুখের দিকে চাহিল।
দেবু বলিল-কাউকে শাপ-শাপান্ত করতে নেই, ইরসাদ-ভাই।
ইরসাদের চোখ দুইটা দপদপ করিয়া জ্বলিতেছিল।
দেবু হাসিয়া বলিল—নিজে যদি ভগবানের কাছে অপরাধ করি সংসারে পাপ করি, তবে ভগবানকে বলতে হয় আমাকে সাজা দাও। সে সাজা মাথা পেতে নিতে হয়। কিন্তু অন্য কেউ যদি পাপ করে সংসারে, আমার অনিষ্ট করে, তবে ভগবানকে বলতে হয়—ভাগবান, ওকে তুমি ক্ষমা কর, মাফ কর!
ইরসাদ স্থিরদৃষ্টিতে দেবুর মুখের দিকে চাহিয়া ছিল; এবার দুইটি তপ্ত অশ্রুত ধারা তাহার প্রদীপ্ত চক্ষু হইতে গড়াইয়া পড়িল।
দেবু বলিল—এস। মাথার ওপর রোদ চড়ছে। রোজার সময়। পা চালিয়ে এস।
চাদরের খুঁটে চোখ মুছিয়া ইরসাদ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।
—আমাদের গাঁ হয়ে চল। আমার বাড়িতে একটু বসবে, জিরিয়ে ঠাণ্ডা হয়ে বাড়ি যাবে, কেমন?
ইরসাদ এবার ম্লান হাসি হাসিয়া বলিল—চল।
গ্রামের মধ্যে তাহারা দুইজনে যখন ঢুকিল, তখন গ্রামের পথ লোকজনে পরিপূর্ণ। পল্লীপথের জনবিরলতাই স্বাভাবিক রূপ। এমন অস্বাভাবিক জনতা দেখিয়া দেবু ও ইরসাদ দুইজনেই চমকিয়া উঠিল। ইরসাদ বলিলব্যাপার কি দেবু-ভাই?
দেবু ততক্ষণে ব্যাপারটা বুঝিয়াছে। ভিড় শুধু মানুষেরই নয়, রাস্তার ধারে গাছতলায় গাড়িরও ভিড় জমিয়া গিয়াছে। দেবু বলিল—দেখবে চল। বিপদ কিছু নয়। সে একটু হাসিল।
ইরসাদও চাষী মুসলমানের ঘরের ছেলে। সুস্থ অবস্থা হইলে ব্যাপারটা সে মুহূর্তে বুঝিতে পারি। কিন্তু আজ তাহার চিত্ত ও মস্তিষ্ক উদ্ভ্রান্ত হইয়া রহিয়াছে।
পথের ভিড় অতিক্ৰম করিয়া অল্প খানিকটা আসিয়াই শ্ৰীহরি ঘোষের বাড়ি। তাহার খামারবাড়ির প্রবেশের দরজাটা সম্প্ৰতি পাকা ফটকে পরিণত করিয়াছে শ্ৰীহরি। প্রশস্ত ফটকটা দিয়া গাড়ি পর্যন্ত প্রবেশ করিতে পারে। ফটকটার মুক্ত পথে আঙুল বাড়াইয়া দেবু বলিল—ওই দেখ!
তকতকে খামারের উঠানে একখানা ঘরের সমান উচ্চ স্থূপ বধিয়া রাশি রাশি ধান ঢালা হইয়াছে। ভদ্রের নির্মেঘ আকাশে প্রখর সূর্যের আলোতে শরতের শুভ্রতা। সেই শুভ্র উজ্জ্বল রৌদ্রের প্রতিফলনে পরিপুষ্ট সিঁদুরমুখী ধানের রাশি ঠিক যেন পাকা-সোনার বর্ণে ঝলমল করিতেছিল।
শ্ৰীহরি একখানা চেয়ারে বসিয়া আছে—একটা লোক একটা ছাতা ধরিয়াছে তাহার মাথার উপর। মধ্যস্থলে বাঁশের তে-কাটায় প্রকাণ্ড এক দাড়িপাল্লায় সেই ধান ওজন হইতেছে।—রামরাম রামরাম, রামে-রামে দুই-দুই; দুই রামে তিন-তিন!
আশপাশ ঘিরিয়া বসিয়া আছে গ্রাম-গ্রামান্তরের মোড়ল-মাতত্ত্বরেরা। বাহিরে পাচিলের গায়ে ঘরের দেওয়ালের পাশে সঙ্কীর্ণ চালের ছায়ায় ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়া আছে সাধারণ চাষীরা লুব্ধ প্রত্যাশায়। তাহারা সকলেই দেবুকে দেখিয়া মাথা নত করিল। দেবু কাহাকেও কোনো কথা বলিল না। ইরসাদকে লইয়া সে আপনার দাওয়ায় গিয়া উঠিল। সেখান হইতে শুনিল জগন ডাক্তার উচ্চকণ্ঠে লোকগুলিকে গালিগালাজ করিতেছে।-বড়লোকের পা-চাটা কুত্তার দল। বেইমান বিশ্বাসঘাতক সব! ইতর ছোটলোক সব।
বাড়ির ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিল দুর্গা। ইরসাদকে দেখিয়া সে বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিল—ওই, কুসুমপুরের পণ্ডিত মিয়া যি গো!
ইরসাদ বলিল–হ্যাঁ। ভাল আছ তুমি?
দুর্গা বলিলহ্যাঁ, ভাল আছি। তারপর সে দেবুর দিকে চাহিয়া হাসিয়া বলিলপথ দিয়ে। এলে, দেখে এলে?
—কি?
–ঘোষের দুয়ারে ভিড়?
–হ্যাঁ।
–হ্যাঁ নয়। ইহার ঠেলা তোমাকে সামলাতে হবে। ই সব হচ্ছে তোমার লেগে।
দেবু হাসিল।
দুর্গা বলিল হাসি লয়। রাঙাদিদির ছেরাদ্দ নিকটিয়ে এসেছে। পঞ্চায়েত বসবে।
দেবু আরও একটু হাসিল। তারপর ভিতর হইতে এক বালতি জল ও একটি ঘটি আনিয়া ইরসাদের সামনে নামাইয়া দিয়া বুলিল—মুখ-হাত-পা ধুয়ে ফেল। রোজার উপোস, জল খাবার তো জো নাই!
ইরসাদ বলিল-কুল্লি করবার পর্যন্ত হুকুম নাই।
দেবু একখানা পাখা লইয়া নিজের গায়ে-সঙ্গে সঙ্গে ইরসাদের গায়েও বাতাস দিতে আরম্ভ করিল।
দুর্গা বলিল-আমাকে দেন, পণ্ডিত, আমি দুজনকেই বাতাস করি!