Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

সমগ্ৰ অঞ্চলটা একদিনে

সমগ্ৰ অঞ্চলটা একদিনে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই উত্তেজনায় চাঞ্চল্যে অধীর হইয়া উঠিল। সামান্য চাষী প্রজারও যে মান-মর্যাদার অনেকখানি দাবি আছে, দেশের শাসনতন্ত্রের কাছে জমিদার ধনী মহাজন এবং তাহার মান-মর্যাদার কোনো তফাত নাই—এই কথাটা অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে তাহারা না-বুঝিলেও আভাসে অনুভব করিল। ব্যাপারটা ঘোরালো করিয়া তুলিয়াছে কুসুমপুরের পাঠশালার মৌলবী ইরসাদ এবং দেবু।

রহম তিনকড়িকে সেদিন একটা তালগাছ বিক্রয়ের কথা বলিয়াছিল। আসন্ন ঈদল্ফেতর। পর্ব এবং শ্রাবণ-ভাদ্রের অনটনে বিব্রত হইয়া যখন সে ধান বা টাকা ঋণের সন্ধানে এদিক-ওদিক ঘুরিতেছিল, তখনই সে শুনিয়াছিল জংশন শহরে কলিকাতার কলওয়ালার কলে নূতন শেড় তৈয়ারি হওয়ার কথা। শেডের জন্য ভাল পাকা তালগাছের প্রয়োজন—এ খবর সে তাহাদের গ্রামের করাতিদের কাছে শুনিয়াছিল। করাতি আবু শেখ বলিয়াছিল—বড় ভাই, সোনাডাঙ্গালের মাঠে আউশের ক্ষ্যাতের মাথার গাছটারে দাও না কেনে বেচ্যা। মিলের মালিক দাম দিচ্ছে। এক্কারে চরম। কুড়ি টাকা তো মিলবেই ভাই!

গরু-ছাগলের পাইকার ব্যবসায়ীরা যেমন কোথায় কাহার ভাল পশু আছে খোঁজ রাখে, কাঠচেরা ব্যবসায়ে নিযুক্ত এই করাতিরাও তেমনি কোথায় কাহার ভাল গাছ আছে খোঁজ রাখে। অভ্যাসও বটে এবং প্রয়োজনও আছে। কাহারও নূতন ঘর দুয়ার তৈয়ারি হইতেছে সন্ধান পাইলেই সেখানে গিয়া হাজির হয়। ঘরের কাঠ চিরিবার কাজ ঠিক করিয়া লয়; গাছের অভাব পড়িলে তাহারাই সন্ধান বলিয়া দেয় কোথায় তাহার প্রয়োজনমত ঠিক গাছটি পাওয়া যাইবে। কলওয়ালার শেডটা প্ৰকাণ্ড বড়, তার চালকাঠামোর জন্য তালগাছ চাই সাধারণ গাছ অপেক্ষা অনেক লম্বা গাছ, শুধু লম্বা হইলেই হইবে নাসোজা গাছ চাই এবং আগাগোড়া পাকা অর্থাৎ সারসম্পন্ন হওয়া প্রয়োজন। লোহার টি এবং এ্যাঁঙ্গেলের কাজ চালাইতে হইবে-এই কাঠগুলিকে। লোহা এবং কাঠের দাম হিসাব করিয়া কলওয়ালা দেখিয়াছেওখানে গাছ যে দরে কেনা-বেচা হয়, তাহা অপেক্ষা তিনগুণ দাম দিলেও তাহার খরচ অর্ধেক কমিয়া যাইবে। সে চলতি দর অপেক্ষা দ্বিগুণ দাম ঘোষণা করিয়া দিয়াছে। যে গাছটির দিকে আবুর দৃষ্টি পড়িয়াছিল—এখানকার দরে সে গাছটির দাম পনের টাকার বেশি হয় না; তাই সে কুড়ি টাকা বলিয়াছিল।

অন্য সময় কেহ এ প্রস্তাব করিলে রহম তাহাকে সঙ্গে সঙ্গে হকাইয়া দিত-প্যাটে কি আমার আগুন লেগেছে না নক্ষ্মী ছেড়েছে যে ওই গাছটা বেচতি যাব? ভাগ, ভাগ বুলছি, শয়তান কুথাকার।

গাছটা তাহাদের সংসারের বড় পেয়ারের গাছ। তাহার দাদু গাছটা লাগাইয়া গিয়াছিল। কোথায় কোন মেহমান অর্থাৎ কুটুম্ব বাড়ি গিয়া সেখান হইতে একটা প্রকাণ্ড বড় পাকা তাল আনিয়াছিল। তালটার মাড়ি অর্থাৎ ঘন রস যেমন মিষ্ট তেমনি সুগন্ধ। সাধারণ তালের তিনটি অ্যাঁটি, এ তালটার অ্যাঁটি ছিল চারটি। সোনাডাঙ্গালের উঁচু ডাঙ্গায় তখন সে সদ্য মাটি কাটিয়া জমি তৈয়ারি করিয়াছে। সেই জমির আলে ওই চারিটি অ্যাঁটিই পুঁতিয়া দিয়াছিল। গাছ হইয়াছিল একটা। আজ তিনপুরুষ ধরিয়া গাছটা বাড়িয়া বুড়া হইয়াছে। সার তাহার আগাগোড়া। তা ছাড়া খোলা সমতল মাঠের উপর জন্মিবার সুযোগ পাইয়া গাছটা একেবারে সোজা তীরের মত উপর দিকে উঠিয়াছিল। এ গাছ বেচিবার কল্পনাও কোনোদিন রহমের ছিল না। কিন্তু এবার সে বড় কঠিন ঠেকিয়াছিল; এই সময় পনের টাকার স্থলে কুড়ি টাকা দামও প্রলুব্ধ করিবার মত; আবুর কথায় তাই প্রতিবাদ না করিয়া চুপ করিয়াই ছিল। আরও একটা কথা তাহার মনে হইয়াছিল। বাবু যখন কুড়ি বলিয়াছে, তখন সে নিশ্চয় কিছু হাতে রাখিয়াছে। তাই সে সেদিন নিজেই গিয়াছিল কলওয়ালার কাছে। কলওয়ালাও পূর্বেই গাছটির সন্ধান করিয়াছিল। সে এক কথাতেই নিজের হিসাবমত বলিয়াছিল যদি গাছ বেচ, আমি ত্রিশ টাকা দাম দিব।

—তিরিশ টাকা? রহম অবাক হইয়া গিয়াছিল।

—রাজি হও যদি, টাকা নিয়ে যাও। দরদস্তুর আমি করি না। এর পর আর কোনো কথা আমি বলব না।

রহম আর রাজি না হইয়া পারে নাই। চাষের সময় চলিয়া যাইতেছে, ঘরে ধান-চাল ফুরাইয়া আসিয়াছে। মুনিষজনকে ধান দিতে হয়, তাহারা খোরাকি ধানের জন্য অধীর হইয়া উঠিয়াছে। ধান না পাইলেই বা কি খাইয়া চাষে খাঁটিবে? তাহার উপর রমজানের মাস; রোজা উদযাপনের দিন দ্রুত আগাইয়া আসিতেছে; তাহার ছেলেমেয়েরা ও স্ত্রী দুইটি কত আশা করিয়া রহিয়াছে—কাপড়-জামা পাইবে। এ সময় রাজি না হইয়া তাহার উপায় কি? এক উপায় জমিদারের কাছে মাথা হেঁট করিয়া বৃদ্ধি দেওয়া; কিন্তু সে তাহা কোনোমতেই পারিবে না। বাৎ যখন দিয়াছে তখন জাতের হলফ করিয়াছে; সে বাৎ খেলাপি হইলে তাহার ইমান কোথায় থাকিবে? রমজানের পবিত্র মাস, সে রোজা রক্ষা করিয়া যাইতেছে, আজ ইমানভঙ্গের গুনাহ্ করিতে পারিবে না।

এইখানেই কলওয়ালার সঙ্গে তাহার দাদনের কথাও হইয়াছিল। মিলের গুদাম ঘরে ও বাহিরের উঠানে রাশি-রাশি ধান দেখিয়া রহম আত্মসংবরণ করিতে পারে নাই, বলিয়াছিল–আমাদের কিছু ধান বাড়ি, মানে দাদন দ্যান কেনে? পৌষ মাঘ মাসে লিবেন। সুদ সমেত পাবেন।

কলওয়ালা তাহার মুখের দিকে কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া বলিয়াছিল—ধান না, টাকা দান দিতে পারি।

–টাকা নিয়ে কি করব গো বাবু? আমাদের ধান চাই। আমরা বুঝি ধান।

–ধানেই টাকা, টাকাতেই ধান। টাকার দাদন নিয়ে ধান কিনে নেবে।

–তা আপনার কাছেই কিনব তো–

–না। আমি ধান বেচি না। চাল বেচি। তাও দু মন চার মন দশ মন না! দুশো-চারশো মনের কম হলে বেচি না। তোমরা টাকা নিয়ে এখানকার গদিওয়ালার কাছে কিনে নাও।

অনেকক্ষণ চুপ করিয়া ভাবিয়া রহম বলিয়াছিল—সুদ কত নেবেন টাকায়?

—সুদ নেব না; পৌষ-মাঘ মাসে কিস্তির মুখে টাকার পরিমাণে ধান দিতে হবে। যে দর থাকবে, দরে টাকায় এক আনা কম দরে দিতে হবে। আর একটি শর্ত আছে।

–বলেন। কি শর্ত?

—তোমরা যারা দাদন নেবে, তারা অন্য কাউকে ধান বেচতে পারবে না। এর অবিশ্যি লেখাপড়া নাই, কিন্তু কথা দিতে হবে। তোমরা মুসলমান-ইমানের উপর কথা দিতে হবে।

রহম সেদিন বলিয়াছিল—আজ্ঞা আমরা শলাপরামর্শ করা বলব।

—বেশ। মিলওয়ালা মনে মনে হাসিয়াছিল। তালগাছের টাকাটা আজই নিয়ে যেতে পার।

–আজ্ঞা, পরশু আসব। সব ঠিক করা যাব।

মজলিশে টাকা দান লওয়া স্থির হইয়াছিল, রহম তালগাছ বিক্রি করিতে মনস্থ। করিয়াছিল। তাহার দুই স্ত্রীই কিন্তু গাছের শোকে চোখের জল ফেলিয়াছিল—এমন মিঠা তাল! তিন পুরুষের গাছ! কত লোকে তাহাদের বাড়িতে তাল চাহিতে আসে। ভাদ্র মাসে তাল পাকিয়া আপনি খসিয়া পড়ে, ভোররাত্রি হইতে নিম্নশ্রেণীর ছেলেমেয়েরা তাল কুড়াইয়া লইয়া যায়। খসিয়া পড়া তালে এ অঞ্চলে কাহারও স্বত্ব-স্বামিত্ব নাই। তাই রহম তালগুলিতে পাক ধরিলে খসিয়া পড়িবার পূর্বেই কাটিয়া ঘরে আনে। দুঃখ তাহারও যথেষ্ট হইতেছিল; কিন্তু তবুও উপায় কি? সেদিন গিয়া সে গাছ বিক্রি করিয়া টাকা লইয়া আসিল; এবং টাকা দান লওয়ারও পাকা কথা দিয়া আসিল।

একটা কথা কিন্তু রহমের মনে হয় নাই। সেইটাই আসল কথা। ওই গাছটার স্বামিত্বের কথা। তিন পুরুষের মধ্যে স্বামিত্বের পরিবর্তন হইয়া গিয়াছে—কথাটা তাহার মনে হয় নাই। তাহার পিতামহ জমিদারের কাছে ডাঙ্গা বন্দোবস্ত লইয়া নিজ হাতে জমি কাটিয়াছিল। কিন্তু তাহার বাপ শেষ বয়সে ঋণের দায়ে ওই জমি বেচিয়া গিয়াছে কঙ্কণার মুখয্যেবাবুকে। মুখুয্যেবাবুরা মস্ত মহাজন—লক্ষপতি লোক। এমনি ধারার ঋণের টাকায় এ অঞ্চলের বহু জমির স্বামিত্ব তাহাদিগকে অর্শিয়াছে। হাজার হাজার বিঘা জমি তাহাদের কবলে। এত জমি কাহারও নিজের তত্ত্বাবধানে চাষ করানো অসম্ভব। আর তাহারা চাষীও নয়; আসলে তাহারা মহাজন জমিদার। তাই সকল জমিই তাহাদের চাষীদের কাছে ভাগে বিলি করা আছে। তাহারা চাষ করে; ফসল উঠিলে বাবুদের লোক আসে। দেখিয়া-শুনিয়া প্ৰাপ্য বুঝিয়া লইয়া যায়। রহমের বাপ জমি বিক্রি করিবার পর বাবুর কাছে জমিটা ভাগে চষিবার জন্য চাহিয়া লইয়াছিল। তাহার বাপ জমি চষিয়া গিয়াছে, রহমও চষিতেছে। কোনো দিন একবারের জন্য তাহাদের মনে হয় নাই যে জমিটা তাহাদের নয়। খাজনার পরিবর্তে ধানের ভাগ দেয় এই পর্যন্ত। সেই মতই সে জমিগুলির তদবির-তদারক করিতেছে। মজুর নিযুক্ত করিয়া, উন্নতিসাধনের প্রয়োজন হইলে সে-ই করিয়াছে; বাবুদের নিকট হইতে সেই বাবদ টাকা চাহিবার কথা কোনোদিন মনে ওঠে নাই। মুখে বরাবর দশের কাছে বলিয়া আসিয়াছে—আমার বাপুতি জমি। মনে মনে জানিয়া আসিয়াছে—আমার জমি। ওই জমির ধান কাটিয়াই নবান্ন পর্ব করিয়াছে। তাই তালগাছটা যখন সে বেচিল, তখন তাহার একবারের জন্যও মনে হইল না—সে অন্যের গাছ বেচিতেছে, একটা অন্যায় কাজ করিতেছে।

গাছটা কাটিয়া মিলওয়ালা তুলিয়া লইয়া যাইবার পর, হঠাৎ আজ সকালে রহমের বাড়িতে ভোরবেলায় একজন চাপরাসী আসিয়া হাজির হইল। বাবুর তলব, এখনি চল তুমি।

রহম বলদ-গরু দুইটিকে খাইতে দিয়া তাহাদের খাওয়া শেষ হওয়ার অপেক্ষা করিতেছিল। সে বলিল—উ বেলায় যাব, বলিয়ো বাবুকে হে।

—উঁহুঁ! এখুনি যেতে হবে।

রহম মাতব্বর চাষী, গোয়ার লোক—সে চটিয়া গেল; বলিল—এখুনি যেতে হবে মানে? আমি কি তুর বাবুর খরিদ-করা বান্দা—গোলাম?

লোকটা রহমের হাত চাপিয়া ধরিল। সঙ্গে সঙ্গে শক্তিশালী দুর্ধর্ষ রহম তাহার গালে কষাইয়া দিল প্রচণ্ড একটা চড়—আস্পর্ধা বটে, আমার গায়ে হাত দি!

লোকটা জমিদারের চাপরাসী। ইন্দ্রের ঐরাবতের মতই তাহার দম্ভ, তেমনি হেলিয়া দুলিয়াই চলাফেরা করে। তাহাকে এ অঞ্চলে কেহ এমনি করিয়া চড় মারিতে পারে এ তাহার ধারণার অতীত ছিল। চড় খাইয়া মাথা ঘুরিয়া গেলেও সামলাইয়া উঠিয়া সে একটা হুঙ্কার ছাড়িল। রহম সঙ্গে সঙ্গে কষাইয়া দিল অন্য গালে আর একটা চড়; এবং দাওয়ার উপর হইতে লাঠি লইয়া প্ৰচণ্ড বিক্রমে ঘুরিয়া দাঁড়াইল।

এবার চাপরাসীটার উঁশ হইল। কোনো কিছু না বলিয়া সে ফিরিয়া গিয়া জমিদারের পায়ে গড়াইয়া পড়িল। রহমের চপেটচিহ্নাঙ্কিত বেচারার স্ফীত ব্যথিত গাল দুইটা চোখের জলে ভাসিয়া গেল আর আপনার চাকরি করতে পারব না হুজুর। মাপ করুন আমায়।

ব্যাপার শুনিয়া বাবু ক্রোধে অগ্নিশৰ্মা হইয়া উঠিলেন। আবার সঙ্গে সঙ্গে গেল পাঁচ-পাঁচজন লাঠিয়াল। রহমকে চাষের ক্ষেত হইতে তাহারা উঠাইয়া লইয়া গেল। সম্রাট আলমগীর যেমন আপনার শক্তি ও ঐশ্বর্যের চরম প্রদর্শনীর মধ্যে বসিয়া পার্বত্য মূষিক শিবাজীর সঙ্গে দেখা করিয়াছিলেনবাবুও ঠিক তেমনিভাবে রহমের সঙ্গে দেখা করিলেন। তাহার খাস বৈঠকখানার বারান্দায় রহমকে হাজির করা হইল। সেখানে পাইক-চাপরাসী-পেশকার-গোমস্তা গিসগিস করিতেছিল; বাবু তাকিয়ায় হেলান দিয়া ফরসি টানিতেছিলেন।

রহম সেলাম করিয়া দাঁড়াইল। বাবু কথাও বলিলেন না।

সে ক্ষুব্ধ হইয়া একটা বসিবার কিছু খুঁজিতেছিল, কিন্তু খানকয়েক চেয়ার ছাড়া আর কোনো আসনই ছিল না। শুধু মাটির উপর বসিতেও তাহার মন চাহিতেছিল না। তাহার আত্মাভিমানে আঘাত লাগিল। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান চাষী যাহাদের জমিজেরাত আছে, তাদের সবারই এ আত্মাভিমানটুকু আছে। কতক্ষণ মানুষ দাঁড়াইয়া থাকিতে পারে? তাহা ছাড়া তাহাকে কেহ একটা সম্ভাষণ পর্যন্ত করিল না। চারিদিকের এ নীরব উপেক্ষা ও বাবুর এই একমনে তাম্রকূট সেবন যে তাহাকে শুধু অপমান করিবার জন্যই ইহা বুঝিতেও তাহার বিলম্ব হইল না।

সে এবার বেশ দৃঢ়স্বরেই বলিল-সালাম! নিজের অস্তিত্বটা সে সংক্ষেপে জানাইয়া দিল।

রহম বলিল-আমাদের চাষের সময়, ইটা আমাদের বস্যা থাকবার সময় লয় বাবু। কি বলছেন বলেন?

বাবু উঠিয়া বসিয়া বলিলেন—আমার চাপরাসীকে চড় মেরেছ তুমি?

—উ আমার হাতে ধরেছিল কেনে? আমার ইজ্জত নাই! চাপরাসী আমার গায়ে হাত দিবার কে?

ঘাড় ফিরাইয়া বক্রহাস্যে বাবু বলিলেন—এইখানে যত চাপরাসী আছে, সবাই যদি তোমাকে দুটো করে চড় মারে, কি করতে পার তুমি?

রহম রাগে কথা বলিতে পারি না। দুর্বোধ্য ভাষায় একটা শব্দ করিয়া উঠিল।

একটা চাপরাসী ধাঁ করিয়া তাহার মাথায় একটা চড় কইয়া দিয়া বুলিল—চুপ বেয়াদপ!

রহম হাত তুলিয়াছিল; কিন্তু তিন-চারজন একসঙ্গে তাহার হাত ধরিয়া বলিল—চুপ! বস্—এইখানে বস্।

তাহারা পাঁচজনে মিলিয়া চাপ দিয়া তাহাকে মাটির উপর বসাইয়া দিল। সে এবার বুঝিল তাহার শক্তি যতই থাক, এতজনের কাছে তাহা নিষ্ফল-মূল্যহীন। ক্ষুব্ধ রোষে চাপরাশীর দিকে সে একবার চাহিল। পনরজন চাপরাসী; তাহার মধ্যে দশজন তাহার স্বধৰ্মী স্বজাতি, মুসলমান। রমজানের মাসে সে রোজা করিয়া উপবাসী আছে; তবু তাহাকে অপমান করিতে তাহাদের বাঁধিল না। রমজানের ব্ৰত উদ্যাপনের দিনে ইহাদের সঙ্গেই আলিঙ্গন করিতে হইবে। মাটির দিকে চাহিয়া সে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।

দেবু ঘোষের রাখালটা দুর্গাকে তিনকড়ি প্রসঙ্গে বলিয়াছিল—বানের আগু হাদি; অর্থাৎ বন্যার অগ্রগামী জলস্রোতের মাথায় নাচিতে নাচিতে ভাসিয়া যাওয়া বস্তুসমূহ। হাদি বলিতে প্রায়ই জঞ্জাল বুঝায়। তিনকড়ি জঞ্জাল কি না জানি না—তবে সর্বত্র সর্বাগ্রে গিয়া হাজির হয়। কিন্তু তাহাকে কেহ ভাসাইয়া লইয়া যায় না, সে-ই অন্যকে ভাসাইয়া লয়। বন্যার অগ্রগামী জলস্রোত বলিলেই বোধহয় তিনকড়িকে ঠিক বলা হয়। মুখে মুখে সংবাদটা সর্বত্র ছড়াইয়াছে। কুসুমপুরের আরও কয়েকজন মুসলমান চাষী রহমের জমির কাছাকাছি চাষ করিতেছিল। তাহারা ব্যাপারটা দেখিয়াও কিন্তু হাল ছাড়িয়া যাইতে পারে নাই। তিনকড়ি ছিল অপেক্ষাকৃত দূরে। সে ব্যাপারটা দূর হইতে দেখিয়া ঠিক ঠাওর করিতে পারে নাই। কয়েকজন লোক আসিল, রহম ভাই হাল ছাড়িয়া চলিয়া গেল। কিন্তু লোকগুলির মাথার লাল পাগড়ি তাহাকে সচেতন করিয়া তুলিল। সে তৎক্ষণাৎ কৃষাণটার হাতে হালখানা দিয়া আগাইয়া আসিল। সমস্ত শুনিয়া সে ছুটিয়া গেল কুসুমপুর। ইরসাদকে সমস্ত জানাইয়া বলিল—দেখ, খোঁজ কর।

ইরসাদ চিন্তিত হইয়া বলিল–তাই তো!

ভাবিয়াচিন্তিয়া ইরসাদ একজন লোক পাঠাইয়া দিল। লোকটা আসিয়া প্রকৃত সংবাদ দিতেই ইরসাদ যেন ক্ষেপিয়া গেল। সে তৎক্ষণাৎ গ্রামের চাষীদের খবর পাঠাইল। তাহারা আসিবামাত্র ইরসাদ বলিল—যাবে তুমরা আমার সাথে। চিনায়ে নিয়ে আসব রহম-ভাইকে!

পঞ্চাশ-ষাটজন চাষী সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়া উঠিল।

মুসলমানদের সাহস জিনিসটা অনেকাংশে সম্প্রদায়গত সাধনায়ত্ত জিনিস। তাহার উপর অজ্ঞতা-অসামর্থ্য-দারিদ্র্য-নিপীড়িত জীবনের বিক্ষোভ, যাহা শাসনে-পেষণে লুপ্ত হয় না—সুপ্ত হইয়া থাকে অন্তরে অন্তরে, সেই বিক্ষোভ তাহাদিগকে স্বতঃই সম্মিলিত করে একই সমবেদনার ক্ষেত্রে। ইহাদের সদ্যোজাগ্রত বিক্ষোভ কিছুদিন হইতে জমিদারের বিরুদ্ধে ধর্মঘটের মুক্তিপথে উচ্ছ্বসিত হইতেছিল—আগ্নেয়গিরির গরমুখ-মুক্ত অগ্নিধূমের মত।

তাহারা দল বাঁধিয়া চলিল, রহমকে তাহারা ছিনাইয়া আনিবে। তাহাদের স্বজাতি, স্বধৰ্মী তাহাদের পাঁচজনের একজন, তাহাদের মধ্যে গণ্যমান্য ব্যক্তি তাহাদের রহম-ভাই। তাহারা ইরসাদকে অনুসরণ করিল। তিনকড়ি সেই মুহূর্তে ছুটিল শিবকালীপুরের দিকে। এ সময় দেবুকে চাই। সে সত্য সত্যই জোর কমে ছুটিল।

এইভাবে দল বাঁধিয়া তাহারা ইহার পূর্বেও জমিদার-কাছারিতে কতবার আসিয়াছে। ক্ষেত্রও অনেকটা একই ভাবের। জমিদারের কাছারিতে জমিদার কর্তৃক দণ্ডিত ব্যক্তির মুক্তির জন্য গ্রামসুদ্ধ লোক আসিয়া হাজির হইয়াছে। সবিনয় নিবেদন অর্থাৎ বহুত লোম জানাইয়া। দণ্ডিতের কসুর গাফিলতি স্বীকার করিয়া হুজুরের দরবারে মাফ করিবার আরজি পশ করিয়াছে। আজ কিন্তু তাহারা অন্য মূর্তিতে ভিন্ন মনোভাব লইয়া হাজির হইয়াছে।

জমিদারের কাছারি-প্রাঙ্গণে দলটি প্রবেশ করিল। তাহাদের সর্বাগ্রে ইরসাদ। বারান্দায় জমিদার চেয়ার হইতে উঠিয়া দাঁড়াইলেন—নিঃশব্দে নিজের চেহারাখানা দেখাইয়া দিলেন। তিনি জানেন তাহাকে দেখিলে এ অঞ্চলের লোকেরা ভয়ে স্তম্ভিত হইয়া পড়ে। চাপরাসীরা বেশ দম্ভ সহকারে যেন সাজিয়া দাঁড়াইল—যাহার পাগড়ি খোলা ছিল সে পাগড়িটা তাড়াতাড়ি তুলিয়া মাথায় পরিল।

দলটি মুহূর্তে বারান্দার সিঁড়ির গোড়ায় গিয়া স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইল।

জমিদার গম্ভীরস্বরে হাকিয়া বলিলেনকে? কোথাকার লোক তোমরা? কি চাই? প্রত্যাশা করিলেন মুহূর্তে দলটির মধ্যে সম্মুখে আসিবার জন্য ঠেলাঠেলি বাঁধিয়া যাইবে, সকলেই আপন আপন সেলাম তাহাকে দেখাইয়া দিতে চাহিবে; একসঙ্গে পঞ্চাশ-ষাটজন লোক নত হইবে মাটিতে প্রতিধ্বনিত হইয়া তাহাদের কথা তাহার দাওয়ার উপর আসিয়া উঠিবে সসম্ভ্ৰমে-সালাম হুজুর।

দলটি তখন স্তব্ধ। অল্প খানিকটা স্তিমিত ভাবের চাঞ্চল্যও যেন পরিলক্ষিত হইল।

জমিদার সঙ্গে সঙ্গে আবার হকিলেন–কি চাই সেরেস্তায় গিয়ে বল।

ইরসাদ এবার সোজা উপরে উঠিয়া গেল; নিতান্ত ছোট একটা সেলাম করিয়া বলিল–সালাম! দরকার আপনার কাছেই।

—একসঙ্গে অনেক আরজি বোধ হয়? এখন আমার সময় নাই। দরকার থাকলে—

এবার কথার মাঝখানেই প্রতিবাদ করিয়া ইরসাদ বলিল রহম চাচাকে এমন করে চাপরাসী পাঠিয়ে ধরে এনেছেন কেন? তাকে বসিয়ে রেখেছেন কেন?

জমিদার এবং রহম এবার একসঙ্গে ক্ষুব্ধ রোষে গর্জন করিয়া উঠিল!

জমিদার চিৎকার করিয়া ডাকিলেন–চাপরাসী! কিষণ সিং! জোবেদ আলি।

রহম উঠিয়া পাঁড়াইয়া চিৎকার করিয়া উঠিল—আমার মাথায় চড় মারছে; আমার ঘাড়ে ধরে বস্ করিয়ে দিছে! আমার ইজ্জতের মাথার পরে পয়জার মারছে!

চাপরাসী কিষণ সিং হাকিয়া উঠিল—এ্যাঁও রহম আলি, বইঠ রহো।

জোবেদ আগাইয়া আসিল খানিকটা, অন্য চাপরাসীরা আপন আপন লাঠি তুলিয়া লইল।

ইরসাদও সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করিয়া উঠিল—খবরদার!

তাহার পিছনের সমগ্র জনতাও এবার চিৎকার করিয়া উঠিল—নানা কথায়; কোনো একটা কথা স্পষ্ট বোঝা গেল না, নানা শব্দ-সমন্বিত বিপুল ধ্বনি জ্ঞাপন করিল এক সবল প্রতিবাদ।

পরের মুহূর্তটি আশ্চর্য রকমের একটি স্তব্ধ মুহূর্ত। দুই পক্ষই দুই পক্ষের দিকে স্তব্ধ হইয়া চাহিয়া রহিল।

সে স্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া প্রথম কথা বলিলেন জমিদার। তিনি প্রথমটা স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছিলেন। প্রজার দল, দরিদ্র মানুষগুলো এমন হইল কেমন করিয়া? পরমুহূর্তে মনে হইল–কুকুরও কখনও কখনও পাগল হয়। ওটা উহাদের মৃত্যুব্যাধি হইলেও ওই ব্যাধি-বিষের সংক্রমণ এখন উহাদের দম্ভে সঞ্চারিত হইয়াছে। তাহাদের দাঁত অঙ্গে বিদ্ধ হইলে মালিককেও মরিতে হইবে। তিনি সাবধান হইবার জন্যই বলিলেন–কিষণ সিং, বন্দুক নিকালো!

তারপর জনতার দিকে ফিরিয়া বলিলেন—তোমরা দাঙ্গা করতে চাইলে বাধ্য হয়ে আমি বন্দুক চালাব।

একটা মার মার শব্দ সবে উঠিতে আরম্ভ করিয়াছিল, কিন্তু ধ্বনিটা উঠিবার প্রারম্ভ-মুহূর্তেই পশ্চাৎ হইতে তীক্ষ্ণ উচ্চ কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হইয়া উঠিল—না ভাই সব, দাঙ্গা করতে আমরা আসি নাই। আমরা আমাদের রহম চাচাকে ফিরিয়ে নিতে এসেছি। এস রহম চাচা, উঠে এস।

সকলে দেখিল—নিচের সমবেত জনতার পাশ দিয়া আসিয়া জনতাকে অতিক্ৰম করিয়া। দেবু ঘোষ প্রথম সিঁড়িতে উঠিতেছে। সমস্ত জনতা সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করিয়া উঠিল—উঠে এস! উঠে এস! চাচা! বড়-ভাই! রহম-ভাই এস উঠে এস!

সমস্ত চাপরাসীরা জমিদারের মুখের দিকে চাহিল। এমন ক্ষেত্রে তাহারা তাহার মুখ হইতে প্রচণ্ড একটা ধমক বা তাহাদের প্রতি একটা জোরালো বেপরোয়া হুকুম জারির প্রত্যাশা করিল। কিন্তু বাবু শুধু বলিলেন–রহম আমার তালগাছ বিক্রি করেছে চুরি করে, আমি তাকে থানায় দেব।

দেবু বলিল—থানায় আপনি খবর দিন, ধরে নিয়ে যেতে হয় দারোগা এসে ধরে নিয়ে যাবে। থানায় খবর না দিয়ে আপনার চাপরাসী দিয়ে গ্রেপ্তার করবার ক্ষমতা আপনার নাই। আপনার কাছারিটা গভর্নমেন্টের থানাও নয়, হাজতও নয়। উঠে এস চাচা! এস! এস !

রহম দাঁড়াইয়াই ছিল। দেবু তাহার হাত ধরিয়া বারান্দা হইতে নামিতে আরম্ভ করিল। ইরসাদ তাহার সঙ্গ ধরিল। দেবু জনতাকে সম্বোধন করিয়া বলিল—চল ভাই। বাড়ি চল সব।

বন্য কুকুর ও মৃগ সজ্ঞাবদ্ধ হইয়া থাকে; কিন্তু গণ্ডার, বাঘ বা সিংহ থাকে না। ওটা জীবধর্ম। শক্তি যেখানে আসমান আধিক্যে একস্থানে জমা হয়, সেখানে নিৰ্ভয়ে একক থাকিবার প্রবৃত্তি তাহার স্বাভাবিক। আদিম মানুষের মধ্যে দৈহিক শক্তিতে শ্ৰেষ্ঠজনের আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষার জন্যই দুর্বল মানুষেরা জোট বাঁধিয়া তাহাকে পরাজিত করিতে চাহিয়াছিল। পরে আবার শক্তিশালীকেই দলপতি করিয়া সম্মানের বিনিময়ে তাহার স্কন্ধে দলের সকলের প্রতি কর্তব্যের বোঝা চাপাইয়া দিবার কৌশল আবিষ্কার করিয়াছিল। কিন্তু তবুও দলের মধ্যে শক্তিশালীদের প্রতি ঈর্ষা চিরকাল প্রচ্ছন্ন ছিল এবং আছে। ধনশক্তি আবিষ্কারের পর ধনপতিদের কাছে শৌর্যশালী মানুষ হার মানিয়াছে। ধনপতিদের ইঙ্গিতেই আজ এক দেশের শৌর্যশক্তি অপর দেশের শৌর্যশক্তির সহিত লড়াই করে, বন্ধুত্ব করে। কিন্তু একই দেশের ছোট-বড় ধনপতিদের পরস্পরের মধ্যেও সেই ঈৰ্ষা পুরাতন নিয়মে বিদ্যমান। একের ধ্বংসে তাহাদের অন্যেরা আনন্দ পায়। বর্তমান ক্ষেত্রে সেইরূপ ঈর্ষান্বিত এক ব্যক্তির প্রতিনিধি আসিয়া তাহার সম্মুখে উপস্থিত হইল।

কঙ্কণারই একজন মধ্যবিত্ত জমিদারের নায়েব আসিয়া দেবু এবং ইরসাদকে ডাকিল। লোকটা পথে তাহাদের জন্যই অপেক্ষা করিতেছিল। সে বলিল-আমাদের বাবু পাঠালেন। আমাকে।

ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া দেবু বলিল—কেন, কেন?

–বাবু অত্যন্ত দুঃখিত হয়েছেন। ছি! ছি! এই কি মানুষের কাজ! পয়সা হলে কি এমনি করে মানুষের মাথায় পা দিয়ে চলে।

ইরসাদ বলিলবাবুকে আমাদের সালাম দিয়ে।

—বাবু বলে দিলেন, থানায় ডায়রি করতে যেন ভুল না হয়। নইলে এর পর তোমাদেরই ফ্যাসাদে ফেলবে। এই পথে তোমরা থানায় চলে যাও।

ইরসাদ দেবুর মুখের দিকে চাহিল। দেবুর মনে পড়িল যতীনবাবু রাজবন্দির কথা। আরও একবার গাছ কাটার হাঙ্গামার সময় যতীনবাবু থানায় ডায়রি করিতে বলিয়াছিল; ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে, কমিশনার সাহেবকে দুখানা টেলিগ্রাম করে দাও। এইভাবে ডায়রি কর–চাপরাসীরা গলায় গামছা বেঁধে টেনে নিয়ে এসেছে মাঠ থেকে, কাছারিতে মারপিট করেছে, থামে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে। তোমরা গেলে বন্দুকের গুলি ছুঁড়েছে, ভাগ্যক্রমে কাউকে লাগে নাই।

দেবু অবাক হইয়া নায়েবটার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। এই নায়েবের মনিব ক্ষুদে জমিদারটির সঙ্গেও তাহাদের করবৃদ্ধির কিছু কিছু বিরোধ আছে। বৃদ্ধির ব্যাপার লইয়া ইনিও মুখুয্যেবাবুদের সঙ্গে দল পাকাইয়াছেন, আবার সেই লোকই গোপনে গোপনে মুখুয্যেদের শত্ৰুতা করিতেছে তাহাদিগকে পরামর্শ দিয়া!

ইরসাদ এবং অন্য সকলে উৎফুল্ল হইয়া উঠিল; ইরসাদ বলিল—নায়েব মশায় মন্দ বলেন নাই দেবু-ভাই।

নায়েব বলিল-আমি চললাম। কে কোথায় দেখবে! হাজার হোক, চক্ষুলজ্জা আছে তো। তবে যা বললাম—তাই কোরো যেন। সে চলিয়া গেল।

ইরসাদ কহিল—দেবু-ভাই! তুমি কিছু বলছ নাই যে?

দেবু শুধু বলিল—নায়েব যা বললে, তাই কি করতে চাও ইরসাদ-ভাই?

রহম বলিল–হ্যাঁ, বাপজান। নায়েব ঠিক বুলেছে।

—ডায়রি করতে আমার অমত নাই। কিন্তু গলায় গামছা দেওয়া, দড়ি দিয়ে থামে বাধা; গুলি ছোঁড়া—এই সব লিখাবে নাকি?

–হাঁ, কেটা জোর হবে তাতে।

–কিন্তু এ যে মিথ্যে কথা রহম-চাচা!

রহম ও ইরসাদ অবাক হইয়া গেল। রহম মামলা-মকদ্দমায় অভ্যস্ত লোক, ইরসাদ নিজে মামলা না করিলেও দৌলত হাজীর সঙ্গে পাড়া-প্রতিবেশীর মকদ্দমায় শলাপরামর্শ দেয়, তদ্বির-তদারক করে। পুরোপুরি সত্য কথা বলিয়া যে দুনিয়ায় মামলা-মকদ্দমা হয় না—এ তাহাদের অভিজ্ঞতালব্ধ নিছক বাস্তব জ্ঞান। বহম বলিল—দেবু-চাচা আমাদের ছেল্যা মানুষই থেকে গেল হে!

দেবু বলিলতা হলে তোমরাই যা হয় করে এস চাচা। ইরসাদ-ভাইও যাচ্ছে। আমি এই পথে বাড়ি যাই!

—বাড়ি যাবা?

–হ্যাঁ। অন্য সময় আমি রইলাম তোমাদের সঙ্গে। এ কাজটা তোমরাই করে এস।

ইরসাদ-রহম মনে মনে খানিকটা চটিয়া গেল, বলিল—বেশ। তা যাও।

কয়েকদিন পর। টেলিগ্রাম এবং ডায়রি দুই-ই করা হইয়াছে। সঙ্গে সঙ্গে চারিপাশের গ্রামগুলিতে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে প্রজা-ধর্মঘটের আয়োজনটা উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে। খাজনাবৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রজা-ধর্মঘটের আয়োজনটা এই আকস্মিক ঘটনার সংঘাতে অভাবনীয় রকমে শক্তিশালী হইয়া উঠিল। ইহাতে খাজনা বৃদ্ধির হিসাব নিকাশের আঙ্কিক ক্ষতিবৃদ্ধি একেবারেই তুচ্ছ হইয়া গিয়াছে প্রজাদের কাছে। ইহা অকস্মাৎ তাহাদের জীবনের ইহলৌকিক পারলৌকিক সমস্ত চিন্তা ও কর্মকে পরিব্যাপ্ত করিয়া ফেলিয়াছে। লাভ-লোকসানের হিসাবনিকাশের অতিরিক্ত একটা বস্তু আছে—সেটার নাম জেদ। এই জেদটা তাহাদের আরও প্রবল হইয়া উঠিয়াছে জলগত স্বার্থ ও নীতির খাতিরে।

এই উত্তেজিত জীবন-প্রবাহের মধ্য হইতে দেবু যেন অকস্মাৎ নিম্প্রবাহের একপ্রান্তে আসিয়া ঠেকিয়া গেল। সে আপনার দাওয়ায় তক্তপোশখানির উপর বসিয়া সেই কথাই ভাবিতেছিল। দুর্গা তাহাকে পঞ্চায়েতের কথাটা বলিয়া গিয়াছে। সে প্রথমটা উদাসভাবে হাসিয়াছিল। কিন্তু এই কয়েকদিনের মধ্যেই তাহাকে এবং পদ্মকে লইয়া নানা আলোচনা গ্রামের মধ্যে আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। নানা জনের নানা কথার আভাস তাবার কানে পৌঁছিতেছে।

আজ আবার তিনকড়ি আসিয়া বলিয়া গেল—লোকে কি বলছে জান, দেবু-বাবা?

লোকে যাহা বলিতেছে দেবু তাহা জানে। সে নীরবে একটু হাসিল।

তিনকড়ি উত্তেজিত হইয়া বলিল—হেসো না বাবা! তোমার সবতাতেই হাসি ও আমার ভাল লাগে না।

দেবু তবুও হাসিয়া বলিল—লোকে বললে তার প্রতিবিধান আমি কি করব বলুন?

কি প্রতিবিধান করা যাইতে পারে, সে কথা তিনকড়ি জানে না। কিন্তু সে অধীরভাবেই বলিল—লোকের নরকেও ঠাঁই হবে না। সে কথা আমি কুসুমপুরওয়ালাদের বলে এলাম।

–কুসুমপুরওয়ালারাও এই কথা আলোচনা করছে নাকি?

–তারাই তো করছে। বলছে-দের ঘোষ মুখুয্যেবাবুদের সঙ্গে তলায় তলায় ষড় করছে। নইলে ডায়রি করতে তার করতে সঙ্গে গেল না কেন?

শুনিয়া দেবুর সর্বাঙ্গ যেন হিম হইয়া গেল।

তিনকড়ি বলিল—আরও বলছে দেবু ঘোষ যখন কাছারিতে ওঠে, তক্ষুনি বাবু ইশারায় দেবুকে চোখ টিপে দিয়েছিল। তাতেই দেবু মাঝপথ থেকে ফিরে এসেছে।

দেবু যেন পাথর হইয়া গিয়াছে; কোনো উত্তর দিল না, নিস্পন্দ হইয়া বসিয়া রহিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress