Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পঞ্চগ্রাম || Tarashankar Bandyopadhyay

পঞ্চগ্রাম || Tarashankar Bandyopadhyay

এক আষাঢ় মাস

এক আষাঢ় মাস। শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা পর্ব দ্বাদশ মাসে বিষ্ণুর দ্বাদশ যাত্রার মধ্যে আষাঢ়ে রথযাত্রা হিন্দুর সর্বজনীন উৎসব। পুরীতে জগন্নাথ-বিগ্রহের রথযাত্রাই ভারতবর্ষে প্রধান রথযাত্রা। সেখানেও আজ জগন্নাথ-বিগ্রহ জাতি-বৰ্ণ-নির্বিশেষে সকল মানুষের ঠাকুর অবশ্য এ জাতি-বৰ্ণ-নির্বিশেষত্ব কেবল হিন্দুধর্মাবলম্বীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ; হিন্দুদের সকলেই আজ রথের দড়ি স্পর্শ করিয়া জগন্নাথ-বিগ্রহের স্পৰ্শ-পুণ্যলাভের অধিকারী। জগন্নাথ-বিগ্রহ কাঙালের ঠাকুর।

পুরীর রথযাত্রা প্রধান রথযাত্রা হইলেও, হিন্দুসমাজের সর্বত্র বিশেষ করিয়া বাংলাদেশের প্রায় গ্রামে গ্রামেই ক্ষুদ্র বৃহৎ আকারে রথযাত্রার উৎসব অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে। উচ্চবর্ণের হিন্দুগৃহে আজ জগন্নাথদেবের উদ্দেশ্যে পঞ্চগব্য ও পঞ্চামৃতের সহযোগে পায়সানের বিশেষ ভোগ নিবেদন করা হইবে। আম-কাঁঠালের সময়, আম-কাঁঠাল ভোগের একটি অপরিহার্য উপকরণ। ধনী জমিদারদের অনেকেরই ঘরে প্রতিষ্ঠিত রথ আছে; কাঠের রথ, পিতলের রথ। এই রথে শালগ্ৰাম-শিলা অথবা প্রতিষ্ঠিত বিগ্ৰহমূর্তিকে অধিষ্ঠিত করিয়া পুরীর অনুকরণে রথ টানা হয়। বৈষ্ণবদের মঠে রথযাত্রা উপলক্ষে মহোৎসব সংকীর্তন হয়, মেলা বসিয়া থাকে। বাংলার চাষীদের অধিকাংশই বৈষ্ণবধর্মাশ্রয়ী, তাহারা এই পর্বটি বিশেষ আগ্রহে পালন করে; হলকর্ষণ নিষিদ্ধ করিয়া তাহারা পর্বটিকে আপনাদের জীবনের সঙ্গে অতি ঘনিষ্ঠভাবে জড়াইয়া লইয়াছে। দু-দশখানা গ্রাম অন্তর অবস্থাপন্ন-চাষীপ্রধান গ্রামে বাঁশ-কাঠ দিয়া প্রতি বৎসর নূতন রথ তৈয়ারি করিয়া পর্বের সঙ্গে উৎসব করে। ছোটখাটো মেলা বসে। আশপাশের লোকজন ভিড় করিয়া আসে। কাগজের ফুল, রঙিন কাগজে মোড়া বাঁশি, কাগজের ঘূর্ণিফুল, তালপাতার তৈরি হাত-পা-নাড়া হনুমান, দুম-পটকা বাজি, তেলেভাজা পাঁপর, বেগুনি, ফুলরি ও অল্পস্বল্প মনিহারীর জিনিস বিক্রি হয়।

মহাগ্রামের ন্যায়রত্নের বাড়িতে রথযাত্রার অনুষ্ঠান অনেক দিনের ন্যায়রত্নের ঊর্ধ্বতন চতুর্থ পুরুষ রথ-প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। গৃহদেবতা লক্ষ্মীজনার্দন ঠাকুর রথারোহণ করেন; পাঁচচূড়াবিশিষ্ট মাঝারি আকারের কাঠের রথ। একটি মেলাও বসে। আগে মেলাটা বেশ বড় হইত। বিশেষ করিয়া লাঙলের জন্য বাবলাকাঠের টুকরা, বাবুই-ঘাসের দড়ি, তৈয়ারি দরজা জানালা এবং কামারের সামগ্রী অর্থাৎ লোহার বড় গজাল, ফাল, কোদাল, কুড়ুল, কাটারি, হাতা, খন্তা কিনিতে কয়েকখানা গ্রামের লোকই এখানে ভিড় করিয়া আসিত। কিন্তু এখন আর সেসব জিনিস কেনাবেচা হয় না। স্থানীয় ছুতার-কামারেরা এখন সাহস করিয়া এসব জিনিস মেলায় বিক্রির জন্য তৈয়ারি করে না। তাহাদের পুঁজির অভাবও বটে, আবার লোকে কেনে না বলিয়াও বটে। একমাত্র লাঙলের জন্য বাবলাকাঠের কেনাবেচা এখনও কিছু হয় এবং বাবুই-ঘাস এবং বাবুই-দড়িও এখনও কিছু বিক্রি হয়। তবে অন্য কেনাবেচা কম হয় নাই, দোকানপাটও পূর্বাপেক্ষা বেশি সংখ্যায় আসে, লোকের ভিড়ও বাড়িয়াছে। মাতব্বর ছাড়াও লোকজনেরা ভিড় করিয়া আসিয়া থাকে। সস্তা শৌখিন মনিহারী জিনিসের দোকান, তৈরি জামাকাপড়ের দোকান আসে, জংশনের ফজাই শেখের জুতার দোকানও আসিয়া একপাশে বসে। কেনাবেচা যাহা হয়—তাহা এইসব দোকানেই। লোকও অনেক আসে। কয়েকখানা গ্রামের মাতব্বর লোকেরা আজও সসম্ভ্ৰমে ন্যায়রত্নের বাড়িতে ঠাকুরের রথযাত্রা উপলক্ষে আসিয়া উপস্থিত হয়, রথের টানে প্রথম মাতব্বরেরাই দড়ি ধরিবার অধিকারী। অপর লোকের জনতা দোকানেই বেশি। এখনও তাহারা ভিড় করিয়াই আসে। পাপর খাইয়া, কাগজের বাঁশি বাজাইয়া, নাগরদোলায়। চাপিয়া ঘুরপাক খাইয়া তাহারাই মেলা জমাইয়া দেয়।

মহাগ্রাম এককালে—এককালে কেন, প্রায় সত্তর-আশি বৎসর পূর্বেও—ওই অঞ্চলের প্রধান গ্রাম ছিল। ন্যায়রত্নই এ অঞ্চলের সমাজপতি, পরম নিষ্ঠাবান পণ্ডিতবংশের উত্তরাধিকারী। এককালে ন্যায়রত্নের পূর্বপুরুষেরাই ছিলেন এখানকার পঞ্চবিংশতি গ্রাম-সমাজের বিধান দাতা। পঞ্চবিংশতি গ্রাম-সমাজ অবশ্য বর্তমানকালে কল্পনার অতীত। কিন্তু এককালে ছিল। গ্রাম হইতে পঞ্চগ্রাম, সপ্তগ্রাম, নবগ্রাম, বিংশতিগ্রাম, পঞ্চবিংশতিগ্রাম—এমনিভাবেই গ্রাম্যসমাজের ক্রমবিস্তৃতি ছিল; বহুপূর্বে শতগ্রাম, সহস্রগ্রাম পর্যন্ত এই বন্ধনসূত্র অটুটও ছিল। তখন যাতায়াত ছিল কষ্টসাধ্য। এখন যাতায়াত সুগম হইয়াছে কিন্তু সম্পর্ক-বন্ধন বিচিত্রভাবে শিথিল হইয়া যাইতেছে। আজ অবশ্য সেসব নিতান্তই কল্পনার কথা, তবে পঞ্চগ্রাম-বন্ধন এখনও আছে। মহাগ্রাম আজ নামেই মহাগ্রাম, কেবলমাত্র ন্যায়রত্নের বংশের অস্তিত্বের লুপ্তপ্রায় প্রভাবের অবশিষ্টাংশ অ্যাঁকড়াইয়া ধরিয়া মহৎ বিশেষণে কোনোমতে টিকিয়া আছে। রথযাত্রার মতই কয়েকটি পর্ব উপলক্ষে লোকে ন্যায়রত্নদের টো, ও ঠাকুরবাড়িতে আসে। রথযাত্রা, দুর্গাপূজা, বাসন্তীপূজা—এই তিনটি পর্ব এখনও ন্যায়রত্নের বাড়িতে বেশ একটু সমারোহের সঙ্গেই অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে।

আজ ন্যায়রত্নের বাড়িতে রথযাত্রার উৎসব।

ন্যায়রত্ন নিজে হোম করিতেছেন। টোলের ছাত্ররা কাজকর্ম করিয়া ফিরিতেছে। কয়েকখানি গ্রামের মাতব্বরেরা আটচালায় শতরঞ্জির আসরে বসিয়া আছে। গ্রাম্য চৌকিদার এবং আরও কয়েকজন তামাক সাজিয়া দিতেছে। মেলার মধ্যেও লোকজনের ভিড় ধীরে ধীরে ক্রমশ বাড়িয়া চলিয়াছে। একটা ঢাকী ঢাক বাজাইয়া দোকানে দোকানে পয়সা মাগিয়া ফিরিতেছে।

বর্ষার আকাশে ঘনঘোর মেঘের ঘটা; শূন্যলোক যেন ভূপৃষ্ঠের নিকট স্তরে স্তরে নামিয়া আসিয়াছে। মধ্যে মধ্যে দুই-একখানা পাতলা কালো ধোঁয়ার মত মেঘ অতি দ্রুত ভাসিয়া চলিয়াছে; মনে হইতেছে সেগুলি বুঝি ময়ূরাক্ষীর বন্যারোধী উঁচু বধের উপর বহুকালের সুদীর্ঘ তালগাছগুলির মাথা ছুঁইয়া চলিয়াছে।

ঢাকের বাজনা শূন্যলোকের মেঘস্তরের বুকে প্রতিহত হইয়া দিগৃদিগন্তরে ছড়াইয়া পড়িতেছে।

শিবকালীপুরের দেবু ঘোষ ময়ূরাক্ষীর বন্যারোধী বাঁধ ধরিয়া দ্রুতপদে মহাগ্রামের দিকে চলিয়াছিল। ঢাকের গুরুগম্ভীর বাদ্যধ্বনি দিগন্তে গিয়া প্ৰতিধ্বনিত হইতেছে। মহাগ্রামেই ঢাক বাজিতেছে। ন্যায়রত্নের বাড়িতে রথযাত্রা। এতক্ষণে ঠাকুর বোধহয় রথে চড়িলেন। রথ হয়ত চলিতে আরম্ভ করিয়াছে। দ্রুত গতিতেই সে চলিয়াছিল, তবু সে তাহার গতি আরও দ্রুত করিবার। চেষ্টা করিল।

ন্যায়রত্ন মহাশয়ের পৌত্র বিশ্বনাথ দেবুর স্কুলের বন্ধু—শুধু বন্ধু নয়, স্কুলে তাহারা ছিল। পরস্পরের প্রতিযোগী। ক্লাসে কোনোবার দেবু ফাস্ট হইত, কোনোবার হইত বিশ্বনাথ। বিশ্বনাথ এম.এ পড়ে। দেবু পাঠশালার পণ্ডিত। এককালে, অর্থাৎ স্ত্রী-পুত্রের মৃত্যুর পূর্বে, একথা মনে করিয়া তীব্র অসন্তোষের আক্ষেপে দেবু বিদ্রুপের হাসি হাসিত। কিন্তু এখন আর হাসে না—দুঃখও তাহার নাই। প্রাক্তন অথবা অদৃষ্ট অমোঘ অখণ্ডনীয় বলিয়া নয়, সে যেন এখন এসবের গণ্ডির বাহিরে আসয়া পড়িয়াছে।

সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়িল যতীনকে।

ডেটিন্যু যতীন তাহাকে দিয়া গেল অনেক। এ সমস্তকে জয় করিবার শক্তি-যতীনের সাহায্যই তাহাকে দিয়াছে। যতীনবাবু আজ এখান হইতে চলিয়া গেলেন। এই কিছুক্ষণ পূর্বে সে তাহাকে ময়ূরাক্ষীর ঘাট পর্যন্ত আগাইয়া দিয়া বিদায় লইয়াছে। সেখান হইতে সে মহাগ্রামের দিকে আসিতেছে। তাহার শূন্য জীবনে ডেটিন্যু যতীনই ছিল একমাত্র সত্যকারের সঙ্গী। আজ সেও চলিয়া গেল। তাহার ইচ্ছা হইতেছিল এই বর্ষার মেঘাচ্ছন্ন দিনটিতে এই ময়ূরাক্ষীর ঘাটেই কোনো নির্জন গাছতলায় চুপ করিয়া বসিয়া থাকে। ওই ঘাটের পাশেই ময়ূরাক্ষীর বালছুরের উপর সে তাহার খোকনকে এবং প্ৰিয়তমা বিলুকে ছাই করিয়া দিয়াছে। জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে–অল্পস্বল্প বৃষ্টিতে সে চিহ্ন আজও নিঃশেষে মুছিয়া যায় নাই; তাহার পাশ দিয়া ভিজাবালির উপর পায়ের ছাপ ঝাঁকিয়া যতীন চলিয়া গেল। আজ যে ঘটা করিয়া মেঘ নামিয়াছে, নৈঋত কোণ হইতে যে মৃদুমন্দ বাতাস বহিতে শুরু করিয়াছে, তাহাতে বর্ষার বর্ষণ নামিতে আর দেরি নাই। গ্রাম মাঠঘাট ভাসিয়া ময়ূরাক্ষীতে ঢল্‌ নামিবে—সেই ঢলের স্রোতে খোকন-বিলুর চিতার চিহ্ন, যতীনের পায়ের দাগ নিঃশেষে মুছিয়া যাইবে—সেই মুছিয়া যাওয়া দেখিবার ইচ্ছা তাহার ছিল। কিন্তু ন্যায়রত্ন মহাশয়ের বাড়ির আহ্বান সে প্রত্যাখ্যান করিতে পারে না। যতীন তাহাকে জীবনে দিয়াছে একটি সুস্পষ্ট আদর্শ আর ন্যায়রত্ন তাহার জীবনে দিয়াছেন এক পরম সান্ত্বনা। তাহার সে গল্প যে ভুলিবার নয়। ঠাকুরমশাই আজ তাহাকে বিশেষ করিয়া আহ্বান জানাইয়াছেন। তাহার একটি বিশেষ কারণও আছে। স্নেহ তো আছেই, কিন্তু যে কারণ তিনি উল্লেখ করিয়াছেন—সেই কথাটিই দেবু ভাবিতেছিল।

সরকারি জরিপ আইন অনুযায়ী এ অঞ্চলে সেটেলমেন্ট সার্ভে হইয়া গেল। রেকর্ড অব্ রাইটসের ফাইনাল পাব্লিকেশনও হইয়া গিয়াছে। সেটেলমেন্টের খরচের অংশ দিয়া প্রজারা পরচা লইয়াছে। এইবার জমিদারের খাজনা-বৃদ্ধির পালা। সর্বত্র সকল জমিদারই এক ধুয়া তুলিয়াছে খাজনা বৃদ্ধি। আইনসম্মতভাবে তাহারা প্রতি দশ বৎসর অন্তর নাকি খাজনায় বৃদ্ধি পাইবার হকদার। আজ বহু দশ বৎসর পর সেটেলমেন্টের বিশেষ সুযোগে তাহারা খাজনাবৃদ্ধি করাইবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছে। ফসলের মূল্য বৃদ্ধি পাইয়াছে—এইটাই হইল খাজনাবৃদ্ধির প্রধান কারণ। রাজসরকারের প্রতিভূস্বরূপে জমিদারের প্রাপ্য নাকি ফসলের অংশ। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আমলে জমিদারেরা সেই প্রাপ্য ফসলের তৎকালীন মূল্যকেই টাকাখাজনায় রূপান্তরিত করিয়াছিল। সুতরাং আজ যখন ফসলের মূল্য সেকাল হইতে বহুগুণে বাড়িয়া গিয়াছে, তখন জমিদার বৃদ্ধি পাইবার হকদার। তা ছাড়া আরও একটা প্রকাণ্ড সুবিধা জমিদারের হইয়াছে। সেটেলমেন্ট আইনের পাঁচ ধারা অনুযায়ী স্থানে স্থানে সাময়িক আদালত বসিবে। সেখানে কেবল এই খাজনাবৃদ্ধির উচিত-অনুচিতের বিচার হইবে। অতি অল্প খরচে বৃদ্ধির মামলা দায়ের করা চলিবে বিচারও হইবে অল্প সময়ের মধ্যে। তাই আজ ছোট বড় সমস্ত জমিদারই একসঙ্গে বৃদ্ধি-বৃদ্ধি করিয়া কোমর বাঁধিয়া লাগিয়াছে।

প্রজারাও বসিয়া নাই; বৃদ্ধি দিব না এই রব তুলিয়া তাহারাও মাতিয়া উঠিয়াছে। হ্যাঁ, মতন বৈকি! যুক্তি আছে তাহাদের, তর্কও তাহারা করে। তাহারা বলে—ফসলের দাম বাড়িয়াছে সে কথা ঠিক, কিন্তু আমাদের সংসার-খরচ কত বাড়িয়াছে দেখ! জমিদার বলে সে দেখিবার কথা আমাদের নয়; আমাদের সম্পর্ক রাজভাগ ফসলের দামের সঙ্গে। এ সূক্ষ্ম যুক্তি প্রজারা বুঝিতে পারে না—বুঝিতে চায় না। তাহারা বলিতেছে—আমরা দিব না। এই দিব না কথাটির মধ্যে তাহারা আস্বাদ পায় এক অদ্ভুত তৃপ্তির। একক কেহ পাওনাদারের প্রাপ্য দিব না বলিলে সমাজে সে নিন্দিত হয়, কিন্তু ওইটিই মানুষের যেন অন্তরের কথা। না দিলে আমার যখন বাড়িবে—অন্তত কমিয়া যাওয়ার দুঃখ হইতে বাঁচিব-তখন না-দিবার প্রবৃত্তিই অন্তরে জাগিয়া ওঠে। তবে একক বলিলে সমাজে নিন্দা হয়, আদালতে পাওনাদার দেনাদারের কাছে। সহজেই প্রাপ্য আদায় করিয়া লয়। কিন্তু আজ যখন সমাজসুদ্ধ সকলেই দিব না রব তুলিয়াছে, তখন এ আর নিন্দার কথা কোথায়? আজ দাঁড়াইয়াছে দাবির কথা। রাজদ্বারে পাওনাদার করুক নালিশ; কিন্তু আজ তাহারা একখানি বাঁশের কঞ্চি নয়, আজ তাহারা কঞ্চির অ্যাঁটি-মুট করিয়া অনায়াসে ভাঙিয়া যাইবার ভয় নাই। ভয় নাই এই উপলব্ধির মধ্যে যে শক্তি আছে, যে মাতন আছে, সেই মাতনেই তাহারা মাতিয়া উঠিয়াছে। এখানকার প্রায় সকল গ্রামের প্রজারাই ধর্মঘট করিবে বলিয়া সংকল্প করিয়াছে। এখন প্রয়োজন তাহাদের নেতার। প্রায় প্রতি গ্রাম হইতে দেবু নিমন্ত্ৰণ পাইয়াছে। তাহাদের গ্রাম শিবকালীপুরের লোকেরা তাহাকে ব্যস্ত করিয়া তুলিয়াছে। এসব ব্যাপারে দেবুর আর নিজেকে জড়াইয়া ফেলিবার ইচ্ছা ছিল না। বারবার সে তাহাদের ফিরাইয়া দিতেই চাহিয়াছে—তবু তাহারা শুনিবে না। এদিকে মহাগ্রামের লোকে শরণাপন্ন হইয়াছিল ন্যায়রত্ন মহাশয়ের। ন্যায়রত্ন পত্ৰ লিখিয়া তাহাদিগকে দেবুর কাছে পাঠাইয়া দিয়াছেন। লিখিয়াছেন পণ্ডিত, আমার শাস্ত্রে ইহার বিধান নাই। ভাবিয়া দেখিলাম তুমি বিধান দিতে পার; বিবেচনা করিয়া তুমি ইহার বিধান দিও।

আজ এই রথযাত্রা উপলক্ষে পঞ্চগ্রামের চাষী মাতব্বরেরা ন্যায়রত্নের ঠাকুরবাড়িতে সমবেত হইবে। মহাগ্রামের উদ্যোক্তারা এই সুযোগে ধর্মঘটের উদ্যোগপর্বের ভূমিকাটা সারিয়া লইতে চায়। তাই বারবার দেবুকে উপস্থিত হইতে অনুরোধ করিয়াছে। ন্যায়রত্ন নিজেও আবার লিখিয়াছেনপণ্ডিত আমার আশীর্বাদ জানিবে। ঠাকুরের রথযাত্রা, অবশ্যই আসিবে। আমাকে বিপদ হইতে ত্রাণ কর। আমার ঠাকুরের রথ চলিবে সংসার সমুদ্র পার হইয়া পরলোকে। ইহলোকে যাহাদের প্রভুর রথ সুখ-সম্পদময় মাসির ঘরে যাইবে, তাহারা আমাকে লইয়া টানাটানি করিতেছে। দায়িত্বটা তুমি লইয়া আমাকে মুক্তি দাও। তোমার হাতে ভার দিতে পারিলে আমি নিশ্চিন্ত হইতে পারি। কারণ মানুষের সেবায় তুমি সর্বস্ব হারাইয়াছ; তোমার হাতে ঘটনাচক্রে যদি লাভের পরিবর্তে ক্ষতিও হয়—তবু সে ক্ষতিতে অমঙ্গল হইবে না বলিয়া আমার। প্রত্যয় আছে। দেবু এ নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করিতে পারে নাই। তাই স্ত্রী-পুত্রের চিতা-চিহ্নের বিপুল আকর্ষণ, বন্ধু যতীনের বিদায়বেদনার অবসাদ-সমস্ত ঝাড়িয়া ফেলিয়া সে মহাগ্রাম অভিমুখে চলিয়াছে।

ময়ূরাক্ষীর বন্যারোধী বধের উপর হইতে সে মাঠের পথে উত্তরমুখে নামিল। খানিকটা দূর গিয়াই মহাগ্রাম। ঢাকের শব্দ উচ্চতর হইয়া উঠিয়াছে। পথচলার গতি আরও খানিকটা দ্রুততর করিয়া, জনতার ভিড় ঠেলিয়া শেষে সে ন্যায়রত্নের ঠাকুরবাড়ির আটচালায় আসিয়া উঠিল। পূজার স্থানে প্রজ্জ্বলিত হোমবহ্নির সম্মুখে বসিয়াই ন্যায়রত্ন তাহাকে স্মিতহাস্যে সস্নেহে নীরব আহ্বান জানাইলেন।

দেবু প্রণাম করিল।

চাষী মাতব্বরেরাও দেবুকে সাগ্রহে সস্নেহে আহ্বান করিল।—এস এস, পণ্ডিত এস। এই এই এইখানে বস। সকলেই তাহাকে বসিতে দিবার জন্য জায়গা ছাড়িয়া দিয়া কাছে পাইতে চাহিল। দেবু কিন্তু সবিনয়ে হাসিয়া এক পাশেই বসিল; বলিল—এই বেশ বসেছি আমি—তবে তাহাদের আহ্বানের আন্তরিকতা তাহার বড় ভাল লাগিল। স্ত্রী-পুত্র হারাইয়া সে যেন এ অঞ্চলের সকল মানুষের স্নেহ-প্ৰীতির পাত্র হইয়া উঠিয়াছে। দুই বিন্দু জল তাহার চোখের কোণে জমিয়া উঠিল। তাহার সমস্ত অন্তরটা অপরিসীম কৃতজ্ঞতায় ভরিয়া উঠিল। মানুষের এত প্রেম!

আসিয়াছে অনেকে। মহাগ্রামের মুখ্য ব্যক্তি শিবু দাস, গোবিন্দ ঘোষ, মাখন মণ্ডল, গণেশ গোপ প্রভৃতি সকলে তো আছেই—তাহা ছাড়া শিবকালীপুরের হরেন্দ্র ঘোষাল আসিয়াছে, জগন ডাক্তারও আসিবে। দেখুড়িয়ার তিনকড়ি দাস আসিয়াছে, সঙ্গে আরও কয়েকজন; বালিয়াড়ার বৃদ্ধ কেনারাম, গোপাল ও গোকুলকে সঙ্গে লইয়া আসিয়াছে। কেনারাম সে-কালে গ্রাম্যপাঠশালায় পণ্ডিতি করিত, এখন সে বৃদ্ধ এবং অন্ধ; প্রাচীনকালের অভ্যাসবশেই বোধ করি দৃষ্টিশক্তিহীন চোখে এদিক হইতে ওদিক পর্যন্ত চাহিয়া দেখিল, তারপর সঙ্গী গোপালকে মৃদুস্বরে ডাকিল-গোপাল!

গোপাল পাশেই ছিল, সে বৃদ্ধের কানের কাছে মুখ আনিয়া ফিসফিস করিয়া বলিল–পণ্ডিত, দেবু ঘোষ।

কুব্জ বৃদ্ধ সোজা হইয়া ডাকিল দেবু? কই, দেবু কই?

দেবু আপনার স্থান হইতেই উত্তর দিল—ভাল আছেন?

—এইখানে—এইখানে, আমার কাছে এস তুমি।

এ আহ্বান দেবু উপেক্ষা করিতে পারি না, সে উঠিয়া আসিয়া বৃদ্ধের কাছে বসিয়া পায়ে হাত দিয়া স্পৰ্শ জানাইয়া প্ৰণাম করিয়া বলিল–প্রণাম করছি।

আপনার দুইখানি হাত দিয়া দেবুর মুখ হইতে বুক পর্যন্ত স্পৰ্শ করিয়া বৃদ্ধ বলিল–তোমাকে দেখতেই এসেছি আমি। পরক্ষণেই হাসিয়া বলিল—চোখে দেখতে পাই না, দৃষ্টি নাই, তাই তোমাকে গায়ে মুখে হাত বুলিয়ে দেখছি।

দেবু এই বৃদ্ধের কথার অন্তরালে যে সমবেদনা এবং প্রশংসার গাঢ় মধুর আস্বাদ অনুভব করিল, সে উচ্ছাসকে এড়াইবার জন্যই প্রসঙ্গান্তরের অবতারণা করিয়া বলিল—চোখের ছানি কাটিয়ে ফেলুন না। এই তো বেনাগড়েতে পাদ্রীদের হাসপাতালে আকছার ছানি কাটিয়ে আসছে লোকে। সত্যি সত্যিই ওখানে অপারেশন খুব ভাল হয়।

–অপারেশন? অস্ত্র করাতে বলছ?

–হ্যাঁ। সামান্য অপারেশন–হয়ে গেলেই পরিষ্কার দেখতে পাবেন।

—কি দেখব?—বৃদ্ধ অদ্ভুত হাসিয়া প্রশ্ন করিল—কি দেখব? তোমার শূন্য ঘর? তোমার চোখের জল? চোখ গিয়েছে ভালই হয়েছে দেবু। অকালমৃত্যুতে দেশ ছেয়ে গেল। সেদিন আমার একটা ভাগ্নে মল, বোনটা বুক ফাটিয়ে কাঁদলে—কানে শুনলাম, কিন্তু তার মরা মুখ তো দেখতে হল না! এ ভাল, দেবু এ ভাল! এখন কানটা কালা হয় তো এসব আর শুনতেও হয় না।

বৃদ্ধের দৃষ্টিহীন বিস্ফারিত চোখ হইতে জলের ধারা মুখের কুঞ্চিত লোল চৰ্ম সিক্ত করিয়া মাটির উপর ঝরিয়া পড়িল। স্লান হাসিমুখে দেবু চুপ করিয়া রহিল—কোনো উত্তর দিতে পারিল না। সমবেত সকলের কথাবার্তাও বন্ধ হইয়া গেল। শুধু ন্যায়রত্নের মন্ত্রধ্বনি একটা সঙ্গীতময় পরিবেশের সৃষ্টি করিয়া উচ্চারিত হইয়া ফিরিতে লাগিল।

ঠিক এই সময়েই টোলবাড়ির আটচালার বাহিরে খোলা উঠানে রাস্তা হইতে আসিয়া উঠিল আধুনিক সুদর্শন তরুণ, দেবুরই সমবয়সী। তাহার পিছনে একটি কুলির মাথায় ছোট একটি সুটকেস ও একটি ফলের ঝুড়ি। দেবু সাগ্রহে উঠিয়া দাঁড়াইল—বিশু-ভাই!

দেবুর বিশু-ভাই—বিশ্বনাথ–ন্যায়রত্নের পৌত্র।

ন্যায়রত্নের তখন কথা বলিবার অবকাশ ছিল না, শুধু তাহার ঠোঁটের কোণে মন্ত্রোচ্চারণের ছেদের মধ্যে একটু সস্নেহ হাসি ফুটিয়া উঠিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28
Pages ( 1 of 28 ): 1 23 ... 28পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress