২৩. দুদিন কাটল এমনি
দুদিন কাটল এমনি। তৃতীয় দিন খালের মোহনার ধারে হঠাৎ মহিমের নজরে পড়ল, খালে ঢুকছে একটি শিশুর মৃতদেহ। শ্যামবর্ণ নিটোল নবজাত শিশু উবু হয়ে জলে ভাসছে। নরহরির সাহায্যে শিশুটিকে ডাঙায় তুলে খাল ধারে পুঁতে দিল মহিম।
তারপর কী বিচিত্র খেয়ালে বাড়ি এসে সেই শিশুর মূর্তি গড়তে শুরু করল সে। এমন কী, কুঁজো কানাইয়ের মূর্তি শেষ করার আগেই সেই মূর্তি গড়তে লাগল।
আজ আর মহিমকে দেখে কেউ সুস্থ বলতে পারবে না। আজকের তার নাওয়া খাওয়া ভোলার চেহারা অন্যরকম। যেন জ্বরের বিকারের ঘোরে কাজ করছে সে। কাজ থামিয়ে চেয়ে থাকে তো চেয়েই থাকে। ঘন্টা কেটে যায়। তার মাথায় অদ্ভুত সব চিন্তার উদয় হতে লাগল। তার গড়া শিশুকে সে একবার ভাবল এ বুঝি হরেরামের বউয়ের বিয়োনো মরা ছেলে। আবার ভাবল এ হয়তো বনলতার অনাগত সন্তান। তারপর হঠাৎ তার মনে হল এই শিশু কেন অহল্যার গর্ভেও আসে না! মানুষ কোথা থেকে এল, কেন এল?…এক বিষয় থেকে আর বিষয়ে হাজার চিন্তায় মাথায় যেন রক্ত উঠে আসে তার। ঘরটার মধ্যে প্রেতের মতো পায়চারি করে সে। আচমকা ঠাণ্ডা মাটিতে বুক চেপে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে মাঝে মাঝে।
অহল্যা পাষাণ। সবই দেখছে, সবই শুনছে কিন্তু আড়াল ছেড়ে কখনওই বাইরে আসে না। ভরতের শেষ কথাগুলো কেবলি থেকে থেকে তার মনে পড়ে। চমকে চমকে নিজের গা হাত-পা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। মহিমকে দেখলেই চোখ নামিয়ে চকিতে আড়ালে সরে যায়। চোখ ভরা ত্রাস তার। গোপন কান্নার বদলে গোপন ভয় বুঝি বসা বেধেছে তার বুকে। ভাত বেড়ে দিয়ে বসা দূরের কথা, দাঁড়ায় না পর্যন্ত। এ কী হল তার! ভরত বলেছিল, কাঁদবার ঢের সময় পাবি। কোথায় সেই কান্না!… সে দেখল বউঠাকুরানীকে আসতে, শুনল মহিমের চলে যাওয়ার বাসনার কথা। দেখেছে মহিমকে আলিঙ্গনাবদ্ধ বউঠাকুরানীর বুকে। পাষাণের বুক অহল্যার, তবু কেন প্রাণের ধিকি ধিকি শব্দ শোনা যায়! নিশীথ রাত্রে বাড়ির পেছনে ডোবার নিস্তরঙ্গ জল ডাক দিয়ে গেল, হাতছানি দিয়ে গেল নয়নপুরের খালের তীব্র স্রোত। খালের মোহনায় মধুমতীর কোল ডাক দিয়ে দিল তাকে। কিন্তু ভেতরে দুটো মনের কোলাহলে নিঃসাড় রইল সে। ঘরের অন্ধ কোণে অশ্রুহীন চোখে হাত দিয়ে বসে রইল সে। জীবনের এ দুর্বোধ্য বিপর্যয় কীসের?
শিশুর মূর্তি গড়ার দুদিন বাদে সন্ধ্যার খানিক পরে মহিম ফিরে এল মোহনার ধার থেকে। তেমনি জ্বর বিকারের ঘোর লেগে রয়েছে তার মুখে, চোখ লাল, দৃষ্টি বিভ্রান্ত। চোয়াল শক্ত, ঠোঁট টেপা। সে সোজা এসে উঠল অহল্যার ঘরের দরজায়। ঘরে প্রদীপ জ্বলছে। মহিম ডাকল, বউদি।
অহল্যা বসেছিল চুপচাপ ঘরের মধ্যে। তাড়াতাড়ি ঘোমটা টেনে দিয়ে মুখ ফিরিয়ে জবাব দিল, কী?
তোমারে একটা কথা বলতে আসছি।
অহল্যা নীরব। মহিমও। খানিকক্ষণ চুপ থেকে যেন নিজেকে তৈরি করে নিয়ে বলল, মুই চলে যাব এখান থে।
বলতে তার গলায় যেন কী ঠেলে এল ভিতর থেকে। তাকে জোর করে রোধ করে বলল আবার, মুই কাঁটা হইছি তোমার, সরে যাওয়া মোর ভাল। মুই কাছে থাকলে তোমার যন্ত্রণা লাগে, তার শেষ হউক।
এক মুহূর্ত নীরব থেকে অহল্যা বলল, কে কাঁটা হইছে ভগবান জানে তা। যেতে চাইলে আটকাবে কে তোমারে?
বিভ্রান্ত চোখ মহিমের হঠাৎ স্থির হয়ে গেল। মাথা নিচু করে বলল, কেউ আটকাবে না। মোর ঘরে একটু আসবে।
কেন?
কাম ছিল।
একটু চুপ থেকে অহল্যা বলল, চলো যাচ্ছি।
মহিম চলে গেল নিজের ঘরে। অহল্যা প্রদীপ নিয়ে মহিমের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
মহিম ডাকল, ভিতরে আসো।
অহল্যা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মহিমকে দেখে ভিতরে এল।
মহিম শান্তভাবে বলল, বসো না কেন?
কী করবে মহিম, কী চায়? অহল্যা চমকায়। প্রদীপ রেখে বসল সে।
মহিম সেই শিশুর মূর্তি অহল্যার কোলে রেখে দিয়ে বলল, তোমারে কভু কিছু দেই নাই, এটা দিলাম। মোরে ঠেলে দিলা, মোর হাতে গড়া একে কি ঠেলতে পারবে?
অহল্যা ফ্যাকাসে মুখে আর্তনাদ করে উঠল। দুহাতে মুখ ঢেকে বলে উঠল সে, এ কী করলা, এ কী করলা তুমি? এত নির্দয়, এত বড় শত্তুর হইলা তুমি মোর?
শত্তুর! কেন?
নয়? অহল্যা ড়ুকরে উঠল। বলল, মোর যে কোনও আশা নাই, সব যে শেষ হইয়া গেছে। হায়, তোমার দাদাও যে আর নাই।
কথা শুনে বুকটা পুড়ে গেল মহিমের। সে তো এ কথা ভাবে নাই। সে যে রক্তক্ষয়ী অভিমান বশে তার শেষ দান ওই শিশুটি অহল্যাকে দিয়ে যেতে চেয়েছিল। যে বুক তাকে ত্যাগ করেছে, সে বুকে অহল্যার নিয়তি কামনার মূর্তি স্থান পাবে ভেবেছিল। ..সে দুহাতে মুখ ঢেকে অপরাধীর মতো ছুটে পালিয়ে গেল।
অহল্যার বুক ফাটল, চোখ ফেটে জল এল। বার বার এইকথা বলতে লাগল এ কী করলা, এ কী করলা। তারপর মুখ তুলে দেখল মহিম নেই। বাতি জ্বলছে। তার চোখ পড়ল শিশুর দিকে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল তার। এ কী দেখছে সে। কোলে তার নধর শ্যাম শিশু, অপলক মধুর চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। নরম ঠোঁট ঈষৎ ফাঁক, কচি মাড়ি দেখা যাচ্ছে তার ভিতরে। সুগোল কচি কচি হাত বাড়ানো অহল্যার দিকে। বুঝি ডাক শুনতে পেল শিশুর। আচমকা সন্তানহীনা অহল্যার স্তনযুগলের শিরা-উপশিরা বড় ভারী হয়ে টনটন করে উঠল, স্ফীত হয়ে উঠল স্তনের বোঁটা।
তাড়াতাড়ি উঠে দরজা বন্ধ করে বুকের কাপড় খুলে মাটির ঠাণ্ডা শিশুকে আগুনের মতো উষ্ণ বুকে চেপে ধরল সে। যেন প্রাণ সঞ্চার করবে মাটির শিশুর মধ্যে। …থাকতে থাকতে নিজেকে দেখার বাসনা তার উদগ্র হয়ে উঠল। সর্বাঙ্গ বিকৃন্ত্র করে মুগ্ধ চোখে নিজেকে দেখতে লাগল সে। …নিটোল পা, বিশাল উরত, প্রশস্ত নিতম্ব, জননীর জঠর, বলিষ্ঠ বুক, সুডৌল হাত। বিস্মিত মুগ্ধ চোখে দু-হাতে স্তন তুলে দেখল সে। তারপর মাটিতে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। বিরাম নেই সে কান্নার।
অনেকক্ষণ কেঁদে কেঁদে একসময় সে থামল। মাটির শিশু মাটিতে রাখল, মহিমের মুখ মনে পড়ল তার। সে মুখ মনে করে উৎকণ্ঠায় বুক ভরে উঠল তার, হাহাকার করে উঠল প্রাণ। সেই অসহায় দিশেহারা যন্ত্রণাকাতর মুখ মনে করে অপরাধে নিজেকে ধিক্কার দিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। মহিমকে মেরে ফেলতে বসেছে সে। তার শৈশবের বন্ধু, অহল্যাবউয়ের উপর একান্ত নির্ভরশীল মহিম! তাকে সে বিদেশে, বউঠাকুরানীর অচেনা বুকের আগুনে ছুড়ে দিতে চাইছে দখে মারবার জন্য! কেন সে বুঝল না, মহিমের সারা প্রাণ ছড়ানো নয়নপুর, তার প্রিয়তম বন্ধুদের তিরোভাব, বীভৎস হত্যা, ভিটের শশাকে ভাইয়ের মৃত্যু সব যখন তাকে দিশেহারা করে দিয়েছে সেই সময় অহল্যার সরে যাওয়া তার মাথায় মৃত্যু-আঘাত করেছে। সে তো জানত, এ জীবনে নিজের কথা ভেবে কোনও লাভ নেই। তবু নিজেকে নিয়েই সে কেন পড়েছিল?
এস্তে কাপড় সামলে বাতি নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে সে দরজা খুলল। ডাকল, ঠাকুরপো।
নিস্তব্ধ অন্ধকার উঠোন থেকে মানুষ দেখে শেয়াল পালিয়ে গেল। সেখানে কেউ নেই। ভয়ে কান্না পেল অহল্যার। ডাকল, মহী, মহী।
সাড়া নেই। সব নিস্তব্ধ। গাছের আঁধার কোল থেকে রাতজাগা পাখি অকে। অহল্যা ছুটে নিজের ঘরে গেল! ঘর খালি। রান্নাঘর, চেঁকিঘর সব শুন্য। হঠাৎ নজরে পড়ল বাড়ির পিছনে পিপুলতলায় মাটিতে বুক চেপে মহিম শুয়ে আছে। বুকটা পুড়ে গেল অহল্যার। তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে দু-হাতে মহিমের মাথাটা তুলে ধরে ডাকল, মহী, মহী, ওঠো!
মহী, মহী, ওঠো।
মহিম মাথা তুলে চোখে মেলে তাকাল। রক্তবর্ণ চোখ, বিভ্রান্ত দৃষ্টি। বলল, আজ নয়, কাল চলে যাব।
কান্না চেপে অসম্ভব শক্তিতে অহল্যা মহিমকে টেনে তুলল। বলল, কোথায় যাবে এখন ছেড়ে? কোথাও যেতে পারবে না। ওঠো শিগগির মাটি ছেড়ে!
স্থির চোখে মহিম তাকাল অহল্যার দিকে, চোখের ঘোর যেন কাটতে লাগল।
মহিমের মুখভাব দেখে কান্না ঠেলে এল অহল্যার। বলল, মোর বুঝি খিদে তেষ্টা নাই। ওঠো, খাবে চলো।
এবার মহিম অহল্যার কোলে মুখ রেখে সেই শিশুর মতো ফুলে ফুলে উঠল কান্নায়। সে কান্নায় অহল্যার কান্না এল।