নৌকাডুবি (46-50)
নৌকাডুবি ৪৬
এখন রমেশের সম্মুখে কোনো কাজ রহিল না। তাহার মনে হইতে লাগিল, ইহজীবনে সে যেন কোনো কাজ করিবে না, কোথাও স্থায়ী হইয়া বসিতে পারিবে না। হেমনলিনীর কথা তাহার মনে একেবারেই যে উঠে নাই তাহা নহে, কিন্তু তাহা সে সরাইয়া দিয়াছে; সে মনে মনে বলিয়াছে, ‘আমার জীবনে যে নিদারুণ ঘটনা আঘাত করিল তাহাতে আমাকে চিরদিনের জন্য সংসারের অযোগ্য করিয়া তুলিয়াছে। বজ্রাহত গাছ প্রফুল্ল উপবনের মধ্যে স্থান পাইবার আশা কেন করিবে?’
রমেশ মিণ করিয়া বেড়াইবার জন্য বাহির হইল। এক জায়গায় কোথাও বেশি দিন রহিল না। সে নৌকায় চড়িয়া কাশীর ঘাটের শোভা দেখিল, সে দিল্লিতে কুতবমিনরের উপরে চড়িল, আগ্রায় জ্যোৎস্না-রাত্রে তাজ দেখিয়া আসিল। অমৃতসরে গুরুদরবার দেখিয়া রাজপুতানায় আবুপর্বতশিখরে মন্দির দেখিতে গেল–এমনি করিয়া রমেশ নিজের শরীর-মনকে আর বিশ্রাম দিল না।
অবশেষে এই মিণশ্রান্ত যুবকটির অন্তঃকরণ কেবল ঘর চাহিয়া হা হা করিতে লাগিল। তাহার মনে একটি শান্তিময় ঘরের অতীত সমৃতি ও একটি সম্ভবপর ঘরের সুখময় কল্পনা কেবলই আঘাত দিতেছে। অবশেষে একদিন তাহার শোককাল-যাপনের মিণ হঠাৎ শেষ হইয়া গেল এবং সে একটা মস্ত দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কলিকাতার টিকিট কিনিয়া রেলগাড়িতে উঠিয়া পড়িল।
কলিকাতায় পৌঁছিয়া রমেশ সেই কলুটোলার গলিটার ভিতরে হঠাৎ প্রবেশ করিতে পারিল না। সেখানে গিয়া সে কী দেখিবে, কী শুনিবে, তাহার কিছুই ঠিকানা নাই। মনের মধ্যে কেবলই একটা আশঙ্কা হইতে লাগিল যে, সেখানে একটা গুরুতর পরিবর্তন হইয়াছে। একদিন তো সে গলির মোড় পর্যন্ত গিয়া ফিরিয়া আসিল। পরদিন সন্ধ্যাবেলা রমেশ নিজেকে জোর করিয়া সেই বাড়ির সম্মুখে উপস্থিত করিল। দেখিল, বাড়ির সমস্ত দরজাজোনলা বন্ধ, ভিতরে কোনো লোক আছে এমন লক্ষণ নাই। তবু সেই সুখন-বেহারাটা হয়তো শূন্য বাড়ি আগলাইতেছে মনে করিয়া রমেশ বেহারাকে ডাকিয়া দ্বারে বারকতক আঘাত করিল। কেহ সাড়া দিল না। প্রতিবেশী চন্দ্রমোহন তাহার ঘরের বাহিরে বসিয়া তামাক খাইতেছিল; সে কহিল, “কে ও। রমেশবাবু নাকি। ভালো আছেন তো? এ বাড়িতে অন্নদাবাবুরা তো এখন কেহ নাই।”
রমেশ। তাঁহারা কোথায় গেছেন জানেন?
চন্দ্র। সে খবর তো বলিতে পারি না, পশ্চিমে গেছেন এই জানি।
রমেশ। কে কে গেছেন মশায়?
চন্দ্র। অন্নদাবাবু আর তাঁর মেয়ে।
রমেশ। ঠিক জানেন, তাঁহাদের সঙ্গে আর কেহ যান নাই?
চন্দ্র। ঠিক জানি বৈকি। যাইবার সময়ও আমার সঙ্গে দেখা হইয়াছে।
তখন রমেশ ধৈর্যরক্ষায় অক্ষম হইয়া কহিল, “আমি একজনের কাছে খবর পাইয়াছি, নলিনবাবু বলিয়া একটি বাবু তাঁহাদের সঙ্গে গেছেন।”
চন্দ্র। ভুল খবর পাইয়াছেন। নলিনবাবু আপনার ঐ বাসাটাতেই দিন-কয়েক ছিলেন। ইঁহারা যাত্রা করিবার দিন-দুইচার পূর্বেই তিনি কাশীতে গেছেন।
নৌকাডুবি ৪৬ (২)
রমেশ তখন এই নলিনবাবুটির বিবরণ প্রশ্ন করিয়া করিয়া চন্দ্রমোহনের কাছ হইতে বাহির করিল। ইঁহার নাম নলিনাক্ষ চ-োপাধ্যায়। শোনা গেছে, পূর্বে রংপুরে ডাক্তারি করিতেন, এখন মাকে লইয়া কাশীতেই আছেন। রমেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিল। জিজ্ঞাসা করিল, যোগেন এখন কোথায় আছে বলিতে পারেন?”
চন্দ্রমোহন খবর দিল, যোগেন্দ্র ময়মন্সিঙের একটি জমিদারের স্থাপিত হাই-স্কুলের হেড্মাস্টার-পদে নিযুক্ত হইয়া বিশাইপুরে গিয়াছে।
চন্দ্রমোহন জিজ্ঞাসা করিল, “রমেশবাবু, আপনাকে তো অনেকদিন দেখি নাই; আপনি এতকাল কোথায় ছিলেন?”
রমেশ আর গোপন করবার কারণ দেখিল না; সে কহিল, “প্র্যাকটিস করিতে গাজিপুরে গিয়াছিলাম।”
চন্দ্র। এখন তবে কি সেইখানেই থাকা হইবে?
রমেশ। না, সেখানে আমার থাকা হইল না; এখন কোথায় যাইব ঠিক করি নাই।
রমেশ চলিয়া যাইবার অনতিকাল পরেই অক্ষয় আসিয়া উপস্থিত হইল। যোগেন্দ্র চলিয়া যাইবার সময়,
মাঝে মাঝে তাহাদের বাড়ির তত্ত্বাবধানের জন্য অক্ষয়ের উপর ভার দিয়া গিয়াছিল। অক্ষয় যে ভার গ্রহণ করে তাহা রক্ষা করিতে কখনো শৈথিল্য করে না; তাই সে হঠাৎ যখন-তখন আসিয়া দেখিয়া যায়, বাড়ির বেহারা দুজনের মধ্যে একজনও হাজির থাকিয়া খবরদারি করিতেছে কি না।
চন্দ্রমোহন তাহাকে কহিল, “রমেশবাবু এই খানিকক্ষণ হইল এখান হইতে চলিয়া গেলেন।”
অক্ষয়। বলেন কী! কী করিতে আসিয়াছিলেন?
চন্দ্র। তাহা তো জানি না। আমার কাছে অন্নদাবাবুদের সমস্ত খবর জানিয়া লইলেন। এমন রোগা হইয়া গেছেন, হঠাৎ তাঁহাকে চেনাই কঠিন; যদি বেহারাকে না ডাকিতেন আমি চিনিতে পারিতাম না।
অক্ষয়। এখন কোথায় থাকেন, খবর পাইলেন?
চন্দ্র। এতদিন গাজিপুরে ছিলেন; এখন সেখান হইতে উঠিয়া আসিয়াছেন, কোথায় থাকিবেন ঠিক করিয়া বলিতে পারিলেন না।
অক্ষয় বলিল, “ও” বলিয়া আপন কর্মে মন দিল।
রমেশ বাসায় ফিরিয়া আসিয়া ভাবিতে লাগিল, ‘অদৃষ্ট এ কী বিষম কৌতুকে প্রবৃত্ত হইয়াছে। এক দিকে
আমার সঙ্গে কমলার ও অন্য দিকে নলিনাক্ষের সঙ্গে হেমনলিনীর এই মিলন, এ যে একেবারে উপন্যাসের মতো–সেও কুলিখিত উপন্যাস। এমনতরো ঠিক উল্টাপাল্টা মিল করিয়া দেওয়া অদৃষ্টেরই মতো বে-পরোয়া রচয়িতার পক্ষেই সম্ভব–সংসারে সে এমন অদ্ভুত কাণ্ড ঘটায় যাহা ভীরু লেখক কাল্পনিক উপাখ্যানে লিখিতে সাহস করে না।’ কিন্তু রমেশ ভাবিল, এবার সে যখন তাহার জীবনের সমস্যাজাল হইতে মুক্ত হইয়াছে, তখন খুব সম্ভব, অদৃষ্ট এই জটিল উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ে রমেশের পক্ষে নিদারুণ উপসংহার লিখিবে না।
যোগেন্দ্র বিশাইপুর জমিদার-বাড়ির নিকটবর্তী একটি একতলা বাড়িতে বাসা পাইয়াছিল; সেখানে রবিবার সকালে খবরের কাগজ পড়িতেছিল এমন সময় বাজারের একটি লোক তাহার হাতে একখানি চিঠি দিল। খামের উপরকার অক্ষর দেখায়াই সে আশ্চর্য হইয়া গেল। খুলিয়া দেখিল রমেশ লিখিয়াছে–সে বিশাইপুরের একটি দোকানে অপেক্ষা করিতেছে, বিশেষ কয়েকটি কথা বলিবার আছে।
নৌকাডুবি ৪৬ (৩)
যোগেন্দ্র একেবারে চৌকি ছাড়িয়া লাফাইয়া উঠিল। রমেশকে যদিও সে একদিন অপমান করিতে বাধ্য হইয়াছিল তবু সেই বাল্যবন্ধুকে এই দূরদেশে এতদিন অদর্শনের পরে ফিরাইয়া দিতে পারিল না। এমন-কি, তাহার মনের মধ্যে একটা আনন্দই হইল, কৌতূহলও কম হইল না। বিশেষত হেমনলিনী যখন কাছে নাই, তখন রমেশের দ্বারা কোনো অনিষ্টের আশঙ্কা করা যায় না।
পত্রবাহকটিকে সঙ্গে করিয়া যোগেন্দ্র নিজেই রমেশের সন্ধানে চলিল। দেখিল, সে একটি মুদির দোকানে একটা শূন্য কেরোসিনের বাক্স খাড়া করিয়া তাহার উপরে চুপ করিয়া বসিয়া আছে; মুদি ব্রাহ্মণের হুঁকায় তাহাকে তামাক দিতে প্রস্তুত হইয়াছিল, কিন্তু চশমা-পরা বাবুটি তামাক খায় না শুনিয়া মুদি তাহাকে শহরজাত কোনো অদ্ভুতশ্রেণীর পদার্থের মধ্যে গণ্য করিয়াছিল। সেই অবধি পরস্পরের মধ্যে কোনোপ্রকার আলাপ-পরিচয়ের চেষ্টা হয় নাই।
যোগেন্দ্র সবেগে আসিয়া একেবারে রমেশের হাত ধরিয়া তাহাকে টানিয়া তুলিল; কহিল, “তোমার সঙ্গে পারা গেল না। তুমি আপনার দ্বিধা লইয়াই গেলে। কোথায় একেবারে সোজা আমার বাসায় আসিয়া হাজির হইবে, না, পথের মধ্যে মুদির দোকানে গুড়ের বাতাসা ও মুড়ির চাকতির মাঝখানে অটল হইয়া বসিয়া আছ!”
রমেশ অপ্রতিভ হইয়া একটুখানি হাসিল। যোগেন্দ্র পথের মধ্যে অনর্গল বকিয়া যাইতে লাগিল; কহিল, “যিনিই যাই বলুন, বিধাতাকে আমরা কেহই চিনিতে পারি নাই। তিনি আমাকে শহরের মধ্যে মানুষ করিয়া এতবড়ো শাহরিক করিয়া তুলিলেন, সে কি এই ঘোর পাড়াগাঁয়ের মধ্যে আমার জীবাত্মাটাকে একেবারে মাঠে মারিবার জন্য?”
রমেশ চারি দিকে তাকাইয়া কহিল, “কেন, জায়গাটি তো মন্দ নয়।”
যোগেন্দ্র। অর্থাৎ?
রমেশ। অর্থাৎ, নির্জন—
যোগেন্দ্র। এইজন্য আমার মতো আরো একটি জনকে বাদ দিয়া এই নির্জনতা আর-একটু বাড়াইবার জন্য আমি অহরহ ব্যাকুল হইয়া আছি।
রমেশ। যাই বল, মনের শান্তির পক্ষে—
যোগেন্দ্র। ও-সব কথা আমাকে বলিয়ো না–কয়দিন প্রচুর মনের শান্তি লইয়া আমার প্রাণ একেবারে কণ্ঠাগত হইয়া আসিয়াছে। আমার সাধ্যমত এই শান্তি ভাঙিবার জন্য ত্রুটি করি নাই। ইতিমধ্যে সেক্রেটারির সঙ্গে হাতাহাতি হইবার উপক্রম হইয়াছে। জমিদার-বাবুটিকেও আমার মেজাজের যে-প্রকার পরিচয় দিয়াছি সহজে তিনি আমার উপরে আর হস্তক্ষেপ করিতে আসিবেন না। তিনি আমাকে দিয়া ইংরাজি খবরের কাগজে তাঁহার নকিবি করাইয়া লইতে ইচ্ছুক ছিলেন–কিন্তু আমার ইচ্ছা স্বতন্ত্র, সেটা আমি তাঁকে কিছু প্রবলভাবে বুঝাইয়া দিয়াছি। তবু যে টিঁকিয়া আছি সে আমার নিজগুণে নয়। এখানকার জয়েণ্ট্সাহেব আমাকে অত্যন্ত পছন্দ করিয়াছেন; জমিদারটি সেইজন্য ভয়ে আমাকে বিদায় করিতে পারিতেছেন না। যেদিন গেজেটে দেখিব, জয়েণ্ট্ বদলি হইতেছেন সেইদিনই বুঝিব, আমার হেড্মাস্টারি-সূর্য বিশাইপুরের আকাশ হইতে অস্তমিত হইল। ইতিমধ্যে এখানে আমার একটিমাত্র আলাপী আছে, আমার পাঞ্চ্কুকুরটি। আর-সকলেই আমার প্রতি যেরূপ দৃষ্টিনিক্ষেপ করিতেছে তাহাকে কোনোমতেই শুভদৃষ্টি বলা চলে না।
নৌকাডুবি ৪৬ (৪)
যোগেন্দ্রের বাসায় আসিয়া রমেশ একটা চৌকিতে বসিল। যোগেন্দ্র কহিল, “না, বসা নয়। আমি জানি প্রাতঃস্নান নামে তোমার একটা ঘোরতর কুসংস্কার আছে, সেটা সারিয়া এসো। ইতিমধ্যে আর-এক বার গরম জলের কাৎলিটা আগুনে চড়াইয়া দিই। আতিথ্যের দোহাই দিয়া আজ দ্বিতীয় বার চা খাইয়া লইব।”
এইরূপে আহার আলাপ ও বিশ্রামে দিন কাটিয়া গেল। রমেশ যে বিশেষ কথাটা বলিবার জন্য এখানে আসিয়াছিল যোগেন্দ্র সমস্ত দিন তাহা কোনোমেতই বলিবার অবকাশ দিল না। সন্ধ্যার পর আহারান্তে কেরোসিনের আলোকে দুইজনে দুই কেদারা টানিয়া লইয়া বসিল। অদূরে শৃগাল ডাকিয়া গেল ও বাহিরে অন্ধকার রাত্রি ঝিল্লির শব্দে স্পন্দিত হইতে লাগিল।
রমেশ কহিল, “যোগেন, তুমি তো জানই, তোমাকে কী কথা বলিতে আমি এখানে আসিয়াছি। একদিন তুমি আমাকে যে প্রশ্ন করিয়াছিলে সে প্রশ্নের উত্তর করিবার সময় তখন উপস্থিত হয় নাই। আজ আর উত্তর দিবার কোনো বাধা নাই।”
এই বলিয়া রমেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। তাহার পরে ধীরে ধীরে সে আগাগোড়া সমস্ত ঘটনা বলিয়া গেল। মাঝে মাঝে তাহার স্বর রুদ্ধ হইয়া কণ্ঠ কম্পিত হইল, মাঝে মাঝে কোনো কোনো জায়গায় সে দুই-এক মিনিট চুপ করিয়া রহিল। যোগেন্দ্র কোনো কথা না বলিয়া স্থির হইয়া শুনিল।
যখন বলা হইয়া গেল তখন যোগেন্দ্র একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, “এই-সকল কথা যদি সেদিন বলিতে, আমি বিশ্বাস করিতে পারিতাম না।”
রমেশ। বিশ্বাস করার হেতু তখনো যেটুকু ছিল, এখনো তাহাই আছে। সেজন্য তোমার কাছে আমার প্রার্থনা যে, আমি যে গ্রামে বিবাহ করিয়াছিলাম সে গ্রামে একবার তোমাকে যাইতে হইবে। তাহার পর সেখান হইতে কমলার মাতুলালয়েও লইয়া যাইব।
যোগেন্দ্র। আমি কোনোখানে এক পা নড়িব না, আমি এই কেদারাটার উপরে অটল হইয়া বসিয়া তোমার কথার প্রত্যেক অক্ষর বিশ্বাস করিব। তোমার সকল কথাই বিশ্বাস করা আমার চিরকালের অভ্যাস; জীবনে একবারমাত্র তাহার ব্যত্যয় হইয়াছে, সেজন্য আমি তোমার কাছে মাপ চাই।
এই বলিয়া যোগেন্দ্র চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া রমেশের সম্মুখে আসিল; রমেশ উঠিয়া দাঁড়াইতেই দুই বাল্যবন্ধু একবার পরস্পর কোলাকুলি করিল। রমেশ রুদ্ধ কণ্ঠ পরিষ্কার করিয়া লইয়া কহিল, “আমি কোথা হইতে ভাগ্যরচিত এমন একটা দুশ্ছেদ্য মিথ্যার জালে জড়াইয়া পড়িয়াছিলাম যে, তাহার মধ্যেই সম্পূর্ণ ধরা দেওয়া ছাড়া আমি কোনো দিকেই কোনো উপায় দেখিতে পাই নাই। আজ যে আমি তাহা হইতে মুক্ত হইয়াছি, আর যে আমার কাহারো কাছে কিছুই গোপন করিবার নাই, ইহাতে আমি প্রাণ পাইয়াছি। কমলা কী জানিয়া, কী ভাবিয়া আত্মহত্যা করিল, তাহা আমি আজ পর্যন্ত বুঝিতে পারি নাই, আর বুঝিবার কোনো সম্ভাবনাও নাই–কিন্তু ইহা নিশ্চয়, মৃত্যু যদি এমন করিয়া আমাদের দুই জীবনের এই কঠিন গ্রনিথ কাটিয়া না দিত, তবে শেষকালে আমরা দুজনে যে কোন্ দুর্গতির মধ্যে গিয়া দাঁড়াইতাম তাহা মনে করিলে এখনো আমার হৃৎকম্প হয়। মৃত্যুর গ্রাস হইতে একদিন সে সমস্যা অকসমাৎ উঠিয়া আসিয়াছিল, মৃত্যুর গর্ভেই একদিন সেই সমস্যা তেমনি অকসমাৎ বিলীন হইয়া গেল।”
যোগেন্দ্র। কমলা যে নিশ্চয়ই আত্মহত্যা করিয়াছে তাহা অসংশয়ে স্থির করিয়া বসিয়ো না। সে যাই হোক, তোমার এ দিকটা তো পরিষ্কার হইয়া গেল, এখন নলিনাক্ষের কথা আমি ভাবিতেছি।
নৌকাডুবি ৪৬ (৫)
তাহার পরে যোগেন্দ্র নলিনাক্ষকে লইয়া পড়িল। কহিল, “আমি ওরকম লোকদের ভালো বুঝি না এবং যাহা বুঝি না তাহা আমি পছন্দও করি না। কিন্তু অনেক লোকের অন্যরকম মতিই দেখি, তাহারা যাহা বোঝে না তাহাই বেশি পছন্দ করে। তাই হেমের জন্য আমার যথেষ্ট ভয় আছে। যখন দেখিলাম, সে চা ছাড়িয়া দিয়াছে, মাছ-মাংসও খায় না, এমন-কি, ঠাট্টা করিলে পূর্বের মতো তাহার চোখ ছল্ছল্ করিয়া আসে না, বরং মৃদুমন্দ হাসে, তখন বুঝিলাম গতিক ভালো নয়। যাই হোক, তোমাকে সহায় পাইলে তাহাকে উদ্ধার করিতে কিছুমাত্র বিলম্ব হইবে না তাহাও আমি নিশ্চয় জানি; অতএব প্রস্তুত হও, দুই বন্ধু মিলিয়া সন্ন্যাসীর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিতে হইবে।”
রমেশ হাসিয়া কহিল, “আমি যদিও বীরপুরুষ বলিয়া খ্যাত নই, তবু প্রস্তুত আছি।”
যোগেন্দ্র। রোসো, আমার ক্রিস্ট্মাসের ছুটিটা আসুক।
রমেশ। সে তো দেরি আছে, ততক্ষণ আমি একলা অগ্রসর হই-না কেন?
যোগেন্দ্র। না না, সেটি কোনোমতেই হইবে না। তোমাদের বিবাহটি আমিই ভাঙিয়াছিলাম, আমি নিজের হাতে তাহার প্রতিকার করিব। তুমি যে আগেভাগে গিয়া আমার এই শুভকার্যটি চুরি করিবে, সে আমি ঘটিতে দিব না। ছুটির তো আর দশ দিন বাকি আছে।
রমেশ। তবে ইতিমধ্যে আমি একবার-
যোগেন্দ্র। না না, সে-সব কিছু শুনিতে চাই না–এ দশ দিন তুমি আমার এখানেই আছ। এখানে ঝগড়া করিবার যতগুলা লোক ছিল সব আমি একটি একটি করিয়া শেষ করিয়াছি; এখন মুখের তার বদলাইবার জন্য একজন বন্ধুর প্রয়োজন হইয়াছে, এ অবস্থায় তোমাকে ছাড়িবার জো নাই। এতদিন সন্ধ্যাবেলায় কেবলই শেয়ালের ডাক শুনিয়া আসিয়াছি; এখন, এমন-কি, তোমার কণ্ঠস্বরও আমার কাছে বীণাবিনিন্দিত বলিয়া মনে হইতেছে, আমার অবস্থা এতই শোচনীয়।
নৌকাডুবি ৪৭
চন্দ্রমোহনের কাছে রমেশের খবর পাইয়া অক্ষয়ের মনে অনেকগুলা চিন্তার উদয় হইল। সে ভাবিতে লাগিল, ব্যাপারখানা কী? রমেশ গাজিপুরে প্র্যাকটিস করিতেছিল, এতদিন নিজেকে যথেষ্ট গোপনেই রাখিয়াছিল, ইতিমধ্যে এমন কী ঘটিল যাহাতে সে সেখানকার প্র্যাকটিস ছাড়িয়া দিয়া আবার সাহসপূর্বক কলুটোলার গলির মধ্যে আত্মপ্রকাশ করিবার জন্য উপস্থিত হইয়াছে। অন্নদাবাবুরা যে কাশীতে আছেন, কোন্দিন রমেশ কোথা হইতে সে খবর পাইবে এবং নিশ্চয়ই সেখানে গিয়া হাজির হইবে। অক্ষয় স্থির করিল, ইতিমধ্যে গাজিপুরে গিয়া সে সমস্ত সংবাদ জানিবে এবং তাহার পর একবার কাশীতে অন্নদাবাবুর সঙ্গে গিয়া দেখা করিয়া আসিবে।
একদিন অগ্রহায়ণের অপরাহ্নে অক্ষয় তাহার ব্যাগ হাতে করিয়া গাজিপুরে আসিয়া উপস্থিত হইল। প্রথমে বাজারে জিজ্ঞাসা করিল, “রমেশবাবু বলিয়া একটি বাঙালি উকিলের বাসা কোন্ দিকে?” অনেককেই জিজ্ঞাসা করিয়া জানিল, বাজারে রমেশবাবু-নামক কোনো ব্যক্তির উকিল বলিয়া কোনো খ্যাতি নাই। তখন সে আদালতে গেল। আদালত তখন ভাঙিয়াছে। শামলা-পরা একটি বাঙালি উকিল গাড়িতে উঠিতে যাইতেছেন, তাঁহাকে অক্ষয় জিজ্ঞাসা করিল, “মশায়, রমেশচন্দ্র চৌধুরী বলিয়া একটি নূতন বাঙালি উকিল গাজিপুরে আসিয়াছেন, তাঁহার বাসা কোথায় জানেন?”
অক্ষয় ইঁহার কাছ হইতে খবর পাইল যে, রমেশ তো এতদিন খুড়ামশায়ের বাড়িতেই ছিল, এখন সে সেখানে আছে কি কোথাও গেছে তাহা বলা যায় না। তাহার স্ত্রীকে পাওয়া যাইতেছে না, সম্ভবত তিনি জলে ডুবিয়া মরিয়াছেন।
অক্ষয় খুড়ার বাড়িতে যাত্রা করিল। পথে যাইতে যাইতে ভাবিতে লাগিল, এইবার রমেশের চালটা বুঝা যাইতেছে। স্ত্রী মারা গিয়াছে; এখন সে অসংকোচে হেমনলিনীর কাছে প্রমাণ করিবার চেষ্টা করিবে, তাহার স্ত্রী কোনোকালেই ছিল না। হেমনলিনীর অবস্থা যেরূপ, তাহাতে রমেশের কথা অবিশ্বাস করা তাহার পক্ষে অসম্ভব হইবে। যাহারা ধর্মনীতি লইয়া অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করিয়া বেড়ায়, গোপনে তাহারা যে কী ভয়ানক লোক অক্ষয় তাহা মনে মনে আলোচনা করিয়া নিজের প্রতি শ্রদ্ধা অনুভব করিতে লাগিল।
খুড়ার কাছে গিয়া তাঁহাকে রমেশের ও কমলার কথা জিজ্ঞাসা করিবামাত্র তিনি শোক সংবরণ করিতে পারিলেন না, তাঁহার চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। তিনি কহিলেন, “আপনি যখন রমেশবাবুর বিশেষ বন্ধু, তখন আমার মা কমলাকে নিশ্চয় আপনি আত্মীয়ের মতোই জানেন; কিন্তু আমি এ কথা বলিতেছি, কয়েক দিন মাত্র তাঁহাকে দেখিয়া আমি আমার নিজের কন্যার সহিত তাঁহার প্রভেদ ভুলিয়া গেছি। দুদিনের জন্য মায়া বাড়াইয়া মা-লক্ষ্মী যে আমাকে এমন বজ্রাঘাত করিয়া ত্যাগ করিয়া যাইবেন, এ কি আমি জানিতাম।”
অক্ষয় মুখ মলান করিয়া কহিল, “এমন ঘটনাটা যে কী করিয়া ঘটিল, আমি তো কিছুই বুঝিতে পারি না। নিশ্চয়ই রমেশ কমলার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে নাই।”
নৌকাডুবি ৪৭ (২)
খুড়া। আপনি রাগ করিবেন না, আপনাদের রমেশটিকে আমি আজ পর্যন্ত চিনিতে পারিলাম না। এ দিকে বাহিরে তো দিব্য লোকটি; কিন্তু মনের মধ্যে কী ভাবেন, কী করেন, বুঝিবার জো নাই। নহিলে কমলার মতো অমন স্ত্রীকে কী মনে করিয়া যে অনাদর করিতেন তাহা ভাবিয়া পাওয়া যায় না। কমলা এমন সতীলক্ষ্মী, আমার মেয়ের সঙ্গে তার আপন বোনের মতো ভাব হইয়াছিল–তবু কখনো একদিনের জন্যও নিজের স্বামীর বিরুদ্ধে একটি কথাও কহে নাই। আমার মেয়ে মাঝে মাঝে বুঝিতে পারিত যে, সে মনের মধ্যে খুবই কষ্ট পাইতেছে, কিন্তু শেষ দিন পর্যন্ত একটি কথা বলাইতে পারে নাই। এমন স্ত্রী যে কী অসহ্য কষ্ট পাইলে এমন কাজ করিতে পারে তাহা তো আপনি বুঝিতেই পারেন–সে কথা মনে করিলেও বুক ফাটিয়া যায়। আবার আমার এমনি কপাল, আমি তখন এলাহাবাদে চলিয়া গিয়াছিলাম, নহিলে কি মা কখনো আমাকে ছাড়িয়া যাইতে পারিতেন?
পরদিন প্রাতে খুড়াকে লইয়া অক্ষয় রমেশের বাংলা ও গঙ্গার তীর ঘুরিয়া আসিল। ঘরে ফিরিয়া আসিয়া কহিল, “দেখুন মশায়, কমলা যে গঙ্গায় ডুবিয়া আত্মহত্যা করিয়াছে, এ সম্বন্ধে আপনি যতটা নিঃসংশয় হইয়াছেন আমি ততটা হইতে পারি নাই।”
খুড়া। আপনি কিরূপ মনে করেন?
অক্ষয়। আমার মনে হয় তিনি গৃহ ছাড়িয়া চলিয়া গেছেন, তাঁহাকে ভালোরূপ খোঁজ করা উচিত।
খুড়া হঠাৎ উত্তেজিত হইয়া উঠিয়া কহিলেন, “আপনি ঠিক বলিয়াছেন, কথাটা নিতান্তই অসম্ভব নহে।”
অক্ষয়। নিকটেই কাশীতীর্থ। সেখানে আমাদের একটি পরম বন্ধু আছেন; এমনও হইতে পারে, কমলা তাঁহাদের কাছে গিয়া আশ্রয় লইয়াছে।
খুড়া আশান্বিত হইয়া কহিলেন, “কই, তাঁহাদের কথা তো রমেশবাবু আমাদের কখনো বলেন নাই। যদি জানিতাম, তবে কি খোঁজ করিতে বাকি রাখিতাম?”
অক্ষয়। তবে একবার চলুন-না, আমরা দুইজনেই কাশী যাই। পশ্চিম-অঞ্চল আপনার সমস্তই জানাশোনা আছে, আপনি ভালো করিয়া খোঁজ করিতে পারিবেন।
খুড়া এ প্রস্তাবে উৎসাহের সহিত সম্মত হইলেন। অক্ষয় জানিত তাহার কথা হেমনলিনী সহজে বিশ্বাস করিবে না, এইজন্য প্রামাণিক-সাক্ষীর স্বরূপে খুড়াকে সঙ্গে করিয়া কাশীতে গেল
নৌকাডুবি ৪৮
শহরের বাহিরে ক্যাণ্টন্মেণ্টের অধিকারের মধ্যে ফাঁকা জায়গায় অন্নদাবাবুরা একটি বাংলা ভাড়া করিয়া বাস করিতেছেন।
অন্নদাবাবুরা কাশীতে পৌঁছিয়াই খবর পাইলেন, নলিনাক্ষের মাতা ক্ষেমংকরীর সামান্য জ্বরকাসি ক্রমে ন্যুমোনিয়াতে দাঁড়াইয়াছে। জ্বরের উপরেও এই শীতে তিনি নিয়মিত প্রাতঃস্নান বন্ধ করেন নাই বলিয়া তাঁহার অবস্থা এরূপ সংকটাপন্ন হইয়া উঠিয়াছে।
কয়েক দিন অশ্রান্তযত্নে হেম তাঁহার সেবা করার পর ক্ষেমংকরীর সংকটের অবস্থা কাটিয়া গেল। কিন্তু তখনো তাঁহার অতিশয় দুর্বল অবস্থা। শুচিতা লইয়া অত্যন্ত বিচার করাতে পথ্যজল প্রভৃতি সম্বন্ধে হেমনলিনীর সাহায্য তাঁহার কোনো কাজে লাগিল না। ইতিপূর্বে তিনি স্বপাক আহার করিতেন, এখন নলিনাক্ষ স্বয়ং তাঁহার পথ্য প্রস্তুত করিয়া দিতে লাগিল এবং আহার সম্বন্ধে মাতার সমস্ত সেবা নলিনাক্ষকে স্বহস্তে করিতে হইত। ইহাতে ক্ষেমংকরী সর্বদা আক্ষেপ করিয়া বলিতে লাগিলেন, “আমি তো গেলেই হত, কেবল তোদের কষ্ট দিবার জন্যই আবার বিশ্বেশ্বর আমাকে বাঁচাইলেন।”
ক্ষেমংকরীর নিজের সম্বন্ধে কঠোরতা অবলম্বন করিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার চারি দিকে পারিপাট্য ও সৌন্দর্যবিন্যাসের প্রতি তাঁহার অত্যন্ত দৃষ্টি ছিল। হেমনলিনী সে কথা নলিনাক্ষের কাছ হইতে শুনিয়াছিল। এইজন্য সে বিশেষ যত্নে চারি দিক পরিপাটি করিয়া এবং ঘর-দুয়ার সাজাইয়া রাখিত এবং নিজেও যত্ন করিয়া সাজিয়া ক্ষেমংকরীর কাছে আসিত। অন্নদা ক্যাণ্টন্মেণ্টে যে বাগান ভাড়া করিয়াছিলেন সেখান হইতে প্রত্যহ ফুল তুলিয়া আনিয়া দিতেন, হেমনলিনী ক্ষেমংকরীর রোগশয্যার কাছে সেই ফুলগুলি নানা রকম করিয়া সাজাইয়া রাখিত।
নলিনাক্ষ মাতার সেবার জন্য দাসী রাখিতে অনেক বার চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু তাহাদের হস্ত হইতে সেবা গ্রহণ করিতে কোনোমতেই তাঁহার অভিরুচি হইত না। অবশ্য, জল তোলা প্রভৃতির জন্য চাকর-চাকরানি ছিল বটে, কিন্তু তাঁহার একান্ত নিজের কাজগুলিতে বেতনভুক্ কোনো চাকরের হস্তক্ষেপ তিনি সহ্য করিতে পারিতেন না। যে হরির মা ছেলেবেলায় তাঁহাকে মানুষ করিয়াছিল সে মারা গিয়া অবধি অতি বড়ো রোগের সময়েও কোনো দাসীকে তিনি পাখা করিতে বা গায়ে হাত বুলাইতে দেন নাই।
সুন্দর ছেলে, সুন্দর মুখ তিনি বড়ো ভালোবাসিতেন। দশাশ্বমেধঘাটে প্রাতঃস্নান সারিয়া পথে প্রত্যেক শিবলিঙ্গে ফুল ও গঙ্গাজল দিয়া বাড়ি ফিরিবার সময় এক-এক দিন কোথা হইতে হয়তো একটি সুন্দর খোট্টার ছেলেকে অথবা কোনো ফুট্ফুটে হিন্দুস্থানি ব্রাহ্মণকন্যাকে বাড়িতে আনিয়া উপস্থিত করিতেন। পাড়ার দুটিএকটি সুন্দর ছেলেকে তিনি খেলনা দিয়া, পয়সা দিয়া, খাবার দিয়া বশ করিয়াছিলেন; তাহারা যখন-তখন তাঁহার বাড়ির যেখানে-সেখানে উপদ্রব করিয়া খেলিয়া বেড়াইত, ইহাতে তিনি বড়ো আনন্দ পাইতেন। তাঁহার আর-একটি বাতিক ছিল। ছোটোখাটো কোনো একটি সুন্দর জিনিস দেখিলেই তিনি না কিনিয়া থাকিতে পারিতেন না। এ-সমস্ত তাঁহার নিজের কোনো কাজেই লাগিত না; কিন্তু কোন্ জিনিসটি কে পাইলে খুশি হইবে, তাহা মনে করিয়া উপহার পাঠাইতে তাঁহার বিশেষ আনন্দ ছিল। অনেক সময় তাঁহার দূর আত্মীয়পেরিচিতেরাও এইরূপ একটা-কোনো জিনিস ডাক-যোগে পাইয়া আশ্চর্য হইয়া যাইত। তাঁহার একটি বড়ো আবলুস কাঠের কালো সিন্ধুকের মধ্যে এইরূপ অনাবশ্যক সুন্দর শৌখিন জিনিসপত্র, রেশমের কাপড়-চোপড় অনেক সঞ্চিত ছিল। তিনি মনে মনে ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলেন, নলিনের বউ যখন আসিবে তখন এগুলি সমস্ত তাহারই হইবে। নলিনের একটি পরমাসুন্দরী বালিকাবধূ তিনি মনে মনে কল্পনা করিয়া রাখিয়াছিলেন–সে তাঁহার ঘর উজ্জ্বল করিয়া খেলিয়া বেড়াইতেছে, তাহাকে তিনি সাজাইতেছেন-পরাইতেছেন, এই সুখচিন্তায় তাঁহার অনেক দিনের অনেক অবসর কাটিয়াছে।
তিনি নিজে তপস্বিনীর মতো ছিলেন; স্নানাহ্নিক-পূজায় প্রায় দিন কাটিয়া গেলে এক বেলা ফল দুধ মিষ্ট খাইয়া থাকিতেন; কিন্তু নিয়মসংযমে নলিনাক্ষের এতটা নিষ্ঠা তাঁহার ঠিক মনের মধ্যে ভালো লাগিত না। তিনি বলিতেন, ‘পুরুষমানুষের আবার অত আচার-বিচারের বাড়াবাড়ি কেন?’ পুরুষমানুষদিগকে তিনি বৃহৎবালকদের মতো মনে করিতেন; খাওয়াদাওয়া-চালচলনে উহাদের পরিমাণবোধ বা কর্তব্যবোধ না থাকিলে সেটা যেন তিনি সস্নেহ প্রশ্রয়বুদ্ধির সহিত সংগত মনে করিতেন, ক্ষমার সহিত বলিতেন, ‘পুরুষমানুষ কঠোরতা করিতে পারিবে কেন!’ অবশ্য, ধর্ম সকলকেই রক্ষা করিতে হইবে, কিন্তু আচার পুরুষমানুষের জন্য নহে, ইহাই তিনি মনে মনে ঠিক করিয়াছিলেন। নলিনাক্ষ যদি অন্যান্য সাধারণ পুরুষের মতো কিঞ্চিৎ পরিমাণে অবিবেচক ও স্বেচ্ছাচারী হইত, সতর্কতার মধ্যে কেবলমাত্র তাঁহার পূজার ঘরে প্রবেশ এবং অসময়ে তাঁহাকে স্পর্শ করাটুকু বাঁচাইয়া চলিত, তাহা হইলে তিনি খুশিই হইতেন।
নৌকাডুবি ৪৮ (২)
ব্যামো হইতে যখন সারিয়া উঠিলেন ক্ষেমংকরী দেখিলেন, হেমনলিনী নলিনাক্ষের উপদেশ-অনুসারে নানাপ্রকার নিয়মপালনে প্রবৃত্ত হইয়াছে, এমন-কি, বৃদ্ধ অন্নদাবাবুও নলিনাক্ষের সকল কথা প্রবীণ গুরুবাক্যের
মতো বিশেষ শ্রদ্ধা ও ভক্তির সহিত অবধান করিয়া শুনিতেছেন।
ইহাতে ক্ষেমংকরীর অত্যন্ত কৌতুক বোধ হইল। তিনি একদিন হেমনলিনীকে ডাকিয়া হাসিয়া কহিলেন, “মা, তোমরা দেখিতেছি, নলিনকে আরো খ্যাপাইয়া তুলিবে। ওর ও-সমস্ত পাগলামির কথা তোমরা শোন কেন? তোমরা সাজগোজ করিয়া, হাসিয়া-খেলিয়া আমোদ-আহ্লাদে বেড়াইবে; তোমাদের কি এখন সাধন করিবার বয়স? যদি বল ‘তুমি কেন বরাবর এই-সব লইয়া আছ’, তার একটু কথা আছে। আমার বাপ-মা বড়ো নিষ্ঠাবান ছিলেন। ছেলেবেলা হইতে আমরা ভাইবোনেরা এই-সকল শিক্ষার মধ্যেই মানুষ হইয়া উঠিয়াছি। এ যদি আমরা ছাড়ি তো আমাদের দ্বিতীয় কোনো আশ্রয় থাকে না। কিন্তু তোমরা তো সেরকম নও; তোমাদের শিক্ষাদীক্ষা তো সমস্তই আমি জানি। তোমরা এ যা-কিছু করিতেছ এ কেবল জোর করিয়া করিতেছ; তাহাতে লাভ কী মা? যে যাহা পাইয়াছে সে তাহাই ভালো করিয়া রক্ষা করিয়া চলুক, আমি তো এই বলি। না না, ওসেব কিছু নয়, ও-সমস্ত ছাড়ো। তোমাদের আবার নিরামিষ খাওয়া কী, যোগ-তপই বা কিসের! আর নলিনই বা এতবড়ো গুরু হইয়া উঠিল কবে? ও এ-সকলের কী জানে? ও তো সেদিন পর্যন্ত যা-খুশি-তাই করিয়া বেড়াইয়াছে, শাসেত্রর কথা শুনিলে একেবারে মারমূর্তি ধরিত। আমাকেই খুশি করিবার জন্য এই-সমস্ত আরম্ভ করিল, শেষকালে দেখিতেছি কোন্দিন পুরা সন্ন্যাসী হইয়া বাহির হইবে। আমি ওকে বার বার করিয়া বলি, ‘ছেলেবেলা হইতে তোর যা বিশ্বাস ছিল তুই তাই লইয়াই থাক্; সে তো মন্দ কিছু নয়, আমি তাহাতে সন্তুষ্ট বৈ অসন্তুষ্ট হইব না।’ শুনিয়া নলিন হাসে; ঐ ওর একটি স্বভাব, সকল কথাই চুপ করিয়া শুনিয়া যায়, গাল দিলেও উত্তর করে না।”
অপরাহ্নে পাঁচটার পর হেমনলিনীর চুল বাঁধিয়া দিতে দিতে এই-সমস্ত আলোচনা চলিত। হেমের খোঁপাবোঁধা ক্ষেমংকরীর পছন্দ হইত না। তিনি বলিতেন, “তুমি বুঝি মনে কর মা, আমি নিতান্তই সেকেলে, এখনকার কালের ফ্যাশান কিছুই জানি না। কিন্তু আমি যতরকম চুল-বাঁধা জানি এত তোমরাও জান না বাছা। একটি বেশ ভালো মেম পাইয়াছিলাম, সে আমাকে সেলাই শিখাইতে আসিত, সেইসঙ্গে কতরকম চুল-বাঁধাও শিখিয়াছিলাম। সে চলিয়া গেলে আবার আমাকে স্নান করিয়া কাপড় ছাড়িতে হইত। কী করিব মা, সংস্কার, উহার ভালোমন্দ জানি না–না করিয়া থাকিতে পারি না। তোমাদের লইয়াও যে এতটা ছুঁই-ছুঁই করি, কিছু মনে করিয়ো না মা। ওটা মনের ঘৃণা নয়, ও কেবল একটা অভ্যাস। নলিনদের বাড়িতে যখন অন্যরূপ মত হইল, হিন্দুয়ানি ঘুচিয়া গেল, তখন তো আমি অনেক সহ্য করিয়াছি, কোনো কথাই বলি নাই; আমি কেবল এই কথাই বলিয়াছি যে, যাহা ভালো বোঝ করো–আমি মূর্খ মেয়েমানুষ, এতকাল যাহা করিয়া আসিলাম তাহা ছাড়িতে পারিব না।”
বলিতে বলিতে ক্ষেমংকরী চোখের এক ফোঁটা জল তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়া মুছিয়া ফেলিলেন।
এমনি করিয়া, হেমনলিনীর খোঁপা খুলিয়া ফেলিয়া তাহার সুদীর্ঘ কেশগুচ্ছ লইয়া প্রত্যহ নূতন-নূতন রকম বিনানি করিতে ক্ষেমংকরীর ভারি ভালো লাগিত। এমনও হইয়াছে, তিনি তাঁহার সেই আবলুস কাঠের সিন্ধুক হইতে নিজের পছন্দসই রঙের কাপড় বাহির করিয়া তাহাকে পরাইয়া দিয়াছেন। মনের মতো করিয়া সাজাইতে তাঁহার বড়ো আনন্দ। প্রায়ই প্রতিদিন হেমনলিনী তাহার সেলাই আনিয়া ক্ষেমংকরীর কাছে দেখাইয়া লইয়া যাইত; ক্ষেমংকরী তাহাকে নূতন-নূতন রকমের সেলাই সম্বন্ধে শিক্ষা দিতে আরম্ভ করিলেন। এ-সমস্তই তাঁহার সন্ধ্যার সময়কার কাজ ছিল। বাংলা মাসিকপত্র এবং গল্পের বই পড়িতেও উৎসাহ অল্প ছিল না। হেমনলিনীর কাছে যাহা-কিছু বই এবং কাগজ ছিল, সমস্তই সে ক্ষেমংকরীর কাছে আনিয়া দিয়াছিল। কোনো কোনো প্রবন্ধ ও বই সম্বন্ধে ক্ষেমংকরীর আলোচনা শুনিয়া হেম আশ্চর্য হইয়া যাইত; ইংরাজি না শিখিয়া যে এমন বুদ্ধিবিচারের সহিত চিন্তা করা যায় হেমের তাহা ধারণাই ছিল না। নলিনাক্ষের মাতার কথাবার্তা এবং সংস্কার-আচরণ সমস্ত লইয়া হেমনলিনীর তাঁহাকে বড়োই আশ্চর্য স্ত্রীলোক বলিয়া বোধ হইল। সে যাহা মনে করিয়া আসিয়াছিল তাহার কিছুই নয়, সমস্তই অপ্রত্যাশিত।
নৌকাডুবি ৪৯
ক্ষেমংকরী পুনর্বার জ্বরে পড়িলেন। এবারকার জ্বর অল্পের উপর দিয়া কাটিয়া গেল। সকালবেলায় নলিনাক্ষ প্রণাম করিয়া তাঁহার পায়ের ধুলা লইবার সময় বলিল, “মা, তোমাকে কিছুকাল রোগীর নিয়মে থাকিতে হইবে। দুর্বল শরীরের উপর কঠোরতা সহ্য হয় না।”
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “আমি রোগীর নিয়মে থাকিব, আর তুমিই যোগীর নিয়মে থাকিবে। নলিন, তোমার ও-সমস্ত আর বেশি দিন চলিবে না। আমি আদেশ করিতেছি, তোমাকে এবার বিবাহ করিতেই হইবে।”
নলিনাক্ষ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। ক্ষেমংকরী কহিলেন, “দেখো বাছা, আমার এ শরীর আর গড়িবে না; এখন তোমাকে আমি সংসারী দেখিয়া যাইতে পারিলে মনের সুখে মরিতে পারিব। আগে মনে করিতাম একটি ছোটো ফুট্ফুটে বউ আমার ঘরে আসিবে, আমি তাহাকে নিজের হাতে শিখাইয়া-পড়াইয়া মানুষ করিয়া তুলিব, তাহাকে সাজাইয়া গুজাইয়া মনের সুখে থাকিব। কিন্তু এবার ব্যামোর সময় ভগবান আমাকে চৈতন্য দিয়াছেন। নিজের আয়ুর উপরে এতটা বিশ্বাস রাখা চলে না, আমি কবে আছি কবে নাই তার ঠিকানা কী। একটি ছোটো মেয়েকে তোমার ঘাড়ের উপর ফেলিয়া গেলে সে আরো বেশি মুশকিল হইবে। তার চেয়ে তোমাদের নিজেদের মতে বড়ো বয়সের মেয়েই বিবাহ করো। জ্বরের সময় এই-সব কথা ভাবিতে ভাবিতে আমার রাত্রে ঘুম হইত না। আমি বেশ বুঝিয়াছি এই আমার শেষ কাজ বাকি আছে, এইটি সম্পন্ন করিবার অপেক্ষাতেই আমাকে বাঁচিতে হইবে, নহিলে আমি শান্তি পাইব না।”
নলিনাক্ষ। আমাদের সঙ্গে মিশ খাইবে, এমন পাত্রী পাইব কোথায়?
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “আচ্ছা, সে আমি ঠিক করিয়া তোমাকে বলিব এখন, সেজন্য তোমাকে ভাবিতে হইবে না।”
আজ পর্যন্ত ক্ষেমংকরী অন্নদাবাবুর সম্মুখে বাহির হন নাই। সন্ধ্যার কিছু পূর্বে প্রাত্যহিক নিয়মানুসারে বেড়াইতে বেড়াইতে অন্নদাবাবু যখন নলিনাক্ষের বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন তখন ক্ষেমংকরী অন্নদাবাবুকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। তাঁহাকে কহিলেন, “আপনার মেয়েটি বড়ো লক্ষ্মী, তাহার ‘পরে আমার বড়োই স্নেহ পড়িয়াছে। আমার নলিনকে তো আপনার জানেন, সে ছেলের কোনো দোষ কেহ দিতে পারিবে না–ডাক্তারিতেও তাহার বেশ নাম আছে। আপনার মেয়ের জন্য এমনতরো সম্বন্ধ কি শীঘ্র খুঁজিয়া পাইবেন?”
অন্নদাবাবু ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “বলেন কী। এমনতরো কথা আশা করিতেও আমার সাহস হয় নাই। নলিনাক্ষের সঙ্গে আমার মেয়ের যদি বিবাহ হয়, তবে তার অপেক্ষা সৌভাগ্য আমার কী হইতে পারে। কিন্তু তিনি কি–”
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “নলিন আপত্তি করিবে না। সে এখনকার ছেলেদের মতো নয়, সে আমার কথা মানে। আর, এর মধ্যে পীড়াপীড়ির কথাই বা কী আছে। আপনার মেয়েটিকে পছন্দ না করিবে কে? কিন্তু এই কাজটি আমি অতি শীঘ্রই সারিতে চাই। আমার শরীরের গতিক ভালো বুঝিতেছি না।”
সে রাত্রে অন্নদাবাবু উৎফুল্ল হইয়া বাড়িতে গেলেন। সেই রাত্রেই তিনি হেমনলিনীকে ডাকিয়া কহিলেন, “মা, আমার বয়স যথেষ্ট হইয়াছে, আমার শরীরও ইদানীং ভালো চলিতেছে না। তোমার একটা স্থিতি না করিয়া যাইতে পারিলে আমার মনে সুখ নাই। হেম, আমার কাছে লজ্জা করিলে চলিবে না; তোমার মা নাই, এখন তোমার সমস্ত ভার আমার উপরে।”
হেমনলিনী উৎকণ্ঠিত হইয়া তাহার পিতার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
অন্নদাবাবু কহিলেন, “মা, তোমার জন্য এমন একটি সম্বন্ধ আসিয়াছে যে,মনের আনন্দ আমি আর রাখিতে পারিতেছি না। আমার কেবলই ভয় হইতেছে, পাছে কোনো বিঘ্ন ঘটে। আজ নলিনাক্ষের মা নিজে আমাকে ডাকিয়া তাঁহার পুত্রের সঙ্গে তোমার বিবাহের প্রস্তাব করিয়াছেন।”
নৌকাডুবি ৪৯ (২)
হেমনলিনী মুখ লাল করিয়া অত্যন্ত সংকুচিত হইয়া কহিল, “বাবা, তুমি কী বল! না না, এ কখনো হইতেই পারে না।”
নলিনাক্ষকে যে কখনো বিবাহ করা যাইতে পারে, এ সম্ভাবনার সন্দেহমাত্র হেমনলিনীর মাথায় আসে নাই। হঠাৎ পিতার মুখে এই প্রস্তাব শুনিয়া তাহাকে লজ্জায়-সংকোচে অস্থির করিয়া তুলিল।
অন্নদাবাবু প্রশ্ন করলেন, “কেন হইতে পারে না?”
হেমনলিনী কহিল, “নলিনাক্ষবাবু! এও কি কখনো হয়!” এরূপ উত্তরকে ঠিক যুক্তি বলা চলে না, কিন্তু যুক্তির অপেক্ষা ইহা অনেক গুণে প্রবল।
হেম আর থাকিতে পারিল না, সে বারান্দায় চলিয়া গেল।
অন্নদাবাবু অত্যন্ত বিমর্ষ হইয়া পড়িলেন। তিনি এরূপ বাধার কথা কল্পনাও করেন নাই। বরঞ্চ তাঁহার ধারণা ছিল, নলিনাক্ষের সহিত বিবাহের প্রস্তাবে হেম মনে মনে খুশিই হইবে। হতবুদ্ধি বৃদ্ধ বিষণ্নমুখে কেরোসিনের আলোর দিকে চাহিয়া স্ত্রীপ্রকৃতির অচিন্তনীয় রহস্য ও হেমনলিনীর জননীর অভাব মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন।
হেম অনেকক্ষণ বারান্দার অন্ধকারে বসিয়া রহিল। তাহার পরে ঘরের দিকে চাহিয়া তাহার পিতার নিতান্ত হতাশ মুখের ভাব চোখে পড়িতেই তাহার মনে বাজিল। তাড়াতাড়ি তাহার পিতার চৌকির পশ্চাতে দাঁড়াইয়া তাঁহার মাথায় অঙ্গুলিসঞ্চালন করিতে করিতে কহিল, “বাবা চলো, অনেকক্ষণ খাবার দিয়াছে, খাবার ঠাণ্ডা হইয়া গেল।”
অন্নদাবাবু যন্ত্রচালিতবৎ উঠিয়া খাবারের জায়গায় গেলেন, কিন্তু ভালো করিয়া খাইতেই পারিলেন না। হেমনলিনী সম্বন্ধে সমস্ত দুর্যোগ কাটিয়া গেল মনে করিয়া তিনি বড়োই আশান্বিত হইয়া উঠিয়াছিলেন, কিন্তু হেমনলিনীর দিক হইতেই যে এতবড়ো ব্যাঘাত আসিল ইহাতে তিনি অত্যন্ত দমিয়া গেছেন। আবার তিনি ব্যাকুল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মনে ভাবিলেন, হেম তবে এখনো রমেশকে ভুলিতে পারে নাই।
অন্য দিন আহারের পরেই অন্নদাবাবু শুইতে যাইতেন, আজ বারান্দায় ক্যাম্বিসের কেদারার উপরে বসিয়া বাড়ির বাগানের সম্মুখবর্তী ক্যাণ্টন্মেণ্টের নির্জন রাস্তার দিকে চাহিয়া ভাবিতে লাগিলেন। হেমনলিনী আসিয়া সিনগ্ধস্বরে কহিল, “বাবা, এখানে বড়ো ঠাণ্ডা, শুইতে চলো।”
অন্নদা কহিলেন, “তুমি শুইতে যাও, আমি একটু পরেই যাইতেছি।”
হেমনলিনী চুপ করিয়া তাঁহার পাশে দাঁড়াইয়া রহিল। আবার খানিক বাদেই কহিল, “বাবা, তোমার ঠাণ্ডা লাগিতেছে, নাহয় বসিবার ঘরেই চলো।”
তখন অন্নদাবাবু চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া, কিছু না বলিয়া শুইতে গেলেন।
পাছে তাহার কর্তব্যের ক্ষতি হয় বলিয়া হেমনলিনী রমেশের কথা মনে মনে আন্দোলন করিয়া নিজেকে পীড়িত হইতে দেয় না। এজন্য এ পর্যন্ত সে নিজের সঙ্গে অনেক লড়াই করিয়া আসিতেছে। কিন্তু বাহির হইতে যখন টান পড়ে তখন ক্ষতস্থানের সমস্ত বেদনা জাগিয়া উঠে। হেমনলিনীর ভবিষ্যৎ জীবনটা যে কী ভাবে চলিবে তাহা এ পর্যন্ত সে পরিষ্কার কিছুই ভাবিয়া পাইতেছিল না, এই কারণেই একটা সুদৃঢ় কোনো অবলম্বন খুঁজিয়া অবশেষে নলিনাক্ষকে গুরু মানিয়া তাহার উপদেশ অনুসারে চলিতে প্রস্তুত হইয়াছিল। কিন্তু যখনই বিবাহের প্রস্তাবে তাহাকে তাহার হৃদয়ের গভীরতম দেশের আশ্রয়সূত্র হইতে টানিয়া আনিতে চাহে তখনই সে বুঝিতে পারে, সে বন্ধন কী কঠিন! তাহাকে কেহ ছিন্ন করিতে আসিলেই হেমনলিনীর সমস্ত মন ব্যাকুল হইয়া সেই বন্ধনকে দ্বিগুণবলে আঁকড়িয়া ধরিতে চেষ্টা করে।
নৌকাডুবি ৫০
এ দিকে ক্ষেমংকরী নলিনাক্ষকে ডাকিয়া কহিলেন, “আমি তোমার পাত্রী ঠিক করিয়াছি।”
নলিনাক্ষ একটু হাসিয়া কহিল, “একেবারে ঠিক করিয়া ফেলিয়াছ?”
ক্ষেমংকরী। তা নয় তো কী? আমি কি চিরকাল বাঁচিয়া থাকিব? তা শেনো, আমি হেমনলিনীকেই পছন্দ করিয়াছি–অমন মেয়ে আর পাইব না। রঙটা তেমন ফর্সা নয় বটে, কিন্তু-
নলিনাক্ষ। দোহাই মা, আমি রঙ ফর্সার কথা ভাবিতেছি না। কিন্তু হেমনলিনীর সঙ্গে কেমন করিয়া হইবে? সে কি কখনো হয়?
ক্ষেমংকরী। ও আবার কী কথা। না হইবার তো কোনো কারণ দেখি না।
নলিনাক্ষের পক্ষে ইহার জবাব দেওয়া বড়ো মুশকিল। কিন্তু হেমনলিনী–এতদিন যাহাকে কাছে লইয়া অসংকোচে গুরুর মতো উপদেশ দিয়া আসিয়াছে, হঠাৎ তাহার সঙ্গে বিবাহের প্রস্তাবে নলিনাক্ষকে যেন লজ্জা আঘাত করিল।
নলিনাক্ষকে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া ক্ষেমংকরী কহিলেন, “এবারে আমি তোমার কোনো আপত্তি শুনিব না। আমার জন্য তুমি যে এই বয়সে সমস্ত ছাড়িয়া দিয়া কাশীবাসী হইয়া তপস্যা করিতে থাকিবে, সে আমি আর কিছুতেই সহ্য করিব না। এইবারে যেদিন শুভদিন আসিবে সেদিন ফাঁক যাইবে না, এ আমি বলিয়া রাখিতেছি।”
নলিনাক্ষ কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া কহিল, “তবে একটা কথা তোমাকে বলি মা। কিন্তু আগে হইতে বলিয়া রাখিতেছি, তুমি অস্থির হইয়া পড়িয়ো না। যে ঘটনার কথা বলিতেছি সে আজ নয়-দশ মাস হইয়া গেল, এখন তাহা লইয়া উতলা হইবার কোনো প্রয়োজন নাই। কিন্তু তোমার যেরকম স্বভাব মা, একটা অমঙ্গল কাটিয়া গেলেও তাহার ভয় তোমাকে কিছুতেই ছাড়িতে চায় না। এইজন্যই কতদিন তোমাকে বলিব-বলিব করিয়াও বলিতে পারি নাই। আমার গ্রহশান্তির জন্য যত খুশি স্বস্ত্যয়ন করাইতে চাও করাইয়ো, কিন্তু অনাবশ্যক মনকে পীড়িত করিয়ো না।”
ক্ষেমংকরী উদ্বিগ্ন হইয়া কহিলেন, “কী জানি বাছা, কী বলিবে, কিন্তু তোমার ভূমিকা শুনিয়া আমার মন আরো অস্থির হয়। যতদিন পৃথিবীতে আছি নিজেকে অত করিয়া ঢাকিয়া রাখা চলে না। আমি তো দূরে থাকিতে চাই, কিন্তু মন্দকে তো খুঁজিয়া বাহির করিতে হয় না; সে আপনিই ঘাড়ের উপর আসিয়া পড়ে। তা, ভালো হোক মন্দ হোক, বলো তোমার কথাটা শুনি।”
নলিনাক্ষ কহিল, “এই মাঘ মাসে আমি রঙপুরে আমার সমস্ত জিনিসপত্র বিক্রি করিয়া, আমার বাগানবাড়িটা ভাড়ার বন্দোবস্ত করিয়া ফিরিয়া আসিতেছিলাম। সাঁড়ায় আসিয়া আমার কী বাতিক গেল, মনে করিলাম, রেলে না চড়িয়া নৌকা করিয়া কলিকাতা পর্যন্ত আসিব। সাঁড়ায় একখানা বড়ো দেশী নৌকা ভাড়া করিয়া যাত্রা করিলাম। দু দিনের পথ আসিয়া একটা চরের কাছে নৌকা বাঁধিয়া স্নান করিতেছি, এমন সময় হঠাৎ দেখি, আমাদের ভূপেন এক বন্দুক হাতে করিয়া উপস্থিত। আমাকে দেখিয়াই তো সে লাফাইয়া উঠিল, কহিল, ‘শিকার খুঁজিতে আসিয়া খুব বড়ো শিকারটাই মিলিয়াছে।’ সে ঐ দিকেই কোথায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটি করিতেছিল তাঁবুতে মফস্বল-মিণে বাহির হইয়াছে। অনেকদিন পরে দেখা, আমাকে তো কোনো মতেই ছাড়িবে না, সঙ্গে সঙ্গে ঘুরাইয়া বেড়াইতে লাগিল। ধোবাপুকুর বলিয়া একটা জায়গায় একদিন তাহার তাঁবু পড়িল। বৈকালে আমরা গ্রামে বেড়াইতে বাহির হইয়াছি–নিতান্তই গণ্ডগ্রাম, একটি বৃহৎ খেতের ধারে একটা প্রাচীরেদেওয়া চালাঘরের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িলাম। ঘরের কর্তা উঠানে আমাদের বসিবার জন্য দুটি মোড়া আনিয়া দিলেন। তখন দাওয়ার উপরে ইস্কুল চলিতেছে। প্রাইমারি ইস্কুলের পণ্ডিত একটা কাঠের চৌকিতে বসিয়া ঘরের একটা খুঁটির গায়ে দুই পা তুলিয়া দিয়াছে।
নৌকাডুবি ৫০ (২)
নীচে মাটিতে বসিয়া স্লেট-হাতে ছেলেরা মহা কোলাহল করিতে করিতে বিদ্যালাভ করিতেছে। বাড়ির কর্তাটির নাম তারিণী চাটুজ্জে। ভূপেনের কাছে তিনি তন্ন তন্ন করিয়া আমার পরিচয় লইলেন। তাঁবুতে ফিরিয়া আসিতে আসিতে ভূপেন বলিল, ‘ওহে, তোমার কপাল ভালো, তোমার একটা বিবাহের সম্বন্ধ আসিতেছে।’ আমি বলিলাম, ‘সে কী রকম?’ ভূপেন কহিল, ‘ঐ তারিণী চাটুজ্জে লোকটি মহাজনি করে, এতবড়ো কৃপণ জগতে নাই। ঐ-যে ইস্কুলটি বাড়িতে স্থান দিয়াছে, সেজন্য নূতন ম্যাজিস্ট্রেট আসিলেই নিজের লোকহিতৈষিতা লইয়া বিশেষ আড়ম্বর করে। কিন্তু ইস্কুলের পণ্ডিতটাকে কেবলমাত্র বাড়িতে খাইতে দিয়া রাত দশটা পর্যন্ত সুদের হিসাব কষাইয়া লয়, মাইনেটা গবর্মেণ্টের সাহায্য এবং ইস্কুলের বেতন হইতে উঠিয়া যায়। উহার একটি বোনের স্বামীবিয়োগ হইলে পর সে বেচারা কোথাও আশ্রয় না পাইয়া ইহারই কাছে আসে। সে তখন গর্ভিণী ছিল। এখানে আসিয়া একটি কন্যা প্রসব করিয়া নিতান্ত অচিকিৎসাতেই সে মারা যায়। আর একটি বিধবা বোন ঘরকন্নার সমস্ত কাজ করিয়া ঝি রাখিবার খরচ বাঁচাইত, সে এই মেয়েটিকে মায়ের মতো মানুষ করে। মেয়েটি কিছু বড়ো হইতেই তাহারও মৃত্যু হইল। সেই অবধি মামা ও মামীর দাসত্ব করিয়া অহরহ ভর্ৎসনা সহিয়া মেয়েটি বাড়িয়া উঠিতেছে। বিবাহের বয়স যথেষ্ট হইয়াছে, কিন্তু এমন অনাথার পাত্র জুটিবে কোথায়? বিশেষত উহার মা-বাপকে এখানকার কেহ জানিত না, পিতৃহীন অবস্থায় উহার জন্ম ইহা লইয়া পাড়ার ঘোঁট-কর্তারা যথেষ্ট সংশয়প্রকাশ করিয়া থাকেন। তারিণী চাটুজ্জের অগাধ টাকা আছে সকলেই জানে, লোকের ইচ্ছা–এই মেয়ের বিবাহ উপলক্ষে কন্যা সম্বন্ধে খোঁটা দিয়া উহাকে বেশ একটু দোহন করিয়া লয়। ও তো আজ চার বছর ধরিয়া মেয়েটির বয়স দশ বলিয়া পরিচয় দিয়া আসিতেছে। অতএব, হিসাবমত তার বয়স এখন অন্তত চৌদ্দ হইবে। কিন্তু যাই বল, মেয়েটি নামেও কমলা, সকল বিষয়েই একেবারে লক্ষ্মীর প্রতিমা। এমন সুন্দর মেয়ে আমি তো দেখি নাই। এ গ্রামে বিদেশের কোনো ব্রাহ্মণ যুবক উপস্থিত হইলেই তারিণী তাহাকে বিবাহের জন্য হাতে-পায়ে ধরে। যদি বা কেহ রাজি হয়, গ্রামের লোকে ভাংচি দিয়া তাড়ায়। অতএব এবারে নিশ্চয় তোমার পালা।’ জান তো মা, আমার মনের অবস্থাটা তখন একরকম মরিয়া গোছের ছিল; আমি কিছু চিন্তা না করিয়াই বলিলাম, ‘এ মেয়েটিকে আমিই বিবাহ করিব।’ ইহার পূর্বে আমি স্থির করিয়াছিলাম, একটি হিন্দুঘরের মেয়ে বিবাহ করিয়া আনিয়া আমি তোমাকে চমৎকৃত করিয়া দিব; আমি জানিতাম, বড়ো বয়সের ব্রাহ্মমেয়ে আমাদের এ ঘরে আনিলে তাহাতে সকল পক্ষই অসুখী হইবে। ভূপেন তো একেবারে আশ্চর্য হইয়া গেল। সে বলিল, ‘কী বল!’ আমি বলিলাম, ‘বলাবলি নয়, আমি একেবারেই মন স্থির করিয়াছি।’ ভূপেন কহিল, ‘পাকা?’ আমি কহিলাম, ‘পাকা’। সেই সন্ধ্যাবেলাতেই স্বয়ং তারিণী চাটুজ্জে আমাদের তাঁবুতে আসিয়া উপস্থিত। ব্রাহ্মণ হাতে পইতা জড়াইয়া জোড়হাত করিয়া কহিলেন, ‘আমাকে উদ্ধার করিতেই হইবে। মেয়েটি স্বচক্ষে দেখুন, যদি পছন্দ না হয় তো অন্য কথা–কিন্তু শত্রুপক্ষের কথা শুনিবেন না।’ আমি বলিলাম, ‘দেখিবার দরকার নাই, দিন স্থির করুন।’ তারিণী কহিলেন, ‘পরশু দিন ভালো আছে, পরশুই হইয়া যাক।’ তাড়াতাড়ির দোহাই দিয়া বিবাহে যথাসাধ্য খরচ বাঁচাইবার ইচ্ছা তাঁহার ছিল। বিবাহ তো হইয়া গেল।”
ক্ষেমংকরী চমকিয়া উঠিয়া কহিলেন, “বিবাহ হইয়া গেল–বল কী নলিন!”
নলিনাক্ষ। হাঁ, হইয়া গেল। বধূ লইয়া নৌকাতেই উঠিলাম। যেদিন বৈকালে উঠিলাম, সেইদিনই ঘণ্টা-দুয়েক বাদে সূর্যাস্তের এক দণ্ড পরে হঠাৎ সেই অকালে ফাল্গুন মাসে কোথা হইতে অত্যন্ত গরম একটা ঘূর্ণিবাতাস আসিয়া এক মুহূর্তে আমাদের নৌকা উল্টাইয়া কী করিয়া দিল, কিছু যেন বোঝা গেল না।
ক্ষেমংকরী বলিলেন, “মধুসূদন!” তাঁহার সর্বশরীরে কাঁটা দিয়া উঠিল।
নৌকাডুবি ৫০ (৩)
নলিনাক্ষ। ক্ষণকাল পরে যখন বুদ্ধি ফিরিয়া আসিল তখন দেখিলাম, আমি নদীতে এক জায়গায় সাঁতার দিতেছি, কিন্তু নিকটে কোনো নৌকা বা আরোহীর কোনো চিহ্ন নাই। পুলিসে খবর দিয়া খোঁজ অনেক করা হইয়াছিল, কিন্তু কোনো ফল হইল না।
ক্ষেমংকরী পাংশুবর্ণ মুখ করিয়া কহিলেন, “যাক, যা হইয়া গেছে তা গেছে, ও কথা আমার কাছে আর কখনো বলিস নে–মনে করিতেই আমার বুক কাঁপিয়া উঠিতেছে।”
নলিনাক্ষ। এ কথা আমি কোনোদিনই তোমার কাছে বলিতাম না, কিন্তু বিবাহের কথা লইয়া তুমি নিতান্তই জেদ করিতেছ বলিয়াই বলিতে হইল। ক্ষেমংকরী কহিলেন, “একবার একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়াছিল বলিয়া তুই ইহজীবনে কখনো বিবাহই করিবি না?”
নলিনাক্ষ কহিল, “সেজন্য নয় মা, যদি সে মেয়ে বাঁচিয়া থাকে?”
ক্ষেমংকরী। পাগল হইয়াছিস? বাঁচিয়া থাকিলে তোকে খবর দিত না?
নলিনাক্ষ। আমার খবর সে কী জানে? আমার চেয়ে অপরিচিত তাহার কাছে কে আছে? বোধ হয় সে আমার মুখও দেখে নাই। কাশীতে আসিয়া তারিণী চাটুজ্জেকে আমার ঠিকানা জানাইয়াছি; তিনিও কমলার কোনো খোঁজ পান নাই বলিয়া আমাকে চিঠি লিখিয়াছেন।
ক্ষেমংকরী। তবে আবার কী।
নলিনাক্ষ। আমি মনে মনে ঠিক করিয়াছি, পূরা একটি বৎসর অপেক্ষা করিয়া তবে তাহার মৃত্যু স্থির করিব।
ক্ষেমংকরী। তোমার সকল বিষয়েই বাড়াবাড়ি। আবার এক বৎসর অপেক্ষা করা কিসের জন্য?
নলিনাক্ষ। মা, এক বৎসরের আর দেরিই বা কিসের। এখন অঘ্রাণ; পৌষে বিবাহ হইতে পারিবে না; তাহার পরে মাঘটা কাটাইয়া ফাল্গুন।
ক্ষেমংকরী। আচ্ছা, বেশ। কিন্তু পাত্রী ঠিক রহিল। হেমনলিনীর বাপকে আমি কথা দিয়াছি।
নলিনাক্ষ কহিল, “মা, মানুষ তো কেবল কথাটুকুমাত্রই দিতে পারে, সে কথার সফলতা দেওয়া যাঁহার হাতে তাঁহারই প্রতি নির্ভর করিয়া থাকিব।”
ক্ষেমংকরী। যাই হোক বাছা, তোমার এই ব্যাপারটা শুনিয়া এখনো আমার গা কাঁপিতেছে।
নলিনাক্ষ। সে তো আমি জানি মা, তোমার এই মন সুস্থির হইতে অনেক দিন লাগিবে। তোমার মনটা একবার একটু নাড়া পাইলেই তাহার আন্দোলন কিছুতেই আর থামিতে চায় না। সেইজন্যই তো মা, তোমাকে এরকম সব খবর দিতেই চাই না।
ক্ষেমংকরী। ভালোই কর বাছা–আজকাল আমার কী হইয়াছে জানি না, একটা মন্দ-কিছু শুনিলেই তার ভয় কিছুতেই ঘোচে না। আমার একটা ডাকের চিঠি খুলিতে ভয় করে, পাছে তাহাতে কোনো কুসংবাদ থাকে। আমিও তো তোমাদের বলিয়া রাখিয়াছি, আমাকে কোনো খবর দিবার কোনো দরকার নাই; আমি তো মনে করি, এ সংসারে আমি মরিয়াই গেছি, এখানকার আঘাত আমার উপরে আর কেন।