নৌকাডুবি (11-15)
নৌকাডুবি ১১
প্রায় প্রতিবৎসর শরৎকালে পূজার টিকিট বাহির হইলে হেমনলিনীকে লইয়া অন্নদাবাবু জব্বলপুরে তাঁহার ভগিনীপতির কর্মস্থানে বেড়াইতে যাইতেন। পরিপাকশক্তির উন্নতিসাধনের জন্য তাঁহার এই সাংবৎসরিক চেষ্টা।
ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি হইয়া আসিল, এবারে পূজার ছুটির আর বড়ো বেশি বিলম্ব নাই। অন্নদাবাবু এখন হইতেই তাঁহার যাত্রার আয়োজনে ব্যস্ত হইয়াছেন।
আসন্ন বিচ্ছেদের সম্ভাবনায় রমেশ আজকাল খুব বেশি করিয়া হারমোনিয়ম শিখিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে। একদিন কথায় কথায় হেমনলিনী কহিল, “রমেশবাবু, আমার বোধ হয়, আপনার অন্তত কিছুদিন বায়ুপরিবর্তন দরকার। না বাবা?”
অন্নদাবাবু ভাবিলেন কথাটা সংগত বটে, কারণ ইতিমধ্যে রমেশের উপর দিয়া শোকদুঃখের দুর্যোগ গিয়াছে। কহিলেন, “অন্তত কিছুদিনের জন্য কোথাও বেড়াইয়া আসা ভালো। বুঝিয়াছ রমেশ, পশ্চিমই বল আর যে দেশই বল, আমি দেখিয়াছি, কেবল কিছুদিনের জন্য একটু ফল পাওয়া যায়। প্রথম দিনকতক বেশ ক্ষুধা বাড়ে, বেশ খাওয়া যায়, তাহার পরে যে-কে সেই। সেই পেট ভার হইয়া আসে, বুক জ্বালা করিতে থাকে, যা খাওয়া যায় তা-ই–”
হেমনলিনী। রমেশবাবু, আপনি নর্মদা-ঝরনা দেখিয়াছেন? রমেশ। না, দেখি নাই। হেমনলিনী। এ আপনার দেখা উচিত, না বাবা? অন্নদা। তা বেশ তো, রমেশ আমাদের সঙ্গেই আসুন-না কেন? হাওয়া-বদলও হইবে, মার্বল্-পাহাড়ও দেখিবে।
হাওয়া-বদল করা এবং মার্বল্-পাহাড় দেখা, এই দুইটি যেন রমেশের পক্ষে সম্প্রতি সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয়–সুতরাং রমেশকেও রাজি হইতে হইল।
সেদিন রমেশের শরীর মন যেন হাওয়ার উপরে ভাসিতে লাগিল। অশান্ত হৃদয়ের আবেগকে কোনো একটা রাস্তায় ছাড়া দিবার জন্য সে আপনার বাসার ঘরের মধ্যে দ্বার রুদ্ধ করিয়া হারমোনিয়মটা লইয়া পড়িল। আজ আর তাহার ষত্বণত্বজ্ঞান রহিল না–যন্ত্রটার উপরে তাহার উন্মত্ত আঙুলগুলা তাল-বেতালের নৃত্য বাধাইয়া দিল। হেমনলিনীর দূরে যাইবার সম্ভাবনায় কয় দিন তাহার হৃদয়টা ভারাক্রান্ত হইয়া ছিল–আজ উল্লাসের বেগে সংগীতবিদ্যা সম্বন্ধে সর্বপ্রকার ন্যায়-অন্যায়-বোধ একেবারে বিসর্জন দিল।
এমন সময় দরজায় ঘা পড়িল, “আ সর্বনাশ! থামুন, থামুন রমেশবাবু, করিতেছেন কী?”
রমেশ অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া আরক্ত মুখে দরজা খুলিয়া দিল। অক্ষয় ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া কহিল, “রমেশবাবু, গোপনে বসিয়া এই-যে কাণ্ডটি করিতেছেন, আপনাদের ক্রিমিনাল কোডের কোনো দণ্ডবিধির মধ্যে কি ইহা পড়ে না?”
রমেশ হাসিতে লাগিল; কহিল, “অপরাধ কবুল করিতেছি।” অক্ষয় কহিল, “রমেশবাবু, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, আপনার সঙ্গে আমার একটা কথা আলোচনা করিবার আছে।”
রমেশ উৎকণ্ঠিত হইয়া নীরবে আলোচ্য বিষয়ের প্রতীক্ষা করিয়া রহিল।
অক্ষয়। আপনি এতদিনে এটুকু বুঝিয়াছেন, হেমনলিনীর ভালোমন্দের প্রতি আমি উদাসীন নহি।
রমেশ হাঁ-না কিছু না বলিয়া চুপ করিয়া শুনিতে লাগিল।
অক্ষয়। তাঁহার সম্বন্ধে আপনার অভিপ্রায় কী, তাহা জিজ্ঞাসা করিবার অধিকার আমার আছে–আমি অন্নদাবাবুর বন্ধু।
কথাটা এবং কথার ধরনটা রমেশের অত্যন্ত খারাপ লাগিল। কিন্তু কড়া জবাব দিবার অভ্যাস ও ক্ষমতা রমেশের নাই। সে মৃদুস্বরে কহিল, “তাঁহার সম্বন্ধে আমার কোনো মন্দ অভিপ্রায় আছে, এ আশঙ্কা আপনার
মনে আসিবার কি কোনো কারণ ঘটিয়াছে?”
নৌকাডুবি ১১ (২)
অক্ষয়। দেখুন, আপনি হিন্দুপরিবারে আছেন, আপনার পিতা হিন্দু ছিলেন। আমি জানি, পাছে আপনি ব্রাহ্ম-ঘরে বিবাহ করেন, এই আশঙ্কায় তিনি আপনাকে অন্যত্র বিবাহ দিবার জন্য দেশে লইয়া গিয়াছিলেন। এই সংবাদটি অক্ষয়ের জানিবার বিশেষ কারণ ছিল। কারণ অক্ষয়ই রমেশের পিতার মনে এই আশঙ্কা জন্মাইয়া দিয়াছিল। রমেশ ক্ষণকালের জন্য অক্ষয়ের মুখের দিকে চাহিতে পারিল না। অক্ষয় কহিল, “হঠাৎ আপনার পিতার মৃত্যু ঘটিল বলিয়াই কি আপনি নিজেকে স্বাধীন মনে করিতেছেন? তাঁহার ইচ্ছা কি–”
রমেশ আর সহ্য করিতে না পারিয়া কহিল, “দেখুন অক্ষয়বাবু, অন্যের সম্বন্ধে আমাকে উপদেশ দিবার অধিকার যদি আপনার থাকে, তবে দিন, আমি শুনিয়া যাইব–কিন্তু আমার পিতার সহিত আমার যে সম্বন্ধ তাহাতে আপনার কোনো কথা বলিবার নাই।”
অক্ষয় কহিল, “আচ্ছা বেশ, সে কথা তবে থাক্। কিন্তু হেমনলিনীকে বিবাহ করিবার অভিপ্রায় এবং অবস্থা আপনার আছে কি না, সে কথা আপনাকে বলিতে হইবে।”
রমেশ আঘাতের পর আঘাত খাইয়া ক্রমশই উত্তেজিত হইয়া উঠিতেছিল; কহিল, “দেখুন অক্ষয়বাবু, আপনি অন্নদাবাবুর বন্ধু হইতে পারেন, কিন্তু আমার সহিত আপনার তেমন বেশি ঘনিষ্ঠতা হয় নাই। দয়া করিয়া আপনি এ-সব প্রসঙ্গ বন্ধ করুন।”
অক্ষয়। আমি বন্ধ করিলেই যদি সব কথা বন্ধ থাকে এবং আপনি এখন যেমন ফলাফলের প্রতি দৃষ্টি না রাখিয়া বেশ আরামে দিন কাটাইতেছেন, এমনি বরাবর কাটাইতে পারিতেন, তাহা হইলে কোনো কথা ছিল না। কিন্তু সমাজ আপনাদের মতো নিশ্চিন্তপ্রকৃতি লোকের পক্ষে সুখের স্থান নহে। যদিও আপনারা অত্যন্ত উঁচুদরের লোক, পৃথিবীর কথা বড়ো বেশি ভাবেন না, তবু চেষ্টা করিলে হয়তো এটুকুও বুঝিতে পারিবেন যে, ভদ্রলোকের কন্যার সহিত আপনি যেরূপ ব্যবহার করিতেছেন, এরূপ করিয়া আপনি বাহিরের লোকের জবাবদিহি হইতে নিজেকে বাঁচাইতে পারেন না–এবং যাঁহাদিগকে আপনি শ্রদ্ধা করেন তাঁহাদিগকে লোকসমাজে অশ্রদ্ধাভাজন করিবার ইহাই উপায়।
রমেশ। আপনার উপদেশ আমি কৃতজ্ঞতার সহিত গ্রহণ করিলাম। আমার যাহা কর্তব্য তাহা আমি শীঘ্রই স্থির করিব এবং পালন করিব, এ বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত হইবেন–এ সম্বন্ধে আর অধিক আলোচনা করিবার প্রয়োজন নাই।
অক্ষয়। আমাকে বাঁচাইলেন রমেশবাবু। এত দীর্ঘকাল পরে আপনি যে কর্তব্য স্থির করিবেন এবং পালন করিবেন বলিতেছেন, ইহাতেই আমি নিশ্চিন্ত হইলাম–আপনার সঙ্গে আলোচনা করিবার শখ আমার নাই। আপনার সংগীতচর্চায় বাধা দিয়া অপরাধী হইয়াছি–মাপ করিবেন। আপনি পুনর্বার শুরু করুন, আমি বিদায় হইলাম।
এই বলিয়া অক্ষয় দ্রুতবেগে বাহির হইয়া গেল।
ইহার পরে অত্যন্ত বেসুরা সংগীতচর্চাও আর চলে না। রমেশ মাথার নীচে দুই হাত রাখিয়া বিছানার উপর চিত হইয়া শুইয়া পড়িল। অনেকক্ষণ এইভাবে গেল। হঠাৎ ঘড়িতে টং টং করিয়া পাঁচটা বাজিল শুনিয়াই সে দ্রুত উঠিয়া পড়িল। কী কর্তব্য স্থির করিল তাহা অন্তর্যামীই জানেন–কিন্তু আশু প্রতিবেশীর ঘরে গিয়া যে পেয়ালা-দুয়েক চা খাওয়া কর্তব্য, সে সম্বন্ধে তাহার মনে দ্বিধামাত্র রহিল না।
হেমনলিনী চকিত হইয়া কহিল, “রমেশবাবু, আপনার কি অসুখ করিয়াছে?” রমেশ কহিল, “বিশেষ কিছু না।” অন্নদাবাবু কহিলেন, “আর কিছুই নয়, হজমের গোল হইয়াছে–পিত্তাধিক্য। আমি যে পিল ব্যবহার করিয়া থাকি তাহার একটা খাইয়া দেখো দেখি–” হেমনলিনী হাসিয়া কহিল, “বাবা, ঐ পিল খাওয়াও নাই, তোমার এমন আলাপী কেহ দেখি না–কিন্তু তাহাদের এমন কী উপকার হইয়াছে?”
অন্নদা। অনিষ্ট তো হয় নাই। আমি যে নিজে পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি–এ পর্যন্ত যতরকম পিল খাইয়াছি, এইটেই সব চেয়ে উপকারী।
হেমনলিনী। বাবা, যখন তুমি একটা নূতন পিল খাইতে আরম্ভ কর, তখনি কিছুদিন তাহার অশেষ গুণ দেখিতে পাও-
অন্নদা। তোমরা কিছুই বিশ্বাস কর না–আচ্ছা, অক্ষয়কে জিজ্ঞাসা করিয়ো দেখি, আমার চিকিৎসায় সে উপকার পাইয়াছে কি না।
সেই প্রামাণিক সাক্ষীকে তলবের ভয়ে হেমনলিনীকে নিরুত্তর হইতে হইল। কিন্তু সাক্ষী আপনি আসিয়া হাজির হইল। আসিয়াই অন্নদাবাবুকে কহিল, “অন্নদাবাবু, আপনার সেই পিল আমাকে আর-একটি দিতে হইবে। বড়ো উপকার হইয়াছে। আজ শরীর এমনি হালকা বোধ হইতেছে!”
অন্নদাবাবু সগর্বে তাঁহার কন্যার মুখের দিকে তাকাইলেন।
নৌকাডুবি ১২
পিল খাওয়ার পর অন্নদাবাবু অক্ষয়কে শীঘ্র ছাড়িতে চাহিলেন না। অক্ষয়ও যাইবার জন্য বিশেষ ত্বরা প্রকাশ না করিয়া মাঝে মাঝে রমেশের মুখের দিকে কটাক্ষপাত করিতে লাগিল। রমেশের চোখে সহজে কিছু পড়ে না-কিন্তু আজ অক্ষয়ের এই কটাক্ষগুলি তাহার চোখ এড়াইল না। ইহাতে তাহাকে বার বার উদ্বেজিত করিয়া তুলিতে লাগিল।
পশ্চিমে বেড়াইতে যাইবার সময় নিকটবর্তী হইয়া উঠিয়াছে–মনে মনে তাহারই আলোচনায় হেমনলিনীর চিত্ত আজ বিশেষ প্রফুল্ল ছিল। সে ঠিক করিয়া রাখিয়াছিল, আজ রমেশবাবু আসিলে ছুটিযাপন সম্বন্ধে তাঁহার সঙ্গে নানাপ্রকার পরামর্শ করিবে। সেখানে নিভৃতে কী কী বই পড়িয়া শেষ করিতে হইবে, দুজনে মিলিয়া তাহার একটা তালিকা করিবার কথা ছিল। স্থির ছিল, রমেশ আজ সকাল-সকাল আসিবে, কেননা, চায়ের সময়ে অক্ষয় কিংবা কেহ-না-কেহ আসিয়া পড়ে, তখন মন্ত্রণা করিবার অবসর পাওয়া যায় না।
কিন্তু আজ রমেশ অন্য দিনের চেয়েও দেরি করিয়া আসিয়াছে। মুখের ভাবও তাহার অত্যন্ত চিন্তাযুক্ত। ইহাতে হেমনলিনীর উৎসাহে অনেকটা আঘাত পড়িল। কোনো-এক সুযোগে সে রমেশকে আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি আজ বড়ো যে দেরি করিয়া আসিলেন?”
রমেশ অন্যমনস্কভাবে একটু চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, “হাঁ, আজকে একটু দেরি হইয়া গেছে বটে।”
হেমনলিনী আজ তাড়াতাড়ি করিয়া কত সকাল-সকাল চুল বাঁধিয়া লইয়াছে। চুল-বাঁধা কাপড়-ছাড়ার পরে সে আজ কতবার ঘড়ির দিকে তাকাইয়াছে–অনেকক্ষণ পর্যন্ত মনে করিয়াছে তাহার ঘড়িটা ভুল চলিতেছে, এখনো বেশি দেরি হয় নাই। যখন এই বিশ্বাস রক্ষা করা একেবারে অসাধ্য হইয়া উঠিল তখন সে জানলার কাছে বসিয়া একটা সেলাই লইয়া কোনোমতে মনের অধৈর্য শান্ত রাখিবার চেষ্টা করিয়াছে। তাহার পরে রমেশ মুখ গম্ভীর করিয়া আসিল–কী কারণে দেরি হইয়াছে, তাহার কোনোপ্রকার জবাবদিহি করিল না–আজ সকালসেকাল আসিবার যেন কোনো শর্তই ছিল না।
হেমনলিনী কোনোমতে চা-খাওয়া শেষ করিয়া লইল। ঘরের প্রান্তে একটি টিপাইয়ের উপরে কতকগুলি বই ছিল–হেমনলিনী কিছু বিশেষ উদ্যমের সহিত রমেশের মনোযোগ আকর্ষণপূর্বক সেই বইগুলা তুলিয়া লইয়া ঘর হইতে বাহির হইবার উপক্রম করিল। তখন হঠাৎ রমেশের চেতনা হইল; সে তাড়াতাড়ি কাছে আসিয়া কহিল, “ওগুলি কোথায় লইয়া যাইতেছেন? আজ একবার বইগুলি বাছিয়া লইবেন না?”
হেমনলিনীর ওষ্ঠাধর কাঁপিতেছিল। সে উদ্বেল অশ্রুজলের উচ্ছ্বাস বহুকষ্টে সংবরণ করিয়া কম্পিত কণ্ঠে কহিল, “থাক্-না, বই বাছিয়া কী আর হইবে।”
এই বলিয়া সে দ্রুতবেগে চলিয়া গেল। উপরের শয়নঘরে গিয়া বইগুলা মেজের উপর ফেলিয়া দিল।
রমেশের মনটা আরো বিকল হইয়া গেল। অক্ষয় মনে মনে হাসিয়া কহিল, “রমেশবাবু, আপনার বোধ হয় শরীরটা আজ তেমন ভালো নাই?”
রমেশ ইহার উত্তরে অর্ধস্ফুটস্বরে কী বলিল, ভালো বোঝা গেল না। শরীরের কথায় অন্নদাবাবু উৎসাহিত হইয়া কহিলেন, “সে তো রমেশকে দেখিয়াই আমি বলিয়াছি।”
অক্ষয় মুখ টিপিয়া হাসিতে হাসিতে কহিল, “শরীরের প্রতি মনোযোগ করা রমেশবাবুর মতো লোকেরা বোধ হয় অত্যন্ত তুচ্ছ মনে করেন। উঁহারা ভাবরাজ্যের মানুষ–আহার হজম না হইলে তাহা লইয়া চেষ্টাচরিত্র করাটাকে গ্রাম্যতা বলিয়া জ্ঞান করেন।”
অন্নদাবাবু কথাটাকে গম্ভীরভাবে লইয়া বিস্তারিতরূপে প্রমাণ করিতে বসিলেন যে, ভাবুক হইলেও হজম করাটা চাইই।
রমেশ নীরবে বসিয়া মনে মনে দগ্ধ হইতে লাগিল।
নৌকাডুবি ১২ (২)
অক্ষয় কহিল, “রমেশবাবু, আমার পরামর্শ শুনুন–অন্নদাবাবুর পিল খাইয়া একটু সকাল-সকাল শুইতে যান।”
রমেশ কহিল, “অন্নদাবাবুর সঙ্গে আজ আমার একটু বিশেষ কথা আছে সেইজন্য আমি অপেক্ষা করিয়া আছি।”
অক্ষয় চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া কহিল, “এই দেখুন, এ কথা পূর্বে বলিলেই হইত। রমেশবাবু সকল কথা পেটে রাখিয়া দেন, শেষকালে সময় যখন প্রায় উত্তীর্ণ হইয়া যায় তখন ব্যস্ত হইয়া উঠেন।”
অক্ষয় চলিয়া গেলে রমেশ নিজের জুতাজোড়াটার প্রতি দুই নত চক্ষু বদ্ধ রাখিয়া বলিতে লাগিল, “অন্নদাবাবু, আপনি আমাকে আত্মীয়ের মতো আপনার ঘরের মধ্যে যাতায়াত করিবার অধিকার দিয়াছেন, ইহা আমি যে কত সৌভাগ্যের বিষয় বলিয়া জ্ঞান করি তাহা আপনাকে মুখে বলিয়া শেষ করিতে পারিব না।”
অন্নদাবাবু কহিলেন, “বিলক্ষণ! তুমি আমাদের যোগেনের বন্ধু, তোমাকে ঘরের ছেলে বলিয়া মনে করিব না তো কী করিব?”
ভূমিকা তো হইল, তাহার পরে কী বলিতে হইবে, রমেশ কিছুতেই ভাবিয়া পায় না। অন্নদাবাবু রমেশের পথ সুগম করিয়া দিবার জন্য কহিলেন, “রমেশ, তোমার মতো ছেলেকে ঘরের ছেলে করিতে পারা আমারই কি কম সৌভাগ্য!”
ইহার পরেও রমেশের কথা জোগাইল না।
অন্নদাবাবু কহিলেন, “দেখো-না, তোমাদের সম্বন্ধে বাহিরের লোক অনেক কথা বলিতে আরম্ভ করিয়াছে। তাহারা বলে, হেমনলিনীর বিবাহের বয়স হইয়াছে, এখন তাহার সঙ্গিনির্বাচন সম্বন্ধে বিশেষ সতর্ক হওয়া আবশ্যক। আমি তাহাদিগকে বলি, রমেশকে আমি খুব বিশ্বাস করি–সে আমাদের উপরে কখনোই অন্যায় ব্যবহার করিতে পারিবে না।”
রমেশ। অন্নদাবাবু, আমার সম্বন্ধে আপনি সমস্তই তো জানেন, আপনি যদি আমাকে যোগ্য পাত্র বলিয়া মনে করেন, তবে-
অন্নদা। সে কথা বলাই বাহুল্য। আমরা তো একপ্রকার ঠিক করিয়াই রাখিয়াছি–কেবল তোমার সাংসারিক দুর্ঘটনার ব্যাপারে দিন স্থির করিতে পারি নাই। কিন্তু বাপু, আর বিলম্ব করা উচিত হয় না। সমাজে এ লইয়া ক্রমেই নানা কথার সৃষ্টি হইতেছে–সেটা যত শীঘ্র হয় বন্ধ করিয়া দেওয়া কর্তব্য। কী বল?
রমেশ। আপনি যেরূপ আদেশ করিবেন তাহাই হইবে। অবশ্য সর্বপ্রথমে আপনার কন্যার মত জানা আবশ্যক।
অন্নদা। সে তো ঠিক কথা। কিন্তু সে একপ্রকার জানাই আছে। তবু কাল সকালেই সে কথাটা পাকা করিয়া লইব।
রমেশ। আপনার শুইতে যাইবার বিলম্ব হইতেছে, আজ তবে আসি।
অন্নদা। একটু দাঁড়াও। আমি বলি কী, আমরা জব্বলপুরে যাইবার আগেই তোমাদের বিবাহটা হইয়া গেলে ভালো হয়।
রমেশ। সে তো আর বেশি দেরি নাই।
অন্নদা। না, এখনো দিন-দশেক আছে। আগামী রবিবারে যদি তোমাদের বিবাহ হইয়া যায় তাহা হইলে তাহার পরেও যাত্রার আয়োজনের জন্য দু-তিন দিন সময় পাওয়া যাইবে। বুঝিয়াছ রমেশ, এত তাড়া করিতাম না, কিন্তু আমার শরীরের জন্যই ভাবনা।
রমেশ সম্মত হইল এবং আর-একটা পিল গিলিয়া বাড়ি চলিয়া গেল।
নৌকাডুবি ১৩
বিদ্যালয়ের ছুটি নিকটবর্তী। ছুটির সময়ে কমলাকে বিদ্যালয়েই রাখিবার জন্য রমেশ কর্ত্রীর সহিত পূর্বেই ঠিক করিয়াছিল।
রমেশ প্রত্যুষে উঠিয়া ময়দানের নির্জন রাস্তায় পদচারণা করিতে করিতে স্থির করিল, বিবাহের পর সে কমলা সম্বন্ধে হেমনলিনীকে সমস্ত ঘটনা আগাগোড়া বিস্তারিত করিয়া বলিবে। তাহার পরে কমলাকেও সমস্ত কথা বলিবার অবকাশ হইবে। এইরূপ সকল পক্ষে বোঝাপড়া হইয়া গেলে কমলা স্বচ্ছন্দে বন্ধুভাবে হেমনলিনীর সঙ্গেই বাস করিতে পারিবে। দেশে ইহা লইয়া নানা কথা উঠিতে পারে, ইহাই মনে করিয়া সে হাজারিবাগে গিয়া প্র্যাক্টিস করিবে স্থির করিয়াছে।
ময়দান হইতে ফিরিয়া আসিয়া রমেশ অন্নদাবাবুর বাড়ি গেল। সিঁড়িতে হঠাৎ হেমনলিনীর সঙ্গে দেখা হইল। অন্যদিন হইলে এরূপ সাক্ষাতে একটু কিছু আলাপ হইত। আজ হেমনলিনীর মুখ লাল হইয়া উঠিল, সেই রক্তিমার মধ্য দিয়া একটা হাসির আভা উষার আলোকের মতো দীপ্তি পাইল–হেমনলিনী মুখ ফিরাইয়া চোখ নিচু করিয়া দ্রুতবেগে চলিয়া গেল।
রমেশ যে গৎটা হেমনলিনীর কাছ হইতে হারমোনিয়মে শিখিয়াছিল, বাসায় গিয়া সেইটে খুব করিয়া বাজাইতে লাগিল। কিন্তু একটিমাত্র গৎ সমস্ত দিন বাজানো চলে না। কবিতার বই পড়িতে চেষ্টা করিল–মনে হইল, তাহার ভালোবাসার সুর যে-সুদূর উচ্চে উঠিতেছে কোনো কবিতা সে পর্যন্ত নাগাল পাইতেছে না।
আর হেমনলিনী অশ্রান্ত আনন্দের সহিত তাহার গৃহকর্ম সমস্ত সারিয়া নিভৃত দ্বিপ্রহরে শয়নঘরের দ্বার বন্ধ করিয়া তাহার সেলাইটি লইয়া বসিয়াছে। মুখের উপরে একটি পরিপূর্ণ প্রসন্নতার শান্তি। একটি সর্বাঙ্গীণ সার্থকতা তাহাকে বেষ্টন করিয়া রহিয়াছে।
চায়ের সময়ের পূর্বেই কবিতার বই এবং হারমোনিয়ম ফেলিয়া রমেশ অন্নদাবাবুর বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইল। অন্যদিন হেমনলিনীর সহিত দেখা হইতে বড়ো বিলম্ব হইত না। কিন্তু আজ চায়ের ঘরে দেখিল সে ঘর শূন্য, দোতলায় বসিবার ঘরে দেখিল সে ঘরও শূন্য, হেমনলিনী এখনো তাহার শয়নগৃহ ছাড়িয়া নামে নাই।
অন্নদাবাবু যথাসময়ে আসিয়া টেবিল অধিকার করিয়া বসিলেন। রমেশ ক্ষণে ক্ষণে চকিতভাবে দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিল।
পদশব্দ হইল, কিন্তু ঘরে প্রবেশ করিল অক্ষয়। যথেষ্ট হৃদ্যতা দেখাইয়া কহিল, “এই-যে রমেশবাবু, আমি আপনার বাসাতেই গিয়াছিলাম।”
শুনিয়াই রমেশের মুখে উদ্বেগের ছায়া পড়িল।
অক্ষয় হাসিয়া কহিল, “ভয় কিসের রমেশবাবু? আপনাকে আক্রমণ করিতে যাই নাই। শুভসংবাদে অভিনন্দন প্রকাশ করা বন্ধুবান্ধবের কর্তব্য–তাহাই পালন করিতে গিয়াছিলাম।”
এই কথায় অন্নদাবাবুর মনে পড়িল হেমনলিনী উপস্থিত নাই। হেমনলিনীকে ডাক দিলেন–উত্তর না পাইয়া তিনি নিজে উপরে গিয়া কহিলেন, “হেম, এ কী, এখনো সেলাই লইয়া বসিয়া আছ! চা তৈরি যে। রমেশ-অক্ষয় আসিয়াছে।”
হেমনলিনী মুখ ঈষৎ লাল করিয়া কহিল, “বাবা, আমার চা উপরে পাঠাইয়া দাও, আজ আমি সেলাইটা শেষ করিতে চাই।”
নৌকাডুবি ১৩ (২)
অন্নদা। ঐ তোমার দোষ হেম! যখন যেটা লইয়া পড়, তখন আর-কিছুই খেয়াল কর না। যখন পড়া লইয়া ছিলে তখন বই কোল হইতে নামিত না–এখন সেলাই লইয়া পড়িয়াছ, এখন আর-সমস্তই বন্ধ। না না, সে হইবে না–চলো, নীচে গিয়া চা খাইবে চলো।
এই বলিয়া অন্নদাবাবু জোর করিয়াই হেমনলিনীকে নীচে লইয়া আসিলেন। সে আসিয়াই কাহারো দিকে দৃষ্টি না করিয়া তাড়াতাড়ি চা ঢালিবার ব্যাপারে ভারি ব্যস্ত হইয়া উঠিল।
অন্নদাবাবু অধীর হইয়া কহিলেন, “হেম, ও কী করিতেছ? আমার পেয়ালায় চিনি দিতেছ কেন? আমি তো কোনোকালেই চিনি দিয়া চা খাই না।”
অক্ষয় টিপিটিপি হাসিয়া কহিল, “আজ উনি ঔদার্য সংবরণ করিতে পারিতেছেন না–আজ সকলকেই মিষ্ট বিতরণ করিবেন।”
হেমনলিনীর প্রতি এই প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ রমেশের মনে মনে অসহ্য হইল। সে তৎক্ষণাৎ স্থির করিল, আর যাই হউক, বিবাহের পরে অক্ষয়ের সহিত কোনো সম্পর্ক রাখা হইবে না।
অক্ষয় কহিল, “রমেশবাবু, আপনার নামটা বদলাইয়া ফেলুন।”
রমেশ এই রসিকতার চেষ্টায় অধিকতর বিরক্ত হইয়া কহিল, “কেন বলুন দেখি।”
অক্ষয় খবরের কাগজ খুলিয়া কহিল, “এই দেখুন, আপনার নামের একজন ছাত্র অন্য লোককে নিজের নামে চালাইয়া পরীক্ষা দেওয়াইয়া পাস হইয়াছিল–হঠাৎ ধরা পড়িয়াছে।”
হেমনলিনী জানে, রমেশ মুখের উপর উত্তর দিতে পারে না–সেইজন্য এতকাল অক্ষয় রমেশকে যত আঘাত করিয়াছে সেই তাহার প্রতিঘাত দিয়া আসিয়াছে। আজও থাকিতে পারিল না। গূঢ় ক্রোধের লক্ষণ চাপিয়া ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিল, “অক্ষয় বলিয়া ঢের লোক বোধ হয় জেলখানায় আছে।”
অক্ষয় কহিল, “ঐ দেখুন, বন্ধুভাবে সৎপরামর্শ দিতে গেলে আপনারা রাগ করেন। তবে সমস্ত ইতিহাসটা বলি। আপনি তো জানেন, আমার ছোটো বোন শরৎ বালিকা-বিদ্যালয়ে পড়িতে যায়। সে কাল সন্ধ্যার সময় আসিয়া কহিল, ‘দাদা, তোমাদের রমেশবাবুর স্ত্রী আমাদের ইস্কুলে পড়েন।’ আমি বলিলাম, ‘দূর পাগলী! আমাদের রমেশবাবু ছাড়া কি আর দ্বিতীয় রমেশবাবু জগতে নাই?’ শরৎ কহিল, ‘তা যেই হোন, তিনি তাঁর স্ত্রীর উপরে ভারি অন্যায় করিতেছেন। ছুটিতে প্রায় সব মেয়েই বাড়ি যাইতেছে, তিনি তাঁর স্ত্রীকে বোর্ডিঙে রাখিবার বন্দোবস্ত করিয়াছেন। সে বেচারা কাঁদিয়া কাটিয়া অনর্থপাত করিতেছে।’ আমি তখনি মনে মনে কহিলাম, এ তো ভালো কথা নহে, শরৎ যেমন ভুল করিয়াছিল, এমন ভুল আরো তো কেহ কেহ করিতে পারে!”
অন্নদাবাবু হাসিয়া উঠিয়া কহিলেন, “অক্ষয়, তুমি কী পাগলের মতো কথা কহিতেছ! কোন্ রমেশের স্ত্রী ইস্কুলে পড়িয়া কাঁদিতেছে বলিয়া আমাদের রমেশ নাম বদলাইবে নাকি?”
এমন সময়ে হঠাৎ বিবর্ণমুখে রমেশ ঘর হইতে উঠিয়া চলিয়া গেল। অক্ষয় বলিয়া উঠিল, “ও কী রমেশবাবু, আপনি রাগ করিয়া চলিয়া গেলেন নাকি? দেখুন দেখি, আপনি কি মনে করেন আপনাকে আমি সন্দেহ করিতেছি?” বলিয়া রমেশের পশ্চাৎ পশ্চাৎ বাহির হইয়া গেল।
অন্নদাবাবু কহিলেন, “এ কী কাণ্ড!”
হেমনলিনী কাঁদিয়া ফেলিল। অন্নদাবাবু ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “ও কী হেম, কাঁদিস কেন?”
সে উচ্ছ্বসিত রোদনের মধ্যে রুদ্ধকণ্ঠে কহিল, “বাবা, অক্ষয়বাবুর ভারি অন্যায়। কেন উনি আমাদের বাড়িতে ভদ্রলোককে এমন করিয়া অপমান করেন?”
নৌকাডুবি ১৩ (৩)
অন্নদাবাবু কহিলেন, “অক্ষয় ঠাট্টা করিয়া একটা কী বলিয়াছে, ইহাতে এত অস্থির হইবার কী দরকার ছিল?”
“এ-রকম ঠাট্টা অসহ্য।” বলিয়া দ্রুতপদে হেমনলিনী উপরে চলিয়া গেল।
এইবার কলিকাতায় আসার পর রমেশ বিশেষ যত্নের সহিত কমলার স্বামীর সন্ধান করিতেছিল। বহুকষ্টে ধোবাপুকুরটা কোন্ জায়গায়, তাহা বাহির করিয়া কমলার মামা তারিণীচরণকে এক পত্র লিখিয়াছিল।
উক্ত ঘটনার পরদিন প্রাতে রমেশ সেই পত্রের জবাব পাইল। তারিণীচরণ লিখিতেছেন, দুর্ঘটনার পরে তাঁহার জামাতা শ্রীমান্ নলিনাক্ষের কোনো সংবাদই পাওয়া যায় নাই। রংপুরে তিনি ডাক্তারি করিতেন-সেখানে চিঠি লিখিয়া তারিণীচরণ জানিয়াছেন, সেখানেও কেহ আজ পর্যন্ত তাঁহার কোনো খবর পায় নাই। তাঁহার জন্মস্থান কোথায়, তাহা তারিণীচরণের জানা নাই।
কমলার স্বামী নলিনাক্ষ যে বাঁচিয়া আছেন, এ আশা আজ রমেশের মন হইতে একেবারে দূর হইল।
সকালে রমেশের হাতে আরো অনেকগুলা চিঠি আসিয়া পড়িল। বিবাহের সংবাদ পাইয়া তাহার আলাপী
পরিচিত অনেকে তাহাকে অভিনন্দন-পত্র লিখিয়াছে। কেহ-বা আহারের দাবি জানাইয়াছে, কেহ-বা এত দিন সমস্ত ব্যাপারটা সে গোপন রাখিয়াছে বলিয়া রমেশকে সকৌতুক তিরস্কার করিয়াছে।
এমন সময়ে অন্নদাবাবুর বাড়ি হইতে চাকর একখানি চিঠি লইয়া রমেশের হাতে দিল। হাতের অক্ষর দেখিয়া রমেশের বুকের ভিতরটা দুলিয়া উঠিল। হেমনলিনীর চিঠি। রমেশ মনে করিল, অক্ষয়ের কথা শুনিয়া হেমনলিনীর মনে সন্দেহ জন্মিয়াছে এবং তাহাই দূর করিবার জন্য সে রমেশকে পত্র লিখিয়াছে।
চিঠি খুলিয়া দেখিল, তাহাতে কেবল এই ক’টি কথা লেখা আছে-“অক্ষয়বাবু কাল আপনার উপর ভারি অন্যায় করিয়াছেন। মনে করিয়াছিলাম আজ সকালেই আপনি আসিবেন, কেন আসিলেন না? অক্ষয়বাবুর কথা কেন আপনি এত করিয়া মনে লইতেছেন? আপনি তো জানেন, আমি তাঁর কথা গ্রাহ্যই করি না। আপনি আজ সকাল-সকাল আসিবেন–আমি আজ সেলাই ফেলিয়া রাখিব।”
এই ক’টি কথার মধ্যে হেমনলিনীর সান্ত্বনাসুধাপূর্ণ কোমল হৃদয়ের ব্যথা অনুভব করিয়া রমেশের চোখে জল আসিল। রমেশ বুঝিল, কাল হইতেই হেমনলিনী রমেশের বেদনা শান্ত করিবার জন্য ব্যাগ্রহৃদয়ে প্রতীক্ষা করিয়া আছে। এমনি করিয়া রাত গিয়াছে, এমনি করিয়া সকালটা কাটিয়াছে, অবশেষে আর থাকিতে না পারিয়া এই চিঠিখানি লিখিয়াছে।
রমেশ কাল হইতে ভাবিতেছে, আর বিলম্ব না করিয়া এইবার হেমনলিনীকে সকল কথা খুলিয়া বলা আবশ্যক হইয়াছে। কিন্তু কল্যকার ব্যাপারের পর বলা কঠিন হইয়া উঠিয়াছে। এখন ঠিক শুনাইবে যেন অপরাধ ধরা পড়িয়া জবাবদিহির চেষ্টা হইতেছে। শুধু তাহাই নহে, অক্ষয়ের যে কতকটা জয় হইবে, সেও অসহ্য।
রমেশ ভাবিতে লাগিল, কমলার স্বামী যে আর-কোনো রমেশ নিশ্চয়ই অক্ষয়ের মনে সেই ধারণাই আছে-নহিলে সে এতক্ষণে কেবল ইঙ্গিত করিয়া থামিয়া থাকিত না, পাড়াসুদ্ধ গোল করিয়া বেড়াইত। অতএব এই বেলা যাহা-হয় একটা উপায় অবলম্বন করা দরকার।
এমন সময় আর-একটা ডাকের চিঠি আসিল। রমেশ খুলিয়া দেখিল, সে চিঠি স্ত্রীবিদ্যালয়ের কর্ত্রীর নিকট হইতে আসিয়াছে। তিনি লিখিয়াছেন, কমলা অত্যন্ত কাতর হইয়া পড়িয়াছে, তাহাকে এ অবস্থায় ছুটির সময় বিদ্যালয়ের বোর্ডিঙে রাখা তিনি সংগত বোধ করেন না। আগামী শনিবারে ইস্কুল হইয়া ছুটি হইবে, সেই সময়ে তাহাকে বিদ্যালয় হইতে বাড়ি লইয়া যাইবার ব্যবস্থা করা নিতান্ত আবশ্যক।
নৌকাডুবি ১৩ (৪)
আগামী শনিবারে কমলাকে বিদ্যালয় হইতে লইয়া আসিতে হইবে! আগামী রবিবারে রমেশের বিবাহ!
“রমেশবাবু, আমাকে মাপ করিতে হইবে” এই বলিয়া অক্ষয় ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। কহিল, “এমন একটা সামান্য ঠা ঠাট্টায় আপনি যে এত রাগ করিবেন, তাহা আগে জানিলে আমি ও কথা তুলিতাম না। ঠা ঠাট্টার মধ্যে কিছু সত্য থাকিলেই লোকে চটিয়া ওঠে, কিন্তু যাহা একেবারে অমূলক তাহা লইয়া আপনি সকলের সাক্ষাতে এত রাগারাগি করিলেন কেন? অন্নদাবাবু তো কাল হইতে আমাকে ভর্ৎসনা করিতেছেন-হেমনলিনী আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করিয়াছেন। আজ সকালে তাঁহাদের ওখানে গিয়াছিলাম, তিনি ঘর ছাড়িয়া চলিয়াই গেলেন। আমি এমন কী অপরাধ করিয়াছিলাম বলুন দেখি।”
রমেশ কহিল, “এ-সমস্ত বিচার যথাসময়ে হইবে। এখন আমাকে মাপ করিবেন–আমার বিশেষ একটা প্রয়োজন আছে।” অক্ষয়। রোশনচৌকির বায়না দিতে চলিয়াছেন বুঝি? এ দিকে সময়সংক্ষেপ। আমি আপনার শুভকর্মে বাধা দিব না, চলিলাম।
অক্ষয় চলিয়া গেলে রমেশ অন্নদাবাবুর বাসায় গিয়া উপস্থিত হইল। ঘরে ঢুকিতেই হেমনলিনীর সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইল। আজ রমেশ সকাল-সকাল আসিবে, ইহা হেমনলিনী নিশ্চয় ঠিক করিয়া প্রস্তুত হইয়া বসিয়া ছিল। তাহার সেলাইয়ের ব্যাপারটি ভাঁজ করিয়া রুমালে বাঁধিয়া টেবিলের উপরে রাখিয়া দিয়াছিল। পাশে হারমোনিয়ম-যন্ত্রটি ছিল। আজ খানিকটা সংগীত-আলোচনা হইতে পারিবে এইরূপ তাহার আশা ছিল, তা ছাড়া
অব্যক্ত সংগীত তো আছেই।
রমেশ ঘরে ঢুকিতেই হেমনলিনীর মুখে একটি উজ্জ্বল-কোমল আভা পড়িল। কিন্তু সে আভা মুহূর্তেই মলান হইয়া গেল যখন রমেশ আর-কোনো কথা না বলিয়া প্রথমেই জিজ্ঞাসা করিল, “অন্নদাবাবু কোথায়?”
হেমনলিনী উত্তর করিল, “বাবা তাঁহার বসিবার ঘরে আছেন। কেন? তাঁহাকে কি এখনি প্রয়োজন আছে? তিনি তো সেই চা খাইবার সময় নামিয়া আসিবেন।”
রমেশ। না, আমার বিশেষ প্রয়োজন আছে। আর বিলম্ব করা উচিত হইবে না।
হেমনলিনী। তবে যান, তিনি ঘরেই আছেন।
রমেশ চলিয়া গেল। প্রয়োজন আছে! সংসারে প্রয়োজনেরই কেবল সবুর সয় না! আর ভালোবাসাকেই দ্বারের বাহিরে অবকাশ প্রতীক্ষা করিয়া বসিয়া থাকিতে হয়।
শরতের এই অমলান দিন যেন নিশ্বাস ফেলিয়া আপন আনন্দ-ভাণ্ডারের সোনার সিংহদ্বারটি বন্ধ করিয়া দিল। হেমনলিনী হারমোনিয়মের নিকট হইতে চৌকি সরাইয়া লইয়া টেবিলের কাছে বসিয়া একমনে সেলাই করিতে প্রবৃত্ত হইল। ছুঁচ ফুটিতে লাগিল কেবল বাহিরে নহে, ভিতরেও। রমেশের প্রয়োজনও শীঘ্র শেষ হইল না। প্রয়োজন রাজার মতো আপনার পুরা সময় লয়–আর ভালোবাসা কাঙাল!
নৌকাডুবি ১৪
রমেশ অন্নদাবাবুর ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। তখন অন্নদাবাবু মুখের উপরে খবরের কাগজ চাপা দিয়া কেদারায় পড়িয়া নিদ্রা দিতেছিলেন। রমেশ ঘরে প্রবেশ করিয়া কাসিতেই তিনি চকিত হইয়া উঠিয়া খবরের কাগজটা তুলিয়া ধরিয়াই কহিলেন, “দেখিয়াছ রমেশ, এবারে ওলাউঠায় কত লোক মরিয়াছে?”
রমেশ কহিল, “বিবাহ এখন কিছুদিন বন্ধ রাখিতে হইবে–আমার বিশেষ কাজ আছে।”
অন্নদাবাবুর মাথা হইতে শহরের মৃত্যুতালিকার বিবরণ একেবারে লুপ্ত হইয়া গেল। ক্ষণকাল রমেশের মুখের দিকে তাকাইয়া কহিলেন, “সে কী কথা রমেশ! নিমন্ত্রণ যে হইয়া গেছে।”
রমেশ কহিল, “এই রবিবারের পরের রবিবারে দিন পিছাইয়া দিয়া আজই পত্র বিলি করিয়া দেওয়া যাইতে পারে।”
অন্নদা। রমেশ, তুমি আমাকে অবাক করিলে। একি মকদ্দমা যে, তোমার সুবিধামত তুমি দিন পিছাইয়া মুলতুবি করিতে থাকিবে? তোমার প্রয়োজনটা কী, শুনি।
রমেশ। সে অত্যন্ত বিশেষ প্রয়োজন, বিলম্ব করিলে চলিবে না।
অন্নদাবাবু বাতাহত কদলীবৃক্ষের মতো কেদারার উপর হেলান দিয়া পড়িলেন–কহিলেন, “বিলম্ব করিলে চলিবে না! বেশ কথা, অতি উত্তম কথা! এখন তোমার যাহা ইচ্ছা হয় করো। নিমন্ত্রণ ফিরাইয়া লইবার ব্যবস্থা তোমার বুদ্ধিতে যাহা আসে, তাহাই হোক। লোকে যখন আমাকে জিজ্ঞাসা করিবে আমি বলিব, ‘আমি ও-সব কিছুই জানি না–তাঁহার কী আবশ্যক সে তিনিই জানেন, আর কবে তাঁহার সুবিধা হইবে সে তিনিই বলিতে পারেন।”
রমেশ উত্তর না করিয়া নতমুখে বসিয়া রহিল। অন্নদাবাবু কহিলেন, “হেমনলিনীকে সব কথা বলা হইয়াছে?”
রমেশ। না, তিনি এখনো জানেন না।
অন্নদা। তাঁহার তো জানা আবশ্যক। তোমার তো একলার বিবাহ নয়।
রমেশ। আপনাকে আগে জানাইয়া তাঁহাকে জানাইব স্থির করিয়াছি।
অন্নদাবাবু ডাকিয়া উঠিলেন, “হেম! হেম!”
হেমনলিনী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া কহিল, “কী বাবা?”
অন্নদা। রমেশ বলিতেছেন, উঁহার কী-একটা বিশেষ কাজ পড়িয়াছে, এখন উঁহার বিবাহ করিবার অবকাশ হইবে না।
হেমনলিনী একবার বিবর্ণমুখে রমেশের মুখের দিকে চাহিল। রমেশ অপরাধীর মতো নিরুত্তর বসিয়া রহিল।
হেমনলিনীর কাছে এ খবরটা যে এমন করিয়া দেওয়া হইবে, রমেশ তাহা প্রত্যাশা করে নাই। অপ্রিয় বার্তা অকসমাৎ এইরূপ নিতান্ত রূঢ়ভাবে হেমনলিনীকে যে কিরূপ মর্মান্তিকরূপে আঘাত করিল, রমেশ তাহা নিজের ব্যথিত অন্তঃকরণের মধ্যেই সম্পূর্ণ অনুভব করিতে পারিল। কিন্তু যে তীর একবার নিক্ষিপ্ত হয়, তাহা আর ফেরে না–রমেশ যেন স্পষ্ট দেখিতে পাইল এই নিষ্ঠুর তীর হেমনলিনীর হৃদয়ের ঠিক মাঝখানে গিয়া বিঁধিয়া রহিল।
এখন কথাটা আর কোনোমতে নরম করিয়া লইবার উপায় নাই। সবই সত্য–বিবাহ এখন স্থগিত রাখিতে হইবে, রমেশের বিশেষ প্রয়োজন আছে, কী প্রয়োজন তাহাও সে বলিতে ইচ্ছা করে না। ইহার উপরে এখন আর নূতন ব্যাখ্যা কী হইতে পারে?
নৌকাডুবি ১৪ (২)
অন্নদাবাবু হেমনলিনীর দিকে চাহিয়া কহিলেন, “তোমাদেরই কাজ, এখন তোমরাই ইহার যা হয় একটা মীমাংসা করিয়া লও।”
হেমনলিনী মুখ নত করিয়া বলিল, “বাবা, আমি ইহার কিছুই জানি না।” এই বলিয়া, ঝড়ের মেঘের মুখে সূর্যাস্তের মলান আভাটুকু যেমন মিলাইয়া যায় তেমনি করিয়া সে চলিয়া গেল। অন্নদাবাবু খবরের কাগজ মুখের উপর তুলিয়া পড়িবার ভান করিয়া ভাবিতে লাগিলেন। রমেশ নিস্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল।
হঠাৎ রমেশ এক সময় চমকিয়া উঠিয়া চলিয়া গেল। বসিবার বড়ো ঘরে গিয়া দেখিল হেমনলিনী জানালার কাছে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। তাহার দৃষ্টির সম্মুখে আসন্ন পূজার ছুটির কলিকাতা জোয়ারের নদীর মতো তাহার সমস্ত রাস্তা ও গলির মধ্যে স্ফীত জনপ্রবাহে চঞ্চল-মুখর হইয়া উঠিয়াছে।
রমেশ একেবারে তাহার পার্শ্বে যাইতে কুণ্ঠিত হইল। পশ্চাৎ হইতে কিছুক্ষণের জন্য স্থিরদৃষ্টিতে তাহাকে দেখিতে লাগিল। শরতের অপরাহ্ন-আলোকে বাতায়নবর্তিনী এই স্তব্ধমূর্তিটি রমেশের মনের মধ্যে একটি চিরস্থায়ী ছবি আঁকিয়া দিল। ঐ সুকুমার কপোলের একটি অংশ, ঐ সযত্নরচিত কবরীর ভঙ্গি, ঐ গ্রীবার উপরে কোমলবিরল কেশগুলি, তাহারই নীচে সোনার হারের একটুখানি আভাস, বাম স্কন্ধ হইতে লম্বিত অঞ্চলের বঙ্কিম প্রান্ত, সমস্তই রেখায় রেখায় তাহার পীড়িত চিত্তের মধ্যে যেন কাটিয়া কাটিয়া বসিয়া গেল। রমেশ আস্তে আস্তে হেমনলিনীর কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। হেমনলিনী রমেশের চেয়ে রাস্তার লোকদের জন্য যেন বেশি ঔৎসুক্য বোধ করিতে লাগিল। রমেশ বাষ্পরুদ্ধকণ্ঠে কহিল, “আপনার কাছে আমার একটি ভিক্ষা আছে।”
রমেশের কণ্ঠস্বরে উদ্বেল বেদনার আঘাত অনুভব করিয়া মুহূর্তের মধ্যে হেমনলিনীর মুখ ফিরিয়া আসিল। রমেশ বলিয়া উঠিল, “তুমি আমাকে অবিশ্বাস করিয়ো না।”–রমেশ এই প্রথম হেমনলিনীকে ‘তুমি’ বলিল।–“এই কথা আমাকে বলো যে, তুমি আমাকে কখনো অবিশ্বাস করিবে না। আমিও অন্তর্যামীকে অন্তরে সাক্ষী রাখিয়া বলিতেছি তোমার কাছে আমি কখনো অবিশ্বাসী হইব না।”
রমেশের আর কথা বাহির হইল না, তাহার চোখের প্রান্তে জল দেখা দিল। তখন হেমনলিনী তাহার সিনগ্ধকরুণ দুই চক্ষু তুলিয়া রমেশের মুখের দিকে স্থির করিয়া রাখিল। তাহার পরে সহসা বিগলিত অশ্রুধারা হেমনলিনীর দুই কপোল বাহিয়া ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে সেই নিভৃত বাতায়নতলে দুই জনের মধ্যে একটি বাক্যবিহীন শান্তি ও সান্ত্বনার স্বর্গখণ্ড সৃজিত হইয়া গেল।
কিছুক্ষণ এই অশ্রুজলপ্লাবিত সুগভীর মৌনের মধ্যে হৃদয়মন নিমগ্ন রাখিয়া একটি আরামের দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া রমেশ কহিল, “কেন আমি এখন সপ্তাহের জন্য বিবাহ স্থগিত রাখিবার প্রস্তাব করিয়াছি, তাহার কারণ কি তুমি জানিতে চাও?”
হেমনলিনী নীরবে মাথা নাড়িল–সে জানিতে চায় না। রমেশ কহিল, “বিবাহের পরে আমি তোমাকে সব কথা খুলিয়া বলিব।” এই কথাটায় হেমনলিনীর কপোলের কাছটা একটুখানি রাঙা হইয়া উঠিল। আজ আহারান্তে হেমনলিনী যখন রমেশের সহিত মিলনপ্রত্যাশায় উৎসুকচিত্তে সাজ করিতেছিল, তখন সে অনেক হাসিগল্প, অনেক নিভৃত পরামর্শ, অনেক ছোটোখাটো সুখের ছবি কল্পনায় সৃজন করিয়া লইতেছিল। কিন্তু এই-যে অল্প কয় মুহূর্তে দুই হৃদয়ের মধ্যে বিশ্বাসের মালা-বদল হইয়া গেল–এই-যে চোখের জল ঝরিয়া পড়িল, কথাবার্তা কিছুই হইল না, কিছুক্ষণের জন্য দুইজনে পাশাপাশি দাঁড়াইয়া রহিল–ইহার নিবিড় আনন্দ, ইহার গভীর শান্তি, ইহার পরম আশ্বাস সে কল্পনাও করিতে পারে নাই।
হেমনলিনী কহিল, “তুমি এক বার বাবার কাছে যাও, তিনি বিরক্ত হইয়া আছেন।”
রমেশ প্রফুল্লচিত্তে সংসারের ছোটো-বড়ো আঘাত-সংঘাত বুক পাতিয়া লইবার জন্য চলিয়া গেল।
নৌকাডুবি ১৫
অন্নদাবাবু রমেশকে পুনরায় গৃহে প্রবেশ করিতে দেখিয়া উদ্বিগ্নভাবে তাহার মুখের দিকে চাহিলেন। রমেশ কহিল, “নিমন্ত্রণের ফর্দটা যদি আমার হাতে দেন, তবে দিনপরিবর্তনের চিঠিগুলি আজই রওনা করিয়া দিতে পারি।”
অন্নদাবাবু কহিলেন, “তবে দিনপরিবর্তনই স্থির রহিল?”
রমেশ কহিল, “হাঁ, অন্য উপায় আর কিছুই দেখি না।”
অন্নদাবাবু কহিলেন, “দেখো বাপু, তবে আমি ইহার মধ্যে নাই। যাহা-কিছু বন্দোবস্ত করিবার, সে তুমিই করিয়ো। আমি লোক হাসাইতে পারিব না। বিবাহ-ব্যাপারটাকে যদি নিজের মর্জি অনুসারে ছেলেখেলা করিয়া তোল, তবে আমার মতো বয়সের লোকের ইহার মধ্যে না থাকাই ভালো। এই লও তোমার নিয়ন্ত্রণের ফর্দ। ইতিমধ্যে আমি কতকগুলা টাকা খরচ করিয়া ফেলিয়াছি, তাহার অনেকটাই নষ্ট হইবে। এমনি করিয়া বার বার টাকা জলে ফেলিয়া দিতে পারি এমন সংগতি আমার নাই।”
রমেশ সমস্ত ব্যয় ও ব্যবস্থার ভার নিজের স্কন্ধে লইতেই প্রস্তুত হইল। সে উঠিবার উপক্রম করিতেছে, এমন সময় অন্নদাবাবু কহিলেন, “রমেশ, বিবাহের পরে তুমি কোথায় প্র্যাক্টিস করিবে, কিছু স্থির করিয়াছ? কলিকাতায় নয়?”
রমেশ কহিল, “না। পশ্চিমে একটা ভালো জায়গার সন্ধান করিতেছি।”
অন্নদা। সেই ভালো, পশ্চিমই ভালো। এটোয়া তো মন্দ জায়গা নয়। সেখানকার জল হজমের পক্ষে অতি উত্তম–আমি সেখানে মাসখানেক ছিলাম–সেই এক মাসে আমার আহারের পরিমাণ ডবল বাড়িয়া গিয়াছিল। দেখো বাপু, সংসারে আমার ঐ একটিমাত্র মেয়ে–আমি সর্বদা উহার কাছে কাছে না থাকিলে সেও সুখী হইবে না, আমিও নিশ্চিন্ত হইতে পারিব না। তাই আমার ইচ্ছা–তোমাকে একটা স্বাসথ্যকর জায়গা বাছিয়া লইতে হইবে।
অন্নদাবাবু রমেশের একটা অপরাধের অবকাশ পাইয়া সেই সুযোগে নিজের বড়ো বড়ো দাবিগুলা উপস্থিত করিতে আরম্ভ করিলেন। সে সময়ে রমেশকে তিনি যদি এটোয়া না বলিয়া গারো বা চেরাপুঞ্জির কথা বলিতেন, তবে তৎক্ষণাৎ সে রাজি হইত। সে কহিল, “যে আজ্ঞা, আমি এটোয়াতেই প্র্যাক্টিস করিব।” এই বলিয়া রমেশ নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যানের কার্যভার লইয়া প্রস্থান করিল।
অনতিকাল পরে অক্ষয় ঘরে ঢুকিতেই অন্নদাবাবু কহিলেন, “রমেশ তাহার বিবাহের দিন এক সপ্তাহ পিছাইয়া দিয়াছে।”
অক্ষয়। না না, আপনি বলেন কী! সে কি কখনো হইতে পারে? পরশু যে বিবাহ।
অন্নদা। হইতে তো না পারাই উচিত ছিল–সাধারণ লোকের তো এমনতরো হয় না। কিন্তু আজকাল তোমাদের যে-রকম কাণ্ড দেখিতেছি, সবই সম্ভব।
অক্ষয় অত্যন্ত মুখ গম্ভীর করিয়া আড়ম্বর-সহকারে চিন্তা করিতে লাগিল।
কিছুক্ষণ পরে কহিল, “আপনারা যাহাকে একবার সৎপাত্র বলিয়া ঠাওরাইয়াছেন, তাহার সম্বন্ধে দুটি চক্ষু বুজিয়া থাকেন। মেয়েকে যাহার হাতে চিরদিনের মতো সমর্পণ করিতে যাইতেছেন, ভালো করিয়া তাহার সম্বন্ধে খোঁজখবর রাখা উচিত। হোক-না কেন সে স্বর্গের দেবতা, তবু সাবধানের বিনাশ নাই।”
অন্নদা। রমেশের মতো ছেলেকেও যদি সন্দেহ করিয়া চলিতে হয়, তবে তো সংসারে কাহারো সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ রাখা অসম্ভব হইয়া পড়ে।
নৌকাডুবি ১৫ (২)
অক্ষয়। আচ্ছা, এই-যে দিন পিছাইয়া দিতেছেন, রমেশবাবু তাহার কারণ কিছু বলিয়াছেন?
অন্নদাবাবু মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে কহিলেন, “না, কারণ তো কিছুই বলিল না–জিজ্ঞাসা করিলে বলে বিশেষ দরকার আছে।”
অক্ষয় মুখ ফিরাইয়া ঈষৎ একটু হাসিল মাত্র। তাহার পরে কহিল, “বোধ হয় আপনার মেয়ের কাছে রমেশবাবু একটা কারণ নিশ্চয় কিছু বলিয়াছেন।”
অন্নদা। সম্ভব বটে।
অক্ষয়। তাঁহাকে একবার ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিলে ভালো হয় না?
“ঠিক বলিয়াছ” বলিয়া অন্নদাবাবু উচ্চৈঃস্বরে হেমনলিনীকে ডাক দিলেন। হেমনলিনী ঘরে ঢুকিয়া অক্ষয়কে দেখিয়া তাহার বাপের পাশে এমন করিয়া দাঁড়াইল যাহাতে অক্ষয় তাহার মুখ না দেখিতে পায়।
অন্নদাবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিবাহের দিন যে হঠাৎ পিছাইয়া গেল, রমেশ তাহার কারণ তোমাকে কিছু বলিয়াছেন?”
হেমনলিনী ঘাড় নাড়িয়া কহিল, “না।”
অন্নদা। তুমি তাহাকে কারণ জিজ্ঞাসা কর নাই?
হেমনলিনী। না।
অন্নদা। আশ্চর্য ব্যাপার। যেমন রমেশ, তুমিও দেখি তেমনি। তিনি আসিয়া বলিলেন, ‘আমার বিবাহে ফুরসৎ হইতেছে না’–তুমিও বলিলে, ‘বেশ, ভালো, আর-এক দিন হইবে!’ বাস্, আর কোনো কথাবার্তা নাই!
অক্ষয় হেমনলিনীর পক্ষ লইয়া কহিল, “এক জন লোক যখন স্পষ্টই কারণ গোপন করিতেছে তখন সে কথা লইয়া তাহাকে কি কোনো প্রশ্ন করা ভালো দেখায়? যদি বলিবার মতো কিছু হইত, তবে তো রমেশবাবু আপনিই বলিতেন।”
হেমনলিনীর মুখ লাল হইয়া উঠিল। সে কহিল, “এই বিষয় লইয়া আমি বাহিরের লোকের কাছে কোনো কথাই শুনিতে চাই না। যাহা ঘটিয়াছে তাহাতে আমার মনে কোনো ক্ষোভ নাই।”
এই বলিয়া হেমনলিনী দ্রুতপদে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
অক্ষয় পাংশু মুখে হাসি টানিয়া আনিয়া কহিল, “সংসারে বন্ধুর কাজটাতেই সব চেয়ে লাঞ্ছনা বেশি। সেইজন্যই আমি বন্ধুত্বের গৌরব বেশি অনুভব করি। আপনারা আমাকে ঘৃণা করুন আর গালি দিন, রমেশকে সন্দেহ করাই আমি বন্ধুর কর্তব্য বলিয়া জ্ঞান করি। আপনাদের যেখানে কোনো বিপদের সম্ভাবনা দেখি সেখানে আমি অসংশয়ে থাকিতে পারি না–আমার এই একটা মস্ত দুর্বলতা আছে, এ কথা আমাকে স্বীকার করিতেই হইবে। যাই হোক, যোগেন তো কালই আসিতেছে, সেও যদি সমস্ত দেখিয়া-শুনিয়া নিজের বোনের সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত থাকে তবে এ বিষয়ে আমি আর কোনো কথা কহিব না।”
রমেশের ব্যবহার সম্বন্ধে প্রশ্ন করিবার সময় আসিয়াছে, অন্নদাবাবু এ কথা একেবারে বোঝেন না তাহা নহে-কিন্তু যাহা অগোচরে আছে তাহাকে বলপূর্বক আলোড়িত করিয়া তাহার মধ্য হইতে হঠাৎ একটা ঝঞ্ঝা আবিষ্কারের সম্ভাবনায়, তিনি স্বভাবত তাহাতে কিছুমাত্র আগ্রহবোধ করেন না।
অক্ষয়ের উপর তাঁহার রাগ হইল। তিনি কহিলেন, “অক্ষয়, তোমার স্বভাবটা বড়ো সন্দিগ্ধ। প্রমাণ না পাইয়া কেন তুমি–”
অক্ষয় আপনাকে দমন করিতে জানে, কিন্তু উত্তরোত্তর আঘাতে আজ তাহার ধৈর্য ভাঙিয়া গেল। সে উত্তেজিত হইয়া কহিল, “দেখুন অন্নদাবাবু, আমার অনেক দোষ আছে। আমি সৎপাত্রের প্রতি ঈর্ষা করি, আমি সাধুলোককে সন্দেহ করি। ভদ্রলোকের মেয়েদের ফিলজফি পড়াইবার মতো বিদ্যা আমার নাই এবং তাঁহাদের সহিত কাব্য আলোচনা করিবার স্পর্ধাও আমি রাখি না–আমি সাধারণ দশ জনের মধ্যেই গণ্য–কিন্তু চিরদিন আমি আপনাদের প্রতি অনুরক্ত, আপনাদের অনুগত। রমেশবাবুর সঙ্গে আর-কোনো বিষয়ে আমার তুলনা হইতে পারে না–কিন্তু এইটুকুমাত্র অহংকার আমার আছে, আপনাদের কাছে কোনোদিন আমার কিছু লুকাইবার নাই। আপনাদের কাছে আমার সমস্ত দৈন্য প্রকাশ করিয়া আমি ভিক্ষা চাহিতে পারি, কিন্তু সিঁদ কাটিয়া চুরি করা আমার স্বভাব নহে। এ কথার কী অর্থ, তাহা কালই আপনারা বুঝিতে পারিবেন।”