নৈমিষ কানন
“টিং টং টিং টং —– “
বছর আট/দশের বান্টি এসেছে সদলবলে। সরস্বতী পুজোর চাঁদা।
“বেশি করে ডবল টাকা দেবে আন্টি। এবার পুজো দুদিন”।
—– “হ্যাঁ বৌদি। বলতে ভুলে গেছি। আমার কিন্তু তিন দিন ছুটি হবে”।
ঘর মুছতে মুছতে বান্টির দিদা, বিন্তি মাসির ঘোষণা। ঘটনাচক্রে তিনি বিগত বেশ কয়েক বছর আমার বাসস্থান (অ)পরিচ্ছন্ন রাখার গুরুদায়িত্ব পালন করে চলেছেন।
রাগটাগ বিশেষ হয় না কোনো কালে। তবে কিনা বুদ্ধি সুদ্ধির ঘাটতি আছে আমার চিরকালই। মাথাটা তাই কেমন কেমন করে। বান্টিকে টাকা দিতে দিতে ভাবতে থাকি, জিজ্ঞেস করা কি ঠিক হবে ! —–
“তোরা দুদিন ধরে পুজো করবি বলে আমি ডাবল চাঁদা কেন দেবো!
বিন্তি মাসির তিন দিন ছুটি! সরস্বতী পুজোর জন্য!”
মাথার সঙ্গে শরীর মনটাও কেমন দুবলা দুবলা বোধ হয়। অবশ্য কাউকেই কিছু বলতে হয় না। টাকার পরিমাণটা বোধহয় ভাগ্যগুণে খুশি করে বান্টিদের। নিজেরাই বলে —–
“ঠাকুর দেখতে যেও। ব্রহ্মাস্ত্রের আলিয়ার থেকেও ঝক্কাস একখান পোতিমে নামাব। কিপটেমি করোনি। তোমায় পেশাদ খাওয়াব”।
ঝিমঝিমে দেহে দরজা বন্ধ করতে না করতেই, নাতির কথার ধুয়ো ধরে দিদা —–
—– “মঙ্গলবার খিচুড়ি ভোগ। বুধবার গোটা ষষ্ঠী। এবার তাই বিষ্যুদবার নি-আচার। ওইদিন আমাদের বিরিয়ানি পাটি। তিনদিন কি টানা নিরিমিষ গেলা যায়! কও দেখি? কলুষ নিওনি পাপহারী”।
মোছা ফেলে হাত দু’খানা জড়ো করে কপালে ছোঁয়ায় আলগোছে।
💮💮💮💮💮
“টিং টিং টিং টিং ——“
মেসেঞ্জারে কোনো এক অনুপমার লেখা শব্দিত হল —–
“তুই গীতবিতান’এর বীরেশ্বর স্যার’এর ছাত্রী তো? একটুও বদলাসনি। আমায় চিনতে পেরেছিস? আমার বোন তোর ব্যাচমেট ছিল —– “।
প্রোফাইল এর অত্যাধুনিক পোশাকে সজ্জিতার ছবি দেখে অনুপমাদিকে চিনতে আমার অসুবিধাই হলো। তবে কথায় গল্পে সেই অসুবিধা সহজেই উবে গেল। মনে পড়ল। অনুপমা অনুত্তমা দুই সহোদরা ছিল রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী।
স্মৃতির তরণী বেয়ে সেকেন্ড মিনিট ঘন্টা ভেসে চলল। কিশোরী বেলার দুষ্টু মিষ্টি আলাপচারিতা। সঙ্গীতের থিওরি পরীক্ষার অবৈধ লুকোচুরি থেকে, তানপুরা তবলা সঙ্গতকারী দাদাদের জন্য নির্দোষ চঞ্চলতা।
জানলাম অনুপমাদি নিজেই এখন একটি গানের ইন্সটিটিউশনের পরিচালিকা। অসংখ্য তার ছাত্র ছাত্রী। সরস্বতী পূজার আমন্ত্রণ পেলাম একাধিকবার। দিদির আদরের নাতনির নাচ গানের ভিডিও আসতে লাগল হোয়াটস অ্যাপ/মেসেঞ্জারে।
💮💮💮💮💮
দিনে দিনে এসে পড়ল বসন্ত পঞ্চমী। বেদমাতার বাৎসরিক শাস্ত্রসাধন যথাবিহিত সাধিত হল। প্রসাদ বিতরণ সমাপনীতে আত্মীয় বন্ধুরাও প্রস্থান করল। কন্যা গেল বন্ধুদের সঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে।
জনশূন্য গৃহে হঠাৎ মনে হল, একটু প্রসাদ নিয়ে যাই অনুপমাদির সাথে দেখা করে আসি। এত করে ডাকে। শুক্লা পঞ্চমীর মিঠে কড়া রোদের অন্তরঙ্গতায় পৌঁছে গেলাম ‘harmony fusion’.
বিশাল এক দ্বিতল। দরজার বাইরে শয়ে শয়ে জুতো। পিলপিল করছে কালো মাথা। কচি কাঁচাদের কলতানে সরগরম। ভেবেছিলাম ঢোকার আগে ফোন করব। কিন্তু বুঝলাম, এই মুখরিত কলকাকলির সাথে আমার কণ্ঠস্বর পাল্লা দিতে পারবে না।
দরজা দিয়ে ঢুকতে গিয়ে আমি বিহ্বল। বিস্তারিত কক্ষের একদিক জুড়ে উঁচু স্টেজ। উড়ন্ত রাজহংসের উপর নৃত্যরত বীণাপাণি। মুকুটের চূড়া প্রায় ছাদ ছুঁই ছুঁই। গীতিপ্রিয়ার এহেন সুউচ্চ মূর্তি আমার এই মধ্যজীবনে অদ্যাবধি অভূতপূর্ব।
ঘোর কাটল মাইকের উচ্চনাদে।
—– “attention attention. আমাদের cultural encounter start হচ্ছে —–“
মাইক্রোফোন হাতে অনুপমাদি। ডিজাইনার পোশাকে ঝলমলে অপরূপা। মনে মনে কোথাও যেন একটু গর্ব হলো। একই সঙ্গীত গুরু। আমি তো সব ভুলে মেরে দিয়েছি। দিদি কেমন শিক্ষাটাকে কাজে লাগাচ্ছে।
—– “আজ কিন্তু সরস্বতী পুজো। যে যা খুশি গাইবে। তবে বাংলা গান। মনে থাকে যেন। only bengali songs —– “
ভিডিও দেখে দেখে এতদিনে অনুপমাদির নাতনি আমার অতি পরিচিতা।
“আমি কলকাতার রসগোল্লা” —-
“বেশ করেছি প্রেম করেছি করবই তো” —-
“প্রেম জেগেছে আমার মনে” —-
“কোথায় ছিলে দুষ্টু ছেলে” —-
—- “উরি উরি বাবা উরি উরি বাবা —-“
পাঁচ/সাত বছরের রিনরিনে কণ্ঠ এবং তনু বিভঙ্গে উন্মাদনা প্রকাশ করার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। গোটা হল নাচছে গাইছে। সাথে স্বচ্ছবসনা বিলোল শিক্ষিকা। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বুঝলাম, আমার মতন বেরসিক নেহাতই বেমানান এই আনন্দযজ্ঞে।
নিঃশব্দে পরিত্যাগ করে এলাম সশব্দ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। পোড়া মনে ছায়ার মতন ঝাপসা একটা ছবি! গীতবিতান’এর বাণী বন্দনা। লালপাড় হলুদ শাড়ি, দুই বিনুনির অনুপমাদি। সামনে হারমোনিয়াম। মুদ্রিত নয়নে উচ্চারিত ভগবতী স্তোত্র। সন্তর্পনে বিলীন হল harmony encounter-এর শব্দ তরঙ্গ। কাঁধে প্রসাদ’এর ঝোলাখানা। কি করি! এখান থেকে মিনিট ছয় সাত হাঁটতে পারলে বিন্তি মাসিদের বস্তি। যাই। প্রসাদটা বান্টিকেই দিয়ে আসি। নতুন উদ্যমে হাঁটা শুরু করলাম। দূর থেকে কানে এল —–
“ডাআআআআরলিং —- “
মৃদু মন্দ্রিত ঊষা উত্থুপজি উচ্চকিত হলেন —-
“এক দো, চা চা চা” —-
“রাম্বা হো হো হো” —-
—-“হরি ওম হরি” —-
হরি হরি। আলিয়া ভট্টের মুখ বিন্যাসে ক্যাটরিনা কাইফের লাস্যে নৃত্যময়ী সুরেশ্বরী। সামনে সারি সারি বেঞ্চি। তার উপর নীচে আট থেকে আশির বাদ্যোদ্যমে মধুর ভাষিণীর বন্দনা। সীমাহীন অসমীক্ষিত স্থূলবুদ্ধি আমি গুটি গুটি পায়ে ফিরতি পথ ধরলাম।
বড়ো রাস্তায় ওঠার মুখে নজর পড়ল নির্গৃহ নির্ধন নিরাসক্ত এক বৃদ্ধ বাতুল। ত্রিফলার পোস্টে হেলান দিয়ে পদযুগল মেলে, সূরতাপ উপভোগ করছে পরমানন্দে। বাম হাতে ধরা একটি ফাঁকা থার্মোকলের বাটি। হয়তো প্রসাদ বিতরণীতে পেয়েছে কখনও।
মনে পড়ল। কাঁধের ব্যাগে থাকা প্রসাদের কথা। ইউজ অ্যান্ড থ্রো টিফিন বক্সগুলি মাথায় ঠেকিয়ে নামিয়ে রাখলাম তার সামনে। কি বুঝল কে জানে! একগাল হাসি নিয়ে জটাজুটধারী তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
অন্তরে ঘনায়মান মর্মপীড়া লহমায় নিরত হল নিরলঙ্কৃত সহাস্য দৃষ্টিতে। খুশি মনে পা বাড়ালাম বাড়ির পথে। পশ্চাতে ধ্বনিত হল পাগলা বাবার উন্মুক্ত কণ্ঠ —–
“জিলে লে জিলে লে
আয়ো আয়ো জিলে রে —- “
এক মূহুর্ত থমকে দাঁড়ালাম। পরমূহূর্তে নিরুদ্বিগ্ন হাসি মুখে চলতে শুরু করলাম নিরবিচ্ছিন্ন জীবন স্রোতে।
💮💮💮💮💮
ফিরে এলাম আমার সংসার মন্দিরে। উদ্বেগ রহিত নিরালা গৃহকোণ। আমার আপন তুলিকায় চিত্রিত শ্বেতপদ্মকরার রং রূপ। স্বীয় বাগিচার কুসুমে নিজহস্তে গ্রথিত তপস্বিনীর পুষ্পাভরণ। দুহিতার সযতনে অঙ্কিত মনস্বিনীর আলপনা। নিভৃত নির্জন উপাসনা কক্ষ। মুখোমুখি অনুদ্ধতা আমি আর আমার সমাহিতা ক্ষমাবতী অক্ষরা।।