Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নৃসিংহ রহস্য || Shirshendu Mukhopadhyay » Page 9

নৃসিংহ রহস্য || Shirshendu Mukhopadhyay

ফের সেই খোড়ো ঘরটায়

ফের সেই খোড়ো ঘরটায় ফিরে এল তারা। সঙ্গে সুমন্তবাবু। কাঠুরিয়া তাঁকে শুকনো একটা ধুতি আর একখানা কম্বল দিল গায়ে দেওয়ার জন্য। কুলুঙ্গি থেকে নামিয়ে চিড়ে, গুড়, মর্তমান কলা দিয়ে খাওয়াল। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকেই ঘটনাটা বলে গেলেন সুমন্তবাবু।

কাঠুরিয়া চুপ করে শুনল। তারপর জিজ্ঞেস করল, “মৃদঙ্গবাবুর কী হল সে খবর কি জানেন?”

সুমন্তবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “না। বোধহয় পুলিশে ধরেছে।”

কাঠুরিয়া চুপ করে ভাবতে লাগল। বাইরে সন্ধে ঘনিয়ে এসেছে। পাখিরা ফিরে আসছে নিজেদের বাসায়। তাদের কিচির-মিচির শব্দে বনভূমি মুখর। সন্ধের সঙ্গে সঙ্গেই ঠাণ্ডা বাড়তে লাগল। জলার জল ছুঁয়ে উত্তুরে বাতাস এল হু হু করে। শীতে সুমন্তবাবু আর পল্টু কাঁপতে লাগল। কিন্তু কাঠুরিয়া নির্বিকার।

অন্ধকার হয়ে আসার পর কাঠকুটো জ্বেলে ঘরের মধ্যে একটা চমৎকার আগুন তৈরি করল কাঠুরিয়া। তারপর পল্টুকে বলল, “আমার বন্ধু একটা জরুরি কাজ সেরে আসতে গেছে। তোমাকে সে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারত, কিন্তু তার আর দরকার নেই। খবর পেয়েছি, পুলিশ এখানে আসছে। তারা এলে তুমি তাদের সঙ্গেই ফিরে যেতে পারবে।”

“আর আপনি?”

কাঠুরিয়া একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “আমার পালিয়ে যাওয়ার পথ আছে। কিন্তু পালিয়ে লাভ নেই।”

“কেন?”

“পালালে পুলিশের হাত এড়াতে পারব বটে, কিন্তু সেক্ষেত্রে পাহারার কাজেও ফাঁক পড়বে। দু নম্বর মুখোশধারী আমাকে বুদ্ধির খেলায় হারিয়ে দিয়েছে।”

“কেন, আমি পুলিশকে বলব যে, এ কাজ আপনার বন্ধু করেনি।”

কাঠুরিয়া মাথা নেড়ে বলল, “তোমার কথা তারা বিশ্বাস করবে। কারণ আমার ধারণা, মৃদঙ্গবাবুও সেই মুখোশধারীর পাল্লায় পড়েছিলেন। তিনি নিশ্চয়ই পুলিশকে জানিয়েছেন।”

“তাহলে উপায়?”

“কোনও উপায় দেখছি না। কয়েক ঘণ্টার জন্য পাহারার কাজে ফাঁক পড়বেই।”

হঠাৎ সুমন্তবাবু একটা হুংকার দিলেন, “না, পড়বে না।”

কাঠুরিয়া অবাক হয়ে তাঁর দিকে চেয়ে বলল, “তার মানে?”

“আমি পাহারা দেব। কী করতে হবে শুধু বলুন।”

কাঠুরিয়া একটু হাসল। বলল, “কাজটা খুব শক্ত, ভীষণ শক্ত। তাছাড়া আপনার বাড়ির লোকও তো আপনার জন্য ভাবছেন।”

সুমন্তবাবু ম্লান মুখে বললেন, “তা ভাবছে বটে। কিন্তু আমার বাড়ি ফেরার উপায় নেই। গয়েশের বাড়িতে আনঅথরাইজড অনুপ্রবেশের দরুন বজ্রাঙ্গ আমাকে ধরবেই। আমাদের বংশে কেউ কখনও পুলিশের খাতায় নাম লেখায়নি মশাই। তার চেয়ে বরং গুণ্ডা বদমাসদের সঙ্গে লড়াই করে জীবন বিসর্জন দেওয়াও শ্রেয়। না, আমিই পাহারা দেব। কী করতে হবে শুধু বলুন।”

পল্টুর বাড়ি ফেরার তাড়া নেই। সেও বলে উঠল, “আমিও বাড়ি ফিরব না। পাহারা দেব।”

কাঠুরিয়া চিন্তিতভাবে সুমন্তবাবুকে বলে, “আপনি আর পল্টু দুজনের কারওই এসব বিপজ্জনক কাজে অভিজ্ঞতা নেই। যদি শেষ অবধি আপনাদের কিছু হয়?”

সুমন্তবাবু খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা বৈঠক দিয়ে বুকডন মারতে মারতে বললেন, “মরার চেয়ে বেশি আর কী হবে মশাই?”

কাঠুরিয়া বলে, “মরলেই তো হবে না, কাজটাও উদ্ধার করা চাই।”

“কাজটার কথাই বলুন। আমাদের নিরাপত্তার কথা ভাবতে হবে না।”

কাঠুরিয়া জিজ্ঞেস করল, “আপনি মোটরবোট চালাতে পারেন?”

সুমন্তবাবু বললেন, “না, তবে নৌকো বাইতে পারি।”

“তাহলেও হবে। আপনি নদী আর ঝিলের মাঝখানকার খাঁড়িটা নিশ্চয়ই চেনেন!”

“খুব চিনি মশাই, এখানেই তো জীবনটা কাটল।”

কাঠুরিয়া বলল, “লোকটা ওই খাড়ি দিয়ে নদীতে গিয়ে পড়বে। নদীতে পড়লে তাকে ধরা মুশকিল হবে। সে বোধহয় খুবই ভাল নৌকো চালায়।”

“লোকটা যাবে কোথায়?”

“লোকটা নদীর স্রোতে পড়লে অনেকদূর অবধি ভাঁটিতে চলে যাবে। তারপর সম্ভবত কোনও মোটরলঞ্চ বা ছোট্ট স্টিমার তাকে তুলে নেবে।”

“আপনি তাহলে পুরো ষড়যন্ত্রটাই জানেন?”

“ঠিক জানি না। তবে আন্দাজ করছি। গয়েশবাবুকে খুন করার পিছনে উদ্দেশ্য একটাই। লোকজনকে বিভ্রান্ত করে দেওয়া। সকলের মনোযোগ এখন গয়েশবাবুর দিকে। আজ সারা রাত ধরে জেলেরা জলায় তাঁর লাশ খুঁজবে। সেই ফাঁকে একটা ছোট্ট নৌকো খাড়ি বেয়ে নদীতে পড়ল কিনা কে অত নজর রাখে! আর রাখবেই বা কেন? কিন্তু লোকটা জানে, আর কেউ নজর না রাখলেও আমরা রাখছি। তাই আমাদের সরিয়ে দেওয়ার চমৎকার একটা প্ল্যান করেছে সে। এখন শুধু নজর রাখছে কখন পুলিশ আমাদের ধরে নিয়ে যায়।”

সুমন্তবাবু হঠাৎ বললেন, “জলপথেই বা সে পালাবে কেন? স্থলপথও তো আছে। ট্রেনে উঠে যদি পালায়?”

“তাহলে তার লাভ নেই। জলপথে যত সহজে স্বদেশের সীমা ডিঙোনো যায় স্থলপথে তত নয়। তা ছাড়া স্থলপথে নজর রাখারও লোক আছে। কিন্তু সে সেদিক দিয়ে পালাবে না, নিশ্চিন্ত থাকুন। ওই খড়িটাই তার একমাত্র পথ। আমাদের একটা ডিঙি নৌকোও আছে। আপনি আর পটু সেটা নিয়ে খাঁড়ির মুখটা পাহারা দেবেন, পারবেন?”

“পারব। কিন্তু লোকটাকে চিনব কী করে?”

“সম্ভবত তার মুখে এবারও সিংহের মুখোশ থাকবে। যদি তা না থাকে তবে কী করবেন তা বলতে পারব না। তবে নজর রাখবেন। ওই বোধহয় পুলিশের নৌকো এল।”

বাস্তবিকই দূরে অনেক লোকের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল। জঙ্গল ভেঙে ভারী পায়ের এগিয়ে আসার শব্দও পাওয়া যাচ্ছে।

কাঠুরিয়া উঠে পড়ল। বলল, “ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা বাঁ দিকে এগিয়ে যান। দশ মিনিট হাঁটলেই খাঁড়ি।”

কাঠুরিয়া কুলুঙ্গি থেকে একটা টর্চ আর একটা বেতের লাঠি নামিয়ে সুমন্তবাবুকে দিয়ে বলল, “পল্টুকে দেখবেন।”

“ঠিক আছে। চলি।”

সুমন্তবাবু ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি-কি-মরি করে বাঁ দিকে হাঁটতে লাগলেন। সঙ্গে পল্টু। পিছনে পুলিশের তীব্র টর্চের আলো জঙ্গল ভেদ করে এদিকে-সেদিকে পড়ছে। দুজনে আরও জোরে হাঁটতে থাকে।

জঙ্গলের এবড়ো-খেবড়ো জমিতে টক্কর খেতে খেতে দুজনে খাঁড়ির ধারে পৌঁছে গেল। নদীতে ভরা জোয়ার। খাঁড়ি দিয়ে তীব্র স্রোত হুহুংকারে ঝিলের মধ্যে ঢুকছে। সেই স্রোতের ধাক্কায় মোচার খোলার মতো একটা ডিঙি নৌকো দোল খাচ্ছে তীরে। দুজনে নেমে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে ডিঙিটায় উঠে পড়ল।

“জয় দুগ! জয় দুর্গতিনাশিনী!” বলে একটা হুংকার ছাড়লেন সুমন্তবাবু।

পল্টু সতর্ক গলায় বলল, “কাকাবাবু! আস্তে। বজ্রাঙ্গবাবু শুনতে পেলে–”

সুমন্তবাবু ভয় খেয়ে তাড়াতাড়ি দু হাত জড়ো করে কপালে আর বুকে ঘন ঘন ঠেকাতে ঠেকাতে বিড়বিড় করে বললেন, “জয় বজরঙ্গবলী। জয় রাম। জয় অসুরদলনী।”

দুজনে চুপ করে বসে রইলেন নৌকোয়। কুয়াশা আজ বেশ পাতলা। তার ভিতর দিয়ে দূরে দূরে জেলে-নৌকোর বহু আলো দেখা যাচ্ছে। এখনও গয়েশবাবুর লাশের খোঁজ চলছে।

খাঁড়ির মুখ পাহারা দেওয়া এমনিতে শক্ত নয়। মাত্র পঞ্চাশ হাতের মতো চওড়া জায়গাটা। তবে এখন জোয়ারের সময় জলের তোড় কিছু বেশি। কোনও নৌকোকে নদীতে যেতে হলে বেশ কসরত করতে হবে। কিন্তু দুজনেই জানে, দুনম্বর মুখোশধারী নৌকো বাওয়ায় দারুণ ওস্তাদ লোক। এই স্রোত ঠেলে নৌকো নিয়ে নদীতে পড়তে তার বিশেষ অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া অন্ধকার মতো আছে, কুয়াশা আছে। মুখোশধারী নিশ্চিত আলো জ্বেলে আসবে না। কাজেই দুজনে খুব তীক্ষ্ণ চোখে নজর রাখতে লাগল।

প্রচণ্ড শীত। তার ওপর মাঝে মাঝে ডিঙির গায়ে ঢেউ ভেঙে জল ছিটকে আসছে গায়ে। সুমন্তবাবু আপাদমস্তক কম্বল দিয়ে জড়িয়ে নিয়েছেন। পল্টু খোলের মধ্যে খানিক সেঁধিয়ে হিহি করে কাঁপছে।

ধীরে ধীরে সময় কেটে যেতে লাগল। জোয়ারের স্রোতটাও যেন ধীরে ধীরে কমে এল একটু।

সুমন্তবাবু বললেন, “শীতে জমে গেলাম রে পল্টু! আয়, একটু গা গরম করি।”

“কী ভাবে কাকু?”

“নৌকো বেয়ে।” বলে সুমন্তবাবু পারে নেমে খুঁটি থেকে ডিঙির দড়িটা খুলে দিয়ে উঠে বৈঠা হাতে নিলেন।

নৌকো সুমন্তবাবু ভালই চালান। স্রোত ঠেলে দিব্যি বার দুই খাঁড়ির এপার ওপার হলেন। তারপর বললেন, “নাঃ; আজ আর হতভাগা আসবে না।”

হঠাৎ চাপাস্বরে পটু বলল, “আসছে।”

“বলিস কী?” বলেই সুমন্তবাবু বৈঠা রেখে নৌকোর মধ্যেই গোটা দুই বৈঠকি দিয়ে নিতে গেলেন। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নৌকোটা বোঁ বোঁ করে চরকির মতো দুটো পাক খেল।

“বাবা গো!” পল্টু ভয় খেয়ে চেঁচিয়ে উঠল।

সুমন্তবাবু চোখের পলকে আবার বৈঠা তুলে নৌকো সামাল দিয়ে বললেন, “কোথায় রে? কই?”

“আপনি সব গণ্ডগোল করে দিচ্ছেন কাকু। ওই তো দূরে। ওই যে!”

বাস্তবিকই কিছু দূরে একটা কালো বস্তুকে জলে ভেসে আসতে দেখা গেল।

সুমন্তবাবু সতর্ক গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “তোর গলা শুনেছে?”

পল্টু ফিস ফিস করে বলল, “কে জানে? তবে বাতাস উল্টোদিকে বইছে। নাও শুনতে পারে।”

“জয় মা।” বলে কপালে বারকয়েক হাত ঠেকালেন সুমন্তবাবু।

নৃসিংহ-অবতার নৌকোর ভেলকি দেখাতে পারে। অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছিল, ছোট্ট নৌকোটা তীরের মতো গতিতে ছুটে আসছে। খাঁড়ির স্রোত কমলেও যা আছে তাও বেশ তীব্র। সেই স্রোত ঠেলে ওরকম গতিতে চলা খুব সোজা কাজ নয়।

পল্টু বলল, “আসছে কাকু! এসে গেল।”

“ও বাবা! তাহলে আর দুটো বৈঠকি দিয়ে নেব নাকি?”

“সর্বনাশ! ও কাজও করবেন না। নৌকো বানচাল হয়ে যাবে।”

সুমন্তবাবু “জয় মা, জয় মা” বলে বিড়বিড় করতে লাগলেন। বিপরীত দিক থেকে নৌকোটা বিশ হাতের মধ্যে চলে এল। বৈঠার ছলাত ছলাত শব্দও পাওয়া যাচ্ছিল।

পল্টু জিজ্ঞেস করল, “কাকু, এবার কী করবেন?”

চিন্তিত সুমন্তবাবু বললেন, “তাই তো ভাবছি। একটা বন্দুক থাকলে–”

“যখন নেই তখনকার কথা ভাবুন।”

“লাঠিটা দে।”

“লাঠি দিয়ে নাগাল পাবেন না।”

“তাহলে তুই একটা বৈঠা জলে ডুবিয়ে নৌকোটা সামলে রাখ। আমি আর একটা বৈঠা দিয়ে ঘা কতক দিই লোকটাকে।”

“পারবেন?”

“জয় মা।” বলে সুমন্তবাবু বৈঠা নিয়ে খাড়া হলেন। কিন্তু পল্টুর অনভ্যস্ত হাতে নৌকোটা স্থির থাকছে না। টালমাটাল হয়ে যাচ্ছে। সুমন্তবাবু ঝড়াক করে খোলের মধ্যে পড়ে গেলেন। আবার উঠলেন।

তা করতে করতে নৌকোটা পাল্লার মধ্যে এসে পড়ল। কিন্তু নৃসিংহ-অবতার খুবই বুদ্ধিমান। একটা নৌকো যে খাঁড়ির মুখ আগলাচ্ছে তা লক্ষ করেই আচমকা নিজের নৌকোটাকে চোখের পলকে দশ হাত তফাতে নিয়ে ফেলল সে। তারপর নদীর দিকে প্রাণপণে এগোতে লাগল।

সুমন্তবাবু বুঝলেন, সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে। পল্টুর হাত থেকে বৈঠাটা টেনে নিয়ে তিনি দু হাতে প্রাণপণে বাইতে লাগলেন। টপটপ করে ঘাম ঝরতে লাগল তার এই শীতেও। ফিসফিস করে বললেন, “হ্যাঁ, একেই বলে একসারসাইজ! এই হল একসারসাইজ!”

নৃসিংহ-অবতারের নৌকোটার কাছাকাছি এগিয়ে গেল সুমন্তবাবুদের ডিঙি। এই জায়গায় জলের স্রোত এখনও ভীষণ। দুটো ডিঙির কোনওটাই তেমন এগোতে পারছে না। তবু তার মধ্যেই নৃসিংহ-অবতারের ডিঙি কয়েক হাত এগিয়ে যেতে পেরেছে এবং আরও এগিয়ে যাচ্ছে!

সুমন্তবাবু চেঁচালেন, “খবরদার! থামো বলছি! নইলে গুঁড়িয়ে দেব!”

নৃসিংহ-অবতার কোনও জবাব দিল না। কিন্তু দু হাতে চমৎকার বৈঠা মেরে নৌকোটাকে প্রায় নাগালের বাইরে নিয়ে ফেলল।

“তবে রে?” বলে সুমন্তবাবু দুই হাতে প্রায় ঝড় তুলে ফেললেন বৈঠার ঘায়ে। ছোট্ট ডিঙিটা ঢেউয়ের ওপর দিয়ে দুটো লাফ মেরে ব্যাংবাজির মতো ছিটকে নৃসিংহ-অবতারের নৌকোকে ছুঁয়ে ফেলল। সুমন্তবাবু সঙ্গে সঙ্গে একটা বৈঠা তুলে দড়াম করে বসালেন গলুইয়ে বসা লোকটার মাথায়।

কিন্তু কোথায় মাথা। চতুর লোকটা চোখের পলকে নৌকোটাকে একটা চরকিবাজি খাইয়ে ঘুরিয়ে নিয়েছে। বৈঠা লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় সুমন্তবাবু টাল সামলাতে না পেরে গুপুস করে জলে গিয়ে পড়লেন।

পটু নিজের বিপদ আন্দাজ করে আগে থেকেই তৈরি ছিল। সুমন্তবাবুর সঙ্গে নৌকোয় চড়া যে কতটা বিপজ্জনক, তা সে অনেকক্ষণ আগেই বুঝে গেছে। সুতরাং নৃসিংহের নৌকোর গলুইতে তাদের গলুই ঠেকতেই সে টুক করে ওই নৌকোয় লাফিয়ে চলে গেছে। নৃসিংহ তখন নৌকো সামলাতে ব্যস্ত। তাই দেখেও তেমন কিছু করতে পারল না।

পল্টু দেখল, তাদের ডিঙিটা স্রোতের মুখে নক্ষত্ৰবেগে ওলটপালট খেতে খেতে ভেসে যাচ্ছে। তবে সুমন্তবাবু বীর-বিক্রমে সাঁতার দিয়ে আসছেন।

মুখে সিংহের মুখোশ পরা লোটা একটা বৈঠা তুলল। সুমন্তবাবুর মাথাটাই তার লক্ষ্য সন্দেহ নেই। পল্টু আর দেরি করল না। একটা ডাইভ দিয়ে সে সোজা নৃসিংহের কোলে গিয়ে পড়ল। তারপর দুই হাতে চালাতে লাগল দমাদম ঘুষি।

কিন্তু পল্টুর ঘুষিতে কাবু হওয়ার লোক নৃসিংহ নয়। হাতের এক ঝটকায় পল্টুকে ছিটকে ফেলে লোকটা আবার বৈঠা তুলে চোখের পলকে সুমন্তবাবুর মাথা লক্ষ করে চালাল। কিন্তু সুমন্তবাবু এবার খুব বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে টুক করে ডুব দিলেন।

নৃসিংহের নৌকোটা বৈঠার সাহায্য না পেয়ে স্রোতের মুখে একটু পিছিয়ে গেল। আর পটুও ফের উঠে ঝাঁপিয়ে পড়ল নৃসিংহের ওপর। দুহাতে সে লোকটার গলা খামচে ধরল।

নৃসিংহ ভারী জ্বালাতন হয়ে বলে উঠল, “উঃ! ছাড়ো, ছাড়ো!”

নৌকোটা ফের একটা চক্কর মারল। আর ততক্ষণে গলুই ধরে সুমন্তবাবু ঝপাত করে নৌকোয় উঠে পড়লেন।

নৌকোটা পুরো বেসামাল হয়ে পিছন দিকে দৌড়োতে থাকে।

কিন্তু সেদিকে দৃকপাত না করে সুমন্তবাবু পল্টুকে সরিয়ে নিজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন লোকটার ওপর। রাগে তাঁর গা রি-রি করছে। বৈঠাটা মাথায় লাগলে এতক্ষণে তাঁর সলিল-সমাধি হয়ে যেত। তার ওপর এই লোকটাই তাঁকে আজ সাপ আর কুমিরের মুখে ছেড়ে দিয়ে এসেছিল। এবং সম্ভবত এই লোকটাই গয়েশের খুনী।

সব রাগ গিয়ে লোকটার ওপর পড়ায় সুমন্তবাবুর ঘুষির জোর গেল বেড়ে। তাঁর দু-দুখানা হাতুড়ির মতো ঘুষি খেয়ে লোকটা নেতিয়ে পড়ল গলুইতে।

গোলমতো একটু চাঁদ উঠেছে আকাশে। নৌকোটা চক্কর খেতে খেতে আর পিছিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ ধারের কাছে অগভীর জলে বালির মধ্যে ঘষটে থেমে গেল।

হাঃ হাঃ করে টারজানের মতো কোমরে হাত দিয়ে বিজয়ীর হাসি হাসলেন সুমন্তবাবু। ভেজা খালি গা, কিন্তু যুদ্ধজয়ের আনন্দে তাঁর শীতবোধ লুপ্ত হয়ে গেছে।

খানিকক্ষণ হেসে নিয়ে তিনি পল্টুর দিকে চেয়ে বললেন, “তুই ঠিক আছিস তো পল্টু?”

পল্টু সুমন্তবাবুর ধাক্কায় পড়ে গিয়ে কনুইতে বেশ ব্যথা পেয়েছে। তবু চিচি করে বলল, “আছি।”

“আয় এবার লোকটার মুখোশ খুলে দেখি ঘুঘুটি কে।”

এই বলে সুমন্তবাবু নিচু হয়ে নৃসিংহের মুখোশটা এক টানে খুলে ফেললেন।

তারপরেই হঠাৎ তারস্বরে “ভূত! ভূত! ভূত!” বলে চেঁচাতে চেঁচাতে এক লাফে জলে নেমে দৌড়োতে দৌড়োতে সুমন্তবাবু ডাঙায় উঠেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।

পল্টুও মুখোনা দেখতে পেয়েছিল। “বাবা গো” বলে আর্তনাদ করে সেও চোখ বুজে ফেলল।

আর ঠিক এইসময়ে ভুটভুট আওয়াজ করতে করতে একটা মোটরবোট তীব্র বেগে এগিয়ে আসতে লাগল তাদের দিকে। সন্ধানী আলো এসে পড়ল পল্টুর চোখে-মুখে।

১০.

সেই খোড়ো ঘরটায় আবার আগুন জ্বেলেছে কাঠুরিয়া। এবার আগুনের চারধারে গোল হয়ে বসেছে অনেকগুলো লোক। বিনয়, সুমন্তবাবু, বজ্রাঙ্গ, পল্টু, মৃদঙ্গবাবু, সান্টু, মঙ্গল, পরেশ, কবি সদানন্দ এবং কয়েকজন সেপাই। অপরাধীকে নিয়ে কয়েকজন সেপাই ইতিমধ্যেই রওনা হয়ে গেছে মোটরবোটে। দ্বিতীয় খেপে এঁরা সবাই যে যাঁর বাড়ি ফিরে যাবেন।

কাঠুরিয়া বলছিল, “জ্যান্ত লোক কি কখনও ভূত হয় সুমন্তবাবু?”

“তা বলে লোকটা যে গয়েশ তা কী করে বুঝব?”

কাঠুরিয়া একটু হেসে বলল, “লোকটা যে গয়েশ তা আমরা অনেকদিন ধরেই জানি। কিন্তু এই অতি বুদ্ধিমান লোকটির বিরুদ্ধে কিছুই প্রমাণ করা যায়নি এতদিন। অথচ ভারতবর্ষের বিভিন্ন দামি পুরাকীর্তি ইনি অনেকদিন ধরেই বাইরে চালান দিয়ে আসছেন। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা, পাঞ্জাব থেকে আসাম অবধি এঁর কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত ছিল। ইদানীং হঠাৎ একদিন টের পেলেন, এ ব্যবসা বেশিদিন চালানো অসম্ভব। অনেক এজেন্ট, অনেক লোকের কাছে পরিচয় ফাঁস হয়ে গেছে। এরা যে-কেউ একদিন মুখ খুলবে। ব্যবসা চালানোর আর প্রয়োজনও ছিল না। লক্ষ লক্ষ টাকা হাতে এসে গেছে। তাই শেষ দাঁটি মেরেই ব্যবসা গুটিয়ে পালিয়ে এলেন নিজের শহরে। কিন্তু এই শেষ দাঁটিই ছিল মারাত্মক। বিজাপুরের বিষ্ণুমূর্তি। খাঁটি সোনার ওপর নানা দামি পাথর বসানো বলে এর দাম বহু লক্ষ টাকা। কিন্তু পুরাকীর্তি হিসেবে এর আন্তর্জাতিক বাজারে দাম দশ লক্ষ ডলারের কাছাকাছি। গয়েশবাবু এই অত্যধিক দামি জিনিসটা না পারছিলেন হজম করতে, না ওগরাতে। আমাদের লোক ওঁর পিছু নিয়েছিল। তিনি তাও টের পেয়েছিলেন। এদিকে বিদেশে চিঠি লেখালিখি করে একজন ভাল খদ্দেরও পেয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু জিনিসটা হস্তান্তর করতে পারছিলেন না। একমাত্র উপায় হচ্ছে জলপথ। গয়েশবাবু নিজের বাড়ির পিছনের জলায় নিয়মিত নৌকো বাইতেন এবং অঞ্চলটা ঘুরে ঘুরে মাল পাচার করবার নিরাপদ পথটা আবিষ্কার করতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ততদিনে আমি আর বিনয় এই জঙ্গলে থানা গেড়ে ফেলেছি। সিংহের মুখোশ পরা বিনয়কে গয়েশবাবু বহুবার মোটরবোটে ওঁর পিছু নিতে দেখেছেন। আমরা ওঁকে ভড়কে দেওয়ার জন্যই বেশি আত্মগোপন করতাম না। ভড়কালেই সুবিধে। মানুষ ঘাবড়ে গেলে নানারকম ভুলভ্রান্তি করে।

“উনি অবশ্য কাঁচা অপরাধী নন। অনেক ভেবেচিন্তে প্ল্যান করলেন। বিদেশের খদ্দেরকে চিঠি লিখে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করলেন। লোকটা ওই নদীতে খুব দ্রুতগামী মোটরলঞ্চ রাখবে। ও ব্যাপারে সবুজ সংকেত পাওয়ার পর নির্ধারিত দিনটিতে প্রথমে নিজে গায়েব হয়ে সকলকে সচকিত করে তুললেন। আর সেই গোলমালে সবাই যখন একদিকে তাকিয়ে আছে, তখন উনি অন্য দিকে কাজ সারতে চাইলেন। গায়েব হওয়ার রাত্রেই পল্টুর কাছে বিষ্ণুমূর্তিটা গচ্ছিত রেখে আসেন। পরদিন পল্টুকে গুম করার পর যখন তার বাড়ির লোক থানাপুলিশ করে বেড়াচ্ছে, আর ঝিলের জলে খোঁজা হচ্ছে পল্টুর দেহ, তখন তার বাড়ি থেকে বিষ্ণুমূর্তি সরিয়ে নিলেন। তার পরের ইতিহাস তো আপনাদের জানা।

“কিন্তু আমাদের কৃতিত্ব সামান্যই। গয়েশবাবুকে বমাল ধরার জন্য সব কৃতিত্ব প্রাপ্য সুমন্তবাবুর আর পল্টুর।”

সুমন্তবাবু বললেন, “কী যে বলেন! গয়েশকে কাবু করতে দুটো ঘুষি চালাতে হয়েছে সেটাই তো লজ্জার কথা। একটা ঘুষিতেই কাত হওয়া উচিত ছিল। নাঃ, কাল থেকে আরও ব্যায়াম, আরও ব্যায়াম…”

বিমর্ষ মৃদঙ্গবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “সবই হল, কিন্তু আসল জিনিসটাই মাঠে মারা গেল যে।”

কাঠুরিয়া বলল, “কী সেটা?”

“গয়েশবাবুর লেজ নেই।”

সবাই হেসে উঠল। দূরে নিশুত রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে ভুটভুট করে একটা মোটরবোটের শব্দ এগিয়ে আসতে লাগল। গয়েশবাবুর নৌকোর পাটাতনের তলা থেকে উদ্ধার করা বিষ্ণুমূর্তিটা তক্তাপোশের ওপর রাখা। আগুনের আভায় ঝকমক করছে। যেন বিষ্ণু হাসছেন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9
Pages ( 9 of 9 ): « পূর্ববর্তী1 ... 78 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress