পল্টু ধীরে ধীরে চোখ খুলল
পল্টু ধীরে ধীরে চোখ খুলল। মাথার পিছন দিকে প্রচণ্ড যন্ত্রণা, শরীরটা ভারী কাহিল। চোখ খুলে সে চারদিকে চেয়ে যা দেখল, তা মোটেই খুশি হওয়ার মতো নয়। পিছনে জঙ্গল, সামনে জল। দুপুর পেরিয়ে সূর্য একটু হেলেছে। বাড়ি ফেরার কোনও উপায় নেই।
নিজের অবস্থাটা বুঝবার একটু চেষ্টা করল পল্টু। ধীরে ধীরে উঠে বসল। যে লোকটা তাকে এখানে এনে মাথায় মেরে অজ্ঞান করে ফেলে রেখে গেছে, সে খুবই বুদ্ধিমান। পল্টুকে সে ইচ্ছে করেই খুন করেনি। কারণ জানে, এই নির্জন জনমানবশূন্য জায়গায় পড়ে থেকে না-খেতে পেয়েই সে মরবে। নইলে বুনন জন্তু-জানোয়ার বা সাপখোপ তো আছেই।
মাথাটা ঝন ঝন করছে বটে, তবু পল্টু উঠে ধীরে-ধীরে জলের কাছে নেমে এসে প্রথমে ব্যথার জায়গাটায় ঠাণ্ডা জল চাপড়াল। মুখে চোখে জলের ঝাঁপটা দিল। খানিকটা খেয়েও নিল।
একটু সুস্থ ও স্বাভাবিক বোধ করার পর সে আস্তে আস্তে জঙ্গলের দিকে হাঁটতে লাগল। লোকটা বলেছিল ওই জঙ্গলের মধ্যেই পালের গোদাটি আছে। পল্টুকে সে-ই আনিয়েছে এখানে। কিন্তু কথাটা পল্টুর এখন বিশ্বাস হচ্ছিল না।
জঙ্গল-টঙ্গল দেখে তার অভ্যাস নেই। তবু যদি বাঁচতে হয় তবে এই জঙ্গলই এখন একমাত্র ভরসা। যদি কিছু ফল-টল পাওয়া যায় তো খেয়ে বাঁচবে। আর যদি কাঠ-কাঠ দিয়ে একটা ভেলাটেলা বানানো যায় তো জলাটা পেয়োনো যাবে। যদিও দ্বিতীয় প্রস্তাবটা তার সম্ভব বলে মনে হচ্ছিল না।
জঙ্গলে ঢোকার এমনিতে কোনও রাস্তা নেই। কিন্তু খুঁজতে খুঁজতে পল্টু একটা সরু শুড়িপথ দেখতে পেল। আগাছার মধ্যে যেন একটা ফোকর। নিচু হয়ে ঢুকতে হয়। সামনেটা যেন আধো অন্ধকার একটা টানেল।
পল্টু সাহস করে ঢুকল, এবং হাতড়ে হাতড়ে এগোতে লাগল। জঙ্গলের মধ্যে নানারকম অদ্ভুত শব্দ। কখনও অদ্ভুত গলায় কোনও পাখি ডেকে ওঠে, পোকামাকড় ঝি ঝি বোঁ বোঁ কটরমটর নানারকম আওয়াজ দেয়। মাঝে মাঝে পায়ের তলা দিয়ে সাঁত করে যেন কী সরে যায়।
খানিকটা এগোনোর পর হঠাৎ জঙ্গলটা একটু ফাঁকা ফাঁকা মনে হল। সে চারধারে চেয়ে দেখল, অনেকগুলো বড় বড় গাছ কাটা হয়েছে। চারদিকে গাছের গুঁড়ি আর কাঠের টুকরো ছড়িয়ে আছে। পল্টুর বুক আনন্দে কেঁপে ওঠে। এখানে কাঠুরিয়ারা আসে।
জায়গাটা পেরিয়ে আবার এগোয় পল্টু। আচমকাই তার চোখে পড়ে চমৎকার একটা পেয়ারা গাছ। ফলে কেঁপে আছে। সে কলকাতার ছেলে, গাছ বাইতে শেখেনি। কিন্তু এ গাছটা বেশ নিচু এবং ফলগুলো হাত বাড়িয়েই পাড়া যায়।
গোটাকয়েক পেয়ারা খেয়ে পল্টুর গায়ে আবার জোর বল ফিরে এল। চারদিকে তাকিয়ে জঙ্গলটা দেখছিল সে। তেমন ভয়ংকর মনে হচ্ছে না আর জায়গাটাকে। সে জায়গাটা একটু ঘুরে দেখল। মনে হচ্ছিল, এ-জায়গাটা একটু অন্যরকম। চারদিকে ভাঙা ইট পড়ে আছে। একটা পুরনো পাথুরে ফোয়ারা কাত হয়ে পড়ে আছে। এখানে নিশ্চয়ই কারও বাড়িঘর ছিল।
পায়ে পায়ে আর-একটু এগোতেই পল্টু দেখতে পেল বাড়িটা। ঠিক বাড়ি নয়, ধ্বংসস্তৃপ। তবে কয়েকটা খিলান খাড়া আছে এখনও। ধ্বংসস্তৃপটার পাশেই একটা খোছড়া ঘর দেখে পল্টু অবাক হয়ে গেল। এখানে কি কেউ থাকে? কিন্তু কে? সেই পালের গোদা লোকটা নয় তো?
ঘরটা দেখে একই সঙ্গে পল্টু আকর্ষণ ও বিকর্ষণ বোধ করতে থাকে। শেষ অবধি আকর্ষণই জয়ী হয়। দেখাই যাক না।
খোড়ো ঘরটার দরজা নতুন কাঁচা কাঠের তৈরি। কোনও হুড়কো-টুড়কো নেই। ঠেলতেই খুলে গেল। ভিতরটা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। একধারে দুটো কুড়ল বেড়ার গায়ে দাঁড় করানো। অন্য ধারে তক্তা দিয়ে বানানো একটা চৌকির মতো জিনিস। তাতে একটা মাদুর পাতা। ঘরে কেউ থাকে বা বিশ্রাম নেয়। কিন্তু এখন সে নেই।
পল্টু কুড়ল দুটোর একটা হাতে তুলে নিয়ে একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখল, মনে হয়, ঘরে যে থাকে সে কাঠুরিয়াই। তবে আত্মরক্ষার জন্য হাতের কাছে কুড়লটা রাখা ভাল।
তক্তপোশটার ওপর বসে পল্টু পকেট থেকে আর একটা পেয়ারা বার করে খেতে লাগল।
কোথাও কোনও শব্দ হয়নি! আচমকাই দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল।
পল্টু চিৎকার করার জন্য হাঁ করেছিল। কিন্তু শব্দ বেরোল। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে একটা দৈত্য বিশেষ। তালগাছের মতো ঢ্যাঙা, বিপুল স্বাস্থ্য, দুই ঘন ভূর নীচে কঠিন একজোড়া চোখ।
কয়েকটা মুহূর্তকে যেন কত যুগ বলে মনে হচ্ছিল পল্টুর কাছে।
হঠাৎ লোকটা খুব নরম ভদ্র গলায় বলল, “ভয় পেও না। তুমি কে?”
পল্টু শ্বাস ছেড়ে কাঁপা গলায় বলল, “আমি পল্টু।”
“শহরে থাকো?”
“হ্যাঁ।”
“কার বাড়ি?”
“পরেশ রায় আমার মামা।”
লোকটা বুঝদারের মতো মাথা নাড়ল। গায়ে একটা হাতকাটা জামা, পরনে ধুতি, পায়ে টায়ার কেটে বানানো চপ্পল। লোকটার দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে রইল পল্টু।
লোকটা হাতের টাঙ্গি গোছের জিনিসটা বেড়ার গায়ে দাঁড় করিয়ে রেখে বলল, “এখানে এলে কী করে? নৌকোয়?”
“আমি ইচ্ছে করে আসিনি। একটা মুখোশধারী লোক আমাকে এখানে এনে ছেড়ে দিয়ে গেছে।”
লোকটা অবাক হয়ে বলল, “ঘটনাটা কি আমায় খুলে বলবে?”
পল্টুর ভয় কেটেছে একটু। লোকটার চেহারা যেমন, স্বভাব হয়তো তেমন খারাপ নয়। সে ধীরে ধীরে বলতে লাগল।
আগাগোড়া দরজার গায়ে একটা খুঁটিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে গম্ভীর মুখে লোকটা সব শুনল। কোনও কথা বলল না। পল্টুর গল্প শেষ হওয়ার পর মিনিট দুয়েক চুপ করে কী ভেবে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “গয়েশবাবুর সঙ্গে আগের রাতে কি সত্যিই তোমার দেখা হয়েছিল?”
পল্টু মাথা নেড়ে বলল, “হয়েছিল। উনি আমার কাছে এসেছিলেন।”
ভ্রু কুঁচকে লোকটা জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
“একটা জিনিস আমাকে রাখতে দিতে এসেছিলেন।”
“জিনিসটা কী?”
“কাগজে জড়ানো একটা প্যাকেট। আমি দোতলার ঘরে থাকি। মাঝরাতে আমার জানালায় ঢিল পড়ে। আমি জানালা খুলে দেখি, নীচে উনি দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে হাতছানি দিয়ে নীচে ডাকলেন। আমি নীচে গিয়ে দরজা খুলতেই উনি প্যাকেটটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘খুব সাবধানে এটা তোমার কাছে লুকিয়ে রেখো। আমি ক’দিন পরে এসে নিয়ে যাব।”
“তুমি প্যাকেটটা খুলেছিলে?”
“না। গয়েশবাবুর সঙ্গে আমার খুব ভাব ছিল। উনি আমাকে বিশ্বাস করতেন।”
লোকটা আবার একটু ভেবে নিয়ে বলল, “প্যাকেটটা কি খুব ভারী?”
“খুব। সিঁড়ি দিয়ে ওটা নিয়ে উঠবার সময় আমার ভীষণ কষ্ট হয়েছে।”
লোকটা আবার মাথা নাড়ল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
পল্টু কাঠুরিয়া কখনও দেখেনি ঠিকই, কিন্তু এই লোকটার হাবভাব পেঁয়ো বা অশিক্ষিত লোকের মতো যে নয়, তা সে স্পষ্টই বুঝতে পারছিল। তাই ফশ করে সে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কে?”
“আমি কাঠুরিয়া।”
“কিন্তু আপনাকে দেখে কাঠুরিয়া বলে মনে হয় না।”
লোকটা একটু হাসল। বলল, “যে কাঠ কাটে তাকে তো কাঠুরিয়াই বলে।”
পল্টুর সন্দেহ গেল না। তবে সে কথাও আর বাড়াল না।
লোকটা কী যেন ভাবছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ আপনমনে বলল, “ব্যাপারটা বড্ড জট পাকিয়ে গেছে।”
“কোন ব্যাপারটা?”
“তুমি যে ব্যাপারটার কথা বললে।”
“আমি কি বাড়ি ফিরে যেতে পারব আজ?”
লোকটা কী যেন ভাবছে। ভাবতে ভাবতেই বলে, “পারবে। এ জায়গাটা এমন কিছু দুর্গম নয়। প্রায়ই লোকজন যাতায়াত করে। কাঠুরিয়া আসে, মউলিরা আসে, জেলেরা আসে।”
“আপনি কি এখানেই থাকেন?”
“মাঝে-মাঝে থাকতে হয়।”
“ভয় করে না?”
“না। ভয় কিসের? জঙ্গলে যেমন বিপদ আছে, শহরেও তেমনি আছে। বরং বেশিই আছে।”
“আপনি কি শুধু কাঠই কাটেন? আর কিছু করেন না?”
“করি। আমাকে চারধারে নজর রাখতে হয়।”
“তার মানে?”
লোকটা কথাটার জবাব দিল না। আবার ভাবতে লাগল। মুখোনা খুব গম্ভীর।
দূরে একটা ঘুঘু পাখি ডাকছিল। লোকটা হঠাৎ উৎকর্ণ হয়ে শব্দটা শুনে নিয়ে পল্টুর দিকে চেয়ে বলল, “আমি একটু আসছি। তুমি কোথাও যেও না।”
“আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
“একটা ঘুঘু ডাকছে। ঘুঘুটা আমার পোষা। কেন ডাকছে। দেখে আসি।”
লোকটা বেরিয়ে গেল। নিঃশব্দে।
পল্টু এক সেকেন্ড অপেক্ষা করেই লাফ দিয়ে উঠে ছুটে গেল দরজায়। পাল্লাটা একটু ফাঁক করে দেখল, লোকটা ধ্বংসস্তৃপটা পার হয়ে লম্বা পায়ে হেঁটে যাচ্ছে।
পল্টু বুঝতে পারছিল না, লোকটা কে বা কেমন। তবে এ যে কাঠুরিয়া নয় সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। মুখোশধারী বলেছিল তাদের সর্দার এই দ্বীপে থাকে। এই লোকটা সত্যিই সেই সর্দার নয় তো! ব্যাপারটা জানা দরকার।
পল্টু গাছের আড়াল-আবডাল দিয়ে লোকটার পিছনে চলতে লাগল। কিন্তু লোকটা জঙ্গলে চলাফেরায় অভ্যস্ত। পল্টু নয়। উপরন্তু তাকে গা ঢাকা দিয়ে চলতে হচ্ছে। বারবার লোকটাকে হারিয়ে ফেলছিল পল্টু। তবে বেশিদূর যেতে হল না। মিনিট দুয়েক হাঁটার পরেই পল্টু দেখল সামনেই খাঁড়ি। দৈত্যের মতো লোকটা একটা গাছের ধারে থেমেছে। খাঁড়িতে একটা সবুজ রঙের ছোট্ট মোটরবোট থেকে একজন লোক ডাঙায় নেমে লোকটার দিকে উঠে আসছে।
লোকটার মুখ দেখে পল্টুর বুকের মধ্যে রেলগাড়ির পোল পার হওয়ার মতো গুম গুম শব্দ হতে লাগল। চোখের পলক পড়ল না। লোকটার মুখে সিংহের মুখোশ।
পল্টুর ভিতর থেকে আপনাআপনিই একটা আতঙ্কের চিৎকার উঠে আসছিল। মুখে হাতচাপা দিয়ে সে চিৎকারটাকে আটকাল। একটা বড় গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সে দেখল, মুখোশধারী কাঠুরিয়ার সঙ্গে কী যেন কথা বলছে।
খুব সামান্যক্ষণই কথা বলল তারা। মুখোশধারী আবার মোটরবোটে ফিরে গেল। তারপর বোটের মুখ ঘুরিয়ে জল কেটে চলে গেল কোথায়। বোটটার মোটরে খুব সামান্য একটু শব্দ হচ্ছিল। বোধহয় খুবই দামি মোটরবোট।
কাঠুরিয়া কয়েক সেকেন্ড মোটরবোটটার গমনপথের দিকে চেয়ে থেকে আস্তে আস্তে ফিরে আসতে লাগল।
আর এবারই হঠাৎ ভয় পেল পল্টু। দারুণ ভয়। সে বুঝতে পারল, তার বিপদ ঘনিয়ে আসছে। সে মুখ ঘুরিয়ে দিগবিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়োতে লাগল। কোথায় যাচ্ছে জানে না। কী হবে জানে না। শুধু মনে হচ্ছে, পালানো দরকার। এক্ষুনি পালানো দরকার।
কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে দৌড়োনো সহজ নয়। পদে পদে অজস্র বাধা, কাঁটাগাছ, লতা, ঝোঁপঝাড়, কী নেই। বার দুই পড়ে গেল পল্টু।
পিছন থেকে একটা হেঁড়ে গলার হাঁক শোনা গেল হঠাৎ, “পল্টু! পল্টু! পালিও না। ভয় নেই।”
পল্টু আরও আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে দৌড়োতে গিয়ে দিক হারিয়ে ফেলল। হঠাৎ দেখল সামনে তার পথ আটকে সেই কাঠুরিয়া দাঁড়িয়ে।
পল্টুর গলা দিয়ে স্বর বেরোল না। নিষ্পলক আতঙ্কিত চোখে চেয়ে রইল লোকটার দিকে।
কাঠুরিয়া একটা হাত বাড়িয়ে বলল, “অত ভয় পেলে কেন? মুখোশধারীকে দেখে? ওকে ভয়ের কিছু নেই। যে তোমাকে এখানে এনেছে, সে ও লোকটা নয়।”
“তাহলে ও কে?”
“ও আমার বন্ধু। এসো, কিছু ভয়ের নেই।”
“আমি যাব না।”
লোকটা হেসে ফেলল। সরল হাসি। বলল, “তোমার মতো ছোট্ট একটু ছেলেকে ইচ্ছে করলেই তো আমি মেরে ফেলতে পারি, যদি আমার সেই মতলব থাকে। তাই না? তবু যখন মারছি
তখন নিশ্চয়ই আমার সে মতলব নেই।”
“তাহলে?”
“তাহলে কিছু নয়। আমার সঙ্গে এসো, সব বলছি।”
পল্টু লোকটার হাত ধরল। লোকটা পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে যেতে তাকে বলল, “এই দ্বীপটার একধারে নদী, অন্যধারে বড় ঝিল। নদী থেকে ঝিলে ঢুকবার পথ আছে। আমি এখানে সেই পথটা পাহারা দিই।”
“কেন?”
“লক্ষ করি কারা ওই পথে যাতায়াত করে।”
“আর ওই মোটরবোটের লোকটা?”
“ও লোকটাও পাহারা দেয়। সারাক্ষণ তো একজনের পক্ষে পাহারা দেওয়া সম্ভব নয়। ও আমাকে সাহায্য করে।”
“আপনি তাহলে কাঠুরিয়া নন?”
“কাঠুরিয়াও বটে। তবে শুধু কাঠুরিয়া নই।”
“আপনি কি পুলিশের লোক?”
“অনেকটা তাই।”
“পাহারা দেন কেন?”
“কিছু দুষ্টু লোক এই পথ দিয়ে আনাগোনা করে।”
“ওই মুখোশওলা লোকটা কি সত্যিই আমাকে এখানে আনেনি?”
“না। ও তোমাকে চেনেও না। তবে যে তোমাকে এখানে এনেছে সে খুব চালাক লোক।”
“কেন?”
“সে জানে যে, তুমি মরবে না। শহরে ফিরেও যাবে। গিয়ে বলবে যে, একজন সিংহের মুখোশ-পরা লোক তোমাকে চুরি করে এনেছিল। তখন দোষটা গিয়ে পড়বে আমার ওই বন্ধুটির কাঁধে। কারণ এই অঞ্চলে যে-সব কাঠুরিয়া, জেলে আর মউলি যাতায়াত করে তারা সবাই আমাকে আর আমার বন্ধুকে চেনে, তারা জানে আমার বন্ধু একটা মুখোশ পরে ঘুরে বেড়ায়।”
“আপনার বন্ধু মুখোশ পরে কেন?”
“এমনিতে কোনও দরকার নেই। খানিকটা শখ বলতে পারো। আর একটা উদ্দেশ্য হল, যেসব দুষ্ট লোক এখান দিয়ে আনাগোনা করে তারা যাতে ওকে চিনে না রাখতে পারে।”
“কিন্তু মুখোশ দেখলে তো লোকের সন্দেহ আরও বাড়বে।”
কাঠুরিয়া খুব হেঃ হেঃ করে হেসে উঠল। বলল, “বাঃ! তোমার তো খুব বুদ্ধি! কথাটা ঠিক বলেছ। তবে আমার ওই বন্ধুটির মুখটা দেখতে বিশেষ ভাল নয়। ছেলেবেলায় আগুনে পুড়ে মুখটা একটু বীভৎস হয়ে গেছে। ফলে ও মুখোশ ছাড়া বেরোতে চায় না। ওর অবশ্য নানারকম মুখোশ আছে। তবে সিংহের মুখোশটাই ও সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে।”
তারা খোড়ো ঘরটার কাছে পৌঁছে গেল হাঁটতে হাঁটতে।
কাঠুরিয়া ঘরে ঢুকে বলল, “চুপচাপ বসে বিশ্রাম নাও। আমার বন্ধুটি ফিরে এলে তোমাকে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা হবে।”
“আপনার বন্ধু কোথায় গেল?”
“একজন জেলে আমার বন্ধুকে খবর দিয়েছে, সিংহের মুখোশ-পরা একটা তোক একটা নৌকোয় করে জলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটু আগেও তাকে দেখা গেছে পশ্চিম ধারের একটা দ্বীপের কাছে। আমাদের মনে হয়, লোকটা ওখানেই কোনও কীর্তি করে এসেছে। আমার বন্ধু সেখানে গেল দেখে আসতে।”
“তাহলে মুখোশধারী দু নম্বর লোকটা কে?”
“সে নিশ্চয়ই আমাদের বন্ধু নয়।”
“আপনি তাকে চেনেন না?”
“কী করে চিনব? তবে আমার ধারণা, লোকটা খুব অচেনাও নয়।”
“সে এসব করছে কেন?”
“বললাম যে, সে আমাদের বিপদে ফেলতে চায়। পুলিশ যখনই খবর পাবে যে, একজন মুখোশধারী একটা বাচ্চা ছেলেকে গুম করে এখানে এনে ফেলে রেখে গিয়েছিল, তখনই খোঁজখবর এবং তল্লাশ শুরু হবে। আমাদের হদিস পেতে পুলিশের মোটেই দেরি হবে না। তারা এসে আমাদের ধরে নিয়ে যাবে।”
“কিন্তু আপনারাও তো পুলিশের লোক!”
“তা অনেকটা বটে। কিন্তু আমরা সাধারণ পুলিশ নই। আমাদের কাছে আইডেনটিটি কার্ড বা কোনও প্রমাণপত্র থাকে না। কাজেই ধরতে এলে প্রমাণ করতে পারব না যে, আমরা অপরাধী নই।”
“তাহলে কী হবে? আপনাদের জেল হবে?”
কাঠুরিয়া হেসে মাথা নেড়ে বলল, “তা অবশ্য হবে না। ধরা পড়ার পর আমরা আমাদের হেড কোয়ার্টারে ব্যাপারটা জানাব। সেখান থেকে আমাদের আইডেনটিফাই করা হলে পুলিশ আমাদের ছেড়েও দেবে। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার তা হয়ে যাবে।”
“কী হবে?”
“মুখোশধারী কিছুক্ষণের জন্য আমাদের এখান থেকে সরাতে চাইছে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্যও যদি আমাদের এখান থেকে সরিয়ে দেওয়া যায় তাহলে সেই ফাঁকে সে মস্ত একটা কাজ হাসিল করে নেবে।”
“কী কাজ হাসিল করবে?”
“সেইটে জানার জন্যই তো আমরা এখানে বেশ কিছুদিন হয় থানা গেড়ে বসে আছি।”
“পুলিশ কি আপনাদের ধরবেই?”
কাঠুরিয়া আবার হাসল, “তাই তো মনে হচ্ছে।”
“আমি ফিরে গিয়ে না হয় কিছু বলব না।”
কাঠুরিয়া মাথা নেড়ে বলল, “তুমি না বললে কী হয়! দ্বিতীয় মুখোশধারী বোকা লোক নয়। সে যা করেছে তা দিনের আলোতেই করেছে। নিজেকে খুব একটা গোপন রাখেনি। জলায় সর্বদাই জেলেদের নৌকো ঘোরে। তাদের চোখে পড়বেই। তুমি না বললেও তারা বলে দেরে। সুতরাং পুলিশ যে আসবেই তাতে সন্দেহ নেই।”
হঠাৎ আবার আগেকার মতোই দূরে ঘুঘুর ডাক শোনা গেল। লোকটা উৎকৰ্শ হয়ে শুনল। তারপর পল্টুর দিকে তাকিয়ে বলল, “এসো।”
পল্টু উঠে পড়ল। বলল, “কিছু পাওয়া গেছে ওই দ্বীপে?”
“মনে তো হচ্ছে। চলো দেখি।”
খাঁড়ির মুখে এসে তারা দেখে, মুখোশধারী মোটরবোট থেকে পাঁজাকোলা করে একটা লোককে নামিয়ে আনছে। লোকটাকে দেখে পল্টু চেঁচিয়ে উঠল, “আরে! এ যে সান্টুর বাবা–“
কাঠুরিয়া বলল, “চেনো তাহলে!”
“খুব চিনি।”।
মুখোশধারী সুমন্তবাবুকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে মৃদুস্বরে বলল, “একটুর জন্য লোকটাকে সাপে কামড়ায়নি। কিন্তু লোকটা একটু অদ্ভুত। অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল, হাতে একটা লাউডগা সাপ বাইছিল। সাপটাকে তাড়িয়ে মুখে চোখে জলের ঝাঁপটা দিতেই উঠে বসল। তারপর কথা নেই বার্তা নেই দুম করে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুষি চালাতে লাগল। তাই বাধ্য হয়ে আমি লোকটার চোয়ালে একটা ঘুষি মেরে অজ্ঞান করে দিই। তারপর নিয়ে আসি।”
কাঠুরিয়া পল্টুর দিকে চেয়ে একটু হেসে বলে, “বুঝলে?”
“না।” বলেই পল্টু আবার তাড়াতাড়ি বলল, “বুঝেলে? আপনার বন্ধুকে সুমন্তবাবু আমার মতো সেই দ্বিতীয় মুখোশধারী বলে মনে করেছিল।”
“ঠিক বলেছ। দু নম্বর মুখোশধারী খুব কাজের লোক।”
পল্টু উদ্বেগের সঙ্গে বলে, “আচ্ছা, গয়েশবাবুকেও কি মুখোশধারীই সরিয়ে দিয়েছে?”
“খুব সম্ভব।”
“উনি কি বেঁচে আছেন?”
“সেটা বলা শক্ত।”
“লোকে বলছে ওঁকে খুন করা হয়েছে।”
কাঠুরিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “সেটাই স্বাভাবিক। গয়েশবাবুর ঘটনাটাই সব গণ্ডগোল পাকিয়ে দিয়েছে।”
কাঠুরিয়ার মুখোশধারী বন্ধু খাঁড়ি থেকে একটা মগে করে জল এনে সুমন্তবাবুর মুখে চোখে ছিটিয়ে দিচ্ছিল। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই সুমন্তবাবুর চোখ পিটপিট করতে লাগল।
কাঠুরিয়া মৃদুস্বরে বলল, “বিনয়, তুমি সামনে থেকো না। তোমাকে দেখলেই আবার ভায়োলেন্ট হয়ে উঠবে।”
মুখোশধারী বোধহয় মুখোশের আড়ালে একটু হাসল। তারপর নেমে গিয়ে তার মোটরবোটের মুখ ঘুরিয়ে আবার জলায় অদৃশ্য হয়ে গেল।
সুমন্তবাবু চোখ পিটপিট করে কাঠুরিয়াকে একটু দেখে নিয়েই হঠাৎ “তবে রে!” বলে একটা হুংকার দিয়ে লাফিয়ে উঠলেন। কাঠুরিয়া একটুও নড়ল না। সুমন্তবাবু দাঁড়াতে গিয়ে মাথা ঘুরে নিজেই বসে পড়লেন। তারপর হঠাৎ পটাং পটাং করে কয়েকটা বৈঠক এবং বুকডন দিয়ে নিতে লাগলেন।
এবার আত্মপ্রকাশ করা বিধেয় ভেবে পটু এগিয়ে গিয়ে মিষ্টি করে বলল, “কাকাবাবু, কোনও ভয় নেই। ইনি আমাদের শত্রু নন।”
সুমন্তবাবু একটা বুকডনের মাঝখানে থেমে হ করে পল্টুর দিকে চেয়ে রইলেন।
কাঠুরিয়া তাঁকে ধরে তুলল। তারপর বলল, “আমি কখনও মারপিট করিনি। আপনি মারলে আমার খুব ব্যথা লাগত। আমি তো শত্রু নই, বন্ধু।”