Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নৃসিংহ রহস্য || Shirshendu Mukhopadhyay » Page 7

নৃসিংহ রহস্য || Shirshendu Mukhopadhyay

সুমন্তবাবু প্রথমটায় প্রাণপণে সাঁতরে

সুমন্তবাবু প্রথমটায় প্রাণপণে সাঁতরে ঝিলের অনেকটা ভিতর দিকে চলে গেলেন। পুলিশের ভয়ে সাঁতারটা একটু তেজের সঙ্গেই কেটেছেন। ফলে বেদম হয়ে হাঁফাতে লাগলেন।

সাঁতার জিনিসটা খারাপ নয়, তিনি জানেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সাঁতার হল শ্রেষ্ঠ ব্যায়াম। কিন্তু ব্যায়ামেরও তো একটা শেষ আছে। আজ সকালেই সুমন্তবাবু অনেকটা দৌড়েছেন, ওঠবোস করেছেন, বৈঠকি মেরেছেন। তার ওপর এই সাঁতার

তাঁর শরীরের জোড়গুলোয় খিল ধরিয়ে দিল। জলও বেজায় ঠাণ্ডা।

ঝিলের মাঝমধ্যিখানে পৌঁছে সুমন্তবাবু একবার পিছু ফিরে দেখে নিলেন। না, নিশ্চিন্তি। অনেকটা দূরে চলে এসেছেন। এত দূর থেকে ঝিলের পারটা ধুধু দেখা যায়, কিন্তু তোকজন চেনা যায় না।

সুমন্তবাবু সাঁতার থামিয়ে চিত হয়ে ভেসে রইলেন কিছুক্ষণ। মৃদঙ্গবাবুর কী হল তা বুঝতে পারছেন না। লোকটা বায়োলজির পণ্ডিত সন্দেহ নেই, কিন্তু জীবনে বায়োলজিটাই তো সব নয়। সাঁতার জানলে আজ পুলিশের হাতে ধরা পড়তে হত না।

চোখে প্রখর সূর্যের আলো এসে পড়ছে। সুমন্তবাবু চোখ বুজলেন। জলে চিত হয়ে ভেসে থাকাও যে খুব সহজ কাজ তা নয়। একটু-আধটু হাত-পা নাড়তে হয়। কিন্তু সুমন্তবাবুর হাত-পা ভীষণ ভারী হয়ে এসেছে।

একটু চিন্তিত হয়ে পড়লেন সুমন্তবাবু, ডাঙা অনেক দূর। ভয়ে সাঁতার দিয়ে এত দূর চলে এসেছেন বটে, কিন্তু ফের এতটা সাঁতরে ফিরে যাওয়া অসম্ভব। যদিও ফিরে যেতে পারেন, তাহলেও লাভ নেই। পুলিশে ধরবে।

সুমন্তবাবু ধীরে-ধীরে ফের সাঁতরাতে লাগলেন। তিনি শুনেছেন, জলার মাঝে-মাঝে দ্বীপের মতো জায়গা আছে। তার কোনও একটাতে বসে যদি একটু জিরিয়ে নিতে পারেন তাহলে সন্ধের মুখে ধীরে-সুস্থে ফিরে যেতে পারবেন। কপাল ভাল থাকলে একটা জেলে-নৌকোও পেয়ে যেতে পারেন।

কিন্তু কিছুক্ষণ সাঁতার দেওয়ার পরই সুমন্তবাবুর দম আটকে আসতে লাগল। হাত-পা লোহার মতো ভারী। শরীরটা আর কিছুতেই ভাসিয়ে রাখতে পারছেন না। দুপুরে ভাল করে খাওয়াও হয়নি। শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে।

সুমন্তবাবু গলা ছেড়ে হাক দিলেন, “বাঁচাও! বাঁচাও! আমি ডুবে যাচ্ছি!”

কিন্তু কেউ সে ডাক শুনতে পেল না।

এর চেয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়লেই বুঝি ভাল ছিল। সুমন্তবাবু মনে মনে মৃদঙ্গবাবুকে একটু হিংসেই করতে লাগলেন। সাঁতার না শিখেই তো লোকটা বেঁচে গেল।

হঠাৎ একটা ছপছপ বৈঠার শব্দ হল না? নাকি ভুল শুনছেন?

সুমন্তবাবু ঘাড় ঘোরালেন। বুকটা আনন্দে ধপাস ধপাস করতে লাগল। ভুল শোনেননি। বাস্তবিকই একটা নৌকো তাঁর দিকে আসছে। ছোট্ট নৌকো।

“বাঁচাও!” বলে হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন সুমন্তবাবু।

নৌকো থেকে একটা লোক মোলায়েম গলায় বলল, “আপনাকে বাঁচাতেই তো আসা।”

“বটে!” বলে সুমন্তবাবু নৌকোর গলুইটা ধরতে হাত বাড়ালেন। অমনি একটা বৈঠা এসে খচাত করে বসে গেল বাঁ কাঁধে। সুমন্তবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, “বাপ রে!”

নৌকো থেকে একটা লোক মোলায়েম গলায় বলল, “অত তাড়াহুড়ো করবেন না। আমার দু-একটা কথা আছে।”

ব্যথায় সুমন্তবাবু চোখে অন্ধকার দেখছিলেন। ককিয়ে উঠে বললেন, “আমি যে ডুবে যাচ্ছি।”

“বৈঠাটা ধরে ভেসে থাকুন।”

মন্দের ভাল। সুমন্তবাবু বৈঠাটা চেপে ধরলেন। বললেন, “কী কথা?”

“গয়েশবাবুর বাড়িতে চোরের মতো ঢুকেছিলেন কেন?”

সুমন্তবাবু অবাক হয়েও সামলে গেলেন। নৌকোর নীচে থেকে লোকটার মুখ ভাল দেখা যাচ্ছে না। সূর্যের আলোটাও চোখে এসে পড়ছে সরাসরি। তবু মনে হল নৌকোর ওপরে যে লোকটা বসে আছে তার মুখটা মানুষের মুখ নয়। মনে হচ্ছে যেন একটা মানুষের মতো হাত-পা-বিশিষ্ট সিংহ বসে আছে।

সুমন্তবাবু ভয় খেলেন। নির্জন ঝিলের জলে তাঁকে মেরে ডুবিয়ে দিলেও সাক্ষী কেউ নেই, কাঁপা গলায় বললেন, “ঠিক চোরের মতো নয়, চোরের মত ঢুকেছিলেন মৃদঙ্গবাবু।”

“উনি কেন ঢুকেছিলেন জানেন?”

“বললেন তো গয়েশবাবুর লেজ খুঁজতে?”

“লেজ কি পেয়েছেন উনি?”

“তা বলতে পারি না। গয়েশবাবুর যদি লেজ থেকেও থাকে তবু সেটা তিনি ফেলে যাওয়ার লোক নন।”

“আপনি কেন ঢুকেছিলেন?”

সুমন্তবাবু অম্লান বদনে বললেন, “আমি ঠিক ঢুকিনি। পল্টুর খোঁজে লোক জড়ো হয়েছে দেখে আমিও দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। দেখলাম, মৃদঙ্গবাবু চুপি-চুপি গয়েশবাবুর বাড়িতে ঢুকছেন। তাই ওঁকে ফলো করে আমিও ঢুকে পড়ি। তারপর একটা ঘরে বসে বই পড়তে থাকি। হঠাৎ আমাকে চোর বলে সন্দেহ করে মৃদঙ্গবাবু আমার ওপর লাফিয়ে পড়েন।”

সিংহের মুখটাকে ভাল করে লক্ষ করছিলেন সুমন্তবাবু। তাঁর সন্দেহ হল, ওটা মুখ নয়, মুখোশ। তবে খুব নিখুঁত মুখোশ। একেবারে সত্যিকারের সিংহের মুখ বলেই মনে হয়।

লোকটা বলল, “বৈঠাটা শক্ত করে ধরুন।”

সুমন্তবাবু কাতর স্বরে বলেন, “নৌকোয় উঠব না?”

“না, ডাঙা অল্প দূরেই। আমি সেখানে আপনাকে ছেড়ে দিয়ে যাব।”

“আমি বাড়ি যাব। আমার যে খিদে পেয়েছে।”

“খিদে আমারও পেয়েছে। তাতে কী?”

“খিদে পেলে আমি ভীষণ রেগে যাই।”

“তা যান না। রাগ তো পুরুষের লক্ষণ।”

সুমন্তবাবুর বাস্তবিকই রাগ হচ্ছিল। কোনওক্রমে নিজেকে সংযত করে তিনি বললেন, “আপনি কে?”

“আমি নৃসিংহ অবতার।”

সুমন্তবাবু আর কথা বললেন না। তাঁর মনে হল, তিনি আসল অপরাধীর পাল্লায় পড়েছেন। উচ্চবাচ্য করা উচিত হবে না।

নৌকোটা তাঁকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। একটা বৈঠা তিনি ধরে আছেন, আর লোকটা আর-একটা বৈঠা মেরে নৌকোটাকে নিপুণ ভাবে নিয়ে যাচ্ছে। সন্দেহ নেই, লোকটা চমৎকার নৌকো বায়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আচমকা সুমন্তবাবু পায়ের নীচে জমি পেয়ে গেলেন। এবং উঠে দাঁড়ালেন।

লোকটাও নৌকো থামিয়েছে। বলল, “এবার আসুন তাহলে। সামনেই ডাঙা জমি।”

সুমন্তবাবু দেখলেন জঙ্গলে-ছাওয়া একটা পুরনো চর। অনেকটা দ্বীপের মতোই। তবে জনমনিষ্যি নেই।

সুমন্তবাবু কোমরসমান জলে দাঁড়িয়ে দ্বীপটা একটু দেখলেন। বৈঠার ডগাটা এখনও হাতে ধরা।

লোকটা একটু হেসে বলল, “রাতটা কোনওমতে কাটিয়ে দিন। ভোরবেলা সাঁতার শুরু করলে দুপুরের আগেই পৌঁছে যাবেন বাড়িতে।”

সুমন্তবাবুর মাথাটা চড়াক করে উঠল রাগে। একে পেটে খিদে তার ওপর এসব টিপ্পনী তাঁর সহ্য হওয়ার নয়। তিনি হঠাৎ এক ঝটকায় বৈঠাটায় একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে মোচড় মারলেন।

ব্যায়ামের আশ্চর্য সুফল। লোকটা সেই টানে বেসামাল হয়ে নৌকোর মধ্যেই উপুড় হয়ে পড়ল।

সুমন্তবাবু একলাফে নৌকোয় উঠে লোকটার ঘাড়ে সামিল হয়ে দুটো প্রচণ্ড রদ্দা কষালেন।

কিন্তু মুশকিল হল, জলে ভিজে এবং নানারকম ব্যায়ামের ফলে তাঁর শরীরে আর সেই শক্তি নেই। উপরন্তু নৃসিংহ অতিকায় বলবান লোক। কোনওরকম গা-জোয়ারির মধ্যেই গেল না। শুধু টপ করে উঠে বসল।

তার পিঠ থেকে পাকা ফলের মতো খসে ফের জলে পড়ে গেলেন সুমন্তবাবু।

লোকটা বৈঠা তুলে নিয়ে এক ঠেলায় নৌকোটা গভীর জলে নিয়ে ফেলল। তারপর মোলায়েম গলায় বলল, “ডাঙায় উঠে পড়ন সুমন্তবাবু। জলায় কুমির আছে।”

সুমন্তবাবু দুই লাফে ডাঙায় উঠে কোমরে হাত দিয়ে বেকুবের মতো চেয়ে দেখলেন, নৃসিংহ অবতার নৌকো নিয়ে ক্রমে দূর থেকে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে।

সুমন্তবাবু এবার চারদিকটা ভাল করে দেখলেন। দ্বীপটায় বড় গাছ নেই বললেই হয়। আগাছাই বেশি। ফলমূল খেয়ে যে খিদে মেটাবেন, সে উপায় নেই।

ভেজা গায়ে বাতাস লেগে খুব শীত করছিল সুমন্তবাবুর। গরম বালির ওপর বসে শীতটা খানিক সামাল দিলেন। বেলা আর খুব বেশি অবশিষ্ট নেই। জেলে-নৌকোর টিকিটিও দেখা যাচ্ছে না। সুতরাং এই দ্বীপেই রাতটা কাটাতে হবে।

দিনের আলো থাকতে-থাকতেই দ্বীপটা ঘুরে দেখবেন বলে ক্লান্ত শরীরেও সুমন্তবাবু উঠে পড়লেন।

জায়গাটা খুব বড় নয়। জলের ধার ঘেঁষে-ঘেঁষে হাঁটতে-হাঁটতে লক্ষ করে যাচ্ছিলেন তিনি।

হঠাৎ আতঙ্কে থমকে দাঁড়ালেন সুমন্তবাবু। সামনেই বালির ওপর একটা, দুটো, তিনটে, চারটে কুমির চুপচাপ শুয়ে আছে। ভারী নিরীহ দেখতে। কিন্তু সাক্ষাৎ যম।

সুমন্তবাবু খুব দ্রুতপায়ে ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। বুকটা ধকধক করছে ভয়ে। পায়ে গোটাকয়েক কাঁটা ফুটল প্যাট-প্যাট করে। তবু শব্দ করলেন না। কুমির যদি ধেয়ে আসে?

কিন্তু ঝোঁপজঙ্গলগুলোও খুব বেশি নিরাপদ মনে হচ্ছিল না তাঁর। এই ছোট দ্বীপে বাঘ-ভালুক বা হায়না-নেকড়ে নেই ঠিকই, কিন্তু অন্যবিধ প্রাণী থাকতে পারে। বিপদের কথা ভাবতে-ভাবতে আপনা থেকেই সুমন্তবাবু কয়েকটা বুকডন আর বৈঠকি দিয়ে ফেললেন। কিন্তু ক্লান্ত পরিশ্রান্ত বেদম শরীরের হাড়গুলো সেই অনাবশ্যক ব্যায়ামে মটমট করে উঠল, পেশীগুলো ‘ব্রাহি ত্রাহি’ ডাক ছাড়তে লাগল। সুমন্তবাবু নিরস্ত হয়ে মাটিতে বসে হাঁফাতে লাগলেন।

হঠাৎ তাঁর কাঁধের ওপর একটা গাছের ডগা খুব ধীরে ধীরে নেমে এল। বাঁ কাঁধে একটা হিমশীতল স্পর্শ পেলেন। চমকে উঠে তাকাতেই তাঁর চক্ষু চড়কগাছ। সবুজ রঙের একটা সরু সাপ খুব স্নেহের সঙ্গে তার হাত বেয়ে খানিকদূর এসে মুখের দিকে যেন অবাক হয়ে চেয়ে দেখছে।

লাউডগা সাপ বিষাক্ত কি না তা তিনি ভাল জানেন না। কিন্তু এত কাছে, একেবারে নাকের ডগায় সাপের মুখোমুখি তিনি কখনও হননি।

“বাঁচাও! বাপ রে!” বলে একটা বুকফাটা আর্তনাদ করে সুমন্তবাবু মূচ্ছা গেলেন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress