Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নৃসিংহ রহস্য || Shirshendu Mukhopadhyay » Page 6

নৃসিংহ রহস্য || Shirshendu Mukhopadhyay

দুপুরে খেতে বসে সুমন্তবাবু

দুপুরে খেতে বসে সুমন্তবাবু বললেন, “ব্যায়াম। ব্যায়াম। ব্যায়াম ছাড়া কোনও পন্থা নেই। ব্যায়াম না করে করেই বাঙালি শেষ হয়ে গেল। বিকেল থেকে পাঁচশো স্কিপিং শুরু করো সান্টু। মঙ্গল, তুমি ব্যায়ামবীর বটে, কিন্তু ফ্যাট নও। শরীরে কেবল মাংস জমালেই হবে না, বিদ্যুতের মতো গতিও চাই। গতিই আর একটা শক্তি। আজ বিকেল থেকে তুমি গতি বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করবে। কমলা, তুমি আর তোমার মাকে নিয়েই আমার প্রবলেম। তোমরা কপালগুণে মেয়েমানুষ। শাস্ত্রে মেয়েদের ব্যায়ামের কথা নেই। কিন্তু শহরে বিপদ দেখা দিয়েছে, সকলেরই খানিকটা শক্তিবৃদ্ধি দরকার। আমাদের পেঁকিটা আজকাল ব্যবহার হয় না। আমার মা ওই টেকিতে পাড় দিয়ে-দিয়ে বুড়ো বয়স পর্যন্ত শুধু বেঁচেই আছেন যে তাই নয়, খুবই সুস্থ আছেন। একবার আমাদের বাড়িতে দুদুটো চোরকে ধরে তিনি মাথা ঠুকে দিয়েছিলেন। সুতরাং আজ থেকে তুমি আর তোমার মা কেঁকিতে পাড় দিতে শুরু করো। ওফ, কাঁকালে বড় ব্যথা।” বলে সুমন্তবাবু যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করলেন।

কুমুদিনী দেবী বললেন, “তা না হয় হল, কিন্তু ব্যায়াম করে গায়ে জোর হতে তো সময় লাগে। ততদিনে যদি ভাল-মন্দ কিছু হয়ে যায়? তার চেয়ে আমি বলি কী, একটা কুকুর পোযো।”

সুমন্তবাবু বললেন, “সেটা মন্দ বুদ্ধি নয়। বজ্রাঙ্গবাবুর সঙ্গে কথা বলে যা বুঝলাম, গয়েশবাবু খুনই হয়েছেন। লাশটা হয়তো জলায় ফেলে দিয়েছে। গয়েশবাবু খুন হলেন কেন তা পরে জানা যাবে। আমার ধারণা, গয়েশবাবুর লেজটাই তার মৃত্যুর কারণ। আমাদের লেজ নেই বটে, কিন্তু অন্যরকম ডিফেক্ট থাকতে পারে। সান্টুর নাকটা লম্বা, মঙ্গলের কপালের দুদিকটা বেশ উঁচু, অনেকটা শিং-এর মতো, আমার অবশ্য ওরকম কোনো ডিফেক্ট নেই, তাহলেও…”

“আছে।” গম্ভীরভাবে কমলা বলল।

“আছে?” বলে অবাক হয়ে সুমন্তবাবু মেয়ের দিকে তাকালেন।

“তোমার গায়ে মস্ত-মস্ত লোম। বনমানুষের মতো।”

সুমন্তবাবু তাড়াতাড়ি ভাত মাখতে-মাখতে বললেন, “যাক সে কথা। বজ্রাঙ্গবাবু বলেছেন ‘দি কিলার উইল স্ট্রাইক এগেন। আমাকে সতর্ক থাকা দরকার।”

ঠিক এই সময়ে বাইরে একটা হৈ চৈ শোনা গেল। কে যেন ঢোল বাজাচ্ছে আর চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে কী বলছে।

সান্টু লাফিয়ে উঠে বাইরে ছুটল। পিছনে সুমন্তবাবু, মঙ্গল, কমলা, কুমুদিনী।

দেখা গেল, নাপিত নেপাল সুমন্তবাবুর ফটকের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঢোল বাজাতে বাজাতে প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে, “দুয়ো দুয়ো, হেরে গেল।”

সুমন্তবাবু হেঁকে বললেন, “কে হেরে গেল রে ন্যাপলা! বলি ব্যাপারখানা কী?”

নেপাল ঢোল থামিয়ে একগাল হেসে বলল, “আজ্ঞে এবার আর আমার সঙ্গে পারবেন না। একেবারে কাকের মুখ থেকে খবর নিয়ে এসেছি। সকালবেলা খুব জব্দ করেছিলেন আজ। গয়েশবাবুর খবরটা সবে গঙ্গাগোবিন্দবাবুকে দিতে যাচ্ছিলুম সেই সময় আপনি এমন হেঁড়ে গলায় পেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করলেন যে, আমি একেবারে চুপসে গেলুম। কিন্তু এবার আমি মার দিয়া কেল্লা।”

সুমন্তবাবু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলেন, “বলছিস কী রে ন্যাপলা? আবার কিছু ঘটেছে নাকি?”

নেপাল ঢেলে চাঁটি মেরে চাটিস-চাটিস বোল বাজিয়ে কিছুক্ষণ নেচে নিয়ে বলল, “ঘটেছে বই কী। এই একটু আগে পল্টুকে পরীরা ধরে নিয়ে গেছে।”

“পরীরা ধরে নিয়ে গেছে কী রে।”

“তবে আর বলছি কী, আমার পিসশ্বশুরের স্বচক্ষে দেখা। পল্টু দারোগাবাবুর সামনে সাক্ষী দিয়ে জলার ধারে গিয়েছিল। সেখানে ঠিক সাতটা মেয়ে-পরী এসে তাকে হেঁকে ধরে। আমার পিসশ্বশুর জলায় মাছ ধরতে গিয়েছিল। নিজের চোখে দেখেছে, সাতটা পরী পল্টুকে ধরে নিয়ে ভেসে চলে যাচ্ছে মেঘের দেশে।”

সুমন্তবাবু এঁটো হাত ঘাসে মুছে নিয়ে শশব্যস্তে বললেন, “তাহলে তো খবরটা সবাইকে দিতে হচ্ছে।”

একগাল হেসে নেপাল বলে, “আজ্ঞে সেকাজ আমি সেরেই এসেছি। কারও আর জানতে বাকি নেই।”

সুমন্তবাবু বাস্তবিকই একটু দমে গেলেন। এত বড় একটা খবর, সেটা তিনি কিনা পেলেন সবার শেষে! কিন্তু কী আর করেন। দাঁত কিড়মিড় করে শুধু বললেন,”আচ্ছা, দেখা যাবে।”

কী দেখা যাবে, কী ভাবে দেখা যাবে তা অবশ্য বোঝা গেল। না। তবে সুমন্তবাবু আর খেতে বসলেন না। গায়ে জামা চড়িয়ে, পায়ে একজোড়া গামবুট পরে এবং মাথায় চাষিদের একটা টোকলা চাপিয়ে হাতে লাঠি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।

সান্টু আর মঙ্গল আবার খেতে বসে গিয়েছিল। কুমুদিনী দেবী একটু নিচু গলায় তাদের বললেন, “ওরে, ওই দ্যাখ, বাড়ির কর্তার মতিচ্ছন্ন হয়েছে। এই দুপুরে বিকট এক সাজ করে কোথায় যেন। চললেন। তোরাও একটু সঙ্গে যা বাবারা। কোথায় কী ঘটিয়ে আসেন বলা যায় না।”

সান্টু আর মঙ্গল শেষ কয়েকটা গ্রাস গপাগপ গিলে উঠে পড়ল। সান্টু তার গুলতি আর মঙ্গল একটা মাছ মারার ট্যাটা হাতে নিয়ে সুমন্তবাবুর পিছনে দৌড়োতে থাকে।

জলার ধারে পৌঁছে খুবই বিরক্ত হলেন সুমন্তবাবু। এমনিতেই জলাটা নির্জন জায়গা, তার ওপর ভূতপ্রেত আছে বলে সহজে লোকে এদিকটা মাড়ায় না। কিন্তু আজ জলার ধারে রথযাত্রার মতো ভিড়। বোঝা গেল, নেপাল ভালমতোই খবরটা চাউর করেছে। জেলেদের যে কটা নৌকো ছিল, সব জলে দাবড়ে বেড়াচ্ছে। বহু লোক হোগলাবনে কোমরসমান জলে নেমে গাছ উপড়ে ফেলছে।

কবি সদানন্দ একটু হাসি-হাসি মুখ করে সুমন্তবাবুকে বললেন, “ছেলেটা খুব ভেঁপো ছিল মশাই। আমার কবিতায় ভুল ধরেছিল। তখনই জানতাম, ছোঁকরা বিপদে পড়বে।”

“কার কথা বলছেন? পল্টু?”

“তবে আর কে! আলোকবর্ষ নাকি বছর-টছর নয়। তা নাই। বা হল, তা বলে মুখের ওপর ফস্ করে বলে বসবি? আর তোর চেয়ে সায়েন্স-জানা লোক কি এখানে কম আছে? এই তো গঙ্গাগোবিন্দবাবুই রয়েছেন। উনিই তো বললেন, আলোর গতি মোটেই সেকেণ্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল নয়। বেশ কিছু কম। “

বলতে বলতেই গঙ্গাগোবিন্দ এগিয়ে এলেন। মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললেন, “আহাহা, এখন আবার ওসব কথা কেন?”

সুমন্তবাবু একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলেন। আলোকবর্ষ বা আলোর গতির প্রসঙ্গটা ধরতে পারছিলেন না। একটু সামলে নিয়ে বললেন, “পল্টুর ঠিক কী হয়েছে জানেন আপনারা?”

গঙ্গাগোবিন্দ মাথা নেড়ে বললেন, “না। কয়েকজন লোক তাকে জলার দিকে আসতে দেখেছে। তারপর কী ঘটেছে, তা অনুমান করা যায় মাত্র। কলকাতার ছেলে, সাঁতার জানত না, মনে হয় ডুবেই গেছে।”

“সর্বনাশ!” বলে সুমন্তবাবু এগিয়ে গেলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, পল্টু এমনি-এমনি গায়েব হয়নি। গয়েশবাবু সম্পর্কে সে কিছু গুরুতর তথ্য জানতে পেরেছিল। গয়েশবাবুকে যারা খুন বা গুম করেছে, সম্ভবত তারাই পল্টুকেও খুন বা গুম করেছে।

জলার ধারে লোকজনের ভিড় হওয়াতে কয়েকজন দিব্যি ব্যবসা ফেঁদে বসে গেছে। হরিদাস পায়ে ঘুঙুর বেঁধে নেচে-নেচে তার বুলবুলভাজা বিক্রি করছে, কানাই তার ফুচকার ঝুড়ি নামিয়েছে একটা শিমুলগাছের তলায়, চিনেবাদাম বিক্রি করতে লেগেছে ষষ্ঠীপদ। ওদিকে জেলেরা বেড়াজাল ফেলে জলায় পল্টুর মৃতদেহ খুঁজছে। দারোগাবাবু একটা আমগাছের তলায় ইজিচেয়ারে বসে নিজে তদারক করছেন।

সুমন্তবাবু বুঝলেন, এই ভিড়ের মধ্যে ভিড়ে কোনও লাভ হবে না। তিনি সান্টু আর মঙ্গলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার মনে হয় রহস্যের উত্তর গয়েশবাবুর বাড়ির মধ্যেই পাওয়া যাবে। আমি গোপনে বাড়ির মধ্যে ঢুকছি, তোরা চারদিকে নজর রাখিস।”

গয়েশবাবুর বাড়িটা আজ বড়ই ফাঁকা। সদর দরজায় তালা লাগিয়ে চাকরটা পর্যন্ত জলার ধারে গিয়ে মজা দেখছে। সুতরাং সুমন্তবাবুর ধরা পড়ার ভয় বড় একটা নেই।

বাড়িতে ঢোকা খুব একটা শক্ত হল না। পুরনো বাড়ি বলে অনেক জানালা-দরজাই নড়বড় করছে। সুমন্তবাবু একটা আধখোলা জানালার গরাদহীন ফোকর দিয়ে গামবুট এবং টোলাসহই ঢুকে পড়লেন ভিতরে।

নীচে এবং ওপরে অনেকগুলো ঘর। তার সবগুলোই ফাঁকা পড়ে আছে। গয়েশবাবু শুধু সামনের দিকের দুখানা ঘর ব্যবহার করতেন। বাকি ঘরগুলোয় তালাও দেওয়া নেই। ডাইকা কিন্তু ভাঙা আসবাব, তোরঙ্গ আর হাবিজাবি জিনিস রয়েছে। মাকড়সার জাল, ধুলো, ইঁদুর আর আরশোলার নাদিতে ভরতি।

সুমন্তবাবু প্রথম ঘরটায় ঢুকেই চারদিকে চেয়ে বুঝলেন, এ ঘরে বহুকাল লোক ঢোকেনি। মেঝেতে পুরু ধুলোর আস্তরণ।

কিন্তু সুমন্তবাবু লক্ষ করলেন, ধুলোর ওপর নির্ভুল একজোড়া জুতোর ছাপ রয়েছে। রবারসসালের জুতো। লাঠিটা শক্ত হাতে চেপে ধরে তিনি এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুললেন। ওপাশে আর একটা ঘর। অনেক-দেরাজওলা একটা মস্ত চেস্ট রয়েছে। ভাঙা আলনা। একটা লোহার সিন্দুক। সুমন্তবাবু দেরাজগুলো খুলে দেখলেন, তাতে পুরনো খবরের কাগজ আর কিছু লাল হয়ে যাওয়া চিঠিপত্র ছাড়া কিছুই নেই। সিন্দুকটা খুলতে পারলেন না। তালা লাগানো। পরের ঘরটাতে একটা মস্ত কাঠের বাক্স। সেটা খুলে দেখলেন, রাজ্যের ছেঁড়া কাঁথা কাপড় আর ভাঙা বাসন। পরের ঘরটায় কয়েকটা বইয়ের আলমারি। পাল্লা খুলে কয়েকটা বই একটু নেড়েচেড়ে দেখলেন সুমন্তবাবু। ছেলেবেলায় একটা বই পড়েছিলেন সুমন্তবাবু। ‘গুপ্তহিরার রহস্য। দস্যুসদার কালোমানিক সুবর্ণগড় থেকে বিখ্যাত গুপ্তহিরা লুঠ করে নিয়েছিল বটে, কিন্তু শেষ অবধি গোয়েন্দা জীমূতবাহন তা উদ্ধার করে। কিন্তু কালোমানিক তাকে হুমকি দিয়েছিল, শোধ নেবে। জীমূতবাহন যখন এক রাত্রে ঘুমোচ্ছিল তখন জানালায় শব্দ হল টক। জীমূত জানালা খুলে দেখে, কাঠের পাল্লায় একটা তীর গেঁথে আছে। তীরের ফলায় গাঁথা চিঠি : “শিগগিরই দেখা হবে। কালোমানিক।” ‘গুপ্তহিরার রহস্য’ প্রথম খণ্ড সেখানেই শেষ। অনেক চেষ্টা করেও বইটার দ্বিতীয় খণ্ড যোগাড় করতে পারেননি সুমন্তবাবু। কিন্তু এতকাল পরে গয়েশবাবুর বাড়িতে আলমারি খুলে তাঁর নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। দ্বিতীয় তাকে কোণের দিকে তৃতীয় বইখানাই ‘গুপ্তহিরার রহস্য’ (দ্বিতীয় খণ্ড)।

সুমন্তবাবু বইটা তাড়াতাড়ি টেনে নিয়ে কোঁচা দিয়ে ধুলো ঝেড়ে একটা নড়বড়ে চেয়ারে বসে পড়তে শুরু করলেন। রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা। কালোমানিক আবার ফিরে আসছে। পড়তে পড়তে সুমন্তবাবুর বাহ্যজ্ঞান রইল না।

যদি বাহ্যজ্ঞান থাকত তাহলে তিনি ভিতরদিককার দরজার পাল্লায় ক্যাঁচ শব্দটা ঠিকই শুনতে পেতেন। কিন্তু পেলেন না।

দরজার আড়াল থেকে একজোড়া চোখ তাঁকে লক্ষ করল। তারপর ছায়ামূর্তির মতো একটা লোক নিঃশব্দে ঢুকল দরজা দিয়ে।

সুমন্তবাবু মাথার টোকাটা খুলতে ভুলে গেছেন। গামবুটও পায়ে রয়েছে। ছায়ামূর্তি পিছন থেকে তাঁকে জ্বলজ্বলে চোখে খানিকক্ষণ দেখল। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল।

সুমন্তবাবু তেরো পৃষ্ঠা পড়ে পাতা উল্টে চৌদ্দ পৃষ্ঠায় গেছেন মাত্র। সুবর্ণগড়ের রাজবাড়ির বিশ হাত উঁচু দেয়াল টপকে একজন লোক কাঠবেড়ালির মতো লাফ দিয়ে আমগাছের ডাল ধরে ঝুল খেয়ে মাটিতে নামল।

ঠিক এই সময়ে পিছন থেকে লোকটা লাফিয়ে পড়ল তাঁর ঘাড়ে।

ভাগ্যিস টোকলাটা মাথা থেকে খোলেননি। যেরকম জোরে তিনি চেয়ার থেকে মাটিতে ছিটকে পড়েছিলেন তাতে মাথা ফেটে যাওয়ার কথা। ফাটল না টোকলাটার জন্যই। বুকের ওপর একটা লোক চেপে বসে বলছে, “হুঁ হুঁ বাছাধন, এবার?”

সুমন্তবাবুর সারা গায়ে ব্যথা। অনভ্যাসের ব্যায়াম করলে যা হয়। তবু তিনি ঝটকা মেরে উঠতে গেলেন এবং দুজনে জড়াজড়ি করে মেঝেয় গড়াতে লাগলেন। সুমন্তবাবুর মনে হচ্ছিল, একটু ভুল হচ্ছে। ভীষণ ভুল।

আগন্তুক লোকটাও যেন তার ভুল বুঝতে পেরেছে।

হঠাৎ লোকটা বলে উঠল, “সুমন্তবাবু না?”

সুমন্তবাবুও বলে উঠলেন, “আরে! মৃদঙ্গবাবু যে!”

গা-হাত ঝেড়ে উঠে মৃদঙ্গবাবু বললেন, “আর বলেন কেন!

এসেছিলাম গয়েশবাবুর ছেলেবেলার কোনো ফোটোগ্রাফ পাওয়া যায় কি না তা খুঁজে দেখতে।”

“ফোটোগ্রাফ? তা দিয়ে কী হবে?”

“গবেষণায় লাগবে। গয়েশবাবুর লেজ সংক্রান্ত গুজবটা সত্যি কি না তা আজ অবধি ধরতে পারলাম না। অথচ বেশ জোরালো গুজব! যদি সত্যি হয় তবে মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসে একটা মস্ত ওলটপালট ঘটে যাবে। তাই দেখছিলাম যদি গয়েশবাবুর একেবারে ছেলেবেলার কোনো ছবি থাকে, আর তাতে যদি লেজের প্রমাণ পাওয়া যায়। লোকটাকে তো আর পাওয়া যাবে না।”

সুমন্তবাবু একটু উত্তেজিত গলায় বললেন, “শহরে এতবড় একটা বিপর্যয় চলছে, আর আপনি খুঁজছেন গয়েশবাবুর লেজ! জানেন পল্টুকে গুম করা হয়েছে?”

মৃদঙ্গবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “জানি। কিন্তু গয়েশবাবুর লেজটাও কিছু কম গুরুতর ব্যাপার নয়।”

সুমন্তবাবু খুব উত্তেজিত গলায় বললেন, “তাহলে আমার কাছে শুনুন। গয়েশবাবুর মোটেই লেজ ছিল না।”

মৃদঙ্গবাবুও উত্তেজিত গলায় পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “আপনি তা জানলেন কী করে?”

দুজনের যখন বেশ তর্কাতর্কি লেগে পড়েছে, তখন হঠাৎ ঘরের মধ্যে একটা বাজ পড়ার মতো শব্দ হল। “কী হচ্ছে এখানে? অ্যাঁ! কী হচ্ছে?”

দুজনেই চেয়ে দেখেন, দরজায় বজ্রাঙ্গবাবু দাঁড়িয়ে। দুই চোখে ভয়াল দৃষ্টি, দাঁত কিড়মিড় করছেন। সুমন্তবাবু আর মৃদঙ্গবাবু সঙ্গে-সঙ্গে মিইয়ে গিয়ে আমতা-আমতা করতে লাগলেন।

বজ্রাঙ্গ অত্যন্ত কটমট করে দুজনের দিকে চেয়ে বললেন, “অনধিকার প্রবেশের জন্য আপনাদের দুজনকেই অ্যারেস্ট করছি।” বলেই পিছু ফিরে হুংকার দিলেন, “এই, কে আছিস?”

সুমন্তবাবু চোখের পলকে দৌড় দিলেন। খোলা জানালা গলে একলাফে বাগানে নেমে ছুটে গিয়ে হোগলাবনে ঢুকে ঝিলের জলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। পড়ার পর খেয়াল হল, তিনি একা নন। মৃদঙ্গবাবুও জলে ঝাঁপ দিয়েছেন।

সুমন্তবাবুর পাশাপাশি কোমরজলে দাঁড়িয়ে মৃদঙ্গবাবু বললেন, “আমি সাঁতার জানি না।”

“আমি জানি।”

“তাতে আমার কী লাভ?”

“আপনার লাভের কথা তো বলিনি। বলেছি আমি সাঁতার জানি।”

“আমি ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাস জানি।”

“তাতে আমার কী?”

“আপনার কথা তো বলিনি। বললাম, আমি জানি।”

“আমি কৃমাসন জানি।”

“আমি ইভোলিউশন থিওরি জানি।”

“আমি হাঁফানির ওষুধ জানি।”

“আমি ব্যাঙের মেটাবলিজম জানি।”

এ সময়ে অদূরে একটা বজ্র-হুংকার শোনা গেল, “পাকড়ো! জলদি পাকাড়কে লাও।”

সঙ্গে-সঙ্গে কে যেন হেগলাবনের আড়ালে ঝিলের পার থেকে জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল।

সুমন্তবাবু প্রমাদ গুনে তৎক্ষণাৎ গভীর জলের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে জোরে সাঁতার দিতে লাগলেন।

পিছন থেকে করুণ গলায় মৃদঙ্গবাবু বললেন, “সুমন্তবাবু, আমি রয়ে গেলাম যে।”

সুমন্তবাবু বললেন, “আপনি পুলিশকে ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাস আর ব্যাঙের মেটাবলিজম বোঝাতে থাকুন।”

মৃদঙ্গবাবু করুণতর স্বরে বললেন, “আমাদের বংশে যে কেউ কখনও পুলিশের হাতে ধরা পড়েনি। আমি পড়লে বংশের কলঙ্ক হবে যে!”

“আমার বংশেও কেউ পড়েনি।”

“আপনি ভীষণ স্বার্থপর।”

“আপনিও খুব পরোপকারী নন।”

হোগলাবন চিরে সিপাইটা এগিয়ে আসছে। কিন্তু মৃদঙ্গবাবুর কিছুই করার নেই। তিনি লজ্জায় চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইলেন। পুলিশের হাতে নিজের গ্রেফতার হওয়ার ঘটনাটা তিনি স্বচক্ষে দেখতে পারবেন না।

টের পেলেন পুলিশটা এসে তাঁর হাত ধরল। মৃদঙ্গবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “চলো বাবা সেপাই, শ্রীঘরে ঘুরিয়ে আনবে চলো।”

মৃদুস্বরে কে যেন বলল, “চলুন।” গলাটা পুলিশের বলে মনে হল না। সাবধানে চোখটা একটু খুলে মৃদঙ্গবাবু দেখলেন। দেখেই কিন্তু ভিরমি খাওয়ার যোগাড়। গোঁগোঁ করে একটা শব্দ বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে। অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন। লোকটাই ধরে দাঁড় করিয়ে রাখল।

ঠিক লোক নয়। নৃসিংহ অবতার। শরীরটা মানুষের মতো বটে, কিন্তু মুখটা সিংহের।

মৃদঙ্গবাবু চিচি করে বললেন, “আমি কিছু জানি না। আমাকে ছেড়ে দিন।”

নৃসিংহ অবতার গম্ভীর গলায় বলল, “বাঁচতে চাইলে আমার সঙ্গে চলুন। নইলে পুলিশের হাত এড়াতে পারবেন না। আপনার বংশের মুখে কালি পড়বে।”

কথাটা অতি সত্যি। মৃদঙ্গবাবু সভয়ে বললেন, “আপনি কে?”

“আমি যেই হই, সেটা বড় কথা নয়। তবে আপনাকে চুপিচুপি বলে রাখি গয়েশবাবুর কিন্তু সত্যিই লেজ ছিল।”

“বলেন কী?”

“প্রমাণ চান তো আমার সঙ্গে চলুন। আমার মুখোশটাকে ভয় পাবেন না। আমার মুখটা দেখতে ভাল নয় বলে মুখোশ পরি। এখন চলুন।”

মৃদঙ্গবাবু উত্তেজিত গলায় বললেন, “চলুন।”

“এই দিকে আসুন।” বলে নৃসিংহ অবতার মৃদঙ্গবাবুর হাত ধরে কোমরজল ভেঙে উত্তরদিকে এগোতে লাগল।

লোকটা ঘাঁতঘোঁত জানে। দিব্যি লোকজনের চোখের আড়াল দিয়ে, পুলিশের নাগাল এড়িয়ে জল ভেঙে একটা নিরিবিলি জায়গায় এনে ডাঙায় তুলল।

জায়গাটা মৃদঙ্গবাবু চেনেন। এক সময়ে এখানে নীলকুঠি ছিল। ভাঙা পোড়ো একখানা মস্ত বাড়ি আজও আছে। বিশাল বিশাল বটগাছ ছায়াচ্ছন্ন করে রেখেছে চারধার। পারতপক্ষে লোকে এখানে আসে না। এখানে নাকি ভীষণ বিষাক্ত সাপের আড্ডা।

ডাঙায় তুলে লোকটা হঠাৎ হাত বাড়িয়ে বলল, “এবার জিনিসটা দিয়ে দিন।”

মৃদঙ্গবাবু আঁতকে উঠে বললেন, “মানে?”

“ন্যাকামি করবেন না মৃদঙ্গবাবু। গয়েশবাবুর বাড়িতে যে-জিনিসটা পেয়েছেন, সেটা দিয়ে দিন।”

“কিছু পাইনি তো?”

লোকটা হঠাৎ জামার ভেতর থেকে একটা পিস্তল বের করে বলল, “বেশি কথা বললে খুলি উড়ে যাবে।”

মৃদঙ্গবাবু জীবনে কখনও বন্দুক পিস্তলের মুখোমুখি হননি। আতঙ্কে ‘আঁ আঁ করে উঠলেন।

লোকটা বলল, “গয়েশবাবুর যে লেজ ছিল, সে-প্রমাণ আমার কাছে আছে। যদি সেটা চান তো জিনিসটা দিয়ে দিন।”

মৃদঙ্গবাবু হাঁ করে লোকটার দিকে চেয়ে ছিলেন। হাঁ-মুখের মধ্যে একটা মাছি ঢুকে মুখের ভিতরে দিব্যি একটু বেড়িয়ে আবার বার হয়ে এল।

“কই, দিন।” লোকটা তাড়া দেয়।

“কী রকম জিনিস?”

“একটা লকেট। তেমন দামি জিনিসেরও নয়। পেতলের।”

“মা কালীর দিব্যি, লকেটটা আমি পাইনি।”

“ন্যাকামি হচ্ছে?”

“না না। তবে আমার মনে হয়, লকেটটা সুমন্তবাবু পেয়েছেন।”

“ঠিক জানেন?”

“জানি। উনিও ওসময়ে ঘুরঘুর করছিলেন।”

“উনি কোথায়?”

“পালিয়েছেন। জলে নেমে সাঁতার দিয়ে পালিয়েছেন। পালানোর ভঙ্গি দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল, কিছু একটা হাতিয়ে এনেছেন গয়েশবাবুর বাড়ি থেকে।”

“আচ্ছা, সুমন্তবাবুর সঙ্গেও মোলাকাত হবে। এখন আপনি যেতে পারেন।”

“যাব?” ভয়ে ভয়ে সুমন্তবাবু জিজ্ঞেস করলেন।

“যান। কিন্তু পুলিশের কাছে কিছু বলবেন না।”

“না না। পুলিশের সঙ্গে আমার দেখাই হবে না। আমি এখন দিশেরগড়ে মাসির বাড়ি যাব। মাসখানেকের মধ্যে আর ফিরছি না।”

এই বলে মৃদঙ্গবাবু তাড়াতাড়ি রওনা হলেন। কিন্তু দশ পাও যেতে হল না তাঁকে। পিছন থেকে কী যেন একটা এসে লাগল মাথায়।

মৃদঙ্গবাবু উপুড় হয়ে পড়ে গেলেন। নৃসিংহ অবতার এগিয়ে এল। মৃদঙ্গবাবুর মাথার কাছেই ঘাসের ওপর পড়ে থাকা বলটা কুড়িয়ে নিয়ে পকেটে পুরল। তারপর দ্রুত হাতে মৃদঙ্গবাবুর শরীর তল্লাশ করতে লাগল।

যা খুঁজছিল, তা পেয়েও গেল লোকটা। তারপর হোগলার বনে নেমে জলের মধ্যে চোখের পলকে মিলিয়ে গেল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress