গয়েশবাবুর লাশ
কিন্তু মুশকিল হল, গয়েশবাবুর লাশটা নদী থেকে তোলার পর দেখা গেল, সেটা মোটেই গয়েশবাবু বা আর কারও লাশ নয়। সেটা একটা গোড়াকাটা কলাগাছ। আর সতুবাবুদের গা-ছমছমে পোড়াবাড়িটার পিছনের জঙ্গলে-ছাওয়া বাগানে শিমুলগাছের ডালে যেটা ছিল, সেটাও গয়েশবাবুর মুণ্ডু নয়। ভাল গাছ বাইতে পারে বলে ফুফুকেই সবাই ঠেলে তুলেছিল গাছে। সে অনেক আগাছা, লতানে গাছ আর শিমুলের পাতার আড়াল ভেদ করে মগডালের কাছাকাছি পৌঁছতেই গোটাকয় মৌমাছি তেড়ে এসে হুল দিল। ফুচু বড় বড় চোখে চেয়ে দেখল, ডাল থেকে গয়েশবাবুর মুণ্ডু তার দিকে চেয়ে দাঁত খিচোচ্ছে না, বরং লম্বা দাড়িওলা শান্ত একটা মুখের মতো ঝুলে আছে একটা মৌচাক।
তাহলে গয়েশবাবুর হল কী?
লোকে গয়েশবাবুকে জানে অতি শান্তশিষ্ট লেজবিশিষ্ট মানুষ বলে। তিনি শান্ত লোক ছিলেন এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই। তাঁর ব্যবহারও ছিল অতি শিষ্ট। কিন্তু তাঁর লেজ নিয়ে মতান্তর আছে। অনেকেই বলে, “গয়েশবাবুর লেজ আছে। আমার ঠাকুদার নিজের চোখে দেখা। সন্ধেবেলা ঘরের দাওয়ায় নিরিবিলিতে বসে তিনি লেজ দিয়ে মশা তাড়ান।” আবার অনেকের ধারণা–লেজের কথাটা স্রেফ গাঁজা, ছেলেবেলায় খুব দুষ্ট ছিলেন বলে মাস্টারমশাইরা তাঁর লেজ কল্পনা করেছিলেন, সেই থেকে কথাটা চালু হয়ে গেছে।
কিন্তু এখন গয়েশবাবুও নেই, তাঁর লেজও দেখা যাচ্ছে না। বানর থেকে মানুষের যে বিবর্তন, সেই ধারায় একটা শূন্যস্থান আছে। নৃতত্ত্ববিদরা সেই শূন্যস্থানের নাম দিয়েছেন মিসিং লিংক। কলেজের বায়োলজির অধ্যাপক মৃদঙ্গবাবুর খুব আশা ছিল, গয়েশবাবুকে দিয়ে সেই মিসিং লিংক সমস্যার সমাধান হবে। হয়তো বা লেজবিশিষ্ট মানুষের প্রথম সন্ধান দিয়ে তিনিই নোবেল প্রাইজ পেয়ে যাবেন।
মৃদঙ্গবাবু প্রথমে খুনের খবরটা পেয়ে হায় হায় করে বুক চাপড়াতে লাগলেন। এমন কি এই শীতে গয়েশবাবুর লাশ তুলতে তিনিই প্রথম নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ঝাঁপিয়ে পড়ার পর তাঁর খেয়াল হল, ওই যাঃ। তিনি যে সাঁতার জানেন না! যখন বিস্তর জল ও নাকানি-চোবানি খাওয়ার পর তাঁকে তোলা হল তখনও গয়েশবাবুর জন্য তিনি শোক করছিলেন। পরের জন্য মৃদঙ্গবাবুর এমন প্রাণ কাঁদে দেখে সকলেই তাঁর খুব প্রশংসা করছিল আজ। যাই হোক, ধড় বা মুণ্ডু কোনওটাই গয়েশবাবুর নয় জেনে মৃদঙ্গবাবু বাড়ি ফিরে গিয়ে লেপমুড়ি দিয়ে শুয়েছেন।
সমস্যাটা মৃদঙ্গবাবুকে নিয়ে নয়, গয়েশবাবুকে নিয়ে। এই শান্তশিষ্ট এবং বিতর্কিত-লেজবিশিষ্ট মানুষটির নিকট-আত্মীয় বলতে কেউ নেই। পশ্চিম ভারতের কোথাও তিনি চাকরি করতেন। মেলা টাকা করেছেন। অবশেষে একটু বয়স হওয়ার পর দেশের জন্য প্রাণ কাঁদতে থাকায় চলে এসে পৈতৃক আমলের বাড়িটায় একাই থাকতে লাগলেন। খুব বাগানের শখ ছিল। জ্যোতিষবিদ্যে জানা ছিল। ভাল দাবা খেলতে পারতেন। ছোটখাটো ম্যাজিক দেখাতে পারতেন। তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তি ছিল। তবে মাঝে-মাঝে কোনও লোককে দেখে অদ্ভুত-অদ্ভুত কথা বলে ফেলতেন। কিন্তু অদ্ভুত শোনালেও কথাগুলির গুঢ় অর্থ আছে বলে অনেকের মনে বিশ্বাস আছে।
এলাকার বিখ্যাত ঢোলক বীর হল গোবিন্দ। তার ভাই জয়কৃষ্ণ ভাল ঢাক বাজায়। ফলে গোবিন্দর নাম হয়ে গেছে ঢোলগোবিন্দ আর জয়কৃষ্ণকে আদর করে ডাকা হয় জয়ঢাক বলে। সেবার ঈশানী কালীবাড়িতে বিরাট করে কালীপুজো হচ্ছে। কালীর গায়ে খাঁটি সোনার একশো আট ভরি গয়না। সকালবেলা দেখা গেল একটা মটরদানা হার আর একজোড়া রতনচূড় নেই। হৈ-চৈ পড়ে গেল চারধারে। দারোগা-পুলিশে ছয়লাপ। মণ্ডপের সকলকে ধরে সার্চ করা হল। পাওয়া গেল না। তোকজন কিছু সরে গেলে গয়েশবাবু ঢোলগোবিন্দের কাছে গিয়ে ভারী নিরীহ গলায় বললেন, “ঢোলের মধ্যেই গোল হে।” তারপর জয়ঢাকের কাছে গিয়ে এক গাল হেসে বললেন, “ঢাকেই যত ঢাকগুরগুর।” একথায় দুই ভাই খুব গম্ভীর আর মনমরা হয়ে গেল হঠাৎ। ঘণ্টা দুই বাদে ঈশানীকালীর সিংহাসনের পিছনে খোয়া-যাওয়া গয়না ফিরে এল। সকলেই বুঝল, গয়েশবাবুর কথা এমনিতে অর্থহীন মনে হলেও যার বোঝার সে ঠিকই বুঝেছে আর ভয় খেয়ে গয়নাও ফেরত দিয়েছে।
একদিন বাজারের রাস্তায় গয়েশবাবু কবি সদানন্দকে বলেছিলেন, “কাজটা ভাল করেননি।”
“কোন কাজটা?”
“কাজটা ঠিক হয়নি সদানন্দবাবু। এর বেশি আমি আর ভেঙে বলতে পারব না।”
গয়েশবাবুর একথায় সদানন্দ মহা মুশকিলে পড়ে আধবেলা ধরে আকাশ-পাতাল ভাবলেন। তারপর হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল, আগের রাতে যে কবিতাটা লিখেছেন, তাতে এক জায়গায় আশীবিষের সঙ্গে কিসমিস মিল দিয়েছেন। মিলটা দেওয়ার সময় মনটায় খটকা লেগেছিল ঠিকই, কিন্তু তখন ওটা গোঁজামিল বলে ধরতে পারেননি। গয়েশবাবুর ইংগিতে ধরতে পারলেন এবং তৎক্ষণাৎ কিসমিস কেটে সে-জায়গায় অহর্নিশ বসিয়ে কবিতার খাতা বগলে নিয়ে ছুটলেন গয়েশবাবুর বাসায়।
মৃদঙ্গবাবুকেও একবার জব্দ করেছিলেন গয়েশবাবু। হয়েছে। কী, গয়েশবাবুর লেজের কথা কানাঘুষোয় শুনে মৃদঙ্গবাবু প্রায়ই রাস্তাঘাটে তাঁর পিছু নিতেন। অবশ্য খুবই সন্তর্পণে এবং গোপনে। যদি হঠাৎ কখনও লেজটার কোনও আভাস-ইংগিত পাওয়া যায়। একদিন হরিহরবাবুর চণ্ডীমণ্ডপের আড্ডায় দুজনে একসঙ্গেই যাচ্ছিলেন। অভ্যাসবশে মৃদঙ্গবাবু মাঝে-মাঝে গয়েশবাবুর লেজ খুঁজতে আড়চোখে চাইছেন। এমন সময় গয়েশবাবু হঠাৎ থমকে গিয়ে চাপা স্বরে বললেন, “মৃদঙ্গবাবু! আছে! আছে!”
“আছে?” বলে মৃদঙ্গবাবু স্থানকালপাত্র ভুলে “হুররে” বলে লাফিয়ে উঠলেন।
গয়েশবাবু তখন আরও চাপা স্বরে বললেন, “কাউকে বলবেন কথাটা।”
মৃদঙ্গবাবু আহ্লাদের গলায় বললেন, “আরে না, না। তবে একবারটি যদি চোখের দেখা দেখিয়ে দেন তবে চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হয়।”
গয়েশবাবু আঁতকে উঠে বললেন, “দেখাব? না, না, তাহলে সবাই টের পেয়ে যাবে। দেখানোর দরকার নেই। শুধু জেনে রাখুন, লোকটা এখানেই আছে।”
“লোকটা? লোকটা না লেজটা? ঠিক করে বলুন তো আর একবার গয়েশদা। ছেলেবেলায় একবার গাছ থেকে পড়ে গিয়েছিলুম। সেই থেকে বাঁ কানে একটু কম শুনি।”
“লেজ!” গয়েশবাবু আকাশ থেকে পড়ে বলেন, “লেজ কোথায়? লেজের কথা বলিনি। সেই লোকটার কথা বলছি। সে-ই যে লোকটা।”
কিন্তু তখন মৃদঙ্গবাবুর কৌতূহল নিভে গেছে। কোনও লোক নিয়ে তাঁর কোনও আগ্রহ নেই। লোকেরা সব বেয়াদব, বেয়াড়া, বিচ্ছিরি। তবে হ্যাঁ, লেজওয়ালা কোনও লোক পেলে তাকে তিনি মাথায় করে রাখতে রাজী। মৃদঙ্গবাবু তাই নিস্তেজ গলায় বললেন, “কোন লোকটা?”
গয়েশবাবু মিটমিট করে একটু হাসছিলেন। বললেন, “সে-কথা পরে। কিন্তু আগে বলুন তো, লেজের কথাটা আপনার মাথায় এল কেন? কিসের লেজ?”।
মৃদঙ্গবাবু লজ্জা পেয়ে আমতা-আমতা করতে লাগলেন, খোলাখুলি কথাটা বলাও যায় না। গয়েশবাবু চটে যেতে পারেন। তাই তিনি ভণিতা করতে লাগলেন, “আসলে কী জানেন গয়েশদা, কিছুদিন যাবৎ আমি লেজের উপকারিতা নিয়ে ভাবছি। ভেবে দেখলাম, লেজের মতো জিনিস হয় না। বেশির ভাগ জীবজন্তুরই লেজ আছে, শুধু মানুষের লেজ না থাকাটা ভারী অন্যায়। লেজ দিয়ে মশা মাছি তাড়ানো যায়, নিজের পিঠে সুড়সুড়ি দেওয়া যায়, লেজে খেলানো যায়, লেজ গুটিয়ে পালানো যায়। ভেবে দেখুন, আজ মেয়েদের কত এক্সট্রা গয়না পরার স্কোপ থাকত লেজ হলে।”
গয়েশবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “খুব খাঁটি কথা। তা আমি যে-লোকটার কথা বলছি, কী বলব আপনাকে, বড়ই আশ্চর্যের বিষয় যে, সেই লোকটারও লেজ আছে। শুধু আছে নয়, সে রীতিমত আমাকে লেজে খেলাচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে।”
মৃদঙ্গবাবু “অ্যাঁ?” বলে চোখ বিস্ফারিত করেন। বলেন কী দাদা, তাহলে কি উলটো বিবর্তন ঘটতে শুরু করল নাকি? জনে-জনে লেজ দেখা দিলে তো”
এরপর গয়েশবাবু আর কথা বাড়াতে চাননি। মৃদঙ্গবাবুর বিস্তর চাপাচাপিতেও না।
কিন্তু মৃদঙ্গবাবু খুব ভাবিত হয়ে পড়লেন। শুধু এই ছোট গঞ্জ-শহরেই যদি দুদুটো লেজওয়ালা লোকের আবির্ভাব ঘটে থাকে, তবে পৃথিবীতে না জানি আরও কত লক্ষ লোকের লেজ দেখা দিয়েছে এতদিনে। বিবর্তনের চাকা উলটো দিকে ঘোরে না বড়-একটা। তবে ইংরেজিতে একটা কথা আছে, হিস্টরি রিপিটস ইটসেলফ। সুতরাং কিছুই বলা যায় না। তিনি খুব উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।
লেজের কথা আর কিছু জানা যায় না।
তবে গয়েশবাবু একদিন সন্ধেবেলায় দাবা খেলার সময় ফুচুর জ্যাঠামশাইগঙ্গাগোবিন্দকে বলেছিলেন, “রুইতনটা দেখলেই বোঝা যায়।”
গঙ্গাগোবিন্দ গয়েশবাবুর একটা বিপজ্জনক আগুয়ান বোডড়কে গজ দিয়ে চেপে দিতে যাচ্ছিলেন। থেমে গিয়ে হাতটা সরিয়ে নিয়ে বললেন, “রুই? তা কত করে নিল?”
“রুই নয়। রুইতন।”
গঙ্গাগোবিন্দ শশব্যস্তে দাবার ছকের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলেন, “রুইতন? বলো কী? এতক্ষণ তবে কি আমরা বসেবসে তাস খেলছি? দাবা নয়? এ, সেটা এতক্ষণ বলোনি কেন?”
গয়েশবাবু একটু হাসলেন। তারপর বললেন, “না, আমরা দাবাই খেলছি। কিন্তু রুইতনের কথাটা ভুলতে পারছি না।”
গঙ্গাগোবিন্দ দাবা খেলতে বসলে এতই মজে যান যে, দুনিয়ার কিছুই আর মনে থাকে না। খেলার পরেও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে অনেকক্ষণ সময় লাগে। আর যতক্ষণ তা ফিরে না আসে, ততক্ষণ তিনি লোকের কথাবাতার অর্থ বুঝতে পারেন না, জল আর দুধের তফাত ধরতে পারেন না, তারিখ মাস বা দিন পর্যন্ত মনে পড়ে না তাঁর। তাই তিনি হতভম্ব হয়ে বললেন, “ভুলতে পারছ না! কী মুশকিল!”
গয়েশবাবু মোলায়েম স্বরে বললেন, “রুইতন বটে, তবে তাসের রুইতন নয়। একটা লোকের বাঁ হাতের তেলোয় মস্ত একটা রুইতন আছে। দেখলেই চিনবেন। পাঞ্জাব থেকে পিছু নিয়েছিল। মোগলসরাইতে চোখে ধুলো দিতে পেরেছিলাম। কিন্তু গন্ধ শুকে-শুকে ঠিক খুঁজে বের করেছে আমাকে।”
গঙ্গাগোবিন্দ চোখ বুজে বললেন, “আর একবার বলো। বুঝতে পারিনি।”
গয়েশবাবু আবার বললেন।
গঙ্গাগোবিন্দ চোখ খুলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“আজকাল চারদিকে ভাল-ভাল লোকগুলোর কেন যে মাথা বিগড়ে যাচ্ছে।”
গয়েশবাবু আর একটাও কথা বললেন না। শুধু একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন।
এখন গয়েশবাবু গায়েব হওয়ার পর সেইসব কথা সকলের মনে পড়তে লাগল।