কলকব্জার যুক্তিতর্ক (নূহর নৌকা)
মানুষের জীবনে অনেক অ মানুষেরও অংশ থাকে। যেমন, গাছপালা, জন্তু-জানোয়ার, পাখি, পোকা, ব্যাকটিরিয়া, ভাইরাস। এগুলো প্রত্যক্ষ। সম্পর্ক নির্ণয় করা সহজ। গাছপালা ছায়া দেয়, ভূমি সংরক্ষণ করে, ফল ফুল শস্য দেয়। প্রধান প্রধান খাদ্যবস্তু উদ্ভিদ থেকেই মেলে। গৃহপালিত জন্তু থেকে দুধ মাংস পরিবহণ পাওয়া যায়। বনের জন্তু-জানোয়ার মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে এক খাদ্য পিরামিড তৈরি করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করছে। পাখি পোকাপুকি খেয়ে দেয়ে সাফ করে সব, জমাদার পাখিরা জঞ্জালও খায়, কেউ কেউ মাংস এবং ডিম দেয় আমাদের আহারের জন্যে। ব্যাকটিরিয়া ভাল আছে, মন্দ আছে। ভাইরাসও তাই। আসলে, মানুষের ভাল-মন্দ সূত্রে তাদের কথা আমরা ভাবি, পড়ি। কিন্তু মানুষের জন্যেই তারা সৃষ্টি হয়েছে এ কথা বোধহয় সত্যি না। সে যাই হোক। কিন্তু যন্ত্রপাতি? তারাও তো আমাদের জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ? আমরাই তৈরি করেছি, ধাতু ব্যবহার করে।
একটা তালা ধরুন। কী চমৎকার তার কেজো চেহারাটা। গোল হাতল, চৌকো কিম্বা গোল বডি, ভেতরে একটি কল আছে। হাতলের সঙ্গে খাপে খাপে বসে যায়। হয় এমনি লক হয়ে গেল। তা নয়তো চাবি দেওয়া হবে। বহু দিন আগে উদ্ভাবিত হয়েছে, কিন্তু ছোট্ট হলে কী হবে সামান্য নয়। আজ তার ব্যবহার এমন ছড়িয়ে পড়েছে যে, তালা তৈরি করেই এক জন কোটিপতি হতে পারে। যে দিকে চাও তালা ঝুলছে। এ বাড়িতে কেউ থাকে না— তালা। এ বাড়ির লোক বেড়াতে গেছে ডবল তালা। স্যুটকেশ, ট্রাঙ্ক, আলমারি, সিন্দুক, কোল্যাপসিব্ল গেট। সর্বত্র তালা ঝুলছে। অফিস টাইম শেষ হল। চলল দারোয়ান ঘরে ঘরে তালা মারতে মারতে। দোকান বাজার অফিস বসতবাড়ি বাক্স দরজা লিফট, সব জায়গায় তালা তালা তালা। ছোটখাটোগুলো আবার হারায়, খুব। আবার কেনো-ও সুতরাং।
ঠিক এমনি মোটর বাইকও একটা যন্ত্র। তার পার্টস আসতে পারে নানান খুচরো কারখানা থেকে। তার পর খুটখাট সব ফিট করে ধাপে ধাপে গড়ে উঠতে থাকে মোটরবাইক। রং হয়। চকচকে ঝকঝকে। তার পর সব আসে ঝিঙ-চ্যাক্ শো-রুমে। একটু হেলিয়ে ২৫০ ডিগ্রি মতো কোণ করে তাকে তাদের সাজিয়ে রাখা হয়। সেজেগুজে পোজ নিয়ে যেন একদল যূথবদ্ধ নর্তক। চমৎকার কোরিওগ্রাফি রেডি। শিগ্গিরই শুরু হবে তালে তালে নাচ। এইটুকু আমরা সবাই জানি। টেকনিক্যাল ডিটেল, খুঁটিনাটি জানবার মতো যন্ত্রোৎসুক আমরা নই। কিন্তু মোটরবাইক জানে। তাকে জানতে হয়। তার টায়ার, তার টিউব, সিট, পিলিয়ন, ব্রেক, স্টার্ট প্রত্যেকটি যন্ত্রাংশকে চালু রাখতে শুধু ডিজেল নয়, তাতে সামগ্রিক ইচ্ছাশক্তি লাগে। ছোট ছোট নাট, বল্টু, স্ক্রু, স্প্রিং, ফোম, ইস্পাত, প্লাস্টিক, চামড়া সমস্ত অজৈব বস্তুর মিলিত এক অন্ধ ইচ্ছাশক্তি। বস্তুপুঞ্জের একটা ভারও তো আছে। আর ভেঙে ভেঙে ফেললে তো সেই একই অ্যাটম কণা, যা পাখির, জন্তুর, গাছপালার, মানুষের শরীরেরও আদি বস্তু। তা হলে কী করে বলি তার ইচ্ছাশক্তি নেই! দেখতে পাচ্ছি না, বুঝতে পারছি না এই পর্যন্ত।
এবং কারখানা। সে-ও তো এক গৃহ। সেখানে বাস করে কল-কব্জা, বড় বড় মেশিন। সারা দিনের কাজের পর মানুষ ফিরে গেলে তালা পড়ে গেটে। তখন কারখানার ভেতর দিকে তাকালে দেখা যাবে অন্ধকারে ভুতুড়ে সব আকার। মেশিনপত্তর সব যে যার জায়গায় স্থাণু। কিন্তু যেন কিছু চালাচালি করছে তারা। কথা নয়, তাদের নিজের জগতের কোনও ধরনের কমিউনিকেশন। কত কারখানা পড়ে আছে বড় ছোট। সেগুলো পোড়ো। যন্ত্রে জং ধরছে। নাম কা ওয়াস্তে এক দারোয়ান আছে। সে নিজের দারোয়ানগিরিটাকে খুব গুরুত্ব দেয় না। দেশোয়ালিদের সঙ্গে ফুর্তি করতে যায়।
ছোট কারখানা। কারও একক প্রচেষ্টায় হয়তো গড়ে উঠেছিল। ক্রমবর্ধমান মার্কেটের বিলিয়ন ডলারের সঙ্গে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি-বাণিজ্য-বিপণন চক্রের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া তার কম্মো নয়। ভাল কণ্ডিশন-এর যন্ত্রপাতি সে বেচে দিয়েছে। পুরনো মডেলের মাল কিছু রয়ে গেছে। আছে শেডটা। আর জমি। এইটুকু বেচে দিতে পারলে উদ্যোগপতি নিজেকে ধন্য মনে করবে। কী কুক্ষণেই বেচারা ক্ষীয়মাণ চাকরির দুনিয়ায় সেল্ফ-এমপ্লয়মেন্টের হুজুগে কান দিয়েছিল। কুড়ি-পঁচিশ বছরের শ্রম, মগজ খাটানো। তিল তিল করে জমানো পয়সা, ব্যাঙ্ক লোন। তার সুদ কষা, টেনশন, সব শেষে উদ্যোগপতি এখন ফ্রি মার্কেটের, বিশ্বায়নের বলি। ঘরে বসে আছে। রক্ষা এই যে, খুব বেশি লেবর ছিল না। এক এক করে বিদায় দিতে পেরেছে। লোকসান স্বীকার করে কোনও মতে বেঁচে থাকা সম্ভব হচ্ছে। কার চাকর হবে এখন, উদ্যোগী ভাবছে মনে মনে। ডিগ্রির চেয়ে কারিগরি বুদ্ধি ছিল বেশি। তাই।
ইতিমধ্যে বন্ধ কারখানাই কি ভাবছে না? কী প্রয়োজন ছিল এ সবের, যদি এই ব্যর্থতাই কপালে লেখা ছিল! কারখানা মনে করতে পারে, এক পয়লা বৈশাখ তার মহরতের কথা। কলাগাছ, নতুন কলসিতে আম্রপল্লব, আর ডাব। গণেশ পুজো। লুচি-মণ্ডার প্রসাদ। পার্টস আসত নানান জায়গা থেকে। সে সব অ্যাসেম্বল করে ওয়াশিং মেশিন। তখন জিনিসটার এত রমরমা ছিল না। ধনী লোকের বাড়িতে, বড় বড় হোটেলে, হাসপাতাল-নার্সিংহোমে সাপ্লাই যেত ‘পালসার’। আজও সেগুলো বিনা আয়াসে চলছে। বড় বড় ব্র্যাণ্ড যেই বাজারে এসে গেল, তারা চতুর্দিক ছেয়ে দিল বিজ্ঞাপনে। বড় বড় শো-রুমে ক্রেডিটে পাঠিয়ে দিল মাল। চতুর্দিক তাদের মহার্ঘ প্রতিশ্রুতিতে ভরে গেল। পালসার তার শপথ ভাঙেনি। কিন্তু তার বিজ্ঞাপন কই? হোর্ডিং? নামী দোকানে তার ঝাঁ-চকচকে শো! ব্র্যাণ্ড নেম কই? একটা পণ্যের পেছনে একটা বড় বিজনেস হাউজের নিরাপদ উপস্থিতির নাম ব্র্যাণ্ড নেম। পালসার-এর কি তা ছিল? তা হলে কেন সেল্ফ এমপ্লয়মেন্টের ঢাকটি বাজালে?— শূন্য কারখানার বাঁ দিকের ফাঁকা বাতাস প্রশ্ন করে ডান দিকের ফাঁকা বাতাসকে। ফিস ফিস করে কে বলে— ইকন্মিক্স— ম্যাক্রো, মাইক্রো, চক্কর-বক্কর, জি ডি পি, ম্যালথাস, কেইনস, গ্রামীণ, শহরীণ ঝক্কড়-মক্কড় গ্যাট ম্যাট ক্যাট।
ইংরেজি নববর্ষের আগের দিন। খবরের কাগজের আপিসে বাসর জাগিয়ে বসে আছে কম্পিউটার আর ফ্যাক্স যন্ত্র, টেবিলে টেবিলে দিন কি রাত বোঝা যায় না এমন আলোয় নির্ঘুম সাংবাদিক নিউজ ডেস্কে।
শশাঙ্ক আজ পেয়েছে অতুল বণিক ফটোগ্রাফারকে। শশাঙ্ক-অতুলের যুগলবন্দির সুনাম আছে। পার্ক ষ্ট্রিট কভার করে কানেক্টর দিয়ে ছুটছে প্রেসের গাড়ি। সামনে প্রচুর গাড়ি বাইকের গাঁদি। অতুল টুকটাক ছবি তুলে নিচ্ছে। নতুন গজিয়ে ওঠা হোটেলগুলো আপাদমস্তক আলোকসজ্জায় সেজেছে। বাইরে গাছপালা ঝোপঝাড় সব কিছুতে আলো। আলোর তাল গাছ। আলোর ঝাউ।
—যে কোনও উৎসবই এখন বিজ্ঞাপন হয়ে যাচ্ছে, খেয়াল করেছিস, শশাঙ্ক?
—হুঁ।
—ক’বছর ধরে বিজ্ঞাপনের হাত পাকড়ে উঠে আসছে পয়লা বৈশাখ। আচ্ছা বলতো, পয়লা বৈশাখে হালখাতা ছাড়া আর কী কী ছিল!
—আমার তো কিছুই ছিল না।
—সে তুই মফস্সলি বলে। কয়লা-টাউনে ছোটবেলা কাটিয়েছিস। আমরা পয়লা বৈশাখ দেখেছি কিছু কিছু। ধর, ছুটি তো নিশ্চয়ই। আরে এই গরমের দেশে মানুষ কাঁহাতক গা ঘামাবে? বাবার হাত ধরে দোকানে দোকানে নেমন্তন্ন রক্ষা করতে যেতুম। মিষ্টির বাক্সো, কিংবা মাটির প্লেটে করে গুচ্ছের মিষ্টি। ছোটবেলায় দারুণ লাগত কিন্তু। নতুন কাপড় হত, বিশেষ বাড়ির মেয়েদের। তখন তো সারা বছর ধরে এমন লাগাতার মার্কেটিং ছিল না। বাল্ক কেনাকাটা পুজো আর পয়লা বৈশাখ। দুুটোতেই ডাহা সেল। বচ্ছরকার জিনিস কেনো। এখন সব পুঁচকে পুঁচকে ছেলেমেয়ের ওয়ার্ডরোব নিয়ে কভার স্টোরি করতে হচ্ছে। হেসে আর বাঁচি না।
শশাঙ্ক বলল—হুঁ।
—আচ্ছা এরা কি বাংলার নববর্ষটাকে বাংলার, বাঙালির প্রতি বিগলিত প্রেমে রিভাইভ করতে চাইছে?
—না।
—আরে ঝেড়ে কাশো না বাবা। কী তখন থেকে সুন্দরবাবুর মতো হুম হাম করছ।
—কে সুন্দরবাবু?
—সে তুমি চিনবে না। একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর। আমার কথাটার জবাব দে।
—জবাব তো তুমিই একটু আগে বলে দিলে। বিক্রি, আরও বিক্রির যে কোনও সুযোগ এরা প্রোমোট করবে।
—ধর মে-ডে’র সেলিব্রেশন লাল পতাকা, লাল কার্ড, লাল মিষ্টি, লালমোহনবাবু, লাল দই…কিংবা ধর, বিশ্বকাপ পরাজয়ের পোস্টার, স্ট্যাচু মানে পুতুল-টুতুল। সচিন ‘থিংকার’-এর পোজে, রাহুল ক্রুসে ঝুলছে। সৌরভ অ্যাপলোর মতো মাসকুল ফুলিয়ে এইসা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
শশাঙ্ক বলল— সুনামি নিয়েও করতে পারে। সুনামি-ডে। আসুন অ্যাকোয়া ওয়র্ল্ড, এসেল ওয়ার্ল্ড, সুনামি উপভোগ করুন, টোয়েন্টি মিটার ঢেউ, ঝড়ের গতি টু হানড্রেড কিলোমিটার্স পার আওয়ার। বিধ্বস্ত হয়ে যান। তার পর তার পর ফিউশন ডিনার। কেন বলো তো? সুনামির পর তো তোমাকে যা পাচ্ছ সাপ-ব্যাঙ তাই-ই খেতে হবে। সুনামি রেসিপির কম্পিটিশন হায়াত কী তাজ বেঙ্গলে।
—ব্রেনগুলো গুরু পেল কোত্থেকে বল তো!
—সব কিছুরই কোর্স হয়েছে আজকাল অতুলদা। ভর্তি হয়ে যাও।
—সামনে একটা গোলমাল পাকাচ্ছে মনে হচ্ছে?— অতুল বণিক মন্তব্য করল।
একটা ব্লু সিয়েলো মেন রাস্তা থেকে বাঁ দিকে নেমে যাচ্ছে। পেছনে কতকগুলো মোটরবাইকও।
—রাস্তা ছোড়ো ইয়ার— আপন মনেই বলল অতুল। তার খুব ফুর্তি আজ।
একটি বিখ্যাত ফাইভ-স্টার হোটেলের নিউ-ইয়ার ধামাকার খুঁটিনাটি কভার করে মনের সাধে পাইন-অ্যাপল অ্যাণ্ড পিসতাশিও চিকেন, পায়েস ক্যারামেল, বেকড ফ্রুটস বেগমবাহার, মোগলাই ক্যাসর্টো ইত্যাদির ছবি-টবি তুলে সেই জায়গাটাতে দু’জনে যখন ফিরল তখনও সিয়েলো গাড়িটা দাঁড়িয়ে, গলির মোড়ে কেমন সন্দেহজনক ভাবে বেঁকে। কাছে গিয়ে দেখল পরিত্যক্ত। দরজা হাতল ঘোরাতেই খুলে গেল। নামো অতুলদা— শশাঙ্কর গলায় যেন আদেশের সুর।
—আরে ছোড় না ইয়ার। সিয়েলোকো কোই ছোড় সাকতা নহি ক্যা?
কিন্তু শশাঙ্কর সেই বিখ্যাত নাক, তাকে দিয়ে প্রেসের গাড়ি থামায়। অতুলকে নামতে বাধ্য করে। খোলা গাড়ির ড্যাশবোর্ডে কোনও চাবি নেই এবং সামনের সিট দুটোয় চটচটে গাঢ় রঙের কী একটা পদার্থ, টর্চের আলো পড়তেই বোঝা গেল রক্তই। অতুল বণিক বলল— ইউ উইন ম্যান। চলো এক্সপ্লোর করা যাক।
শশাঙ্ক প্রথমেই তার সেলফোনে লালবাজারে খবর দিল। তার পর গাড়িটা গলির মুখে আড়াআড়ি থামিয়ে ঢুকল। এবং তখনই মাটি কাঁপছে বুঝতে পারল। না বোমাটোমা নয়। মাটি তাকে দ্রুত বুঝিয়ে দিল গরগর করতে করতে কিছু মোটরবাইক আসছে। অচিরেই খ্যাপা মোষের মতো ছুটে এল তিনখানা। চার সওয়ারি নিয়ে। উল্টো দিক থেকে এমন জোরে যেন পৃথিবীর শেষ প্রান্তে পৌঁছবার তাড়া তাদের। শশাঙ্ক তার হাতের শক্তিশালী টর্চটা তাক করল সোজা সামনের বাইক সওয়ারির চোখে। গোঁত্তা খেয়ে উল্টে গেল গাড়িটা। পেছনের দুটোও স্পিডে আসছিল, প্রায় এ ওর ঘাড়ে পড়তে গিয়ে সামলে নিল। বাইকরা সমস্বরে বলল— ডিগবাজি খেলাম মালিক, খেতে হল, মনে কিছু কোরো না।
অকথ্য গালাগাল ভেসে এল ও দিক থেকে— শুয়োরের বাচ্চা, সান অব আ বিচ এবং চলতি চার অক্ষর। এই সময়ে অদূরে গাড়ির ‘প্রেস’ লেখাটার ওপর অতুল বণিকের টর্চের আলো পড়ল। দু’জন দুদ্দাড় করে এ দিক ও দিক পালিয়ে গেল। মোটর বাইক নিয়েই, আশপাশের এবড়ো খেবড়ো ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে। গোঁত্তা খাওয়া বাইকটা ফেলে রেখে প্রথম জন পায়দল ভাগতে থাকল। বাইক গোঁ গোঁ করে বলল— আমি প্রাণহীন যন্ত্রমাত্র। আমার কাজ আমি করেছি। এ বার তোমরা বুঝে নাও। ড্রাইভারের হাতে বাইকটা জিম্মা রেখে দু’জনে এগোচ্ছে।
অতুল বলল— গাড়ি ছিল, লোকটাকে চেজ করা উচিত ছিল কিন্তু।
—বাইকটা তো আছে। পুলিশ বুঝবে।— শশাঙ্ক আর সময় নষ্ট করতে চায় না। কেন সিয়েলো গাড়ি পরিত্যক্ত খোলা পড়ে থাকে। মোটরবাইক আরোহী চার জন এ দিকে কোথায় গিয়েছিল, কেনই বা খ্যাপা মোষের মতো ছুটে আসছিল, পালালই বা কেন? তাকে জানতে হবে। সে কিছু একটা টের পাচ্ছে।
সামনে একটা কারখানা। মস্ত গেট বন্ধ, কোথাও কেউ নেই। অতুল বলল— হল তো?
শশাঙ্ক এগিয়ে গিয়ে দরজার তালাটা ধরতেই সেটা শব্দ করে পড়ে গেল। কল বই তো নই। যা করেছি খুব করেছি— তালাটা খুব নিচু ডেসিবেলে বলল। শশাঙ্কর রগের শিরা প্রচণ্ড লাফাচ্ছে। সে ঠ্যালা দিতেই কারখানার পুরনো দরজা কব্জাগুলোর ওপর দুলতে লাগল। যেন তাকে পথ করে দিল। ক্ষীণ গোঙানি ভেসে আসছে না!
দৃশ্যটা এই রকম: একটি সদ্য চল্লিশোর্ধ্ব মহিলা এবং বছর চোদ্দো মেয়ের ছিন্নভিন্ন পোশাক, প্রায় নগ্ন পড়ে আছে, হতচেতন। মেয়েটির মুখ দিয়ে অস্ফুট গোঙানির শব্দ উঠছে। দু’জনেরই কান রক্তারক্তি, ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে গয়না। ভদ্রমহিলার হাতও ক্ষতবিক্ষত। সেখানেও কিছু ছিল। স্টিলেটো পরা এক পায়ে। মেয়েটির রিবক রক্তে ভিজে চুপচুপে।
কাছাকাছি ঝোপে এক ভদ্রলোকের অর্ধমৃত দেহ পুলিশই আবিষ্কার করে। তিন জনকেই কাছাকাছি নার্সিং হোমে পাঠানো হয়। ভদ্রলোক রাত্তিরেই কোমায় চলে গেলেন। তাঁর মাথার পেছনে মারাত্মক আঘাত। ভদ্রমহিলা তিন দিন যুঝে লড়াই শেষ করলেন। মেয়েটি বেঁচে গেল। তবে, সে কাউকে চিনতে পারছে না। হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার করে উঠছে।
কাগজপত্র থেকে আবিষ্কার হল ভদ্রলোক এক নামী কোম্পানির উচ্চপদস্থ মানুষ। শৈবালসাধন গুপ্ত। স্ত্রী সাহানা গুপ্ত ডাক্তার। ইনিও বেশ কয়েকটি সংস্থার নিজস্ব ডাক্তার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। মেয়েটির নাম মিলি। সে একটি নামী স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ত। কিন্তু এঁদের কোনও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনকে কলকাতা শহরে পাওয়া গেল না। খবর সংগ্রহ হল, সাহানার দুই ভাই অষ্ট্রেলিয়ায় সেটল্ড। শৈবালসাধন একমাত্র সন্তান। বাবা-মা গত। বাবাও খুবই উচ্চপদস্থ ছিলেন। মাসতুতো-পিসতুতো ডিরেক্ট কেউ নেই। এক থার্ড কাজিন দম্পতি অনেক সাধ্যসাধনার পর পুলিশের গুঁতোয় এলেন। আমতা আমতা করে যা বললেন বোঝা গেল, গুপ্ত দম্পতিটি একটু হাই-ব্রাও গোছের ছিলেন। মধ্যবিত্ত আত্মীয়দের সঙ্গে তেমন আসা-যাওয়া ছিল না।
কাগজে দীর্ঘ দিন এই খুন ও ধর্ষণের বিবরণ ও সেই নিয়ে চিঠিপত্র চলতে থাকল। কিন্তু দিনের শেষে দেখা গেল মিলি নামের মেয়েটির দায়িত্ব নিতে কেউ নেই। স্কুল হস্টেলে রাখার কথা হয়েছিল। প্রিন্সিপ্যাল বললেন— একটি রেপ-ভিকটিমকে হস্টেলে জায়গা দিয়ে অন্য বোর্ডারদের মানসিক স্থৈর্য নষ্ট করার ঝুঁকি তিনি নিতে পারবেন না, অধিকারও তাঁর নেই। অভিভাবকদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তিনি দুঃখিত।
—তা হলে আর কী? আপাতত সরকারি হোম।
শশাঙ্ক বলল— না।
চেষ্টা চরিত্র করে নার্সিং হোমের মেয়াদটা বাড়ানো হল। কিন্তু সারা কলকাতা ঢুঁড়ে এ রকম মেয়ের জন্য কোনও আশ্রয় ও চিকিৎসার কেন্দ্র পাওয়া গেল না। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বন্ধ বাড়ির চাবি খুলল। এক জন সর্ব সময়ের নার্স নিযুক্ত হল। ব্যস এর বেশি আর কী? মেয়েটির কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা অবশ্যই শশাঙ্কর। সে নানা কাজে ব্যস্ত। মোটরবাইকের সূত্র ধরে চার মস্তানের খোঁজে পুলিশ কতটা এগোল, আর এক দিকে আইনি পরামর্শ। মেয়েটি মাইনর। তার কোথায় কী আছে, বাবা-মা’র ইনসিওরেন্স, তাঁদের টাকাপয়সা, সাকসেশন সার্টিফিকেট। নানান ঝামেলা। একটা নিজস্ব অ্যাকাউন্ট আছে তার। তাতে দেড় লাখের ওপর টাকা জমা রয়েছে ওইটুকু মেয়ের নামে। কী করত ও এত টাকা? বাবা-মাই রাখতেন নিশ্চয়। ইনকাম-ট্যাক্স ফাঁকি? না শুধুই আদর? যাই হোক এটাই আপাতত তার একমাত্র ভরসা।
ব্যস্ততা আর বিপন্নতা যখন ক্রমশই বেড়ে চলেছে, নাওয়া-খাওয়া মাথায় উঠেছে, সেই সময়ে জামসেদপুর সাকচি থেকে ফোন এল।— চিনচিন আমাকে মা বলে ডাকছে দাদা, ও ভাবছে আমিই ওর মা। ছেলেটা যে কী মায়াবী, কী মিশুকে ভাবতে পারবেন না। আমাদের এখানে সবাই ওকে নিয়ে মুগ্ধ। আমি কি ওকে কোনও ভাবে দত্তক নিতে পারি?
কঙ্কণা চিনচিনকে দত্তক নিতে পারে কি না সে কথা শশাঙ্ক কী করে বলবে? বলতে পারে লোটন। কঙ্কণা কেন তার স্বামীকে একটা লং ডিসট্যান্স কল-এ ডেকে জিজ্ঞেস করছে না? এই পরামর্শ ছাড়া আর কী বলতে পারে সে কঙ্কণাকে? এরই মধ্যে চিঠি এসেছে, মোটা পার্সেল ক্যুরিয়ারে কার্তিক সামন্তর কাছ থেকে।
—বহু কষ্টে গোপনে এই পত্র পাঠাইলাম। বাবাজি, স্বহস্তে লিখিত এই ইচ্ছাপত্রও সঙ্গে দিলাম। স্থাবর-অস্থাবর যাবতীয় সম্পত্তি যা আমার নামে আছে তা অতঃপর চিনুর হইবে। ইহারা এখনই নিজেদের নামে ট্রান্সফার করাইতে চাহিতেছে। পুত্রটি ছিল আমার বয়সের, অনেক সাধ্য-সাধনার, দোকানগুলিতে কর্মচারী রাখিয়াছি। ইহাদের তাহা পছন্দ নয়। সোজাসুজি কিছু করিতে পারিতেছে না। দেহে মনে ভাঙিয়া গিয়াছি। কিন্তু যাহারা আমার পুত্র-পুত্রবধূকে খুন করিল, আমার নাতিকে আমার কাছ হইতে কাড়িয়া লইল, হরে-দরে তাহাদের কোনও না কোনও সময়ে শাস্তি দেখিয়া যাইব। আমি থাকিয়া থাকিয়া গর্জিয়া উঠি, খুনের কিনারা করো, বলাই নিতাই তোমাদের দাদা বউদির, আদরের ভাইপোটির খুনের কিনারা করো। উহারা কুঁকড়িয়া যায়। তোমাকে সহি করা চেকবই, পাসবই পাঠাইলাম। ইনভেস্টমেন্ট শেয়ার সকলই লকারে আছে। চেকে টাকাগুলি তুলিয়া লইও। যাহা লকারে আছে কোনও সুযোগে বাহির হইয়া হস্তান্তর করিব। ফোনে চিনুর খবর পাইয়াছি। তুমি এ-ধার মাড়াইও না। বড় ভাল হয় তোমার ভ্রাতৃজায়াটি যদি চিনুকে আপন সন্তানের সহিত মানুষ করে। আমি তাহাকে রক্ষা করিতে পারি নাই। তাহার উপর আমার কোনও দাবি নাই। ভাবিও না বুড়া নিজের দায় তোমার উপর চাপাইতেছে। আর্থিক ভার সকলই আমার। শুধু শপথ করো চিনুর স্বার্থ নিঃস্বার্থ ভাবে দেখিবে।