Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নূহর নৌকা || Bani Basu

নূহর নৌকা || Bani Basu

জায়গাটা নির্জন। ডালপালা মেলে কিছু গাছ বসবাস করে। যেমন একটা বুড়ো অশথ। ঋতুতে ঋতুতে যার ছোকরা সাজবার, টেরি ঘোরাবার সাধ যায়। ডুমুর গাছটা উঠে ছিল প্রথম পাঁচিল ফাটিয়ে। আরও তুবড়ে গেছে পাঁচিল, কিন্তু তার ইট বেয়ে বেয়ে ডুমুর পেয়ে গেছে তার পায়ের তলার মাটি। বড় বড় খসখসে পাতাগুলো বুড়ো হয়ে গেলে ঝুপঝাপ করে নীচেই পড়ে। বৃষ্টিতে ভিজে, পোকা পতং এর সঙ্গে মিলেমিশে রোমশ মাটি তৈরি করতে থাকে, তার ওপরই ডুমুরের বাড় বাড়ন্ত। বনতুলসীর একখানা ঝোপ রে রে করে চার দিকে ছড়িয়ে পড়ে একখানা থেকে দশখানা হয়ে গেছে। কোথায় তার শুরু, কোথায় শেষ বোঝা দায়। তুলসী মঞ্জরীর সোঁদা সোঁদা বুনো গন্ধে ভারী হয়ে থাকে হাওয়া। এরই মধ্যে আছে দাগড়া দাগড়া শিরকাটা পাতার এক আদ্যিকালের গুলঞ্চ। ক্বচিৎ কখনও ফুল ধরে। তাতেই তার গুমোরে মাটিতে পা পড়ে না। এবড়ো খেবড়ো মাটি আঁকড়ে থাকে শিয়ালকাঁটা, পাথরকুচি, দুব্বো ঘাস।

সে এখানেই ছিল। জ্যামিতিক বিন্দুর যেমন দৈর্ঘ্য প্রস্থ বেধ নেই তবু সে আছে, তারও তেমন জল নেই, পাড় নেই, ব্যবহার নেই তবু সে ছিল। যে যেখানে থাকে তার কিছু কাজ, কিছু দায়ও থাকে। অশথটা ঝিলিমিলি আলোছায়া দেয়, নতুন ফাগুনে পাতায় পাতায় শ্যামকাঞ্চন বাহার দেয়, শুঁয়োপোকা লাগলে লোকে দুদ্দাড় করে ছুটে এসে গোছা গোছা ডুমুর পাতা নিয়ে যায়, শুঁয়োলাগা গায়ে ঘষলেই শুঁয়োগুলো উঠে আসবে, এমনই তার গুণ। ডুমুরও পেড়ে নিয়ে যায় লোকে, রেঁধে খাবে। তুলসীর পাতা নেয় মুঠো মুঠো, সর্দি কাশিতে কাজে লাগে, তুলসী নির্বিকারে দিয়ে যায়, ভারী একটা আত্মপ্রসাদ তার। গৌরব। অফলা গুলঞ্চটার অবধি আঁকাবাঁকা ডালে কেমন অনৈসর্গিক চিত্ররূপের বাহার! কোনও এক বছরে প্রচুর হলুদগর্ভের ফুল সে ফুটিয়েছিল, ভবিষ্যতেও ফোটাবে বলে হৃষ্ট হয়ে আছে। শুধু তারই প্রশ্ন প্রখর রোদের টান ওঠা গ্রীষ্মের আকাশের দিকে চেয়ে।
রোদ বলে— আমি খুঁড়িনি হে, আমায় শাপান্ত কোরো না।|
আকাশ বলে— রোদে জলে আমার বুক বারো মাস ভেসে যায়, সে কি আমার দোষ? তার উৎপত্তি প্রকরণ আমি কি কিছু জানি?
গ্রীষ্ম বলে— দিনে আসি রাতে যাই, কারও কথায় আমার কাজ নাই।
কত গভীর করেই না খুঁড়েছিল। খুঁড়তে খুঁড়তে পাতালে পৌঁছে গিয়েছিল, বাসুকি নাগের রাজ্যে। নাগ গর্জন করে বলেন— জল নেই, খুঁড়ো না, ফিরে যাও।
— কিন্তু এ তো নিয়মের বাইরে নয় নাগ। পাতালপ্রদেশে জল থাকে, মাটির আঁশ আঁট কাঁকরের বড় ছোট নানান স্তর পেরিয়ে জলের ধারা চুঁইয়ে চুঁইয়ে সে তোমার রাজ্যেই স্বচ্ছ অমল সলিল হয়ে জমা হয়।
— হত, হচ্ছে না। পাতাল রাজ্যে হাহাকার। আশে জল পাশে জল, জল আমাদের রসাতল, তো সেই অতলান্তিকে টান পড়েছে হে। ফেরত যাও।
তবু খন্তারা ফেরে না। তখন ক্ষ্যামা ঘেন্নায় বাসুকি এক আঁজলা জল দিয়েছিলেন। সেই এক অঞ্জলি এখনও তার হৃৎ প্রদেশে জমা আছে। সযত্নে রেখেছে। বর্ষাবাদলে একটু বাড়ে, গ্রীষ্মে উবে যায়। পড়ে থাকে যোগ বিয়োগের শেষে নিট ফল সেই আদি এক অঞ্জলি জল। তাতে পাতা ঝরে, পাতা পচে, ঘন সবুজ কালচে মতো শ্যাওলাদাম, তলায় ভিজে মাটিতে থকথকে গোড়ালি ডোবা কাদা। তাতে উই চিংড়ি, জলমাকড়, ব্যাং ব্যাঙাচির ফরফরানি, পাঁকাল কালো শ্যাওলাগহন বুক আর মুখ, যা হৃদয় তাই-ই তার নয়ন, তাইই শ্রবণ, এমন এক এ পাঁচ পঞ্চেন্দ্রিয় নিয়ে সে প্রশ্ন উঁচিয়ে জেগে থাকে গোল নীল রুটির মতো দৃশ্যমান আকাশটুকুর দিকে মুখ করে।
বেড়াল লাফিয়ে নামে শব্দহীন পায়ে। পার হয়ে যায় সা নির্জন, মনুষ্য সংসারের পাঁচিলে আলসেয় ঘোরাফেরাই তার স্বাস্থ্য বজায় রাখে। নেড়ি কুকুর তুরতুর করে দৌড়ে যায় শুকনো পাতায় খড়খড় শব্দ তুলে। তুলসীঝোপের পাশটাতে তার আঁতুর, কুঁই কুঁই করতে করতে সেখানেই সে ঝুলিভর্তি বাচ্চার জন্ম দেয়। কামড়াকামড়ি, মারামারি, রঙ্গভঙ্গ গড়াগড়ি, সে বেড়াল বলো, কুকুর বলো, ইঁদুর ফড়িং সব বাবাজির জীবলীলা অবাধে চলতে থাকে এই ভূমির ওপর। এই সব ইতর জীবনের চলাচল, শব্দবর্ণগন্ধ — সবই সে টের পায়। কিন্তু তার কাছে কিছু চেয়ে কেউ আসে না। অশথ, ডুমুর, তুলসীদের কাছে প্রাণীর প্রার্থনা আছে, তার কাছে নেই কোনও প্রত্যাশা, কোনও প্রার্থনা। এবং এ তার এক রহস্যময় অহেতুক ভয়ও বটে। যদি গহ্বর দেখে কেউ তেষ্টা নিয়ে আসে? যদি বলে, জল দাও। স্নায়ুতন্ত্র দিয়ে ভয়ের শিহরন বয়ে যায়, লজ্জার। শিহরন বেয়ে বেয়ে মাকড়সারা উঠতে থাকে লম্বা সরু শনের ফেঁসোর মতো ঠ্যাং এ, ইঁদুর হেঁটে যায় ছাতা হাতে সার্কাস মেয়ের মতো, ব্যাঙ লাফিয়ে লাফিয়ে পার হতে থাকে গিঁটের পর গিঁট। এবং গভীর রাতে কটু গন্ধে ভরে যায় তার চার পাশ। অন্ধকারে অগ্নিমুখ জ্বলে নেভে, জ্বলে নেভে। অজ্ঞান অন্ধ তিমিরে গা মিশিয়ে নেশা করে রোগা রোগা, হনু জাগা, চোয়াল সর্বস্ব গেঞ্জি লুঙ্গি। শিঁটকে যায় সে। কুকুর বেড়াল আদি যতেক প্রাণী তো মলমূত্র ত্যাগ করছেই, মানুষও বাদ যাচ্ছে না। জল বাতাস আলো রোদ শুষে নিচ্ছে যা পারছে, বাকিটুকু মাটির দায়। বর্ষাকালে আরও সবুজ, আরও সরস হয়ে উঠবে। কিন্তু এই কটু গন্ধের তরল বাষ্পীয় নেশা দ্রব্য মাটি নেয় না। বায়ু প্রত্যাখ্যান করে। তাই দশগুণ হয়ে সে ঝাঁঝ পাক খেতে থাকে তার বদ্ধ বাতাসে। সে হাঁপিয়ে ওঠে, ককিয়ে ওঠে। কেননা, সে এক নিষ্ক্রিয়, নিষ্কর্মা কুয়ো, যে কোনও দিন জল দিতে পারেনি বলে তার পাড় আধ বাঁধাই রেখে লোকে চলে গেছে।
জায়গাটা কিন্তু বনজঙ্গল নয়। গ্রামগঞ্জও নয়। খুঁজতে জানলে শহর বাজারের আনাচে কানাচে কিছু কিছু এমন পোড়ো জমি পাওয়া যায়। আশে বাড়ি, পাশে বাড়ি, একতলা, দোতলা, ফ্ল্যাটগুচ্ছ, বড় বাড়ি, ছোট বাড়ি, টালিচাল, খোলা চাল, গা ঘেঁষাঘেঁষি ঘোঁট এক, দলা পাকিয়ে রয়েছে একেবারে অপরিকল্পিত। বাড়িগুলোর পেছন বাগে পকেটে আধগোঁজা রুমালের মতো এলোমেলো পড়ে থাকে ক্ষেত্রফলের হিসেবের বাইরের কোনাচে, আঁকা বাঁকা জমি। হিসেব করে যার মালিকানা শেষমেশ সাব্যস্ত হল, ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে একটু পাঁচিল দিল কি না দিল, কোণে কোণে থাম গেঁথে রাখল। তার পর জমি প্রকৃতি ও প্রাকৃত জনের খপ্পরে। কে জানে হয়তো জমির জমিদার সব দরকারের মূল দরকার জল বুঝে সর্বাগ্রে কুয়োটাই খুঁড়তে গিয়েছিল। জল না পেয়ে আর দালানটা তোলেনি। কালে কালে লোকে ভুলে যাক জলহীনতার কথা, তখন ভাল দামে বেচবে।
এরাও কিন্তু কংক্রিট জঙ্গলের এক ধরনের ফুসফুস যন্ত্রই। তাই গুল্টু, প্যান্তা, মাকু, গনারা গুলতানি করতে এখানেই আসে। নেশার আসর, জুয়োর আসর। কিছু পাতি লাভার এবড়ো খেবড়ো পাঁচিলের ধার বুঝে তোয়ালে পেতে বসে, ফুসফুস গুজগুজ, গোলাপায়রার মতো ঠোঁটে ঠোঁট বুকে বুক ধুকপুক কিছুক্ষণ তাক বুঝে। তার পর সরে যায়। পোড়ো। যতই পোকা পাখি, জন্তু জানোয়ার, নেশাড়ে, লাভাড়ু আসুক মোটের ওপর পোড়ো জমিতে একখানা পোড়ো পাতি কুয়ো, যার এক আঁজলার বেশি মুরোদ নেই।
জলজ্যান্ত হয়ে থাকার যখন উপায় নেই তখন তার গরজ কী? সে ঝিমিয়ে থাকে। চার পাশে যা ঘটছে ঘটুক। বেড়ালে বিয়োক, কুকুরে পেচ্ছাপ করুক, মানুষে ফুঁকুক, তার এ দিকে ও দিকে যে সব বাড়ির খিড়কি, সেখান থেকেও কি কলহবিবাদ, তুলকালাম ভেসে আসে না? পুরুষ গলায়, মেয়ে গলায়, বুড়ো গলায়? করুক করুক, যার যা ইচ্ছে করুক গে, মরুক গে যাক। তার বুকে তো আকাশটুকুও ছায়া ফেলে না। শুকনো, পাতি, বাপে তাড়ানো, মায়ে খ্যাদানো নিমুরুদে কুয়ো একখানা! বিশ্ব সংসারের কোথায় কী ঘটছে না ঘটছে, তাতে তার কী এলো গেলো? তাই যখন নিশুত রাতে কোথাও একটা আর্তনাদের মুখ চেপে ধরল কেউ, সে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে বুঝল ঠিকই, একটা অসৈরন কিছু ঘটছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। কিছু পরেই ধুপধাপ। বাঁদরের না মানুষের পায়ের শব্দ ঠাহর হয় না। গুমসোনি গোঙানি। তার ভাঙা পাড়ের কাছে দুর্গন্ধ শয়তানি জটলা একটা, তীক্ষ্ণ শিশুগলার চিৎকার, তার পরেই বদ্ধ বাতাস তোলপাড় করে। কাদা কাজল বাসুকিদত্ত সেই এক আঁজলা জলে ধুপ করে কিছু একটা পড়ল। খুব দামি জিনিস সে বুঝল। শিশু একটি। কান্না অচিরেই থেমে যায়। সে কাঁটা হয়ে ছিল, কিন্তু বুঝে যায় একেবারে কোলটিতে পড়েছে সে হাঁটু গেড়ে, কাদায় পুঁতে গেছে তলাটা। পড়ে আর ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে, নেতিয়ে গেছে বাবুটা। এমন অদ্ভুত ঘটন তার জীবনে আর কখনও ঘটেনি।
একটা গলা বলল— যাঃ, নিশ্চিন্ত।
আকাশ উধাও। তিন চারটে মুণ্ডু ঝুঁকে পড়েছে। ভাল হয়েছে স্বচ্ছ সলিল নেই। সে ক্ষেত্রে শয়তানি বিম্ব ধরতে হত তাকে চার চারটে। হাত ঝেড়ে ঝুড়ে সব চলে গেল ভারী ভারী পায়ে।
সকালবেলায় থানা পুলিশ ছয়লাপ। লোক ভেঙে পড়েছে বাইলেনের সরু পরিসরে ৫/১ নম্বরের উঠোনে, রোয়াকে। কার্তিক সামন্ত মশাইয়ের নাতিকে মাঝরাতে তুলে নিয়ে গেছে জনা কয়েক মরদ। পাঁচিল টপকে ঢুকেছিল। উঠোন, দাওয়া, ঘর ঘরালি তাদের বিলকুল চেনা, তা নয়তো কোণের ঘরে দাদুর কাছে ছোট্ট নাতি ঘুমোচ্ছে, সে ঘরের দরজা বন্ধ করলেই কাঁদে, এ সব কথা তারা জানবে কী করে? ঠাকুমার কাছে নাতি শোয়। কিন্তু দু’আড়াই বছরের বাচি দাদুর কাছে, একটু আলাদা রকম না? অন্ধকারে তাঁর পাঁজরের কাছে খোঁচা লেগেছিল। চাঁদ আড়াল করে মানুষের মুণ্ডু — কে? কে? — দরজা দিয়ে ততক্ষণে চম্পট দিচ্ছে কেউ কেউ। শিশুটির মুখে হাত চাপা। একটা ঝিম ধরানো মিষ্টি গন্ধ তাঁর নাকে ঠেসে ধরছে কেউ। তাঁর জ্ঞান লোপ হয়। তবু তাঁর মনে আছে তাঁর চিৎকারে ছেলে বউয়ের ঘরের দরজা খুলেছিল। এখন শুনছেন ঘরের ভেতর তারা রক্তমুখী লাশ হয়ে আছে। মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন বৃদ্ধ।
ভোরের আলো ফোটার পরে সদর খোলা পেয়ে গোয়ালা দেখে ঘরে ঘরে শেকল তোলা। সেই গিয়ে পাড়ার লোক ডেকে আনে। কিছু খোয়া যায়নি। সামন্তর বালিশের নীচে সিন্দুকের চাবি, লকারের চাবি সব যেমন কে তেমন। খালি ছেলে বউ খুন। একমাত্র নাতিটি গায়েব।
পুলিশ ছবি তোলে। মাপজোক নেয়। আর তার পরেই হামলে পড়ে বুভুক্ষু খবুরে লোকেরা। কেউ ছেপে বের করবে, কেউ চলচ্ছবি তুলে বয়ান দেবে। টেলিভিশন, খবরের কাগজ উপুড় হয়ে পড়েছে ডেডবডিগুলোর ওপর। বেবাক বৃদ্ধটির ওপর। সে ভদ্রলোকের ঘোর কাটছে না। মাথার ভেতর ভোঁ ভোঁ শব্দ হচ্ছে যেন। হঠাৎ তিনি ডুকরে ওঠেন, কী যে বলতে চান ভাল বোঝা যায় না। সেই বোবা আর্তনাদের টিকা টিপ্পনী বার হতে থাকে নানান রকম।
— বুড়োটাকে বাঁচিয়ে রাখলি কেন বাবা। যা চাইতিস তাই না হয় দিয়ে দিতুম রে মেধো! জোয়ান ছেলে বউ আমার…দুধের ছেলেটা…কথা হারিয়ে গেল বৃদ্ধর। ‘মেধো’ অংশটুকু পড়ে ফেলল পুলিশ এবং অনেকেই। কে এই মেধো? এ প্রশ্নের উত্তর অবশ্য দিল জনতা। মেধোরা চার মস্তান, এ তল্লাটের সন্ত্রাস। তোলাবাজি প্রধান কাজ, ড্রাগ বিক্রি দ্বিতীয়। শাসানি হুমকি ইদানীং বেড়েছে। এইটুকু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সবাই।
বিলাপের শেষের অংশটুকু যার কানে ইয়ার প্লাগের মতো আটকে ছিল, সে শশাঙ্ক। পদবী নিষ্প্রয়োজন। ছ’ ফুটের সামান্য বেশি লম্বা, ছত্রিশ ইঞ্চি বুকের হিলহিলে ফ্যাকাশে ফর্সা অনতিযুবক এক। খ্যাতনামা কাগজের রিপোর্টার। দু দু’বার পুরস্কার পেয়েছে। ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমে তার দক্ষতা বিস্ময়কর। কিন্তু তার নিয়ন্তাদের নিশ্চয় কিছু অসুবিধে ছিল। তাই বেশ দীর্ঘ সময় তাকে রাজনৈতিক রিপোর্টিং এ চালান করা হয়েছিল। তার যোগ্যতার লোক তো তাইই যায়। গণনেতারা বাইরে গেলে সার্ক সম্মেলন কী ইউ এন এর কনফারেন্স, ইউনাইটেড স্টেটসে বিদেশমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক কী পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তি প্রয়াস…। শশাঙ্কর কাছ থেকে টেবিলাতিরিক্ত অন্দরের খবর পাওয়া যেত। নেতাদের চোখ মুখের ভাষা পড়তে যথেষ্ট কেরামতি দেখিয়েছে সে। কিন্তু ইদানীং সে এ ব্যাপারে তার চিফের কাছে অব্যাহতি চেয়েছিল। তার ক্যালির লোক আবার ফিরে এসেছে রহস্যময় খুন জখম, অপহরণ ইত্যাদির আসরে।
তাকে বলা হয়েছিল— আগেরটা অনেক আরামের এবং নিরাপদও, যদি না প্লেন হাইজ্যাক হয় বা মন্ত্রী মহাশয়দের লোপাট করতে গাড়ি বোমা টোমা ব্যবহার হয়। সম্মান বেশি তো বটেই। শশাঙ্ক জানে, কিন্তু আর করবে না। পুলিশের কুকুরের মতো অকুস্থল শুঁকে শুঁকে অপরাধের নাড়িভুঁড়ি টেনে বার করাতেই যেন তার কেমন একটা অসুস্থ উৎসাহ।
শশাঙ্ক দাঁড়িয়েছিল শেষ প্রান্তে। লম্বা বলে তার কিছু বাড়তি সুবিধে আছেই। ‘দুধের ছেলেটা’ শুনতে পেয়েই তার খবরের নাক কান সক্রিয় হয়ে গেল। দুটি খুন, একটি শিশু উধাও— গুরুত্বের দিক দিয়ে কোনটা প্রায়রিটি পাবে? শশাঙ্কর ব্রেন বলল— খুন যারা হয়েছে তাদের তো হয়েই গেছে। কিন্তু শিশুটি কোথায় গেল? খুনের গন্ধে গুড়ে মাছির মতো আটকে পড়া কাগুজে লোক ও পাড়াপড়শির ভিড় থেকে আলগা হয়ে সে খোঁজ করতে লাগল দুধের শিশুটি কে?
উত্তর জোগাড় হল এই রকম— সামন্তরা ব্যবসায়ী পরিবার। কাপড়ের দোকান, বড় মনোহারী দোকান, আটা চাক্কি, ইলেকট্রনিক গ্যাজেটসের দোকান, রেশন দোকান ইত্যাদি অনেক কিছু আছে এদের। ছোট গণেশ মারা গেছেন। তাঁর ছেলেপুলেরা ৫ /২ এ থাকে। কার্তিক সামন্তর ছেলে কানাই সামন্তকে তার স্ত্রী সহ খুন করে গেছে কেউ। তাদেরই ছেলে আড়াই বছরের চিনচিন। খুব মিষ্টি বাচ্চা, দু পরিবার তো বটেই, সবাইই তাকে খুব ভালবাসে। একটু চিনে চিনে দেখতে। পাড়াতে অবাধে খেলে বেড়ায়। কে তাকে নেবে? কেনই বা?
কে, কেনর থেকে কোথায় টাই শশাঙ্ককে বেশি ভাবাতে লাগল। যারা তার মা বাবাকে খুন করেছে তারা তাকেও খুন করেনি কেন এটা একটা বড় প্রশ্ন। কিন্তু তাদের হাতে তো সে খুব নিরাপদও নয়।
এই সময়ে ইলেকট্রিক শকের মতো কিছু একটা তার মগজে ধাক্কা মারল। সে আস্তে আস্তে একেবারে বাইরে বেরিয়ে এল। কোথা থেকে একটা সংকেত আসছে, তার অ্যানটেনা সেটা ঠিকঠাক ধরতে পারছে না। তার এ রকম হয়। তার লাইনে এই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়টা খুব জরুরি। একটা থিয়োরি গড়ছে ভাঙছে। শিশু গায়েব। বৃদ্ধ বেঁচে, যুবক যুবতী খুন। খুন, অ্যাবডাকশন দুই-ই। সে ভীষণ চঞ্চল বোধ করছে। শিশুটির খোঁজ চাই। মুক্তিপণের জন্য যদি সে অপহৃত হত, তা হলে তার মা বাবা খুন হল কেন?
রোদ চড় চড় করে বাড়ছে। পুলিশ বডি নিয়ে চলে গেছে। কার্তিক সামন্তকে তাঁর ছোট ভাইয়ের বাড়ির লোকেরা হাত ধরে ও বাড়ি নিয়ে গেল। এ বাড়ি পুলিশ সিল করে দিচ্ছে। পাহারা বসছে। দুটো নাগাদ পুলিশ কুকুর মিলখা আর বেটি এসে গেল। চরকি ঘুরছে অ্যালসেশিয়ান দুটো। ভারী কাঁধ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বাঘের মতো চেহারার মিলখা মাটি শুঁকছে, এগিয়ে যাচ্ছে। পেছনে পেছনে বেটি। পুলিশ জনতাকে ঠেকিয়ে রাখছে। কিন্তু ধার দিয়ে দিয়ে তারা এগোচ্ছেই। সোজা সড়ক দিয়ে ছুটে গিয়ে মিলখা আরও এগিয়ে যায়। তরুণী বেটি যেন একটু দ্বিধাগ্রস্ত। সে কি ডান দিকে ফিরতে চায়? মিলখার প্রবল ইচ্ছাশক্তির কাছে বেটি যেন পরাজিত। শশাঙ্ক ডান দিকে বেঁকে গেল। গলি একটা। ইটপাতা। দু’পাশে মফস্‌সলি চেহারার বাড়ি সব। গলিটা গিয়ে পড়েছে পেছনের সড়কে। সড়কের ওধারেও ছাড়া ছাড়া বাড়ি, মাঝে ডোবা কচুরিপানায় আটক। ঘোরাঘুরি করে অ্যানটেনা ব্যর্থ হওয়ায় চিন্তিত মুখে সে অফিসে ফিরে গেল, রিপোর্ট তৈরি করে দিল। তার পর বাড়ি ফিরে গেল। একেবারেই আনমনা।
তখনও চার দিকে ঘষাকাঁচ অন্ধকার। কুয়ো তার তরঙ্গ পাঠাচ্ছিল প্রাণপণ। তরঙ্গগুলো কুয়োর গোলাকৃতি মুখ পর্যন্ত ঝটিতি উঠে এসে লাফিয়ে লাফিয়ে পড়ছিল চার দিকে। রাতের কুকুর তার চার পাশ ঘিরে ডেকে ডেকে ফিরে গেছে। রাতপাখি তীব্র গলাচেরা ডাক ডেকেছে, অশথ ডুমুর গুলঞ্চ তুলসী স্তব্ধ কাঁটা হয়ে ছিল সারা রাত। এখন ভোর কুয়াশায় স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্রমশ। ইমপ্রেশনিস্ট ছবির মতো। শশাঙ্ক এসে ঢুকল, হাতে জোরালো টর্চ।
সারা রাত সে ঘুমোতে পারেনি। মগজের মধ্যে সূক্ষ্ম একটা তার পিড়িং পিড়িং করে কেঁপে গেছে। শিউরে শিউরে উঠেছে রগের কাছটা। ভোররাত্তিরে বিছানা ছেড়ে চটপট তৈরি হয়ে ট্যাক্সি নিয়ে সে চলে এসেছে। এই তো দুই বাড়ি ৫ /১, ৫ /২। সামনে বাইলেন এসে পড়েছে বড় রাস্তায়, রাস্তা ধরে চলে যাও দক্ষিণমুখো। এইখানে ডাইনের বাঁক, ঘোরো। পৌঁছও এসে ইটপাতা রাস্তায়। এটা গিয়ে পৌঁছেছে বড় রাস্তার সমান্তরাল একটা খিড়কির রাস্তায়। বদ্ধ ডোবা, জলাশয়, কাঁচাবাড়ি, পাকাবাড়ি। দু’তিন বাড়ির মাঝে গোঁজা আধভাঙা পাঁচিলে ঘেরা পোড়ো জমিটা সে পেয়ে যায়। রগ লাফাচ্ছে এখন। পাঁচ-ছটা এলোমেলো গাছ। তুলসীর গন্ধে ঝিম ধরে আছে। নেড়িকুত্তার বিষ্ঠা, আধলা ইট আর দুব্বো ঘাসের ঠাস বুনোট জালে ঠোক্কর খেতে খেতে সে কুয়োর পাড় অবধি পৌঁছয়, এবং তার পরেই সেই গহ্বরের ভেতর থেকে পাক খেতে খেতে উঠে আসে কান্না। খুব ক্ষীণ। মানব শিশুর নাও হতে পারে। কুয়ো তাকে প্রবল টানে টেনে ধরে। শশাঙ্ক কিনার থেকে মুখ বাড়িয়ে টর্চের আলো ফেলে। জোরালো আলো অন্ধকার ফুঁড়ে ছুটে যায়। একটি ছোট্ট মাথা, নগ্ন পেট ও দুটি ছোট ছোট হাত। খুব আবছা তবু চেনা জিনিস। মনুষ্য শাবক। ঝট করে হাতে উঠে আসে সেলফোন। পুলিশ এবং দমকল। কাদামাখা পোকায় কাটা, ইঁদুরে খাওয়া, মৃতপ্রায় শিশুটি হাসপাতালে চলে যায় দ্রুত।
কেন সে জলহীন, কেন তার গর্ভে দশ বারো আঙুল মসমসে শ্যাওলার গদি, সাটিনের মতো পাঁক। কেন তালপুকুরে ঘটি ডোবে না জল — সমস্ত বুঝে স্তব্ধ থাকে সে। পার্থিব নিয়মকানুনের ছকখানায় যে সব কিছুরই একটা উদ্দেশ্য বিধেয় আছে, এমনকী তার আপাত অর্থহীন অস্তিত্বেরও একটা মানে একটা নির্দিষ্ট কাজ ছিল, এই কথাটা হৃদয়জাত করে রোমহর্ষ হয় তার এবং সেই ভূখণ্ডে সাক্ষ্য প্রমাণাদি সংগ্রহের জন্য অতঃপর যে পুলিশি তৎপরতা শুরু হয়, তার মধ্যেও সে শান্ত, ধীর স্থির, যাকে বলে স্থিতপ্রজ্ঞ থাকে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7
Pages ( 1 of 7 ): 1 23 ... 7পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress