নীলবসনা সুন্দরী : তৃতীয় খণ্ড – সপ্তম পরিচ্ছেদ – তিতুরাম
দেবেন্দ্রবিজয় সহজে ছাড়িবার পাত্র নহেন। তখনই খিদিরপুর অভিমুখে যাত্রা করিলেন। মোজাম হোসেনের সহিত দেখা করিবার পূর্ব্বে তিনি সেই ফটোগ্রাফ ছবি প্রস্তুতকারীর সহিত দেখা করিলেন। তাঁহার নাম কবিরুদ্দীন! ফটোগ্রাফ ছবিতেই তাঁহার নাম ও ঠিকানা লেখা ছিল, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে দেবেন্দ্রবিজয়ের বিশেষ কোন কষ্ট স্বীকার করিতে হইল না। কবিরুদ্দীনের নিকটে গিয়া যাহা তিনি শুনিলেন, তাহাতে তাঁহাকে আরও আশ্চর্য্যান্বিত হইতে হইল। কবিরুদ্দীন বলিলেন, সেই ফটো দুইখানির একখানি মুন্সী মোজাম হোসেনের এবং অপরখানি তাহার কন্যা সৃজানের। তিনি দিলজান বা মৃজান সম্বন্ধে কিছু জানেন না। দেবেন্দ্রবিজয়ের বিস্ময় সীমাতিক্রম করিয়া উঠিল; তিনি ভাবিতে লাগিলেন, সৃজন বিবির ফটো দিলজানের দেরাজের মধ্যে কেন? অথচ লতিমন বাইজী সৃজান বিবির ফটোকে দিলজানের প্রতিকৃতি বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে চাহে। অবশ্যই লতিমনের এরূপ করিবার একটা গুপ্ত-উদ্দেশ্য আছে; কিন্তু সে উদ্দেশ্য কি? হয়তো লতিমনও এই খুনের মামলায় জড়ীভূত আছে; নতুবা তাহার ভ্রম হইয়াছে। এ যে বিষম ভ্রম! আগে একবার মুন্সী মোজাম হোসেনের সহিত দেখা করি তাহার পর দেখিতে হইবে, দিলজানের খুনের সহিত লতিমন বাইজীর কতটুকু সংশ্রব আছে। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া দেবেন্দ্রবিজয় তথা হইতে বাহির হইলেন।
দেবেন্দ্রবিজয় একেবারে মুন্সী মোজাম হোসেনের সহিত সাক্ষাৎ করা যুক্তি-যুক্ত বোধ করিলেন না। আগে বাহির হইতে তাহার বিষয়টা যতটা জানিতে পারা যায়, সেই চেষ্টা করিতে হইবে স্থির করিয়া, দেবেন্দ্রবিজয় সেখানকার একটি পল্লীর মধ্যে প্রবেশ করিলেন। পল্লীতে মুসলমান অধিবাসীর সংখ্যাই বেশি। দক্ষিণাংশে কয়েকজন দরিদ্র হিন্দুর বসতি। দেবেন্দ্রবিজয় সেখান দিয়া যাইবার সময়ে দেখিলেন, একখানি খোলার ঘরে বাহিরের দাবায় বসিয়া একজন পক্ককেশ বৃদ্ধ ক্রোড়স্থিত একটি পঞ্চমবর্ষীয় শিশুর সহাস্যে অনেক কটূক্তি বর্ষণ করিতেছেন। তাহাকে “ভাই-দাদা’ বলিয়া সম্বোধন করিতেছেন, তখনই আবার তাহাকে শ্যালক পদাভিষিক্ত করিয়া নিজে নিজে খুব একটা আনন্দানুভাব করিতেছেন; সেই আনন্দাতিশয্যে সেই বালকের ভাবী-পত্নীর উপরে (হয় ত এখনও সে জন্মগ্রহণ করে নাই) একটা অযথা দাবী দিয়া রাখিতেছেন! মুখর বৃদ্ধের মুখের বিশ্রাম নাই-অনবরত বকিতেছেন। শিশু কখনও ‘হাঁ’-কখনও ‘না’-কখনও বা ‘আচ্ছা’ বলিয়া ঘাড় নাড়িতেছে। বালকটি তাঁহার পৌত্র।
দেবেন্দ্রবিজয় সেই মুখর বৃদ্ধের সম্মুখীন হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়, বলিতে পারেন, এখানে মুন্সী মোজাম হোসেন সাহেব কোথায় থাকেন?”
বৃদ্ধ কহিলেন “আরও আপনাকে অনেকটা যাইতে হইবে-গ্রামের বাহিরে গঙ্গার ধারে তিনি থাকেন। মহাশয়ের নাম?”
দে। দেবেন্দ্রবিজয় মিত্র। আপনার নাম?
বৃ। আমার নাম শ্রীতিতুরাম পরামাণিক।
দে। মহাশয়ের কি করা হয়?
বৃ। নিজের জাতীয় ব্যবসা-আমরা জতিতে নাপিত। তবে আমি নিজের হাতে আর পারি না, এ বুড়োবয়সে চোখে ঠাহর হয় না; আমার ছেলেই সব দেখে-শোনে।
দে। সে ত ঠিক কথা, উপযুক্ত ছেলের কাজই ত এই।
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, তিনি যথাস্থানে ও যোগ্য ব্যক্তির নিকটেই উপনীত হইয়াছেন। এই বৃদ্ধের নিকটে সকল খবরই পাওয়া হাইবে। বৃদ্ধ জাতিতে নাপিত-নাপিত গ্রামের সংবাদপত্র-বিশেষ। যেখানে যাহা কিছু ঘটে, সে সংবাদ আগে ইহাদের নিকটে পৌঁছায়। বিশেষতঃ ইনি বৃদ্ধ-তাতে বেকার-নিজেকে বড়-একটা কিছু করিতে হয় না; সুতরাং ইনি গ্রামের ভালমন্দ সর্ব্ববিধ সংবাদে কূলে কূলে পূর্ণ হইয়া আছেন। দেবেন্দ্রবিজয় “আঃ! আর পারা যায় না, অনেক ঘুরেছি,” বলিয়া সেইখানে বসিয়া পড়িলেন। বসিয়া বলিলেন, “এখন কি মুন্সী সাহেবের সঙ্গে দেখা হইবে?”
বৃ। সকল সময়ে দেখা হবে। তিনি আজ পাঁচ বৎসর শয্যাশায়ী হ’য়ে রয়েছেন। খুব আমীর লোক ছিল গো-ইদানীং অবস্থাটা একেবারে খারাপ হ’য়ে গেছে। তাঁর কাছে আপনার কি দরকার?
দে। (যাহা মনে আসিল)। তাঁহার একখানি বাড়ী বিক্রয় হইবে, শুনিয়াছি। সেই বাড়ী কিনিবার ইচ্ছা আছে।
বৃ। সে বাড়ী অনেকদিন বিক্রী হ’য়ে গেছে। সে আজ সাত-আট বছরের কথা। এখন নিজে একখানি ছোট খোলার ঘর ভাড়া নিয়ে গঙ্গার ধারে থাকেন। তাঁর আর বাড়ী কোথায়। এখন অবস্থা বড় খারাপ।
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, কথাটা ঠিক খাটিল না উল্টাইয়া দেওয়া দরকার। বলিলেন, “তাই ত, তবে কি ক’রে তাঁর চলে? তাঁর কি আর কেহ নাই-ছেলে-মেয়ে?”
তিতুরাম কহিলেন, “ছেলে নাই-দুইটি মেয়ে।”
দেবেন্দ্রবিজয় সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাঁর দুইটি কন্যা?”
তিতুরাম বলিল, “হাঁ, দুটি মেয়ে-যমজ। বড় চমৎকার দেখতে, বামুন-কায়স্থের ঘরেও এমন রূপ হয় না-যেন ফেটে পড়্ছে। একজনের নাম মৃজান আর একজনের নাম সৃজান।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “বটে! মেয়ে দুটি কি এখন মুন্সী সাহেবের কাছেই আছে না কি?”
গম্ভীরভাবে তিতুরাম বলিলেন, “না মশাই! বড়-বড় মেয়ে। মুন্সী সাহেব আজ পাঁচ বৎসর ব্যারামে প’ড়ে। কে বা মেয়েদের দেখে, কে বা বিয়ে দেয়! একটা মেয়ে, মৃজান যার নাম, একটা কোন লোকের সঙ্গে তার ভাব হয়, তারই সঙ্গে সে কোথায় চ’লে গেছে। সেই অবধি সে একেবারে নিরুদ্দেশ।”
দে। কে সে লোক-নাম কি?
তিতু। কি আমীর খাঁ, না হামির খাঁ-মুসলমানের নাম ঠিক মনে থাকে না, বাপু।
দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিলেন, তিনি সেই সকল পত্র পড়িয়া পূর্ব্বে যাহা অনুমান করিয়াছিলেন, তাহা অভ্রান্ত। মনিরুদ্দীন আমীর খাঁ নামে এখানে আবির্ভূত হইয়া মৃজান সহ অন্তর্হিত হইয়াছিলেন। এবং বামুন বস্তিতে লতিমনের বাড়ীতে মৃজানকে দিলজান নামে জাহির করিয়া রাখিয়াছিলেন। দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “আর সেই সৃজান নামে যে মেয়েটি?”
তিতু। তার অদৃষ্টা ভাল। খুব একজন বড়লোকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। সে এখন মুন্সী জোহিরুদ্দীনের পত্নী। যদিও জোহিরুদ্দীনের বয়স হয়েছে, তাতে আর আসে-যায় কি, খুব বড়লোক, বুড়ো হ’লে কি হয়!
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, বৃদ্ধ তিতুরাম এবার নিজের গায়ে হাত দিয়া কথা কহিতেছে। বলিলেন, “তা’ ত বটেই, এক সময়ে সকলেই বুড়ো হ’তে হবে।” মনে ভাবিলেন, যাহা হউক, এখানে আসিয়া অনেকটা কাজ হইল। দিলজান যে সৃজানের ভগিনী, ইহাতে সন্দেহ নাই। এখন একবার মুন্সী সাহেবের সঙ্গে দেখা করিতে পারিলেই সকল গোল চুকিয়া যায়।
অনন্তর দেবেন্দ্রবিজয় মুন্সী মোজাম হোসেনের বাসস্থানের ঠিকানা ঠিক করিয়া লইয়া সেখান হইতে উঠিলেন।