বৃথা এ ক্রন্দন! বৃথা এ অনল-ভরা দুরন্ত বাসনা! রবি অস্ত যায়। অরণ্যেতে অন্ধকার আকাশেতে আলো। সন্ধ্যা নত-আঁখি ধীরে আসে দিবার পশ্চাতে। বহে কি না বহে বিদায়বিষাদশ্রান্ত সন্ধ্যার বাতাস। দুটি হাতে হাত দিয়ে ক্ষুধার্ত নয়নে চেয়ে আছি দুটি আঁখি-মাঝে। খুঁজিতেছি, কোথা তুমি, কোথা তুমি। যে অমৃত লুকানো তোমায় সে কোথায়। অন্ধকার সন্ধ্যার আকাশে বিজন তারার মাঝে কাঁপিছে যেমন স্বর্গের আলোকময় রহস্য অসীম, ওই নয়নের নিবিড় তিমির তলে, কাঁপিছে তেমনি আত্মার রহস্য-শিখা। তাই চেয়ে আছি। প্রাণ মন সব লয়ে তাই ডুবিতেছি অতল আকাঙ্ক্ষা-পারাবারে। তোমার আঁখির মাঝে, হাসির আড়ালে, বচনের সুধাস্রোতে, তোমার বদনব্যাপী করুণ শান্তির তলে তোমারে কোথায় পাব— তাই এ ক্রন্দন। বৃথা এ ক্রন্দন। হায় রে দুরাশা, এ রহস্য এ আনন্দ তোর তরে নয়। যাহা পাস তাই ভালো, হাসিটুকু, কথাটুকু, নয়নের দৃষ্টিটুকু, প্রেমের আভাস। সমগ্র মানব তুই পেতে চাস, এ কী দুঃসাহস! কী আছে বা তোর, কী পারিবি দিতে! আছে কি অনন্ত প্রেম? পারিবি মিটাতে জীবনের অনন্ত অভাব? মহাকাশ-ভরা এ অসীম জগৎ-জনতা, এ নিবিড় আলো অন্ধকার, কোটি ছায়াপথ, মায়াপথ, দুর্গম উদয়-অস্তাচল, এরই মাঝে পথ করি পারিবি কি নিয়ে যেতে চিরসহচরে চিররাত্রিদিন একা অসহায়? যে জন আপনি ভীত, কাতর, দুর্বল, ম্লান, ক্ষুধাতৃষাতুর, অন্ধ, দিশাহারা, আপন হৃদয়ভারে পীড়িত জর্জর, সে কাহারে পেতে চায় চিরদিন-তরে? ক্ষুধা মিটাবার খাদ্য নহে যে মানব, কেহ নহে তোমার আমার। অতি সযতনে, অতি সংগোপনে, সুখে দুঃখে, নিশীথে দিবসে, বিপদে সম্পদে, জীবনে মরণে, শত ঋতু-আবর্তনে বিশ্বজগতের তরে ঈশ্বরের তরে শতদল উঠিতেছে ফুটি; সুতীক্ষ্ম বাসনা-ছুরি দিয়ে তুমি তাহা চাও ছিঁড়ে নিতে? লও তার মধুর সৌরভ, দেখো তার সৌন্দর্য-বিকাশ, মধু তার করো তুমি পান, ভালোবাসো, প্রেমে হও বলী, চেয়ো না তাহারে। আকাঙ্ক্ষার ধন নহে আত্মা মানবের শান্ত সন্ধ্যা, স্তব্ধ কোলাহল। নিবাও বাসনাবহ্নি নয়নের নীরে, চলো ধীরে ঘরে ফিরে যাই।