নিশুতি রাতের ডাক : 04
যে দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটা ধরেছিলেন, গুলিয়ে গেছে। অমিয় বকসী আর উজ্জ্বলকুমারের হত্যাকারীকে নীতিবাগীশ–এবং যেন আদর্শবাদীও ভেবেছিলেন। রাখী সব ভুল প্রতিপন্ন করে দিয়েছে। খুনের মোটিভ খুব স্পষ্ট হয়ে গেছে। যাকগে, দায়িত্বটা কাঁধ থেকে গেছে। আবার প্রকৃতিরহস্যে ডুবে থাকা যাবে।
কর্নেল ছাদের প্ল্যান্ট ওয়ার্লডে খুরপি চালাচ্ছিলেন। মেক্সিকান অর্কিডটায় কুঁড়ি দেখা দিয়েছে। এ সময় খুব যত্ন দরকার। ফুল ফুটতে মাসখানেক লেগে যাবে। ছবিতে দেখেছেন কি অসাধারণ ফুল! মুক্তোর ঝালরে পান্না গাঁথা জড়োয়া গহনার মতো।
তবু কি এক ব্যর্থতা তাকে হঠাৎ হঠাৎ অন্যমনস্ক করছে। কেন এ ভুল হল? বয়সের চাপে মস্তিষ্কের স্নায়ু কি নিঃসাড় হয়ে গেছে এরই মধ্যে? এমন ভুল তো এর আগে কখনও হয়নি।
প্রকাণ্ড চুল্লীর ভেতর আগুনের হলকা। নরকের প্রতীক! কিচেনের দরজা বন্ধ ছিল এবং চুল্লীও তখন নেভানো ছিল। নইলে অমিয় বকসীকে চুল্লীতে ঢোকানোরই ইচ্ছা ছিল যেন খুনীর। অগত্যা চিমনিতে ঢুকিয়েছিল–ওতেই ইচ্ছার খানিকটা নিবৃত্তি।
তারপর উজ্জ্বলকুমারকে হয়তো চিমনিতে ঢোকাত। কিন্তু পথে বাধা দেখা দিয়েছে তখন। কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়েছে। অগত্যা লাশটা ফেলে দিয়ে চলে গেছে দুঃখিত মনে।
–হুঁ! এই সিদ্ধান্তের পিছনে জোরালো যুক্তি আছে। ভুল হবার তো কথা নয়।
অথচ দেখা যাচ্ছে হত্যাকারীর অস্পষ্ট আদল থেকে শেষ পর্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠল স্বপন নামে এক সাধারণ ক্রিমিন্যাল। আজকাল পিতৃঘাতী ছেলেদের দেখা পাওয়া কঠিন নয়। প্রায়ই কাগজে তাদের খবর বেরোয়। সামাজিক অবক্ষয়, নৈতিক অধঃপতন, মূল্যবোধের ভাঙন–এদিকে আইন-শৃঙ্খলার অবস্থা যেখানে নেমে এসেছে সেখানে পিতৃহত্যা সামান্য ঘটনা। বোঝা যায়, নন্দিতা নামে প্রেমিকার জন্য স্বপন প্রচণ্ড খেপে গিয়েছিল। অমিয় বকসীকে শাসাতে গিয়েছিল। বাবাকে শাসিয়েছিল। রাখী অকপটে বলেছে, স্বপন বলেছিল–মেরেছি, বেশ করেছি!…….।
কর্নেল বড় করে শ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। অবশ্য তথাকথিত সমাজবিরোধী বা মাস্তানদের কোনোই নীতিবোধ থাকে না, এমনও নয়। কুখ্যাত ডাকাত গরিবদের সাহায্য করে। নিষ্ঠুর খুনীও প্রেমিক হতে পারে। দুর্দান্ত ঘাতকও কি সস্নেহে পুত্রের মুখচুম্বন করে না? প্রিয়তমা নারীর মৃত্যুতে কি জঘন্য অপরাধীর চোখ অশ্রুতে ভিজে যায় না? নন্দিতার আত্মহত্যার কারণ জানা গেছে–সে গর্ভবতী ছিল। খুব ভাবপ্রবণ মেয়ে ছিল নাকি তার মায়ের মতো স্বপনের প্রতিহিংসাপ্রবণ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু….।
তবু কোথায় একটা কিন্তু থেকে যাচ্ছে। সে কি নিজের ডিডাকশান পদ্ধতির ব্যর্থতার দরুন? সারাজীবন এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে সফল হয়েছেন কর্নেল। এতদিনে ব্যর্থ হলেন। তাই বুঝি মনের ভেতর খচখচ করছে পরাজয়ের জ্বালা। মুশকিল হচ্ছে, স্বপনকে কর্নেল তার তৈরি খুনীর মডেলের সঙ্গে মেলাতে পারছেন না।…..
ষষ্ঠী এল দুপদাপ শব্দে শিড়ি ভেঙে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–ফোং বাবামশাই। জলদি তলপ। নালবাজারের নাহিড়ী সায়েবের ফোং।
কর্নেল খাপ্পা হয়ে খুরপি তুলে বললেন নিকুচি করেছে তোর নালবাজারের নাহিড়ী সায়েবের।
ষষ্ঠী ভড়কে পিছিয়ে গেল। মুখ করুণ করে বলল–তাইলে বলে দিচ্ছি বাবামশাই বললেন ফোং ধরবেন না।
কর্নেল খুরপি রেখে হো হো করে হেসে উঠলেন।তুই বুঝি ভেবেছিলি খুরপিটা তোর মাথায় বসিয়ে দেব? যেমন করে পিছিয়ে গেলি, আমার নিজেকেই মনে হচ্ছিল আমি যেন সত্যি খুনী!
ষষ্ঠী দাঁত বের করল। আমাকে কি আপনি মাত্তে পারেন? সে কথা ভগমানও বিশ্বাস করবেন না। যান, আর দেরি করবেন না। জলদি তলপ। নাহিড়ী সায়েব লোকটি বড় ভাল। পুলিস বলে মনেই হয় না।
সে কর্নেলের পেছন পেছন চলল কথা বলতে বলতে বলনে, কেন মনে হয় না? মনে হয় না এইজন্যে ওনার পোশাক-আশাক আপনার মতন। একদিনও তো দেখলুম না পুলিসের পোশাক পরতে। কোমরে বন্দুক পিস্তলও ঝুলতে দেখলুম না। বড় সাদাসিদে মানুষ, বাবামশাই!
কর্নেল বললেন–ওরে হাঁদারাম। ও যে গোয়েন্দা। গোয়েন্দা বুঝিস?
বুঝি বৈকি। অ্যাদ্দিন আপনার কাছে আছি অ্যাতটুকুন বয়েস থেক। গোয়েন্দা বুঝব না?
বল তো, গোয়েন্দা কী?
আজ্ঞে, লুকিয়ে যেনারা চোর-ডাকাত ধরেন। বাবামশাই, আপনিও তো
কর্নেল চোখ কটমট করে তাকাতেই ষষ্ঠী কেটে পড়ল। ফোন তুলে বললেনবল ডার্লিং, স্বপনকে পাকড়াও করে ফেলেছ বুঝি?
না কর্নেল! তাকে জোর খোঁজা হচ্ছে। আশাকরি, পেয়ে যাব শিগগির। আমি রিং করেছি মণিদীপার ব্যাপারে।
–ও নিয়ে আর কী হবে? কেস তত সেটলড।
কে জানে! ব্যপারটা আপনাকে জানাতে চাই। খুব ইন্টারেস্টিং এপিসোড। কেস নতুন দিকে টার্ন নিচ্ছে।
তার মানে?
–মণিদীপা কনফেস করেছেন। সম্প্রতি কলকাতায় শুটিং করতে এসে উজ্জ্বলকুমারের পাল্লায় পড়েছিলেন। মণিদীপা বিয়ে করতে চলেছেন কোটিপতি ব্যবসায়ী ইন্দ্রজিৎ প্রসাদকে। সব কাগজে সে খবর বেরিয়েছে। এদিকে সঙ্গে মিঃ প্রসাদও ছিলেন। বেগতিক দেখে মণিদীপা উজ্জ্বলবাবুকে হাজার টাকার চেক লিখে দেন। কিন্তু তারপর ভেবে দেখেন, ব্ল্যাকমেলারের হাত থেকে। নিষ্কৃতি পাবেন না। ক্রমাগত তাকে সন্তুষ্ট করে যেতে হবে। মনে শান্তি থাকবে না। তাই প্রাক্তন প্রেমিক ফুটবল-কোচ অমর্ত্য রায়ের শরণাপন্ন হন। অমর্ত্যবাবু খেয়ালি লোক। মণিদীপার সঙ্গে পুরনো প্রেমের খাতিরে কথা দেন, উজ্জ্বলকুমারের মুখ চিরতরে বন্ধ করে দেবেন। তিনিই চেকের পেমেন্ট বন্ধ রাখার জন্য ব্যংককে নির্দেশ দিতে বলেন।
বুঝলুম। কিন্তু তাতে কী প্রমাণ হচ্ছে? কেসের নতুন দিকে টার্ন তো দেখছি না।
–আর একটু আছে, কর্নেল! ব্যাপারটা আবার একটু জট পাকিয়েছে।
বল!
–স্বপন একসময় ভাল ফুটবলার ছিল। কিছুদিন ইলেভেন টাইগার্সে খেলেও ছিল। অমর্ত্যবাবু তার মুরুব্বি ছিলেন। তারপর
–তুমি কী বলতে চাইছ, বুঝেছি। অর্থাৎ স্বপনের অমিয়বাবুকে খুন করার পেছনে অমর্ত্যবাবুরও প্ররোচনা ছিল। এই তো? এতে খুনের মোটিভ দ্বিগুণ জোরালো এবং স্পষ্ট হল। কেসে অমর্ত্যবাবুও জড়িয়ে গেলেন। তাই তো?
–আমার কথা শেষ হয়নি, কর্নেল!
–হুঁ, বল।
–অমর্ত্যবাবু স্বপনকে দল থেকে বের করে দেন কোনো কারণে। এমন কি স্বপনের কোনো ভাল টিমে খেলার চান্স পর্যন্ত নষ্ট করে দেন। বাধ্য হয়ে স্বপন ফুটবল থেকে সরে যায়। অমর্ত্যবাবু খেলার জগতে খুব প্রভাবশালী লোক।
–এই তথ্য কোথায় জোগাড় করলে?
–ইলেভেন টাইগার্সের ক্লাবের এক খেলোয়াড়ের কাছ থেকে।
–তাহলে অমর্ত্যবাবুর সঙ্গে স্বপনের শত্রুতা ছিল দেখা যাচ্ছে। কাজেই। স্বপনকে তাঁর প্ররোচিত করার প্রশ্ন থাকছে না এবং আমরা আগের জায়গায় ফিরে আসছি আবার।
–আসছি না। আরও একটু আছে। মন দিয়ে শুনুন।
–আহা, শুনছি তো!
–আপনাকে উত্তেজিত মনে হচ্ছে! প্লিজ, দিস ইজ ভাইটাল।
কর্নেল হাসলেন।না, না। বল ডার্লিং!
মায়াপুরী স্টুডিও একজন টেকনিশিয়ান চিরঞ্জীব গাঙ্গুলি আমাদের গোপনে জানিয়েছেন, উজ্জ্বলবাবু খুন হবার রাতে–তখন প্রায় নটা বাজে, অমর্ত্যবাবু এসে উজ্জ্বলকুমারকে ডেকে নিয়ে যান। চিরঞ্জীববাবু ওদিকে ল্যাট্রিনে যাচ্ছিলেন। দুজনকে কথা বলতে বলতে বাগানের দিকে যেতে দেখেন। অমর্ত্যবাবুকে তিনি চেনেন। কে না চেনে ওঁকে? বাঙালি ফুটবলপাগল জাত। ওঁর মতো বিখ্যাত লোককে অন্ধকারেও চিনে ফেলবে।
–হুঁ, সত্যি আবার জট পাকাল তাহলে। অমর্ত্যবাবুকে মিট কর। ওঁর কী বক্তব্য জেনে নাও এখনই। তবে নামী এবং প্রভাবশালী লোক। সাবধানে এগোনো দরকার।
–সেটাই তো সমস্যা। খুব টাফ ধরনের মানুষ। হার্ড নাট। কর্নেল আপনি একবার দেখুন না! আপনি তো জাদুকর জিনিয়াস! ওঁকে ট্যাক করা আপনার পক্ষে কিছুই না।
–লেগপুল কোরো না ডার্লিং!
কর্নেল। প্লিজ! একে লেগপুলিং বলে না। আপনার নির্ভেজাল প্রশংসা।
–আচ্ছা, আচ্ছা! দেখি কী করতে পারি।
দৃশ্যটা বাইরের লোকের কাছে দৃষ্টিকটু। কিন্তু ইলেভেন টাইগার্স ক্লাবের টেন্টে সকলেরই চোখ সওয়া। অমর্ত্য রায় শুধু দুর্ধর্ষ কোচ নন, ক্লাবের অন্যতম কর্মকর্তাও। অবসরকালে ওঁর হাতে হুইস্কির গ্লাস এবং পাশে সুন্দরী মহিলা না দেখতে পেলে কানাকানি শুরু হয়, বসের মুড ঠিক নেই–আজ কোচিং জমবে না।
কাল টেন্টেই রাত্রিযাপন করেছেন অমর্ত্য। ভোর ছটার মধ্যেই খেলোয়াড়রা এসে গেছে যথারীতি। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্র্যাকটিশ করছে অন্যদিনের মতো একা বা গ্রুপ-ওয়াইজ। এ ক্লাবে অনেক আধুনিক সরঞ্জাম আছে ফিজিক্যাল এক্সারসাইজের। বাঘ যেমন নিজের এলাকায় একেশ্বর এবং বাইরের বাঘকে পা বাড়াতে দেয় না, অমর্ত্যও তাই। গত মাসে এক বিদেশী কোচকে আনা হয়েছিল পরবর্তী বড় ম্যাচের প্রস্তুতির তাগিদে। অমর্ত্যের সঙ্গ বরদাস্ত করতে না পেরে কেটে পড়েন ভদ্রলোক। তাতে ক্লাবে মনান্তর ঘটেনি। সবাই অমর্ত্যের অনুরাগী। তিনি একাই একশো।
আটটা অবধি গলদঘর্ম পরিশ্রমের পর খেলোয়াড়দের অনেকে চলে গেছে। কয়েকজন আড্ডা দিচ্ছে ঘেরা মাঠের আনাচে-কানাচে। টেন্টের একটু তফাতে ঝাঁকড়া প্রকাণ্ড অমলতাস গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছেন অমর্ত্য। হতে হুইস্কির গ্লাস এতক্ষণে। পরনের শর্টস, গলায় সরু রুপোর লকেটচেন, মাথায় ফেল্ট টুপি, পায়ে সাদা মোজা এবং কেডস জুতো। তার বুক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সদ্যপ্রয়াত চিত্রাভিনেতা উজ্জ্বলকুমারের মেয়ে রাখী। সে এখন অমর্ত্যের ভাষায় ইন ফুল ফর্ম। তার মানে, লাস্যময়ী। তার কাঁধে বাঁ হাত রেখে অমর্ত্য মাঝে মাঝে তার চুলে চিবুক ঠেকানোর চেষ্ঠা করছেন। উঁচু মানুষ। শরীর অনেকটা বেঁকে যাচ্ছে। রাখী প্রতিবার খিলখিল করে হেসে উঠছে। বলছে–এই! কাতুকুতু লাগছে!
অমর্ত্য বললেন–তোর চুলেও দেখছি নার্ভ আছে!
রাখী ঘুরে বলল–অমর্ত্যদা, ওই ছেলেটা কে গো?
-অ্যাই, সাবধান! ওর দিকে নজর দিবি নে বলে দিচ্ছি! ও এবার আমাদের রেস হর্স নাম্বার ওয়ান।
-কিসে খেলে ও?
–সেন্টার ফরোয়ার্ডে।
নাম কী ওর?
অমর্ত্য ওর মাথায় মৃদু চাটি মেরে বললেন শাট আপ! তারপর ছায়ায় রাখা বেতের চেয়ারে বসলেন।
রাখী সানগ্লাস খুলে এদিকে ঘুরল এবং টেন্টের ওদিকে একটু দূরে গেটের কাছে কাউকে দেখে চমকে উঠল–এই, দেখছ ওই লোকটাকে? সে ফিসফিস করে বলল। দেখ, দেখ। আহা, তাকাও না!
অমর্ত্য ঘুরেই দেখতে পেলেন। চোখে বাইনোকুলার রেখে ভদ্রলোক এদিকে তাদেরকেই দেখছে। পাদ্রীর মতো চেহারা। সাদা গোঁফদাড়ি। লোকটি অমর্তের মতোই উঁচু। কিন্তু গায়ে-গতরে আরও চওড়া। মাথায় ছাইরঙা টুপি। কাঁধে একটা স্যামেরাও ঝুলছে।
বুড়ো আবার ফিসফিসিয়ে উঠল বুড়ো এখানে কেন? কী তলব? অমর্ত্য যাঁড়ের মতো কাঁধ উঁচু করে বললেন হু ইজ হি?
–ডিটেকটিভ!
–হোয়াট?
–হ্যাঁ, ডিটেকটিভ। আমি ভীষণ চিনি। ওর নাম কর্নেল কর্নেল কী যেন, মনে পড়ছে না।
অমর্ত্য হাতে হুইস্কির গ্লাস নিয়ে এগিয়ে গেলেন গেটের কাছে।-হেই! হোয়াট ডু ইউ থিংক ইউ আর ডুইং? হোয়াট দা ব্লাডি হেল ইউ আর লুকিং ফর?
কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে রেখে অমায়িক হাসলেন। নাথিং মিস্টার! জাস্ট বার্ড ওয়াচিং! পাখি দেখছি। ওই অমলতাসের গাছে বাই দা বাই, আমার যদি ভুল না হয়, আমি নিশ্চয় বিশ্ববিখ্যাত প্রাক্তন ফুটবলার অমর্ত্য রায়ের সঙ্গে কথা বলছি? ওঃ! সে এক অভিজ্ঞতা। অসাধারণ স্মরণীয় ঘটনা আমার জীবনে। আমি সেভেনটি টুয়ের ব্যাংককে এশিয়ান ম্যাচের কথা বলছি। ইন্ডিয়ান টিমের সেন্টার ফরোয়ার্ডে খেলেছিলেন আপনি। অমন অপূর্ব খেলা জীবনে দেখিনি। আমার পঁয়ষট্টি বছর বয়স হল। দেশে বিদেশে প্রচুর ফুটবল দেখেছি। কিন্তু
কর্নেল এক পা এক পা করে টেন্টের দিকে হাঁটছিলেনও কথা বলতে বলতে। অমর্ত্য পাশ কাটিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। হুইস্কিতে চুমুক দিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললেন–আর ইউ ডিটেকটিভ?
কর্নেল হো হো করে হেসে উঠলেন। কি অবাক কাণ্ড! কে বলল? রাখী বুঝি?
বলেই রাখীর উদ্দেশে হাত নাড়লেন। রাখী, নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে। ছিল–অবশ্য আবার চোখে সানগ্লাস! ঠোঁট কামড়ানো।
অমর্ত্য বললেন–দেখুন মশাই! এটা একটা ফুটবল ক্লাবের প্রাইভেট এরিয়া। আপনি ট্রেসপাস করেছেন, মাইন্ড দ্যাট! আপনি যদি এখনই না বেরিয়ে যান, মুশকিলে পড়বেন।
কর্নেল গলা নামিয়ে বললেন–অমর্ত্যবাবু, আপনি ৮ মে রাত নটায় মায়াপুরী স্টুডিওর বাগানে রাখীর বাবাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। তার কিছুক্ষণ পরে তিন খুন হন। আপনাদের বাগানের দিকে যেতে দেখেছিলেন এক ভদ্রলোক। তিনিই পুলিসকে সব বলেছেন। কাজেই, বুঝতে পারছেন, আপনি বিপন্ন।
সকালের রোদে অমর্ত্যের মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। এবার মুহূর্তে সাদা হয়ে গেল। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে রুক্ষ স্বরে বললেন—সো হোয়াট? আই কেয়ার এ ফিগ ফর দ্যাট!
–অমর্ত্যবাবু, মণিদীপা পুলিসের কাছে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন লিখিতভাবে। ব্ল্যাকমেইলের শাস্তি দিতে আপনি উজ্জ্বলবাবুর মুখ চিরতরে বন্ধ করে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। দু-দুজন ভাইটাল সাক্ষীকে আদালত অগ্রাহ্য করতে পারবে না।
অমর্ত্য হুইস্কির গ্লাস ঘাসের ওপর দমাস করে ছুঁড়ে ফেলে বললেন–গো টু হেল!
–আপনি নামী বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি অমর্ত্যবাবু! আদালতে একথা ফাস হবে। পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যেও আপনি খুনী সাব্যস্ত হবেন। আপনার কেরিয়ারের কথা ছেড়ে দিচ্ছি, চরম শাস্তিও হতে পারে। বিশ্বের সব কাগজে প্রচার হবে। স্ক্যান্ডাল রটবে।
অমর্ত্য ঘুষি চালাবেন বলে হাত তুলেই নামিয়ে নিলেন। গলার ভেতর থেকে বললেন–ওকে! কী বলতে চান আপনি?
কর্নেল মিষ্টি হাসলেন।–আমি কথা বলতে চাই আপনার সঙ্গে।
–সবই যখন প্রুভড, তখন কথা বলে কী লাভ? আমি কথা যা বলার কোর্টেই বলব। ইউ গো।
–অমর্ত্যবাবু, প্লিজ! আমি জানি, আপনি শক্ত মানুষ। আপনি জেদী। কিন্তু ভুলে যাবেন না, আজ যেখানে পৌঁছেছেন এবং আরও উঁচুতে পৌঁছুনোর আশা করছেন, তার জন্য আপনাকে প্রচণ্ড স্ট্রাগল করতে হয়েছে। বিশ্বের সেরা কোচদের তালিকায় আপনার নাম উঠতে চলেছে। ঠিক এই সময়ে এত দিনের স্ট্রাগল এবং স্বপ্নকে জেদের বশে কেন নষ্ট করে দেবেন অমর্ত্যবাবু?
অমর্ত্যের নাকমুখ দিয়ে সশব্দে গরম নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল।
–চলুন অমর্ত্যবাবু, আমরা কোথাও ছায়ায় গিয়ে দাঁড়াই।
অমর্ত্য পা বাড়ালেন অমলতাস গাছটার দিকে। ছায়া লম্বা হয়ে আছে এখনও। কয়েকটা বেতের হালকা চেয়ার রয়েছে সেখানে। রাখী একটাতে শক্ত হয়ে বসে আছে। সানগ্লাসের চৌহদ্দি জুড়ে ঘামের ফোঁটা। ঘাম নাকে, চিবুকে, কপালে।
অমর্ত্য কর্নেলকে বসতে ইশারা করে রাখীকে বললেন–তুই এখন আয় রাখী। পরে দেখা করিস। তারপর কর্নেলকে বললেন–এনি ড্রিংক?
কর্নেল হাত তুলে বললেন–থ্যাংকস। রাখী, তুমি চলে যেও না। একটু অপেক্ষা কর। তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।
রাখী অবশ শরীরে মাথাটা একটু দোলাল।
অমর্ত্য বললেন–ওক্কে। রাখী, টেন্টে গিয়ে বস্। আর পরিমলকে বল, আমাকে একটা হুইস্কি দিয়ে যাবে।
কর্নেল চুরুট ধরালেন। তারপর বললেন–৮মে মায়াপুরীতে
–অমর্ত্য বাধা দিলেন।ওয়েট এ মিনিট! ড্রিংকটা আসুক। আমার মুড নষ্ট হয়ে গেছে।
কর্নেল হাসলেন। চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখতে থাকলেন। ক্লাবের আর্থিক সঙ্গতি আছে। নিজস্ব মাঠ–একটা স্টেডিয়াম বলাই ভাল, একটা সুইমিং পুলও দেখা যাচ্ছে অন্য পাশে। ওখানে একটা গেটের মাথায় লেখা আছে ব্যায়ামাগার। উজ্জ্বল সকালের রোদে ঝলমল করছে ফুলের বাগান। মাঠে প্রাকটিশ করছে দুজন খেলোয়াড়। আর কোথাও কেউ নেই। পৌনে নটা বেজে গেল প্রায়।
ড্রিংক দিয়ে গেলে চুমুক দিয়ে অমর্ত্য বললেন–মণিদীপাকে আমি বিয়ে করতে পারতুম। করিনি। কেরিয়ারের জন্য নিজেকে বিকিয়ে দিতে তার বাধত না। তাই অমিয়র ওপরও শেষ পর্যন্ত আমার রাগ হয়নি। ওর কী দোষ? মণিদীপা ওর মুখেও লাথি মেরে চলে গেল বোম্বেতে। আমি ওকে ভুলে গেলুম। সম্প্রতি মণিদীপা টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে ছবি করতে এসেছিল। আমি জানতুমই না সে কলকাতা এসেছে। সন্ধ্যাবেলা এখানে বসে আছি, হঠাৎ মণিদীপা এসে হাজির। মহা ধূর্ত মেয়েছেলে। যাই বলুন মশাই, মেয়েদের অভিনয় করার ন্যাক জন্মগত। কেঁদেকেটে আমাকে বলল, উজ্জ্বল ওকে ব্ল্যাকমেইল করতে গিয়েছিল একটা ছবি দেখিয়ে। ছবিটা আমাকেও দেখিয়েছিল উজ্জ্বল। অমিয়র সঙ্গে সে এক ডার্টি সিন! অমিয়টা ছিল কুকুরেরও অধম।
–আপনি মণিদীপাকে আশ্বাস দিলেন?
–দিলুম। আফটার অল আমার প্রাক্তন প্রেমিকা। ওকে বললুম, কাল ফাস্ট আওয়ারে ব্যাংককে বলে দাও, পেমেন্ট যেন না দেয় উজ্জ্বলকে।
–আর বললেন, উজ্জ্বলের মুখ চিরতরে বন্ধ করে দেবেন?
–ওর কান্নাকাটি দেখে একথা না বলে উপায় ছিল না তো!
–আপনি মায়াপুরীতে গেলেন কেন?
উজ্জ্বলকে বুঝিয়ে সুজিয়ে বা ভয় দেখিয়ে নিবৃত্ত করতে–যাতে মণিদীপাকে ব্ল্যাকমেল না করে। তাছাড়া মণিদীপা একটা অফারও দিয়েছিল। পাঁচ হাজার টাকা দিতে সে রাজি, যদি উজ্জ্বল নেগেটিভ আর সব প্রিন্ট ছবি ফেরত দেয়। আমি তাই উজ্জ্বলের কাছে এই অফারটা নিয়েই গিয়েছিলুম।
–কিন্তু অত রাতে কেন?
অমর্ত্য রেগে গেল। উজ্জ্বলকে খুন করার ইচ্ছে থাকলে ওকে এই টেন্টে ডেকে পাঠিয়ে তা পারতুম! মদের লোভে ও চলে আসত! তা ছাড়া ও আমার বহুকালের বন্ধু।
–ঠিক, ঠিক। বলুন।
–মণিদীপার তর সইছিল না। সেদিন ছিল রবিবার। ওর গাড়িতেই ওকে সঙ্গে নিয়ে উজ্জ্বলের বাড়ি চললুম।
–ও! তাহলে ৭মে প্রথমে ওঁর বাড়িতেই গিয়েছিলেন?
–হ্যাঁ। কিন্তু সেন্ট্রাল অ্যাভেন্যুতে কী সব হাঙ্গামায় ট্রাফিক জ্যাম। আটকে গেলুম। হঠাৎ আমার মাথায় বদ খেয়াল এসে গেল। জ্যাম ছাড়তে দেরি হবে। ততক্ষণে কাছাকাছি কোনও বারে মণিদীপাকে পাশে নিয়ে ড্রিংক করা যায়। জাস্ট এ নস্টালজিয়ার প্রকোপ বলতে পারেন। মণিদীপা তখন আমার করায়ত্তে। যা বলব, মেনে নিতে প্রস্তুত।
–ও, বারে গেলেন এবং ড্রিঙ্ক করলেন। তারপর?
–টু কাট শর্ট, বেরুলুম যখন তখন রাত সাড়ে দশটা। আমি বেশ খানিকটা মাতাল হয়ে গেছি। উজ্জ্বলের বাড়ি থেকে একটু দূরে গাড়ি রইল। গাড়িতে মণিদীপা আর ড্রাইভার। আমি উজ্জ্বলের বাড়ির দরজায় নক করতে যাচ্ছি, ভেতরে বাস্টার্ড স্বপনটার গলা শুনতে পেলুম। সে তার বাবাকে অকথ্য গালিগালাজ করে শাসাচ্ছে। বাবাটিও কম নয়। সমানে মুখ খিস্তি করছে। বাধ্য হয়ে চলে এলুম। মণিদীপাকে বললুম, ভেবো না। আগামীকালই ওর সঙ্গে যোগাযোগ করব আবার।
–অমর্ত্যবাবু, স্বপনকে আপনি দল থেকে তাড়িয়ে ছিলেন কেন?
বললুম তো, হি ইজ এ বাস্টার্ড।
–ওর কেরিয়ার নাকি আপনি নষ্ট করে দিয়েছিলেন? অমর্ত্য রাগী চোখে তাকাল। তারপর গেলাসে চুমুক দিয়ে বলল হ্যাঁ। দ্যাটস ফ্যাক্ট।
–কিন্তু কেন?
–এর সঙ্গে ওসবের কোনো সম্পর্ক নেই। আপনাকে আমি তা বলব না।
নন্দিতাকে তো আপনি চিনতেন?
অন্ধকারে একটা ঢিল ছোঁড়ার মতো প্রশ্ন। কর্নেল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন অমর্ত্যের মুখের দিকে। অমর্ত্যের চোখ দুটো সঙ্গে সঙ্গে নিষ্পলক হয়ে গেল। অতি সূক্ষ্ম কয়েকটা রেখা জলের ওপর মুহূর্তকালের শিহরনের মতো ফুটে মিলিয়ে গেল।
তারপর সটান উঠে দাঁড়ালেন অমর্ত্যইউ গোয় যত সব বাজে প্রশ্ন!
-প্লিজ অমর্ত্যবাবু! আপনাকে বাঁচাবার স্বার্থেই এটা জানা দরকার। পরে আপনাকে সব বলছি। প্রশ্নটার জবাব দিন।
অমর্ত্য বসলেন। শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন–কে নন্দিতা? আমি জানি না।
কর্নেল বুঝলেন, অমর্ত্য গোপন করলেন ব্যাপারটা। বললেন–ঠিক আছে। মায়াপুরীতে গেলেন পরদিন। কিন্তু অত রাতে কেন?
–উজ্জ্বলকে ফোন করেছিলুম স্টুডিওতে। জানতুম, সে হ্যাংলার মতো স্টুডিওতে সক্কালেই গিয়ে হাজির হয়। রাত অবধি থাকে। ওর ব্যাপারটা ছিল অচল আইনজীবীদের মক্কেল পাকড়ানোর মতো। কোনো ছবিতে রোল না থাকলেও যেত। ঘুরঘুর করে বেড়াত। নতুন প্রডিউসার বা ডাইরেকটারদের পেছন পেছন ঘুরত। তো উজ্জ্বলকে আমি ফোনে বললুম, মণিদীপার ব্যাপারে তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই!
উজ্জ্বল মণিদীপার নামে খিস্তি করে বলল, বজ্জাত মাগী আমাকে চেক দিয়ে পেমেন্ট স্টপ করতে বলেছে। আমি দস্তুরমতো অপমানিত হয়েছি ব্যাংকে গিয়ে। কালই ওর হবু বরের কাছে গ্র্যান্ড হোটেলে হাজির হচ্ছি।
বললুম, মণিদীপা রফা করতে চায়। তুমি চলে এস আমার ক্লাবে।
উজ্জ্বল বলল–তোমার মাথা খারাপ? আজ আমার হেভি শুটিং! রাতে ডিনার-উইথ ড্রিংকস! আজ স্টুডিও ছেড়ে বেরুনোর উপায় আছে?
সমস্যা হল সেদিন আমার ক্লাবে জরুরি মিটিং। বিকেলে মোহনবাগানের সঙ্গে একটা চ্যারিটি ম্যাচ। এ সব বেরুতে রাত্রি হয়ে যাবে। তাই বললুম, ঠিক আছে। আমি রাত আটটা থেকে নটার মধ্যে তোমার কাছে যাচ্ছি।
উজ্জ্বল এদিন খুব মুড়ে ছিল। বলল, বেশ, তাই এস। আমাকে তুমি গাড়ি করে পৌঁছে দেবে বাড়িতে। ভালই হবে।
তারপর আপনি স্টুডিওতে গেলেন?
–ড্রিংক নিয়ে বসলে আমার কিছু খেয়াল থাকে না। রাত সাড়ে আটটায় মণিদীপা হোটেল থেকে ক্লাবে ফোন না করলে ভুলেই যেতুম। তখন সাড়ে আটটা বেজে গেছে। তক্ষুণি গাড়ি নিয়ে বেরুলুম। গিয়ে দেখি উজ্জ্বল স্টুডিওর দু নম্বর ফ্লোরের ওপাশে লনে দাঁড়িয়ে মৌজ করে সিগারেট টানছে। খাওয়া এবং ড্রিংক ভালই হয়েছে। বললুম, চল, একটু নিরিবিলিতে গিয়ে বসি কোথাও।
উজ্জ্বল বলল, চলো, পুকুরের পাড়ে বেঞ্চে গিয়ে বসব। ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। জমবে ভাল।
অমর্ত্য একটা শ্বাস ছাড়লেন। তারপর ডাকলেন–পরিমল! আরেকটা দিয়ে যা।
মাথায় চূড়োবাঁধা চুল, মুখে যথেচ্ছ গোঁফদাড়ি, পরনে খাকি হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি, একটা লোক ড্রিঙ্ক নিয়ে কর্নেলের দিকে আড়চোখে তাকাতে তাকাতে চলে গেল খালি গ্লাসটা নিয়ে।
চুমুক দিয়ে অমর্ত্য বললেন–জ্যোৎস্না ছিল। কিন্তু খোয়ায় ঠোক্কর লেগে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলুম। উজ্জ্বল বকবক করতে করতে আপন খেয়ালে কিছুটা এগিয়ে গেছে। দুধারে ঘন ঝোঁপঝাড়–একেবারে জঙ্গল। উঠে পোশাক থেকে ধুলো ঝাড়ছি হঠাৎ উজ্জ্বল একটা অদ্ভুত শব্দ করল। তাকিয়ে দেখি সে টলতে টলতে পড়ে যাচ্ছে। ভাবলুম নেশা বেশি হয়ে গেছে। তারপর সে ধপাস করে পড়ে গেল। কাছে গিয়ে বললুম, সহ্য হয় না তো অত খাওয়া কেন বাবা? বলে ওকে ওঠাতে গিয়েই চোখে পড়ল ওর সাদা পাঞ্জাবির পিঠের দিকে কালো ছোপ চকচক করছে। হাত দিতেই টের পেলুম রক্ত। চুল থেকে রক্ত গড়িয়ে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলুম কী হয়েছে। প্রচণ্ড ভয় পেলুম–কেউ ওকে মেরে পালিয়ে গেল এবং এর জন্য আমার কাঁধেই সব .. দোষ পড়বে। বুঝতেই পারছেন, আমার অবস্থাটা তখন কী। তবৈ সঙ্গে সঙ্গে আমি জেনে গেছি খুনী কে। দ্যাট বাস্টার্ড, স্বপন!
তারপর আপনি চলে এলেন? কাউকে কিছু না জানিয়ে?
অমর্ত্য গ্লাসে চুমুক দিয়ে গরম শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন হ্যাঁ! চলে আসব না কেন? ছেলে বাবাকে খুন করেছে
–কিন্তু আপনি তো কাউকে দেখতে পাননি?
–না। মনে হয় স্বপন ফলো করেছিল। ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। স্বপনের পক্ষে সব সম্ভব।
এবার নন্দিতার কথা বলুন!
–আবার সেই কথা? হু ইজ দ্যাট হোর? ডোন্ট টক অ্যাবাউট হার।
রাখী আপনার কাছে আসে দেখছি!
রাখী ইজ অলসো এ হোর! আমাকে পটাতে আসে চাকরির জন্য। আমি ওর বাপের বয়সী।
কর্নেল বুঝলেন নেশা হয়ে গেছে এটুকুতেই। অবশ্য আবহাওয়াটা কড়া। এখনও ব্রেকফাস্টও হয়নি সম্ভবত। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–ধন্যবাদ। আসি অমর্ত্যবাবু!
অমর্ত্য ঘাড় গোঁজ করে দুহাতে গ্লাসটা চেপে ধরে ভুরু কুঁচকে মাঠের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলেন।
কর্নেলকে দেখে টেন্ট থেকে বেরিয়ে এল রাখী। মুখে গাঢ় ছায়া থমথম করছে। কর্নেল বললেন বাড়ি যাবে না?
দূরে অমর্ত্যের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে রাখী বলল–আপনার গাড়ি আছে সঙ্গে?
–আছে। এস, তোমাকে পৌঁছে দেব।
লাল ল্যান্ডরোভার গাড়িটা সেন্ট্রাল অ্যাভেন্যু দিয়ে আস্তে সুস্থে এগোচ্ছিল। এখনই রাস্তায় গাড়ি ও মানুষের ভিড় শুরু হয়েছে। পিক আওয়ার্সের প্রথম মুহূর্ত। ট্রাফিক সিগনালের সামনে থামলে রাখী মৃদুস্বরে বলল–অমর্ত্যদাকে আপনারা অ্যারেস্ট করবেন?
কর্নেল হাসলেন।–তুমি ওঁকে অমর্ত্যদা বল?
–আঃ! বলুন না ওকে অ্যারেস্ট করবেন নাকি?
না। কেন?
রাখীর ওপর থেকে ছায়াটা সরে গেল। একটু হাসল সে।তাহলে আমার চাকরিটা পাওয়ার চান্স রইল। বাব্বা! আপনাকে দেখে আমার যা ভয় হয়েছিল!
কর্নেল ওর দিকে সোজা তাকিয়ে বললেন তোমার বড়দাকে অমর্ত্যবাবু দল থেকে কেন তাড়িয়েছিলেন জান?
–অমর্ত্যদাটা যা খচ্চর আছে, না! ভাবতে পারবেন না। নেহাত চাকরির জন্য ওর কাছে যাচ্ছি। বড়দা পালিয়ে না বেড়ালে যেতে পারতুম ভাবছেন? স্ট্যাব করে মেরে দিত। বলতে নেই, আমার বাবাটার কোনো সেন্স ছিল না।
–আমার প্রশ্নের জবাব দাও, রাখী!
–একটা মেয়েকে নিয়ে গণ্ডগোল হয়েছিল। বড়দা অমর্ত্যদাকে খুব পেঁদিয়েছিল, জানেন?
নন্দিতার জন্য?
রাখী মাথা নাড়ল।–উঁহু, নন্দিতা তো বড়দার সেকেন্ড গার্ল। সে একটা মেয়ে ছিল চন্দ্রা নামে। চন্দ্রা থাকত ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে। ওকে পিক আপ করেছিল বড়দা। সঙ্গে করে ক্লাবে যেত। আর অমর্ত্যদাটা না এমন পাজি জানেন? চন্দ্রাকে বাগিয়ে নিল বড়দার কাছ থেকে। চন্দ্রার সঙ্গে আমার ভাব হয়েছিল। সেই তো আমাকে আর নন্দিতাকে–
রাখী থেমে গেল হঠাৎ। নখ খুঁটতে থাকল। কর্নেল আস্তে বললেন-বুঝেছি খারাপ পথ দেখিয়েছিল।
রাখী দুঃখিত ভাবে হাসল একটু। বলতে নেই, চন্দ্রা ব্লাড়ক্যান্সারে মারা গেছে। তবে অনেক দুঃখে ও এমন হয়েছিল।
সিগন্যাল পেয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলেন কর্নেল। স্বপন ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে চোখের সামনে। তার তত্ত্বের কাছাকাছি এসে পড়েছে এবার। অথচ তবু একটা কিন্তু থেকে যাচ্ছে। যাকে ভেবেছেন, তার সঙ্গে কোথায় যেন ফারাক।