নিশিথের অন্ধকার – 2
চন্দ্রানীর বাবা ছিলেন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক। শখ করে কবিতা লিখতেন। তিনি তার নাম রেখে ছিলেন চন্দ্রাননী। চন্দ্রাননী মানে চাঁদ মুখ। মায়ের মুখে শুনেছে। ছোট বেলায় তার মুখখানা নাকি চাঁদের মতো দেখতে লাগত। চাঁদের জ্যোৎনার মতো হাসি মুখে লেগে থাকত সারা সময়। সে নাকি কাঁদত খুব কম। বন্ধুরা তাকে ডাকত চন্দ্রানী বলে। মা ডাকতেন চানু বলে। বন্ধুদের সামনে মার এই ডাকটা শুনে চন্দ্রানী একটু বিব্রত বোধ করত।
চন্দ্রানী যখন মাধ্যমিক পাশ করল। বাবা তার জন্য এক এক পাত্র জোগাড় করলেন। ছেলেটির বয়স একটু বেশি হলেও, বাবার এক বন্ধুর মুখে শুনেছে সে নাকি ভাল চাকরি করে। কী চাকরি করে, কোথায় চাকরি করে, তার কোন খোঁজ খবর ভাল করে না নিয়ে বাবা তার সাথে চন্দ্রানীর বিয়ের ব্যবস্থা পাকা করে ফেললেন। ফলে, ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ের মতো করে, ভাল করে কিছু বোঝার আগেই চন্দ্রানীর বিয়ে হয়ে গেল।
যদিও চন্দ্রানী বিয়ের পর জেনে ছিল, তার বর নিশীথ গেঞ্জীর কারখানায় দৈনিক বেতনে কাজ করে। কাজে গেলে, কাজ করলে সেই অনুযায়ী টাকা পায়। না গেলে কোন টাকা নেই। এই ভাবে একটা সংসার চালান যায়? বাবার সংসারে একটা মাসিক আয় ছিল। মাসের প্রথমে মাইনে পেলে, সারা মাসের চাল, ডাল, তেল, আটা-ময়দা কিনে রাখা হত। সপ্তাহে দু’দিন বাবা সবজী মাছ বাজার করতে বাজারে যেতেন।
তাছাড়া লোকটা ছিল উদ্ধত স্বভাবের। খাম-খেয়ালী। ইচ্ছে হলে কারখানায় যেত, না হলে যেত না। চন্দ্রানীর প্রতি তার কোন মায়া মমতা ছিল না। চন্দ্রানী যেন বাড়ির কাজের মেয়ে, এমন ভাবে তার সঙ্গে ব্যবহার করত হিমাংশু। সে কারণে চন্দ্রানীর সঙ্গে তার কোন মনের মিল ছিল না। মনের ব্যথা মনের ভিতর চেপে রেখে সে তার সংসার করতে লাগল।
চন্দ্রানীর বিয়ের কিছুদিন পর তার বাবা হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। চন্দ্রানীর মনের চাপা কষ্টের কথা তিনি জেনে যেতে পারেননি। না জেনে খুব ভালই হয়েছে। জানলে খুব কষ্ট পেতেন।
অনেকদিন পর চন্দ্রানীর হঠাৎ মলয়ের কথা মনে পড়ল। কিশোরী বয়সের শেষ লগ্নে, বয়সের সন্ধিক্ষণে মলয় সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল। ঘনিষ্টতাও গড়ে উঠেছিল। সে সম্পর্ক শাখা-পল্লবে পল্লবিত হতে পারনি তার মনের জোরের অভাবে। সে সময় সে খুব ভীতু ছিল এসব ব্যাপারে। মলয় অনেকটা সাহসী ছিল।
একদিন চাঁদনি রাতে চাঁদ দেখতে দেখতে সে বলল, জান এখন আমি চাঁদকে চুমু খেতে পারি।
- কি ভাবে?
- দেখবে?
- দেখি।
বলার সঙ্গে সঙ্গে আলটপকা আমার গালে একটা চুমু দিয়ে ফেলল।
আমি রেগে গিয়ে বললাম, এটা কি হল? - চন্দ্রাননী মানে চাঁদপনা মুখ। আমি তো সেখানেই চুমু দিলাম, সেটা চাঁদে গিয়ে পড়ল না? বলেই সে হো হো করে হাসতে শুরু করল। তার হাসি দেখে তখন আমার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিল। সে রাগ হলেও আজ সে কথা ভেবে খুব মজা লাগছে। আজ তারও হাসি পাচ্ছে। মনে পড়ছে বাবার কাছে থাকা একটা ম্যাগাজিনে, সে একটা কবিতা পড়েছিল। কবিতাটার নাম – চিরন্তন। তাতে লেখা ছিল –
“যদি প্রকাশ করতে হয়
সেই ক্ষুদ্র চিরন্তন মুহূর্তটি
সারাজীবনেও কুলোবে না
এ’ কথা নিশ্চিত।
জীবনেরর প্রথম চুম্বনস্বাদ
মৃদু আলিঙ্গন
এই পৃথিবীর বুকে যেন
অন্যকোন গ্রহের সন্মোহন।”
চন্দ্রানী যদি সেদিন রাগ না করে, তার মতো সাহসী হয়ে উঠতে পারত, তাহলে আজ কি হত বলা যায় না। চন্দ্রানী শুনেছে, মলয়ের বিয়ে হয়েছে।
এখন কেমন আছে মলয়? চন্দ্রানীর কথা কি এখন তার একবারও মনে পড়ে না?
চন্দ্রানী বিছানায় শুয়ে শুয়ে এইসব কথা ভাবছিল। ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়ছে টের পায়নি।
নিশীথের ডাকে সে ধড়মড় করে উঠে বিছানায় বসল। নিশীথ তাকে একটা অশ্লীল গালাগাল দিয়ে বলল, এটা ঘুমোবার সময় হল মাগী। জানিস না তুই, আমি এখন কারখানা থেকে ফিরব। নিশীথ প্রায়ই তার সঙ্গে এ রকম ব্যবহার করত। তুই-তোকারি করে কথা বলত। খিস্তি করত হামেশাই।
যার কাছ থেকে কেউ সব সময় খারাপ ব্যবহার পায়, তার রুক্ষ ব্যবহার তাকে আর ততটা আহত করতে পারে না।
চন্দ্রানী বিছানা থেকে উঠে পড়ে, পরনের কাপড় ঠিক করে, স্বাভাবিক ভঙ্গীতে রান্না ঘরের দিকে গেল। নিশীথের জন্য চা-জল খাবার তৈরী করতে। রুটি আর আলু চচ্চরি। সঙ্গে চা।
নিশীথ জামা প্যান্ট ছেড়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ল। নিশীথের ব্যবহারের গ্লানি তার হৃদয় স্পর্শ করল না। স্বপ্নের আবেশ তখনও তার মন জুড়ে আছে।
সে ভাবতে লাগল, এতদিন পরে কেন সে মলয়কে স্বপ্ন দেখল। এর কারণ কি?
অনেকদিন আগে মলয়কে নিয়ে সে আর একটা আজগুপি স্বপ্ন দেখেছিল, যার কোন মানে হয় না। মনে পড়ে গেল। সে দেখেছিল, মলয় ও সে কোন একটা পাহাড়ে উঠছে। খুব উঁচু পাহাড়টা। পাহাড় কেটে পথ করা বলে, পথটা খুব এবড়ো-খেবড়ো, উঁচু-নীচু। চন্দ্রানীর উঠতে কষ্ট হচ্ছে দেখে, মলয় তাকে পাঁজা কোলে ধরে তুলে নিয়ে, পাহাড়ে উঠতে শুরু করল। সে ভয়ে চিৎকার করে তাকে নীচে নামাতে বলছে। আর মলয় তা শুনে হো হো করে বিভৎস ভাবে হাসছে।
চন্দ্রানীর খুব রাগ হয়ে ছিল মলয়ের হাসি শুনে।
সে মলয়ের কোল থেকে ঝাঁপিয়ে নীচে নেমে, টাল সামলাতে না পেরে, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়াতে গড়াতে একটা পাইন গাছের গোড়ায় এসে আটকে গেছিল। তৎক্ষণাৎ তার ঘুমটা ভেঙে গিয়ে বুকের ভিতরটা ধরাস ধরাস করছিল।
এই সব ভাবতে ভাবতে রুটি চাটুতে সেঁকবার সময়, তার অন্যমনস্কতায় ডান হাতটা পুড়ে গেল। সে হাত উলটে দেখল, মধ্যমা আর অনামিকা গরমে পুড়ে লাল হয়ে উঠেছে। জ্বালা করছে। সে গ্যাস ওভেনটা বন্ধ করে, ঘরে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের ড্রায়ার থেকে বের করে পোড়ার মলম লাগাল।
নিশীথ বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এসে, তা দেখে বলে, কি হয়েছে?
চন্দ্রানী মুখে কোন উত্তর না দিয়ে, মলমটা তার আঙুল দুটোয় লাগাতে থাকে।
– হাত পুড়বে না মাগি? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাজ করলে এই হয়। বলে নিশীথ আয়নার সমনে দাঁড়িয়ে পরিপাট করে চুল আঁচড়াতে লাগল।
সামান্য একটু সহানুভূতি দেখিয়ে তার হাতটা একবার দেখতে চাইল না। বরং তাকে শ্লেষ করে বলল, কার কথা ভাবছিলিস মনে মনে? আগে এসব ভাবলে চন্দ্রানীর খুব দুঃখ হত। মনে খুব কষ্ট পেতো।আজকাল আর তা হয় না।