নিশিকন্যা
মেঘনা নদীর তীরে ছোট একটা শহরে এক অনুষ্ঠানে গিয়েছি। স্কুলের ছেলেমেয়েদের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান, আয়োজকরা খুব খাটাখাটুনি করে আয়োজন করেছেন। ছোট বাচ্চাকাচ্চারা পুরস্কার নিতে এসেছে, আমিও পুরস্কার দিতে দিতে মোটামুটি এক্সপার্ট হয়ে গেছি। বাচ্চারা আগে পুরস্কারটা নেবে নাকি আগে হ্যান্ডশেক করবে সেটা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকে, আমি সেগুলো মিটিয়ে দিই। দিশেহারা টাইপের বাচ্চাগুলোর নাম জিজ্ঞেস করে সার্টিফিকেটের সাথে মিলিয়ে নিই এবং যাদের বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়ের পুরস্কার গ্রহণের দৃশ্যের ছবি তোলার জন্যে ক্যামেরা নিয়ে এসেছেন, তারা যতক্ষণ পর্যন্ত ছবিটা ঠিকমতো না তুলছেন ততক্ষণ পর্যন্ত পুরস্কারটা ধরে রেখে বাচ্চাটাকে স্টেজে আটকে রাখি। এ ধরনের অনুষ্ঠান সাধারণত শুরু হয় দেরি করে এবং কখনোই সময়মতো শেষ হয় না। কিন্তু অনুষ্ঠান শেষে আমি অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম যে আয়োজকরা ঠিক সময়মতো অনুষ্ঠান শেষ করে ফেলেছেন-আমি হাতে কিছু সময় রেখেছিলাম এবং সেই পুরো সময়টুকু এখন উদ্বৃত্ত!
বাড়তি সময় নিয়ে কী করা যায় সেটা নিয়ে আলোচনা করছি তখন মধ্যবয়স্ক একজন ভদ্রলোক বলেন, “স্যার আমাদের গ্রামে চলেন।”
আয়োজকদের একজন ধমক দিলেন, বললেন, “স্যারের এখন খেয়েদেয়ে কাজ নেই আপনার গণ্ডগ্রামে যাবেন!”
ভদ্রলোক তবু দুর্বলভাবে চেষ্টা করলেন, বললেন, “খুব সুন্দর গ্রাম স্যার। নদীর তীরে একেবারে ছবির মতন–”
একজন হা হা করে হেসে বললেন, “রাস্তাঘাট নাই, ইলেকট্রিসিটি নাই, হাঁটু উঁচু কাদা, কোন জায়গাটা ছবির মতো?”
অন্য একজন বললেন, “স্যারের হাতে সময় খুব বেশি হলে তিন ঘণ্টা। আপনার গ্রামে নৌকা করে যেতেই তো লাগবে তিন ঘণ্টা!”
মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক বললেন, “ট্রলারে গেলে এক ঘণ্টায় যাওয়া যাবে, আর টিএনও সাহেবকে বলে স্পিডবোটটা নিলে তো কথাই নাই। আধা ঘণ্টার মাঝে–”
অন্যেরা রীতিমতো হৈ হৈ করে তাকে থামিয়ে দিল। ভদ্রলোক তবু হাল ছাড়লেন না, আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “চলেন স্যার, আপনি রাজি হলেই হয়ে যাবে। আপনি খুব পছন্দ করবেন স্যার। একটা বটগাছ আছে কমপক্ষে এক হাজার বছরের পুরনো। একটা গোরস্তান–”
আয়োজকদের একজন রাগ হয়ে বললেন, “মাস্টার সাহেব, আপনি তো আচ্ছা মানুষ, স্যারকে গোরস্তানে নিয়ে যেতে চাইছেন।”
অন্য একজন বলল, “এদিকে চেয়ারম্যান সাহেব খবর পাঠিয়েছেন, স্যারকে নিয়ে যাবার জন্যে। চা-নাস্তার ব্যবস্থা করবেন।”
চেয়্যারম্যান সাহেবের বাসায় চা-নাস্তা খাবার আয়োজন শুনে আমি অবিশ্যি নার্ভাস হয়ে গেলাম। এর চাইতে মেঘনা নদীতে ট্রলারে করে ঘণ্টাখানেক নৌকা ভ্রমণ মন্দ ব্যাপার নয়। হাজার বছরের পুরনো বটগাছ এবং গোরস্তান কেক এবং সমুছা থেকে অনেক ভালো। আমি তাই মধ্যবয়স্ক মানুষটির দিকে তাকিয়ে বললাম, মাস্টার সাহেব, আপনি গোরস্তানের কথা কী যেন বলছিলেন?”
আমার কথায় মধ্যবয়স্ক মাস্টার সাহেব উৎসাহ পেলেন, চোখ বড় বড় করে বললেন, “স্যার গোরস্তানটা কত পুরনো কেউ জানে ভাঙা একটা দেওয়াল আছে, দেখে মনে হয় কয়েক হাজার বছরের পুরনো।”
ভদ্রলোকের একটু বাড়িয়ে বলার বাতিক আছে, কথাবার্তা বলার জন্যে এরকম মানুষ মন্দ নয়। আমি অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললাম, “বেশ ইন্টারেস্টিংই তো মনে হচ্ছে! ঘুরে আসলে মন্দ হয় না, কী বলেন?”
আয়োজকদের একজন বললেন, “কষ্ট হবে স্যার অনেক!”
চেয়ারম্যান সাহেবের বাসায় চা-নাস্তা খাবার ভয়ে আমি হাত নেড়ে উড়িয়ে দিয়ে বললাম, “কিচ্ছু কষ্ট হবে না। ট্রলারে করে যেতে আমার খুব ভালো লাগে!” কাজেই কিছুক্ষণের মাঝেই আমরা মাস্টার সাহেবের গ্রাম দর্শনে বের হয়ে গেলাম। ভদ্রলোকের পুরো নাম আজীজুর রহমান, সবাই ডাকে আজীজ মাস্টার। তার গ্রামের নাম বাঘাইকান্দি, সেই গ্রামের হাইস্কুল বাঘাইকান্দি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনজন পুরস্কারপ্রাপ্ত ছেলেমেয়ে নিয়ে এসেছিলেন, এখন আমাদের ট্রলারে করে ফিরে যাচ্ছেন। ভদ্রলোকের কথা বলার বাতিক আছে, একটানা কথা বলে গেলেন, তবে ট্রলারের ইঞ্জিনের বিকট শব্দের কারণে তার কথার বেশির ভাগ শুনতে হলো না, আমি হুঁ হুঁ বলে কাজ চালিয়ে গেলাম।
বাঘাইকান্দি গ্রাম একেবারে খাঁটি অজপাড়াগাঁ-সেখানে মনে হয় ট্রলার পর্যন্ত যায় না। কাজেই যখন ট্রলার এসে ভিড়ল তখন মানুষের ভিড় জমে গেল। আজীজ মাস্টার বিশেষ সমাদর করে আমাকে নামালেন এবং একটানা ধারা বর্ণনা দিয়ে গেলেন, “স্যার এই গ্রামের নাম বাঘাইকান্দি তার একটা ইতিহাস আছে। একবার বন্যার পানিতে এক বাঘ ভেসে এলো, একেবারে রীতিমতো রয়েলবেঙ্গল টাইগার। মানুষ ভয়ে অস্থির। অনেক আগের ঘটনা, কারো কাছে বন্দুক নাই বাঘকে গুলি করতে পারে না। অনেক বুদ্ধি করে গ্রামের মানুষ বিশাল এক গর্ত করল, ওপরে গাছপালা দিয়ে ঢাকা দিয়ে একদিন বাঘকে চারদিক থেকে ঘিরে তাড়া করল! ঢাকঢোল বাজিয়ে চিৎকার করে মশাল জ্বালিয়ে আসছে-তাড়া খেয়ে বাঘ সেই গর্তে গিয়ে পড়েছে! সেই গর্ত থেকে বাঘ আর বের হতে পরে না। সারারাত গর্জন করে আর সারারাত কান্দে! সেই থেকে গ্রামের নাম বাঘাইকান্দি।”
জিজ্ঞেস করলাম, “কতদিন আগের ঘটনা?”
“বেশিদিন আগের না, আমার দাদা নিজের চোখে দেখেছেন—”
“ইন্টারেস্টিং!” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এই ঘটনার আগে। তাহলে গ্রামের নাম কী ছিল?”
আজীজ মাস্টার মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললেন, “ ইয়ে-সেটা তো জানি না।”
আয়োজকদের একজন বলল, “নিশ্চয় বিলাইকান্দি!”
উপস্থিত অনেকেই সেটাকে উঁচুদরের রসিকতা মনে করে হি হি করে হাসতে শুরু করল।
তবে আজীজ মাস্টারের কথা সত্যি, গ্রামটি আসলেই একেবারে ছবির মতোন। নদীর তীর অনেক উঁচু, সেখানে দাঁড়িয়ে সামনে সুবিস্তৃত মেঘনা নদীকে দেখলে বুকের ভেতরে বিচিত্র একধরনের শূন্যতার অনুভূতি হয়। নদীর ঘাটে ইট দিয়ে বাঁধানো সিঁড়ি-সিঁড়ির পাশে বসার জন্যে বেদী। তার কাছাকছি ছোট একটা টিনের ঘর। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কার ঘর?”
“চেয়ারম্যান সাহেবের।”
“কে থাকে?”
“এমনিতে কেউ থাকে না। আপনার মতো গেস্ট আসলে থাকার ব্যবস্থা হয়।”
শুনে আমি চমৎকৃত হলাম, সত্যিই নদীর তীরে এরকম ছোট একটা ঘরে কিছুদিন থাকতে পারলে মন্দ হতো না। বারান্দায় বসে নদীর দিকে তাকিয়ে আছি, আকাশ কালো করে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে, টিনের ছাদে ঝমঝম করে শব্দ হচ্ছে, সেই শব্দ ছাপিয়ে ব্যাঙের ডাক শুনতে পাচ্ছি-চিন্তা করেই আমি কেমন জানি দুর্বল হয়ে গেলাম। আমার চেহারায় সেটা নিশ্চয়ই ধরা পড়েছিল, কারণ আজীজ মাস্টার বললেন, স্যার আজকে তো দেখে গেলেন। আপনাকে কিন্তু একবার বেশ কয়েকদিনের জন্যে আসতেই হবে!”
আমি অন্যমনস্কভাবে মাথা নেড়ে বললাম, “আসব। নিশ্চয়ই আসব।”
“আমি যোগাযোগ রাখব স্যার।”
“রাখবেন।”
“আমি নিজে গিয়ে আপনাকে নিয়ে আসব স্যার।”
আমি অন্যমনস্কভাবে বললাম, “ঠিক আছে।”
বাঘাইকান্দি গ্রামের বিখ্যাত বটগাছ এবং গোরস্তান দেখে যখন আমরা ফিরে এলাম তখন সূর্য ঢলে পড়ে বিকেল হয়ে এসেছে।
সত্যি সত্যি আমি আবার কখনো বাঘাইকান্দি গ্রামে যাব ভাবিনি। কিন্তু মাস তিনেক পর হঠাৎ একদিন আজীজ মাস্টারের একটা চিঠি এসে হাজির। সেখানে নানা ধরনের ভূমিকার পর লেখা—
“…আগামী ১৫ই আষাঢ় পূর্ণিমার রাত। এখন বর্ষাকাল, আকাশে মেঘের ঘনঘটা। মেঘের ফাঁকে যখন পূর্ণিমার চাঁদ উঁকি দেয় সেই দৃশ্য অতীব মনোহর। মেঘনা নদীর তীরে বসিয়া আপনাকে সেই দৃশ্য দেখিবার আমন্ত্রণ জানাইবার জন্যে এই পত্র লিখিতেছি। আপনি অনুমতি দিলে আমি নিজে আসিয়া আপনাকে লইয়া যাইব।…”
এরপর আমি উপস্থিত হলে বাঘাইকান্দি গ্রামের মাটি কীভাবে “ ধন্য হয়ে যাবে তার একটা মোটামুটি চমকপ্রদ বর্ণনা আছে। হিসেব করে দেখতে পেলাম আজীজ মাস্টার যে সময়ের কথা বলেছেন সেই সময়ে আমি সত্যি সত্যি নির্ঞ্ঝাট, সত্যি সত্যি আমার নিরিবিলি বসে খানিকটা লেখাপড়া করা দরকার এবং সে কারণে বাঘাইকান্দিতে গিয়ে এক সপ্তাহ কাটিয়ে সেখানকার মাটিকে “ধন্য” করে দিয়ে এলে এক ঢিলে বেশ কয়েকটা পাখি মারা যায়। কাজেই আমি আজীজ মাস্টারের চিঠির উত্তর দিলাম এবং তিনি সত্যি সত্যি একদিন আমাকে নিয়ে যাবার জন্যে দলবল নিয়ে হাজির হয়ে গেলেন।
ভোরবেলা রওনা দিয়ে বাঘাইকান্দি গ্রামে আমি যখন পৌঁছেছি তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। শেষবার এসেছি গরমের সময়ে, নদীর পানি ছিল কম। এখন বর্ষা নেমেছে নদীর পানি ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। একটু আগে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, বাতাসে ভেজা একধরনের সজীবতা। আকাশে বড় একটা চাঁদ উঠেছে, মেঘ কেটে সেই চাঁদ চারিদিকে নরম একটা আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। আমি অবিশ্যি কিছুই উপভোগ করার সুযোগ পাচ্ছি না, কারণ আমাকে তোলা হয়েছে চেয়ারম্যানের বাড়ি এবং গ্রামের গণ্যমান্য মানুষ সেখানে হাজির হয়েছেন। খাবারের আয়োজন হচ্ছে এবং যতক্ষণ খাবার দেয়া না হচ্ছে ততক্ষণ আলোচনা চলছে। আমাকে কোথায় রাখা যায় সেটিই হচ্ছে আলোচনার বিষয়বস্তু। যে মানুষটি সবচেয়ে বেশি কথা বলছে সে সম্ভবত গ্রামের বড় মাতব্বর। সবাই তাকে মুসলিম চাচা বলে ডাকছে। মানুষটি গম্ভীর হয়ে বলল, “এই স্যারকে মনে হয় চেয়ারম্যান বাড়িতেই রাখতে হবে।”
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, “আমি নদীতীরের সেই ছোট ঘরটিতে থাকব।”
আমি খুব একটা অশালীন কথা বলে ফেলেছি সেরকম ভঙ্গি করে কয়েকজন জিবে কামড় দিলেন। মুসলিম চাচা বললেন, “আপনি ওইখানে একলা থাকবেন কীভাবে? ঝড়বৃষ্টির সময়”
আমি বললাম, “আমি একলা থাকার জন্যেই এসেছি। লোকজনকে নিয়ে থাকতে হলে আমি যেখানে ছিলাম সেখানেই থাকতাম।”
মুসলিম চাচা গম্ভীর মুখে বললেন, “আপনি চাইলেই তো হবে না। আমাদের একটা দায়িত্ব আছে? যদি আপনার কিছু একটা হয়?”
“আমার কী হবে?”
“এমনিতে ঝড়বৃষ্টির কাল তার ওপর যদি” মুসলিম চাচা হঠাৎ কথা বলা বন্ধ করে থেমে গেলেন।
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, “যদি কী?”
অন্য একজন তখন বললেন, “আরে না! এই রাত্রিবেলা এখন এসব নিয়ে কথা বলা ঠিক না।”
কাজেই কেউ আর বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হলো না। আমি কথাটি শোনার জন্যে চাপাচাপি করলাম না, গ্রামের মানুষ প্রায় সময়েই কুসংস্কারের ডিপো হয়-খামোখা তাদের সব কথায় গুরুত্ব দিতে নেই।
গ্রামের সবাই মিলে আমাকে চেয়ারম্যান বাড়ির বাংলাঘরে শোওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলছিল। আমি গোঁ ধরে থাকলাম, আমি নদীতীরের ছোট ঘরটাতে থাকব। আজীজ মাস্টার শেষ পর্যন্ত আমার পক্ষ নেয়ায় তাদের অনেক কষ্টে রাজি করানো গেল। রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর হারিকেন এবং টর্চলাইট জ্বালিয়ে কয়েকজন মিলে আমাকে নদীতীরের ছোট ঘরটাতে পৌঁছে দিয়ে গেল।
শোওয়ার এবং থাকার সব ব্যবস্থা করে দিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় আজীজ মাস্টার বললেন, “স্যার, যাবার আগে একটা কথা বলে যাই।”
“কী কথা?”
“রাতবিরেতে যদি কিছু দেখেন ভয় পাবেন না।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “কী দেখব?”
“কারো ক্ষতি করে না।”
আমি আরো অবাক হয়ে বললাম, “কে কারো ক্ষতি করে না?”
“গ্রামের অনেকেই দেখেছে। যারা দেখে নাই তারা শুনেছে।”
আজীজ মাস্টারের এরকম হেঁয়ালি টাইপের কথা শুনে আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, “কী বলবেন পরিষ্কার করে বলে ফেলেন। আপনি কার কথা বলছেন?”
“নিশিকন্যা।”
“নিশিকন্যা?”
“হ্যাঁ। রাত্রিবেলা বের হয়।”
“সেটি কে?”
“কেউ জানে না। তবে রাত্রে তাদের নাম নেওয়া ঠিক না।”
আমি বেশ অবাক হয়ে আজীজ মাস্টারের দিকে তাকালাম-এই নতুন সহস্রাব্দে এসে আমায় যদি ভূত-প্রেতের কথা শুনতে হয় তাহলে তো মুশকিল। আজীজ মাস্টার আমার মুখ দেখে কিছু একটা আন্দাজ করতে পারল, ইতস্তত করে বলল, “ স্যার, আপনারা শহরে থাকেন, সেখানে এক রকম জীবন। গ্রামের জীবন অন্যরকম-অনেক বিচিত্র জিনিস থাকে গ্রামে!”
“তাই তো দেখতে পাচ্ছি!”
“একটু সাবধানে থাকবেন স্যার। শব্দ শুনলেই ঘর থেকে বের হবেন না। এখনো কারো কোনো ক্ষতি করে নাই; কিন্তু আপনি বিদেশি মানুষ—”
আমি হাসব না কাদব বুঝতে পারলাম না। আজীজ মাস্টারকে বললাম, “ভূত-প্রেত দত্যি-দানব এইসবে আমার ভয় নাই। আমার ক্ষতি করতে চাইলেও আপত্তি নাই। তবে চোর-ডাকাতের উৎপাত থাকলে বলেন।”
আজীজ মাস্টার জিবে কামড় দিয়ে বললেন, “বাঘাইকান্দি গ্রামে চোর-ডাকাতের কোনো উৎপাত নাই স্যার! আপনি ঘরের দরজা খুলে ঘুমান। কেউ একটা সুতাও নিয়ে যাবে না।”
“তাহলেই হলো।”
আমি হারিকেনের আলো উসকে দিয়ে ঘরের একমাত্র টেবিলে কাগজপত্র বের করে চেয়ারে বসলাম, বললাম, “অনেক কাজ বাকি কাজ শুরু করে দিচ্ছি আমি।”
ইঙ্গিতটি স্পষ্ট, আজীজ মাস্টার তখন তখনই চলে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়ালেন।
রাত বারোটা পর্যন্ত লেখালেখি করে আমি শুতে গেলাম। নতুন জায়গায় ঘুম আসতে একটু দেরি হচ্ছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত নদীর শব্দ শুনতে শুনতে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। গভীর রাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল। কেন হঠাৎ করে ঘুম ভেঙেছে আমি বুঝতে পারলাম না, খানিকক্ষণ নিঃশব্দে শুয়ে থাকি এবং তখন শুনতে পেলাম খুব নিচু স্বরে কেউ একজন কাঁদছে আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে শোনার চেষ্টা করলাম তখন মনে হলো ঠিক কান্না নয় একটি মেয়ে নিচু স্বরে গান গাইছে, কথাগুলো শোনা যাচ্ছে না কিন্তু খুব করুণু সুর, মনে হয় কারো মনে কিছু একটা নিয়ে খুব কষ্ট। আমি ভূত-প্রেত বিশ্বাস করি না, অলৌকিক কিছু বিশ্বাস করি না কিন্তু গভীর রাত্রে এই নির্জন নদীতীরে হঠাৎ করে নারীকণ্ঠে এই করুণু গানের সুর শুনে আমার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। আমি নিঃশব্দে বিছানায় উঠে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম, আকাশে মেঘের আড়ালে চাঁদ ঢাকা পড়ে আছে, বাইরে আবছা অন্ধকার। তার মাঝে মনে হলো এটা নারীমূর্তি বারান্দায় হাঁটুমুড়ে বসে আছে। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইলাম, দেখতে পেলাম, খুব ধীরে ধীরে সেই ছায়ামূর্তিটি উঠে দাঁড়াল তারপর হেঁটে হেঁটে নদীতীরের দিকে হেঁটে গেল। নদীর তীরে বাঁধানো বেদীর ওপরে গিয়ে মূর্তিটি দাঁড়িয়ে থাকে, আকাশে মেঘ জমেছে হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চমকে ওঠে এবং ছায়ামূর্তিটি দুই হাতে মুখ ঢেকে আর্তনাদ করে ওঠে! মনে হলো তাকে কিছু একটা আঘাত করেছে, ছায়ামূর্তিটি নিচে লুটিয়ে পড়ল, আবার বিদ্যুৎ চমকে উঠতেই ছায়ামূর্তিটি উঠে দাঁড়ায় তারপর যন্ত্রণায় কাতর শব্দ করে ছুটতে থাকে-কিছুক্ষণের মাঝেই দূরে গাছপালার মাঝে সে অদৃশ্য হয়ে যায়। আমার যতদূর মনে পড়ে বাঘাইকান্দি গ্রামের প্রাচীন গোরস্তানটা সেদিকে। আমার শরীর হঠাৎ আতঙ্কে শিউরে উঠল।
ভোরবেলা আজীজ মাস্টার আমার জন্যে নাস্তা নিয়ে এলো, বিশাল গোলাকৃতি পরোটা, সেদ্ধ ডিম এবং ফ্লাস্কে করে চা। আমি এর আগে কখনো সেদ্ধ ডিম দিয়ে পরোটা খাই নি এবং কেউ যে সেটা খেতে পারে সেটা জানতামও না। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ করলাম যে, বেশ তৃপ্তি করে বিশাল ডালার মতো দুই দুইটা পরোটা সিদ্ধ ডিম দিয়ে খেয়ে ফেললাম। এমনকি পায়েসের মতো চাটাও বেশ তৃপ্তি করে খেলাম। আজীজ মাস্টারও আমার সাথে চা খেতে খেতে বলল, “স্যার, আপনার কথাটা আমি খুব ভালো করে চিন্তা করেছি।”
“কোন কথাটা?”
“ওই যে আপনি বললেন আপনি ভূত-প্রেত বিশ্বাস করেন না।”
“চিন্তা করে কী দেখলেন?”
“চিন্তা করে দেখলাম, আসলে ভূত বলে কিছু নাই। এই যে মনে করেন নিশিকন্যার ব্যাপারটা, কেউ কিন্তু নিজে সেটা দেখে নাই। একজনকে জিজ্ঞেস করলে বলে সে দেখে নাই আরেকজনকে জিজ্ঞেস করলে বলে সেও দেখে নাই আরেকজন দেখেছে। আমার মনে হয় আসলে কেউই দেখে নাই।”
আমি কোনো কথা না বলে চুপ করে রইলাম। আজীজ মাস্টার বলল, “গ্রামের একেকটা মানুষ হচ্ছে কুসংস্কারের একেকটা বস্তা। আপনি এসেছেন ভালোই হলো আপনাকে দিয়েই গ্রামের একটা উপকার করব। আপনি স্যার একটা ঘোষণা দেবেন—”
“কী ঘোষণা দেব?”
“ঘোষণা দেবেন যে নিশিকন্যা বলে কিছু নাই। এবং কেউ যদি নিশিকন্যা দেখাতে পারে তাহলে তাকে একটা পুরস্কার দেওয়া হবে।
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, “মাস্টার সাহেব, কাল রাত্রে আমি আপনাদের নিশিকন্যাকে দেখেছি।”
আজীজ মাস্টারের হাতে গরম চায়ের কাপ ছিল, আমার কথা শুনে তার চায়ের কাপ থেকে গরম চা তার শরীরে ছলকে পড়ল, সে এত হতবাক হয়েছিল সে সেটা টের পর্যন্ত পেল না। সে কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, “আ-আ-আপনি দেখেছেন?”
আমি মাথা নাড়ালাম।
“নি-নিজের চোখে দেখেছেন?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “হ্যাঁ নিজের চোখে দেখেছি।”
আজীজ মাস্টার কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তার মানে নিশিকন্যা সত্যি! ভূত-প্রেত সত্যি!”
আমি আপত্তি করে বললাম, “আমি সেটা বলি নি। আমি বলেছি যে আমি গতরাতে নদীর ঘাটে একটা মেয়েকে দেখেছি! খুবই বিচিত্র মেয়ে-গভীর রাতে দেখে আমি রীতিমতো ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু সেটা ভূত তা আমি বলি নি!”
“তাহলে সেটা কী?”
“হতে পারে কোনো মানসিক রোগী।”
“এই গ্রামে কোনো মানসিক রোগী নাই। কোনো পাগল নাই। মাথা খারাপ নাই। আমি সবাইরে চিনি।”
আমি বললাম, “হতে পারে হঠাৎ হঠাৎ সে অস্বাভাবিক কিছু করে।”
আজীজ মাস্টার মাথা নাড়ল, বলল, “যদি সেরকম কিছু হতো তাহলে তার ফেমিলির মানুষ জানতো।”
“হতে পারে তাহলে অন্য গ্রামে থেকে এসেছে।”
“জি না স্যার। বর্ষাকালে বাঘাইকান্দি গ্রাম একটা দ্বীপের মতোন, অন্য গ্রাম থেকে কেউ আসতে পারে না, অন্য গ্রামে কেউ যেতেও পারে না।”
আমি কী বলব বুঝতে পরলাম না। ইতস্তত করে বললাম, “ কিন্তু তাই বলে তো সত্যি সত্যি ভূত হতে পারে না।”
“কেন হতে পারে না।”
“কারণ ভূত বলে কিছু নাই।”
আজীজ মাস্টার চোখ কপালে তুলে বলল, “আপনি নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করবেন না।”
“আমি কোনো ভূত দেখি নাই। একটা মেয়েকে দেখেছি।”
“কী করেছে সেই মেয়ে?”
আমি তখন গতরাতের ঘটনা খুলে বললাম, যখন ছুটে চলে যাবার কথা বলেছি তখন আজীজ মাস্টার বিস্ফারিত চোখে বলল, “কোন দিকে গেছে বললেন?”
আমি হাত দিয়ে দূরের গাছপালাগুলো দেখিয়ে দিতেই আজীজ মাস্টার শিউরে উঠল, বলল, “সর্বনাশ! ওদিকে তো গোরস্তান।”
“তাতে কী হয়েছে?”
“তারপরেও আপনি বলছেন এইটা ভূত না।”
“বলছি। ভূত বলে কিছু নাই।”
আজীজ মাস্টার খানিকক্ষণ চোখ-মুখ কুঁচকে কোনো একটা জিনিস নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে বলল, “মনে হয় সুলতানের বউ।”
“কার বউ?”
“সুলতানের বউ। কয়দিন আগে এক্লেমশিয়া হয়ে মারা গেছে।”
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। আজীজ মাস্টার বলল, “ প্রদীপের বউও হতে পারে। গত বছর গলায় দড়ি দিয়েছিল।”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “না মাস্টার সাহেব, আমি যেহেতু নিজের চোখে দেখেছি, এটি ভূত-টুত কিছু নয়। এটা একজন মানুষ। আপনি ভালো করে খোঁজ নেন, আপনাদের গ্রামে নিশ্চয়ই কেউ আছে যে মানসিকভাবে অসুস্থ, যার কথা আপনি জানেন না।
ছোট বাচ্চারা অর্থহীন কথা বললে বড়রা যেভাবে তাদের দিকে তাকায় আজীজ মাস্টার ঠিক সেভাবে আমার দিকে তাকাল।
আমি এসেছিলাম এখানে নিরিবিলি কাজ করতে কিন্তু মনে হলো সেটি আর সম্ভব হবে না। কিছুক্ষণের মাঝেই সারা গ্রামে রাষ্ট্র হয়ে গেল যে গতরাতে আমি নিশিকন্যাকে দেখেছি এবং যত সময় যেতে লাগল সেই গল্পটি ততই ডালপালা গজিয়ে ছড়াতে লাগল। আমার নিজের মুখ থেকে সেই গল্পটি শোনার জন্যে গ্রামের মানুষ এসে ভিড় করতে থাকে। একটু বেলা হতেই গ্রামের কিছু মুরুব্বির সাথে চেয়ারম্যান এবং মুসলিম চাচাও এসে হাজির হলেন। চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, “স্যার গতরাত্রে নিশিকন্যা নাকি আপনার ওপর হামলা করেছে?”
আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম, “জি না। হামলা করে নাই।”
মুসলিম চাচা মাথা নেড়ে বললেন, “শুক্কুর আলহামদুলিল্লাহ্! আমরা আরও শুনেছি আপনি রাত্রে ভয় পেয়েছেন?”
“জি না, আমি ভয় পাই নাই।”
চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, “কিন্তু ব্যাপারটা তো ভয়ের-যদি কিছু একটা হতো?”
মুসলিম চাচা বললেন, “আপনি বিদেশি মানুষ। বাঘাইকান্দি গ্রামের মেহমান–”
আমি বললাম, আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমি ভালোই আছি।”
“ভূত-প্রেতের ব্যাপার। সাবধান থাকা ভালো।”
আমি সারাদিনই চেষ্টা করেছি সবাইকে বোঝানোর জন্যে যে এটা ভৌতিক কিছু নয়, কিন্তু বিশেষ লাভ হয় নি। এখনও লাভ হবে না বলে আমি আর চেষ্টা করলাম না। চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, “স্যার, আপনাকে আমরা নিতে এসেছি।”
“কোথায় নিতে এসেছেন?”
“আমার বাড়িতে। বাংলাঘরে আপনার শোওয়ার ব্যবস্থা করেছি।”
“কেন?”
“এইখানে আপনাকে আর থাকতে দেওয়া যায় না। কখন কী বিপদ হয়!”
আমি হেসে বললাম, “কোনো বিপদ হবে না। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকেন।
গ্রামের মুরুব্বি, চেয়ারম্যান সাহেব আর মুসলিম চাচা সবাই মিলে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করল, কিন্তু আমি রাজি হলাম না!
দুপুরের দিকে যখন বুঝতে পারলাম আজকে আমার নিরিবিলি কাজ করার কোনো উপায় নেই-তখন আমি নিজেই আজীজ মাস্টারকে নিয়ে বের হয়ে গেলাম। আমার কাছে সবাই যেটা শুনতে চাইছে নিজের যদি সেটা বলে দিয়ে আসি, হয়তো রাতে কিছু কাজ করতে পারব!
রাত্রিবেলা হারিকেন জ্বালিয়ে আমি কাজ করছি, এমন সময় মনে হলো বারান্দায় খুট করে একটা শব্দ হলো। আমি গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কে?”
বাইরে থেকে একজন মানুষ নিচু গলায় বলল, “আমি স্যার।”
আমি ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত দশটা, গ্রামের জন্যে রাত দশটা অনেক রাত, এত রাতে কে এসেছে? আমি দরজা খুলে দিলাম, বাইরে দীর্ঘদেহী একজন মানুষ, মুখে বয়স এবং জীবন যুদ্ধের ছাপ। আমি একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম, মানুষটি ইতস্তত করে বলল, “স্যারকে এত রাতে কষ্ট দিলাম।”
কষ্ট দিয়ে ফেলার পর সেটা নিয়ে কথা বলে লাভ নেই–আমি তাই ভদ্রতা করে বললাম, “না, কোনো কষ্ট নেই। ভেতরে আসেন।
মানুষটি ভেতরে এলো, হ্যারিকেনের আলোতে দেখলাম, চেহারায় দারিদ্রের ছাপটি স্পষ্ট। তারপরেও চোখে-মুখে একধরনের সম্ভ্রান্ত মানুষের চিহ্ন রয়েছে। মানুষের চেহারার ঠিক কোন অংশটি দিয়ে এই সম্ভ্রান্ত ভাবটি ফুটে ওঠে কে জানে। আমি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মানুষটির দিকে তাকালাম, মানুষটি ইতস্তত করে দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করে বলল, “গ্রামের মানুষের মুখে আপনার কথা শুনে আপনাকে দেখতে এসেছি।”
গ্রামের মানুষের মুখে ঠিক কী কথা শুনে এই গভীর রাতে আমাকে দেখতে এসেছে জানার একটু কৌতূহল হলো, কিন্তু আমি সে বিষয়ে কিছু বললাম না। আজ সকালে আজীজ মাস্টারের সাথে ঘুরতে বের হয়ে গ্রামের অনেক মানুষের সাথে দেখা হয়েছে, তখন এই মানুষটিকে দেখি নি, মানুষটিকে দেখলে মনে থাকতো। আমি বললাম, “বসেন।”
মানুষটি বসল না, দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মানুষটি যদিও বলছে সে আমাকে দেখতে এসেছে কিন্তু সেটি পুরোপুরি সত্যি কথা নয়–আজীজ মাস্টার গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিয়েছে যে আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ এবং আমি নিরিবিলি বসে আরও গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ করছি-কেউ যেন আমাকে বিরক্ত না করে। কিন্তু তারপরেও যখন এই মানুষটি চলে এসেছে, তার নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। মানুষটি নিজে থেকে সেটা বলবে নাকি আমার খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সেটা বের করতে হবে সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।
আলোচনা শুরু করার জন্যে আমি বললাম, “আজ সকালে আমি আপনাদের গ্রাম দেখতে বের হয়েছিলাম। তখন আপনার সাথে দেখা হয় নাই।”
“আমি এই গ্রামের না।”
“ও! বেড়াতে এসেছেন?”
মানুষটি হাসার চেষ্টা করে বলল, “জি না। পেটের দায়ে ঘুরি, চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে কাজ করি।”
“কীসের কাজ?”।
“পুকুরে মাছের চাষ করেন, সেটা দেখাশোনা করি।” একটু থেমে যোগ করল, “আমরা ভাটি অঞ্চলের মানুষ। বর্ষাকালে কাজকর্ম থাকে না তখন বের হই।”
“ও আচ্ছা।” এই দেশের কত কিছু আমরা জানি না, আমার ধারণা ছিল বর্ষাকালে ভাটি অঞ্চলে কাজকর্ম আরো বেশি থাকবে। আলোচনা চালিয়ে যাবার জন্যে এরপর কী জিজ্ঞেস করা যায়। চিন্তা করছি, তখন মানুষটি জিজ্ঞেস করল, “স্যার আপনি যে এই নদী তীরে একলা একলা থাকেন, আপনার ভয় করে না?”
“কীসের ভয়?”
“ভূত-প্রেত?”
আমি হাসার ভঙ্গি করলাম, “ভূত-প্রেত বলে কিছু নাই।”
“আপনি কেমন করে জানেন?”
“যদি থাকতো তাহলে বৈজ্ঞানিকরা সেটাকে ছোট শিশিতে ভরে ইলেকট্রিক ডিসচার্জ করে কী দিয়ে তৈরি বের করে ফেলতো।”
মানুষটা আমার কথা বুঝতে পারল না তাই উত্তরে কী বলবে ভেবে পেল না। একটু ইতস্তত করে বলল, “আপনি তো অনেক জ্ঞানী মানুষ আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি।”
আমি যে সেরকম জ্ঞানী মানুষ নই কথাটা এখানে তোলা হলে হিতে বিপরীত হতে পারে, তাই মাথা নেড়ে স্বীকার করে নিয়ে বললাম, “করেন।”
মানুষটি গম্ভীর মুখে বলল, “মানুষ কী কখনো ভূত হতে পারে?”
আমি অবাক হয়ে মানুষটির মুখে তাকালাম, সে ঠিক কী জিজ্ঞেস করছে বুঝতে পারলাম না। বললাম, “আমি তো আপনাকে আগেই বলেছি ভূত বলে কিছু নাই, যে জিনিসটা নাই কেমন করে মানুষ সেটা হতে পারে।”
মানুষটাকে একটু বিভ্রান্ত দেখা গেল, খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, “কিন্তু আমরা গ্রামের মানুষ তো বলি ভূত আছে। ভূতে নানারকম কাজকর্ম করে, মানুষ ভয় পায়।”
আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম, “সেগুলো গল্প। ভূতের গল্প। গল্পে বলে মানুষ মরে গেলে ভূত হয়। যে মানুষ মারা যায় নাই সেই মানুষ ভূত হবে কেমন করে?”
মানুষটা কোন কথা না বলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। সেই দৃষ্টির সামনে আমি কেমন জানি অস্বস্তি বোধ করতে থাকি। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বললাম, “আপনি কি আমাকে কিছু একটা বলার জন্যে এসেছেন?”
মানুষটি ব্যস্ত হয়ে মাথা নেড়ে বলল, “না-না-না, কিছু বলার জন্যে আসি নাই, এমনি আপনাকে দেখতে এসেছি।” সে হঠাৎ করে চলে যাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে গেল, বলল, “আপনারা জ্ঞানী-গুণী মানুষ, আপনাদের সময়ের কত দাম। আমি যাই। বেয়াদপি নিবেন না।”
আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, “আপনার পরিচয়টা তো জানা হলো না।”
“আমার নাম মাহতাব। মাহতাব মৃধা।”
“কোথায় থাকেন? চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে?”
“জি না। আমি নৌকায় থাকি।”
“নৌকায়? ভেরি ইন্টারেস্টিং!”
“জি। আমার স্ত্রী গত হয়েছে বারো বৎসর। পরিবার নাই, সংসার নাই তাই নৌকাতেই সংসার।”
“নৌকাটা রাখেন কোথায়?”
“এই তো এদিকে–” মাহতাব মৃধা যেভাবে বলল বুঝতে পারলাম সে ঠিক বলতে চাইছে না। “একেকদিন একেক জায়গায় রাখি।”
মানুষটি হঠাৎ করে আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। মানুষটির কথাবার্তা ভাবভঙ্গিতে বিচিত্র কিছু একটা ব্যাপার আছে, সেটা কী আমি ঠিক ধরতে পারলাম না।
গভীর রাতে আবার আমার ঘুম ভেঙে গেল, ঘরের বাইরে নারীকণ্ঠে কে যেন নিচু স্বরে গান গাইছে। আমি নিঃশব্দে বিছানায় উঠে বসলাম। জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকালাম। ঘরের বারান্দায় পা দুলিয়ে একটি মেয়ে বসে আছে। অন্ধকারে চেহারা দেখা যায় না, গলার স্বরটি শোনা যায় কিন্তু কথা বোঝা যায় না। অকারণেই একধরনের অশরীরী আতঙ্কে বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যায়।
মেয়েটি হঠাৎ করে উঠে দাঁড়াল, তারপর হাঁটতে হাঁটতে নদীর ঘাটের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। আকাশের মেঘ কেটে হঠাৎ করে জ্যোৎস্নার নরম আলো ছড়িয়ে পড়ল, তার ভেতরে আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম কুকুরের মতো কিছু জন্তু মেয়েটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি আবার নিজের ভেতরে একধরনের আতঙ্ক অনুভব করি, মেয়েটি যেন বাতাসে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে যাচ্ছে। নদীর ঘাটে মেয়েটি পা ছড়িয়ে বসে, জন্তুগুলো তাকে ঘিরে বসেছে। দূর থেকে পুরো দৃশ্যটি এত অশরীরী এবং অলৌকিক যে আমার সমস্ত শরীর কাটা দিয়ে ওঠে।
আকাশে আবার মেঘ জমে ওঠে, চাঁদ ঢাকা পড়ে যায় তার ভেতরে আবছা অন্ধকারে দেখতে পেলাম নিশিকন্যা সিঁড়ি দিয়ে নদীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পিছু পিছু সেই জন্তুগুলো।
ভোরবেলা আজীজ মাস্টার আবার ডালার মতো বড় বড় গোলাকৃতি পরোটা, সেদ্ধ ডিম এবং গরম চা নিয়ে এলো। গতকালকের মতো আজকেও আমি সেটা বেশ তৃপ্তি করেই খেলাম। আবার নিশিকন্যা নিয়ে আলোচনা উঠল, কিন্তু আজকে আমি গতকালকের মতো কোনো ভুল করলাম না, রাতে কী দেখেছি সেটা তাকে বললাম না। আজীজ মাস্টার খানিকক্ষণ গল্পগুজব করে চলে গেলেন। চেয়ারম্যান সাহেব এবং মুসলিম চাচা এলেন ঘণ্টাখানেক পরে তারাও আমার খোঁজখবর নিয়ে গেলেন।
সারাদিন ঝিরঝির করে বৃষ্টি হলো, কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমি বারান্দায় বসে আকাশের মেঘ এবং মেঘনা নদীকে দেখে সময় কাটিয়ে দিলাম। নির্জন নদীতীরে ঝিরঝিরে বৃষ্টির ভেতরে উখাল নদীটির মাঝে একধরনের অসাধারণ সৌন্দর্য লুকিয়ে রয়েছে, আমি বুভুক্ষের মতো সেই সৌন্দর্যটি অনুভব করার চেষ্টা করলাম। ঘুরেফিরে আমার নিশিকন্যার কথা মনে হলো। গভীর রাতে তাকে যখন দেখেছি প্রতিবারই আমি একধরনের আতঙ্ক অনুভব করেছি। দিনের বেলা সেই কথাটি ভেবে আমার লজ্জা হতে থাকে। আজ রাতেও যদি নিশিকন্যা আসে আমি তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করব। এই মেয়েটি খুব বেশি হলে একধরনের মানসিক রোগী, তাকে দেখে তার জন্যে দুঃখ হতে পারে, কিন্তু ভয় পাওয়ার তো কিছু নেই।
গভীর রাতে নারীকণ্ঠের নিচু গলার গান শুনে আবার আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি সাবধানে বিছানায় উঠে বসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি নিশিকন্যা সেই একই জায়গায় একই ভঙ্গিতে বসে গান গাইছে। আমি সাহস সঞ্চয় করে উঠে দরজায় হাত দিলাম, ছিটকিনি খোলার শব্দ হওয়ার সাথে সাথে বাইরে গানের শব্দ থেমে গেল। আমি সাবধানে দরজা খুললাম, সাথে সাথে নিশিকন্যা ছিটকে সরে গেল। তাকে ঘিরে বড় বড় কয়েকটা কুকুর হিংস্র গলায় আমার দিকে মুখ করে চিৎকার করতে থাকে। মনে হতে থাকে এক্ষুনি আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। আমি অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত রেখে গলা উঁচিয়ে বললাম, “এই যে মেয়ে, শুনো–”
নিশিকন্যা ছিটকে আরো কয়েক পা পিছিয়ে গেল। আমি দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে এসে আবার ডাকলাম, “তোমার কোনো ভয় নেই। শুনো–”
নিশিকন্যা দুর্বোধ্য গলায় কী একটা বলতে বলতে চিৎকার করতে করতে নদীতীরের দিকে ছুটে গেল। আমি বারান্দায় নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম। আকাশ কালো করে মেঘ জমেছে, কয়েকবার বিদ্যুৎ চমকে উঠে হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হলো। সেই বৃষ্টির শব্দ শুনে অকারণেই আমার মন খারাপ হয়ে গেল।
সারাটা দিন বসে বসে লিখেছি। ঝিরঝির করে সারাদিন বৃষ্টি হয়েছে, ছোট ঘরটা থেকে একবারও বের হই নি। রাতের খাবার নিয়ে এসেছিল আজীজ মাস্টার, খাবার রেখে চলে গেছে। রাতে খেয়ে খানিকক্ষণ বারান্দায় বসেছিলাম, তারপর আবার লিখতে বসেছি। রাত বারোটার দিকে হঠাৎ করে দরজায় টুক টুক করে শব্দ হলো, দরজা খুলে দেখি মাহতাব মৃধা দাঁড়িয়ে আছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, “আপনি? এত রাত্রে?”
মাহতাব মৃধা মুখ কাচুমাচু করে বলল, “ইচ্ছা করে একটু রাত করে আসলাম, কিছু মনে করবেন না।”
“ঠিক আছে। আসেন ভেতরে আসেন। কী ব্যাপার?”
মাহতাব মৃধা সেদিনের মতো দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, “স্যার আপনার কাছে আমি একটা কথা বলতে এসেছি।”
“কী কথা?”
“কীভাবে আপনার কাছে বলব সেটা বুঝতে পারছি না।”
“সোজাসুজি বলে ফেলেন, কোনো সমস্যা নেই।”
মাহতাব মৃধা মাথা নাড়ল, বলল, “বললে আপনি বিশ্বাস করবেন কী না জানি না। আপনার কাছে অনুরোধ আপনি আমার কথা বিশ্বাস করবেন। অনেক বিপদে পড়ে এসেছি–”
“আগে শুনি আপনার কথা।”
মাহতাব মৃধা কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, “প্রায় আঠারো-বিশ বছর আগের ঘটনা। আমার পরিবার তখন পোয়াতি—”
মাহতাব মৃধা হঠাৎ কথা বন্ধ করে কান খাড়া করে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?”
“মানুষের শব্দ।”
“মানুষের শব্দ?”
“জি স্যার-শুনেন?”
আমি কিছু শুনতে পেলাম না, শহরের হইচই চেঁচামেচির মাঝে থেকে থেকে শোনার ক্ষমতা নিশ্চয়ই অনেক কমে গেছে। দরজা খুলে ঘরের বাইরে এসে সত্যি সত্যিই অনেক দূর থেকে ভেসে আসা অনেক মানুষের চেঁচামেচি শুনতে পেলাম। মাহতাব মৃধা বলল, “এই দিকেই আসছে।”
“কারা আসছে?”
“গ্রামের মানুষ।”
“কেন আসছে?”
“জানি না স্যার।” মাহতাব মৃধার মুখ হঠাৎ কেমন জানি রক্তহীন ফ্যাকাসে হয়ে যায়।
মাহতাব মৃধা কী বলতে এসেছিল সেটা চাপা পড়ে গেল, আমরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কিছুক্ষণের মাঝেই দেখতে পেলাম গ্রামের রাস্তা ধরে অনেক মানুষ এগিয়ে আসছে। তাদের হাতে মশাল, লাঠিসোটা, তারা চিৎকার করতে করতে আসছে। আমার ঘরের কাছাকাছি আসতেই আমি ভিড়ের মাঝে আজীজ মাস্টার, চেয়ারম্যান সাহেব এবং মুসলিম চাচাকে দেখতে পেলাম। তাদের পিছু অসংখ্য মানুষ, সবার হাতে লাঠি, সড়কি এবং মশাল। মুসলিম চাচার হাতে একটা দোনলা বন্দুক। আমাকে দেখে সবাই আমার কাছে এগিয়ে এলো, আমি ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে?”
আজীজ মাস্টার বলল, “সর্বনাশ হয়ে গেছে স্যার।”
“কী সর্বনাশ হয়েছে?”
“মুসলিম চাচার ভাতিজাকে নিশিকন্যা খুন করে ফেলেছে।”
আমি চমকে উঠে বললাম, “কী বললেন?”
মুসলিম চাচা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললেন, “বাপমরা আমার একমাত্র ভাতিজাকে হারামজাদী খুন করে ফেলেছে-লাশ নিয়ে চলে গেছে!”
“কী বলছেন আপনি?”
মুসলিম চাচা পাঞ্জাবির হাতায় নাক মুছে বললেন, “ভাই মারা যাবার সময় আমার হাত ধরে বলেছিল, একমাত্র ছাওয়াল আমার তুই দেখে রাখিস-আমি দেখে রাখতে পারলাম না–” মুসলিম চাচা আবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।
আজীজ মাস্টার বলল, “নিশিকন্যা লাশ নিয়ে চলে গেছে!”
“লাশ নিয়ে চলে গেছে!”
মুসলিম চাচা মাথা নাড়লেন। বললেন, “আমার চোখের সামনে ঘটনাটা ঘটল। রাত্রিবেলা হঠাৎ শুনি গোঁ গোঁ শব্দ। ঘুম থেকে উঠে দরজা ধাক্কা দিতেই দেখি নিশিকন্যা ছাওয়ালটার গলা কামড়ে ধরেছে-আমাকে দেখে চিৎকার দিয়ে ছাওয়ালটারে নিয়ে জানালা দিয়ে লাফ দিল–”
আমি হতবাক হয়ে মুসলিম চাচার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
আজীজ মাস্টার বলল, “সারা ঘরে খালি রক্ত আর রক্ত।”
“আপনারা এখন কোথায় যাচ্ছেন?”
“নিশিকন্যা এই লাশ নিয়ে জঙ্গলে লুকিয়ে আছে। খুঁজে বের করে গুলি করে মারব।”
মানুষজন চিৎকার করতে লাগল, “খুন করে ফেলব।” জবাই করে ফেলব।” “পুড়িয়ে মারব।” “কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলব।”
চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, “দেরি করো না, হারামজাদী পালিয়ে যাবে।”
সবাই তখন হইচই করে জঙ্গলের দিকে যেতে থাকে। আমার কাছে মাহতাব মৃধা এসেছিল কিছু একটা বলতে। সেও নিশ্চয়ই গ্রামের মানুষের সাথে চলে গেছে। আমি পাথরের মূর্তির মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম, এখনো পুরো ব্যাপারটি আমি বুঝতে পারছি না। নিশিকন্যাকে আমি এক-দুইবার দেখেছি, মনে হয়েছে। অপ্রকৃতিস্থ একটা মেয়ে-তাই বলে একটা ছোট বাচ্চার গলা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলবে, সেটা কখনো কল্পনা করি নি। মানুষজন যখন বেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে তখন আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম। ঘরে ঢুকে জুতো পরে ছয় ব্যাটারির বড় টর্চ লাইটটা নিয়ে আমি পুরো দলটার পিছু পিছু এগিয়ে গেলাম।
গ্রামের সব মানুষ জঙ্গলটাকে ঘিরে ফেলে চিৎকার করছে। হাতে লাঠি এবং সড়কি, মশালের আগুনে তাদের ক্রোধোন্মত্ত চেহারা, চিৎকার-সব মিলিয়ে কেমন জানি ভয়ংকর একটা পরিবেশ। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে এই মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। কিছুক্ষণ আগেও এরা ছিল সহজ-সাধারণ মানুষ, অথচ কী দ্রুত এরা হিংস্র মানুষে পাল্টে গেছে। তারা যদি নিশিকন্যাকে খুঁজে পায় মুহূর্তে কী তাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে না? আমার সারা শরীর হঠাৎ গুলিয়ে আসে।
মানুষগুলো লাঠি দিয়ে গাছপালায় শব্দ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে, শুকনো বাঁশের মাঝে আগুন লাগিয়ে মশাল তৈরি করছে, ঠাস ঠাস শব্দ করে বাঁশের গিট ফুটছে-তার সাথে মানুষের হিংস্র চিৎকার। হঠাৎ একটা ভয়ংকর শোরগোল উঠল। আমি দেখতে পেলাম একটা বড় গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা নিশিকন্যা তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করতে করতে ছুটে বের হয়ে এলো। তার পিছুপিছু অসংখ্য মানুষ লাঠি-সড়কি নিয়ে ছুটে আসে, কিন্তু মেয়েটি ক্ষীপ্র হরিণীর মতো তাদের ফঁক গলিয়ে ছুটে বের হয়ে গেল। গ্রামের মানুষ হই হই করে নিশিকন্যার পিছুপিছু ছুটতে থাকে-আমি আতঙ্কে নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকি, ধরতে পারলে মুহূর্তের মাঝে তাকে সবাই মিলে কী খুন করে ফেলবে না।
কিন্তু মানুষেরা তাকে খুঁজে পেল না, সে নাকি ছুটে গোরস্তানের মাঝে লুকিয়ে গেছে। মানুষজন গোরস্তানটা ঘিরে ফেলে, তারপর ভেতরে ঢুকে খুঁজতে থাকে। প্রাচীন গোরস্তানের ভেতর বড় বড় গাছ, ঝোঁপঝাড় লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মশালের আগুনে সবাই দেখছে। কিন্তু নিশিকন্যা মনে হয় বাতাসের মাঝে উবে গেছে। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কেউ নিশিকন্যাকে খুঁজে পেল এর মাঝে হঠাৎ কয়েকবার বিদ্যুৎ চমকে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল, মশালের আগুন নিভে গেছে, অন্ধকারে খোঁজাও কঠিন হয়ে গেল। যখন সবাই ঘিরে রেখেছিল তখনই সে হরিণীর মতো পালিয়ে গেছে, এই অন্ধকারে তাকে আর কে খুঁজে পাবে?
কাজেই আজ রাতের মতো খোঁজাখুঁজি বন্ধ করে সবাই গ্রামে ফিরে যেতে শুরু করল। আজীজ মাস্টার বলল, “স্যার চলেন যাই।”
আমি অন্যমনস্কের মতো বললাম, “হুঁ। চলেন। কিন্তু আমি তাদের সাথে চলে গেলাম না, একটু পিছিয়ে গোরস্তানে রয়ে গেলাম। দেখতে দেখতে সবাই চলে গেল-এখন এখানে আমি একা। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ কিন্তু মেঘে ঢাকা বলে পুরো আকাশটায় একটা ঘোলাটে আলো, সেই আলোতে পুরো গোরস্তানটাকে কেমন যেন অলৌকিক একটা জায়গা বলে মনে হচ্ছে। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে, বৃষ্টির পানিতে আমি ভিজে যাচ্ছি, ভিজে ভিজে একটা গাছের নিচে আমি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমাকে কেউ বলে দেয়নি কিন্তু আমি জানি এখানে কোথাও নিশিকন্যা লুকিয়ে আছে। আমি কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম, ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। সেই শব্দ ছাপিয়ে কান্নার শব্দ ভেসে এলো। কেউ একজন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
শব্দটি ভেসে আসছে একটা কবরের ভেতর থেকে। পুরনো কবর, মাটি ধসে পড়ে সেখানে একটা গর্ত হয়েছে, সেই গর্তের ভেতর নিশিকন্যা লুকিয়ে ছিল। হঠাৎ কান্নার শব্দ থেমে গেল, আমি দেখলাম কবরের ভেতর থেকে খুব ধীরে ধীরে নিশিকন্যা বের হয়ে আসছে। আবছা অন্ধকারে ভালো দেখা যায় না, শুধু অবয়বটি আবছা বোঝা যায়। আমি গর্তের ভেতর থেকে পুরোপুরি বের হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম, তারপর আমার ছয় ব্যাটারির টর্চলাইটটা নিশিকন্যার দিকে তাক করে জ্বালিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বললাম, “দাঁড়াও।”
তীব্র আলোতে আমি এক মুহূর্তের জন্যে নিশিকন্যাকে দেখতে পেলাম-আঠারো-উনিশ বছরের একটি মেয়ে, ভয়ংকর আতঙ্কে রক্তশূন্য ফ্যাকাসে মুখ! মেয়েটি হঠাৎ দুই হাতে মুখ ঢেকে আর্তনাদ করে নিচে পড়ে গেল, যেন এটি টর্চলাইটের আলো নয়, যেন এটি তীক্ষ্ণ বর্শার আঘাত। আমি আলোটি ধরে রাখলাম আর সেই আলোতে মেয়েটি ভয়ংকর যন্ত্রণায় ছটফট করে কাতরাতে থাকে–
হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। হ্যাঁচকা টানে আমার হাত থেকে টর্চলাইটটা নিয়ে কাতর গলায় বলল, “আল্লাহ্র কসম লাগে স্যার আমার মেয়েটাকে মেরে ফেলবেন না।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “কে?”
“আমি। আমি মাহতাব মৃধা।”
মাহতাব মৃধা টর্চলাইটটা নিভিয়ে দিতেই আবছা অন্ধকারে পুরো এলাকাটা ঢেকে গেল।
মাহতাব মৃধা ছুটে গিয়ে নিশিকন্যাকে ধরে বলল, “কুসুম! কুসুম-মা আমার।”
মেয়েটি যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বলল, “বাবা, বড় কষ্ট বাবা!”
মাহতাব মৃধা মেয়ের শরীরে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “ একটু সহ্য কর মা আমার-একটু সহ্য কর।”
মেয়েটা আকুল হয়ে বলল, “আর পারি না বাবা।” আমি কাছে গিয়ে বললাম, “কী হয়েছে মাহতাব?”
“আমার এই মেয়েটা আলো সহ্য করতে পারে না। শরীরে আলো লাগলে যন্ত্রণায় ছটফট করে।”
“আলো সহ্য করতে পারে না?”
না।”
মাহতাব মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে, মেয়েটা বাবার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে।
মাহতাব ফিসফিস করে বলল, “আমার ফুলের মতো নিষ্পাপ মেয়ে-অন্ধকারে থাকতে থাকতে যখন সহ্য করতে পারে না, তখন মাঝে মাঝে রাত্রিবেলা বের হয়-আর তাকে নিয়ে কত গল্প!”
আমি বললাম, “মুসলিম চাচা যে বলল সে তার ভাতিজাকে খুন করেছে!”
“আমার কুসুম একটা বাচ্চাকে খুন করবে?” মাহতাব তীব্র গলায় বলল, “আপনি আমাকে সেটা বিশ্বাস করতে বলেন?”
কুসুম ফিসফিস করে বলল, “আমি দেখেছি বাবা।”
“কী দেখেছিস?”
“দেখেছি-দেখেছি–” বলে মেয়েটা আবার কেঁদে ওঠে।
“কাঁদিস না, মা, বল।”
“দেখেছি ওই দাড়িওয়ালা মানুষটা বাচ্চাটাকে জবাই করে ফেলেছে!”
আমি চমকে উঠে বললাম, “কোন দাড়িওয়ালা মানুষটা?”
“যে মানুষটার হাতে বন্দুক ছিল।”
“মুসলিম চাচা?”
কুসুম মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”
“মুসলিম চাচা নিজে তার ভাতিজাকে খুন করেছে?”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু একটা মানুষ নিজে তার ভাতিজাকে কেন খুন করবে?”
মাহতাব মিয়া বলল, “সম্পত্তির জন্যে। ভাই মারা গেছে, এখন ভাইয়ের ছেলে যদি মারা যায় সম্পত্তির মালিক হবে নিজে। স্যার, এটা খুব সহজ হিসাব।”
“কী সর্বনাশ!”
কুসুম বাবাকে শক্ত করে ধরে রেখে বলল, “আমার খুব ভয় করছে বাবা!”
মাহতাব মেয়ের গলায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলল, “ কোনো ভয় নাই মা। তোর কোনো ভয় নাই। আমি আছি না?”
আমি কুসুমের কাছে গিয়ে বললাম, “কুসুম। তুমি সত্যি নিজের চোখে মুসলিম চাচাকে খুন করতে দেখেছ?”
“হ্যাঁ।”
“খুন করে কী করেছে?”
“লাশটা টেনে নিয়ে বাঁশঝাড়ের নিচে পুঁতে ফেলেছে।”
“তুমি কেমন করে দেখেছ? “আমি সেখানে ছিলাম।”
“কেন?”
“যখন অন্ধকার হয়, তখন আমি ঘুরে বেড়াই। আমি অন্ধকার দেখতে পাই।”
“তোমার ভয় করে না? জন্তু-জানোয়ার সাপখোপ–“
“না। জন্তু-জানোয়ার আমার ভয় করে না। জন্তু-জানোয়ারের মাথায় হাত রাখলে আমার পোষ মেনে যায়।”
“তোমার কিছু ভয় করে না?”
“করে। আমার মানুষকে ভয় করে। মানুষকে আমার খুব ভয় করে।”
আমি আবছা অন্ধকারে এই দুর্ভাগা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
মাহতাব কুসুমকে টেনে তুলে বলল, “আয় মা।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এখন কোথায় যাচ্ছেন?”
“নৌকায়।”
তারপর?”
“তারপরে অন্য কোনো গ্রামে। বাঘাইকান্দি গ্রামে আমরা আর থাকতে পারব না স্যার।”
“আমি কোনো কথা বললাম না। মাহতাব বলল, “আমার মেয়েটার জন্যে একটু দোয়া করবেন। এত বড় অভিশাপ যেন আর কারো না লাগে।”
আমি বললাম, “মাহতাব সাহেব।”
“বলেন স্যার।”
“আপনার মেয়ের এটা অভিশাপ না।”
“এইটা তাহলে কী?”
“এটা একধরনের অ্যালার্জি। আলো দিয়ে অ্যালার্জি। আমি এর কথা আগে শুনেছি। এর চিকিৎসা করানো যেতে পারে। আপনি আমার সাথে চলেন, আমার পরিচিত বড় ডাক্তার আছে।”
মাহতাব মাথা নাড়ল, বলল, “এখন আমাদের বড় বিপদ স্যার। আমাদের এখনই এই গ্রাম ছেড়ে যেতে হবে।”
“কেন যেতে হবে? পুলিশের কাছে সব খুলে বললেই হবে–“
মাহতাব শুষ্ক গলায় হেসে বলল, “আমাদের কথা পুলিশে শুনবে না। আজ রাতে আমরা যদি পালিয়ে না যাই আমার এ মেয়েটারে আমি বাঁচাতে পারব না। এ মেয়েটাকে যদি ধরতে পারে সূর্যি ওঠার সাথে সাথে মেয়েটা মরে যাবে”
“তাহলে আপনার ঠিকানা দেন। আমি আপনাকে খোঁজ করে বের করব।”
“আমার কোনো ঠিকানা নাই। আমরা নৌকায় থাকি। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চল।”
আমি পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে মাহতাবকে দিয়ে বললাম, তাহলে এইটা সাথে রাখেন। আপনি আমার সাথে যোগাযোগ করবেন।”
মাহতাব কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে হাত বাড়িয়ে কার্ডটি নিল।
আমি মাহতাব আর তার মেয়ের সাথে হাঁটতে হাঁটতে নদীর তীরে এলাম। নদীর ঘাটে একটা ছোট নৌকা, নৌকায় ওঠার আগে মাহতাব হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, “স্যার।”
“কী হলো?”
“আমার মেয়ে আপনাকে ছাড়া আর কোনো মানুষকে কাছে থেকে দেখে নাই। কারো সাথে কথা বলে নাই।”
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। মাহতাব বলল, “আমার মেয়েটা আপনার পা ছুঁয়ে একটু সালাম করতে চায়। আপনি তার মাথায় হাত দিয়ে একটু দোয়া করে দিবেন?”
“এসো।”
নিশিকন্যা আমার কাছে এসে আমার পা স্পর্শ করে সালাম করল। আমি তার মাথায় হাত রেখে মনে মনে বললাম, “খোদা, আমি তো কখনো তোমার কাছে কোনো কিছু চাই নাই। তুমি এই দুঃখী মেয়েটাকে ভালো করে দাও।”
নৌকাটি চলে যাওয়া পর্যন্ত আমি নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে রইলাম। জ্যোৎস্নার আলোতে মেঘনা নদীতে নৌকাটা ছোট হয়ে মিলিয়ে যাওয়ার পর আমি ফিরে আসতে গিয়ে দেখলাম বড় বড় কয়েকটা কুকুর নদীর ঘাটে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তারা আমার পিছুপিছু এসে আমাকে আমার ঘরে পৌঁছে দিল।
আমি পরদিন ভোরেই বাঘাইকান্দি গ্রাম থেকে ফিরে এসেছিলাম। ফিরে আসার আগে থানার ওসিকে বাঁশঝাড়ের নিচে খোঁজ করার কথা বলে এসেছিলাম। আজীজ মাস্টার আমাকে চিঠি লিখে জানিয়েছিল মানুষ খুন করার কারণে মুসলিম চাচার নামে কেস হয়েছে-কেসের ফল কী সেটা কখনো জানতে পারিনি।
মাহতাব কখনো আমার সাথে যোগাযোগ করেনি। আমার মাঝে মাঝে খুব জানার ইচ্ছে কুসুম নামে সেই দুঃখী নিশিকন্যা
এখন কোথায় আছে।
আমার বড় ভাবতে ইচ্ছে করে খোদা আমার প্রার্থনা শুনেছেন। সে ভালো হয়ে গেছে, তাকে আর অন্ধকারে লুকিয়ে থাকতে হয় না। তার খুব একজন প্রাণবন্ত সুদর্শন তরুণের সাথে বিয়ে হয়েছে। বিয়ের রাতে কুসুম তাকে বলেছে, “তুমি জানো আগে আমি কখনো অন্ধকার থেকে আলোয় আসতে পারতাম না!”
সেই তরুণুটি তখন হি হি করে হেসে বলছে, “ইশ কুসুম! তুমি যে কী মিথ্যা কথা বলতে পারো!”