Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

জুলাইয়ের শেষে হঠাৎ করে আমরা বুঝতে পারলাম পরীক্ষা এসে যাচ্ছে। বাণিজ্যমন্ত্রীর ছেলে আমাদের ব্যাচে পড়ে, জুলাই মাসে একটা রাষ্ট্রীয় সফরে তার বাবার সাথে চীন যাবার কথা আছে বলে শুনেছিলাম, সে যদি চীন যায় ফিরে এসে পরীক্ষা দেবে কেমন করে? কাজেই ধরেই নিয়েছিলাম পরীক্ষাটা পিছাবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কে জানি এসে খবর দিল যে কূটনৈতিক পর্যায়ে একটা সমস্যা হয়েছে চীনে রাষ্ট্রীয় সফর বাতিল, বাণিজ্যমন্ত্রীর ছেলে চীন যাচ্ছে না যার অর্থ আমাদের আগস্ট মাসেই পরীক্ষা দিতে হবে। আমাদের মাথায় একেবারে আকাশ ভেঙে পড়ল।

এরকম একটা ব্যাপার তো আর এমনি এমনি মেনে নেওয়া যায় না কাজেই পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলনের জন্যে একটা কমিটি করা হলো এবং রাত দশটার সময় সেই কমিটির পক্ষ থেকে মিছিল বের করা হলো। মিছিলে কেমন মানুষ হয় সেটা নিয়ে একটা দুশ্চিন্তা ছিল কিন্তু দেখা গেল আমাদের ব্যাচের সব ছেলেই বের হয়ে এসেছে। প্রথম মিছিলটা ইচ্ছে করে রাত্রিবেলা করা হয়েছে, ভালো ছাত্রগুলোও তাহলে যোগ দিতে পারবে, হলের হাউস টিউটর বা ক্যাম্পাসের স্যারেরা যেন তাদের চিনতে না পারে। মিছিলে দেওয়ার জন্যে কিছু গরম স্লোগান তৈরি করা হয়েছে তবে মূল স্লোগানটা এরকম, একজন বলবে “আগস্ট না সেপ্টেম্বর” অন্যেরা সবাই বলবে, “সেপ্টেম্বর সেপ্টেম্বর”–স্লোগানে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই পরীক্ষাটি আগস্টে নয় আমরা চাই এক মাস পিছিয়ে সেপ্টেম্বরে।

মিছিল নিয়ে আমরা যখন ক্যাম্পাস থেকে বের হলাম তখন দুটি ব্যাপার ঘটল, প্রথমটি হচ্ছে স্লোগান নিয়ে যতবার স্লোগান ধরা হলো “আগস্ট না সেপ্টেম্বর” ততবার উত্তর এলো, “ডিসেম্বর ডিসেম্বর!” উদ্যোক্তারা প্রথমে ভাবল ভুল বোঝাবুঝি কিন্তু কিছুক্ষণেই বোঝা গেল মিছিলের অতি উৎসাহী কিছু ছাত্র পরীক্ষাটা সেপ্টেম্বর নয় ডিসেম্বর পর্যন্তই পেছাতে চায়। উদ্যোক্তারা উপায় না দেখে তখন সেভাবেই স্লোগানটা পাল্টে নিল।

দ্বিতীয় ব্যাপারটা মিছিলের প্রকৃতি নিয়ে। মিছিলটা ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে রাস্তায় আসামাত্র মস্তান প্রকৃতির কয়েকজন ঠোঁট উল্টে বলল, “এই মিছিল দিয়ে পরীক্ষা পেছাবে? উল্টো পুরো কমিটির নামে প্রক্টরিয়াল তদন্ত-কমিটি হয়ে যাবে। একেবারে তিন বছরের জন্যে বহিষ্কার।” উদ্যোক্তারা বলল, “তাহলে?” মস্তানরা বলল, “আমাদের ওপর ছেড়ে দাও।” ছেড়ে না দিলেও তারা অবিশ্যি ব্যাপারটা নিজের হাতে নিয়ে নিত, তারা সেরকম প্ল্যান করেই এসেছে। তারা বড় রাস্তায় সব গাড়ি আটকে ফেলল, গুনে গুনে এক ডজন গাড়ির কাঁচ গুঁড়ো করে দিয়ে একটা বিআরটিসি বাসে আগুন ধরিয়ে দিল। যখন পুলিশ ফায়ারব্রিগেড ছোটাছুটি করছে তখন তাড়া দাঁত বের করে হেসে বলল, “এখন দেখি শালার ব্যাটারা পরীক্ষা না পিছিয়ে কোথায় যায়!” শালার ব্যাটা বলতে তারা আমাদের স্যারদের বুঝিয়েছে।

পরদিন খবরের কাগজে দেখলাম জরুরি সিন্ডিকেট ডেকে পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্যে পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। সফল একটা আন্দোলন করতে পেরে আমাদের ভারী আনন্দ হওয়ার কথা ছিল কিন্তু সবাই টের পেলাম নিজেদের কেমন যেন বেকুব বেকুব মনে হচ্ছে! কেউ অবিশ্যি সেটা স্বীকার করলাম না, খুব একটা বিজয় হয়েছে সেরকম ভান করে ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম।

পরীক্ষার পড়াশোনার ভয়ংকর চাপ থেকে হঠাৎ করে এমন একটা অবস্থায় চলে এসেছি যে পরীক্ষার তারিখ পর্যন্ত নেই, আমরা ঠিক কী করব বুঝতে পারছিলাম না। তখন আমাদের ভেতর থেকে সুমন বলল, “চল কোন জায়গা থেকে বেরিয়ে আসি।”

জয়ন্ত বলল, “কোথায় যাবি?”

সুমন বলল, “কক্সবাজার, কুয়াকাটা, মাধবকুণ্ডু-কত জায়গা আছে বেড়ানোর।”

“উঁহু, খাগড়াছড়ি হচ্ছে সবচেয়ে ভালো জায়গা।”

হেলাল বলল, “তাহলে সুন্দরবন দোষ করল কী? পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট”

সবাই যখন নানা জায়গার বর্ণনা দিতে শুরু করল, আমি বললাম, “জায়গা পরে ঠিক করা যাবে, প্রথমে ঠিক করে নিই কোথায় যাব।”

জয়ন্ত বলল, “খাঁটি কথা।”

সুমন বলল, “কোথায় থাকব, কী খাব, কত টাকা বাজেট সেসব ঠিক না করা পর্যন্ত আমি এর সাথে নেই–”

কাজেই আলোচনা শুরু হয়ে গেল।

পরীক্ষা পেছানোর কারণে শেষ পর্যন্ত সত্যি সত্যি আমরা ঘুরতে বের হতে পেরেছিলাম। আমাদের সবচেয়ে উৎসাহী দুজন সুমন এবং হেলাল অবিশ্যি শেষ মুহূর্তে আমাদের সাথে যেতে পারেনি। সুমনের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন, হেলালের জণ্ডিস হয়ে গেল! গেলাম আমি আর জয়ন্ত। খুব চমৎকার সময় কেটেছিল। আমাদের এই দেশে যে এত চমকপ্রদ জায়গা আছে আমি জানতাম না। তবে শেষের দিকে আমাদের এমন একটা বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল যে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। অভিজ্ঞতাটা শুধু বিচিত্র নয়-সেটা ছিল ভয়ংকর একটা অভিজ্ঞতা!

আমরা ট্রেনে করে আসছি, শ্রীমঙ্গল এসে খবর পেলাম সামনে কিছু মালগাড়ি পড়ে গেছে ট্রেন আসতে ঘণ্টা তিনেক দেরি হবে। আগে যখন কোথাও গিয়েছি হঠাৎ করে এরকম কিছু ঘটলে একেবারে অস্থির হয়ে যেতাম-এখন মোটেও অধৈর্য হলাম না, বরং একটু খুশি হয়ে উঠলাম যে এই তিন ঘণ্টায় নতুন কিছু করা যাবে। আমি প্লাটফরমে পা ছড়িয়ে দিয়ে বসলাম, জয়ন্ত খোঁজ নিতে গেল আশেপাশে দেখার কী আছে। কিছুক্ষণের মাঝেই সে খোঁজ নিয়ে এলো, একগাল হেসে বলল, “এইখানে অনেক কিছু দেখার আছে।”

“তাই নাকি?”

“হ্যাঁ। কাছাকাছি অনেক চা বাগান। ফ্লোরোফরম ট্রি নামে একটা গাছ আছে কয়েক কিলোমিটার দূরে। একটা সুন্দর মন্দির আছে, বিশাল একটা বটগাছ আছে এবং একজন ভণ্ড সাধুও আছে আশেপাশে।”

“ভণ্ড সাধু কেমন করে? সাধু মানেই তো খাঁটি।”

জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলল, “এটা ভণ্ড। হ্যাঁন্ড্রেড পার্সেন্ট গ্যারান্টি।”

“কীভাবে গ্যারান্টি দিচ্ছিস?

“সে হচ্ছে পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিক। টাকা দিলে সে পিশাচের খেলা দেখায়।”

আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, “পিশাচের খেলা?”

“হ্যাঁ।”

“মানুষ যে রকম করে বানরের খেলা দেখায় সেরকম?”

“মনে হয় সেরকম। টিকিট করে দেখতে হয়।”

আমি হাতে কিল দিয়ে বললাম, “তাহলে তো দেখতে যেতেই হয়।”

জয়ন্ত বলল, “জায়গাটা কিন্তু দূর আছে এখান থেকে। মনে হয় ট্রেন মিস করব।”

“করলে করব। পিশাচের নাচ না দেখে আমি যাচ্ছি না।”

কাজেই আমি আর জয়ন্ত পিশাচের নাচ দেখতে রওনা দিয়ে দিলাম।

জায়গাটা খুঁজে বের করতে অবিশ্যি বেশ সমস্যা হলো-এটা নাট্যগোষ্ঠীর নাটক বা শিল্পীর চিত্র প্রদর্শনীর মতো কিছু নয় যে পুরো এলাকায় জানাজানি হয়ে গেছে। অনেক কষ্টে এলাকাটার নাম বের করে টেম্পো-রিকশা দিয়ে শেষ পর্যন্ত সেখানে পৌঁছালাম। সেই এলাকায় অবিশ্যি তান্ত্রিকের খানিকটা পরিচিতি আছে, যাকেই জিজ্ঞেস করি সে মুখ বাঁকা করে বলে, “ও নিশা পাগলার আস্তানা? সোজা চলে যান, বড় পুকুরের সামনে বটগাছ, সেই বটগাছের নিচে!”

আমি আর জয়ন্ত কিছুক্ষণের মাঝেই নিশা তান্ত্রিকের আস্তানায় হাজির হলাম। বটগাছের নিচে একটা ছাপড়ার মতো তৈরি করা হয়েছে সেখানে বেশ কিছু মানুষের ভিড়। মানুষগুলোর মাঝে একধরনের মিল রয়েছে সবার চোখ ঢুলু ঢুলু এবং লাল, সম্ভবত গাঁজা খাওয়ার কারণে। মাঝামাঝি মিশমিশে কালো একজন মানুষ, তার চুল-দাড়ি এমনকি ভুরু পর্যন্ত পেকে গেছে। আমরা উঁকি দিতেই মানুষগুলো সরে আমাদের ভেতরে আসার জন্যে জায়গা করে দিল, যারা এসেছে সবাই চাষাভূষা ধরনের মানুষ, শার্ট-প্যান্ট পরে আছি বলে আমরা মনে হয় একটু আলাদা সমাদর পেলাম। মিশমিশে কালো মানুষটি, যে সম্ভবত নিশা পাগলা বা নিশা তান্ত্রিক নামে পরিচিত আমাদের দিকে তাকিয়ে একটা ভং ধরে ফেলল। সামনে একটা মালশা সেখানে তুষের আগুন জ্বলছে তার মাঝে কী একটা দিতেই ভক করে একটু আগুন জ্বলে সারা ঘরে ঝাঁজালো একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। কাছেই একটা মানুষের করোটি, তার ওপরে একটা মোমবাতি জ্বলছে। একটা বোতল থেকে লাল একধরনের পানীয় এক কোঁক খেয়ে হাত দিয়ে মুখ মুছে সে আমাদের দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, ‘কী চাই আপনাদের?”

আমি বললাম, “আমরা আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি।”

“কেন?”

“শুনেছি আপনি নাকি প্রেতসাধক। আপনি নাকি পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিক।”

মানুষটি মুখে মিটিমিটি হাসি ফুটিয়ে বলল, “আপনি ঠিকই শুনেছেন।”

আমি বললাম, “আমাদের সমস্যা হলো যে আমরা দুজনেই বিজ্ঞানের ছাত্র। আমরা আবার ভূতপ্রেত এসব ঠিক বিশ্বাস করি”

মানুষটির মুখের মিটিমিটি হাসি বন্ধ হয়ে এবারে তার মুখটা কেমন জানি কঠিন হয়ে যায়। আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আমি তো আপনাদের সমস্যা মিটাতে পারব না।”

জয়ন্ত বলল, “কিন্তু সাহায্য তো করতে পারেন।”

“আমি কেন আপনাদের সাহায্য করব? আমার কী লাভ?”

এই প্রশ্নের উত্তর আমি আর জয়ন্ত দুজনের কেউ-ই জানি না। আমরা একটু থতমত খেয়ে গেলাম। আমি ইতস্তত করে বললাম, “দুজন মানুষকে আপনার লাইনে বিশ্বাস আনাতে পারবেন-এটা কী লাভ হতে পারে না?

নিশা তান্ত্রিক মাথা নেড়ে বলল, “না। আপনাদের মতো মানুষকে লাইনে আনার আমার কোনো ইচ্ছা নেই।”

“কেন?”

“এইসব ব্যাপার হচ্ছে বিশ্বাসের ব্যাপার। যারা এটা বিশ্বাস করে তারা এখানে আসবে, যারা বিশ্বাস করে না তারা অন্য জায়গায় যাবে। যে যেটা বিশ্বাস করে সে সেটার জন্যে কাজ করবে। বুঝেছেন?”

আমি মাথা নাড়লাম। নিশা তান্ত্রিক আমাদের দুজনকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে তার বাম পাশে বসে থাকা একজনকে বলল, “মনসুর, কল্কেটা সাজা।”

আমি আর জয়ন্ত দুজনই অপমানের সূক্ষ একটা খোঁচা অনুভব করলাম। ইউনিভার্সিটিতে পড়ি দুজন মানুষকে এরকম চাষাভূষো জংলি ধরনের মানুষ এভাবে উড়িয়ে দিতে পারে আমরা ঠিক বিশ্বাস করতে পারলাম না। জয়ন্ত মনে হয় একটু রেগে গেল, বলল, “আপনি কী আমাদের একটা ভূত-প্রেত-পিশাচ কিছু একটা দেখাতে পারবেন?”

আমরা ভেবেছিলাম নিশা তান্ত্রিক কথাটা এড়িয়ে যাবে কিন্তু সে এড়িয়ে গেল না, সোজাসুজি জয়ন্তের দিকে তাকিয়ে বলল, “ পারব। দেখার সাহস আছে?”

জয়ন্ত একটু ঘাবড়ে গেল, আমতা আমতা করে বলল, “ থাকবে না কেন? একশবার আছে।”

“চমৎকার। তাহলে আজ রাত বারোটার সময় এখানে আসেন। আপনারে দেখাব।”

আমি বললাম, “উঁহু। আমাদের চলে যেতে হবে। ট্রেন ধরতে হবে।”

জয়ন্ত বলল, “এখন দেখাতে পারবেন?”

নিশা তান্ত্রিক অবাক হয়ে বলল, “এখন?”

“হ্যাঁ।”

খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “না। তবে”

“তবে কী?”

“আপনারা যেন পরে দেখতে পারেন তার ব্যবস্থা করে দিতে পারব।”

জয়ন্তের মুখে একটা বাঁকা হাসি ফুটে উঠল, বলল, “সত্যি?”

“হ্যাঁ। যদি সাহস থাকে বলেন, ব্যবস্থা করে দিই। যদি সাহস থাকে খবরদার চেষ্টা করবেন না, বিপদ হতে পারে?”

সাহস নিয়ে খোটা দেওয়া হলে আমরা তো আর চুপ করে থাকতে পারি না, দুজনেই প্রায় গর্জন করে বললাম, “সাহস থাকবে না কেন?”

“ঠিক আছে। দুজনের একজন আমার কাছে আসেন।”

“কেন?”

নিশা তান্ত্রিক বিরক্ত হয়ে বলল, “শুধু শুধু প্রশ্ন করবেন না। সাহস থাকে তাহলে কাছে আসেন, সাহস না থাকলে সময় নষ্ট না করে চলে যান।”

আমি আর জয়ন্ত একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালাম, তারপর আমি এগিয়ে গেলাম। নিশা তান্ত্রিক বলল, “ডান হাতটা দেন।”

আমি ডান হাতটা এগিয়ে দিলাম। নিশা তান্ত্রিক তার ঝোলার ভেতর থেকে অনেক ছোট ছোট হাড় বের করে তার ভেতর থেকে খুঁজে খুঁজে একটা বের করে খানিকক্ষণ পরীক্ষা করে আমার হাতে রেখে বলল, “হাত বন্ধ করেন।”

নিশা তান্ত্রিক আমার হাতটা চেপে ধরে রেখে বিড়বিড় করে কী যেন বলতে থাকে।

কিছুক্ষণ পর হঠাৎ একটা বিচিত্র জিনিস ঘটতে শুরু করে, মনে হতে থাকে ছোট হাড়টা জীবন্ত কিছুর মতো আমার হাতের ভেতর নড়তে শুরু করেছে, আমি চমকে হাতটা খুলে ফেলতে চাইলাম, নিশা তান্ত্রিক খুলতে দিল না। হাতে একটা ফুঁ দিয়ে বলল, “আপনাকে আমি একটা অপদেবতা দিলাম।”

“অপদেবতা দিলেন? আমাকে?”

“হ্যাঁ। সেটা আপনার সাথে দেখা করতে আসবে।”

“দেখা করতে আসবে?”

“হ্যাঁ। নিচু শ্রেণীর অপদেবতা, বেশি কিছু বুঝে না, কাজেই সাবধান। ভয় পাবেন না তাহলে আপনার ওপর ভর করতে পারবে না।”

আমার চেহারায় নিশ্চয়ই ভয়ের ছাপ ফুটে উঠেছিল কারণ নিশা তান্ত্রিক ভুরু কুঁচকে বলল, “ভয় পেয়েছেন? তাহলে—”

আমি তাড়াতাড়ি মুখ শক্ত করে বললাম, “না। ভয় পাই নাই।”

“তারপরেও আমি দুইটা তাবিজ দেই। হাতে বেঁধে রাখবেন-বিপদ হবে না তাহলে।”

“তাবিজ বেঁধে রাখব?” আমি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে নিশা তান্ত্রিকের দিকে তাকিয়ে বললাম, “আমরা?”

“হ্যাঁ। যে খেলার যে নিয়ম। আপনার বিজ্ঞান সাধনায় তাবিজ লাগে না। এই সাধনায় লাগে।”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “ঠিক আছে।”

“চমৎকার। এখন তাহলে যান আপনারা।” নিশা তান্ত্রিক তার সাগরেদের দিকে তাকিয়ে বলল, “কল্টো দে মনসুর।”

মনসুর নামে লিকলিকে রোগা মানুষটা একটা সরু কল্কে এগিয়ে দিল। নিশা তান্ত্রিক হাতে নিয়ে দুই হাতে ধরে এমনভাবে মুখে লাগিয়ে টান দিল যে মনে হলো কল্কে বুঝি ফেটে যাবে! তারপর বেশ কিছুক্ষণ ধোঁয়াটা বুকে আটকে রেখে সে নাক-মুখ দিয়ে বের করে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থাকে। সমস্ত ছাপড়ায় একটা বোটকা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল।

আমি আর জয়ন্ত উঠে দাঁড়ালাম। নিশা তান্ত্রিক বলল, “যদি এই অপদেবতাকে ডাকেন কাছাকাছি একটা জীবন্ত প্রাণী রাখবেন।”

“কেন?”

নীচু শ্রেণীর অপদেবতা। একটা প্রাণহানি না করে যেতে চায় না।”

আমার বুকটা ধক করে উঠল, বলে কী মানুষটা!

“বিড়াল কুকুর পাখি হাঁস মুরগি যা কিছু হতে পারে।”

“যদি না রাখি?”

“বিপদ হতে পারে।” নিশা তান্ত্রিক চোখ তুলে বলল, “আর শোনেন এই তাবিজ আর হাড় হারাবেন না, ফেলে দিবেন না।”

“কেন?”

“ওই যে বললাম, বিপদ হতে পারে। হাড়টা মানুষের হাড়।”

আমার গা ঘিনঘিন করে উঠল, সেটা প্রকাশ না করে বললাম, “ঠিক আছে।”

নিশা তান্ত্রিক হাত বাড়িয়ে বলল, “‘দুই শ টাকা দেন।”

আমরা অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। জয়ন্ত চোখ পাকিয়ে বলল, “কেন?”

“আমার ফি। ডাক্তাররা ফি নেয়, ইঞ্জিনিয়াররা নেয়-আমি নিতে পারব না?”

আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম নিশা তান্ত্রিক বাধা দিয়ে বলল, “এখন আমি দুই শ টাকায় মানব, পরে কিন্তু দুই হাজারেও মানব না!”

“কী মানবেন না?”

নিশা তান্ত্রিক কোনো কথা না বলে হা হা করে হেসে উঠল। তার হাসি শুনে হঠাৎ আমার বুক কেঁপে ওঠে। আমি তাড়াতাড়ি মানিব্যাগ বের করে দুই শ টাকা বের করে আনি।

ছাপড়া থেকে বের হয়ে জয়ন্ত আমার দিকে তাকিয়ে রেগে বলল, “আমি বিশ্বাস করতে পারছি না তুই এই ভণ্ড মানুষটার বজুরুকি দেখে ভয় পেয়ে দুইশ টাকা দিয়ে দিলি।”

আমি কোনো কথা বললাম না, জয়ন্ত বলল, “কত বড় ধরিবাজ দেখেছিস? কত রকম ভজং!”

আমি এবারেও কোনো কথা বললাম না। জয়ন্ত বলল, “বাড়ি গিয়েই এই তাবিজ আর হাড্ডি আমি যদি টয়লেটে ফেলে না দেই।”

আমি এবারেও কোনো কথা বললাম না, ছোট হাড়টা পকেটে আছে, আমার এক ধরনের অস্বস্তি হচ্ছে এটা একটা মৃত মানুষের শরীরের হাড় জানার পর থেকে মনটা খুঁত খুঁত করছে সত্যি কিন্তু অস্বস্তিটা অন্য কারণে। কেন জানি মনে হচ্ছে পকেটে ছোট হাড়টা মাঝে মাঝে নড়ে উঠছে।

প্রথম কয়েকদিন আমি একটু ভয়ে ভয়ে ছিলাম, আমার মনে হয়েছিল সত্যিই বুঝি নিশা তান্ত্রিকের অপদেবতা এসে হাজির হবে। কয়েকদিন যাবার পর মোটামুটিভাবে নিঃসন্দেহ হয়ে গেলাম যে পুরো ব্যাপারটি একটা বুজরুকি ছাড়া আর কিছু নয়। এক কথায় দুইশ টাকা দিয়ে দেবার জন্যে তখন রীতিমতো আফসোস হতে থাকে।

আমি আর জয়ন্ত সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, টেকনাফ হয়ে রাঙ্গামাটি এসেছি। রাঙ্গামাটিতে একটা চমৎকার রেস্ট হাউস পেয়ে গেলাম, জয়ন্তের এক কাকা বড় ইঞ্জিনিয়ার তিনি ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। পাহাড়ের গাঘেঁষে ছবির মতো গেস্ট হাউস, দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। আমরা গিয়ে আবিষ্কার করলাম এখানে আরো যে দুটো পরিবার ছিল তারা ওই দিন ভোরবেলাই চলে গেছে, এখন পুরো রেস্ট হাউসটা আমার আর জয়ন্তের দখলে-একটা বিড়াল দেখেছি, যদি সেটাকে ধর্তব্যের মাঝে না আনি!

অনেকদিন পর ভালো করে গোসল করে পরিষ্কার কাপড় পরেছি। রাত্রে খাওয়ার আয়োজনও ছিল ভালো, ভাত, মুরগির মাংস সবজি এবং ডাল। সবকিছুতেই ঝাল একটু বেশি কিন্তু খেতে চমৎকার। খেয়ে বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে আমি আর জয়ন্ত অনেক বড় বড় জিনিস নিয়ে কথা বলে রাত বারোটা বাজিয়ে ফেললাম। ঘড়ি দেখে আমি বললাম, “চল শুয়ে পড়ি।”

জয়ন্ত উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চল।”

আমরা দুজনেই তখন হঠাৎ একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম, দুজনেই হঠাৎ কিছু একটা অস্বাভাবিক জিনিস অনুভব করতে শুরু করেছি, জিনিসটা কী ঠিক বুঝতে পারছি না। জয়ন্ত ফিসফিস করে বলল, “কিছু একটা হয়েছে হঠাৎ।”

“হ্যাঁ।” আমি মাথা নাড়লাম, “কী হয়েছে?”

জয়ন্ত হঠাৎ চমকে উঠে বলল, “বুঝতে পেরেছি।”

“কী?”

“মনে আছে কেমন ঝিঁঝি পোকার ডাক ছিল? এখন কোনো শব্দ নেই। কোনো ঝিঁঝি পোকার ডাক নেই।”

সত্যিই তাই, পুরো এলাকাটা হঠাৎ এমন নীরব হয়ে গেছে যে আমি ভয়ের একটা কাঁপুনি অনুভব করলাম। আমি আর জয়ন্ত চারিদিকে তাকালাম, রেস্ট হাউসের আরো বাইরে খানিক দূর গিয়েছে, তার বাইরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। চারিদিকে গাছগাছালি, সব মিলিয়ে কেমন যেন থমথমে একটা ভাব।

হঠাৎ করে কাছাকাছি গাছের একটা ডাল নড়তে শুরু করে, মনে হয় সেই ডালে কেউ একজন বসে ডাল ঝাঁকাতে শুরু করেছে, হঠাৎ করে ঝাঁকুনি থেমে গেল; এবং ধুপ করে একটা শব্দ শুনতে পেলাম। মনে হলো গাছ থেকে কিছু একটা জিনিস যেন নিচে পড়েছে। চারিদিকে হঠাৎ একটা বোটকা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল, অনেকটা মাংস পোড়া গন্ধ।

আমি জয়ন্তকে বললাম, “জয়ন্ত ভেতরে আয়।”

“হ্যাঁ। চল।”

দুজনে আমরা তাড়াতাড়ি আমাদের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। হঠাৎ করে আমরা দুজনেই ভয় পেয়েছি। জয়ন্ত নিচু গলায় বলল, “নিশ্চয়ই বানর হবে।”

“হ্যাঁ। নিশ্চয়ই বানর।” আমি একটু অস্বস্তি নিয়ে বললাম, “ কিন্তু এমন দুর্গন্ধ কেন চারিদিকে?

জয়ন্ত ঢোঁক গিলে বলল, “সেটা তো জানি না।”

“আয় শুয়ে পড়ি।”

জয়ন্ত মাথা নাড়ল, বলল, “গুড আইডিয়া।”

আমরা লাইট নিভিয়ে নিজেদের বিছানায় শুয়ে পড়লাম এবং শুয়ে শুয়ে শুনলাম একটা বিড়াল হঠাৎ করে ঠিক মানুষের গলায় কান্নার মতো শব্দ করে ডাকছে। সেই ডাকটি এমন ভয়ংকর যে আমার গা কেঁপে উঠল।

আমি আর জয়ন্ত দুজনেই নিজেদের বিছানায় শুয়ে আছি দুজনের কেউ-ই ঘুমাতে পারছি না। আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুনতে পেলাম ঘরের ভিতরে খুট খুট করে এক রকম শব্দ হচ্ছে। আমি বললাম, “জয়ন্ত, শব্দ শুনতে পাচ্ছিস?”

“হ্যাঁ।”

“কোথা থেকে শব্দ হচ্ছে?”

“জানি না। মনে হয় তোর ব্যাগের ভেতর থেকে।” জয়ন্ত এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, “লাইটটা জ্বালাব?”

“জ্বালা।”

আমি শুনতে পেলাম সে বিছানা থেকে নামল, ঠিক তখন হঠাৎ করে গেস্ট হাউসের একটা জানালা সশব্দে খুলে গেল। মনে হলো হঠাৎ করে একটা দমকা হাওয়া ঘরের ভেতরে ঢুকেছে। ঘরের ভেতর বাতাসের একটা ঝাঁপটায় কাগজপত্র বই উড়তে থাকে, বাদুর কিংবা রাতজাগা কোনো পাখির ডানা ঝাঁপটানোর একটা শব্দ শুনলাম-সাথে সাথে ঘরের ভেতরটুকু বোটকা একটা গন্ধে পুরো ঘর ভরে ওঠে। মনে হতে থাকে ভয়ংকর অশুচি কিছু ঘরের ভেতরে ঢুকেছে। আমি চিৎকার করে জয়ন্তকে ডাকলাম, বললাম, “জয়ন্ত, সাবধান।”

জয়ন্ত আমার কথার কোনো উত্তর দিল না। আমি একটু ভয় পাওয়া গলায় ডাকলাম, “জয়ন্ত!”

জয়ন্ত এবারও আমার কথার উত্তর দিল না। আবছা অন্ধকারে জয়ন্তকে দেখতে পাচ্ছি সে ঘরের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছে; কেন সে কথার উত্তর দিচ্ছে না বুঝতে পারছি না। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, “জয়ন্ত! কী হয়েছে তোর?”

ঠিক তখন মনে হলো ঘরের ভেতর একটা চাপা অন্ধকার জমা হয়েছে, সেটি নড়ছে, ঘরের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি নিঃশ্বাস নেবার মতো এক ধরনের শব্দ শুনতে পেলাম। জয়ন্ত তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে–জমাটবাঁধা অন্ধকারটা হঠাৎ করে জয়ন্তের দিকে ছুটে এলো, মনে হলো সেটা জয়ন্তের ওপর লাফিয়ে পড়ল। অমানুষিক একটা চিৎকার দিয়ে জয়ন্ত তখন নিচে পড়ে যায়। আমি এক ধরনের গোঙানোর মতো শব্দ শুনতে পেলাম, মনে হলো জয়ন্ত বুঝি মরে যাচ্ছে।

আমি বিছানা থেকে লাফিয়ে নামলাম আলো জ্বালানোর জন্যে। পাগলের মতো সুইচ খুঁজতে থাকি সেটা আর খুঁজে পাই না, শেষ পর্যন্ত সেটা খুঁজে পেলাম, সুইচটা টিপতেই ঘরটা আলোকিত হয়ে উঠল। জয়ন্ত মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে, সে থরথর করে কাঁপছে। আমি তার কাছে দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরে ডাকলাম, “ জয়ন্ত! এই জয়ন্ত।”

জয়ন্ত চোখ খুলে তাকাল। তার সেই দৃষ্টি দেখে আমি ভয়ে ছিটকে সরে গেলাম। সেটি মানুষের দৃষ্টি নয়। জয়ন্ত মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল, তারপর হঠাৎ হা হা করে হেসে উঠল, আমি তার হাসি দেখে আতঙ্কে শিউরে উঠলাম। হাসতে হাসতেই জয়ন্ত উঠে বসল, দেখে মনে হচ্ছে সে নিজে থেকে ওঠে নি, কেউ তাকে টেনে তুলেছে, তার ভঙ্গি আড়ষ্ট। আমি বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম, দেখতে পেলাম সে দুই হাত সামনে তুলে ধরে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল, মনে হলো আমাকে সে ধরতে চায়। ভয়ংকর একটি দৃষ্টিতে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, মুখ দিয়ে গোঙানের মতো শব্দ করছে, জিব বের হয়ে আছে এবং মুখ থেকে লালা ঝরছে। মুখের চামড়া টেনে ওপরে উঠে গিয়ে দাঁতগুলো বের হয়ে এসেছে। জয়ন্ত আর জয়ন্ত নেই সে একটি অমানুষিক পিশাচে পাল্টে গেছে।

জয়ন্ত খুব ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে, আমি পিছিয়ে যেতে থাকি, এই ঘর থেকে বের হয়ে গেস্ট হাউসের গার্ডকে ডেকে আনতে হবে, কিন্তু দরজাটি অন্যদিকে আমি যেতে পারছি না। জয়ন্ত আরো কাছে এগিয়ে এসে হঠাৎ হিংস্র পশুর মতো আমার ওপর লাফিয়ে পড়ল-আমি চিৎকার দিয়ে এক পাশে সরে গেলাম, জয়ন্ত আমার পাশে এসে পড়ল, খাটের পাশে রাখা ছোট টেবিলে আঘাত লেগে তার মাথা কেটে গেছে, সেখানে রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে বের হতে থাকে। আমি ভয়ংকর আতঙ্কে দেখতে পেলাম সে জিব বের করে চেটে চেটে তার নিজের রক্ত খেতে থাকে।

ঠিক তখন আমার নিশা তান্ত্রিকের কথা মনে হলো-এটি কী তার অপদেবতা? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে কী আমি তার দেওয়া সেই তাবিজটি বের করতে পারি না? আমার ব্যাগের পকেটে রেখেছিলাম ব্যাগটা টেবিলের ওপর। জয়ন্তকে পাশ কাটিয়ে অন্য পাশে যেতে হবে, কাজটি সহজ নয় কিন্তু আমাকে যেতেই হবে। আমি উঠে বসে এক লাফ দিয়ে অন্যপাশে ছুটে যাবার চেষ্টা করলাম কিন্তু জয়ন্ত আমাকে ধরে ফেলল, গোঙানোর মতো শব্দ করে সে আমার গলায় দাঁত বসানোর চেষ্টা করতে থাকে আমি চিৎকার করে তার কাছ থেকে ছোটার চেষ্টা করতে থাকি, তার গায়ে অমানুষিক শক্তি নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়া অসম্ভব একটি ব্যাপার! জয়ন্ত আমাকে নিচে ফেলে দিয়ে আমার বুকের ওপর চেপে বসে ভয়ংকর ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না, সেই অবস্থায় হাত দিয়ে টেনে ব্যাগটা নামিয়ে আনি। আন্দাজে ব্যাগের জিপ খুলে হাত ঢুকিয়ে দিতেই মনে হলো ব্যাগের ভেতর কিছু একটা নড়ছে। এটা নিশ্চয়ই সেই মানুষের হাড়-এটাই খুট খুট শব্দ করছিল। আমি হাত দিয়ে হাতড়াতে থাকি-হঠাৎ করে তাবিজ দুটো পেয়ে গেলাম খপ করে সেটা ধরতেই একটা বিচিত্র ব্যাপার হলো। জয়ন্ত আমার বুকের ওপর থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেল, তারপর ভীত পশুর মতো গড়িয়ে সরে গেল। সরীসৃপের মতো হামাগুড়ি দিয়ে সে খাটের নিচে ঢুকে গিয়ে আর্তনাদ করতে থাকে।

আমি একটা তাবিজ কোনোমতে নিজে গলায় ঝুলিয়ে নিলাম, অন্যটা হাতে নিয়ে জয়ন্তের কাছে এগিয়ে যেতে থাকলাম। সে খাটের নিচে গুটিশুটি মেরে ঢুকেছে সেখান থেকে তাকে টেনে বের করা সোজা নয়। আমি তাবিজটা হাতে ধরে তার দিকে এগিয়ে যেতে থাকি সে হঠাৎ যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে, আমার থেকে সরে যাবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকে। আমার দিকে হাত-পা ছুড়ছে, কিছুতেই সে আমাকে কাছে আসতে দেবে না। আমি তাবিজটা তার শরীরের দিকে ছুঁড়ে দিলাম, কারো শরীরে কেউ

যদি জ্বলন্ত সিসা ঢেলে দিলে সে যেরকমভাবে আর্তনাদ করে জয়ন্ত সেভাবে আর্তনাদ করে ওঠে, তারপর হঠাৎ করে নেতিয়ে একেবারে নিথর হয়ে গেল।

আমি এরকম সময়ে দরজায় শব্দ শুনতে পেলাম। গার্ড দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। আমি গিয়ে দরজা খুলে দিলাম, হাতে একটা লাঠি নিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে সে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে স্যার?”

আমি কীভাবে ব্যাখ্যা করব বুঝতে পারলাম না, তাই সে চেষ্টা না করে বললাম, “খাটের তলা থেকে জয়ন্তকে আগে বের করতে হবে। তারপর ডাক্তার ডাকতে হবে–”

দুজনে মিলে আমরা জয়ন্তকে বের করে আনলাম, রক্তে মুখ মাখামাখি হয়ে আছে, চোখ বন্ধ আমি নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখলাম নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে মরে যায় নি, অচেতন হয়ে আছে। আমি গার্ডকে বললাম, “দৌড়ে একজন ডাক্তারকে ডাকেন তা না হলে এখনি একে হাসপাতালে নিতে হবে”

গার্ড বের হয়ে যেতে যেতে ফিরে এসে বলল, “দরজার সামনে আমার বিড়ালটা মরে পড়ে আছে, কে মেরেছে?”

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “মানুষ মরে যাচ্ছে আর আপনি বিড়াল নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন?”

এর পরের ঘটনা মোটামুটিভাবে স্বাভাবিক। জয়ন্তকে দুদিন হাসপাতালে থাকতে হলো। একটু সুস্থ হওয়া মাত্রই আমি আর জয়ন্ত শ্রীমঙ্গলে ছুটে গেলাম। নিশা তান্ত্রিক তার আখড়া গুটিয়ে চলে যাবার আয়োজন করছে। আমাদের দেখে দাঁত বের করে হেসে বলল, “কী হলো? বিশ্বাস হয়েছে?”

আমি কোনো কথা না বলে পকেট থেকে তাবিজ এবং মৃত মানুষের হাড়টা বের করে বললাম, “আপনাকে এগুলো ফিরিয়ে দিতে এসেছি।”

“আসেন কাছে আসেন। ফিরিয়ে দেওয়া এত সোজা নয়। আমার ফি দুইশ টাকা। আছে তো টাকা?”

আমি কিছু বলার আগেই জয়ন্ত বলল, “আছে। অবশ্যই আছে।”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *