বদরুল মামা
এই গল্পটি বিশ্বাস করার কোনো প্রয়োজন নেই, কারণ এই গল্পটি আমি যার কাছে শুনেছি তার কোনো গল্পই আমি বিশ্বাস করি না। সম্পর্কে তিনি আমার মামা, আমরা তাকে বদরুল মামা বলে ডাকি। আসলেই কোনো সম্পর্ক আছে না কি গ্রাম সূত্রে মামা সেটাও আমি ঠিক করে জানি না। বদরুল মামার সবকিছু বাড়িয়ে বলা অভ্যাস, একবার মাছ ধরতে গিয়ে আধাহাত একটা রুই মাছের বাচ্চা ধরে আনলেন কিন্তু যে মাছটা ধরতে পারেন নি, সুতা ছিঁড়ে পালিয়ে গেছে সারাক্ষণই সেই মাছটার এমন বর্ণনা দিতে লাগলেন যে শুনলে মনে হবে ভুল করে একটা তিমি মাছ এই নদীতে চলে এসেছিল। আরেকবার ঢাকায় এসে রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে হাঁটুর ছাল তুলে ফেললেন, গ্রামে ফিরে গিয়ে সেই একসিডেন্টের এমন রোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন যে যারা শুনল সবার ধারণা হলো তিনি ভয়ংকর একসিডেন্টে একেবারে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছেন। কিছুদিন আগে তার বাসায় চোর ঢুকে কিছু পুরনো জামাকাপড় নিয়ে পালিয়ে গেল, কিন্তু তার গল্প শুনলে মনে হবে যে চোর নয় বুঝি মেশিনগান নিয়ে ডাকাতের দল চলে এসেছিল।
কাজেই এই বদরুল মামার কাছে আমি যে ভূতের গল্প শুনেছি তার ভেতরে বিশ্বাসযোগ্য অংশ আছে আমি একেবারেই দাবি করব না। তবে গল্পটা ভালো সেটা দশজনকে বলা যায়।
গল্পটি পুরনো দিনের, যখন আমাদের দেশের খালেবিলে শীতকালে অসংখ্য পাখি এসে নামতো এবং লোকজন নিঃসংকোচে সেই পাখি শিকার করতো। জ্যোৎস্না রাতে বিলে গিয়ে দশ-বিশটা সাইবেরিয়ান হাঁস গুলি করে মেরে ফেললেও সেই খবর পত্রিকায় ছাপা হতো না, সম্পাদকীয়রা অতিথি পাখি হত্যাকাণ্ডের ওপর সম্পাদকীয় লিখতেন না, এবং থানা থেকে পুলিশ পাখি মারার জন্যে মামলা করে টাকা কামাই করার চেষ্টা করতো না। সেই যুগে দশ-বিশ গ্রামের ভেতরে এক-দুইজনের বন্দুক থাকতো এবং সেটাকে একটা সম্মানের বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তখন রেডিও-টেলিভিশন ছিল না, বিজ্ঞান নিয়ে কেউ এত মাথা ঘামাতো না, ভূত বলে কিছু নেই সেটাও এত জোর গলায় কেউ বলতো না। অন্ধকার রাতে কেউ যদি একটা ভূতের গল্প ফেঁদে বসততা তার ডিটেলস নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতো না, গল্প শেষ হবার পর কেউ মুচকি হাসততা না যেখানে ভয় পাওয়ার কথা সেখানে নিয়ম মেনে ভয় পেতো!
কাজেই বদরুল মামার গল্পে খুঁটি-নাটি নিয়ে কারো প্রশ্ন থাকলে তার এই গল্পটি পড়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তার কারণ গল্পটি এরকম, তার নিজের ভাষায় :
সেবার শীতে বিলে প্রচুর পাখি পড়েছে, আমাদের বাড়ির কামলা আলাউদ্দিন মাছ মারতে গিয়ে খবর এনেছে শেষ রাতে বৈঠা দিয়ে পানিতে মেরে বসলেই নাকি দুই-চারটা পাখি মেরে ফেলা যায়। যদি ছররা গুলির ঠোটাসহ একটা বন্দুক নিয়ে যাওয়া যায় তাহলে এক গুলিতে যে কয়টা ছররা সেই কয়টা পাখি মারা যাবে। আমার বয়স কম, পাখি শিকারের গল্প শুনে রক্ত চনমন করে ওঠে। তবে সমস্যা একটাই, বাড়িতে বন্দুক একটা এবং সেটা বাবার সরাসরি তত্ত্বাবধানে থাকে। বাবা ছাড়া সেই বন্দুক আর কেউ ধরেছে সেরকম নজির নেই। এই যুগে ছেলেপিলেরা দেখি বাবার গলা ধরে হাঁটাহাঁটি করে, আমাদের যুগে সেটা ছিল চিন্তার বাইরে। বাবাকে কিছু বলতে হলে মায়ের মাধ্যমে বলেছি-সরাসরি বাবাকে কিছু বলার প্রশ্নই আসে না। তার ওপর পাখি শিকারে যাবার জন্যে বন্দুক চাওয়া-তার চাইতে গুলি করে মেরে ফেলার জন্যে বন্দুক ব্যবহার করার অনুমতি চাওয়া সোজা!
কাজেই প্রত্যেকদিন পাখির খবর শুনি আর ছটফট করি। এর মাঝে অভাবিতভাবে একদিন সুযোগ চলে এলো-শুনতে পেলাম জলমহাল নিয়ে মামলার তারিখ পড়েছে, বাবাকে সদরে যেতে হবে। যে সময়ের কথা বলছি সেই সময়ে সদরে যাওয়া এবং আসা চারদিনের ধাক্কা-তার ওপর মামলার জন্যে দুই দিন, কাজেই প্রায় পুরো সপ্তাহটাই বাবা থাকবেন না। তার ভেতরে অন্তত একদিন দোনলা বন্দুকটা ম্যানেজ করা যাবে না সেটা তো হতে পারে না।
কাজেই বাবা সদরে যাবার পরের দিনই পরিকল্পনা পাকা করে ফেললাম, আলাউদ্দিনকে বলে রাখলাম ভোর রাতে আমাকে ডেকে তুলবে, দুইজনে নৌকা করে যাব বিলে। সূর্য ওঠার আগে যে কয়টা পারি পাখি শিকার করা হবে। আলাউদ্দিন রাজি হলো। এমনিতেই আমি ভেতর বাড়িতে ঘুমাই, সেই রাতের জন্যে বাংলা ঘরে ঘুমালাম। মাকে ফাঁকি দিয়ে চাবি ম্যানেজ করে বন্দুকটা আগেই সরিয়ে রেখেছি।
রাত্রি বেলা সকাল সকাল খেয়ে শুয়ে পড়েছি। সেই বছর ঠাণ্ডাও পড়েছে বেশ, এক লেপ দিয়ে শীত মানে না। পাখি শিকারের উত্তেজনায় চোখে ঘুম আসে না, বিছানায় ছটফট করে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। সবে চোখ বন্ধ করেছি মনে হলো তার মাঝেই আলাউদ্দিন এসে দরজায় ধাক্কা দিল। আমি লেপ থেকে মাথা বের করে জিজ্ঞেস করলাম, “কে? আলাউদ্দিন নাকি?”
আলাউদ্দিন বাইরে থেকে বলল, “উঁ।”
“এত সকাল সকাল চলে এসেছিস, ব্যাপারটা কী?”
উত্তরে আলাউদ্দিন কিছু একটা বলল, “আমি সেটা ঠিক ধরতে পারলাম না। যে যুগের কথা বলছি সেই যুগে ঘড়ির চল ছিল না, দিনে সূর্য রাতে চাঁদ দেখে সময় ঠিক করতে হতো মনে করলাম হয়তো আসলেই শেষ রাত হয়ে এসেছে।
আমি ঘুম থেকে উঠে হারিকেনের সলতে উসকে দিয়ে আলাউদ্দিনকে ডেকে বললাম, “আয়, ভেতরে আয়। আমি ততক্ষণ কাপড় পরি।”
কোনো একটা কারণে আলাউদ্দিন ভেতরে ঢুকতে চাইল না। চাদরে মুড়ি দিয়ে বারান্দায় বসে রইল, আমি আর তাকে জোর করলাম না। ফ্লানেলের শার্ট, ওপরে ডাবল সোয়েটার, গলায় মাফলার, মাথায় মানকি ক্যাপ, পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো তার ওপরে একটা কাশ্মীরি শাল চাপিয়ে বের হলাম। একহাতে বন্দুক অন্য হাতে একটা ব্যাগ, ব্যাগের ভেতরে টোটা, পাখি জবাই করার জন্যে একটা চাকু। শুক্লপক্ষের রাত, তিনদিন পর জ্যোৎস্না-এখনই আকাশে বেশ বড় চাঁদ। তবে খুব কুয়াশা পড়েছে, চাঁদের আলোতে কুয়াশার ভেতরে জ্যোৎস্নাকে কেমন যেন অপার্থিব দেখায়। আমি আলাউদ্দিনকে বললাম, “চল।”
আলাউদ্দিন উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল। আমাদের বাড়ি থেকে আধমাইল দূরে খালের মুখে নৌকা বাঁধা থাকে আমরা সেদিকে হাঁটতে শুরু করেছি। কুয়াশায় রাস্তাঘাট দেখা যায় না, নেহাত চেনা রাস্তা তাই যেতে পারছি। আলাউদ্দিন সামনে সামনে হাঁটছে, আমি পেছনে। চারিদিকে সুনসান নীরবতা, মানুষজন নেই, রাস্তার দুপাশে গাছের পাতা থেকে টুপটাপ করে কুয়াশার পানি পড়ছে। কেমন যেন ভয় ভয় আবহাওয়া আমি যতই হেঁটে আলাউদ্দিনের কাছে যেতে চাই আলাউদ্দিন ততই সামনে এগিয়ে যায়। কুয়াশায় তাকে ভালো দেখাও যায় না শুধু বোঝা যায়। অন্ধকারে কেউ একজন আছে। এই ভোর রাতেই হাঁটতে হাঁটতে আমার শরীর গরম হয়ে গেল, কাশ্মীরি শাল আর ডাবল সোয়েটারের নিচে রীতিমত ঘেমে গেলাম।
খালের মুখে এসে আলাউদ্দিন থামল, বেশ কয়েকটা নৌকা বাঁধা আছে। আমি আমাদের নৌকাটা খুঁজে বের করলাম ছোট ছিপ নৌকা। আমি উঠে গলুইয়ের কাছে বসেছি, আলাউদ্দিন তখন নৌকাটাকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ঠেলে দিয়ে সেখানে উঠে বসল। এমনিতে আলাউদ্দিন বেশ কথাবার্তা বলে, কোনো একটা কারণে আজকে বেশ চুপচাপ। যেভাবে চাদর মুড়ি দিয়েছে ভালো করে তার চেহারাও দেখা যাচ্ছে না। আমি বললাম, “দেখেছিস আলাউদ্দিন, কেমন ঠাণ্ডা পড়েছে?”
আলাউদ্দিন মাথা নেড়ে বলল, “হুঁ।”
আমি হাত দুটো ঘষে শরীর গরম করার চেষ্টা করতে লাগলাম, আলাউদ্দিন বৈঠা চালিয়ে নৌকা এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। পানিতে বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। আকাশে চাঁদ উঠেছে, কুয়াশায় সেই চাঁদ ভালো করে দেখা যায় না-শুধু নরম আলোটা ছড়িয়ে পড়েছে। আলাউদ্দিন নৌকার অন্য মাথায় বসে আছে তাকেও ভালো দেখা যায় না। এই কুয়াশায় বিলে যেতে পারবে তো? আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কোন দিকে যেতে হবে জানিস তো, আলাউদ্দিন?”
আলাউদ্দিন বলল, “হুঁ।”
এ দেখি মহাযন্ত্রণা হলো, হাঁ এবং হুঁ ছাড়া সে আর কোনো কথা বলছে না। মনে হয় এই ভোর রাতে জোর করে ধরে নিয়ে এসেছি বলে আমার ওপরে একটু রাগ হয়েছে।
বাড়ির কামলা, কিছু করতে বললে নাও করতে পারে না, মুখ বুজে করতে হয়। এই শীতের রাতে কোথায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাবে তা নয় আমার সাথে কনকনে শীতে কুয়াশার মাঝে বিলে পানিতে রওনা দিতে হচ্ছে। আমি আর তাকে ঘাঁটালাম না।
ঘণ্টাখানেক পরে আমরা বিলের কাছে পৌঁছালাম। কুয়াশাটা আরো চেপে বসেছে ভালো করে কিছু দেখাও যায় না। নৌকা যাবার সময় মাঝে মাঝেই আশেপাশে পাখির শব্দ শুনি কিন্তু পাখিকে দেখতে পাই না। পাখি যদি দেখতে না পাই গুলি করব কেমন করে? এরকম কুয়াশা হবে কে জানত? আমি বললাম, “আলাউদ্দিন, বিলের মাঝখানে চরের মতো একটা জায়গা আছে না?”
আলাউদ্দিন বলল, “হুঁ।”
“সেইখানে নিয়ে চল। চরে নিশ্চয়ই পাখি পড়েছে।”
আলাউদ্দিন নৌকা ঘুরিয়ে বৈঠা চালাতে থাকে, এই কুয়াশার ভেতরে কোনদিকে যেতে হবে সে কেমন করে বুঝতে পারে কে জানে। কিছুক্ষণের মাঝে দেখি বড় বড় ঘাস, তার ভেতর দিয়ে শর শর করে আমাদের নৌকা ডাঙ্গার দিকে এগিয়ে গেল, ডাঙ্গার কাছে গিয়ে আলাউদ্দিন নৌকাটাকে লগি দিয়ে আটকে রাখে, আমি সাবধানে নেমে আসি। কুয়াশার ভেতর দিয়ে আমি হেঁটে যেতে যেতে আবিষ্কার করি শত শত বুনোহাঁসে পুরো চরটা ছেয়ে আছে। আমি নিঃশব্দে এগিয়ে গেলাম, ভালো একটা জায়গা বেছে নিয়ে বন্দুকে টোটা ভরে পাখির দিকে তাক করে গুলি করলাম। গুলির প্রচণ্ড শব্দে পুরো চর প্রকম্পিত হয়ে উঠল, সাথে সাথে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ বুনোহাঁস কলরব করতে করতে আকাশে উড়ে যায়। পাখা ঝাঁপটিয়ে তারা এদিক থেকে অন্যদিকে উড়তে থাকে, আমি বন্দুক উঁচিয়ে দ্বিতীয়বার গুলি করলাম, সাথে সাথে ঝুপ ঝুপ শব্দে অনেক বুনোহাঁস চরের ভেতর, বিলের ভেতরে এসে পড়ল। আমি আমার জীবনে এতগুলো বুনোহাঁস একসাথে দেখি নি, সেগুলো রাতের আকাশে কর্কশ শব্দ করে ডানা ঝাঁপটিয়ে উড়তে থাকে-প্রায় অনেকক্ষণ সময় নিয়ে সেগুলো আবার নিরাপদ জায়গায় গিয়ে বসল। এখন আমার গুলি খাওয়া হাঁসগুলো তুলতে হবে, জবাই করে রাখতে হবে। আমি সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম-ঠিক তখন শুনতে পেলাম কে যেন কাঁদছে।
ভয়ে আমার বুক ধক করে ওঠে। বিলের মাঝে এই নির্জন চরে কে কাঁদছে? আমি কী ভুল শুনছি? আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে শোনার চেষ্টা করলাম, সত্যিই কান্নার শব্দ। একজন মেয়ে মানুষ কাঁদছে, ইনিয়েবিনিয়ে কান্না। আমি কী তাহলে অন্ধকারে কোনো মানুষকে গুলি করে ফেলেছি? কোনো মানুষকে মেরে ফেলেছি? আমি ভয় পাওয়া গলায় ডাকলাম, আলাউদ্দিন।”
আলাউদ্দিন কোনো উত্তর দিল না, আমি আবার চিৎকার করে ডাকলাম, “আলাউদ্দিন? তুই কই?”
এবারেও কেউ উত্তর দিল না, কিন্তু হঠাৎ করে কান্নার শব্দটা থেমে গেল। আমি কী করব বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম, কুয়াশায় সবকিছু ঢাকা, সামনে-পিছে কোথাও কিছু দেখতে পাই না, কেমন যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়।
ঠিক তখন আবার কান্নার শব্দটা শুরু হয়ে গেল-কেউ একজন কাঁদছে, ইনিয়েবিনিয়ে কাঁদছে। স্বামী মারা গেলে কমবয়সী মেয়েরা যেরকম সুর করে কাঁদে ঠিক সেরকম কান্না। আমি কেমন জানি ভয় পেয়ে গেলাম, এটি অন্যরকম ভয়-আমার শিরদাঁড়া দিয়ে এবারে একটা কাঁপুনি বয়ে গেল। আমি এবারে ঘুরে যেদিক দিয়ে এসেছি সেদিকে ছুটে যেতে থাকি, কোনোভাবে গিয়ে নৌকায় উঠে এই ভুতুরে চর ছেড়ে পালিয়ে যাব! কুয়াশায় কিছু দেখা যায় না, কোনদিকে ছুটছি জানি না হঠাৎ করে পায়ের নিচে পানির স্পর্শ পেলাম, ছুটতে ছুটতে বিলের পানিতে নেমে গেছি। আমি ডানে-বামে তাকিয়ে আবার গলা উঁচিয়ে ডাকলাম, “আলাউদ্দিন।”
মনে হলো বাম দিক থেকে আলাউদ্দিনের গলার স্বর শুনতে পেলাম, আন্দাজে ভর করে বাম দিকে ছুটতে থাকি। সত্যি সত্যি কিছুক্ষণের মাঝে কুয়াশার মাঝে আবছা আবছা ভাবে নৌকাটাকে
দেখতে পেলাম। নৌকার গলুইয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে আলাউদ্দিন চুপচাপ বসে আছে। আমি প্রায় ছুটে এসে নৌকায় উঠে বললাম, “ নৌকা চালা আলাউদ্দিন-তাড়াতাড়ি আলাউদ্দিনের মাঝে কোনো তাড়া নেই। সে ধীরেসুস্থে লগি দিয়ে ঠেলে নৌকাটাকে বিলের পানিতে নামিয়ে দেয়। আমি আবার কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম, ইনিয়েবিনিয়ে কেউ একজন কাঁদছে। কান পেতে শুনে মনে হলো একজন নয় বেশ কয়জন কাঁদছে। আমি ভয়ে ভয়ে চরের দিকে তাকালাম, হঠাৎ করে আমার স্পষ্ট মনে হলো, ঘাসবনের পেছনে কয়েকটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বাতাসে তাদের শাড়ি উড়ছে, চুল উড়ছে তারা হাত নেড়ে নেড়ে আমাকে অভিশাপ দিচ্ছে। সেটি যে কী ভয়ংকর অভিজ্ঞতা বলে বোঝানো যাবে না। আমি নিঃশ্বাস আটকে রেখে বললাম, “ তাড়াতাড়ি চল, আলাউদ্দিন। এখান থেকে পালা।”
আলাউদ্দিন কিছু বলল না। আমি বললাম, “কী সর্বনাশ!”
আলাউদ্দিন এবারেও কিছু বলল না। ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করে নৌকা এগিয়ে যাচ্ছে, আমি সাবধানে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, “আফসোস যে হাঁসগুলো আনতে পারলাম না!”
আলাউদ্দিন এবারে অস্পষ্ট একটা শব্দ করল, আমি বললাম, “কী মনে হয় আলাউদ্দিন, কমপক্ষে বারো-চৌদ্দটা হাঁস কী পড়ে নি?”
আলাউদ্দিন কোন উত্তর দিল না কিন্তু হঠাৎ করে নৌকার গলুইয়ে ডানা ঝাঁপটানোর মতো শব্দ শুনতে পেলাম, মাথা নিচু করে দেখি, অনেক বুনোহাঁস, ডানা ভাঙা, গুলি খাওয়া হাঁস। কিছু মরে গেছে, কিছু ধুকছে! আমি আনন্দে চিৎকার করে বললাম, “ আলাউদ্দিন, তুই হাঁসগুলো তুলে নিয়ে এসেছিস?”
আলাউদ্দিন অস্পষ্ট গলায় বলল, “হুঁ।”
“চমৎকার! আমি আরো ভাবলাম এতগুলো হাঁস ফেলে আসতে হলো–“
আলাউদ্দিন এবারেও কোনো কথা বলল না। আমি বললাম, হাঁসগুলো জবাই করে নিতে হবে না? যদি মরে যায়–”
আলাউদ্দিন কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে নৌকা বাইতে থাকে। অন্য যে কোনো সময় হলে এরকম বেয়াদবি আমি সহ্য করতাম না, কিন্তু এখন অন্য ব্যাপার। এই রকম ভুতুড়ে চর থেকে গুলি খাওয়া হাঁসগুলো নিয়ে এসেছে সে জন্যেই আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
বিলের কালো পানিতে নৌকা নিঃশব্দে যেতে থাকে, আমি আকাশের দিকে তাকালাম, মনে হলো হঠাৎ যেন কুয়াশা কেটে যাচ্ছে। ঠিক মাথার ওপরে বড় একটা চাঁদ। জ্যোৎস্নার আলোতে চারপাশে এখন বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দেখতে দেখতে নৌকাটা পরিষ্কার একটা জায়গায় পৌঁছে গেল–কী কারণ কে জানে এখানে কোন কুয়াশা নেই, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দূরে হঠাৎ করে যেন কুয়াশার একটা দেওয়াল দাঁড়িয়ে আছে। তার ভেতরে সবকিছু অস্পষ্ট। সবকিছু ধোয়াটে।
আমি আবার আকাশের দিকে তাকালাম, পরিষ্কার ঝকঝকে চাঁদ। হঠাৎ করে আমি ভয়ানক চমকে উঠি, চাঁদটা ঠিক মাথার ওপরে কেন? চাঁদ তো এতক্ষণে প্রায় ডুবে যাবার কথা। তার মানে এখন তো ভোররাত নয়, এখন তো মাঝরাত। আমি তো আলাউদ্দিনকে বলেছিলাম আমাকে ভোররাতে তুলে নিতে সে মাঝরাতে কেন তুলে আনল? হঠাৎ করে আমি কেমন যেন ভয় পেয়ে যাই আমি আলাউদ্দিনের দিকে তাকালাম, চাদর মুড়ি দিয়ে এমনভাবে ঢেকেছে আমি তার চেহারা দেখতে পাচ্ছি না। এটি কী সত্যিই আলাউদ্দিন নাকি অন্য কেউ? আমি ভয়ে ভয়ে ডাকলাম, “ আলাউদ্দিন।”
আলাউদ্দিন কোনো উত্তর দিল না কিন্তু হঠাৎ করে বৈঠা চালানো বন্ধ করে দিল। খানিকক্ষণ নিঃশব্দে বসে থাকে তারপর বৈঠাটা নৌকায় তুলে রেখে দেয়। নৌকাটা বিলের পানিতে ঢেউয়ে অল্প অল্প দুলছে। আমি শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়েছে?”
“খিদা পাইছে।” এই প্রথম সে কথা বলল, “গলার স্বর শুষ্ক এবং প্রাণহীন। এটি আলাউদ্দিনের গলার স্বর নয়। আমি ভয়ানক চমকে উঠি।
মানুষটি হঠাৎ করে তার হাত বাড়িয়ে দেয়, শুকনো দীর্ঘ হাত, মনে হয় হাড়ের ওপর চামড়া লেপটে লাগানো আছে। মানুষটি শুকনো হাতে খপ করে একটা বুনোহাঁস ধরে নিজের কাছে নিয়ে যায় তারপর হঠাৎ করে তার মাথাটা কামড়ে ধরে কড়মড় করে চিবাতে শুরু করে, হাঁসটা কর্কশ শব্দ করে ডানা ঝাঁপটাতে থাকে কিন্তু মানুষটির ভ্রূক্ষেপ নেই। চাদর মুড়ি দেওয়া মানুষটির মুখ ঢাকা ছিল, মাথা থেকে কাপড় পড়ে গিয়ে এখন তার চেহারাটা বের হয়ে এসেছে। কোটরাগত চোখ, ভাঙা তোড়ানো গাল, মাথায় চুল নেই বড় বড় ধারালো দাঁত। বুনোহাঁসটার বুক ছিঁড়ে দাঁত দিয়ে কামড়ে কামড়ে খেতে খেতে আমার দিকে তাকাল, কী ভয়ংকর সেই চোখ। হাঁসের রক্ত দিয়ে মুখ-হাত মাখামাখি হয়ে গেছে। জন্তুর মতো কড়মড় করে খেতে খেতে সেই পিশাচটা আমাকে বলল, “ খিদা পাইছে। অনেকদিন তো কিছু খাই নাই।”
বদরুল মামা গল্পের এই পর্যায়ে এসে থেমে গিয়েছিলেন। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসেছিলাম, জিজ্ঞেস করলাম, “তারপর?”
বদরুল মামা মাথা চুলকে বললেন, পরের অংশটা ঠিক মনে নাই, অনেক ভয় পেয়ে মানুষ যখন কিছু করে সেটা ঠিক মনে থাকে না। বন্দুকে গুলি ভরে মনে হয় সেই পিশাচটাকে গুলি করার চেষ্টা করেছিলাম–কাজ হয় নাই। শেষ পর্যন্ত লোকজন এসে আমাকে পানি থেকে তুলেছিল–”
“লোকজন জানল কেমন করে?”
“আলাউদ্দিন ভোররাতে উঠে বাংলা ঘরে এসে দেখে আমি নাই, তখনই তার সন্দেহ হয়েছে, তাড়াতাড়ি লোক জোগাড় করে খুঁজতে এসেছিল। এই বিলটার খুব দুর্নাম আছে।”
“আপনার কী হয়েছিল?”
অনেকদিন জ্বরের ঘোরে ছিলাম। শেষ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছি, বাবার এত সখের বন্দুকটা বিলের পানিতে ডুবে গেছে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। বাবা যা রাগ করলেন সে আর বলার মতো না।”
“কী করলেন রাগ করে?”
“ভয়ংকর একটা শাস্তি দিলেন।”
“কী শাস্তি দিলেন?”
বদরুল মামা এদিক-সেদিক দেখে গলা নামিয়ে বললেন, “ বিয়ে দিয়ে দিলেন আমার। সে আরেক কাহিনী—”
সেই কাহিনীটাও আমাদের শুনতে হয়েছে, কিন্তু সেটা এখন থাক।