Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

বাসার সামনে এসে আমি একেবারে হতবাক হয়ে গেলাম-একজন মানুষের বাসা যে এত বড় হতে পারে নিজের চোখে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতে পারতাম না। নিচে গ্যারেজ, সিঁড়ি দিয়ে বাসার দরজা পর্যন্ত উঠে যেতে হলো, কারুকাজ করা। কাঠের দরজা। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেই আমি মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আজকে এখানে সম্ভবত শ-খানেক মানুষ এসেছে, তাদের বেশির ভাগকেই আমি চিনি না, গোটা দশেক মানুষের সাথে হালকা মুখ-চেনা ধরনের পরিচয় আছে। যারা অপরিচিত তাদের নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু যাদের সাথে হালকা এক ধরনের পরিচয় তাদের সাথে পরবর্তী এক-দুই ঘণ্টা আমাকে ভদ্রতার এক ধরনের কথাবার্তা চালিয়ে যেতে হবে। সোজাসুজি প্রশ্ন না করে কথাবার্তার ধরন থেকে আমাকে বের করতে হবে মানুষটি কে, তাকে আমি আগে কোথায় দেখেছি এবং সেই মানুষটিও সেভাবে বের করার চেষ্টা করবে আমি কে এবং সে আমাকে আগে কোথায় দেখেছে! তারপর দুজনেই ভদ্রতার একটা আলাপ চালিয়ে যাব এবং মনে মনে কখন এই যন্ত্রণা শেষ হবে তার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকব।

ভেতরে ঢুকে আমি এদিক-সেদিক তাকালাম, বাসার মালিক আমাকে দেখে অসম্ভব খুশি হয়েছেন এরকম ভান করে আমার দিকে এগিয়ে এলেন, আমার হাত ধরে পুরোপুরি অর্থহীন কয়েকটা কথা বললেন এবং প্রায় টেনে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু মানুষের কাছে নিয়ে গেলেন সেখানে তাদের জিম্মায় ছেড়ে দিয়ে আবার অন্য একজন অতিথির দিকে খুব খুশি হওয়ার ভান করে ছুটে গেলেন। আমাকে যাদের জিম্মায় ছেড়ে গেছেন তাদের দিকে তাকিয়ে আমি একটু সেঁতো হাসি হেসে “কেমন চলছে”

“ভাবীর শরীর কেমন”

“সবাই ভালো তো” এরকম অর্থহীন অপ্রয়োজনীয় কথা বলতে লাগলাম। কিছুক্ষণের মাঝে একজন মানুষ একটা ট্রেতে অনেক গ্লাসে নানা ধরনের পানীয় নিয়ে হাজির হলো, আমি সাবধানে একটা নির্দোষ গ্লাস তুলে নিয়ে অন্যমনস্ক ভান করে ভিড় থেকে সরে এলাম।

বিশাল ড্রয়িংরুমের জায়গায় জায়গায় মানুষজনেরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে কথাবার্তা বলেছে। পুরুষ-মহিলা প্রায় সমান সমান, কথাবার্তার বেশির ভাগ হচ্ছে ইংরেজিতে। যারা বাংলায় কথা বলছেন তাদের বাংলা কথাও শুনতে ইংরেজির মতো শোনায়। একটু দূরে সরে গিয়ে এই মানুষগুলোকে দেখতে বেশ লাগে কিন্তু সরে যাওয়ার সুযোগ নেই।

আমি ঘরে পায়চারি করতে করতে এক কোনায় এসে একটা খালি সোফা পেয়ে গেলাম, এক কোনায় একজন বিরস মুখে বসে আছে, আমি অন্য পাশে বসে টেবিলে রাখা মাগ্যাজিনগুলো দেখতে থাকি। বেশির ভাগই পুরনো নিইজউইক, ছয়-সাত মাস আগে হলিউডে কী ধরনের স্ক্যান্ডাল হয়েছিল সেগুলো পড়ে বেশ সময় কেটে যাবে বলে মনে হচ্ছে।

সোফার অন্য মাথায় বসে থাকা মানুষটি তার পকেট থেকে একটা ছোট পানের বাটা বের করে সেখান থেকে পান-সুপুরি বের করে একটা ছোট পানের খিলি তৈরি করে মুখে পুরে দিলেন। পানের বাটায় ছোট ছোট খুপরিতে জর্দা, মসলা এবং চুন রাখা আছে, আঙুলের ডগায় একটু চুন লাগিয়ে নিয়ে বাটাটি বন্ধ করতে গিয়ে মানুষটি আমার দিকে তাকালেন। আমি তার পান খাওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটি বেশ মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করছিলাম, মানুষটি সেটা লক্ষ করে পানের বাটাটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “ খাবেন?”

আমি একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম, বললাম, “না খাব না। থ্যাংক ইউ।”

ভদ্রলোক পানের বাটা বন্ধ করে পকেটে রেখে পান চিবুতে শুরু করে বললেন, “না খাওয়াই ভালো। খুব খারাপ অভ্যাস।”

আমি একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম, “অনেকদিন পর একজনকে পানের বাটা থেকে পান-সুপুরি বের করে খেতে দেখলাম।”

ভদ্রলোক তার মূল্যবান পানের পিক মুখের মাঝে রক্ষা করার জন্যে মুখটা একটু ওপরে তুলে বললেন, “আমার বউ মনে হয় এ কারণেই আমাকে ডিভোর্স করে দেবে।”

আমি ভদ্রলোকের আগে-পিছে কিছু জানি না, তার পরেই কথার পিঠে কথা বলার জন্যে বললাম, ‘এতদিন যখন করেননি, মনে হয় আর করবেন না।”

‘এতদিন কী বলছেন? আমার পান খাওয়ার অভ্যাস মাত্র দুই বছরের।”

“কেমন করে হলো?”

“ছয় মাসের জন্যে সুইডেন গিয়েছিলাম একটা কাজে, সেখান থেকে শিখে এসেছি।”

ভদ্রলোক ঠাট্টা করছেন কী না বোঝার জন্যে আমি ভালো করে তার দিকে তাকালাম, কিন্তু চোখে-মুখে কৌতুক কিংবা রসিকতার কোনো চিহ্ন নেই। ভদ্রলোক হাসি হাসি মুখ করে বললেন, ‘বিশ্বাস করলেন না, তাই না? কেউ বিশ্বাস করে না। কিন্তু সত্যি কথা। ইচ্ছে করলে আমার বউকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।

“বিশ্বাস করা একটু শক্ত কিন্তু আপনি যেহেতু বলছেন বিশ্বাস করছি।”

“উড়িষ্যার একজন কলিগ ছিল, সেই ব্যাটা এই উপকার করে দিয়ে গেছে-আমাকে পান খাওয়ানো শিখিয়ে দিয়েছে। এখন ঘণ্টায় ঘণ্টায় এক খিলি মুখে না দিলে জুত লাগে না।”

পান নিয়ে আলোচনা কতক্ষণ চালিয়ে যেতে পারব আমি সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম না কিন্তু ভদ্রলোক আমাকে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন, বললেন, “আচ্ছ আমি যদি এখন এই বাসার দেওয়ালে পানের পিক ফেলে দিই তাহলে বাসার মালিক কী করবেন বলে আপনার মনে হয়?”

আমি হা হা করে হেসে বললাম, “চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কী করবেন?”

“দেবো নাকি ফেলে?”

“একেবারে নতুন ঝকঝকে বাসা, প্রথম দিনেই ফেলবেন?”

“থাক তাহলে।” ভদ্রলোক মুখ উঁচু করে পানের পিককে রক্ষা করে পান চিবুতে চিবুতে বললেন, “পার্থিব জিনিসের ওপর বেশি মায়া করলে আত্মার মুক্তি হয় না, ভূত হয়ে ফিরে আসতে হয়।”

যে মানুষ এক মুহূর্ত আগে দেওয়ালে পানের পিক ফেলা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে, পরের মুহূর্তে আত্মার মুক্তি নিয়ে কথা বলবে বুঝতে পারি নি। একটু থতমত খেয়ে বললাম, “কী বললেন?”

“বলেছি যে, এই বাড়ির মালিক মারা যাবার পর ভূত হয়ে এই বাড়িতে থেকে যাবে।”

“কেন?”

“বাড়িটা দেখছেন না? এত বড় বাড়ি আগে দেখেছেন?”

আমাকে স্বীকার করতেই হলো যে আমি এত বড় বাড়ি এর আগে কখনো দেখিনি। ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বলল, “একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে আসলে এত বড় বাড়ি লাগে না। তারপরেও কেন এত বড় বাড়ি বানায় জানেন?”

গলা নামিয়ে বললাম, “ব্ল্যাক মানির একটা গতি করতে হবে তো!”

ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, বললেন, “সেটা একটা কারণ। আরেকটা কারণ হচ্ছে টাকা দিয়ে আরো কত ইন্টারেস্টিং কাজ করা যায় এরা জানে না!”

টাকা দিয়ে আরো কি ইন্টারেস্টিং কাজ করা যায় জিজ্ঞেস করতে গিয়ে আমি থেমে গেলাম, আমিও সেটা জানি না মনে করে ভদ্রলোক যদি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকান তখন সেটা খুব লজ্জার ব্যাপার হবে।

ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় বললেন, “পার্থিব জিনিসে এরা এমনভাবে ফেঁসে যায় চিন্তা করতে পারবেন না। পুরো জীবনটাতেও সবকিছু শেষ হয় না মরে যাবার পরও বাকি থাকে। তখন ভূত হয়ে বাসায় থেকে যায়, একঘর থেকে আরেক ঘরে ঘুরে বেড়ায়। সবকিছু দেখেশুনে রাখে। কউ বাসার অযত্ন করলে তাকে যন্ত্রণা দেয়।”

আমি মানুষটাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না-কথাগুলো ঠাট্টা এবং রসিকতার কথা কিন্তু এমন গম্ভীর মুখে বলছে যেন ব্যাপারটা আসলেই বিশ্বাস করেন। আমি হেসে বললাম, “আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে ভূত কী করে আপনি ভালো করে জানেন।”

ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বললেন, “জানি।”

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, “জানেন?”

“হ্যাঁ। আমি এরকম একটা বাড়িতে ছিলাম। ভূত ছিল সেই বাড়িতে। আমার একেবারে ফাস্টহ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স আছে।”

আমি চোখ বড় বড় করে মানুষটার দিকে তাকালাম, বলে কী মানুষটা? জিজ্ঞেস করলাম, “কবে হয়েছিল এক্সপেরিয়েন্স।”

“বছর পাঁচেক আগে। প্যাসাডিনা, ক্যালিফোরনিয়ায়।”

আমি মুখ হাঁ করে বললাম, “আপনার পান খাওয়ার অভ্যাস হয়েছে সুইডেনে, ভূত দেখার এক্সপেরিয়েন্স ক্যালিফোরনিয়াতে?”

ভদ্রলোক হা হা করে হেসে বললেন, “ঠিকই ধরেছেন। আমি ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তাভাত খাওয়া শিখেছি নিউ জার্সিতে। সেখানে অবিশ্যি ইলিশ বলে না, বলে শ্যাড মাছ।”

“বাংলাদেশে কী শিখেছেন?”

আমাদের কাছে দাঁড়িয়ে ছোট একটা দল ইংরেজি এবং ইংরেজি উচ্চারণে বাংলায় কথা বলছে, ভদ্রলোক তাদের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “মনে হয় ইংরেজিতে কথা বলা শিখে যাব!”

তারপর খুব মারাত্মক একটা রসিকতা করে ফেলেছেন ভাব করে এত জোরে জোরে শব্দ করে হেসে উঠলেন যে আশেপাশে যারা ছিল তাদের অনেকে ঘুরে আমাদের দিকে তাকাল।

আমি হাসি থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করে জিজ্ঞেস করলাম, “ আপনি সত্যিই প্যাসাডিনা শহরে ভূত দেখেছেন?”

“ভূত বলেন, ভৌতিক ব্যাপার বলেন, অলৌকিক ঘটনা বলেন–কিছু একটা দেখেছি।”

আমি কিছুক্ষণ ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললাম, “কীভাবে দেখেছেন, বলবেন আমাকে?”

“শুনতে চাইলে বলব না কেন? অবশ্যই বলব।”

“শুনতে চাই।”

“শোনেন তাহলে।”

তারপর ভদ্রলোক যে ঘটনাটা বললেন সেটা এরকম :

আমি সদ্য পিএইচডি শেষ করেছি, গ্র্যাজুয়েট স্কুলে থাকতে থাকতেই বিয়ে করেছিলাম, এখন দুই বছরের একটা বাচ্চাও আছে। এরকম সময়ে ক্যালটেক থেকে একটা পোস্ট ডক্টরাল কাজের অফার পেলাম। এত বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান খুব আগ্রহ নিয়ে চলে এসেছি। গ্র্যাজুয়েট স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা সাধারণত হতদরিদ্র হয়, সংসারের পুরো জিনিসপত্র মোটামুটি গাড়িতেই এঁটে যায়, একটা ইউ হল ভাড়া করে সংসারের সব জিনিস নিয়ে প্যাসাডিনা চলে এসেছি। প্রথম কয়েকদিন থাকার জন্যে ব্যবস্থা করা হয়েছে এর মাঝে নিজের বাসা খুঁজে নিতে হবে।

অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজতে গিয়ে একটা সমস্যায় পড়েছি, দুই বছরের বাচ্চা আছে শুনে কেউ আর অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া দিতে চায় বাইরে লেখা থাকে “পোষা কুকুর বেড়াল রাখা যাবে না” খোঁজ নিয়ে জানতে পারি যে আসলে বোঝাতে চেয়েছে ছোট বাচ্চা কিংবা কুকুর বেড়াল রাখা যাবে না। সত্য কথা বলতে কী ছোট বাচ্চাদের পোষা কুকুর বেড়াল থেকেও খারাপভাবে দেখা হয়। টাকা-পয়সাও তেমন নেই যে ভালো জায়গায় ভালো অ্যাপার্টমেন্ট নেব। বাসা খুঁজে মোটামুটি হতাশ হয়ে গেছি, তখন এক অ্যাপার্টমেন্টের ম্যানেজারের সাথে দেখা হলো, সে বারান্দায় একটা জীর্ণ চেয়ারে বসে চুরুট টানছে এবং কাশছে। তার কাছে থাকার মতো অ্যাপার্টমেন্ট আছে কীনা জানতে চাইলেই মাথা নাড়ল, বলল, “নাই।” আমি চলে আসছিলাম তখন সে পেছন থেকে ডাকল, বলল, “কী করো তুমি?”

“ক্যালটেকে জয়েন করেছি। পোস্ট ডক করব।”

বুড়ো ম্যানেজার চুরুট সরিয়ে বলল, “নতুন এসেছ বোঝাই যাচ্ছে। এখানে প্রথমেই বলতে হয় যে তুমি ক্যালটেকে আছ। মানুষ তখন তোমাকে অন্যভাবে দেখবে। কেউ জানতে না চাইলেও নিজে থেকে বলবে। বুঝেছ?”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “এখন তাহলে বলো, আছে অ্যাপার্টমেন্ট? আমি আমার স্ত্রী আর দুই বছরের বাচ্চা। বাচ্চাটা খুব শান্ত গ্যারান্টি দিচ্ছি চিৎকার করবে না।”

ম্যানেজার হা হা করে হেসে বলল, “না অ্যাপার্টমেন্ট নাই। তবে—”

“তবে?”

“একটা ছোট বাসা আছে।’

বাসার কথা শুনে আমি একটু মুষড়ে পড়লাম, এক-দেড় বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করতে পারি কিন্তু বাসাভাড়া করার ক্ষমতা কোথায়? ম্যানেজারকে অবিশ্যি বেশ উৎসাহী দেখা গেল, বলল, “তোমার দুই বছরের বাচ্চা আছে, তোমার জন্যে পারফেক্ট আমি আমতা আমতা করে বললাম, কিন্তু ভাড়া দেবো কোত্থেকে?”

ম্যানেজার মাথা নিচু করে ষড়যন্ত্রীর মতো বলল, “ভাড়া নিয়ে চিন্তা করো না, অ্যাপার্টমেন্টের সমানই হবে! বাসাটা পুরনো, ছোট—”

“কোথায় বাসাটা?”

“এই তো অ্যাপার্টমেন্টের পাশেই। আসো তোমাকে দেখাই–“

আমি ম্যানেজারের সাথে বের হয়ে এলাম। দুই পাশে দুটো বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স, তার ঠিক মাঝখানে হঠাৎ খানিকটা জায়গায় রীতিমতো জঙ্গল। ম্যানেজারের পিছু পিছু জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে গিয়ে দেখি জঙ্গলের মাঝখানে। খানিকটা খোলা জায়গা, সেখানে ছোট একটা বাসা, ভূতের সিনেমাতে পোড়োবাড়ি হিসেবে যে রকম বাড়ি দেখায় হুবহু সেরকম! এখানে যে একটা বাসা আছে বাইরে থেকে সেটা বোঝার কোনো উপায় নেই। ম্যানেজার কোমরে ঝোলানো চাবির গোছা থেকে চাবি বের করে তালা খুলে আমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। বাইরে এটাকে পোড়োবাড়ি হিসেবে মনে করতে কারো যদি অল্প কিছু সন্দেহও থাকে ভেতরে এলেই সেই সন্দেহ পুরোপুরি দূর হয়ে যাবে। বাসার ভেতরে থমথমে একটা ভাব, চারপাশে এত গাছ যে দিনের বেলাতেও আবছা অন্ধকার, ভেতরে পুরনো জীর্ণ ফার্নিচার, দাঁড়িয়ে থাকলে মনে হয় এক্ষুনি কাঁচক্যাচ শব্দ করে সামনের দরজাটা খুলে যাবে আর শুকনো চিমসে হয়ে যাওয়া একটা নরকংকাল হি হি করে হাসতে হাসতে মাথা বের করবে।

ম্যানেজার চোখ-মুখ উজ্জ্বল করে বলল, “কী হলো? পছন্দ হয়েছে?”

আমি চিঁ চিঁ করে বললাম, “ভাড়াটা?”

“ভাড়া নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। প্যাসাডিনার মতো শহরে অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া দিয়ে একটা আস্ত বাসা পেয়ে যাচ্ছ সেটা কী সোজা কথা?”

কাজেই আমি আমার স্ত্রী-পুত্র নিয়ে এই পোড়োবাড়িতে চলে এলাম। আমার স্ত্রী শিরীন অবিশ্যি বাসা দেখে খুব খুশি। দুই বছরের বাচ্চাকে নিয়ে অ্যাপার্টমেন্টে থাকা খুব যন্ত্রণা, বাচ্চা একটা চিৎকার দিলেই আশেপাশের সব অ্যাপার্টমেন্টের সবাই দেয়ালে থাবা দিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে, কাজেই সব সময় সতর্ক থাকতে হয়। এ বাসায় আমার বাচ্চা জিশান যত ইচ্ছে চিৎকার করতে পারবে কেউ কিছু জানতেও পারবে না। সত্যি কথা বলতে কী কেউ এসে যদি আমাদের পুরো পরিবারকে খুন করে চলে যায় তাহলেও কেউ কিছু জানতে পারবে না। আমার স্ত্রী শিরীন কোমরে শাড়ি পেঁচিয়ে ঘর-দোর পরিষ্কার করতে লাগল, আমি কার্ডবোর্ডের বাক্স খুলে জিনিসপত্র বের করতে লাগলাম এবং আমার ছেলে জিশান মহানন্দে বাসায় ছোটাছুটি করতে শুরু করল।

সারাদিন খাটাখাটুনি করে আমরা শেষ পর্যন্ত যখন শুতে গিয়েছি তখন রাত একটা বেজে গেছে। কাজকর্ম করে দুজনেই খুব ক্লান্ত, শোয়ামাত্র ঘুমে কাদা হয়ে গেলাম। গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল, শুয়ে শুয়ে শুনতে পেলাম শিরীন বেডরুমের দরজা খুলে বের হয়েছে। তার পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম, সে বাথরুমে ঢুকে বাথরুমের দরজা বন্ধ করছে। ঘুম ঘুম চোখে অপেক্ষা করতে লাগলাম যে সে বাথরুম থেকে ফিরে আসবে কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে গেল সে বের হয়ে আসে না, ব্যাপারটা কী দেখার জন্যে আমি বিছানায় শুয়ে তাকে ডাকলাম, “শিরীন।”

আমার স্ত্রী শিরীন বিছানায় আমার পাশ থেকে ঘুম ঘুম স্বরে বলল, “কী হলো? চিৎকার করছ কেন?”

আমি একেবারে লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসলাম, একটু আগে তাহলে কে বেডরুমের দরজা খুলে বাথরুমে গেছে? আমি ভয়ে ভয়ে বিছানা থেকে উঠে বাথরুমে গেলাম, কেউ কোথাও নেই! শিরীন ঘুম ঘুম চোখে বলল, “কী হয়েছে?”

আমি বললাম, “না, কিছু না।”

সে রাতে আমি আর ভালো করে ঘুমাতে পারলাম না। শেষ রাতের দিকে আবার আমার ঘুম ভেঙে গেল, আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম কে একজন বাইরের ঘর থেকে হেঁটে রান্নাঘরে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসল। আমি জানি শিরীন আমার পাশে শুয়ে আছে এবং আমাদের দুজনের মাঝখানে আমাদের ছেলে জিশান, এই বাসায় আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ নেই এবং কোনোভাবেই কারো পক্ষে রান্নাঘরে চেয়ার টেনে বসা সম্ভব না। উঠে গিয়ে দেখার সাহস নেই, আমি নিঃশব্দে সিটিয়ে বিছানায় শুয়ে রইলাম। সকালে আমাকে দেখে শিরীন আঁতকে উঠল, বলল, “সে কী তোমার এ কী চেহারা হয়েছে? রাত্রে ঘুমাও নি?”

“আমি আমতা আমতা করে বললাম, “না, মানে নতুন জায়গা তো–”

পরের রাতেও ঠিক একই ব্যাপার। গভীর রাতে হঠাৎ শুনতে পেলাম কেউ একজন বসার ঘরে বইয়ের শেলফ কিংবা চেয়ার টানাটানি করছে। আমি এবারে শিরীনকে ডেকে তুললাম, শিরীন ঘুম ঘুম চোখে বলল, “কী হয়েছে?”

আমি ফিসফিস করে বললাম, ‘বাইরের ঘরে কী যেন শব্দ শুনলাম।”

“গিয়ে দেখে এসো–”

আমি লজ্জার মাথা খেয়ে বললাম, “যেতে ভয় করছে।”

শিরীন বিছানায় উঠে বসে বলল, “ঠিক আছে, আমি দেখে আসছি।” সে উঠে বেশ স্বাভাবিকভাবেই সব ঘর দেখে এসে বলল, “কোথাও কেউ নেই। তোমার মনের ভুল।”

“আমি স্পষ্ট শুনলাম–”

“ভুল শুনেছ। এখন ঘুমাও।”

আমি চিঁ চিঁ করে বললাম, “লাইটটা জ্বালিয়ে রাখবে?”

কাজেই সারারাত আমরা লাইট জ্বালিয়ে ঘুমালাম।

শিরীন প্রথম প্রথম আমার কথা বিশ্বাস করেনি কিন্তু একসময় সেও স্বীকার করল এ বাসায় মাঝে মাঝে বিচিত্র ব্যাপার ঘটে। ব্যাপারটা ঘটল জিশানকে নিয়ে, সে মাত্র কথা বলতে শুরু করেছে। এবং হঠাৎ করে শিরীন একদিন শুনতে পেল একা ঘরে সে হেসে কুটি কুটি হচ্ছে, কী দেখে সে হাসছে দেখার জন্যে সে সেই ঘরে। গিয়ে দেখে কিছু নেই, জিশান শিরীনকে দেখে তার ভাঙা ভাঙা আধো উচ্চারণে বলল, “আম্মু দেখো–”

শিরীন জিজ্ঞেস করল, “কী দেখব?”

জিশান হাত দিয়ে সামনে অদৃশ্য কিছু দেখিয়ে বলল, “এই যে–” তারপর হঠাৎ আবার হি হি করে হাসতে শুরু করল।

শিরীন একটু ভয় পেয়ে ছুটে গিয়ে জিশানকে কোলে নিয়ে। সরে গেল। আমি বাসায় এসে দেখি শিরীন শুকনো মুখে বসে আছে। সবকিছু শুনে আমি বললাম, “আমি তোমাকে আগেই বলেছি, তুমি আমার কথা বিশ্বাস করো নি।”

শিরীন বলল, “এই বাসায় থাকব না, তুমি অন্য বাসা দেখো।”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “ঠিক আছে।”

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো আমরা কীভাবে কীভাবে জানি পুরো ব্যাপারটায় অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায় আমরা শুনতে পাই কেউ একজন হাঁটছে, দরজা খুলছে এবং দরজা বন্ধ করছে। মাঝে মাঝেই জিশান অদৃশ্য কাউকে দেখে হেসে কুটি কুটি হয়। কী দেখে সে হাসে আমরা বুঝতে পারি না, কিন্তু ব্যাপারটা নিশ্চয়ই মজার কারণ জিশান প্রায়ই বলে, “আবার-আবার–”

সেই অদৃশ্য মূর্তি বা মানুষ জিশানের কথা শুনে আবার কিছু একটা করে এবং জিশান আবার হেসে কুটি কুটি হয়। প্রথম প্রথম আমরা ভয় পেতাম আজকাল আর ভয় লাগে না। আমাদের কোনো ক্ষতি করে না, ভয় দেখায় না, জিশান মনে হয় পছন্দই করে, আমরাও বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছি।

বাসাভাড়ার চেক দিতে গিয়ে ম্যানেজারের সাথে দেখা হলো, সে চুরুট টানছে এবং কাশছে, আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার বাসায় সবকিছু ঠিক আছে?”

“ঠিক আছে।”

“ভেরি গুড।”

আমি চলে যেতে যেতে থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “ আচ্ছা, আমরা আসার আগে এখানে কে থাকতো?”

ম্যানেজার ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি শুনলে বিশ্বাস করবে না, কমপক্ষে তিনজন এই বাসাটা ভাড়া করেছে, কউ এক সপ্তাহের বেশি থাকে নি।”

“কেন?”

“জানি না। রাত্রিবেলা নাকি ভয় পায়। সব সাইকোলজিক্যাল কেস। মদগাঞ্জা ড্রাগস খেলে কী কেউ নরমাল থাকে! তুমি তো ছোট একটা বাচ্চা নিয়ে থাকো-তুমি কী ভয় পাও?”

আমি ঢোঁক গিলে বললাম, “না ভয় পাই না।”

“তাহলে?”

আমি কথার উত্তর দেবার আগেই হঠাৎ করে ম্যানেজারের বাসার ভেতর থেকে ক্রুদ্ধ গালাগালির শব্দ শুনতে পেলাম, নারীকণ্ঠে কউ কিছু একটা বলল, “তখন মনে হলো কেউ একজন কাউকে আঘাত করল, ম্যানেজার ভেতরে ছুটে যাচ্ছিল তার আগেই একুশ-বাইশ বছরের নিষ্ঠুর চেহারার একটা মানুষ বের হয়ে এলো। মানুষটার ময়লা সোনালি চুল, নীল চোখ, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখের দৃষ্টি ভয়ংকর, চোখের নিচে কালি, গায়ে একটা ময়লা টি শার্ট এবং তার থেকেও ময়লা একটা জিন্স। মানুষটার পিছু পিছু ম্যানেজারের বুড়ো স্ত্রী বের হয়ে এলো, ঠোঁটের কাছে কেটে রক্ত বের হচ্ছে। ম্যানেজার ভয়ংকর রেগে চিৎকার করে বলল, “ডেভিড! তোমার এত বড় সাহস? তোমার মায়ের গায়ে তুমি হাত তুলেছ?”

ডেভিড নামের মানুষটা অত্যন্ত কুৎসিত একটা পালি দিয়ে বলল, “ওই বুড়ি আমার মা তোমাকে কে বলেছে?”

“তুমি কী বলতে চাও?”

“আমাকে একশ ডলার দাও আমি চলে যাচ্ছি।”

“একশ ডলার কেন, তোমাকে আমি একশ পেনিও দেব না–”

ম্যানেজারের কথা শেষ হবার আগেই মানুষটা ম্যানেজারকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে তার ডেস্কের ড্রয়ারটা খুলে হাতড়াতে থাকে, কাগজপত্র চেক বের করে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়ে নেওয়ার মতো কোনো কিছু না পেয়ে মানুষটা আবার ভয়ংকর কুৎসিত একটা গালি দিয়ে ডেস্কটাতে একটা লাথি মেরে বসে। বৃদ্ধ ম্যানেজার চিৎকার করে বলল, “ডেভিড। তুমি এই মুহূর্তে এখান থেকে বের হও। না হয় আমি পুলিশকে ডাকব।”

ডেভিড মুখ ভ্যাংচে বলল, “তোমার পুলিশের ভয়ে আমি মরে যাচ্ছি। নিজের ছেলেকে পুলিশে দিতে তোমার লজ্জা লাগে না?”

ম্যানেজার হিংস্র মুখে বলল, “তুমি আমার ছেলে না। আমি তোমার মুখ দেখতে চাই না। দূর হও তুমি–”

ম্যানেজারের বৃদ্ধ স্ত্রী মুখ ঢেকে হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। গোলমাল শুনে আমার মতো আরো অনেকে তখন ভিড় জমিয়েছে, ডেভিড আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে আবার একটা কুৎসিত গালি দিয়ে লাথি দিয়ে দরজা খুলে বের হয়ে গেল। আমি দেখলাম বিড়বিড় করে গালি দিতে দিতে ডেভিড রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। ম্যানেজার তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, “সোনা, তোমার বেশি ব্যথা লেগেছে? হাসপাতালে নিতে হবে?”

স্ত্রী মাথা নেড়ে ব্যস্ত হয়ে বলল, “না-না–হাসপাতালে নিতে হবে না।”

অ্যাপার্টমেন্টের যেসব বোর্ডার দাঁড়িয়েছিল তাদের একজন বলল, “তোমার ছেলের চিকিৎসা না করালে কিন্তু অবস্থা আরো খারাপ হবে।”

ম্যানেজার দুর্বল গলায় বলল, “জানি। কিন্তু রাজি করাতে পারি না।”

“ড্রাগ এডিক্ট নিজে থেকে রাজি হয় না। জোর করতে হয়।”

ম্যানেজার শুকনো গলায় বলল, “এই ছেলে এখন খুব ভয়ংকর হয়ে গেছে। ড্রাগের টাকার জন্যে এখন সে খুন-জখম করে ফেলবে।”

ম্যানেজারের স্ত্রী আবার হাউমাউ করে কেঁদে বলল, “আমার ছেলেটা কেমন করে ড্রাগ খাওয়া শিখে গেল? কেমন করে শিখল?” আমরা মোটামুটি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম।

দেখতে দেখতে ক্যালটেকের জীবনে আমরা বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেলাম, গ্রীষ্মের শুরুতে এসেছিলাম, গ্রীষ্ম শেষ হয়ে শরৎ এসেছে, শরৎও শেষ হতে যাচ্ছে। প্যাসাডিনা ক্যালিফোরনিয়ার দক্ষিণে, মরুভূমির কাছে, খুব চমৎকার আবহাওয়া, শীতকাল আসছে কিন্তু সেরকম ঠাণ্ডা নেই। অক্টোবরের একত্রিশ তারিখ ওই দেশে হলউইনের রাত্রি বলা হয়ে থাকে-সব মৃত আত্মা সেদিন পৃথিবীতে ফিরে আসে। ব্যাপারটা অবিশ্যি যেটুকু ভৌতিক তার থেকে অনেক বেশি ফুর্তির। সব বাচ্চা-কাচ্চা ভূত সেজে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়, সবাইকে সেদিন চকোলেট লজেন্স দেবার কথা। সন্ধ্যেবেলা মজা দেখার জন্যে আমরা বাসা থেকে বের হয়েছি, ফিরে এসেছি বেশ রাত্রে। দরজা খুলে ঢোকার সাথে সাথে শুনতে পেলাম বাসার ভেতরে কিছু একটা শব্দ হচ্ছে। ঘরে ঢুকে হতবাক হয়ে গেলাম, জিশানের জন্যে একটা ছোট খেলনা ট্রেন কিনেছিলাম, সেটা বসার ঘরে সাজিয়ে রেখে গিয়েছি, সেটা নিজে থেকেই চুচু শব্দ করে চলছে। শুধু তাই নয়, ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা বই খুলে কেউ সাজিয়ে রেখেছে। হাতে নিয়ে দেখি একটা ভৌতিক গল্পের সংকলন, আমাদের বসার ঘরে শেলফে রাখা ছিল। আমি শিরীনের দিকে তাকালাম, শিরীন আমার দিকে তাকাল-হলউইনের রাতে আমাদের বাসার অদৃশ্য অধিবাসী আমাদের সাথে একটু কৌতুক করেছে!

আমরা আমাদের বাসার অদৃশ্য অধিবাসীর সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেলেও আমাদের বাসায় যে সব অতিথি আসততা তারা কিন্তু মোটেও এতে অভ্যস্ত হতো না। একবার শিরীনের এক দূরসম্পর্কের ভাই বেড়াতে এলেন, প্যাসাডিনা শহর লস এঞ্জেলসের কাছে, এই এলাকায় এলে সবাই লস এঞ্জেলস শহরে ডিজনিল্যান্ড দেখে যায়, কাজেই এই ভদ্রলোককেও আমাদের ডিজনিল্যান্ড দেখিয়ে আনতে হলো। অনেক রাত্রে ফিরে এসে শুয়েছি। গভীর রাতে ভয়ংকর আর্তচিৎকার শুনে আমরা লাফিয়ে উঠলাম। ছুটে বাইরের ঘরে গিয়ে দেখি ভদ্রলোক দুই হাত দুই পা ভাজ করে বিছানায় বসে থরথর করে কাঁপছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?”

প্রথমে ভদ্রলোক কথাই বলতে পারেন না, মুখে পানির ঝাঁপটা দিয়ে তাকে ধাতস্থ করতে হলো। একটু শান্ত হয়ে বললেন, রাত্রে হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেছে তখন শুনতে পেলেন কেউ যেন দরজা খুলে হাঁটছে, তারপর চেয়ার টানার শব্দ শুনতে পেলেন। প্রথমে ভেবেছিলেন আমরা কেউ, তাই বেশি গা করেন নি। তারপর শুনতে পেলেন গায়ের শব্দ তার ঘর পর্যন্ত এসেছে, তখন তিনি হঠাৎ চোখ খুলে তাকালেন। তাকাতেই দেখেন মাটি থেকে একেবারে ঘরের ছাদ পর্যন্ত একটা মূর্তি তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো ছোট ছোট লাল আগুনের মতো জ্বলছে। সেটি দেখেই তিনি এরকম ভয়ংকর চিৎকার দিয়েছেন। আমরা সাথে সাথে ব্যাপারটা বুঝে গেছি কিন্তু এই রাতে তাকে সেটা বলা ঠিক হবে বলে মনে হলো না। কোনো রকমে একটু সাহস দিয়ে তাকে ধাতস্থ করলাম। ভদ্রলোক আর ঘুমালেন না, সারারাত জেগে বসে রইলেন এবং সকাল হতেই তার ব্যাগ-স্যুটকেস নিয়ে একটা হোটেলে চলে গেলেন। যাবার আগে বলে গেলেন আমরা যেন এখনই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাই। এটা মানুষের বাসা নয় এটা পিশাচের বাসা।

শুধু যে এই ভদ্রলোকের বেলায় একরম হলো তা নয়, যারাই আমাদের বাসায় আসততা তারাই ভয় পেতো। আমাদের দূরসম্পর্কের এক ভাবী একটা কনফারেন্সে এসে আমাদের বাসায় রাত কাটাতে এসেছেন। গভীর রাতে পানি খাবার জন্যে রান্নাঘরে গিয়ে দেখেন সেখানে চেয়ারে একজন মানুষ বসে আছে, মাথার অর্ধেক কীভাবে থেঁতলে গেছে সারা মুখ রক্তে মাখামাখি। ভাবী তখন রক্ত শীতল করা যা একটা চিৎকার দিলেন তার কোনো তুলনা নেই। আমার আরেক বন্ধু বাসায় বেড়াতে এসেও সেই একই অবস্থা, গভীর রাতে বাথরুমে গিয়ে দেখে বাথটাবে গুটিশুটি মেরে একজন শুয়ে আছে, মুখের অর্ধেকপুড়ে ঝলসে গিয়ে একটা চোখ বের হয়ে গেছে! তাদের কেউ-ই এক রাতের বেশি থাকতে পারেনি–এবং আমরা কীভাবে দিনের পর দিন এই বাসায় আছি সেটা নিয়ে বিস্ময় এবং আতঙ্ক প্রকাশ করে গেছে।

আমরা কিন্তু কখনোই ভয়ের কিছু দেখি নি জিশান মাঝেমধ্যে কিছু একটা দেখতে পায় বলে টের পাই, কিন্তু তার সাথে এই অশরীরী প্রাণীর এক ধরনের বন্ধুত্ব হয়ে আছে। ব্যাপারটা একদিন খুব স্পষ্টভাবে বোঝা গেল।

আমি সেদিন ক্যালটেকে কাজ করছি, নতুন যে ক্সপেরিমেন্টটা দাঁড় করিয়েছি তার ইলেকট্রনিক্সটা পরীক্ষা করা হচ্ছে, তখন টেলিফোন বাজল। টেলিফোন করেছে শিরীন, হিস্টিরিয়াগ্রস্থের মতো চিৎকার করছে। আমি ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে?”

সে কোনো কথা বলতে পারে না, শুধু চিৎকার করে কাঁদে। আমি কোনোমতে ছুটতে ছুটতে বাসায় এসেছি, এসে দেখি বাসার সামনে কয়েকটা পুলিশের গাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্স। বাসার দরজায় বেশ কয়েকজন পুলিশ, তাদের ঠেলে আমি ভেতেরে ঢুকেছি। ঘরের ভেতর সোফায় শিরীন জিশানকে কোলে নিয়ে বসে আছে। জিশান চোখ বড় বড় করে দেখছে কিন্তু শিরীন হাউমাউ করে কাঁদছে। আমাকে দেখে ছুটে এসে আমাকে ধরে আরো জোরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। আমি তখনও কিছু বুঝতে পারছি না, শিরীন আর জিশানের কিছু হয় নি এটুকু বুঝতে পেরে আপাতত জানে পানি এসেছে।

পাহাড়ের মত একজন পুলিশ আমাকে বলল, “তুমি তোমার স্ত্রীকে শান্ত করো। তাকে বলো তার কোনো ভয় নেই। সে যেটা করেছে সেল্ফ ডিফেন্সে করেছে–“

আমি অবাক হয়ে বললাম, “কি হয়েছে?”

“একজন ড্রাগ এডিক্ট আর্মস নিয়ে ঢুকেছিল তাকে এমনভাবে মেরেছে যে তার ওঠার ক্ষমতা নেই।”

আমি হতচকিত হয়ে পুলিশ অফিসারের দিকে তাকালাম। বলে কী মানুষটা! শিরীন একজনকে মেরেছে? যে একটা তেলাপোকা মারার জন্যে আমাকে অফিস থেকে ডেকে আনে? পুলিশ অফিসার বলল, “এই মানুষটার কথা আমরা জানি। তোমাদের অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের ম্যানেজারের ছেলে। নাম ডেভিড।”

আমি কয়েকবার চেষ্টা করে বললাম, “ডেভিডকে শিরীন মেরেছে?”

“তোমার স্ত্রী বলছে সে মারে নি। কিন্তু সে ছাড়া তো আর কেউ ছিল না। এমনভাবে মেরেছে যে না দেখলে বিশ্বাস করবে না—”

পুলিশ এবং অ্যাম্বুলেন্স যাবার পর এবং অনেক চেষ্টা করে শিরীনকে শান্ত করার পর আসল ঘটনা তার কাছে শুনতে পেলাম।

দুপুর দুটোর মতো বাজে। জিশান খেয়েদেয়ে এই সময়টাতে একটু ঘুমায়। শিরীন রান্নাঘরে টুকটাক কাজ শেষ করে মাত্র সোফায় বসে টেলিভিশনটার সুইচ অন করেছে তখন হঠাৎ দরজায় শব্দ হলো। শিরীন মনে করেছে আমি এসেছি, মাঝে মাঝে এরকম সময়ে হঠাৎ করে আমি খেতে চলে আসি। দরজা খুলে দেখে একুশ-বাইশ বছরের একজন মানুষ, সোনালি চুল, নীল চোখ এবং নিষ্ঠুর চেহারা। শিরীন যদিও আগে কখনো ডেভিডকে দেখে নি কিন্তু আমার কাছে এর গল্প শুনেছে কাজেই দেখেই একে চিনতে পারল এবং ভয়ে তার আত্মা শুকিয়ে গেল। শিরীন আবার দরজা বন্ধ করে ফেলতে চেয়েছিল কিন্তু ডেভিড দরজা ঠেলে শিরীনকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। শিরীন কিছু বলার আগেই দেখে ডেভিডের হাতে একটা চাকু, কোথায় চাপ দিতেই শর শর শব্দ করে চাকুর লম্বা ফলাটা বের হয়ে আসে। ডেভিড শিরীনের গলায় চাকুটা ধরে বলল, “একটা কথা বলেছ তো গলা দুই ভাগ করে দেব।”

শিরীন কোনো কথা বলল না, তার কথা বলার মতো অবস্থাও তখন নেই। ডেভিড তখন বলল, “‘টাকা-পয়সা যা আছে দাও।”

শিরীন কোনো কথা না বলে ব্যাগে যে কয়টা ডলার ছিল তার হাতে তুলে দিল। বাসায় টাকা-পয়সা বেশি থাকে না কাজেই ডেভিডের পরিমাণটা পছন্দ হলো না তখন চাকু দিয়ে গলায় খোঁচা দিয়ে কিছুক্ষণ তাকে কুৎসিৎ ভাষায় গালাগালি করল। তরপর বলল, “তোমরা ইন্ডিয়ানরা অনেক সোনার গয়না পর। তোমার গয়না দাও।”

শিরীন এমনিতেই খুব নিরীহ শান্তশিষ্ট মেয়ে, এ ধরনের ঘটনা দেখা দূরে থাকুক, এর আগে কেউ কখনো তার সাথে গলা উঁচু করে কথা বলে নি। সে একেবারেই ভেঙে পড়ল, হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তার কাছে কোনো গয়না নেই। আসলেই শিরীনের শাড়ি-গয়নার শখ নেই, তার কাছে এসব কিছু নেই।

ডেভিড তার কথা বিশ্বাস করল না, তখন তার চুল ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তাকে নিচে ফেলে দিল। সেই শব্দে জিশানের ঘুম ভেঙে গেল, এবং দুই বছরের বাচ্চার এরকম সময়ে যা করার কথা তাই করল সে জেগে উঠে তারস্বরে চিৎকার করতে শুরু করল।

ডেভিড তখন কেমন জানি খেপে যায়, সে জিশানকে তুলে তার গলায় চাকুটা ধরে শিরীনকে হিংস্র গলায় বলল, “এই মুহূর্তে তোমার যত গয়না আছে দাও, তা না হলে তোমার ছেলের গলা আমি দুভাগ করে দেব।”

ভয়ে শিরীন তখন অপ্রকৃতিস্থের মতো হয়ে গেছে, হাত জোড় করে কাতর গলায় চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেছে। ভয়ে তার মাথা ঠিক নেই সম্ভবত জিশানকে বাঁচানোর জন্যে ডেভিডকে গিয়ে খামচে ধরে ফেলেছে, হঠাৎ সে একটা বিচিত্র দৃশ্য দেখতে পায়। সে দেখে বাসার ছাদ পর্যন্ত লম্বা একটা মানুষ। তার মাথার একটা পাশ থেঁতলে গেছে, মুখের একটা অংশ পোড়া এবং একটা চোখ বের হয়ে আছে। মানুষটা নিঃশব্দে ডেভিডের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে বলে ডেভিড তাকে দেখতে পায় নি। মানুষটা ডেভিডের চুল ধরে তাকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে পেছনে নিয়ে এলো, ডেভিড পড়ে যেতে যেতে কোনোমতো নিজেকে সামলে নেয়-হাত থেকে জিশান পড়ে যাচ্ছিল, শিরীন ছুটে গিয়ে তাকে ধরে ফেলল।

ডেভিড অবাক হয়ে পেছনে তাকাল, তখন সেই ছাদ সমান উঁচু থেঁতলে যাওয়া মুখের মানুষটা তার হাত ওপরে তুলে প্রচণ্ড জোরে ডেভিডের মুখে মারল। কট করে শব্দ করে ডেভিডের ঘাড় ঘুরে যায়, একটা দাঁত ভেঙে তার মুখ থেকে রক্ত বের হয়ে আসে। হাঁটু ভেঙে সে কাটা কলাগাছের মতো নিচে পড়ে গেল। মূর্তিটা তখন আরেকটু এগিয়ে আসে তারপর ডেভিড়কে গায়ের জোরে একটা লাথি মারে, ডেভিডের পুরো শরীরটা তখন প্রায় উড়ে গিয়ে বইয়ের শেলফে লাগল, পুরো শেলফসহ ডেভিড আছাড় খেয়ে পড়ল। শিরীন এরপরে আর থাকার সাহস পায় নি, ভয়ে চিৎকার করতে করতে করতে জিশানকে বুকে চেপে ঘর থেকে বের হয়ে এসেছে। ছুটে বের হতে হতে সে শুনতে পেল মূর্তিটা ডেভিডকে আবার একটা লাথি মেরে ঘরের অন্য দেওয়ালে নিয়ে ফেলেছে।

শিরীনের চিৎকার আর কান্না শুনে অন্যেরা ছুটে এসে পুলিশ আর অ্যাম্বুলেন্সে খবর দিয়েছে। ডেভিডকে যখন উদ্ধার করা হয়েছে তখন তার মুখের ওপরের পাটির সামনের দুইটা দাঁত ভেঙে গেছে। নাকের হাড় ভেঙে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। পাঁজরের হাড়ও ভেঙেছে বেশ কয়েকটা, একটা ভেঙে ফুসফুসে ঢুকে মারাত্মক অবস্থা করে ফেলেছে। লোকটা যে বেঁচে গিয়েছিল সেটাই তার বড় সৌভাগ্য।

গল্পের এই পর্যায়ে ভদ্রলোক থামলেন, পকেট থেকে পানের বাটা বের করে পান-সুপুরি দিয়ে যত্ন করে একটা পানের খিলি তৈরি করে মুখে দিয়ে বললেন, “পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম এই বাসার মালিক ভূমিকম্পের সময় মারা গিয়েছিল। ফায়ারপ্লেসের সামনে বসেছিল, চিমনি ভেঙে তার ওপরে পড়ে মাথাটা থেঁতলে গেল। সেই থেকে এই বাসাতেই আছে, বাসা পাহারা দিচ্ছে!”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “খুব ইন্টারেস্টিং গল্প!”

ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে বললেন, “ আমার গল্প বিশ্বাস হলো না? দাঁড়ান তাহলে আমার বউকে ডাকি-আপনি নিজে জিজ্ঞেস করে দেখেন।

এরকম সময়ে দেখতে পেলাম বাসার মালিক আমাদের দিকে আসছেন, আমাকে দেখে বললেন, “তুমি এখানে? তোমাকে আমি সারা বাসায় খুঁজে বেড়াচ্ছি। তোমাকে বাসাটা দেখানো হয় নি এসো আমার সাথে।”

আমার যে বাসাটা দেখার খুব সখ ছিল তা নয়, কিন্তু উঠে তার সাথে যেতে হলো। বাসার মালিক হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “এত বড় বাসা দেখে রাখাই মুশকিল। আমার কী মনে হয় জানো?”

“কী”?

“বেঁচে থাকতে তো এই বাসা দেখে রাখতেই হচ্ছে, মরে গেলেও আমাকে এই বাসা দেখে রাখতে হবে!”

আমি হঠাৎ পানখাওয়া ভদ্রলোকের উচ্চস্বরে হাসির শব্দ শুনতে পেলাম।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *