ভীতু নিরঞ্জন
নিরঞ্জন পাল কখনোই খুব সাহসী মানুষ ছিল না কিন্তু গত এক সপ্তাহ থেকে সে বাড়াবাড়ি ভীতু হয়ে গেছে। দিনের বেলা সে ঘর থেকে বের হয় না, জবুথবু হয়ে বিছানায় বসে থাকে। অন্ধকার হয়ে গেলে সে মাঝে মাঝে ঘর থেকে বের হয় কিন্তু বেশি দূরে যেতে সাহস পায় না, ঘরের আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করে। তার বাড়িটি গ্রামের এক কোনায়, এমনিতেই খানিকটা নির্জন, মানুষজন বলতে গেলে আসে না। হঠাৎ করে কেউ চলে এলে তাদের আওয়াজ শুনেই ভয়ে ছুটে এসে সে ঘরের ভেতর ঢুকে যায়, তারা চলে না। যাওয়া পর্যন্ত সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে।
ব্যাপারটা ঘটেছে বলতে গেলে হঠাৎ করেই। বুধবার রাত্রিবেলা খাওয়া-দাওয়া শেষ করে থালা-বাসন ধুয়ে সে মাত্র বিছানায় শুয়েছে, এরকম সময় কে যেন দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল, “নিরঞ্জন, ঘুমালি নাকি?”
নিরঞ্জন দরজা খুলে দেখে ঘরের দরজায় কাশেম আলী দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটার মোষের মতো চেহারা দেখলেই কেমন জানি ভয় করে, রাত্রিবেলা ঘরের সামনে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিরঞ্জনের কেমন জানি আত্মা শুকিয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে বলল, “কাশেম ভাই! আপনি?”
কাশেম আলী নাক দিয়ে এক ধরনের শব্দ করল, “হুঁ।”
“এত রাত্রে। কী ব্যাপার কাশেম ভাই?”
কাশেম আলী সময় নিয়ে একটা বিড়ি ধরিয়ে নিরঞ্জনের মুখের ওপর ধোঁয়া ছেড়ে বলল, দিনের বেলা এত ব্যস্ত থাকি সময় পাওয়া যায় নাকি!”
নিরঞ্জন জোর করে মুখে হাসি টেনে বলল, “সেটা তো ঠিকই বলেছেন, আপনার মতো ব্যস্ত আর কে আছে এই গ্রামে?”
কাশেম আলী কথা না বলে বিড়িতে লম্বা একটা টান দিল, বিড়ির লাল আগুনে তার মুখটাকে কেমন জানি ভয়ংকর দেখায়, নিরঞ্জনের বুকটা অজানা এক ধরনের আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে। ভয়টাকে লুকিয়ে রেখে সে ঢোঁক গিলে বলল, “ভেতরে আসেন কাশেম ভাই, বসেন।” না।
“নাহ! বসব না।” কাশেম আলী একটু কেশে উঠোনে সশব্দে থুথু ফেলে বলল, “তোর কাছে একটা কাজে এসেছি রে নিরঞ্জন।”
“কী কাজ কাশেম ভাই?”
“আমি ভাবছিলাম তুই নিজেই বলবি–তুই যখন নিজে থেকে কিছু বলছিস না, আমারই তো বলতে হয়।”
নিরঞ্জন অবাক হয়ে বলল, “কী বলব কাশেম ভাই?”
“তোর এই জায়গাজমি তো তোর বাবা আমারে লিখে দিয়ে গেছে।”
নিরঞ্জন হতবাক হয়ে কাশেম আলীর দিকে তাকিয়ে রইল, কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, “এটা আপনি কী বলছেন?”
কাশেম আলী বিড়িতে টান দিয়ে বলল, “কেন? ভুল কিছু বলেছি? তোর বাবা তোকে কিছু বলে যায় নাই?”।
“না কাশেম ভাই! বাবা এরকম কথা কেন বলবে?”
কাশেম আলী খুব বিরক্ত হবার ভান করে দাঁতের ফাঁক দিয়ে পিচিক করে থুথু ফেলে বলল, “এই জন্যে মালাউনের জাতকে বিশ্বাস করতে হয় না। ইন্ডিয়া যাবার আগে আমার কাছে গিয়ে বলল, বাবা কাশেম আমি তো স্ত্রী-পুত্র নিয়ে ইন্ডিয়া যাব, কিছু ক্যাশ টাকা প্রয়োজন।”
“তাই বললেন বাবা?”
“হ্যাঁ। আমি বললাম কাকা আমার তো টাকার ফ্যাক্টরি নাই যে টাকা ছাপাব আর দিব। আপনার জমিজিরাত আছে বেচেন। হুন্ডি করে টাকা নিয়ে যান।”
নিরঞ্জন এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে কাশেম আলীর দিকে তাকিয়ে রইল, হঠাৎ করে মনে হতে থাকে তার হাঁটুতে কোন জোর নেই। কাশেম আলী বিড়িতে একটা টান দিয়ে বলল, “তখন তোর বাবা আমার সাথে জমি রেজিস্ট্রি করল। যাবার আগে আমার হাত ধরে বলল, বাবা আমার বোকা ছেলেটাকে তোমার কাছে রেখে গেলাম। তুমি দেখেশুনে রেখো-”
নিরঞ্জন কিছু একটা বলার চেষ্টা করল কিন্তু কাশেম আলী সুযোগ দিল না, বগলের তলায় চুলকাতে চুলকাতে বলল, “তোর বাপরে আমি কথা দিয়েছিলাম তাই তোরে কয়দিন থাকতে দিয়েছি। এখন তো আর পারি না। সামনে চেয়ারম্যান ইলেকশন, কিছু ক্যাশ টাকার দরকার।”
নিরঞ্জন শুকনো গলায় বলল, “ক্যাশ টাকা?”
“হ্যাঁ। ভাবছি জমিটা বেচব। তোর তো এখন উঠে যেতে হয়। নিরঞ্জন।”
‘উঠে যাব? আমি?” নিরঞ্জন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না।
“হ্যাঁ।” কাশেম আলী নিরঞ্জনের মুখের দিকে তাকিয়ে পান খাওয়া দাঁত বের করে হাসল, সেই হাসি দেখে নিরঞ্জনের বুকের ভেতরে কাঁপুনি শুরু হয়ে যায়।
নিরঞ্জনের মাথা ঘুরতে থাকে, ঘরের দরজা ধরে কোনো মতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, “আপনি নিশ্চয়ই কিছু একটা ভুল করছেন কাশেম ভাই। বাবা এই বসতবাড়ি বেচে নাই। আমার কাছে দলিল আছে।”
কাশেম আলী হঠাৎ হুঙ্কার দিয়ে বলল, “কী বললি হামারজাদা? তোর কাছে দলিল আছে?”
“আছে কাশম ভাই।”
“তুই বলতে চাস আমি মিছা কথা বলছি?
নিরঞ্জন আমতা আমতা করে বলল, “তা বলছি না কাশেম ভাই-আপনি রাগ হবেন না। মনে হয় কিছু একটা ভুল হয়েছে।”
“ভুল?” কাশেম আলী নিরঞ্জনের ঘাড়ে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, “তোর বাপ আমার কাছ থেকে টাকা নেওয়ার সময় তো কোনো ভুল করল না।”
নিরঞ্জন কী বলবে বুঝতে পারল না, চোখ বড় বড় করে কাশেম আলীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কাশেম আলী রাগে ফোঁস ফোঁস করে বলল, “বিরইপুরের পীর সাহেব ঠিকই বলেন।”
নিরঞ্জন দুর্বল গলায় বলল, “কী বলেন পীর সাহেব?”
“বলেন সব মালাউনকে জবাই করে ফেলা দরকার। হারামজাদার বাচ্চা।”
নিরঞ্জন শুকনো গলায় বলল, “আমার ওপর রাগ হন কেন কাশেম ভাই? আমি কী বলেছি?
কাশেম আলী হুঙ্কার দিয়ে বলল, “‘কিছু বলিস নাই তুই?” নিরঞ্জন মাথা নাড়ল, বলল, “বলি নাই।”
“বলিস নাই আমি মিছা কথা বলছি? বলিস নাই আমি মিথ্যুক?”
“না তা বলি নাই। আমি বলেছি–”
নিরঞ্জনের মুখের কথাটা লুফে নিয়ে কাশেম আলী বলল, “ আমি যদি সত্যি কথা বলে থাকি তাহলে বের হ।”
“বের হব?”
“হ্যাঁ। বাড়ি ছেড়ে দে।”
নিরঞ্জন অবিশ্বাসের গলায় বলল, “বাড়ি ছেড়ে দেব?”
“হ্যাঁ। তোদের জাতকে বিশ্বাস নাই। তোরা থাকিস এই দেশে আর তোরা ইন্ডিয়াকে মনে করিস নিজের দেশ–”
“কী বলছেন আপনি কাশেম ভাই? রায়টের সময় ছোট বোনটারে ধরে নিয়ে গেল তাই ভয় পেয়ে বাবা-কাকা ইন্ডিয়া গেছে। আমাকে যেতে বলেছে আমি যাই নাই। এইটা আমার দেশ কাশেম ভাই। এই দেশ ছেড়ে আমি যাই নাই। আমি কখনো যাব না।”
“তোর বাপে গেছে তুইও যাবি ব্যাটা মালাউন।”
নিরঞ্জনের চোখে পানি এসে গেল, ভাঙা গলায় বলল, “না, কাশেম ভাই।”
কাশেম আলী হুঙ্কার দিয়ে বলল, “হ্যাঁ।” তারপর হঠাৎ করে নিরঞ্জনের চুলের মুঠি ধরে তাকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বের করে এনে ধাক্কা দিয়ে উঠোনে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে বলল, “আর ইন্ডিয়া যখন চলেই যাবি, এখনি যা।”
নিরঞ্জন হতবাক হয়ে কাশেম আলীর দিকে তাকিয়ে রইল, সে এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না যে এরকম একটা ব্যাপার ঘটছে। তার অপমানিত বোধ করার কথা ছিল কিন্তু সে অপমানিত বোধ করছে না, হঠাৎ করে তার নিজের ভেতরে অন্যরকম একটা অনুভূতি এসে ভর করতে শুরু করেছে, সেই অনুভূতিটি হচ্ছে ভয়। ভয়ংকর ভয়। সে বিস্ফারিত চোখে দেখল কাশেম আলী তার দিকে এগিয়ে আসছে, কাছে এসে প্রচণ্ড শক্তিতে পাঁজরে একটা লাথি দিতেই নিরঞ্জনের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। মাটি খামচে ধরে সে কোনোভাবে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল কিন্তু পারল না, তার আগেই কাশেম আলী তার মুখে আবার লাথি মেরে নিচে ফেলে দিয়েছে। নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হয়ে আসে নিরঞ্জনের, মুখে রক্তের নোনা স্বাদ পেল, মনে হয় একটা দাঁত ভেঙে গেছে। নিরঞ্জনের ভেতরে যন্ত্রণার কোনো অনুভূতি নেই, শুধু এক ধরনের জান্তব ভয়-অমানুষিক ভয়।
নিরঞ্জন ঘরের বারান্দা ধরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল তার আগেই কাশেম আলী তার চুল ধরে তাকে টেনে দাঁড় করিয়েছে। খোলা চোখে সে দেখতে পেলো কাশেম আলী তার মুখের কাছে মুখ এনে হিংস্র গলায় বলছে, “বল মালাঊনের বাচ্চা-যাবি ইন্ডিয়ায়?”
নিরঞ্জন মাথা নাড়ল, বলল, “না”।
সাথে সাথে প্রচণ্ড ঘুষিতে তাকে নিচে ফেলে দিল কাশেম আলী, তারপর টেনে তুলে বলল, “ইন্ডিয়া যাবি না তুই? ঠিক আছে হারামজাদা-তোর ইন্ডিয়া যেতে হবে না। তোর যেখানে যাওয়া। দরকার সেখানেই আমি পাঠাব।”
নিরঞ্জন হঠাৎ করে দেখতে পেল কাশেম আলীর হাতে চকচকে ধারালো একটা চাকু আবছা অন্ধকারে চিকচিক করছে। হঠাৎ করে বুঝে গেল সে কাশেম আলী তাকে খুন করতে এসেছে। বেঁচে থাকার একেবারে আদিম প্রবৃত্তিতে সে কোনোমতে উঠে দাঁড়াল তারপর দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করল। বেশিদূর যেতে পারল না তার আগেই পেছন থেকে তাকে খপ করে ধরে ফেলেছে কাশেম আলী। পিঠে যন্ত্রণার একটা তীক্ষ্ণ খোঁচা অনুভব করল সে, বাঁকা হয়ে উল্টে পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু কাশেম আলী তাকে টেনেহিঁচড়ে কুয়ার কাছে নিয়ে এসেছে, কুয়ার মুখে তার মাথাটা ঠেলে ধরে বলল, “ইন্ডিয়া যাবি না তুই? তাহলে যা, জাহান্নামে যা!”
নিরঞ্জন আর্তনাদ করে উঠে কাতর গলায় বলল, “না, না, না!”
কাশেম আলী হিংস্র দানবের মতো হা হা করে হাসতে হাসতে নিরঞ্জনের হালকা দেহটা তুলে নেয় তারপর কুয়ার গভীরে কালো পানির মাঝে ছুঁড়ে দেয়। নিরঞ্জনের দেহটা মৃদু একটা শব্দ করে কালো পানিতে ডুবে গেল।
শীতল কালো পানিতে ডুবে যেতে যেতে নিরঞ্জন হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেল, পানি হাতড়ে হাতড়ে সে কোনোমতে উপরে ভেসে ওঠে। কুয়ার ভেতরের খয়ে যাওয়া ইট ধরে সে বিশ্রাম নেয়, প্রচণ্ড আতঙ্কে তার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। সে কতক্ষণ সেভাবে বসে ছিল জানে না, যখন মনে হলো কাশেম আলী চলে গেছে তখন সে কুয়ার ইট ধরে ধরে উপরে উঠে এলো। তার মনে হয়েছিল কাশেম আলী পিঠে চাকু বসিয়ে দিয়েছে-কিন্তু সেরকম কিছু নেই। নাক-মুখ রক্তে ভেসে গিয়েছিল, কুয়ার পানিতে ধুয়েমুছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। পুরো শরীরটা কেমন জানি অসাড় হয়ে আছে। নিরঞ্জন কোনোমতে টলতে টলতে ঘরের ভেতরে এসে ঢোকে। সারা ঘর তছনছ হয়ে আছে-নিশ্চয়ই কাশেম আলী করেছে। মনে হয় দলিলটা খুঁজেছে-কিন্তু নিরঞ্জন জানে সে কখনোই খুঁজে পাবে না। একটা কৌটার মাঝে ঢুকিয়ে সে তার চালের সাথে বেঁধে রেখেছে-না জানা থাকলে কেউ কোনোদিন সেটা খুঁজে পাবে না।
নিরঞ্জন তার ঘরের চারপাশে তাকাল, তারপর টলতে টলতে কোনোমতে বিছানার কাছে গিয়ে উপুড় হয়ে পড়ল।
তার ঘুম হলো ছাড়া ছাড়া, কেমন যেন দুঃস্বপ্নের মতো। মাঝে মাঝেই সে চমকে চমকে জেগে উঠছিল, মনে হচ্ছিল আবার বুঝি কাশেম আলী তাকে খুন করতে আসছে, কিন্তু সে চোখ খুলে দেখেছে কেউ নেই। সে একা তার ঘরে শুয়ে আছে, দরজা খোলা, তার মাঝ দিয়ে উথালপাথাল বাতাস ঘরে এসে হাহাকার করছে।
সেই থেকে নিরঞ্জন কেমন জানি অন্যরকম হয়ে গেল, তার ভেতরে কেমন জানি একটা ভয় এসে দানা বেঁধেছে, মানুষ নিয়ে ভয়, দিনের আলো নিয়ে ভয়, কাশেম আলী নিয়ে ভয়। শুধু যে ভয় তাই নয়, সে মানুষটাই জানি কেমন অন্যরকম হয়ে গেছে, মনে হয় পৃথিবীর কোনো কিছুতেই তার যেন আর কিছু আসে যায় না। তার নড়তে চড়তে ইচ্ছে করে না, বাইরে যেতে ইচ্ছে করে না। সে দিনরাত তার বিছানার ওপর জবুথবু হয়ে বসে থাকে। অকারণে তার কেমন জানি মন খারাপ হয়ে থাকে। বিচিত্র সব স্বপ্ন দেখে, মাঝে মাঝে তার এমন হয়েছে যে কোনটা স্বপ্ন আর কোনটা সত্যি, সে বুঝতে পারে না! নিরঞ্জনের মাঝে মাঝে ভয় হয়, মনে হয় সে বুঝি পাগল হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে তার ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে।
এভাবে কয়দিন গেছে সে জানে না। এর মাঝে সে একদিনও ঘর থেকে বের হয়ে বেশিদূর যায়নি, একজন মানুষের সাথেও দেখা হয়নি। তাদের গ্রামের রইস উদ্দিনের সাথে একদিন দেখা হয়েছিল, অন্ধকার ছিল বলে রইস উদ্দিন মনে হয় তাকে চিনতে পারেনি, একেবারে কাছে দিয়ে হেঁটে গেল তাকে কিছু বলল না!
নিরঞ্জন অবিশ্যি সেজন্যে কিছু মনে করে নাই, তার মনটা আজকাল অন্যরকম হয়ে গেছে, দুঃখ, রাগ বা আনন্দ কিছুই হয় না। সব সময় তার ভেতরে এক রকম চাপা ভয়। শুধু মনে হয় কাশেম আলী বুঝি আবার এসে হাজির হয়। সেদিন তাকে খুন করতে চেয়েছিল, পারেনি, আবার যদি দেখা হয়। তাহলে কী তাকে ছেড়ে দিবে? ভয়ে সারাক্ষণ নিরঞ্জনের বুক ধকধক করতে থাকে।
সত্যি সত্যি নিরঞ্জনের সন্দেহ একদিন সত্যি হয়ে গেল। সেই রাতে আকাশে খুব বড় একটা চাঁদ উঠেছে, জ্যোৎস্নার আলোয় চারিদিকে কেমন জানি একটা মায়াবী ভাব। তার উঠোনে বাঁশঝাড়ের এক ধরনের ছায়া পড়েছে, বারান্দার এককোণে পা ঝুলিয়ে নিরঞ্জন বসে আছে তার মাঝে হঠাৎ করে কাশেম আলী পা টিপে টিপে হাজির হলো। নিরঞ্জন ভয়ে একেবারে পাথর হয়ে গেল, তার অমানুষিক এক ধরনের ইচ্ছে করল এক দৌড়ে পালিয়ে যেতে কিন্তু সে পালাতে পারল না। কাশেম আলী অবিশ্যি তাকে দেখতে পেল না-এদিক-সেদিক তাকিয়ে সে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল। নিরঞ্জন নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনতে পেল কাশেম আলী তার ঘরে সবকিছু তছনছ করে দলিল খুঁজছে। বালিশের নিচে তার সিন্দুকের চাবি পেয়ে গেল, নিরঞ্জন শুনতে পেল কাশেম আলী সিন্দুকের তালাটা খুলে তার ডালাটা টেনে তুলেছে। এতদিনের পুরনো সিন্দুক ডালা খোলার সময় সেটা কাঁচ কাঁচ শব্দ করে উঠল। কাশেম আলী একটা হারিকেন নিয়ে এসেছে, সিন্দুকের ভেতরে সেটা নামিয়ে দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে খুঁজছে।
সিন্দুকের ভেতরে তার বাবার রাজ্যের কাগজপত্র, উঁইয়ে খেয়ে ফেলেছে, এর ভেতরে কাশেম আলী আর কোনোদিন তার দলিল খুঁজে পাবে না। কিন্তু কাশেম আলী তো সেটা জানে না। ভালো করে খোঁজার জন্যে কাশেম আলী তার মোষের মতো শরীর নিয়ে শেষ পর্যন্ত সিন্দুকের ভেতরেই ঢুকে যায়। কাগজ ঘাঁটাঘাঁটি করতে থাকে, বেদরকারি কাগজগুলো ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে থাকে।
ঠিক এরকম সময় নিরঞ্জনের একটা কথা মনে হলো-সে যদি সাবধানে গিয়ে সিন্দুকের ডালাটা ফেলে দেয় তাহলেই তো কাশেম আলী সিন্দুকের ভেতর আটকা পড়ে যাবে-মানুষটার একটা উচিত শিক্ষা হবে তাহলে! সিন্দুকের ভেতর আটকে ফেলে সে যদি রইস উদ্দিন আর আরও দশজন গণ্যমান্য মানুষকে ডেকে এনে নালিশ করে তাহলে কেমন হয়? কাশেম আলী মানুষটা যত বড় গুণ্ডাই হোক তার নিজের বাড়িতে নিজের সিন্দুকের মাঝে আটকে ফেলতে পারলে কেউ আর তার কথার অবিশ্বাস করবে না। কেউ তো আর খোশগল্প করার জন্যে সিন্দুকে ঢুকে না।
নিরঞ্জন আজকাল খুব ভীতু হয়ে গেছে, তারপরেও সে খুব সাহসে ভর করে এগিয়ে গেল। সিন্দুকের কাছাকাছি যেতেই ভয়ে তার বুক ধকধক করতে থাকে, একবার মনে হলো সে ছুটে পালিয়ে যাবে, কিন্তু অনেক কষ্ট করে সে পালিয়ে গেল না। পা টিপে টিপে সিন্দুকের কাছে গিয়ে সে যেই ডালাটাতে হাত দিয়েছে সাথে সাথে কাশেম আলী চমকে উঠে নিরঞ্জনের দিকে তাকাল, ভয়ে নিরঞ্জন একেবারে পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল! নিরঞ্জনকে দেখে কাশেম আলী নিশ্চয়ই এখন ভয়ংকর খেপে চিৎকার করে উঠবে, লাফ দিয়ে সিন্দুক থেকে বের হয়ে তাকে ধরে ফেলবে, তারপর সে নিশ্চয়ই তাকে খুন করে ফেলবে। কিন্তু কী আশ্চর্য কাশেম আলী কিছুই করল না! হঠাৎ করে নিরঞ্জন বুঝতে পারল আসলে কাশেম আলী তাকে দেখতে পায়নি। সিন্দুকের ভেতরে বসে আছে, হারিকেনের আলো চোখে লাগছে তাই বাইরে কী আছে নিশ্চয়ই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে না। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে কাশেম আলী আবার মাথা নিচু করে সিন্দুকের ভেতরের কাগজগুলো ঘাঁটতে শুরু করে দেয়।
নিরঞ্জন এবারে ডালাটি টান দিয়ে নিচে ফেলে দিল। শব্দ করে ডালাটি বন্ধ হতেই ভেতরে কাশেম আলী ভয়ানক চমকে উঠে ডালাটি ওপরের দিকে ঠেলে ধরে, কাশেম আলী ভয় পেয়েছে, ডালাটি বন্ধ হতে দিচ্ছে না। নিরঞ্জন প্রাণপণে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ডালাটি নিচে ঠেসে ধরে, কাশেম আলীও তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সিন্দুকের ডালাটা খুলে রাখার চেষ্টা করতে থাকে। মানুষটার গায়ে মোষের মতো জোর, নিরঞ্জনের মনে হলো সে বুঝি আর পারবে না, কিন্তু হঠাৎ তখন একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটল। নিরঞ্জনের মনে হলো প্রচণ্ড পরিশ্রমে হঠাৎ তার শরীরে কিছু একটা হয়ে গেল এবং ঠিক সেই মুহূর্তে কাশেম আলীও যেন তাকে প্রথমবারের মতো দেখতে পেল। নিরঞ্জন ভেবেছিল তাকে দেখে রেগে যাবে, কিন্তু কাশেম আলী রাগল না, সে অসম্ভব ভয় পেয়ে গেল। অমানুষিক এক ধরনের ভয়, নিরঞ্জন এর আগে কখনো কোনো মানুষকে এত ভয় পেতে দেখেনি–কাশেম আলীর মুখ রক্তশূন্য হয়ে যায়, মুখ হাঁ হয়ে যায় এবং দেখে মনে হয় সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কাশেম আলী থরথর করে কাঁপতে থাকে, বিস্ফারিত চোখে নিরঞ্জনের দিকে তাকিয়ে অমানুষিক একটা আর্তনাদ করে উঠল তারপর হঠাৎ করে ধড়াম করে সিন্দুকের ভেতরে পড়ে গেল। কাশেম আলীর পায়ের সাথে লেগে হারিকেনটা উল্টে পড়ে, কেরোসিন ছড়িয়ে পড়ে মুহূর্তের মাঝে ভেতরে আগুন ধরে যায়। কাশেম আলী সেই জ্বলন্ত আগুনের মাঝে নিজের বুক চেপে ধরে বিকৃত মুখ করে গোঙানোর মতো শব্দ করতে থাকে। দেখে মনে হয় ভয় পেয়ে মানুষটা বুঝি মরে যাচ্ছে।
নিরঞ্জন আর দেরি করল না সিন্দুকের ডালাটা টেনে নামিয়ে দিয়ে ঘটাং করে আংটা দিয়ে আটকে দিল, কাশেম আলী আর বের হতে পারবে না। ভেতরে আটকা পড়ে কাশেম আলী ছটফট করছে, সিন্দুকের দেয়ালে মাথা ঠুকছে। ভেতরে কাগজপত্রে নিশ্চয়ই ভালোভাবেই আগুন লেগে গেছে, কারণ সিন্দুকের ফাঁক দিয়ে কালো ধোঁয়া বের হতে শুরু করেছে, সেই ধোঁয়ায় বিকট পোড়া মাংসের গন্ধ, নিরঞ্জনের নাড়ি উল্টে আসতে চাইল।
নিরঞ্জন চুপ করে সিন্দুকের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে, শুনতে পায় ভেতরে কাশেম আলী দাপাদাপি করছে, গোঙানোর মতো শব্দ করে ছটফট করছে, কিন্তু নিরঞ্জনের তার জন্যে একটুও মায়া হলো না। আশেম আলী মানুষ নয়, সে একটি দানব। এই দানবটা তাকে খুন করে কুয়ার ভেতরে ফেলে দিতে চেয়েছিল-একটুর জন্যে সে বেঁচে এসেছে-আরেকটু হলে সে তো মরেই যেত।
নিরঞ্জন সিন্দুকের কাছে দাঁড়িয়ে অল্প অল্প কাঁপতে থাকে, ভেতরে কাশেম আলীর দাপাদাপি এবং গোঙানোর মতো শব্দটা খুব বেড়েছে, হঠাৎ করে দড়াম করে ভেতরে একটা প্রচণ্ড শব্দ হলো, মনে হলো কাশেম আলী গায়ের জোরে সিন্দুকের ভেতরে একটা লাথি মেরেছে। তারপর হঠাৎ করে দাপাদাপি এবং গোঙানোর শব্দ থেমে গেল। নিরঞ্জন তখন একটু ভয় পেয়ে যায়, মানুষটা কী মরেই গেল নাকি?
সে চাপা গলায় ডাকল, “কাশেম ভাই।”
কোনো উত্তর নেই। নিরঞ্জন তখন আরেকটু জোরে ডাকল, “কাশেম ভাই–”
এবারেও কোনো উত্তর নেই। নিরঞ্জন ভয় পেয়ে সিন্দুকটা খুলতে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ করে থেমে গেল-সিন্দুকের ফাঁক দিয়ে কুচকুচে কালো ধোঁয়ার মতো কিছু একটা বের হচ্ছে। নিরঞ্জন হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে এবং বিস্ফারিত চোখে দেখতে পায় জিনিসটা একটা মানুষের মতো রূপ নিচ্ছে। ঘরের ভেতরে আবছা অন্ধকার কিন্তু তার ভেতরেও মানুষটাকে চিনতে নিরঞ্জনের অসুবিধে হলো না-মানুষটি কাশেম আলী! কাশেম আলীর মূর্তিটা টলতে টলতে কয়েক পা এগিয়ে যায়, মনে হয় ঠিক বুঝতে পারছে না, চারপাশে কী হচ্ছে!
নিরঞ্জন আতঙ্কে চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল অনেক কষ্ট করে নিজেকে সামলে নেয়। সে হতচকিত হয়ে কাশেম আলীর দিকে তাকিয়ে থাকে-তাকে আর মানুষ বলে মনে হচ্ছে না, চোখ দুটো কোটরে ঢুকে গেছে, মুখ খোলা সেখান থেকে লালা ঝরছে, হাত দুটো লম্বা, শরীর থেকে ঝুলছে, দেখে কেমন যেন এক ধরনের পশুর মতো মনে হয়। কাশেম আলীর মূর্তিটা টলতে টলতে ঘর থেকে বের হলো, বাইরে জ্যোৎস্নায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে জন্তুর মতো এক ধরনের শব্দ করে। হঠাৎ করে উঠোনের পাশে বাঁশঝাড় নড়ে উঠল, সেখানে কেমন যেন হুটোপুটি শুরু হয়ে যায়। কাশেম আলী সেদিকে তাকাল, তারপর দুই হাত এবং দুই পায়ে ভর দিয়ে সেই অন্ধকারের দিকে ছুটে যেতে থাকে। বাঁশঝাড়ের নিচে হঠাৎ করে বিচিত্র এক ধরনের চিৎকার-চেঁচামেচি শোনা যায়-বাঁশঝাড় নড়তে থাকে এবং কয়েকটা রাত-জাগা পাখি ভয় পাওয়া গলায় ডাকতে ডাকতে রাতের আকাশে উড়ে যায়। যেভাবে হঠাৎ করে একটা হুটোপুটি শুরু হয়েছিল ঠিক সেভাবে হঠাৎ করেই সেটা আবার থেমে গেল-চারপাশে একধরনের সুনসান নীরবতা-একটু আগে এখানে কিছু একটা গোলমাল হয়েছিল বোঝার কোনো উপায় নেই।
নিরঞ্জন কয়েক মুহূর্ত বাইরের জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলল, সে ভয়ে কুলকুল করে ঘামছে। খুব কষ্ট করে সে সাহস সঞ্চয় করে সিন্দুকটা খুলল, ডালাটা টেনে তুলতেই ভক করে তার নাকে একটা পোড়া গন্ধ এসে লাগল। নাক বন্ধ করে নিরঞ্জন ভেতরে তাকাল, সিন্দুকের ভেতরে কাশেম আলীর নিথর শরীরটা পড়ে আছে-মুখ বিকৃত, চোখ দুটোতে ভয়ংকর অমানুষিক এক ধরনের আতঙ্ক। একটু আগে সে তাহলে কাকে হেঁটে যেতে দেখেছে? কাশেম আলীর প্রেতাত্মা?
নিরঞ্জন অমানুষিক এক ধরনের আতঙ্কে ঘর থেকে বের হয়ে আসে! ভয়ে চিৎকার করে ছুটে যাওয়ার একটা অদম্য ইচ্ছে করছিল-অনেক কষ্ট করে সে নিজেকে শান্ত করল। তাকে এখন খুব ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে হবে-সে একটা মানুষকে খুন করে ফেলেছে। মানুষটা একজন ভয়ংকর মানুষ, কিন্তু তাই বলে তাকে খুন করে ফেলার তো তার কোনো অধিকার নেই। কিন্তু সে ইচ্ছে করে খুন করে নাই-তাকে সে সিন্দুকে আটকে ফেলে দশজনকে দেখাতে চেয়েছিল, খুন করতে চায় নাই। নিরঞ্জনের মাথাটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়-সে কী করবে বুঝতে পারে না। নিরঞ্জন আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে তার বারান্দায় এসে বসল, পুরো ব্যাপারটা একটু ভালো করে ভেবে দেখা দরকার।
নিরঞ্জন অবিশ্যি ভেবে কিছু বের করতে পারল না। সত্যি কথা বলতে কী সে ঠিক করে কিছু ভাবতেও পারছিল না। ব্যাপারটা সে আগেও লক্ষ করেছে আজকাল সে কোনো কিছু আর ঠিক করে ভাবতে পারে না। সবকিছুই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়। সব সময়েই বুকের ভেতরে একধরনের চাপা আতঙ্ক কাজ করে। সবচেয়ে ভালো হয় সে যদি তার পড়শি রইস উদ্দিনের কাছে সবকিছু খুলে বলে, রইস উদ্দিনের মাথাটি খুব পরিষ্কার এরকম অবস্থায় কী করতে হবে তাকে ভালো করে বলে দিতে পারবে।
নিরঞ্জন হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ করে থমকে গেল–কেমন যেন একটা পচা গন্ধ। সে আরও দুপা এগিয়ে যেতেই গন্ধটা হঠাৎ কেমন যেন তীব্র হয়ে উঠল, বিকট দুর্গন্ধে হঠাৎ তার গা গুলিয়ে আসে। নিরঞ্জন এদিক-সেদিক তাকায়–কাছেই কুয়া–গন্ধটা কী কুয়ার ভেতর থেকে আসছে? কয়েকদিন আগে কাশেম আলী তাকে এই কুয়ার ভেতরে ফেলে দিয়েছিল, কপাল জোরে বেঁচে ফিরে এসেছে। গন্ধটা কোথা থেকে আসছে খুঁজতে গিয়ে নিরঞ্জন কুয়াটার কাছে এগিয়ে যায়, চাঁদটা এখন ঠিক মাথার ওপরে, কুয়ার ভেতরে চাঁদের আলো এসে পড়েছে। নিরঞ্জন কুয়ার ভেতরে উঁকি দিতেই ভক করে বিকট তীব্র একটা মাংস পচা গন্ধে তার নাড়ি উল্টে আসতে চায়। নিরঞ্জন নাক চেপে রেখে নিচে তাকাল, নিচে কালো পানিতে একটা মানুষের শরীর ভাসছে। শরীরটা কতদিন থেকে এখানে আছে কে জানে, পচে ফুলে উঠেছে।
ভয়ংকর আতঙ্কে নিরঞ্জন থরথর করে কেঁপে ওঠে। সে মানুষটা মুখের দিকে তাকায়, পচে ফুলে উঠেছে তবুও মানুষটাকে সে চিনেত পেরেছে।
মানুষটি নিরঞ্জন। নিরঞ্জন ভয়ংকর আতঙ্কে তার নিজের মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে থাকে।