নিশিকন্যা : জালালের বাস ভ্রমণ
রেস্টুরেন্টে খাবারের বিল দিয়ে যখন জালাল বের হয়ে এলো তখন তার মুখ দিয়ে রীতিমতো আগুনের হলকা বের হচ্ছে। খাবার যা ঝাল ছিল সেটি আর বলার মতো নয়। বাস রেলস্টেশনের ধারেকাছে যে রেস্টুরেন্টগুলো থাকে সেখানে মনে হয় ইচ্ছে করেই এরকম করে, রেস্টুরেন্টের মালিক জানে যারা খেতে এসেছে তারা প্রায় সবাই দূরপাল্লার যাত্রী, আর কখনোই এখানে দ্বিতীয়বার খেতে ফিরে আসবে না, শুধু শুধু তাদের খুশি রাখার চেষ্টা করে লাভ কী?
জালাল রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে পাশের ছোট পান-সিগারেটের দোকানে গেল।
এক খিলি মিষ্টিপান আর একটা সিগারেট নিয়ে সে পাশে রাখা বেঞ্চটাতে বসে পড়ে। তার বাস ছাড়তে দেরি আছে, বসে বসে খানিকক্ষণ সময় কাটাতে পারবে।
রাতের বাসগুলো একটা একটা করে ছেড়ে দিচ্ছে, বাস স্টেশনে বেশ শোরগোল। রিকশা, স্কুটার করে প্যাসেঞ্জাররা আসা মাত্রই দালালেরা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। সাদাসিধে টাইপের প্যাসেঞ্জার হলে তো কথাই নেই, তাদের ধরে রীতিমতো টানাটানি শুরু হয়ে যায়। বাসের শরীরে থাবা দিয়ে হেল্পাররা চিৎকার করছে, বাসের হর্ন, প্যাসেঞ্জারদের চেঁচামেচি, ফেরিওয়ালারা তাদের জিনিস বিক্রি করার চেষ্টা করছে-সব মিলিয়ে এই রাতেও এখানে রীতিমতো হইচই না। জালাল সিগারেট টানতে টানতে মানুষজনের হই-হল্লা দেখতে থাকে। তার বাস ছাড়বে রাত এগারোটায়, বাড়ি পৌঁছাবে কাল ভোরে। বহুদিন বাড়ি যাওয়া হয় নি, ভেতরে ভেতরে সে একধরনের তাড়া অনুভব করে।
বেঞ্চে তার পাশে একজন বুড়ো লোক এসে বসল, মাথায় লম্বা সাদা চুল, মুখে সাদ দাড়ি। বেঞ্চে পা তুলে বসে মানুষটা একটা বিড়ি ধরিয়ে জালালের দিকে তাকিয়ে বলল, “নিশানা ভালো না।”
“কীসের নিশানা ভালো না?”
“নাইট কোচের।”
জালাল একটু ভালো করে মানুষটার দিকে তাকাল, চেহারায় একটু পাগল-পাগল ভাব, মুখে বয়সের চিহ্ন, পরনে ময়লা একটা খাকি শার্ট, সেখানে রং-বেরঙের কয়েকটা তালি। পা তুলে যেভাবে বসেছে মানুষ সাধারণত সেভাবে বসে না। জালাল জিজ্ঞেস করল, “নাইট কোচের কোন নিশানা খারাপ?”
“আজ এসকিডেন্ট হবে।”
শব্দটা এক্সিডেন্ট কিন্তু আধপাগল ধরনের মানুষটির কথার জন্যে এই শুদ্ধ উচ্চারণটা তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। মানুষটার কথা শুনে জালালের বুকের ভেতর কেমন জানি ঘঁৎ করে ওঠে, এরকম একটা অপয়া কথা কেন বলছে? জালাল ভুরু কুঁচকে বলল, “ আপনি কেমন করে জানেন এক্সিডেন্ট হবে?”
“মরণ্যা আসছে দেখেন না?”
মরণ্যা?”
“হ্যাঁ।”
“সেইটা কে?”
বুড়ো মানুষটা বিড়িতে টান দিয়ে বলল, “যে রাতে এসকিডেন্ট হয় সেই রাতে আসে। ঘুরে ঘুরে দেখে, কোন বাস এসকিডেন্ট করবে সেটা ঠিকঠাক করে।”
জালাল অবাক হয়ে বলল, “কোন বাস এক্সিডেন্ট হবে সেটা আগে থেকে ঠিক করে?”
“মরণ্যার আর কাম কী? এসকিডেন্ট করে মানুষ মারা হচ্ছে মরণ্যার কাম।” খুব একটা মজার কথা বলেছে সেরকম ভান করে বুড়োটা খিকখিক করে হাসল।
জালাল মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলল, “আজকে মরণ্যা এসেছে?”
“হ্যাঁ।”
“কোথায়?”
বুড়ো মানুষটা হাত তুলে বাস স্টেশনে অসংখ্য মানুষের ভিড়ের দিকে দেখিয়ে বলল, “ঐখানে।”
“আপনি দেখতে পাচ্ছেন?”
বুড়োটা চোখ কুঁচকে ভিড়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “নাহ্। এখন দেখা যাচ্ছে না। একটু আগে দেখেছিলাম।”
“দেখতে কী রকম?”
ছোট বাচ্চারা না বুঝে কোনো কথা বললে বড় মানুষেরা যেভাবে তাদের দিকে তাকায় বুড়োটা সেভাবে তার দিকে তাকাল। বলল, “মরণ্যার চেহারা যে দেখে সে সেইটা বর্ণনা করার জন্যে আর ফেরত আসে না। শুনছি তার চক্ষু দুইটা কয়লার আগুনের মতোন। যার দিকে সেই চক্ষু দিয়া তাকায় সে ফিনিশ।”
আধপাগল মানুষ, কী বলতে কী বলছে তার কথার গুরুত্ব দেওয়া ঠিক নয় তবু জালালের ভেতরে একটা অস্বস্তি এসে ভর করে। সে মানুষটাকে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে মরণ্যাকে চিনেন কেমন করে?”
“পোশাক দিয়া চেনা যায়। কালো কাপড় পরে, পা থেকে মাথা পর্যন্ত। অনেক সময় মাথায় একটা লাল কাপড় বান্ধে। সাথে একটা ঝোলা থাকে। কাপড়ের ঝোলা। দেখলেই বোঝা যায়। কাছে গেলে আপনে একটা গোন্ধ পাইবেন।”
“গন্ধ?”
“জে।”
“কী রকম গন্ধ।”
“কর্পূরের গোন্ধের মতোন কিন্তু তার সাথে পচা মাংসের একটা গোন্ধ থাকে। কশাইয়ের দোকানে যে রকম গোন্ধ হয় সেরকম গোন্ধ।”
জালাল এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে বুড়ো মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষটা সেটা লক্ষ করল বলে মনে হলো না, অনেকটা নিজের মনে কথা বলে যেতে লাগল, “যদি তারপরেও মরণ্যারে নিয়া আপনার সন্দেহ থাকে তারে ছুঁলেই সন্দেহ দূর হয়ে যাবে।”
“কেন?”
“মরণ্যার শরীর বরফের মতো ঠাণ্ডা।”
“ঠাণ্ডা?”
“জে।”
“কেন?”
“ধরেন জীবিত মানুষের শরীরে ওম থাকে। মরণ্যা তো আর জীবিত না। তার শরীরে কুনো ওম নাই।”
জালাল ভুরু কুচঁকে বলল, “মরণ্যা তাহলে কী?”
“রাত্রেবেলা তার নাম নেওয়া ঠিক না।”
বুড়ো মানুষটা হঠাৎ করে সোজা হয়ে বসে উত্তেজিতভাবে হাত তুলে দেখাল, “ঐ যে ঐ যে-ঐ দেখেন মরণ্যা!”
“কোথায়?”
“গেইট লকের পিছনে-ঐ দেখেন চাকায় হাত দিচ্ছে-খাইছে রে খাইছে! ইয়া মাবুদ। আইজকে খবর আছে!”
জালাল বাসগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পেল না। জিজ্ঞেস করল, “কোনজন মরণ্যা?”
“ঐ যে এখন হাঁটতাছে। বাসের পিছনে গেল–”
অনেক মানুষই হাঁটছে, বাসের সামনে পিছে যাচ্ছে, কোন বাসের কাছে কোন মানুষটা বোঝার কোনো উপায় নেই। জালাল উঠে দাঁড়াল, এই মানুষের পাশে বসে বসে এই ধরনের মন খারাপ করা ভয়ংকর উদ্ভট কথা শোনার কোনো প্রয়োজন নেই।
বাস ছাড়তে ছাড়তে কুড়ি মিনিটের মতো দেরি হলো। জালাল অবিশ্যি সেটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাল না, রাতের বাস এত ভোরে পৌঁছে যায় যে এক-আধঘণ্টা দেরি হলে কিছু আসে যায় না। আজকাল বাসগুলোও বেশ ভালো, উঁচু সিট, পা ছড়িয়ে দেওয়ারও জায়গা আছে। জালাল বাসের সামনের দিকে জানালার কাছে বসার জায়গা পেয়েছে। তার পাশে একজন মোটাসোটা মানুষ বসেছে, ঘুমকাতুরে মানুষ বসার কিছুক্ষণের মাঝেই নাক ডেকে ঘুমাতে শুরু করেছে। বাসের সিটে ঘুমটা হয় ছাড়া ছাড়া, তাই নাক ডাকাটা কখনোই বিরক্তিকর পর্যায়ে যেতে পারছে না, একটু পরে পরে থেমে আবার নতুন করে। জানালা দিয়ে জালাল বাইরে তাকিয়ে রইল, এখন শহরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, দুই পাশে দোকানপাট, মানুষের ভিড়। কিছুক্ষণের মাঝেই শহরের বাইরে চলে আসবে, শুক্লপক্ষের রাত জ্যোৎস্নায় বেশ দেখাবে তখন।
জালাল বাইরে তাকিয়ে রইল, এবারে বেশ অনেকদিন পর বাড়ি যাচ্ছে, ছেলেটাকে অনেকদিন দেখে না। ওষুধের কোম্পানির চাকরি, বলতে গেলে সারা বছরই ঘুরে বেড়াতে হয়। যে বেতন পায় সেটা দিয়ে শহরে বাসা ভাড়া করে বউ-বাচ্চাকে নিয়ে থাকা সম্ভব না, তাদেরকে বাড়ি রাখতে হয়। কিন্তু আলাদা আলাদা থাকাটা খুব কষ্ট-বেতনটা আর একটু বাড়লেই সে সবাইকে শহরে নিয়ে আসবে। জালাল বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।
বিচিত্র একটা গন্ধে জালালের হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। এখন গভীর রাত, বাসের সব প্যাসেঞ্জার নিজের সিটে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। জালাল এই বিচিত্র গন্ধটার কারণ বোঝার চেষ্টা করল-মাঝে মাঝে বাস একটা নির্দিষ্ট জায়গার ভেতর দিয়ে যায় তখন সেই জায়গায় গন্ধ বাসের ভেতরে ঢুকে পড়ে। কিন্তু এখন সেরকম কিছু নেই, রাস্তার দুই পাশে বিস্তৃত ধানক্ষেত, বিচিত্র কোনো গন্ধ এখানে আসার কোনে উপায় নেই।
পাশে বসে থাকা মানুষটা একটু নড়েচড়ে বসতেই হঠাৎ গন্ধটা তীব্র হয়ে উঠল, পচা মাংসের মতো বোটকা এক ধরনের গন্ধ-সাথে ঝাঁজালো অন্য এক রকম গন্ধ। মনে হলো খুব কাছে থেকে গন্ধটা আসছে। জালাল পাশে তাকাল, তার পাশে বসা ঘুমকাতুরে প্যাসেঞ্জারটি নেই সেখানে অন্য একজন বসে আছে, কালো আলখাল্লা পরা। কালো চাদর দিয়ে পুরো শরীর ঢেকে রেখেছে। চাদর দিয়ে ঢাকা বলে মানুষটির মুখ দেখা যাচ্ছে না। অন্য মানুষের মতো মানুষটি সিটে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে না, শিরদাঁড়া সোজা করে বসে আছে। মানুষটা আবার একটু নড়ে উঠতেই জালালের নাকে গন্ধটা ভক করে এসে লাগে, তার সারা শরীর হঠাৎ গুলিয়ে ওঠে, মনে হয় দুর্গন্ধে বমি হয়ে যাবে।
জালাল জানালা দিয়ে মাথাটা বাইরে বের করে দিয়ে পরিষ্কার বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করল। তখন হঠাৎ টের পেল তার পাশে বসে থাকা মানুষটা উঠে দাঁড়িয়েছে। বাসের সবাই ঘুমুচ্ছে তার মাঝে সে হেঁটে হেঁটে সামনে যেতে থাকে। বাসের ঝাঁকুনির কারণে ওপরের রড না ধরে কেউ কখনো চলন্ত বাসে হাঁটতে পারে না। কিন্তু এই মানুষটি অবলীলায় সামনে হেঁটে গেল। একেবারে সামনে গিয়ে সে বাস ড্রাইভারের পাশে দাঁড়িয়েছে, কী অদ্ভুত দেখাচ্ছে দৃশ্যটি।
হঠাৎ করে জালাল ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল, এই মানুষটি নিশ্চয়ই মরণ্যা। পান-সিগারেটের দোকানে বুড়ো মানুষটা যে বর্ণনা দিয়েছিল হুবহু তার সাথে মিলে যাচ্ছে, কালো কাপড় পরা, মাথায় একটা লাল ফেটি। যেটাকে চাদর ভেবেছিল সেটা একটা ঝোলা, তার মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু নিশ্চয়ই সেই মুখটি।
ভয়ংকর, চোখ দুটো জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো টকটকে লাল। শরীর থেকে যে দুর্গন্ধের কথা বলেছিল সেটাও সে পেয়েছে। তার পাশেই তো বসে ছিল।
বাস ড্রাইভার স্টিয়ারিং হুইল ধরে সামনে তাকিয়ে আছে, তার পাশেই মরণ্যা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, তার কোনো তাড়া নেই। ড্রাইভার হঠাৎ করে পাশে তাকাল, মরণ্যাকে দেখেই সে ভয়ানক চমকে ওঠে, স্টিয়ারিং হুইল হঠাৎ নড়ে যায়, পুরো বাসটা সাথে সাথে একবার ঝাঁকুনি দিয়ে রাস্তায় নড়ে গেল, প্যাসেঞ্জারদের কেউ কেউ চমকে জেগে উঠে আবার সিটে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেল।
জালাল দেখতে পায় বাস ড্রাইভারটা মরণ্যাকে কিছু একটা বলছে কিন্তু মরণ্য সেটা না শুনে বাসের ভেতর দিকে হেঁটে আসছে। একজন প্যাসেঞ্জারের সামনে দাঁড়ায় কিছুক্ষণ তাকে খুব ভাল করে লক্ষ করে তারপর আস্তে করে মানুষটাকে হাত দিয়ে স্পর্শ করে।
মানুষটা জেগে ওঠার পর মরণ্যা তার দিকে তাকায়, তারপর পাশের প্যাসেঞ্জারকে জাগিয়ে তোলে। এভাবে সে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। কাউকে কাউকে জাগিয়ে তুলে চোখের দিকে তাকাচ্ছে, কাউকে কাউকে ডেকে তুলছে না। এভাবে বাসের প্যাসেঞ্জারদের জাগিয়ে তুলতে তুলতে সে পেছনে এগিয়ে আসছে।
জালাল একটি ভয়াবহ আতঙ্ক অনুভব করে–পান-সিগারেটের দোকানে বুড়ো মানুষটি বলেছিল মরণ্যা যার চোখের দিকে তাকাবে এক্সিডেন্টে তারা মারা যাবে। মরণ্য এর মাঝে অনেকের চোখের দিকে তাকিয়ে এসেছে তারা সবাই কি মারা যাবে?
জালাল কী করবে বুঝতে পারছে না–মরণ্যা কি তার চোখের দিকেও তাকাবে? সেও কী এক্সিডেন্টে মারা যাবে?
জালাল চোখ বন্ধ কর ফেলল, বোটকা পচা গন্ধটা তার খুব কাছে চলে এসেছে, যার অর্থ মরণ্যা তার খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, জালাল তার কাপড়ের খসখস শব্দ শুনতে পেল। এখন নিশ্চয়ই তার মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে আজ রাতে এক্সিডেন্টে তার মৃত্যু হবে কি না। জালালের মনে হয় অনন্তকাল থেকে মরণ্যা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
জালাল হঠাৎ চমকে উঠল, একটা হিম শীতল হাত দিয়ে তাকে মরণ্যা স্পর্শ করছে। তাকে তোলার চেষ্টা করছে–সে চোখ খুলে তাকাতেই তার চোখে চোখে তাকাবে,
জালাল দেখতে পাবে কুৎসিত অন্ধকার একটি মুখ তার ভেতরে দুটি চোখ জ্বলন্ত
অঙ্গারের মতো জ্বল জ্বল করছে। সেই চোখ স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাবে এবং একটা ভয়ংকর এক্সিডেন্টে সে মরে যাবে।
জালাল নিঃশ্বাস আটকে রাখল, না, সে মরতে চায় না। কত দিন সে তার ছোট
ছেলেটাকে দেখে না, নিউ মার্কেট থেকে সে তার জন্যে লাল রঙের একটা খেলনা গাড়ি কিনেছে, সুইচ টিপে দিলেই গাড়িটা ছুটে যেতে থাকে, কোথাও ধাক্কা লাগলেই গাড়িটা ঘুরে অন্যদিকে যেতে শুরু করে ছেলেটা সেই গাড়িটা পেয়ে কী খুশিই না হবে! তার বউয়ের জন্যে একটা শাড়ি কিনেছে, নীল জমিনের ওপর সাদা নকশা কাটা। তার স্ত্রীর গায়ের রঙের সাথে যা চমৎকার মানাবে শাড়িটা সেটি বলার মতো নয়। তার ছেলের মুখের সেই হাসি আর তার স্ত্রীর সেই চোখের দৃষ্টি না দেখে সে মারা যাবে না, কিছুতেই মারা যাবে না।
মরণ্যা তাকে ধরে আরেকটু জোরে ধাক্কা দিল। জালাল তবুও চোখ খুলে তাকাল না। মরণ্যা এবারে তার কাধটাকে শক্ত করে ধরে, হিম শীতল হাত লোহার মতো শক্ত জোরে জোরে ঝাঁকুনি দিচ্ছে কিন্তু জালাল চোখ খুলে তাকাল না। জালাল বুঝতে পারে মরণ্যা তার ওপর ঝুঁকে পড়ছে, দুই হাত দিয়ে তাকে শক্ত করে ধরেছে, পচা দুর্গন্ধে তার নাড়ি উল্টে আসছে কিন্তু জালাল তবু চোখ খুলে তাকাল না।
মরণ্যা ফিসফিস করে ডাকছে, বলছে, “চোখ খোলো। চোখ খুলে দেখো–”
জালাল তবুও চোখ খুলল না।
“তোমাকে চোখ খুলতেই হবে, চোখ খোলো–”
জালাল চোখ খুলল না। মরণ্যা তাকে দুই হাত দিয়ে খামচে ধরে ঝাঁকাতে শুরু করে কিন্তু তবু জালাল চোখ খুলল না। বাসের অনেক মানুষ তখন জেগে উঠেছে তারা অবাক হয়ে দেখছে কালো কাপড়ে ঢাকা একটি ছায়ামূর্তি একজন মানুষকে দুই হাতে আঁকড়ে ধরে ঝাঁকাচ্ছে।
ড্রাইভার রিয়ারভিউ মিররে পেছনে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করছে কিন্তু দেখতে পাচ্ছে না। সামনে থেকে একটা ট্রাক আসছে, হাই বিম দিয়েছে নির্বোধ ড্রাইভার, চোখ কুঁচকে তাকানোর চেষ্টা করল বাস ড্রাইভার, হঠাৎ কী যেন লাফিয়ে রাস্তার মাঝে এসে পড়েছে, মুহূর্তের জন্যে স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়েছে, ভয়ংকর শব্দ হলো হঠাৎ–মানুষের আর্তচিৎকার-ভয়ংকর আর্তচিৎকার—
কতদিন হয়েছে কে জানে? জালাল একটা অন্ধকার জগতে আছে। আলোহীন-বাতাসহীন একটা বদ্ধ জগৎ, মাঝে মাঝে অনেকদূর থেকে সে কোনো কোনো মানুষের কথা শুনতে পায়, কার কথা সে বুঝতে পারে না, তারা কী বলছে সেটাও সে বুঝতে পারে না। মাঝে মাঝে মনে হয় তাকে নিয়ে কথা বলছে, কী বলছে কেন বলছে সেটাও সে বুঝতে পারে না। মাঝে মাঝে সে বোঝার চেষ্টা করে কী হচ্ছে, কিন্তু বুঝতে পারে না। আবার সে গভীর অন্ধকারে ডুবে যায়। আলোহীন, অন্ধকার বদ্ধ একটা জগৎ–যার কোনো শুরু নেই, কোনো শেষ নেই।
হঠাৎ একদিন সে একটা বাচ্চার গলার স্বর শুনতে পায়। বাচ্চাটি ডাকছে, “আব্বুও আব্বু” খুব চেনা এই গলার স্বরটি, তাকে আব্বু বলে ডাকছে। জালালের হঠাৎ মনে হতে থাকে এর কথার উত্তর দেওয়া খুব দরকার। সে যদি উত্তর না দেয় এই কণ্ঠস্বরটি চিরদিনের জন্যে হারিয়ে যাবে। জালাল ছটফট করে ওঠে, সে জোর করে চোখ খুলে তাকায়। অবাক হয়ে দেখে তার ওপর ঝুঁকে আছে তার ছেলে। কে একজন নারী কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল, “চোখ খুলেছে! চোখ খুলেছে!”
জালাল ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “আমি কোথায়? কী হয়েছে আমার?”
নারী কণ্ঠ বলল, “তুমি হাসপাতালে। বাস এক্সিডেন্ট হয়েছিল, অনেক মানুষ মারা গেছে। সবাই ভেবেছিল তুমিও বাঁচবে না।”
“আমি বেঁচে গেছি?”
“হ্যাঁ। তুমি বেঁচে গেছ।”
জালালের হঠাৎ একটা মানুষের কথা মনে পড়ে, কালো কাপড়ে ঢাকা মানুষ, হিম শীতল দেহ, শরীর থেকে পচা মাংসের গন্ধ বের হয়–যার চোখ দুটো জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো জ্বলে–সেই মানুষটার কী হয়েছে?
জালাল জোর করে মানুষটার কথা তার মাথা থেকে সরিয়ে দেয়, সে আর কোনোদিন তার কথা ভাবতে চায় না। কোনোদিন না।