নিদাঘী নিশিজাগর
নিদাঘী দাবদাহে ধরিত্রী কাতর। চরাচর দারুন দহন দানে জর্জরিত। এক টুকরো মেঘের আশায় চাতকপ্রায় অপেক্ষারত প্রকৃতি। অসহ্য তাপপ্রবাহ। ধীরে ধীরে অগ্নিগোলক পশ্চিম দিগন্তগামী হন।অস্ত রবির লালিমায় যেন অগ্নি আভার তীব্রতা। একমুঠো শীতলতার আশায় সবাই আকুল।
ধীরে ধীরে ঝিঙাফুলি সাঁঝের আঁচলে ঢাকা পড়ে দহন ক্লান্ত প্রকৃতি। অগ্নি স্নানে শুচি হওয়া ধরার শরীরে যেন চন্দন প্রলেপের স্নিগ্ধতার আভাস জাগে। ঈশান কোণে এক টুকরো কালো মেঘের উদয় হয়— দেখতে দেখতে সাঁঝের মায়াবী আঁধার মেঘের ওড়নায় ঢাকা পড়ে। দূর দিগন্ত সীমায় বিদ্যুতের চমকে চমকে ওঠে প্রকৃতি। ধীরে ধীরে তাপপ্রবাহ যেন কমতে থাকে। তমালের বুক থেকে এক মুঠো শীতলতা নিয়ে ভিজে বাতাসটা ধীরে ধীরে তামসী তপস্বিনী রাতকে পেলবতার আঁচলে জড়িয়ে ফেলে। টিপটিপ করে শুরু হয় বৃষ্টি। নিদাঘী ধরার বুকে সেই বৃষ্টি ফোঁটা যেন শান্তি সুধা রূপে নেমে আসে। যতই রাত গড়িয়ে চলে বৃষ্টির বেগ ও ততই বাড়তে থাকে। নিদাঘী রাত বৃষ্টিতে স্নান করে স্নিগ্ধ হয়। বৃষ্টি ভেজা মিঠেল বাতাসটা তমাল পারের স্নিগ্ধতা নিয়ে বয়ে চলে দিগন্ত পেরিয়ে। সুবাসি বাতাসে ভেসে আসে বৃষ্টিভেজা কামিনী ফুলের সৌরভ। দূরে শাল জঙ্গলের দিক থেকে ভেসে আসে একটা বিরহী পাপিয়ার পিউ কাঁহা ডাক। ধীরে ধীরে বৃষ্টির বেগ কমে আসে। স্নিগ্ধ শান্ত রাতের আকাশে আবার তারাদের সলমা চুমকির মেলা বসে। বৃষ্টি ভেজা গাছপালা থেকে টুপ টুপ করে ঝরতে থাকে জলের ফোঁটা। রাত গভীর হয়। বৃষ্টি ভেজা রাতে চাঁদের কি অপরূপ রূপ। রুপাঝুরি জ্যোৎস্নায় ভেসে যায় নিদাঘী রাতের প্রহর। ঘুমহীন চোখে চেয়ে থাকি তমাল তীরের দিকে। বাদল বাতাসে ভেসে আসে মাদলের দ্রিম দ্রিম বোল। বৃষ্টি ভেজা রাকা রজনী সুরের নেশায় মেতে ওঠে। রাত গড়িয়ে চলে—- নিদালীর মন্ত্রে যেন সারা চরাচর ঘুমন্ত। সুবাসি বাতাসটা ফিসফিস করে রাতের কানে কানে কত কথাই না বলতে থাকে। দূরে বাঁশবনে প্যাঁচাদের মজলিসে শোরগোল ওঠে। তমাল বাঁকের অর্জুন গাছে রাতচরা পাখিদের পাখসাট শোনা যায় । নদী চরের বেনাঘাসের জঙ্গল বাদুলে হওয়ায় মাথা নাড়ে। জঙ্গলের ভিতরে বড়াম থানের গাছ বেষ্টনীতে লাগে বাদল হাওয়ার নাচন। ছলন স্তুপের আনাচে-কানাচে লুকোচুরি খেলতে থাকে হাওয়াটা। নদীতীরের শাল জঙ্গলে মেটে খরগোশের দল নিঃশব্দে ঘুরে বেড়ায়। শিয়াল দম্পতি নদীকূলে র খোঁদল থেকে বের হয়ে খাবারের সন্ধানে। তমাল বাঁকের শিরিষ গাছের এসে বসে কুটরে পেঁচা দম্পতি। ওদের দাম্পত্য কলহের আর শেষ নেই। তমাল তীরের নিদাঘী রাত সচকিত হয়ে ওঠে ওদের কলহে।
ধীরে ধীরে ঠান্ডা বাতাস বইতে থাকে— আঁধার তরল হয়ে আসে। রাত কাটার ইশারা। দূর থেকে ভেসে আসে মোরগের প্রথম ডাক— যেন দিন মনিকে তার প্রথম আহ্বান। নিশি টহল সেরে পেঁচা দম্পতি এসে বসে নদীতীরের পাকুড় গাছে। আশেপাশের গাছগাছালিতে ধীরে ধীরে পাখিদের উসখুসানি শুরু হয়। নিদাঘী ভোরের মায়াবী চাদরে ঢাকা পড়ে জল জঙ্গল। এক জাদুকরি নিশির অবসান হয়।