Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নিজেই নায়ক || Prafulla Roy » Page 5

নিজেই নায়ক || Prafulla Roy

এদিকে আরেক সমস্যা দেখা দিয়েছে। শমিতার ব্যাপারে আমি যতই জড়িয়ে যাচ্ছি, ততই নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে লতিকা। কদিন ধরেই লক্ষ্য করছি অফিসের ব্যাপার নিয়ে দারুণ মেতে উঠেছে সে। কীভাবে নতুন নতুন রাস্তায় আমাদের প্রফেসানটার ডাইভার্সিফিকেশন করা যায় তার প্ল্যান করছে, ব্লু প্রিন্ট করছে, চার্ট করছে এবং কী রকম প্রফিট-ট্রফিট হতে পারে তার হিসেব-টিসেবও করছে।

তাকে যখনই শমিতার কথা বলতে যাই তখনই সে একই কথা বলে যায়, আরে বাবা তোমার এক্সপিরিয়েন্সটা কমপ্লিট হোক না, তখনই সব শুনব।

পরিষ্কার বুঝতে পারি শমিতার অ্যাফেয়ারটা এড়িয়ে যাচ্ছে লতিকা। কিন্তু যে অনিচ্ছুক তাকে তো আর জোর করে শোনানো যায় না।

যাই হোক একদিন দুপুরে অফিসে এসে নিজের চেম্বার পর্যন্ত যাওয়া গেল না। লিফট বক্সের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম, পাস্ট-প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচারের সামনে তুলকালাম চলছে। একগাদা লোক সমানে চেঁচাচ্ছে আর বাপ-বাপান্ত করছে। তাদের মধ্যে জিরাফের মতো লম্বা গলা-ওলা সিঁড়িঙ্গে ভগবতী পোদ্দার আর গোলাকার ঘাড়ে-গর্দানে ঠাসা হীরাচাঁদ আগরওয়ালাও রয়েছে। হে মহান জনগণ, এদের নিশ্চয়ই চিনতে পারছেন। এরা আমাদের এইড-ইলেকসান কর্পোরেশনের মাননীয় সব ক্লায়েন্ট।

হীরাচাঁদ এবং ভগবতী একই কনস্টিটিউয়েন্সির দুই রাইভ্যাল ক্যান্ডিডেট। কিন্তু এখন কে বলবে তারা পরস্পরের রাইভ্যাল? দুজনেই গলার শির ছিঁড়ে খিস্তি দিয়ে যাচ্ছিল। দম নেবার জন্যে একজন যখন থামে, আরেকজন শুরু করে দেয়। জানোয়ার, শুয়ারকে বাচ্চা-কুত্তা, হারামিকে বাচ্চা–গিধধর–উল্লু-কা-পাঠঠে।

ব্যাপারটা এই। এতগুলো লোক কেউ এম-পি, কেউ এম-এল-এ হবার জন্যে, কেউ বা অন্য ইলেকসান জেতার জন্যে আমাদের টাকা দিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ খবর-টবর পেয়ে অকুস্থলে এসে দ্যাখে এইড-ইলেকসানের অফিস উঠে গেছে। ফলে যা রি-অ্যাকশান হবার তাই হচ্ছে।

কদিন আগেও ইলেকসান নিয়ে ওরা একজন আরেকজনের পিঠে ছুরি বসিয়ে দিতে পারত। কিন্তু যেই দেখল এইড-ইলেকসানের জায়গা অন্য অফিস বসে গেছে অমনি তারা এককাট্টা হয়ে হয়ে গেছে। একসঙ্গে কোরাসে আমাদের খিস্তি করে এখন গলাগালি করে দুজনে চলে যাচ্ছে। আর আর যাদের কাছে ইলেকসান করাবার নাম করে টাকা নিয়েছি তারাও ওদের পিছু পিছু প্রায় শোভাযাত্রার করেই চলে গেল।

এ অভিজ্ঞতা আমাদের নতুন নয়। যখনই কোনও একটা কনসার্ন তুলে দিই তখনই ঋক বেঁধে আমাদের সেই কনসানের সম্মানিত ক্লায়েন্টরা কিঞ্চিৎ খিস্তি-খাস্তা করে যায়। এ খিস্তিটুকু আমাদের তেমন গায়ে লাগে না। কেননা সেই প্রবাদটা আছে না, পেটে খেলে পিঠে সয়, আমাদের অবস্থা হয়েছে তাই। যাই হোক হীরাচন্দরা চলে গেলে আমি নিজের চেম্বারে চলে এলাম। ঢুকেই দেখি লতিকা খুব হাসছে। হাসির কারণটা হীরাচন্দদের হতাশ এবং বেকুব হয়ে ওই একটানা খিস্তিখেউড়ে। দেখাদেখি আমিও হেসে ফেললাম।

হাসতে হাসতে বললাম, আরেকবার আমাদের চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার হল।

আমার কথা শেষ হতে না হতেই ফোন বেজে উঠল। সেটা তুলে নিয়ে কানে লাগাতেই মহিলা কণ্ঠ শুনতে পেলাম, মিস্টার সরকার?

বললাম, হ্যাঁ।

আমি মনোবীণা সান্যাল। বিশেষ একটা দরকারে আপনাকে ফোন করছি।

আজ্ঞে হ্যাঁ, বলুন–আমি খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

আপনাকে যে কাজের দায়িত্ব দিয়েছি সেটা কী রকম চলছে?

ভালোই। আমি সিনসিয়ারলি চেষ্টা করে যাচ্ছি।

ডোরাকে নরম্যাল করা যাবে বলে আপনার মনে হয়?

সেই রকমই আমার ধারণা।

ভেরি গুড। বলে একটু থামলেন মনোবীণা। পরক্ষণে আবার শুরু করলেন, কুড়ি-বাইশ দিন হল আপনি আমার কাজটা নিয়েছেন।

বললাম, আজ্ঞে হ্যাঁ–

আপনাকে আর পঁচিশ দিন সময় দিচ্ছি। তার মানে নেক্সট মাস্থের দশ তারিখ পর্যন্ত। এর মধ্যে আপনার কাজ কমপ্লিট করতে হবে।

বললাম, বাইশ দিনের মধ্যে কী হবে? আপনি তো আপনার মেয়েকে জানেন; তার মধ্যে কতরকমের অ্যাডিকসান রয়েছে। সে সব থেকে তাকে বার করে আনতে অনেক সময়ের দরকার।

মনোবীণা অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন, জানি জানি। কিন্তু বাইশ দিনের বেশি একটা দিনও আপনাকে দিতে পারব না। আর শুনুন, আরেকটা কাজ আপনাকে করতে হবে।

কী?

নেক্সট মান্থের ইলেভেন্থ সন্ধের ট্রেনে ভোরাকে নিয়ে আপনাকে বম্বে যেতে হবে। বম্বের একটা ঠিকানা দিয়ে দেব; ওকে ওখানে পৌঁছে দেবেন। আর এই বম্বে যাবার ব্যাপারটা এখন ভোরাকে বলবেন না।

কিন্তু এত অল্প সময়ে

বললামই তো, এর বেশি একটা সেকেন্ডও বাড়ানো যাবে না। দশ তারিখটা মনে রাখবেন। আচ্ছা ছাড়ছি–

টেলিফোনটা নামিয়ে বাঁদিকে তাকাতেই চোখে পড়ল লতিকা একদৃষ্টে আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। তাকে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই আবার ফোন বেজে উঠল। টেলিফোনটা তুলে কানে ঠেকাতেই মণিমোহনের কণ্ঠস্বর ভেসে এল। মনোবীণার পরেই এই লোকটা আমার জন্যে যে ওঁত পেতে বসে ছিল, কে ভাবতে পেরেছে। গলার স্বরটা মধুতে চুবিয়ে বললাম, বলুন স্যার

মণিমোহন বললেন, আমার কাজের কথাটা মনে আছে তো?

নিশ্চয়ই! শমিতা বোসের নুড ছবি আর বেডরুমের কিছু উত্তেজক পিকচার তুবে দেব-এই তো?

মণিমোহন বললেন, কারেক্ট। এবার বলুন, কখানা ফোটো ভোলা হল?

আপনি তো আমাকে দুমাস সময় দিয়েছেন; তার মধ্যেই পেয়ে যাবেন। কিন্তু সময়টা যে একটু কমাতে হচ্ছে। আমি আপনাকে আর পঁচিশটা দিন দিচ্ছি; তার মানে নেক্সট মাছের দশ তারিখের মধ্যে ফোটোগুলো আমার চাই।

দারুণ চমকে উঠলাম। মনোবীণাও ঠিক ওই তারিখটাই আমাকে দিয়েছেন। কী ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে ওর মধ্যে যে একটা সাংঘাতিক ঝামেলা রয়েছে, সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে। বললাম, ঠিক আছে স্যার, দশ তারিখের মধ্যেই ফোটোগুলো দিতে চেষ্টা করব। চেষ্টা না, দিতেই হবে। আচ্ছা, আজ এই পর্যন্ত থাক। পরে আবার যোগাযোগ করব।

লাইন কেটে যাবার পর নিজের অজান্তেই বাঁদিকে আমার ঘাড়টা ঘুরে গেল। দেখি আগের মতোই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে লতিকা। চোখাচোখি হতেই সে বলল, ডিসটার্বড় মনে হচ্ছে?

নিজের মুখ তো দেখতে পাচ্ছি না। হয়তো সেখানে দুর্ভাবনার কিছু ছাপ পড়ে থাকবে। তবু হেসে বললাম, স্লাইট

কে ফোন করেছিল? মণিমোহন মল্লিক?

হ্যাঁ।

তার আগে মনোবীণা সান্যাল?

আমি আস্তে মাথা নাড়লাম। লতিকা আর কিছু জানতে চাইল না। তার সামনে হিসেবের খাতাপত্র খোলা হয়েছে, সে-সব নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আর আমি রিভলভিং চেয়ারে পা ছড়িয়ে দিয়ে ভাবতে লাগলাম, পার্সোনাল ডিপার্টমেন্টটা এবার বন্ধ করে দিতে হবে। মণিমোহন মল্লিক যেভাবে আমার পিছনে লেগে আছে ওটা তুলে না দিলেই নয়। অবশ্য মনোবীণাও লেগে আছেন। তবে এ ব্যাপারটায় আমার নিজেরই যথেষ্ট ইন্টারেস্ট।

চেয়ারে শরীর ছড়িয়ে রেখেই একসময় জিগ্যেস করলাম, আচ্ছা লতিকাকাচের দেয়ালের ওধার থেকে লতিকার গলা শোনা গেল, বলো–

আমাদের পার্সোনাল ডিপার্টমেন্টে আমরা কী রকম অ্যাডভান্স পেয়েছি?

হিসেব-টিসেব সব সময় মুখস্থই থাকে লতিকার। সঙ্গে সঙ্গে সে বলল, মোট সাঁইত্রিশ হাজার চারশো টাকা

একটু চুপ করে থেকে বললাম, নট ব্যাড। অনেকদিন হয়ে গেল; এবার ভাবছি ওটার গণেশ উল্টে দেব। ওই ডিপার্টমেন্টটা তুলে দিয়ে নতুন কী খোলা যায় বলো তো?

হে মহান জনগণ, আগেই বলেছি কীভাবে আমাদের প্রাফেসানটা নতুন নতুন ডাইভার্সিফিকেসন করা যায়, এ নিয়ে কিছুদিন ধরে নানারকম রিসার্চ চালিয়ে যাচ্ছে লতিকা। সে বলল, ভেবেছি ওখানে প্ল্যানস বলে একটা ডিপার্টমেন্ট খুলব।

ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলো।

আমরা প্ল্যানস থেকে নানারকম পরিকল্পনা সাপ্লাই করব। এই ওয়ার্ল্ডে কেউ রাতারাতি মিলিওনেয়ার হতে চায়, কেউ ফেম চায়, কেউ প্রতিষ্ঠা চায়, কেউ চায় পাওয়ার। আমরা তাদের কাছ থেকে অ্যাডভান্সের টাকা নিয়ে দুমাস কি তিন মাস সময় নেব। বলব, পরিকল্পনার ব্লু-প্রিন্ট তৈরি হচ্ছে, পরে পাঠানো হবে। তিন মাসের মধ্যেই আশা করা যায় এই ডিপার্টমেন্টে লাল বাতি জ্বালানো যাবে।

আমি প্রায় লাফিয়েই উঠলাম, গ্র্যান্ড! তোমার ব্রেনটা আজকাল দারুণ ওয়ার্ক করছে।

লতিকা হাসল, সেটা বোধহয় সঙ্গগুণে।

আমিও হেসে ফেললাম, যা বলেছ। তাহলে আসছে সপ্তাহে একটা শুভ দিন দেখে পার্সোনালের সাইন বোর্ডটা পাল্টে দাও

আচ্ছা

আজ একটা দুর্দান্ত ঘটনা ঘটে গেল।

হে মহান জনগণ, আগেই জানিয়েছি আলাপ হবার পর থেকে আজকাল রোজই শমিতার সঙ্গে আমার দেখা হচ্ছে। সে-ই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আমাকে ক্লাবে, হোটেলে, সুইমিং পুলে কিংবা জুয়ার আড্ডায় চরকির মতো ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায়। আজ সে নিয়ে গিয়েছিল রেস কোর্সে।

আগেও আর একদিন রয়াল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবের মাঠে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল শমিতা। কিন্তু রেসের র আমি জানি না। নেহাত ওর গায়ে জোঁকের মতো আমার লেগে থাকতে হবে তাই সঙ্গে সঙ্গে যেতে হয়।

আগের দিনও লক্ষ্য করেছি, আজও দেখলাম, হাজার খানেক টাকা সে হেরেছে। টাকা গচ্চা যাওয়া ছাড়া এর মধ্যে কী ফান বা চার্ম আছে বুঝতে পারি না। আজ বললাম, রেস খেলতে তোমার ভালো লাগে?

শমিতা বলল, দারুণ।

এর মধ্যে কী আছে?

এক্সাইটমেন্ট অ্যান্ড কিক। লাইফটা আমার খুবই বোরিং। তার মধ্যে একটু এক্সাইটমেন্ট না থাকলে স্রেফ মরে যাব। বলে একটু থামল শমিতা। তারপর আবার বলল, রেসের ঘোড়াগুলো যখন ছোটে সেই সময়টা আমার দারুণ উত্তেজনার মধ্যে কাটে। এই উত্তেজনার জন্যেই আমি এখানে আসি।

কথা বলতে বলতে আমরা মেম্বারদের জন্যে সংরক্ষিত স্ট্যান্ড থেকে নেমে আসছিলাম। হঠাৎ সামনে কার দিকে চোখ পড়তে থমকে দাঁড়িয়ে গেল শমিতা। তার দৃষ্টি লক্ষ্য করে তাকাতেই দেখতে পেলাম স্ট্যান্ডটার নীচে ঘাসের লনে সাতাশ-আটাশ বছরের একটা ছোকরা-সাড়ে ছফুটের মতো হাইট, রোদে পোড়া টাফ চেহারা, চওড়া মাসকুলার বুক, ষাঁড়ের মতো ছড়ানো কাধ, পরনে বুকখোলা স্পোর্টস গেঞ্জি আর ট্রাউজার, চোখে সানগ্লাস

জিগ্যেস করলাম, কে ও?

একটা সেক্সি বিস্ট। অনেকদিন কলকাতায় ছিল না। আবার দেখছি এসে হাজির হয়েছে। বলেই আমার হাত ধরে টানল শমিতা, চলো, অন্যদিক দিয়ে যাই—

শমিতার মতো মেয়ে যাকে ভয় পায় সে নিশ্চই বিস্টই হবে।

অসংখ্য মানুষ আর গ্যালারির ফাঁক দিয়ে আমরা কোণাকুণি নামতে লাগলাম। কিন্তু এত করেও তাকে এড়ানো গেল না। নীচে নামতেই দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে আমাদের দিকে চোখ রেখে রেখে সে এখানে চলে এসেছিল। সে বলল, কী ব্যাপার–ডাকলাম, শুনতে পাওনি?

কই না তো–শমিতা ঠান্ডা গলায় বলল।

আমি ভাবলাম অ্যাভয়েড করলে বুঝি—

অ্যাভয়েড করব কেন? তারপর, কবে আমেরিকা থেকে ফিরলে?

পরশু। এসেই তোমার খোঁজ করেছি। শুনলাম তুমি নাকি নতুন বয়ফ্রেন্ড জুটিয়েছ, তাকে নিয়ে দারুণ মাতামাতি করছ! বলেই আঙুল দিয়ে আমাকে দেখাল সে, হি মাস্ট বি দ্যাট লাকি গ্যায়–

রাইট-শমিতা বলল, আমার একটা খুব আরজেন্ট কাজ আছে এখানে চললাম; পরে তোমার সঙ্গে দেখা হবে। বাই

আমি তোমাকে চিনি। তোমার কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই। এতদিন পর দেখা হল—চলো আমার সঙ্গে। বলতে বলতে হঠাৎ কী মনে পড়তে উত্তেজিত হয়ে উঠল সে, জানো-দারুণ একটা খবর আছে। ইওরোপ যাবার আগে রাসেল স্ট্রিটে যে নতুন অ্যাপার্টমেন্টটা বুক করে গিয়েছিলাম কাল সেটা পেয়ে গেছি। তোমার আরেকটা সময় কাটাবার জায়গা

তার কথা শেষ হবার আগেই শমিতা বলে উঠল, প্লিজ প্রবীর, আমি আর ওয়েট করতে পারছি না। বলেই সামনের দিকে পা বাড়িয়ে দিল শমিতা।

সে অর্থাৎ প্রবীর দারুণ নাছোড়বান্দা হাত বাড়িয়ে শমিতার একটা হাত ধরে বলল। বলল, আজ তোমাকে ছাড়ছি না। এতদিন পর দেখা—

প্লিজ

নো, নেভার- দু’কাঁধ ধরে শমিতাকে নিজের দিকে ফেরাল প্রবীর, বলল, শমিতা, ইউ নো মি এভরি ওয়েল। সো

দাঁতে দাঁত চেপে তীব্র চাপা গলায় শমিতা বলল, সো হোয়াট?

আমার ইচ্ছা আমার সঙ্গে তুমি আমার নতুন অ্যাপার্টমেন্টে যাবে।

তোমার এতটা সাহস কোত্থেকে হল?

সে সাহস তো তুমিই আমাকে দিয়েছ ডার্লিং।

শমিতা তার কাঁধ থেকে প্রবীরের হাত দুটো ছুঁড়ে ফেলে আমাকে বলল, চলে এসো-

কিন্তু আরেকবার পা বাড়াতে গিয়ে শমিতাকে থামতে হল। প্রবীর আবার তার দুই কাঁধ চেপে ধরেছে। শমিতা প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, ডোন্ট ক্রিয়েট সিন–

প্রবীর বলল, সিন ক্রিয়েট করার কোনও দরকারই হবে না যদি তুমি আমার সঙ্গে যাও

হে মহান জনগণ, আপনাদের রাজীব সরকার–অর্থাৎ আমি এতক্ষণ একটি কথাও বলিনি এবার আর চুপচাপ থাকা গেল না, প্রবীরকে বললাম, শমিতা যখন যেতে চাইছে না, ইনসিস্ট করছেন কেন?

প্রবীর কিন্তু স্প্যানিশ মাতাদোরের মতো আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ইউ সাট আপ সোয়াইন

আমার মাথায় চিড়িক করে ইলেকট্রিক শকের মতো কিছু খেলে গেল তবু যতটা সম্ভব মেজাজ শান্ত রেখে বললাম, আপনি যা বললেন তার উত্তর আমার জানা আছে। সেটি দিতে বাধ্য করবেন না।

আর একটা কথা বললে, তোমার মুখে একটা দাঁতও আস্ত থাকবে না রাসকেল–বলে উঠল প্রবীর।

হে মহান জনগণ, আমি একটা ভদ্রলোকের ছেলে; পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর বয়স হলেও রক্তের উত্তাপ এখনও যথেষ্ট আছে। সুতরাং নিজের অজান্তে এবং প্রবীর কিছু বুঝবার আগেই তার চোয়ালে আমার একটা ঘুষি নেমে গেল। পরক্ষণেই দেখা গেল ছোকরা প্রায় পনেরো ফুট দূরে মাটির ওপর শুয়ে আছে।

একটু বাদেই স্প্রিংয়ের মতো প্রবীর লাফিয়ে উঠল এবং হে মহান জনগণ, ইংরেজি ভাষার সব চাইতে নোংরা গোটাকয়েক খিস্তি আউড়ে আবার আমার দিকে দৌড়ে এল–তার মাথায় এখন খুন চেপে গেছে।

সুতরাং হে মহান জনগণ, আমাকে দ্বিতীয়বার তার চোয়ালে আরেকটা ঘুষি জমিয়ে দিতে হল। এবারও পনেরো ফুট দুরে ছিটকে গিয়ে শুয়ে পড়ল সে; আর উঠল না।

এদিকে চারপাশ থেকে লোকজন হই-চই করে ছুটে আসতে লাগল। আমি হাত দুটো ঝেড়ে দারুণ নির্বিকার মুখে শমিতাকে বললাম; চলো

শমিতা থ হয়ে গিয়েছিল। তার চোখে-মুখে বিস্ময়, ভয় আর সেই সঙ্গে খানিকটা রিলিফ মানে স্বস্তির ভাবও যেন মেশামেশি করে রয়েছে। আমাকে এই চেহারায় দেখবে, সে হয়তো ভাবতে পারেনি।

যাই হোক, শমিতা আমার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে লাগল।

পার্কিং জোনে এসে আমরা গাড়িতে উঠলাম। শমিতা স্টার্ট দিয়ে তার ফিয়েটটা রেস কোর্সের বাইরে নিয়ে এল। উইন্ডস্ক্রিনের বাইরে চোখ রেখে সে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ

জিগ্যেস করলাম, হঠাৎ ধন্যবাদ কেন?

ওই বিস্টটার হাত থেকে তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ, তাই বলে একটু থামল শমিতা। তারপর আবার শুরু করল, তুমি না থাকলে ও আমাকে নিশ্চয়ই ওর অ্যাপার্টমেন্টে টেনে নিয়ে যেত। আর আজকের রাতটা আটকে রাখত। এতক্ষণে শমিতার স্বস্তির কারণটা বোঝ গেল। তবে আমি আর কিছু বললাম না।

রেস কোর্সের পিছন দিয়ে গাড়িটা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছে নিয়ে এসেছিল শমিতা। ডাইনে ঘুরে চৌরঙ্গীর দিকে যেতে যেতে সে বলল, তবে আমার খুব ভয় করছে।

ফিরে বললাম, কীসের ভয়?

শমিতা বলল, ওই প্রবীর–হি ইজ এ ডার্টি রোগ; দারুণ ভিন্ডিকটিক। তুমি একটু সাবধানে থেকো।

আমার ওপর দুশ্চিন্তার ছায়া পড়তে পড়তেই মিলিয়ে গেল। কিছু বললাম না। আচমকা শমিতা জিগ্যেস করল, আচ্ছা, তুমি ওকে মারলে কেন?

বললাম, তোমরা ওপর ওইরকম জোর করছিল। তা ছাড়া আমাকে শুধু শুধু যা তা খিস্তি করল। তাই

নাকি কারণটা অন্য? গাড়ির স্পিড কমিয়ে আমার দিকে তাকাল শমিতা। ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে নীচু গলায় বলল, মানে আমাকে ভালোবেসে-টেসে ফেলেছ নাকি?

আমার হার্ট লাংস ইত্যাদির মধ্য দিয়ে চমকে খেলে গেল। হে মহান জনগণ, অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছি, মেয়ে সংক্রান্ত ব্যাপারে আমার বিজনেস পার্টনার মানে লতিকার সম্বন্ধে আমার যথেষ্ট সিমপ্যাথি আছে। আমার প্রতি তার দুর্বলতা সব সময়ই টের পাই। কিন্তু তার সম্পর্কে আমার যে সহানুভূতি বা ফিলিং সেটা ভালোবাসার কতটা কাছাকাছি তা আমার নিজের কাছেই খুব স্পষ্ট নয়।

কিন্তু এই মেয়েটা, অর্থাৎ শমিতার পিছনে কদিন ধরে বঁড়শিতে আটকানো মাছের মতো যে ছুটে বেড়াচ্ছি সেটা কি শুধুমাত্র তাকে মদ জুয়া রেস ইত্যাদির অ্যাডিকসান থেকে ফেরাবার জন্যে? আগেও দু-একবার ভেবেছি, এখনও মনে হল, হে মহান জনগণ-আমি ক্রমশ জড়িয়ে যাচ্ছি। হেসে হেসে বললাম, কী জানি–

আমরা চৌরঙ্গীতে চলে এসেছিলাম। কিছু বুঝবার আগেই আচমকা শমিতা গাড়িটা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে বলল, আজ আর হোটেলে খাব না।

তবে?

কিছুদিন ধরে দেখছি হোটেলে বারো পেগ ড্রিংক করার পরও আউট হইনি। আজ ক্লাবে বসে হুইস্কি খাব।

হে মহান জনগণ, মেয়েটা আমাকে দারুণ ঝামেলায় ফেলে দিল তো। হোটেল ষড়যন্ত্র করে হুইস্কিতে জল মেশাবার ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু সব জায়গায় কি তা সম্ভব?

ল্যান্সডাউন রোডের এক পশ ক্লাবে এসে সুইমিং পুলে ঘণ্টাখানেক সাঁতার কাটল শমিতা। সাঁতার-টাতার কাটার পর কিছু খাবার আর ড্রিংক নিয়ে আমার মুখোমুখি বসল শমিতা। আজ এগারোটার মধ্যেই বারো পেগের কোটা কমপ্লিট করে পুরোপুরি আউট হয়ে গেল সে। অবশ্য আউট হবার আগেই কালকের অ্যাপয়েন্টমেন্টটা করে নিয়েছিল। কাল দুটোর সময় বিড়লা প্ল্যানেটেরিয়ামের কাছে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছে।

শমিতাকে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আমি যখন এন্টালি এলাম একটা বেজে গেছে।

পরের দিন ঠিক দুটোর সময় বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের সামনে থেকে আমাকে গাড়িতে তুলে নিল শমিতা, তারপর পার্ক স্ট্রিটের দিকে যেতে যেতে বলল, কোথায় যাওয়া যায় বলো তো? ক্লাব হোটেল এসব বোরিং লাগছে।

আজ সকালেই মাথায় একটা দারুণ প্ল্যান এসে গেছে। বললাম, তুমি এ কদিন আমাকে যেখানে নিয়ে গেছ সেখানেই গেছি। চলো, আজ তোমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাই। যাবে?

কোথায়?

গেলেই বুঝতে পারবে।

আচ্ছা যাব।

তাহলে গাড়ি থামিয়েই আমার জায়গায় এসো। আমাকে ড্রাইভ করতে দাও। ঘণ্টা দুয়েক পর শমিতাকে নিয়ে সোজা ডায়মণ্ড হারবার চলে এলাম। ট্যুরিস্ট লজে কফি-টফি খেয়ে আমরা যখন নদীর পাড়ে গিয়ে বসলাম তখন বিকেল। ঝকঝকে সোনালি রোদ জলের ওপর স্থির হয়ে আছে।

বিশাল দিগন্তের দিকে তাকিয়ে শমিতা বলল, বিউটিফুল।

আমি আস্তে মাথা নাড়লাম।

শমিতা এবার বলল, অনেক দিন পর ডায়মণ্ড হারবার এলাম। একটু থেমে অন্যমনস্ক মতো আবার বলল, জানো, ছেলেবেলায় একেকদিন বাবা আমাদের ডায়মণ্ড হারবার নিয়ে আসতেন। কী ভালো যে লাগত।

মুখ ফসকে বলে বললাম, কার কথা বলছ–মিস্টার সান্যালের?

আরে না, ও তো মার সেকেন্ড হাজব্যান্ড। হি ইজ এ সোয়াইন।

আমি আমার নিজের বাবার কথা বলছি।

যদি কিছু মনে না করে একটা কথা জিগ্যেস করব?

নিশ্চয়ই করবে। মনে করার কী আছে?

বাবাকে তোমার দেখতে ইচ্ছা করে না?

করে তো। কিন্তু দেখব কী করে? হি ইজ নাউ ইন কানাডা

বললাম, তোমাদের তো পয়সার অভাব নেই। ইচ্ছা করলেই তো তুমি বাবার কাছে চলে যেতে পারো।

তা হয়তো পারি। কিন্তু এতদিন মা যেতে দেয়নি; তারপর কত রকম অ্যাডিকসানের মধ্যে জড়িয়ে গেছি। বাবা এমনিতে খুব লিবারেল কিন্তু এসব নেশা-টেশা নোংরামি একেবারেই পছন্দ করেন না। অথচ জানো

কী?

আমার বিশ্বাস, বাবার কাছে যেতে পারলে আমি বেঁচে যেতাম।

একটু চুপ করে থেকে বললাম, বাবার কাছেই তোমার যাওয়া উচিত।

দূর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আবছা গলায় শমিতা বলল, সাহস হয় না। যদি কোনওদিন নোংরা হ্যাবিটগুলো ছাড়তে পারি তবেই যাবার কথা ভাবব।

হ্যাবিটগুলো ইজিলি ছাড়তে পারো। মানুষ ইচ্ছা করলে না পারে কী?

আমার পক্ষে এগুলো ছাড়া ইমপসিবল। তোমাকে আমার লাইফের সব কথা বলেছি না। আমি একটা দারুণ ভ্যাকুয়ামের মধ্যে আছি। সেটা ভুলবার জন্যেই ওই হ্যাবিটগুলোর আমার দরকার।

আমি চুপ করে রইলাম। একটু পর টুপ করে সূর্যটা নদীর জলে ডুবে গেল। আর সন্ধ্যা নামতে না নামতেই চনমনে হয়ে উঠল শমিতা। বলল, আই–

তার চোখ-মুখের লক্ষণ দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম। তবু জিগ্যেস করলাম, কী বলছ?

এখানে হুইস্কি-টুইস্কি পাওয়া যাবে?

কলকাতা থেকে মাত্র তিরিশ-পঁয়ত্রিশ মাইল দূরে মদ্য পাওয়া যাবে না, এ কখনও হয়! কিন্তু সে কথা কি আর বলি। যা বললাম তা এই রকম–হুঁইস্কি কেন, এক ফোঁটা কান্ট্রি লিকারও পাওয়া যাবে না।

শমিতা বলল, ভীষণ ড্রিংক করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তার জন্যে তো কলকাতায় ফিরতে হয়।

আমি ভেতরে ভেতরে নার্ভাস হয়ে গেলাম। ফেরার জন্যে না শমিতা ক্ষেপে ওঠে। কিন্তু না, সে আবার বলল, নদীর পাড়টা খুব ভালো লাগছে। এখন আর কলকাতায় ফিরব না।

রাত্রে ফেরার সময় শমিতা বলল, একটা কথা ভেবে ভীষণ মজা লাগছে।

বললাম, কী কথা?

অনেক দিন পর আজকের দিনটা আমার উইদাউট ড্রিংক কাটল।

খুব খারাপ লাগল কি?

শমিতা হাসল, না না। তবে গলাটা খুব খুসখুস করছে। অনেক দিনের হ্যাবিট তো।

আমিও হাসলাম।

আমার সঙ্গে আলাপ হবার পর আজই প্রথম সজ্ঞানে স্বাভাবিক ভাবে বাড়ি ফিরল শমিতা। তাকে বালিগঞ্জ সার্কুলর রোডে রেখে ট্যাক্সি ধরলাম।

হে মহান জনগণ, আগেই বলেছি আমার আস্তানায় যেতে হলে ট্রাম রাস্তা থেকে গলির ভেতর ঢুকতে হয়।

ট্যাক্সিটা বড় রাস্তায় ছেড়ে গলি দিয়ে বাড়ির কাছাকাছি আসতেই দেখি দুটো লোক কোত্থেকে মাটি খুঁড়ে আমার পিছু নিয়েছে। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে তারাও দাঁড়িয়ে গেল। তাদের চালচলন কেমন যেন সন্দেহজনক। চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে আমি চেঁচিয়ে বললাম, কে তোমরা?

হঠাৎ লোক দুটো পিছন ফিরে দৌড় লাগাল এবং সাপের মতো এঁকে বেঁকে মাঝরাতের অন্ধকার নির্জন রাস্তায় অদৃশ্য হয়ে গেল। ব্যাপারটা আমার কাছে একেবারেই ঝাপসা থেকে গেল।

পরের দিন আবার শমিতাকে নিয়ে কলকাতা থেকে উধাও হলাম। আজ গেলাম ব্যারাকপুরে। অনেক রাত পর্যন্ত সেখানে কাটিয়ে ফিরে এলাম।

এর পর থেকে শমিতাকে নিয়ে রোজই অনেক দূরের কোনও খোলা মাঠে, শালবনে, কিংবা নদীর পাড়ের ছোটখাটো গঞ্জে অথবা নাম-না-জানা কোনো অজ পাড়াগাঁয়ে চলে যাই। রাতের অনেকটা সময় পর্যন্ত কাটিয়ে তাকে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে রেখে আসি। বাইরে কাটাবার জন্যে ড্রিংকটা সে আর করতে পারছে না। প্রথম প্রথম এ জন্যে তার অসুবিধা হত। কিন্তু দু-চার দিন যেতে না যেতে ড্রিংকের কথা সে আর বলে না।

আসলে কলকাতার কটা ক্লাব, হোটেল, রেস কোর্স আর জুয়ার আড্ডার মধ্যে থেকে থেকে তার লাইফ বোরিং হয়ে উঠেছিল। হাজার গন্ডা অ্যাডিকশানের ঘোর কাটিয়ে যখন তাকে বাইরে বার করে আনলাম সে যেন বেঁচে গেল। বিশাল খোলা মাঠ, সবুজ গাছপালায় ঘেরা স্নিগ্ধ গ্রাম কিংবা নদী তীর–এ পর্বের মধ্যে যে এত আনন্দ ছিল সে জানত না।

আগে আগে শমিতা মজা করে বলত, তুমি একটা আস্ত ডেভিল–যাতে ড্রিংক না করতে পারি, রেস কি গ্যাম্বলিং নিয়ে না মাতি সেইজন্যে আমাকে রোজ কলকাতার বাইরে নিয়ে যাও। তোমার মতলব আমি বুঝি?

আমি হাসতে থাকি; উত্তর দিই না।

কোনও দিন বা শমিতা বলে, আই অ্যাম ভেরি মাচ থ্যাঙ্কফুল টু ইউ-মনে হচ্ছে তোমার জন্যে অ্যাডিকশান আর ব্যাড হ্যাবিটগুলো কাটিয়ে উঠতে পারব। এক এক সময় আমার কী মনে হত জানো?

কী?

হোল লাইফ আমি অ্যাবনরম্যাল থেকে যাব। কিন্তু এখন আমি বিশ্বাস করি–তুমি যদি আরেকটু হেল্প করো আমি পুরোপুরি নর্মাল হয়ে যাব।

গম্ভীর গলায় বলি, আমি সব সময় তোমার দিকে হাত বাড়িয়ে আছি শমিতা।

এনি হেল্প-আই অ্যাম অলওয়েজ রেডি।

রোজ নিয়ম করে বাইরে ঘুরতে ঘুরতে একদিন একটা দারুণ ব্যাপার ঘটে গেল। সেদিন আমরা একটা গ্রামে গেছি। দেড়-দুশো মাইল দূরে বে অফ বেঙ্গলে কোথায় যেন আচমকা নিম্নচাপ হয়েছিল; তার ফলে অসময়ে বৃষ্টি নেমে গেল। বৃষ্টিটা এমনই একটানা আর নাছোড়বান্দা যে থামবার লক্ষণ নেই। সুতরাং এক চাষীর বাড়িতে থেকে যেতে হল।

ওরা খাইয়ে-দাইয়ে আমাদের একটা ঘরের ভেতর পুরে দিল। ঢুকে দেখি তক্তপোষে পাশাপাশি বালিশ পেতে আমাদের জন্যে বিছানা করা রয়েছে।

ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ বিছানাটা দেখল শমিতা। তারপর শব্দ করে হেসে উঠল, ওরা আমাদের হাজব্যান্ড-ওয়াইফ ভেবেছে।

বললাম, তাই মনে হয়।

আজ রাতটার জন্যে টেম্পোরারি হাজব্যান্ড-ওয়াইফ হতে আমার আপত্তি নেই। হে মহান জনগণ, আমি যে ভেতরে ভেতরে মেয়েদের ব্যাপারে দারুণ পিউরিটান আর নীতিবাগীশ এই প্রথম টের পেলাম। আমি করলাম কী, তক্তাপোষ থেকে একটা বালিশ আর চাদর তুলে নিয়ে মেঝেতে বিছানা পাতলাম। বললাম, তুমি ওপরে শোও। আমি নীচে শুচ্ছি।

কেন?

আমি, অন্য ঘরে শুতে পারতাম। কিন্তু সে কথা বলতে গেলেই এ বাড়ির লোকেরা জেরা করে করে লাইফ হেল করে দেবে। সুতরাং আমাদের সম্বন্ধে ওরা যা ভেবেছে তা আর ভাঙানোর দরকার নেই। রাতটা কোনওরকমে কাটিয়ে কাল ভালো ভালোয় কেটে পড়তে পারলেই আমি খুশি।

শমিত তক্তপোষে উঠে শুয়ে পড়ল। আমি মেঝেতে শুয়ে পড়লাম।

শমিতার শিয়রের দিকে একটা উঁচু টুলের ওপর হ্যারিকেন জ্বলছিল। চাবি ঘুরিয়ে সেটা নেভাতে নেভাতে চাপা গলায় বলল, কাওয়ার্ড।

কথাটা কাকে লক্ষ্য করে বলা, সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না। হে মহান জনগণ, আমি জবাব দিলাম না; ঘাড় মুখ গুঁজে পড়ে রইলাম।

পরের দিন সকালে কলকাতায় ফেরার সময় শমিতা বলল, একদিন তোমার বাড়িতে আর কাল ওই চাষীদের ঘরে-দু-দুবার চান্স পেয়েও তুমি আমায় ছেড়ে দিলে। ইউ আর অলমোস্ট লাইক গড়।

উত্তর দিলাম না; জানালার বাইরে ধু-ধু ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়ে রইলাম। শমিতা আবার বলল, যদি ফ্ল্যাটারি না ভাবো, একটা কথা বলব?

জানালাম ফ্ল্যাটারি ভাবব না। শমিতার যা ইচ্ছা স্বচ্ছন্দে বলতে পারে।

শমিতা খুব গাঢ় গলায় এবার বলল, বাবাকে বাদ দিলে ছেলেবেলা থেকে এমন কারোকে পাইনি যাকে শ্রদ্ধা করতে পারি, যার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারি। বহুদিন পর একমাত্র তোমাকেই পেলাম যাকে এখন থেকে বিশ্বাস আর শ্রদ্ধা দুটোই করতে পারব।

হে মহান জনগণ, মেয়েটা বলে কী! প্রায় চমকেই উঠলাম। আমি কী বস্তু শমিতা তো জানে না। জানলে কোথায় থাকত তার বিশ্বাস আর কোথায়ই বা শ্রদ্ধা! যাই হোক এমন কথা আগে আর কখনও কেউ আমাকে বলেনি। আমার স্নায়ুর ওপর দিয়ে ঢেউয়ের মতো কিছু বয়ে যেতে লাগল।

যেদিন শমিতা আর আমি চাষীদের বাড়ি রাত কাটিয়ে এলাম তার দুদিন পরের কথা।

আজ আমরা বর্ধমানের একটা গ্রামে গিয়েছিলাম। অন্য দিনের মতো আজও কলকাতায় ফিরে শমিতাকে ওদের বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে পৌঁছে দিলাম। তারপর ট্যাক্সি ধরে সোজা এন্টালিতে।

বড় রাস্তায় ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়ে বাড়ির সামনে যখন এসে গেছি দেখতে পেলাম গেটের কাঠে কটা ছোকরা দাঁড়িয়ে আছে। এ বাড়িরই ছেলে ওরা, খুব সম্ভব নাইট শোতে সিনেমা দেখে এসেছে; এখন তাই নিয়ে গল্প করছে।

আচমকা পিছন থেকে আমার ঘাড়ের পাশ দিয়ে একটা হাতবোমা উড়ে গিয়ে সামনের দেয়ালে ফাটল। দারুণ জোরে একটা শব্দ হল; সেই সঙ্গে আগুনের ঝলক চোখ ধাঁধিয়ে দিল। চমকে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পেলাম বিশ গজ দুরে দুটো লোক দাঁড়িয়ে আছে। বিদ্যুৎ চমকের মতো আমার মনে হল, সেদিন এরাই আমার পিছু নিয়ে এই গলিতে এসেছিল।

আমাকে ঘুরতে দেখেই ওরা আবার দুটো বোমা ছুড়ল। টার্গেটটা যে আমিই বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু এবারের দুটো বোমাও আমার গায়ে লাগল না; উড়ে গিয়ে ওধারের বাড়ির একটা দেয়ালে গিয়ে ফাটল।

হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু কিছু বুঝবার বা করবার আগেই দেখলাম হল্লা করতে করতে আমাদের বাড়ির সেই ছোকরারা সেই লোক দুটোর দিকে দৌড়ে গেল এবং চোখের পলকে একটাকে ধরেও ফেলল। অন্য লোকটাকে অবশ্য ধরা গেল না; সে অন্ধকারে সাপের মতো পিছনে বেরিয়ে গেছে।

বেদম পিটতে পিটতে টেনে হিঁচড়ে ছোকরাগুলো লোকটাকে যখন আমার কাছে নিয়ে এল তার নাক-মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে।

ছেলেদের থামিয়ে বললাম, কে তুমি?

হাতের পিঠ দিয়ে রক্ত মুছতে মুছতে লোকটা গোঙানির মতো শব্দ করল, আমাকে ছেড়ে দিন বাবু

ছেড়ে দেব কিন্তু তার আগে বলতে হবে কেন তুমি আমাকে পেটো মারলে? কে তোমাকে পাঠিয়েছে?

প্রথমে কিছুতেই বলবে না। শেষে যখন তার গলার নলি টিপে ধরে বললাম, জানে খতম করে দেব, তখন সব স্বীকার করল লোকটা। প্রবীর সিনহা তাদের আমার পিছনে লাগিয়েছে। কদিন ধরে আমাকে ফলো করে শেষ পর্যন্ত আজ তারা সুযোগ বুঝে বোমা ছুঁড়েছিল।

প্রবীর সিন্হা মানে রেস কোর্সের সেই ছোকরা। শমিতা বলেছিল সে খুব ডার্টি টাইপের লোক; ভয়ানক ভিনডিক্টিভ। ডার্টি টাইপ তাতে কোনওরকম সন্দেহ নেই। তবে তার সাহস যে নেই, সেটা সে প্রমাণ করে দিয়েছে। সাহস থাকলে সোজা আমার সামনে এসে চোয়াল ভেঙে দিত। তার বদলে দুটো থার্ড ক্লাস গুন্ডাকে আমার পিছনে লাগিয়েছে। হে মহান জনগণ, প্রবীরটা একেবারেই ছ্যাচড়া।

আমি লোকটাকে বললাম, ঘুরে দাঁড়া–

ভয়ে ভয়ে সে পিছন ফিরে দাঁড়াল। আমি তখন তার পাছায় টেনে একটা লাথি কষিয়ে বললাম, ফরোয়ার্ড।

লোকটা হুমড়ি খেয়ে রাস্তার ওপর পড়ল। তারপর ধাঁ করে উঠেই চো-চা ছুট। আমি আর দাঁড়ালাম না; ছেলেদের নিয়ে সদলবলে বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম প্রবীর সম্বন্ধে আমার আর দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে। ওর দৌড় আমার জানা হয়ে গেছে।

দেখতে দেখতে বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল। এর মধ্যে আমাদের পার্সোনাল ডিপার্টমেন্টটা তুলে দিয়ে প্ল্যানস নামে নতুন বিভাগটা খোলা হয়েছে। এ ব্যাপারে কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপনও দিয়েছে লতিকা। রেসপন্স ভালোই পাওয়া যাচ্ছে। লতিকা এবং আমার আশা এই ডিপার্টমেন্টটা দুমাস যদি টিকিয়ে রাখা হয় নিট লাখখানেক টাকা আমাদের হাতে এসে যাবে।

আজ আবার লতিকা অফিসে আসেনি। ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে বাড়ির একটা ব্যাপারে ভীষণভাবে আটকে গেছে। কাজেই কাচের দেয়ালের ওধারে আধখানা চেম্বার এখন ফাঁকা। লতিকা থাকলে খানিকক্ষণ গল্প-টল্প করা যায়। একলা বসে বসে ভীষণ বোরিং লাগছে; হাই উঠছে ঘন ঘন।

আরামদায়ক রিভলভিং চেয়ারে গা এলিয়ে যখন খানিকটা ঘুমিয়ে নেবার চেষ্টা করছি সেইসময় দরজার কাছে খুট খুট আওয়াজে তাকালাম। আর তাকিয়েই মনে হল আমার শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে বরফের মতো ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। মণিমোহন মল্লিক সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন।

চোখাচোখি হতেই মণিমোহন বললেন, মে আই কাম ইন

বিশেষ করে যার জন্যে পার্সোনাল ডিপার্টমেন্টটা তুলে দিতে হয়েছে তিনি যে এখানে সরাসরি চলে আসতে পারেন, ভাবতেই পারিনি। ভেবেছিলাম ডিপার্টমেন্ট ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ও ব্যাপারটার ওপর যবনিকা পতন হয়ে গেছে।

হে মহান জনগণ, আমার বেশ ভয়ই করতে লাগল কিন্তু কয়েক সেকেন্ড মাত্র। তারপরেই মণিমোহনকে দেখে খুশিতে ফেটে পড়ার মতো ভাব করে বললাম, আসুন স্যার, আসুন

মণিমোহন ভেতরে ঢুকে মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসলেন। তার হাতে একটা টেপ রেকর্ডার ছিল। সেটা আমার টেবলি রাখতে রাখতে বললেন, কদিন ধরেই আপনাকে ফোনে ধরবার চেষ্টা করছি কিন্তু যতবারই কানেকসান হচ্ছে ততবারই শুনছি পার্সোনাল বলে কোনও অফিস নেই। ব্যাপারটা কী বুঝবার জন্য সরেজমিন তদন্তে আসতে হল। অকুস্থলে এসে দেখি সত্যি সত্যি অফিসটা নেই। তার জায়গায় প্ল্যানস বলে একটা অফিস বসেছে। ওটা তো আপনারই?

স্বীকার করতে হল। ঢোঁক গিলে বললাম, হ্যাঁ। মানে ওই কারবারটা ভালো চলছিল না। তাই তুলে দিতে হল।

আমাকে এ ব্যাপারটা জানানো উচিত ছিল। কারণ আমি আপনার পার্সোনাল ডিপার্টমেন্টের ক্লায়েন্ট।

ভেবেছিলাম দু-একদিনের মধ্যেই জানিয়ে দেব।

কী একটু ভেবে মণিমোহন বললেন, ভালো কথা, আসবার সময় প্ল্যানসের পাশে পাস্ট-প্রেজেন্ট-ফিউচার আর ন্যাশনাল ডিটেকটিভ কনসার্ন বলে দুটো অফিসও দেখলাম। মনে হচ্ছে ওগুলোও আপনারই।

হে মহান জনগণ, এ রকম ঝামেলায় আগে আর কখনও পড়িনি। বিরুদ্ধ পক্ষের উকিলের মতো উল্টোপাল্টা জেরা করে লোকটা কী জানতে চায়? খুব সাবধানে তাকে লক্ষ্য করতে করতে বললাম, না-না, ওগুলোর সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। ওগুলো সেপারেট কনসার্ন।

স্থির চোখে আমার দিকে পুরো একটা মিনিট তাকিয়ে থাকলেন মণিমোহন। তারপর বললেন, ঠিক আছে, এবার তাহলে কাজের কথায় আসা যাক।

বাইরে স্মার্ট থাকলেও ভেতরে ভেতরে দারুণ উদ্বেগ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। মণিমোহন বললেন, ফোটোগ্রাফগুলোর কী হল?

ঢোক গিলে বললাম, এখনও তো অনেক সময় আছে।

অনেক নেই। আর মাত্র পাঁচটা দিন রয়েছে।

আচমকা আমার মনে পড়ে গেল, এ মাসের দশ তারিখ পর্যন্ত সময় দিয়ে রেখেছিলেন মণিমোহন। আর কী আশ্চর্য, মনোবীণা সান্যালও তো ওই একই তারিখ দিয়েছেন। আর আজ হল এ মাসের ফিফথ।

মণিমোহন আবার বললেন, আপনার মতলবটা কী?

তার গল্প স্বরে এমন কিছু ছিল যাতে চমকে উঠলাম। বললাম, মতলব?

আমার মনে হচ্ছে ফোটোগুলো আপনি দেবেন না। খুব সম্ভব এটাই আপনার মতলব।

হঠাৎ আমার রক্তের মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে গেল। প্রায় চিৎকার করেই বললাম, ঠিকই ধরেছেন, ফোটো আমি দেব না।

দারুণ ঠান্ডা গলায় মণিমোহন বললেন, আস্তে মহাশয়, আস্তে। ডোন্ট বি সো একসাইটেড। ওতে ব্লাড প্রেসার চড়ে যায়। একটু থেমে বললেন, কিন্তু আপনার সঙ্গে সেই রকম চুক্তিই ছিল। সেইজন্যে পাঁচ হাজার টাকা আর একটা দামি ক্যামেরা দিয়েছিলাম।

আপনার কথামতো কাজ করতে আমি রাজি না। তবে টাকাটা আর ক্যামেরা ফেরত দিতে রাজি আছি।

সেই সঙ্গে ফোটোগুলোও তুলে দেবেন।

নো, নেভার–দাঁতে দাঁত চাপলাম, আপনার মতো ব্ল্যাকমেলারের হাতে ওই নুড ছবি কিছুতেই তুলে দেব না।

পকেট থেকে পাইপ আর টোব্যাকো বার করলেন মণিমোহন। ধীরে সুস্থে পাইপে তামাক পুরতে পুরতে বললেন, দেবেন, নিশ্চয়ই দেবেন

তার মানে?

আমার কথার উত্তর না দিয়ে মণিমোহন জিগ্যেস করলেন, আপনাদের এখানে প্লাগ পয়েন্ট আছে।

অবাক হলেও বললাম, আছে।

কোথায়?

দেখিয়ে দিলাম। মণিমোহন উঠে গিয়ে প্লাগ পয়েন্ট কানেকসান করে টেপ রেকর্ডার চালিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে নিজের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। এতদিন মণিমোহনের সঙ্গে ফোনে যে সব কথা বলেছি সেগুলোই রেকর্ডার থেকে উঠে আসতে লাগল। যেমন আমি শমিতার ন্যড ছবি আর বেডরুম সিনের পিকচার তুলব।-এই কথাটাই বার বার শোনা যেতে লাগল। কিন্তু আশ্চর্য, মণিমোহন আমাকে যা-যা বলেছেন সেগুলো শুনতে পাচ্ছি না। তার মানে নিজের কথাগুলো মণিমোহন ইরেজ করে ফেলেছেন।

নিজের গলা শুনে আমার গায়ে কাঁটা দিল। গলগল করে ঘামতে লাগলাম। এদিকে টেপ রেকর্ডার থামিয়ে মণিমোহন বললেন, পাঁচ হাজার টাকা, ক্যামেরা আর শমিতার ফোটোগুলো দিতে এবার আর আপত্তি হবে না আশা করি। যদি হয় আমাকে এই টেপ রেকর্ডারটা নিয়ে কোর্টে যেতে হবে।

আমি কী বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই মণিমোহন আবার বলে উঠলেন, আমি আপনার কাছে এসেছি; ইচ্ছা করলে জোর করে এই টেপ রেকর্ডারটা কেড়ে নিতে পারেন। কিন্তু আপনার জেনে রাখা ভালো, এ রকম আরো পাঁচটা টেপে আপনার কথাগুলো ধরা আছে। কাজেই লাভ হবে না।

হে মহান জনগণ, আমার রি-অ্যাকশানটা নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন। এই লোকটা কী আশ্চর্য ঠান্ডা মাথায় একই সঙ্গে শমিতা আর আমাকে একই ফাঁদে ফেলতে চাইছে; একই সঙ্গে দুজনকে ব্ল্যাকমেলের জালে পোরার প্ল্যান নিয়েছে। মাথাটা দারুণ পরিষ্কার তার, কিন্তু আমার কোমরের বেল্ট আলগা হয়ে যাচ্ছিল। আমি কী বলব, বুঝতে পারছিলাম না।

এদিকে মণিমোহন মল্লিক উঠে পড়েছিলেন। টেপ রেকর্ডারটা হাতে ঝুলিয়ে বললেন, আর পাঁচ দিন দেখব। এর মধ্যে ফোটো, টাকা, ক্যামেরা না পেলে শমিতা বোসের ছবির জন্যে আমাকে অন্য লোক অ্যাপয়েন্ট করতে হবে। আর আপনার সম্বন্ধে আমি কিছু খোঁজ খবর নিয়েছি। সেই সব

আমি প্রায় আঁতকেই উঠলাম, আমার সম্বন্ধে কী খোঁজখবর?

এক্ষুনি বলছি না। পাঁচ দিন দেখব, তারপর যা হয় করব। আচ্ছা নমস্কার।

মণিমোহন মল্লিক চলে গেলেন। বেশ বুঝতে পারছি আমি লোকটার হাতের ভেতর চলে গেছি। বাঘ যেমন তার শিকার নিয়ে খেলে সেও আমাকে নিয়ে তেমনি খেলবে মনে হচ্ছে।

ইচ্ছা করলেই শমিতার নুড ছবি আমি তুলে দিতে পারি। কিন্তু না, কিছুতেই দেব না। হাজার রকম অ্যাডিকশান দিয়ে ঘেরা একটা নোংরা কদর্য ওয়ার্ল্ড থেকে যাকে বার করে এনেছি কিছুতেই তার ক্ষতি হতে দেব না। কিন্তু শমিতার সম্বন্ধে এত দুর্ভাবনা কেন আমার? হে মহান জনগণ, সেই কথাটা আরেকবার মনে পড়ে গেল–আমি কি তবে মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছি?

তিনটে দিন শমিতাকে একরকম পাহারা দিয়েই কাটিয়ে দিলাম। তারপর চতুর্থ দিন অফিসে আসতেই মনোবীণা সান্যালের ফোন এল। মনোবীণা বললেন, কাল ভোর পাঁচটার ভেতর একবার আসতে হবে; বিশেষ দরকার।

আমি বললাম, কিন্তু শমিতা যদি আমাকে আপনার সঙ্গে দেখে ফেলে—

অত ভোরে ও ওঠে না।

—আচ্ছা আসব।

পরের দিন ভোরে মনোবীণা সান্যাল তাদের বাড়ির বাইরের লনে আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। আমি যেতেই বললেন, আমি আপনার কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। ভোরাকে সত্যিই আপনি ফেরাতে পেরেছেন। তার ব্যাড হ্যাবিটগুলো কেটে যাচ্ছে। এখন ও আর ড্রিংক করে না; নেচারও অনেক চেঞ্জ হয়ে গেছে। রিয়ালি আই অ্যাম গ্রেটফুল টু ইউ

শুধুমাত্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্যেই কি মহিলা এত ভোরে আমাকে আসতে বলেছেন। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।

মনোবীণা আবার বললেন, এতটা করেছেন; এবার বাকি কাজটুকু কাইন্ডলি করে দিন।

কী কাজ?

হাত ব্যাগ খুলে দুটো ট্রেনের টিকেট আর একটা ঠিকানা বার করে আমাকে দিলেন মনোবীণা। দেখলাম টিকেট দুটো বম্বের। ঠিকানাটাও বম্বেরই–ডক্টর দেবতোষ বোস, আরব সাগর, ভিলে পার্লে স্কীম, সেভেন্থ ফ্লোর, সুইট নাম্বার ২৭, বম্বে।

মনোবীণা বলতে লাগলেন, আজই সন্ধের ট্রেনে ভোরাকে নিয়ে বম্বে চলে যান; ওকে ওই ঠিকানায় পৌঁছে দেবেন।

শমিতার মুখে তার বাবার কথা আগেই শুনেলািম। তবু ইচ্ছা করেই বললাম, এক্সকিউজ মি, একটা কথা জিগ্যেস করব?

কী?

ডক্তর দেবতোষ বোস কে?

মনোবীণা সেদিনের মতো রেগে উঠলেন না। আস্তে করে বললেন, শমিতার বাবা; আমার আগেকার স্বামী। একটু থেমে অন্যমনস্কর মতো আপন মনেই আবার বললেন, আমার লাইফটা তো নষ্টই হয়ে গেল। ডেরা ওর বাবার কাছে গিয়ে বাঁচুক।

আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু বাদেই মনোবীণার অন্যমনস্কতা কাটল। বললেন, তাহলে আজই যাচ্ছেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

ও ভালো কথা বলতে বলতেই মনোবীণা সান্যাল। ব্যাগ থেকে একটা সাদা এনভেলাপ আমার হাতে দিয়ে বললেন, এটার কথা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম।

কী এটা! আমি কিছুটা অবাকই হলাম।

আট হাজার টাকা আছে এতে। আপনার রেমুনারেশন দশ হাজারের মধ্যে দুহাজার অ্যাডভান্স করা ছিল। বাকিটা

এনভেলাপটা ফেরত দিতে দিতে বললাম, এটা নিতে পারব না।

মনোবীণা বিমূঢ়ের মতো তাকালেন, কেন?

আপনার কাজটা নেবার আগে শমিতার সঙ্গে পরিচয় ছিল না। তারপর ওর সঙ্গে আলাপ হল, ঘনিষ্ঠভাবে মিশলাম। নাউ উই আর গুড ফ্রেন্ডস। যদি কিছু আমি করে থাকি তা করেছি বন্ধুর জন্যে, কিছু করে মজুরি নিতে পারব না। অ্যাডভান্সের টাকাটা বম্বে থেকে ফিরেই সেটা দিয়ে যাব।

আমি চলে এলাম। মনোবীণা সান্যাল স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

হঠাৎ বম্বে যাবার কথা বলতে অবাক হয়ে গিয়েছিল শমিতা। কিন্তু আমার ওপর তার অগাধ বিশ্বাস। তাই একটা প্রশ্নও না করে আমার সঙ্গে পরশু দিন ট্রেনে উঠে পড়েছিল সে।

আজ সকালে আমরা বম্বের শহরতলীতে দাদার স্টেশনে পৌঁছেছি। সেখান থেকে ট্যাক্সিতে ভিলে পার্লে স্কিমে গিয়ে দেবতোষ বোসের স্যুইটটা যখন বার করলাম তখন নটাও বাজেনি।

কলিং বেল টিপতেই যিনি দরজা খুলে দিলেন তার বয়স পঞ্চাশ-বাহান্ন। ইস্পাতের ঝকঝকে ফলার মতো চেহারা, টকটকে রঙ, কাটা-কাটা ধারালো মুখ, শরীরের এক মিলিগ্রাম অনাবশ্যক মেদ নেই। তবে চোখ দুটি দূরমনস্ক। ইরেজিতে যাকে বলে ড্রিমি ঠিক তাই।

ভদ্রলোক কিছু বলবার আগেই হে মহান জনগণ, একটা দারুণ নাটকীয় ব্যাপার ঘটে গেল। হঠাৎ তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ডোরা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, বাবা, আমি–আমি ভোরা–

বুঝতেই পারলাম ইনি ডক্টর দেবতোষ বোস। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, তোর মা চিঠি দিয়েছিল; তুই আসবি। চল্ মা, ভেতরে চল্‌-আমার দিকে ফিরে বললেন, তোমার নাম তো রাজীব।

বললাম, আজ্ঞে হ্যাঁ।

এসো–

কিছুক্ষণ পর আবেগের ঢেউটা থিতিয়ে এলে একটা ঘরে শমিতা আর আমি মুখোমুখি বসলাম। সে বলল, এই জন্যেই তুমি আমাকে বম্বে এনেছিলে?

হ্যাঁ–আস্তে মাথা নাড়লাম, শুধু তাই না, তুমি যাতে তোমার বাবার কাছে আসতে পারো সেইজন্যেই তোমার সঙ্গে এতদিন মিশেছি, বন্ধুত্ব করেছি।

তোমার কথা বুঝতে পারছি না।

মনোবীণা সান্যাল আমার ওপর শমিতার কী দায়িত্ব দিয়েছিলেন এবং কীভাবে আমি তা পালন করেছি খুব সংক্ষেপে সে-সব জানিয়ে বললাম, পিতা এবং কন্যার পুনর্মিলন হয়ে গেছে। এবার আমার একজিটের পালা। আজই আমি চলে যাব শমিতা।

শমিতা হতবাক, আজই!

হ্যাঁ।

কেন, কদিন থেকে যাও না।

না, তার উপায় নেই। কলকাতায় আমার অনেক কাজ রয়েছে।

তবে আবার কবে তোমার সঙ্গে দেখা হচ্ছে?

আর দেখা না হওয়াই ভালো।

কেন?

তুমি আমাকে জানো না শমিতা–আমি একজন

একজন কী?

প্রতারক। তোমার জীবনে আমার ছায়া না পড়াই ভালো।

শমিতা বিষণ্ণ চোখে তাকাল, তুমি যাই হও, আমার তাতে দরকার নেই। তুমি আমার ফ্রেন্ড; আমি–আমি তোমাকে ভালোবাসি-

এই কথাটা চিরদিন মনে রাখব। আমি করুণ ভাবে হাসলাম।

দুদিন পর কলকাতায় ফিরে সোজা অফিসে চলে এলাম। কে জানত, পুলিশ ফাঁদ পেতে রেখেছে। অফিসে পা দিতে না দিতেই সেই ফাঁদে পড়ে গেলাম। চোখে পড়ল আমাদের তিনটে ডিপার্টমেন্ট অর্থাৎ পাস্ট-প্রেজেন্ট-ফিউচার, ন্যাশনাল ডিকেটটিভ কনসার্ন এবং প্ল্যানসের দরজায় তালা ঝুলছে। তার মানে পুলিশই ওগুলো সিল করে দিয়েছে। এটা কার কাজ বুঝতে পারছিলাম। মণিমোহন মল্লিক তার কথা রেখেছেন।

আমাকে ধরে পুলিশ সোজা হাজতে পুরে দিল। আমার বিরুদ্ধে হাজার গন্ডা চিটিংবাজির অভিযোগ রয়েছে। হে মহান জনগণ, এ সব অভিযোগের একটাও মিথ্যে নয়।

সকালে ধরা পড়েছিলাম। কোত্থেকে কীভাবে খবর পেয়ে বিকেলে লতিকা আমাকে দেখতে এল।

লোহার গরাদের ওধারে দাঁড়িয়ে একটা কথাও বলতে পারছিল না লতিকা। তার ঠোঁট থরথর করে কাঁপছিল আর চোখ জলে ভরে যাচ্ছিল। হে মহান জনগণ, মেয়েটা সত্যিই মরেছে। আমার মতো মানুষকে ভালোবাসার কোনও মানে হয়! হাত বাড়িয়ে লতিকার একটা হাত ধরে বললাম, কেঁদো না লতিকা, কেঁদো না। এখান থেকে নিশ্চয়ই একদিন বেরুতে পারব। তখন নতুন করে আবার জীবন শুরু করা যাবে।

লতিকার চোখের জল গালের ওপর দিয়ে ঢলের মতো নামতে লাগল।

হে মহান জনগণ, একবার মাত্র একবারই আমি প্রতারণা করতে চাইনি, চিটিংবাজি কতে চাইনি। আর ওই কারণে আজ আমাকে এখানে—এই হাজতে চলে আসতে হয়েছে।

আমার কথা তো শুনলেন। আপাতত এখানেই শেষ করা যাক। নমস্কার।

Pages: 1 2 3 4 5
Pages ( 5 of 5 ): « পূর্ববর্তী1 ... 34 5

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress