নিখুঁত খুনের অ্যানাটমি
অনেক ভেবেচিন্তে নীতিশ দত্ত ঠিক করলেন, তাঁর স্ত্রীকে স্বর্গের সিঁড়ি দেখাবেন। প্রত্যেকেরই একটা সহ্যের সীমা আছে। সে-সীমা অতিক্রম করলে কারও পক্ষেই ধৈর্য ধরা সম্ভব নয়। সুতরাং বর্তমান ক্ষেত্রে তিনিও অধৈর্য হয়ে উঠেছেন…।
কামিনীর সঙ্গে নীতিশের বিয়ে হয়েছে পঁচিশবছর। এখন ষাটের কোঠায় পৌঁছে তাঁর মনে হয়েছে, কামিনীর এতদিনকার অবিচারের প্রতিফল হিসেবে ওকে খুনই করা উচিত। বিয়ের পর থেকেই বউয়ের বুড়ো আঙুলের তলায় তাঁকে জীবন কাটাতে হয়েছে। একমুহূর্তের জন্যও কোনও কথার প্রতিবাদ করতে পারেননি। কামিনীর কথায় উঠেছেন, বসেছেন। অনেক সময় মন বিদ্রোহ করতে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি। মেরুদণ্ড কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়েছে। আসলে স্ত্রীকে তিনি ভীষণ ভয় পান। অন্তত পাড়াপড়শিরা তাই জানে। স্ত্রীর বহু অত্যাচার তিনি মুখ বুজে সহ্য করেছেন। তাই আজ রাতে কামিনীকে এই চরম শাস্তি দিতে চান—।
রোজকার মতো দোকান খুলে কাউন্টারের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন নীতিশ। পাঁচটা বেজে গেছে। বাইরে আলো কমে এসেছে। গত পঁচিশবছর ধরে এ নিয়মের হেরফের হয়নি। সকাল আটটা থেকে দুপুর একটা। আবার বিকেল পাঁচটা থেকে ঠিক রাত ন’টা। আজ দোকান খুলে থিতু হয়ে বসতেই এসে ঢুকল চুনি মণ্ডল। নীতিশকে দেখে হাসল: দত্তবাবু, আমার এক পাউন্ড রুটি লাগবে…আর মিসেস কোথায় গেলেন?—চোখ নাচাল চুনি।
কামিনী ঘুমোচ্ছে, এক্ষুনি আসবে।—এক পাউন্ড রুটি চুনির দিকে এগিয়ে দিলেন নীতিশ। পয়সা দিয়ে বাইরে পা বাড়াল মণ্ডল। দরজার কাছ থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, দত্তদা, হিসেবের খাতায় দামটা টুকে রাখুন। নয়তো বউদি এসে ধমক লাগাবে’খন।—হেসে বেরিয়ে গেল সে।
রাগে আপাদমস্তক জ্বলে গেল নীতিশের। না, অবাক হওয়ার কিছু নেই। গত পঁচিশবছর ধরেই এ ধরনের কথা তাঁকে শুনতে হচ্ছে…।
কী হল? ঘুমোচ্ছ নাকি! এত বয়স হল, তবু একটা জ্ঞানগম্যি নেই? বলি, দামটা খাতায় তুলবে কে—হ্যাঁ?—বাজখাঁই গলার চিৎকারে চমকে ফিরে তাকালেন নীতিশ। কামিনী দত্ত এসে দাঁড়িয়েছে দোকানে। মোটাসোটা ফুটবলের মতো চেহারা। দু-চোখে ক্রুর চাউনি।
ওহ—হ্যাঁ। একদম ভুলে গেছি।—তাড়াতাড়ি পেনসিল বাগিয়ে এক পাউন্ড রুটির দাম খাতায় টুকতে লাগলেন।
কামিনী দত্ত আগুনঝরা দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইল গোবেচারি স্বামীর দিকে। গোল-গোল পেঁচার মতো চোখে রিমলেস চশমা। ঝাঁটা গোঁফ। ছোট চেহারা। গালের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে! ষাট বছরেই যেন যমের ঘরে পা বাড়িয়ে রেখেছেন। কিন্তু কামিনী জানে না মনে-মনে কী কুটিল অভিসন্ধি এঁটেছে তার এই থুত্থরে বুড়ো স্বামী।
ন’টা বাজতেই সোজা হয়ে বসলেন নীতিশ। ঠিক এই মুহূর্ত থেকেই ওঁর অভিনয় শুরু হবে। তিনি জানেন স্ত্রী হত্যার প্রথম সন্দেহভাজন ব্যক্তি মৃতার স্বামী। এসব জেনেও তিনি ভয় পাননি। এমনভাবে কাজটা ওঁকে সারতে হবে, যাতে কাকপক্ষীও না সন্দেহ করে। এখনকার কাজগুলোর ওপরেই নির্ভর করবে ওঁর এই অদ্ভুত খুনের সাফল্য।
কামিনী এক কোণে বসে রোজকার বিক্রির হিসেব কষছিল। দোকানের শেষ খদ্দের যখন দোকান ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, তখন ব্যস্ততার ভান করলেন নীতিশ। দোকানের টুকিটাকি কাজ নিয়ে পড়লেন। অন্যান্য দিন শেষ খদ্দেরের পিছন-পিছন গিয়ে তিনি সদর দরজা বন্ধ করেন। কিন্তু আজ তা করলে চলবে না। কারণ, আজ তিনি সদর দরজা বন্ধ করবেন না।
যেতে-যেতে থমকে দাঁড়াল শেষ খদ্দের! মিস্টার দত্ত, ন’টা তো বেজে গেল, দোকান বন্ধ করবেন না?
হ্যাঁ—হ্যাঁ—। হাতের কাজটা সেরে নিই, এখুনি বন্ধ করছি।—মনে-মনে ব্যাটাকে প্রাণ খুলে গালাগাল দিলেন। পরের চরকায় কেন তেল দিতে আসছ বাবা। দোকান বন্ধ করি কি না করি তাতে তোমার কী?
খদ্দেরটি বেরিয়ে যেতেই সদর দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন নীতিশ।
কী হল কী? যাওয়ার সময় উনি কী বলে গেলেন শোনোনি? কানে কি গজাল গেঁথে বসে আছ? দরজাটায় খিল লাগিয়ে ছিটকিনি এঁটে তালা-টালা মারো। হোপলেস কোথাকার।—খেঁকিয়ে উঠল কামিনী।
হ্যাঁ—লাগাচ্ছি। আগে ঘরটা ঝাঁট দিয়ে নোংরাগুলো বাইরে ফেলে আসি, তারপর বন্ধ করছি।—চুপচাপ ঝাঁটা দিয়ে কাজ শুরু করলেন নীতিশ। নোংরাগুলো একটা টিনে ভরে (গত পঁচিশবছর ধরে এই একই কাজ করে আসছেন তিনি) দোকানের পিছনদিকের খিড়কি দরজা খুলে বেরোলেন। সামনে একফালি খোলা জায়গা। ঘুটঘুটে অন্ধকার।
মুহূর্তের মধ্যে নীতিশ তৎপর হয়ে উঠলেন।। কোথায় গেল ষাটবছরের বৃদ্ধের জড়তা! টিনটা ফেলে রেখে অন্ধকার কোণ থেকে একটা শাবল তুলে নিয়ে ছুটে বেরোলেন।
দোকানের পিছনে একটা সরু অন্ধকার গলি। রাত আটটার পরই গলিটা একদম ফাঁকা হয়ে যায়। আর এখন তো রাত ন’টা!
গলিটা নির্জন—খাঁ-খাঁ করছে। ছুটে গেলেন গলির একমাত্র ম্যানহোলটার কাছে। শাবলের চাড় দিয়ে লোহার ঢাকনাটা তুলে একপাশে সরালেন। তারপরই আবার ছুটে চললেন দোকানের দিকে। শাবলটা আগের জায়গায় ঠক করে নামিয়ে রেখে হাঁপাতে-হাঁপাতে দোকানে গিয়ে ঢুকলেন।
এতক্ষণ ধরে কি ওই নোংরাগুলো গিলছিলে? কখন থেকে…এ এ কী!
আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে উঠল কামিনী দত্তর দু-চোখ, যেন কোটর ছেড়ে লাফিয়ে বেরিয়ে আসবে।
কারণ, নীতিশের হাতের পাঞ্জায় ধরা একটা গাঢ় নীল রঙের অটোমেটিক রিভলভার। তার নলটা তাক করে আছে কামিনীর দু-চোখের ঠিক মাঝখানে। পরক্ষণেই—গুড়ুম—।
কামিনী লুটিয়ে পড়তেই একহাতে ওর শরীরটা ধরে ফেললেন নীতিশ। সাবধানে শুইয়ে দিলেন কাউন্টারের পিছনে। রিভলভারটা পকেটে পুরে ফেললেন। ক্যাশের সমস্ত টাকা একটা ব্রিফকেসে ভরতি করে তালা এঁটে দিয়েছিল কামিনী। এক হ্যাঁচকায় সেটাকে তুলে নিয়ে ছুটে চললেন ম্যানহোলের দিকে।
ঢাকনাটা খোলাই ছিল। রিভলভার এবং টাকার ব্যাগটা ওর ভেতরে ফেলে ঢাকনা বন্ধ করে তিনি আবার দোকানে ফিরে এলেন।
খুব সতর্কভাবে নীতিশকে প্রত্যেকটি কাজ করতে হবে। এইবার শুরু হল কাজের দ্বিতীয় পর্যায়।
সাড়ে তিনবছর আগে নীতিশের দোকানে একবার ডাকাত পড়েছিল। শীতের সময় রাত আটটা নাগাদ ব্যাপারটা হয়েছিল। তখন কামিনী বাধা দেওয়ায় ডাকাতদলের একটা লোক গুলি চালায়। সেই গুলিতে কামিনী বাঁ-হাতে চোট পায়। তারপর থেকেই ওর বাঁ-হাতটা সামান্য বেঁকা।
কামিনী এমনিতে দজ্জাল, ডাকাবুকো। ওর সাহসের কোনও কমতি নেই। ওরা বেজায় বড়লোক। তা ছাড়া ওর রিলেটিভরা এক-একজন কেউকেটা। ফলে ওই ডাকাতির ঘটনার পর কামিনী বেঁকে বসল। বলল, লাইসেন্স করা একটা রিভলভার ওর চাই-ই চাই।
ওর বায়না মিটতে তেমন দেরি হল না। ওর এক মামা ডেপুটি পুলিশ কমিশনার। তিনিই কীভাবে যেন কলকাঠি নেড়ে আদরের ভাগ্নীকে একটি রিভলভারের লাইসেন্স করিয়ে দিলেন। ০.২২ ক্যালিবারের ছোট্ট বন্দুক। সেটা সবসময় কাউন্টারের নীচে একটা ড্রয়ারে রাখা থাকে—চোর-ডাকাত ঠেকানোর জন্য। এই বন্দুকটাই নীতিশকে আজকের এই প্ল্যান জুগিয়েছে।
চটপট ড্রয়ার খুলে সেই রিভলভারটা বের করলেন নীতিশ। যা করার জলদি করতে হবে। হাতে একদম সময় নেই।
রিভলভারটা ভালো করে মুছে অতি সাবধানে কামিনীর ডেডবডির ওপরে ঝুঁকে পড়লেন। স্ত্রীর প্রাণহীন নিশ্চল ডানহাতটা টেনে নিয়ে রিভলভারের বাঁটের ওপর চেপে ধরলেন ওর হাতের পাঁচ আঙুল। তারপর রিভলভারটা তুলে নিয়ে নিজের মুঠোয় বাগিয়ে ধরে ছুটলেন। লক্ষ্য পিছনের সরু গলি…।
হুড়মুড় করে গলিতে পৌঁছে (এসবই অভিনয়ের অংশ) খুব নিখুঁতভাবে কাজগুলো করতে হবে নীতিশকে। কারণ, স্ত্রী মারা গেলে স্বামীকেই প্রথম সন্দেহ করা হয়। সুতরাং একমুহূর্ত থমকে দাঁড়ালেন। পরক্ষণেই গলির অন্ধকার দিকটা লক্ষ্য করে ফায়ার করলেন—একবার-দুবার—রাতের নিস্তব্ধতাকে খানখান করে ভেসে এল গুলির শব্দ—গুড়ুম-গুড়ুম—।
রিভলভারটা নামিয়ে শ্লথ পায়ে টলতে-টলতে দোকানে ফিরে এলেন নীতিশ। এসে দেখেন যা ভেবেছেন ঠিক তাই। তাঁদের ওপরতলার ভাড়াটে, বৃদ্ধ কুমার চক্রবর্তী, নেমে এসেছেন দোকানে। হতভম্বের মতো চারপাশে তাকাচ্ছেন—।
এই যে, নীতিশ—কী হয়েছে? কীসের একটা আওয়াজ পেলাম মনে হল। তোমার ওয়াইফ কোথায়?
নীতিশ টলতে-টলতে কাউন্টারের পিছনে গেলেন। হাত থেকে রিভলভার খসে পড়ল। জল ভরা চোখে ঝাঁপিয়ে পড়ল কামিনীর মৃতদেহের ওপরে। চমকে উঠে কাউন্টারের এপাশে এলেন চক্রবর্তী: ও গড—নীতিশ, কী করে এসব হল? শিগগিরই পুলিশে খবর দাও—।
নীতিশ ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। চোখের জল মুছে এগিয়ে গেলেন দোকানের টেলিফোনটার দিকে…।
তার মানে আজ আপনি ন’টার সময় দরজা বন্ধ করেননি?—নীতিশের দিকে ক্রুর দৃষ্টি মেলে ধরলেন ইন্সপেক্টর সুনীল ধর: অথচ বছরের পর বছর ঠিক ওই সময়েই আপনি দরজা বন্ধ করে এসেছেন।—ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত নয়, মিস্টার দত্ত?
না…মানে, একটা কাজে আটকে পড়লাম—তাই তক্ষুনি বন্ধ করা হয়ে ওঠেনি—।
দোকানের বাইরে লোক গিজগিজ করছে। খবর পেয়ে এই রাতবিরেতেও সবাই ছুটে এসেছে।
সেই ভিড়ের মধ্যে থেকে এগিয়ে এল সেই শেষ খদ্দের। ইন্সপেক্টরের দিকে তাকাল: উনি ঠিকই বলেছেন, স্যার। আমি যখন বেরিয়ে যাই তখন উনি কৌটোগুলো সাজিয়ে রাখছিলেন।
তাই বুঝি?—ঝকমক করে উঠল ইন্সপেক্টরের চোখ। কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন দত্তর দিকে। তারপর অপেক্ষমাণ কনস্টেবলকে বললেন, এই, সব লোকগুলো হটাও—।
মুহূর্তে দোকান ফাঁকা করে ইন্সপেক্টর দরজা বন্ধ করে দিলেন।
আসুন, মিস্টার দত্ত, এখানটায় বসা যাক—আর-একবার শোনা যাক আপনার গল্পটা।
নীতিশ ইন্সপেক্টরের কাছে এসে বসলেন।
ওদিকে তখন ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্টরা তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছে। চষে ফেলছে গোটা দোকানটা।
বলুন, মিস্টার দত্ত—গোড়া থেকে বেশ ধীরেসুস্থে বলুন। যেন কোনও ভুল না হয়।
নীতিশ দত্ত ওঁর গোল-গোল চোখ তুলে তাকালেন ঠিক কীভাবে যে শুরু করব বুঝতে পারছি না।…ওই ভদ্রলোক—মানে, আমার শেষ খদ্দেরটি চলে যাওয়ার পর আমি সদর দরজা ভেজিয়ে দিই। তারপর রোজকার মতো নোংরার টিনটা জায়গামতো রেখে ফিরে আসতেই দেখি একটা লোক রিভলভার উঁচিয়ে ধরেছে আমার ওয়াইফের দিকে। আমাকে দেখতে পেয়ে ইশারায় কাছে যেতে বলল। আমাদের দুজনকে রিভলভারের ডগায় দাঁড় করিয়ে ক্যাশভরতি ব্যাগটা তুলে নিল। ঠিক এময় সময় কামিনী ড্রয়ারে রাখা ওর রিভলভারটা লুকিয়ে বের করতে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে ডাকাতটা গুলি করল—ওঃ! কামিনী পড়ে যেতেই লোকটা খিড়কি দরজা দিয়ে ছুটে পালাল। কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। তারপর এক হ্যাঁচকায় কামিনীর হাতের মুঠোয় ধরা রিভলভারটা টেনে নিয়ে ছুটলাম। পেছনের সরু গলিটায় পৌঁছেই লোকটাকে দেখতে পেলাম। সঙ্গে-সঙ্গে গুলি করলাম—দুবার—। মনে হল লোকটা একটু টলে পড়ল—তারপরই মিলিয়ে গেল—। দু-হাতে মুখ ঢাকলেন নীতিশ। তিনি জানেন, ওঁর এই হাবাগোবা, ভালোমানুষ চেহারাটাই ইন্সপেক্টরকে ভাবিয়ে তুলেছে সত্যিই তিনি খুন করেছেন কি না।
সুনীল ধরের কথায় ওঁর চমক ভাঙল, ডাকাতটার চেহারার একটা বর্ণনা দিতে পারেন, মিস্টার দত্ত?
এ প্রশ্নের জন্য নীতিশ তৈরিই ছিলেন, জবাব দিলেন, মোটা গোঁফ। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। বড় জুলপি। ডান ভুরুর ওপর একটা লম্বা কাটা দাগ। গর্তে বসা ছোট চোখ। থ্যাবড়ানো নাক। তার পাশে একটা আঁচিল—।
চমৎকার, চমৎকার,—পেনসিল আর নোটবই হাতে উঠে দাঁড়ালেন সুনীল: নিখুত বর্ণনা দিয়েছেন। কিন্তু মিস্টার দত্ত, একটা কথা আপনাকে গোড়াতেই জানিয়ে রাখা ভালো: কোনও ম্যারেড মহিলা মারা গেলে, মানে খুন হলে, আমরা তাঁর হাজব্যান্ডকেই প্রথম সন্দেহ করি। আমিও সন্দেহ করব আপনাকেই— যদিও আপনার চেহারা দেখে মনে হয়, একটা মশা মারতেও আপনি দশবার চিন্তা করবেন। কিন্তু কে জানে…! যাকগে, আজ আমি চললাম। কাল আবার দেখা হবে, এই দোকানে। কোনও খুন-টুন হলে আমি তন্নতন্ন করে খুনি খুঁজে বেড়াই। ওটা আমার একটা ম্যানিয়া…।
পরদিন সন্ধেবেলা ইন্সপেক্টর একাই এলেন। নীতিশ দোকান খোলেননি। ঠিক করেছেন স্ত্রী মারা গেছেন বলে দিন-সাতেক বন্ধ রাখবেন।
আসুন, মিস্টার ধর। কোনও খবর পেলেন ওই লোকটার?—আগ্রহ ফেটে পড়ছে নীতিশের গলায়।
স্থির চোখে নীতিশের দিকে চেয়ে রইলেন ইন্সপেক্টর, বললেন, বোধহয় আপনার ডেসক্রিপশানের কোনও লোকই পৃথিবীতে নেই—।’
চমকে উঠলেন নীতিশ: তার মানে? তার মানে কী, ইন্সপেক্টর?
আজ সারাটা দিন ধরে আমাদের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের পঁয়তাল্লিশজন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে। না, আপনার বর্ণনা মতো কোনও লোকের ছবিই আমাদের ফাইলে নেই। তা হলে আর বাকি থাকে মাত্র দুটো সম্ভাবনা এক, ডাকাতটা এ-লাইনে নতুন। দুই, ডাকাতের ব্যাপারটা পুরো গাঁজাখুরি। মানে, আপনার বানানো।—মুচকি হেসে থামলেন, সুনীল।
কী—কী বলতে চান আপনি?—রাগে নীতিশের চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে।
উত্তেজিত হবেন না, মিস্টার দত্ত। আমি তো আগেই বলেছি, যত অসম্ভব আর অবাস্তব মনে হোক না কেন, আপনাকেই আমি সন্দেহ করি। আর রিভলভারের ছাপ আমরা পরীক্ষা করেছি। তাতে আপনার প্রিন্ট ছাড়াও মিসেস দত্তর পার্শিয়াল প্রিন্ট পাওয়া গেছে। হয়তো আপনার কথাই সত্যি: মিসেস দত্ত গুলি খেয়ে পড়ে যাওয়ার পর আপনি রিভলভারটা নিয়ে ডাকাতটাকে তাড়া করেন। কিন্তু আমার মনে হয়, ডেডবডির হাতে রিভলভারটা চেপে ধরে প্রিন্ট তৈরি করা এমন কিছু অসম্ভব নয়—কী বলেন?…সত্যি, মিস্টার দত্ত, খুনটা যদি আপনিই করে থাকেন তবে আপনাকে সাবাশ দিতে হয়।
আবার ব্যাপার কী জানেন? আপনার কথামতো একটা গুলি পেছনের গলির দেওয়ালের গা থেকে আমরা পেয়েছি। দ্বিতীয়টা পাইনি। হয়তো লোকটার গায়েই ওটা লেগেছে। এখানকার সব ডাক্তার আর হসপিটালকে আমরা অ্যালার্ট করে দিয়েছি। কোনও গুলির চোট খাওয়া লোক যদি তাদের কাছে যায়, তবে তারা যেন সঙ্গে-সঙ্গে খবর দেয়। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি। যদি আপনার কথামতো কোনও ডাকাত ও-কাজটা করে থাকে, তবে আমরা যেভাবে হোক মালকে ভেতরে ঢোকাবই। শুধু একটু খাটতে হবে এই যা। আর সে-লোক যদি আপনি হন, তবে তো হাতের কাছেই আপনাকে পাওয়া যাবে—। দরজার দিকে পা বাড়ালেন ধর হ্যাঁ, একটা কথা—। ইন্সপেক্টর ঘুরে দাঁড়ালেন।
নীতিশের হৃৎপিণ্ড যেন হোঁচট খেল: কী—কী কথা?
সামান্য ব্যাপার। আপনি বলছিলেন না, নোংরার টিনটা রেখে আপনি যখন দোকানে ফিরে আসছিলেন, তখনই ডাকাতটাকে দেখতে পান। কিন্তু খটকাটা কোথায় জানেন? টিনটা আপনি জায়গামতো রাখেননি। মাঝপথেই নামিয়ে রেখে—ভগবান জানেন তারপর কী করেছেন!
ইস—ক্ষুব্ধ হলেন নীতিশ। কী বোকার মতো কাজই না করেছেন! শাবলটা তুলে নেওয়ার সময়ে টিনটা মাঝপথেই নামিয়ে রেখেছিলেন। জায়গামতো রাখার আর সুযোগ পাননি। কী হবে এখন?
ইন্সপেক্টর, দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না—মানে, গত পঁচিশবছর ধরে ওই একই জায়গায় টিনটা রাখি তো—তাই মনে হয়েছিল কালও বোধহয় রেখেছি…। ওহ—হ্যাঁ, এখন মনে পড়েছে।..টিনটা নিয়ে যাওয়ার সময় দোকানের দরজা খোলার শব্দ পেয়ে টিনটা মাঝপথেই নামিয়ে রেখে ফিরে আসি—।
যা ইচ্ছে বলুন…কোনও সাক্ষী তো আর নেই! আপনি যা বলবেন, তাই আমাকে মেনে নিতে হবে।—ইন্সপেক্টর হাসলেন: তবে একটা কথা বলে রাখি, সাক্ষী আমি খুঁজে বের করবই। আজই খবরের কাগজে একটা অ্যাড দিচ্ছি—লাস্ট আট তারিখ রাত ন’টা থেকে সাড়ে ন’টার মধ্যে কেউ এই এরিয়ায় কোনও পিকিউলিয়ার ঘটনা দেখেছে কি না। দেখা যাক, কোনও রেসপন্স যদি পাওয়া যায়।—দোকান ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন সুনীল ধর।
চিন্তিত মুখে দরজা বন্ধ করলেন নীতিশ। কাল সকালে আবার কী সংবাদ শুনবেন, কে জানে!
পরদিন দুপুরে ইন্সপেক্টর আবার এলেন।
দত্ত দোকানেই ছিলেন। ওঁকে লক্ষ করে সুনীল বললেন, ‘আপনাকে কতগুলো খবর শোনাব। ভীষণ ইন্টারেস্টিং খবর। প্রথমে দু-চারটে কথা বলে নিই। আপনার পাড়াপড়শির কাছে আমি খোঁজ নিয়েছি। খোঁজ নিয়ে একটু অবাকও হয়েছি। কারণ ওইরকম জাঁদরেল মহিলাকে অনেকদিন আগেই আপনার খুন করা উচিত ছিল। আমার ভেবে অবাক লাগছে, আপনি পঁচিশবছর ওয়েট করলেন কেন?
কী বলছেন আপনি!—প্রতিবাদ করলেন নীতিশ, আপনাকে তো বলেছি, ডাকাতটা কামিনীকে…।
জানি, জানি।—একহাত তুলে বাধা দিলেন ধর তবে ব্যাপারটা কী জানেন, আপনি বড্ড বেশি পারফেক্ট ডেসক্রিপশান দিয়ে ফেলেছেন, মিস্টার দত্ত। আমার মনে হয়, ওইরকম মেন্টাল অবস্থায় যেখানে আপনি লোকটাকে কয়েক মুহূর্তমাত্র দেখেছেন, কারও পক্ষে অত নিখুত বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। ব্যাপারটা একটু অস্বাভাবিক নয়?
যাকগে, এবার আসল খবরটা শুনুন। গত ৮ তারিখে রাত ন’টা বেজে সাতমিনিটের সময় পেছনের গলিটা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন অশোক রায়। হঠাৎ গাড়ির হেডলাইটের আলোয় একটা অদ্ভুত জিনিস তিনি লক্ষ করেন। গলির ম্যানহোলের ঢাকনাটা খোলা—একপাশে সরানো। হয়তো কোনও গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করতে পারে ভেবে তিনি গাড়ি রেখে মিনিট-দশেক পরে পায়ে হেঁটে ম্যানহোলটার কাছে ফিরে আসেন—কিন্তু…।
নীতিশের মুখে সীমাহীন উৎকণ্ঠা।
মুচকি হেসে ইন্সপেক্টর হাতের একটা ভঙ্গি করলেন, বললেন, কিন্তু সেই ঢাকনাটা এবার বন্ধ ছিল। অর্থাৎ, কোনও কারণে কেউ ওই ঢাকনাটা খুলেছিল। কিন্তু কেন? সেটা জানার জন্যে আমরা ওটা তন্নতন্ন করে লোক দিয়ে সার্চ করিয়েছি। তাতে পাওয়া গেছে এই রিভলভারটি।
পকেট থেকে একটা রিভলভার বের করে দেখালেন ধর, বললেন, ব্যালিস্টিক রিপোর্টে জানা গেছে, এটা থেকেই আপনার মিসেসকে গুলি করা হয়েছিল। রিভলভারটা চোরাই—কিন্তু এটা কোথা থেকে বিক্রি করা হয়েছে সেটা একটু খোঁজ করলেই জানা যাবে।
হৃৎপিণ্ডের উত্তালগতি কি কিছুতেই শান্ত হবে না? নীতিশ ভয় পেলেন। যদি পুলিশ বের করে ফ্যালে কার কাছ থেকে তিনি ওই রিভলভারটা কিনেছিলেন! যদি সে নীতিশের কথা বলে দেয়! ওঃ—তিনি আর ভাবতে পারছেন না!
কিন্তু ইন্সপেক্টর, ওই ম্যানহোল থেকে আপনারা আর কিছু পাননি?
ঠিক এই প্রশ্নটাই আপনার কাছ থেকে এক্সপেক্ট করছিলাম। আপনি ঠিক সেই কতাটা ভেবেছেন দেখছি। হ্যাঁ, ক্যাশ ভরতি ব্যাগটাও আমরা ওখানে পাব বলে ভেবেছিলাম—কিন্তু পাইনি। ওটা পাওয়া গেলে বোঝা যেত আসল ব্যাপারটা। ব্যাগটা যদি টাকাভরতি থাকে, তবে ম্যানহোলের ঢাকনা আপনিই সরিয়েছিলেন। গর্তের ভেতরে ফেলে দিয়েছিলেন ব্যাগ আর রিভলভারটা। কিন্তু ব্যাগটা যদি খালি থাকে, তবে বুঝতে হবে ব্যাপারটা ডাকাতটারই কাজ। মানে, বুঝতে পারছেন, আমাদের হাতে দুটো ক্লু। টাকাভরতি ব্যাগ আর রিভলভার। রিভলভারটায় কোনও প্রিন্ট আমরা পাইনি। বোধহয় ড্রেনের জলে নষ্ট হয়ে গেছে। তবুও…আপনার একসেট প্রিন্ট তো আমাদের কাছে আছে…ওগুলো ম্যাচ করিয়ে…। ইন্সপেক্টর আর কথা শেষ করলেন না।
ইন্সপেক্টর চলে যেতেই তৎপর হয়ে উঠলেন নীতিশ। যদি ওরা সেই লোকটাকে খুঁজে বের করে, তার কাছে যায়, তা হলেই সর্বনাশ!
আর দেরি না করে শোওয়ার ঘরে গেলেন। তোশকের নীচে রাখা ছিল কয়েকটা ০.২২ বোরের গুলি। কামিনীই কিনে এনেছিল ওর রিভলভারের জন্য। গোটাতিনেক পকেটে পুরলেন। তারপর নীচে এসে খিড়কি দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লেন। চুপিসাড়ে নিঃশব্দে…সরু গলিটা ধরে দ্রুতপায়ে এগিয়ে চললেন…।
এই যে মিস্টার দত্ত, কী মনে করে? রিভলভারটা কেমন কাজ দিচ্ছে?— উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে উঠল রমেশ পাত্র।
ব্যাটা তা হলে ওঁকে চিনতে পেরেছে। ভাগ্যিস সুনীল ধর আগে খবর দিয়েছিলেন!
রমেশ চোরাই রিভলভার বিক্রি করে। পুরোনো মাস্তান। বয়েস পঞ্চাশের কোঠায়। সবসময় হাসিখুশি। জোড়া জোড়া ভুরুর নীচে বড়-বড় চোখ।
হ্যাঁ, ভালোই কাজ দিচ্ছে।—রমেশের কাছে এগিয়ে গেলেন দত্ত কিন্তু আর একটা ০.২২ আমার দরকার…।
আসুন, ভেতরে আসুন।—চাপা স্বরে আহ্বান জানাল রমেশ।
ভেতরের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল পাত্র, বলল, বসুন—।
এর পরের ঘটনা ভাবতেই নীতিশের গায়ে কাঁটা দেয়। নিতান্ত মরিয়া না হলে মানুষ এসব কাজ পারে না। আর নীতিশ দত্ত যে মরিয়া সেটা ওঁর চেয়ে ভালো আর কে জানে!
রমেশকে আরও দুটো রিভলভার কেনার কথা বলেছেন নীতিশ। দুটোই সাইলেন্সার সমেত হওয়া চাই। একইসঙ্গে তিরিশহাজার টাকা ক্যাশও গুঁজে দিয়েছেন লোকটার হাতে।
তাতে কাজ হল মন্ত্রের মতো। টাকাটা পকেটে পুরুল রমেশ। ওর চোখ লোভে ঝকঝক করে উঠল।
পরশু মাল পেয়ে যাবেন।—রমেশ বলল, বাকি টাকা ক্যাশে নিয়ে আসবেন।
কোথায়?
বেলেঘাটার মোড়ে…বাসস্টপে…রাত ন’টায়। আমি নিজে থাকব—নীল জামা সাদা প্যান্ট পরে…।
রাজি হয়ে গেলেন নীতিশ।
ঠিক ন’টায় দুজনের দেখা হল। হাতে একটা জুতোর বাক্স ঝুলিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় হাজির হলেন নীতিশ।
বাসস্টপে দু-চারজন লোক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। নীতিশ লক্ষ করলেন রমেশ পাত্রর হাতে একটা বড় নাইলনের থলে—জামাকাপড়ে ঠাসা।
নীতিশ কাছে যেতেই রমেশ চাপা গলায় বলল, মাল এনেছেন?
এনেছি—। —বলে হাতে ঝোলানো জুতোর বাক্সটার দিকে ইশারা করলেন। তারপর এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে বললেন, আপনি?
এনেছি। থলের মধ্যে—জামাকাপড়ের নীচে…।
এখানে লোকজন রয়েছে।—ইশারা করে রাস্তার নির্জন দিকটা দেখালেন নীতিশ: চলুন—ওদিকে একটু এগিয়ে যাই…।
খানিকটা হেঁটে কয়েকটা ঝুপড়ি পেরিয়ে গেল দুজনে। তারপর অন্ধকার একটা জায়গা পাওয়া গেল। সেখানে পাশাপাশি দাঁড়ানো দুটো বিশাল ঝুপসি গাছ। তার আড়ালে দাঁড়িয়ে থলেতে হাত ঢোকাল রমেশ। সাইলেন্সার লাগানো একটা রিভলভার বের করল।
টাকা?
কোনও উত্তর না দিয়ে জুতোর বাক্সটা রমেশের দিকে এগিয়ে দিলেন নীতিশ। রিভলভারটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলেন। সেফটি ক্যাচ খুলে চেম্বারটা চেক করতে-করতে পকেটে হাত ঢোকালেন। আঙুলে তিনটে গুলির ছোঁয়া টের পেলেন।
রমেশ তখন জুতোর বাক্সের একটা কোনা ছিঁড়ে টাকার বান্ডিলগুলো ছুঁয়ে দেখছে। ওর ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি।
তিনটে গুলি বের করে চেম্বারে ভরে নিলেন নীতিশ। তারপর রমেশের বুকে সাইলেন্সারের নল ঠেকিয়ে গুলি করলেন। পরপর দুবার।
চাপা দুটো ভোঁতা শব্দ হল। রমেশ খসে পড়ে গেল মাটিতে। জুতোর বাক্স আর থলে—দুটোই ওর হাত থেকে পড়ে গেল।
রিভলভারটা ভালো করে জামায় মুছে ওটা প্যান্টের পকেটে ঢোকালেন নীতিশ। পরে সুযোগ-সুবিধে মতো ওটা খালের জলে ফেল দেবেন। সূনীল ধরের বাবার সাধ্যি নেই ওটার আর খোঁজ পায়। এইসঙ্গে চোরাই রিভলভারের গল্পও শেষ।
তিনদিন পর ইন্সপেক্টর এলেন। একদিন ভীষণ বৃষ্টি হয়েছে। তাই দোকান ছেড়ে নীতিশ কোথাও যাননি।
সুনীল ধরের মুখে শুধু হতাশা। দেখে খুশি হলেন নীতিশ। নিজের গালে দুবার হাত বুলিয়ে নীতিশের চোখে চোখ রাখলেন সুনীল ধর, বললেন, আপনার ভাগ্য ভালো, মিস্টার দত্ত। আমাদের হাতে আর কোনও ক্লু আসেনি। টাকার ব্যাগটা আমরা খুঁজে পাইনি—বোধহয় বৃষ্টিতে ভেসে নদীতে গিয়ে পড়েছে। আর রিভলভার যার কাছ থেকে কেনা হয়েছে সে-লোকটি মারা গেছে।
কিন্তু ভেবে দেখুন তো, মিস্টার দত্ত, যদি ওই লোকটা—মানে, রমেশ পাত্র—মারা না যেত? হয়তো রিভলভারটার খদ্দেরকে আমরা খুঁজে পেতাম, তাই না? না মশাই, আপনি বুড়ো হলে কী হবে, আপনার মাথায় বুদ্ধি আছে। আমার মতো লোককে আপনি বুদ্ধির খেলায় হারিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য যদি খুন দুটো আপনি ধরে থাকেন। সরি, মিস্টার দত্ত, আপনার ওয়াইফের মার্ডারারকে আমি ধরতে পারলাম না। আমাদের হাতে আর কোনও ক্লু নেই—সুতরাং, দিস কেস রিমেইনস আনসলভড—সো লঙ—। ইন্সপেক্টর চলে গেলেন।
নীতিশ দত্তর মুখে ফুটে উঠল ক্রুর, বাঁকা হাসি…।
কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরেই হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলেন ইন্সপেক্টর, বললেন, মিস্টার দত্ত, আমার রুমালটা কি ফেলে গেছি…ওঃ—এই তো!…থ্যাংকু ইউ।
ও, ভালো কথা। একটা ছোট্ট কথা আপনাকে জিগ্যেস করব। আপনি বলেছিলেন, কামিনী দেবীই ড্রয়ার খুলে রিভলভারটা বের করেছিলেন। তাই তো?
হ্যাঁ—।
আপনি ওই ড্রয়ারটা খোলেননি?
না, না। কতবার বলব। কামিনী ছাড়া কেউ ওই ড্রয়ারে হাতই দিত না।—নীতিশের স্নায়ুতন্ত্রী যেন ছিঁড়ে পড়বে।
০.২২ রিভলভারটা আপনার স্ত্রী-ই বের করেছিলেন, আপনি নয়—এই তো?
ওহ—ইন্সপেক্টর, প্লিজ বিলিভ মি।—উত্তেজনায় নীতিশের মুখ-চোখ লাল হয়ে উঠল।
তা যদি হয়, তবে ভারি আশ্চর্য ব্যাপার ঘটেছে।—হাসলেন ধর। ড্রয়ারটায় মাত্র একসেট ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে। সেটা আমরা মিলিয়েও দেখেছি। ব্যাপারটার মাত্র দুটো সমাধান আমাদের সামনে আছে। এক, ওই ড্রয়ারে আপনি ঘটনার দিন হাত দিয়েছিলেন। হয়তো ০.২২টা বেরও করেছিলেন। যা আপনি সম্পূর্ণ অস্বীকার করছেন। আর দু-নম্বর সমাধানটা একটু পিকিউলিয়ার আর ইয়ে….কষ্টকল্পিত। তবে একেবারে অসম্ভব নয়। আপনাকে বলেছিলাম, আই লিভ নো স্টোন আনটার্নড অ্যাবাউট আ মার্ডার…। তাই হঠাৎই এই আশ্চর্য ব্যাপারটা আমার নজরে এল…।
কী—কী?—প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন নীতিশ।
দু-নম্বর সমাধানটা হল, আপনার এবং আপনার স্ত্রীর আঙুলের ছাপ একেবারে সেম। নয়তো বলুন না, ড্রয়ারের গা থেকে পাওয়া ছাপের সঙ্গে আপনার আঙুলের ছাপ মিলল কেমন করে? অথচ আপনি বারবার বলেছেন, ড্রয়ারে আপনি হাতও দেননি। মিসেস দত্তর সঙ্গে আপনার ছাপ আমি মিলিয়ে পর্যন্ত দেখেছি। দুটোর মধ্যে কোনও মিলই নেই—। সুতরাং কাইন্ডলি আর-একবার ভাবুন না, মিস্টার দত্ত, ড্রয়ারটায় আপনি হাত দিয়েছিলেন কিনা—।—হোলস্টার থেকে ০.৩৮ পুলিশ স্পেশালটা বের করে উঁচিয়ে ধরলেন সুনীল ধর।