Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নারী এবং নদীর পাড়ে বাড়ি || Atin Bandyopadhyay » Page 6

নারী এবং নদীর পাড়ে বাড়ি || Atin Bandyopadhyay

দু’কূল ছাপিয়ে এবারে নদী জলে ভেসে গেল। জ্যৈষ্ঠের শেষাশেষি সেই যে দুর্যোগ শুরু হয়েছিল, দিনরাত ঘনবর্ষণ, ঝোড়ো হাওয়া, আকাশে মেঘের দাপাদাপি, ঘর থেকে বের হওয়াই দায়। ছাতা মাথায় দিলেও রক্ষা নেই, ঝোড়ো হাওয়ায় ছাতা উড়িয়ে নিচ্ছে। ভেতরবাড়িতে অরণি যাচ্ছিল ছাতা মাথায় দিয়ে, তখনই দেখল তিথি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। তিথিও ভিতরবাড়িতে যাবে। কিন্তু ছাতা নেই বলে কারও অপেক্ষায় আছে। তাকে দেখেই সে দৌড়ে এসে ছাতার তলায় ঢুকে গেল।

ওর ইচ্ছে হয়েছিল নিজেই ডেকে বলবে, এই তুই ভিজছিস কেন! চলে আয়।

কিন্তু আজকাল সে আগের মতো তিথিকে কাছে ডাকতে সাহস পায় না।

এই যে দুর্যোগ যাচ্ছে, সে কোনওদিন স্কুলে যেতে পারে, কোনওদিন পারে না। রেনি ডেরও ছুটি থাকে, তবে স্কুল কামাই করার পাত্র সে নয়। বাতাস এতই প্রবল যে ছাতা মাথায় যাওয়া যায় না। বর্ষাকাল আসার মুখে ঋতুর এই খেপা স্বভাবের কথা তার জানা আছে। কিন্তু তিথির কী ইচ্ছে হবে বোঝা ভার।

সে ছাতার ভেতর ঢুকেই বলল, ও ভিজে গেলাম! বলে প্রায় শরীর ঘেঁষে লেপটে যেতে চাইছে।

তিথির শরীরে এত আগুন আছে, কাছে এলেই যেন পুড়ে যেতে পারে, সে যতটা পারে আলগা হয়ে হাঁটে, কিন্তু হাঁটতে দিলে তো! তিথি নিজেই ছাতা কেড়ে নিয়ে বলল, এসো। কাছে এসো। জলে ভিজে যাচ্ছ।

ছপ ছপ পায়ের শব্দ উঠছে জলে।

ভেতরবাড়িতে পাত পড়েছে এমন খবর পাওয়ার পরই সে বের হয়ে পড়েছে। বাবা নাজিরখানা থেকে সোজা চলে যাবেন। আবার খেয়েদেয়ে সোজা নাজিরখানায় যাবেন। তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে দিবানিদ্রা তিনি সেখানেই সেরে নেন। তিথি আগে হলে তার ঘরে ঢুকে যেত, তাকে ডেকে নিয়ে যেত, সেই যে ভেতরবাড়ির সঙ্গে কাছারিবাড়ির দুতিয়ালি করে থাকে, কিন্তু ইদানীং তিথি একা আর তার ঘরে আসে না, সঙ্গে ওর কোনও ভাই না হয় বোন থাকে। সেই কোলে করে নিয়ে আসে, বড়দের হাত ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে আসে।

অরণি তখন ভেতরে ভেতরে বড় অপমান বোধ করে। সে যে রাতের অন্ধকারে তিথির পাশে গিয়ে বসেছিল, আনাড়ি বলেই কী করতে হয় জানে না, তবুও বসেছিল, বোধহয় তিথি তা জানে। বোকার মতো কিছু একটা করে বসলে তিথিরও যে মান থাকে না। সে ছোট হয়ে গেলে তিথিও বোধহয় ছোট হয়ে যাবে।

হাসনুহানার গাছের নিচ দিয়ে পাঁচিলের পাশ ধরে হাঁটছে। তিথির দেরি হয়ে গেছে, সে অনেক আগেই রান্নাবাড়িতে গিয়ে বসে থাকে! তবে ঘর থেকে বের হতে পারছিল না। ছাতা না থাকলে কী করা! ভাঙা ছাতাটি তার বাবা নিয়ে যেতে পারে। ঘরে বসে বোধহয় তিথি লক্ষ্য রাখছিল, তার অরুদা কখন মাঠ পার হয়ে ভেতরবাড়িতে যায়, এবং তাকে দেখেই বড় চালতা গাছটার নিচে এসে দাঁড়িয়েছিল। অরুদার ছাতার নিচে ঢুকে গেলে তার রান্নাবাড়িতে যেতে অসুবিধা হবে না।

তিথি ঠিক করবী গাছটার নিচেই ফিসফিস করে বলল, এই একটা কথা বলব?

একটা কথা বোধ হয় আর শেষ হবে না।

কী বলবি?

বলো রাগ করবে না।

রাগ করার কথা হলে মানুষ রাগ না করে পারে?

তা হলে তো বলা যাবে না। তুলিদি যদি জানতে পারে আমাকে খেয়ে ফেলবে।

বাবুদের বাড়ির মেয়ে। এখন সে আরও লম্বা ফ্রক পরে। তাকে দেখলে আড়ালে চলে যায়—তুলির খুব আজকাল লজ্জা। তিথি বলল, আগে তুমি তুলিদিকে চুরি করে দেখতে, এখন তুলিদি তোমাকে দেখে।

তুলি বলল তোকে!

আমাকে বলবে কেন। তুলিদির চাওনি দেখলেই সব বোঝা যায়।

এই কথা!

আজ্ঞে না। এই কথা না। আরও কথা আছে।

কী কথা, শোনার কোনও আগ্রহ বোধ করল না সে। বাবুদের মেয়ে, কত রকমের শখই থাকে। মেজদা শহর থেকে একটা সাদা রঙের বাচ্চা কুকুর এনে দিয়েছে। খরগোশের চেয়ে সামান্য বড়। কুকুরটা আর বড় হবে না। তুলি বিকাল হলেই পরীর মতো সেজে গুজে কুকুরটা বুকে নিয়ে কাছারিবাড়ির বাগান, না হয় নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়াবে। তার জানালা থেকে যতটা দেখা যায় ততটা রাস্তাতেই তুলি হাঁটাহাঁটি করে। বেশি দূরে যায় না। কখনও বীণা পিসি থাকে, কখনও থাকে না।

পাঁচিলের দরজা দিয়ে ঠিক ভেতরে ঢোকার মুখেই তিথি ছিটকে ছাতার তলা থেকে সরে যাওয়ার সময় বলল, তুমি তো শুনতে চাইলে না পরে বলব।

এক ছাতার তলায় তিথিকে এত ঘনিষ্ঠ দেখলে তুলি কি খেপে যাবে! তিথির ছিটকে যাওয়া দেখে এমনই মনে হল তার। এবং আজকাল তার যা হয় সঙ্গে সঙ্গে সেই দৃশ্য চোখে ভেসে ওঠে। তিথি জলে কাদায় চিত হয়ে পড়ে আছে। তিথিকে না দেখে কেন যে তুলিকে দেখতে পেল—ঠিক একইভাবে জলে কাদায় তুলি চিত হয়ে পড়ে আছে।

এসব কেন যে সে দেখে!

রোয়াকে উঠে এক কোনায় সবার সঙ্গে সেও ছাতা রেখে হেঁটে গেল। লম্বা কার্নিসের নিচ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। রান্নাবাড়ির এলাকাটা বাড়ির ভেতর মহল পার হয়ে। সবাই এসে গেছে—সে এদিক—ওদিক চোখ তুলে তাকায় না। মাথা নিচু করে হাঁটার স্বভাব। চোখ তুললেই যেন, জানালার পাশে কিংবা খাটের বাজুতে দেখতে পাবে তুলি থুতনি রেখে তাকে দেখছে।

অবশ্য তুলি বের হবেই। সে না দেখলেও বের হবেই।

কারণ তার কুকুরটা কী শুঁকতে শুঁকতে রোয়াকে বের হলেই তুলি ছুটে আসবে। একবার পলকে তাকে দেখে কুকুরটাকে বুকে করে তুলে নিয়ে যাবে। তাকে দেখার জন্য তুলির এই ছলনায় সে ভেতরে ভেতরে মজা পায়। তুলি মনে করে সে কিছু বোঝে না।

দুর্যোগের দিনে আজ রান্নাবাড়িতে খিচুড়ি লাবড়া বেগুনভাজা চাটনি দিয়ে সবাই বেশ হুঁসহাস করে খেল। ছোড়দার থালায় খিচুড়ি থেকে গেছে। চাটনি দিতে এলে, ছোড়দা খিচুড়ি পাত থেকে ঠেলে ফেলে দিতে চাইলে জেঠিমা হা হা করে উঠলেন।

ফেলিস না। তিথি খেয়ে নেবে। খেতে পেলে খুশি হবে।

এসব দেখার অভ্যাস তার আছে। পাতে তার কিছুই বেশি হয় না। বেশি হলেও খেয়ে নেয়। না খেলে তিথির জন্য তুলে রাখা হবে। ভেতরে তখন তার বড় কষ্ট হয়। তিথিকে এ নিয়ে শাসনও করা যায় না। তার বাপের যা অবস্থা, বর্ষাকাল বলে অবশ্য তার বাবা ফুলুরি, জিলিপি ভাজার দোকানটায় বসে না। নদীনালার দেশ, বর্ষায় তিথির বাবা একটা ভাঙা কোষা নৌকায় গাওয়াল করতে বের হয়ে যায়। পান, সুপারি, ছোলা, মটর, বিস্কুট, ময়দার কড়ি ভাজা নিয়ে বের হয়। ঘাটে ঘাটে পাটের বদলে গ্রাহকদের ছোলা মটর বিস্কুট দেয়। বাড়ির বউ—ঝিরা চুরি করে পাট দিয়ে জিলিপিও কেনে। এতে তিথির বাবার পড়তা অনেক বেশি পড়ে। এসময় তিথির মা বাবা ভাইবোনগুলি পেট ভরে হয়তো খেতেও পায়। কিন্তু তিথির যখন এক জায়গায় ব্যবস্থা আছে, তখন তার জন্য যেন ভাবার দরকার নেই। তিথির মা যে তার বাবার দ্বিতীয়পক্ষের, তা বোধহয় সে ভুলেই গেছে। সে তার মাকে সবসময় বড় লক্ষ্মীমতী ভাবে। মার জন্যই বাবা বিবাগী হয়ে যায়নি, সোজা কথা!

নদীনালার দেশ। পোকামাকড়ের উপদ্রব আছে। বর্ষায় তিথির বাবার ভাঙা নৌকাই সম্বল। তাপ্পি মারা। গাবের কষ খেতে খেতে পোড়াকাঠের মতো হয়ে গেছে।

ওর বাবার রাতে ফিরতে দেরি হলে নদীর পাড়ে চালতে গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তিথি উসখুস করলেই সে টের পায়—কিছু একটা হয়েছে।

তিথি বলবে, বাবা ফেরেনি। একা সে চালতে গাছটার নিচে গিয়ে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে ভয় পায়। ভয় পায়, না, সঙ্গে যাওয়ার জন্য ভয়ের ছলনা, সে ঠিক বুঝতে পারে না। সে সঙ্গে থাকলে কথায় কথায় তিথি হেসে গড়িয়ে পড়ে। আবার তার বাপের ফিরতে দেরি দেখলে, চোখ জলে ভেসে যায়। বাবা না থাকলে যে কেউ থাকে না।

অরণি খেয়েদেয়ে বের হয়ে দেখল, বৃষ্টি আরও ঝেঁপে নেমেছে।

জগদীশও বৈঠকখানা ঘরে বসেছেন। সেও একটা বড় টুলে বসে আছে। বাবুরা কিংবা বাবুদের ছেলেরা বাড়ির করিডর ধরে যে যার ঘরে ঢুকে গেছেন। বৃষ্টির তোড় না কমলে বের হওয়া যাবে না।

জগদীশই বললেন, একটু বসে যাও। বৃষ্টি ধরে আসুক। তারপর যাবে।

বাবা তার সঙ্গে যাবেন না, সুপারিবাগানের ভেতর দিয়ে বাবা নাজিরখানায় চলে যাবেন। আসলে একসময় কাছারিবাড়িটায় যে নায়েব—গোমস্তাদের ভিড় ছিল, বোঝা যায়। বাবুদের অবস্থা পড়ে যাওয়ায় কাছারিবাড়ি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে কবে অরণি জানে না। কাছারিবাড়িতে শুধু তার বাবা থাকেন। পাশের ঘরটায় দলিল—দস্তাবেজে ভর্তি। পরের ঘরটায়, লাঠি সড়কি বল্লম এবং তরবারিও সে ঝুলতে দেখেছে। ঘরটায় সবসময় তালা দেওয়া থাকে। পরের ছোট ঘরটায় থাকে হরমোহনদাদু—পাইক পেয়াদা এবং বাজার সরকার যখন যা দরকার সেই কাজই করেন!

এত বড় ঘরটায় তার ফিরে যেতেও ভালো লাগছে না। অবশ্য খুবই ঠান্ডা লাগছে। কাঁথা গায়ে দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়তেও পারে। বই খাতা নিয়ে বসতে পারে। চলিত নিয়মের কিছু অঙ্ক করা বাকি। কিন্তু যা দুর্যোগের ঘোর চলছে, তাতে হারিকেন জ্বেলে না দিলে কিছুই দেখা যাবে না। বৃষ্টি ধরে আসতেই সে বের হয়ে পাঁচিলের দিকে যাওয়ার সময় দেখল তিথি পা টিপে টিপে তার ছাতার তলায় ঢুকে যাচ্ছে। তিথি কিছু বলতে চায়।

মানুষ সমান পাঁচিলের এপাশে সে ছাতা মাথায় বৃষ্টিতে হেঁটে যাচ্ছে। পাশে তিথি তেমনি তার গা ঘেঁষে হাঁটছে। তার কনুইয়ে তিথির নরম স্তনের সামান্য আভাস ছুঁয়ে যাচ্ছে। তার ভালো লাগছিল। তিথি কী যে চায়, তার ছাতার নিচে ঢুকে তার সঙ্গে কাছারিবাড়িতে উঠে যেতে পারে, কিন্তু তিথি আজকাল তার ঘরে একা ঢোকে না—যেন তিথি খুবই সতর্ক হয়ে গেছে। তার মনে পাপ আছে, সে কিছু যদি করে বসে, এসবও ভাবতে পারে। নিজেকে সাধু প্রতিপন্ন করার চেষ্টাতেই যেন বলল, যা বাড়ি যা।

বাড়ি যাব কি! তুমি তো আমার কথাই শুনলে না।

আবার কী কথা!

বারে বললাম না, আরও কথা আছে।

আবার বোধহয় ঝেঁপে বৃষ্টি আসছে! সে ছুটতে চাইলে ছাতার ডগা ধরে ফেলল তিথি।

কী যে লাফাচ্ছ না! জলে সব ভিজে যাচ্ছে।

চারপাশে জল জমে যাওয়ায় ইচ্ছে করলেই ছুটে যাওয়া যায় না।

বকের মতো পা ফেলে হাঁটতে হয়। তিথির আরও কথা আছে, কিছুতেই এই বৃষ্টির মধ্যে না শুনিয়ে ছাড়বে না। অথচ দু’জনেই ভিজে যাচ্ছে।

তুমি কিন্তু ঘুণাক্ষরেও বলবে না।

কী বলব না।

এই যে তুলিদি তোমাকে চুরি করে দেখে। তুলিদি সব লক্ষ্য রাখে জানো। কী বলল জানো, দেখিস অরুর আর কদিন বাদেই গোঁফ উঠবে।

সে বলল, তাই বুঝি।

আমাকে বকল। তুই একা ঘরে যাস লজ্জা করে না। দামড়া হয়ে উঠছে জানিস না!

এসব কথা শুনতে তার ভালো লাগছে না।

আর যাবি না একা। খবরদার। একা গেলে ছোটপিসিকে বলে দেব। হুমকি।

এসব শুনতে ভালো লাগছিল না তার।

ঠিক আছে। চল তোকে বাড়ি দিয়ে আসি। না হলে সব তোর ভিজে যাবে।

যাক, গোঁফ উঠলে দামড়া হয়ে যায় একথা কি ঠিক?

জানি না।

তুমি তো কিছুই জানো না। আর ক’দিন বাদে তোমার গোঁফ উঠবে, তুলিদি জানে, অথচ তুমি জানো না। যার গোঁফ সেই ঘুমিয়ে থাকে। আয়নায় দেখে তো বুঝতে পারো, না তাও বোঝ না। তুমি কী বোঝ বলো তো!

তিথির কথা এমন যে মায়া না জন্মে পারে না। তিথি না থাকলে সে কত একা তাও বোঝে। বড় হওয়ার মুখে তিথির সাহচর্য তার চারপাশ ভরে রেখেছে। সে না থাকলে তার যে সবই অর্থহীন হয়ে যেত, সে অতিষ্ঠ হয়ে হয়তো চলেই যেত। একা এমন দূর দেশে মাকে ছেড়ে এভাবে কারও পক্ষে থাকাই সম্ভব হত না। মাঝে মাঝে মনে হয় বাবাকে বলে সে তিথির জন্য ভালো ফ্রক প্যান্ট আনিয়ে দেবে। কিন্তু সে বলে কী করে! তিথির প্রতি তার আকর্ষণ যদি বাবা টের পেয়ে যান!

সে এত নিরুপায় যে তিথিকে কোনও কারণেই সামান্য ভর্ৎসনা পর্যন্ত করতে পারে না। তিথির পক্ষে তার ঘরে একা আসা উচিত নয় সেও এটা বোঝে। তুলির চোখকে ফাঁকি দেওয়া কঠিন।

তারপরই তিথি বলল, মনে আছে তো! এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? তুমি আমাকে কাচের চুড়ি কিনে দেবে, মনে নেই!

দেব।

তারপরই তিথি কেন যে সহসা বলল, আমি যাই। নদীতে বান এসে গেছে, কী মজা হবে না! তুমি যাবে?

কোথায়?

নদীতে।

কেন?

বারে নৌকায় ভেসে যাব আমরা। তারপর নৌকা যেখানে যায় যাবে। আমরা বসে থাকব। হাটবারে বাবা গাওয়ালে যায় না। নৌকাটা নদীর পাড়ে পড়ে থাকে। যাবে আমার সঙ্গে?

না।

কেন যাবে না? আমি কী করেছি! আমার সঙ্গে গেলে তাজা ইলিশ দেখাব। ঝকঝকে রুপোর ইলিশ। লাফাচ্ছে, পাটাতনে লাফাচ্ছে।

তিথির পক্ষে সবই সম্ভব। গেছো মেয়ে, ভালো বৈঠা চালাতে পারে, আর বর্ষায় নদীর জলে স্রোতের মুখে সাঁতরাবার সময় কখন যে শুশুক মাছ হয়ে যায়, কখন যে জলের নিচে ডিগবাজি খায়, দূর থেকে কখনোই মনে হয় না তিথি জলে সাঁতার কাটছে, জলে ডিগবাজি খাচ্ছে, যেন নদীর জলে নেমে মৎস্যগন্ধা হয়ে গিয়ে কোনও সুপ্রাচীন কাব্যগাথা তিথি। সে পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখত। ভরা কোটালে মাঝনদীতে যাওয়ার সাহসই নেই তার। ঘোর বর্ষায় নদীর জলে ঘূর্ণি দেখলেই তার মাথা ঘোরায়। তিথি কিছুই গ্রাহ্য করে না। তাকে তাজা ইলিশমাছের প্রলোভনে ফেলে দিচ্ছে। সে যেন এবার তাকে নিয়ে নদীতে ভেসে যাবেই। তাজা ইলিশ তাকে জেলেদের নৌকায় দেখাবেই।

মানবাজারের ওদিকে মেলা মন্দির আছে। বিশ্বনাথের মন্দির, কালভৈরবের মন্দির, রুদ্রদেবের, অন্নপূর্ণার মন্দির। ওদিকটায় তখন ঘন জঙ্গল। অষ্টমী স্নানের মেলায় জমিদারবাবুরা লোক লাগিয়ে জঙ্গল সাফ করে দেয়। ওখানেই তো মেলা বসে। কাচের চুড়ি ওখানেই কিনতে পাওয়া যায়।

তিথির সঙ্গে থাকার এই মুশকিল। কিছুতেই তার কথা শেষ হয় না। তাকে রাজি না করিয়ে যেন তিথি কিছুতেই যাবে না।

সে কেমন প্রলোভনে পড়ে গিয়ে বলল, ঠিক আছে যাব। হাটবার আসুক।

ঠিক যাবে?

হ্যাঁ, ঠিক যাব।

তিন সত্যি।

তিন সত্যি।

আমার গা ছুঁয়ে বলছ!

এই গা ছুঁয়ে বলছি।

তিথি এতই আপ্লুত তার কথায়, প্রায় বুকের কাছে মাথা ঠেকিয়ে দিয়েছে।

ঘনবর্ষণে দু’জনেই ভিজে যাচ্ছিল। তিথি কি এই বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে চায়! তিথির শরীরে কি উত্তাপ জমা হচ্ছে! বুকে মাথা ঠেকিয়ে দিলে কেন যে মনে হয়েছিল, তিথির গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।

খুবই বিব্রত হয়ে পড়ল সে।

তিথি তোর গা গরম! জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিস!

যা ভাগ! আমার কিছু হয়নি।

এতই ঘনবর্ষণ যে দু—দশ হাতের কাছাকাছি কিছুই দেখা যাচ্ছে না। যেন এক আচ্ছাদন চারপাশে তাদের ঘিরে রেখেছে। এমন মুহূর্তে তার ইচ্ছেই করছে না তিথিকে ফেলে যেতে। কাছারিবাড়িতে গিয়ে উঠতে পারে—কিন্তু তিথি তার বুক থেকে কিছুতেই মাথা তুলছে না।

জানো, তোমাকে আমার ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হয় না। তুমি আমাকে স্বপ্নে দ্যাখ?

এমন প্রশ্নের সে কী জবাব দেবে! সে কখনোই তিথিকে স্বপ্নে দেখেনি।

সে বলল, না।

বা তা হয় নাকি! ভালোবাসলে স্বপ্ন দেখতে হয় জানো!

তুই দেখিস?

হ্যাঁ, দেখি। কত রাতে স্বপ্নে দেখেছি, আমি নদীর জলে ডুবে যাচ্ছি, পাড় থেকে লাফিয়ে পড়েছ তুমি—দু হাতে চুলের ডগা ধরে তুলে আনছ। তারপর পাঁজাকোলে করে…

পাঁজাকোলে করে… কী?

কী আবার, ধ্যাত, আমার লজ্জা লাগে। শুনতে খুব ভালো লাগে… পাঁজাকোলে করে কী… এখন বলব না। পরে বলব।

তারপর বৃষ্টির মধ্যেই সে দৌড়ে সুপারিবাগানের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

মেয়েটার মাঝে মাঝে কী যে হয়!

মাঝে মাঝে তারও কী যে হয়!

মাথা কান গরম হয়ে যায়। চোখ মুখ ঝাঁঝাঁ করে।

পরের বর্ষায় তিথি সত্যি একদিন হাত ধরে টানতে টানতে নদীর পাড়ে গেছিল। সেদিনও অবিশ্রান্ত বর্ষণে পৃথিবী যেন কুহেলিকাময়। ঝাপসা কুয়াশার মতো বৃষ্টির আড়ালে তারা যে নৌকায় উঠে বসেছে কেউ দেখতেই পায়নি। বাবা সেদিনও কাজে বাইরে গেছেন। ফিরবেন দুদিন বাদে। রাতে তিথি এখন তার ঘরে পাহারায় আর থাকে না। তিথির মামা চরণ রাতে তার ঘরে শোয়।

বাবাই কেন যে সেবারে বললেন, তিথির এখন সমন্দ আসছে। গোরাচাঁদ যাকে দেখছে, বলছে, কন্যে উদ্ধার করে দিন। তিথির মামা চরণ তোমার ঘরে শোবে। তিথির আর তোমার ঘরে শোওয়া ঠিক হবে না। আমিই তিথিকে বারণ করে দিয়েছি।

তিথির বিয়ে! যা হয় নাকি! কতটুকুন মেয়ে—বড় না হলে মেয়েদের বিয়ে হওয়া মানায় না।

সে তিথিকে ডেকে বলেছিল, কী রে তোর বাবা নাকি পাত্র খুঁজছে?

ধুস, তুমি যে কি না। আমি বড় হয়ে গেছি না! তাই তোমার ঘরে শুলে কেউ খারাপ কিছু ভাবুক কাকা চায় না। আমার পাত্র দেখা হচ্ছে, আমি জানব না!

এও হতে পারে, মেয়ে বড় হতে থাকলে বাপের চিন্তা বাড়ে। হয়তো বাবাকেই ধরতে পারে, কোনও সুপাত্র যদি জোগাড় হয়। সুন্দরী মেয়ের পাত্রের অভাব হয় না। কিন্তু যা হয়, এসব ভাবলেই খুব মুষড়ে পড়ে অরণি।

তিথি হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলে সে না গিয়ে পারে! তিথি যে কী সুঘ্রাণ ছড়িয়ে রেখেছে—তিথির কাছে থাকলে তার শরীরে যে সুবাতাস বয়—তার সাধ্য কি তিথিকে ফেরায়!

চালতে গাছের নিচে তাপ্পিমারা কোষা নৌকাটা দড়িতে বাঁধা ছিল। পাটাতনের নিচে বৈঠা। একটা লগিও আছে। বৃষ্টিতে পাটাতনের নিচে জল জমে গেছে—তিথি উবু হয়ে বসল। জল সেঁচে ফেলছে—তিথির দুই উরুর দিকে কিছুতেই তাকাচ্ছে না অরণি, যদি কিছু দেখে ফেলে।

সহসা কেন যে অরণির মনে পড়ে গেল তিথি তাকে ফের হয়রানি করতে পারে। নদীতে তাজা ইলিশ দেখাবার নাম করে তাকে নিয়ে গিয়ে শেষে কোথায় ফেলবে জানে না। তিথির যদি কোনও দুষ্টবুদ্ধি কাজ করে, সারা সকাল—দুপুর রোদের সেই হয়রানির কথাও মনে পড়ল।

মুশকিল তিথি কোথায়, কী করছে, দেখার প্রায় কেউ নেই বললেই চলে। তিথি বাড়ি না থাকলে ধরেই নেয় সে বাবুদের রান্নাবাড়িতে আছে, নয়তো তুলির ঘরে, ছোটপিসির ঘরেও থাকতে পারে। কিন্তু তার ওপর বাবুদের বাড়ির সবারই কমবেশি নজর আছে। সেজদা কিংবা সোনাদা কাছারিবাড়িতে এসে উঁকি দিতে পারে, তাছাড়া দুপুরেও তাকে রান্নাবাড়িতে হাজির থাকতে হয়। সে না গেলেই কার নির্দেশে যে ভেতরবাড়িতে তোলপাড় পড়ে যায়—সে তিথির সঙ্গে এই দুর্যোগে কিছুতেই নদীতে নৌকা ভাসিয়ে দিতে পারে না।

নৌকা থেকে লাফ দিয়ে পাড়ে উঠে এল অরণি।

তার খালি গা। প্যান্টের ওপর কোমরে গামছা জড়ানো। সে নদীতে ডুব দিয়ে বলল, এই তিথি বাড়ি চল। যেতে হবে না।

কেন, গেলে কী হবে?

ফিরতে দেরি হয়ে গেল সবাই ভাববে।

ফিরতে দেরি হবে কেন? জাল থেকে পাটাতনে যখন ফেলে, ইলিশ মাছ কী লাফায়! তারপর মরে যায়। মাছের মরে যাওয়া দেখবে না!

আচ্ছা তিথি মাঝে মাঝে তোর এত বাই চাপে কেন বল তো! মাছের মরে যাওয়া দেখার মধ্যে কোনও আনন্দ আছে?

তিথি আর কথা বলল না। সে পাড় থেকে নৌকা ঠেলে পাটাতনে লাফিয়ে উঠে গেল। কী যে করে তিথি! নদীর দু’কূল দেখা যায় না।

ভরা কোটাল। প্রবল স্রোতে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, চরের কাশবন সব ডুবে গেছে। সামনে নদীর এত বড় চড়া অদৃশ্য—মনে হয় নদী ফুলে ফেঁপে দু’পাড় ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে গেছে। মাঝগাঙে মেলা জেলে নৌকা পর পর, খড়ের নৌকাও মেলা। গয়না নৌকার মাঝি গুণ টেনে স্রোতের বিপরীতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতি যেন বড় বেশি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে উঠেছে। সারা আকাশে মেঘ আর বজ্রবিদ্যুতের ছড়াছড়ি।

এই কি, তিথি সত্যি বৈঠা মেরে মাঝগাঙে চলে যাচ্ছে!

সে চিৎকার করে ডাকল তিথি যাস না। গেলে ভালো হবে না। আকাশ তোর মাথায় ভেঙে পড়বে।

তিথি পাটাতনে দাঁড়িয়ে বলল, আমার ভালো দিয়ে তোমার কী হবে?

হবে। তুই ফিরে আয়। তুই ফিরে এলেই হবে।

তুমি কথা রাখো না। আমার গা ছুঁয়ে বলেছ, আমার সঙ্গে নদীতে যাবে। ফিরে গেলে আমার আর কতটা ভালো হবে?

কতটা ভালো হবে জানি না। তবে তুই এলে পরামর্শ করা যাবে। তুই না থাকলে তুলি আমাকে নিয়ে যা খুশি ইচ্ছে করবে। তোর ভালো লাগবে?

এতেই যেন জব্দ। তিথি পাটাতনে বসে পড়ল। পাড়ের দিকে আসার চেষ্টা করছে।

সে কোমর জলে নেমে গেল। তারপর সাঁতার কাটতে থাকল। নৌকার কাছে গিয়ে ঝুঁকি মেরে পাটাতনে উঠল। এবং বৈঠা আর তিথির হাতে রাখল না। সে প্রায় জোর করেই কেড়ে নিল।

তিথি তুই আমাকে নিয়ে কোথায় যেতে চাস বল। আমরা কতদূর যেতে পারি। মাথা খারাপ করে লাভ আছে!

আমি কী করব অরুদা, তিথি কেমন পাগলের মতো হা—হুতাশ করছে।

অরণি ঠিক বুঝতে পারছে না, তিথি এত ভেঙে পড়েছে কেন! তিথির কি কোনও দুঃসংবাদ আছে—অথবা কোনও এক অতিকায় হাঙরের পাল্লায় পড়ে গেছে তিথি! তার বিয়ের কথা কি পাকা হয়ে গেছে!

তবু তার কেন জানি হাঙরের কথাই মনে পড়ল। তিথিকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে।

সেজদা কিংবা জমিদারবাড়ির আর কেউ। তিথির শরীরে লাবণ্য এত বেশি, যে—কেউ যেন তিথিকে দেখলে মোহিত হয়ে যাবে।

সে ডাকল, তিথি।

বলো।

তোর কিছু হয়েছে?

কী হবে?

আচ্ছা আমাকে নিয়ে তুই কোথায় পালিয়ে যেতে চাস?—

তা তো জানি না।

আজকে কী মতলব ছিল তোর?

কী যে ছিল, বলতে পারব না। তুমি আমাকে স্বপ্নে দ্যাখো না, আমি তোমাকে স্বপ্নে দেখি—ভাবলে যে মন খারাপ হয়ে যায়।

স্বপ্নে যদি তোকে দেখি খুশি হবি?

তিথি মাথা নিচু করে বসে থাকল।

বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে। সঙ্গে দামাল হাওয়া। হালকা কোষা নৌকাটি সহজেই উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। সে জলের নিচে বৈঠা ঢুকিয়ে হাল ধরেছে। ইচ্ছে করলেই হাওয়ার উপায় নেই নৌকা উড়িয়ে নেয়। বরং হাওয়ার গতির জন্য নৌকা পাড়ের দিকে ভেসে যাচ্ছে। এত ঘন বৃষ্টির ছাট যে এখন পাড়ও ভালো করে দেখা যায় না। তবে সামনের বাঁশের জঙ্গল বিশেষ করে স্টিমারঘাটের বয়ার আলো দুলছিল বলে সে জানে তারা দিকভ্রান্ত হয়ে নদীর অন্য কোনও মোহনায় হারিয়ে যাচ্ছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই নদীর তীর পেয়ে যাবে।

কী চুপ করে থাকলি কেন, স্বপ্নে যদি তোকে দেখি খুশি হবি?

তিথি বলল, তুমি তুলিদিকে কখনও স্বপ্নে দ্যাখো না?

না।

কাউকে দ্যাখো না।

কাউকে দেখব না কেন। আর স্বপ্নের কথা কি মনে থাকে। কত কিছুই দেখি, ঘুম থেকে উঠে আর মনে করতে পারি না। আমার কী দোষ বল।

আমাকে স্বপ্নে দেখলে তুমি ভুলে যেতেই পারো না। ঠিক তোমার মনে থাকত।

তা অবশ্য বোধহয় থাকত।

বোধহয় না। থাকত।

ঠিক আছে, আয় আমরা এসে গেছি। নাম।

তুমি তো বললে না, কবে তুমি স্বপ্নে আমাকে দেখবে!

তিথির কাছে এই মুহূর্তে কোনও মিছে কথাও বলতে পারছে না। সে বলতে পারত, নারে, আমি তোকে স্বপ্নে দেখি, তবে বলতে লজ্জা হয়। তুই না আবার কী ভাবিস! মিছে কথা বললে, তিথি সহজেই তাকে বিশ্বাস করবে। নিছক একটা স্বপ্ন নিয়ে তিথির কাতর মুখ সহজেই উচ্ছল হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু তিথির কাছে কিছুতেই মিছে কথা বলতে মন সায় দিল না।

শোন অরুদা। স্বপ্ন কখন দ্যাখে জানো?

না, জানি না।

সারাদিন যাকে ভাববে, রাতে সেই স্বপ্নে হাজির হয়, জানো?

অরণি বলল, হতে পারে।

হতে পারে না। হয়। আমি তো প্রায়ই তোমাকে দেখি। সেই এক দৃশ্য, আমি ডুবে যাচ্ছি, তুমি আমাকে জল থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছ। ভাবতে গেলেই আমার শরীর কেমন শিউরে ওঠে। এই দ্যাখো, দ্যাখো না, আমার গায়ের সব লোম খাড়া হয়ে গেছে! স্বপ্নটা ভাবতে গেলেই শরীর অবশ হয়ে যায়।

শিগগির নাম।

নৌকাটা খুবই দুলছিল। নৌকাটাকে আয়ত্তে রাখাই কঠিন। যেন পাড়ে এসে ডুবে যাবে। সে লাফিয়ে কোমর জলে নেমে গেল। নৌকাটা একটা গাছের গুঁড়িতে বেঁধে ফেলল।

এই নাম। ঠান্ডায় হাত—পা অবশ হয়ে আসছে।

নামব না।

তুই কি আমাকে মেরে ফেলতে চাস?

তখনই পাড়ের দুটো গাছ অদূরে শিকড়সুদ্ধ উপড়ে জলে পড়ে গেল। স্রোতে গাছ দুটো ভেসে যাচ্ছে। কোথা থেকে উড়ে এল দুটো বক। ভাসমান গাছের ডালে বসে পড়ল। এক সময় মনে হল এই দুর্যোগ থেকে তিথিকে কিছুতেই রক্ষা করা যাবে না। সেও ভেসে যেতে পারে। নদীর এমন ভয়ঙ্কর রুদ্ররূপ সে যেন জীবনেও দেখেনি। সে ইচ্ছা করলে আত্মরক্ষার্থে তিথিকে ফেলে চলে যেতে পারে—তিথি যা খুশি করুক। কিন্তু তিথিকে ফেলে যাওয়ার যে তার ক্ষমতাই নেই। মরে গেলেও তিথিকে নিয়েই মরে যেতে হবে।

সে না বলে পারল না, কী হল বসে থাকলি কেন? দ্যাখ কী অবস্থা। বুঝতে পারছিস না। দুর্যোগ সব গাছপালা উড়িয়ে নিতে চাইছে। তুই কী মরতে চাস!

তিথি পাটাতনে উঠতে গিয়ে নৌকার দুলুনিতে টাল সামলাতে পারল না। জলে পড়ে গেল। নৌকার কিনার ধরে ফেলায় স্রোতের মুখে ভেসে গেল না ঠিক, তবে কেমন অসহায় চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকল। নৌকার কিনার ধরে সে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়ালে তিথি জলের মধ্যে সহসা অদৃশ্য হয়ে গেল।

তিথি! তিথি!

কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির ঝাপটায় তার যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল। সে পাগলের মতো শুধু চিৎকার করছে, তিথি! তিথি!

মুহূর্তে মনে হল তিথি অদূরে ভেসে উঠেছে জলের ওপরে। জন্ম থেকে সে এই নদীকে চেনে। নদীর ক্ষমতাই নেই তাকে ডুবিয়ে দিতে পারে। সে ভুস করে জলে মুখ দেখিয়ে আবার ডুবে গেল! আবার কিছুটা দূরে চলে যাচ্ছে, আবার ভুস করে ভেসে ওঠে তার মুখ দেখাচ্ছে। সে পাড়ে পাড়ে ছুটে যাচ্ছে। সে চিৎকারও করতে পারছে না, তিথি জলে ডুবে যাচ্ছে। জলে ডুবে যাচ্ছে না, তাকে নিয়ে নদীর পাড়ে মজায় মেতেছে, তখনই তিথি পাড়ের জঙ্গল আঁকড়ে তাকে ডাকছে—অরুদা, আমি এখানে। সে দৌড়ে কাছে গেলে বলল, একটা কথা বলব?

জীবনমৃত্যুর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে তিথির এ কী খেলা! জঙ্গল থেকে তার হাত ফসকে গেলেই তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। জলের ঘূর্ণি এখানটায় প্রবল। দুর্যোগের মুখে স্টিমার পর্যন্ত জায়গাটা এড়িয়ে চলে। যতই সে নদীকে চিনুক, এই প্রবল ঘূর্ণিতে সে হাত ছেড়ে দিলেই জলের নিচে খড়কুটোর মতো তলিয়ে যাবে।

তিথি কি তার শেষ কথা তাকে বলার জন্য অপেক্ষা করছে? তা হলে ফেললেই আর তার মরার ভয় থাকবে না?

সে দাঁড়িয়েই আছে।

তিথি স্রোতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

সে লাফিয়ে জলে নেমে যেতে পারছে না। নামার সময় মাটি ধসে যেতে পারে। মাটি ধসে গেলেই ঝোপজঙ্গলসহ তিথি আবার তলিয়ে যাবে।

সে চিৎকার করে বলল, আমি আর পারছি না। তোর আর কী কথা আছে বল! আমাকে আর কত আতঙ্কে রাখবি?

অরুদা তুমি তুলিদিকে কিন্তু কখনও স্বপ্নে দেখবে না। কথা দাও।

অরণি হাসবে না কাঁদবে না ভয়ঙ্কর বিরক্তিতে চুল ধরে জল থেকে তুলে আনবে বুঝতে পারছে না। সে মুখ খিঁচিয়ে বলতে গিয়ে ভাবল, তা হলে আর এক বিড়ম্বনা শুরু হবে। হয়তো সত্যি হাত ছেড়ে দিয়ে তিথি নদীর অতলে মৎস্যকন্যা হয়ে ঘুরে বেড়াবে।

আর আশ্চর্য, তার কথারই প্রতিধ্বনি যেন করছে তিথি। বলছে অরুদা আমি তো অন্য জন্মে নদীতে মৎস্যগন্ধা হয়ে ঘুরে বেড়াতাম। এ—জন্মে তিথি হয়ে জন্মেছি। তুমি তো কিছুই জানো না।

কত নিশ্চিন্তে এমন কথা বলছে, তার মাথা ধরে যাচ্ছিল। মৃত্যুর মুখে পড়ে গিয়ে, ঠিক পড়ে গিয়ে নয়, যেন কোনও আত্মবিনাশের প্রবণতা থেকে মেয়েটা তার সঙ্গে এভাবে কথা বলছে।

সে আর পারছে না। বলল, ঠিক আছে, সাবধানে উঠে আয়। নে, বলে সে গামছার প্রান্তভাগ ছুঁড়ে দিল তিথির দিকে। তিথি ইচ্ছে করেই যেন ধরল না। এমনকি চেষ্টাও করেও দেখল না, গামছাটা ধরা যায় কিনা।

শুধু বলল, কী দেখবে না তো?

না, দেখব না।

তুমি আমাকে স্বপ্নে না দেখলে তুলিদিকেও স্বপ্নে দেখবে না।

দেখব না, দেখব না।

তিন সত্যি।

তিন সত্যি।

তারপরই তিথি জলের ঘূর্ণিতে অদৃশ্য হয়ে গেল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *