নারী এবং নদীর পাড়ে বাড়ি – পাঁচ
তারপর এ—দেশে ঋতু পরিবর্তনের পালা শুরু হল। চৈত্রমাসে নদীর চর যতদূর দেখা যায় ধুধু করছে। ফুটি তরমুজের চাষ সর্বত্র। হাওয়ায় ধূলিকণা ওড়াওড়ি করছে। গাছপালা সব গৈরিক রঙ ধারণ করছে। স্টিমার আসে না নদীতে। জল শুকিয়ে গেলে যা হয়। শীর্ণ জলধারা নদীর। পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি। তারপরই মেঘ গুরু গুরু—আকাশ মেঘমালায় ভরে যায়। কালবৈশাখীর ঝড়ে গাছের ডালপালা সব তোলপাড় হয়। আমবাগানে তিথি প্রায় সব সময় পড়ে থাকে। ঝোড়ো হাওয়ায় আম পড়লে মেয়েটা ত্বরিতে ছুটে আসে। আম কুড়িয়ে নেওয়ার এই মোহ থেকে অরণি বাদ যায় না। গাছ থেকে ঝুড়ি ভর্তি আম পেড়ে হরমোহন ভেতরে বাড়িতে দিয়ে আসে।
আজকাল অরণি যতটা পারে তুলিকে এড়িয়ে চলে। আমবাগানে তুলিও আসে। তার সঙ্গে বীণা পিসি। তুলি এসেই আর আগের মতো লাফায় না। কিছুটা গম্ভীর প্রকৃতির হয়ে গেছে। অরণির তেজ তার সহ্য হয় না। অরণি তার পুতুলের বিয়েতে না খাওয়ায় ক্ষোভও কম না তার। সে সুযোগ খুঁজতে পারে।
—ধিঙ্গি হচ্ছিস দিন দিন—তোর কি না পুতুলের বিয়ে! এজন্য তুলি আমবাগানে কিংবা কাছারিবাড়ির আশপাশে বের হয়ে এলেই সে এক দৌড়ে বিশুদার ঘরে ঢুকে যায়। যেহেতু বিকেলবেলায় স্কুল থেকে ফিরে, কোনও খেলাধুলোর ব্যবস্থা থাকে না, ইচ্ছে করলে স্কুলের মাঠেও যাওয়া যায় না—ফুটবল খেলা আপাতত বন্ধ, বিশুদার ঘরে গেলে ক্যারাম পেটাতে পারে। তুলি সেখানে বড় যায় না। ছুটির দিনেই হয় মুশকিল, সারাটা দিন একা একা সে যে কী করে! তিথি তাকে গোপনে পাহারা দেয়, কারণ সে কাছারিবাড়ি থেকে বের হলেই টের পায় তিথি কোথাও না কোথাও দাঁড়িয়ে আছে।
এক সকালে জগদীশ নদীর ঘাট থেকে প্রাতঃস্নান সেরে ফিরে এসে দেখলেন, অরণি খুবই মনোযোগ সহকারে অঙ্ক করে যাচ্ছে। অরণিকে বলা দরকার। চার—পাঁচদিনের জন্য তাঁকে শহরে যেতে হবে। ত্রিশ ক্রোশ রাস্তা, কিছুটা নৌকায়, কিছুটা হাঁটাপথে যেতে হবে। যেতে আসতেই প্রায় দুদিন কাবার। অরণিকে একা থাকতে হবে রাতে। তবে তিনি গোরাচাঁদকে বলে ব্যবস্থা করে গেছেন, গোরাচাঁদের মেয়ে তিথি রাতে তার ঘরে শোবে। অরণি কিছুই জানে না। মামলা—মোকদ্দমার ব্যাপার, উকিল—মুক্তার তাঁকে ছুটি না দিলে তিনি ফিরতে পারবেন না। বলি বলি করেও বলা হয়নি। এই মুহূর্তে না বললেও চলে না। কারণ আজই পুঁটুলিতে চিড়াগুড় বেঁধে তাঁকে রওনা হতে হবে।
তিনি তাঁর ভিজা গামছা দড়িতে মেলে দেওয়ার সময় বললেন, আমি আজ থাকছি না। বুলতা, কালীগঞ্জ হয়ে রাতে রাতে ধামগড় পৌঁছাব। সেখানে আমার রাত্রিবাস। সকালে উঠে আবার রওনা হতে হবে। কবে ফিরতে পারব জানি না, তবে চার—পাঁচদিনের আগে কাজ উদ্ধার হবে বলে মনে হয় না। তুমি সাবধানে থেকো। রাতে তিথি এ ঘরে শোবে। চিন্তা করবে না।
অরণি আগেই জানে, বাবা না থাকলে তিথি তার ঘরে রাতে শোবে। বাবাই তাকে কবে যেন বলেছিলেন। তখন অবশ্য তিথির থাকা নিয়ে তার কোনও সঙ্কোচ ছিল না। তবে ঋতুর রঙ বদলে গেলে বয়স যে এক জায়গায় থাকে না, শরীর এবং মন দুই—ই বিদ্রোহ করে। তিথি থাকবে শুনে, তিথিকে অবশ্য পরে বুঝিয়ে বললে হয়—দ্যাখ তিথি আমার ঘরে তোর থাকার কোনও দরকার নেই। বাবা সেকেলে মানুষ, সব সময় আমার কিছু বিপদ না হয়, এমন ভাবে। আমি একাই শুতে পারব। বিছানা করে দিয়ে তুই চলে যা, এইসব যখন ভাবছিল তখনই বাবা বললেন, সাঁজ লাগলে একা এই ঘরে তোমার না থাকাই ভালো। সেদিন কী হয়েছিল জানি না, দ্বিজপদও বললেন, ছেলেমানুষ, এমন পরিত্যক্ত আবাসে একা থাকলে ভয় পেতেই পারে। ভয়ে সে মূর্ছা গিয়েছে, দ্বিজপদ সার নিজের চোখে দেখেছেন, এভাবেই সব চাউর হয়ে যায়। সে যতই সেদিন স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করুক, দ্বিজপদ সারের অমোঘ কথা বাবা বিশ্বাস না করে পারেন না। নিজেকে গোপন করার জন্য সেদিন সে চাদরে শরীর ঢেকেও নিয়েছিল। কেউ গায়ে চাদর জড়িয়ে কি মূর্ছা যায়! দ্বিজপদ সার কেন যে বলতে গেলেন! শুধু বাবাকেই না, মনে হয় বাবুদের বাড়ির সবার কাছেই প্রচার হয়ে গেছে, অরণি অন্ধকারে তক্তপোশে পড়েছিল, কোনও হুঁশ ছিল না!
কী যে বিপদ—সে বলল, হরমোহনদাদু থাকলে হয় না!
সেও তো আমার সঙ্গে যাচ্ছে। তিথি শুলে কি তোমার আপত্তির কিছু আছে!
আপত্তির কথা বলার অর্থই সে সব বুঝতে শিখে গেছে। এই বুঝতে পারাটা এই বয়সে কত বড় অপরাধ গুরুজনদের কাছে সে বোঝে।
সে বলল, না না আপত্তির কী আছে? তবে কেউ না শুলেও আমার অসুবিধা হবে না। আমার জন্য আবার তিথিকে বিরক্ত করা…
সে বিরক্ত হয় না। তার এই সুন্দর স্বভাবের জন্যই সে জীবনে সুখী হবে। একবার তার কাজকাম বন্ধ করে দিয়ে তো বুঝেছিলে, কী অনর্থ ঘটতে পারে!
বাবা সকাল সকাল রওনা হয়ে গেলেন। হরমোহনদাদু মাথায় ফেট্টি বেঁধে পেছনে রওনা হল। কাঁধে লম্বা বেতের লাঠি। মাথায় একটা পুঁটুলি। বাবা ক্যাম্বিসের জুতো পরে হাঁটুর সামান্য নিচে কোঁচা লুটিয়ে দুগগা দুগগা বলতে বলতে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন। সিঁড়ি ধরে নামার সময় বলেছিলেন রোদে ঘুরে বেড়াবে না, নদীতে চান করতে গেলে দু ডুব দিয়ে উঠে আসবে। জলে পড়ে থাকবে না। এ সময়টা দেবী ওলাওঠার আবির্ভাব হয়, নদীর জল না খাওয়াই ভালো। গুটি বসন্তের কাল, রোদের তেজ প্রখর, ঝোড়ো হাওয়ায় বেশি ঘুরে বেড়াবে না। হাওয়ার সঙ্গে গুটি বসন্তের জীবাণু উড়ে বেড়ায়।
তারপর বাবা বলেছিলেন, ঋতুটির রঙ বড়ই অগ্নিবর্ণ। ওলাওঠায় চরের মানুষজন সাফ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিষেধকের কোনও ব্যবস্থা নেই। চৌকির নিচে নিমের ডাল রেখে দেবে রোজ। এতে কিছুটা প্রতিষেধকের কাজ করবে।
এটা ঠিক, এই ঋতুটির আবির্ভাবের সঙ্গে বাবা রোজ কিছু নিমপাতা বালিশের নিচে রেখে দেন। কখনও নিমের ডাল এনে চকির নিচে ঢুকিয়ে রাখেন। রান্নাবাড়িতে কচি নিমবেগুনের ব্যবস্থা হয়। টিউকল কিংবা ইঁদারার জল ছাড়া পানীয় জলের ব্যবহার থাকে না। নদীর জল কিংবা পুকুরের জল যে খাওয়া হয় না তাও নয়। তবে ফুটিয়ে। তার জন্য বাবার দুশ্চিন্তার যে শেষ থাকে না, এইসব বাধা নিষেধে সে ভালোই টের পায়। চরে কিংবা নদীর পাড়ে ছুটতে ছুটতে তেষ্টা পেলে নদী থেকে গণ্ডূষ করে সে কেন, সবাই জল তুলে খায়। বর্ষায় কিংবা শীতে খাওয়া গেলেও এ—সময়টায় খাওয়া একেবারেই অনুচিত, বের হওয়ার আগে পই পই করে মনে করিয়ে দিয়ে গেছেন।
বাবা বের হয়ে গেলে সেও কিছুটা হেঁটে গেল। নদীর পাড় পর্যন্ত সে গেল। নদীতে নৌকা লেগে আছে। চরের ওপর দিয়ে অনেকটা রাস্তা হেঁটে গিয়ে বাবা নৌকায় উঠে পড়লেন। কালীগঞ্জ পর্যন্ত যাওয়া যাবে। তারপর আর নৌকা যাবে না। বর্ষা না নামলে নদী নাব্য হয়ে উঠবে না।
যতক্ষণ বাবার ছই দেওয়া নৌকাটি দেখা যাচ্ছিল, অরণি পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। এত নিরিবিলি এই ঘাট যে কাকপক্ষী উড়ে গেলেও ডানার শব্দ পাওয়া যায়। আজ ছুটির দিন বলেই সে বেশি একা। স্কুলে গেলে সময় কোথা দিয়ে কেটে যায় এবং বিকেলে তারা সবাই মিলে হইহই করতে করতে স্কুল থেকে একসঙ্গে ফেরে। গাছে ফলপাকুড়েরও অভাব থাকে না। লটকন ফলের গুচ্ছ সহজেই লাফিয়ে গাছ থেকে পেড়ে নেওয়া যায় কিংবা মজাখালের পাড় ধরে ফিরলে কার্তিক অঘ্রাণে সহজেই বেতঝোপে বেথুনফলের খোঁজে ঢুকে যাওয়া যায়। ছুটির দিনটি এমনিতেই তার কাটতে চায় না, আজ বাবা না থাকায় কেমন বিমর্ষ লাগছে—কিছুটা নিরুপায় যেন সে! আর তখনই কোনও জঙ্গলে বসে তিথি ‘কু’ দিচ্ছে।
তিথি না অন্য কেউ! তবে কেন যে মনে হল তিথি ছাড়া তার সঙ্গে মজা করার সাহস কারও নেই। ডানদিকের সড়ক পার হয়ে গেলে জেলে পাড়া, তার বয়সি ছেলেছোকরার অভাব নেই। তার বয়সি মেয়েও অনেক। তবে ভুঁইঞামশায়ের পুত্র বলেই তাকে যথেষ্ট সমীহ করে। কেউ কেউ তার সঙ্গে আপনি—আজ্ঞে করে— সুতরাং চরের কাশবন থেকে যেই তাকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করুক, সে পাত্তা দেবে না। তার মন ভালো নেই। কাছারিবাড়িতে ফিরে যেতেও ভালো লাগছে না। গরমও পড়েছে। বেলাও বিশেষ হয়নি, অথচ মনে হচ্ছে হাওয়ায় আগুনের ভাপ ছড়াচ্ছে। নদীর জলে ডুবে থাকলে এ সময় বেশ আরাম পাওয়া যায়।
সে নদীর চর ধরে দৌড়ে যেতে থাকল।
তখনই মনে হল ঝুপ করে কেউ জঙ্গলে উঠে দাঁড়িয়েছে। সে ফিরেও তাকাল না। কারণ তিথি যদি সত্যি হয়, তবে এই পেছনে লেগে থাকা তার পক্ষে সহ্য করা কঠিন হবে।
সে জলে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
নদীর জলে সকাল সকাল মানুষের ভিড় থাকলেও বেলা বাড়লে ভিড় কমে যায়। প্রায় লু বইবার মতো অবস্থা। নদীর ওপারের ঘাটে কেউ কাঠ কাটছে, নদীতে এদিক—ওদিক নৌকা পড়ে আছে ঠিক, তবে মাঝিমাল্লাদের দেখা যাচ্ছে না। কাঠ কাটার শব্দ নদীর পাড়ে বড় বেশি আওয়াজ নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। জলে ডুব দিয়েও সেই আওয়াজ শোনার সময় মনে হল তার পা কিছুতে জড়িয়ে ধরেছে।
জল এদিকটায় এখন গভীর। সে ভোঁস করে ভেসে উঠল। তীর থেকে বেশ দূরেই সে চলে এসেছে। ঘাট থেকে মানুষজন ডুব দিয়ে উঠে যাচ্ছে, তার পায়ে কে যে জড়াজড়ি করে সরে গেল, সে ভোঁস করে ভেসে উঠেও কিছু দেখতে পেল না। তারপরই মনে হল পাশেই কেউ আছে—তার দিকে জল ছিটাচ্ছে। তিথি ছাড়া আর কারও যে সাহস হবে না তাও সে জানে।
সে দেখবে না। তিথি যাকে সে এড়িয়ে চলতে চায়, সেই তাকে নিষ্কৃতি দিচ্ছে না।
সে যে কত অসহায়, বাবা যেন তিথিকে রাতে তার ঘরে শুতে বলে আরও বেশি করে বুঝিয়ে দিয়ে গেল। মেয়েটার উপদ্রবে শেষে সে কি অস্থির হয়ে উঠবে!
সে তিথিকে অনায়াসে তেড়ে যেতে পারত। তিথি যতই ভালো সাঁতার জানুক, সে ইচ্ছা করলে তিথিকে গিয়ে অনায়াসে ধরে ফেলতে পারে। ডুবসাঁতারে চিতসাঁতারে সেও কম দক্ষ নয়, কিন্তু তার ইচ্ছেই করছে না তিথির দিকে তাকাতে। বাবা তিথিকে রাতে তার ঘরে শুতে না বললেই পারতেন। তারা যে বড় হয়ে গেছে বাবা কিছুতেই বোঝেন না।
সে যে তিথির ওপর খুবই ক্ষুব্ধ।
তিথি অন্তত বুঝুক কাছারিবাড়িতে তার রাতে থাকা সে পছন্দ করছে না। তিথিটা বোকা না পাগল তাও সে বোঝে না। তাছাড়া সেও কম অসহায় নয়, তিথিকে সে বারণ করে দিতে পারে, বেরও করে দিতে পারে ঘর থেকে, কিন্তু নিঝুম রাতে পাখিরা কলরব করলে, কিংবা কীটপতঙ্গের আওয়াজও উঠতে পারে, হাওয়ায় টিনের চালে ডালপালার ঘর্ষণের বিদঘুটে আওয়াজ, একা ঘরে শুয়ে খুবই উপদ্রবের শামিল সে বোঝে। আর রাতে ঝড়বৃষ্টি হলে সে যে খুবই ফাঁপরে পড়ে যাবে। শুয়ে থাকলে, কড়িবরগায় ফেলে রাখা মুলিবাঁশের ছাদে ধস্তাধস্তি যদি শুরু হয়, রাতে অশুভ আত্মারাও তাকে একা পেয়ে নানা তামাশায় মত্ত হতে পারে—এইসব চিন্তাতেই তিথিকে সে ঘাঁটাতে সাহস পাচ্ছে না। তিথি ইচ্ছে করলে রাজি নাও হতে পারত, বাবা তবে আর কারওকে বলে যেতেন। কিন্তু তিথি যে এক পায়ে খাড়া। বাবাও বোঝেন না, তিথিও তুলির মতো বড় হয়ে গেছে। এবং তার ভেতর নিজের শরীর নিয়ে এক গোপন অভিমান গড়ে উঠছে—তার মূর্ছা যাওয়ার কথাও একরকম যেন জোর করেই চাপানো—এতে আর কারও সুবিধা না হোক, তিথির খুবই সুবিধা হয়েছে। যেন সে নিজের অধিকারেই তাকে পাহারা দেওয়ার অধিকার পেয়ে গেছে।
সে তিথিকে কিছু বলছে না।
তার দিকে জলের ঢেউ তুলে দিচ্ছে তিথি।
তাকে ডাকছে, অরুদা চলো সামনে যাই। তুমি কতটা দূরে যেতে পারো দেখি। চলো নদী পার হয়ে ওপাড়ে উঠি।
সে তীরের দিকে উঠে যাচ্ছে। তিথির কথায় সাড়া দিচ্ছে না।
তিথি তার পিছু নিয়েছে।
এই অরুদা উঠে যাচ্ছ কেন? আমি তোমাকে কিছু বলেছি?
অরণি ভ্রূক্ষেপ করছে না। তার মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে আছে।
এই অরুদা ঠিক আছে, আর জল ছিটাব না। তুমি ডুবে মাটি তুলতে পারবে? আমি পারি,দেখবে?
অরণি ঘাটের কাছে, যেখানে কাদামাটি এবং খুবই পিছল, পা টিপে টিপে এগোচ্ছে।
তিথি মানবে কেন?
সে লাফিয়ে জল থেকে উঠে অরণির কাছে গিয়ে হাত চেপে ধরল। তিথি তাকে জলে নিয়ে নামবেই। তিথি তাকে জল থেকে উঠতে দেবে না। সে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। জোরাজুরি করলে তিথি জলে কাদায় আছাড় খেয়ে পড়ে যেতে পারে। না করেও উপায় নেই, সে এক ধাক্কায় তিথিকে সরিয়ে এগিয়ে যেতেই দেখল তিথি পড়ে গেছে চিত হয়ে। পড়ে গিয়ে সড়াৎ করে নদীর ঢালুতে পিছলে গেছে।
তিথির ফ্রক কোমরের উপরে উঠে যাওয়ায় সে পুরোদস্তুর বেকুব। তিথি ইজের পরেনি। শুধু ফ্রক গায়ে জলে নেমে এসেছে। সে লজ্জায় অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। ছি! সে এটা কী করল! খুবই অপরাধ তার। তিথির কাছে ক্ষমা চাওয়ারও সে অযোগ্য। সে জানবে কী করে তিথি ইজের না পরেই জলে নেমে এসেছে। তার শরীর রোমাঞ্চিত, আবার অপরাধবোধও আছে, সে তিথির দিকে আর তাকাতে পারছে না। ভাগ্যিস ঘাটে কিংবা নদীর পাড়ে কাছাকাছি কেউ নেই!
তিথির দিকে সে ফিরে তাকাতেও পারছে না।
তিথি এখন কী করছে তাও সে জানে না।
তিথি যদি দেবী দুর্গার মতো জলের কিনারে একইভাবে পড়ে থাকে, তবে আর যাই হোক, তাকানো যায় না। সে নিদারুণ সঙ্কটে পড়ে গেল। কাছে যেতেও পারছে না। হাত ধরে তুলে দিয়ে বলতে পারছে না, ওঠ তিথি। তোর লাগেনি তো!
তিথি কোনওরকমে ততক্ষণে উঠে বসেছে। ফ্রক দিয়ে হাঁটু, শরীর সব দ্রুত ঢেকে পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল, তুমি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে!
সে খুবই কাতর গলায় বলল, ওঠ। আর ফেলব না। আমি কি জানি তুই পড়ে যাবি! ধাক্কা দেব কেন!
তিথি ছাড়ার পাত্র নয়। সে বলল, আমার সব তুমি দেখে ফেললে কেন? বলো কেন দেখে ফেললে!
না, আমি তোর কিছু দেখিনি বলতে পারত। কিন্তু বড় মিছে কথা হবে। সে সবই দেখেছে, এমনকি সবুজ নিথর প্রান্তরটিও। এত কুহক, এই শরীরে, সে চোখ ফেরাতে পারছে না, নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। যেন প্রকৃতি আর শরীরের এক অসীম অনন্ত লীলারহস্যের যুগপৎ খেলায় সে অস্থির হয়ে উঠছে। প্রকৃতি তার বাহু মেলে দিয়েছে তিথির শরীরে।
তিথির কাছে এখন যাওয়া যায়। তিথি সব ঢেকে হাঁটুর কাছে ফ্রক টেনে কাদার মধ্যেই লেপটে বসে আছে। সে উঠছে না।
অরণি হাত ধরে না ওঠালে, সে যেন উঠবে না।
সে কাছে গিয়ে বলল, ওঠ। বাড়ি যাব।
তিথির চোখে জল। তিথি কোনও জবাব দিচ্ছে না।
অরণি কী করবে ভেবে পাচ্ছে না।
তিথির সবকিছু সে দেখে ফেলে কেমন কিছুটা মুহ্যমান। সে কাছেও যেতে সাহস পাচ্ছে না। তিথির রোষ শেষ পর্যন্ত কীভাবে ফুটে বের হবে, সেই আতঙ্কেই সে অস্থির।
তিথি ওঠ। আমি কী জানি তুই পড়ে যাবি। আমার কী দোষ বল? তুই কাঁদছিস কেন তাও বুঝছি না। আমি ইচ্ছে করেও তোকে ফেলে দিইনি!
তিথি সহসা লাফিয়ে তার জামা খামচে ধরল। আঁচড়ে খামচে দিচ্ছে।
কেন তুমি আমার সব দেখে ফেললে! আমার আর কী থাকল!
অরণি হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
এই আমার লাগছে তিথি। তুই কী করছিস বল তো।
লাগুক। একশোবার লাগবে। তুমি আমার সঙ্গে কখনও আর কথা বলবে না।
ঠিক আছে, বলব না। চল এবার।
আমি তোমাকে মজা দেখাচ্ছি, দাঁড়াও।
এবারে সত্যি ভয় পেয়ে গেল অরণি। তিথি কি তুলিকে সব বলে দেবে! মেয়েদের কত গোপন কথা থাকে। তুলির সঙ্গে যে এত ভাব, সেই গোপন কথার সুবাদে। সে বাবুদের বাড়িতে থাকে। বাবা তার বাবুদের আমলা। বাবুদের মেয়ে তুলির হাতে এভাবে অস্ত্র তুলে দিলে সে যে খুবই বিপদে পড়ে যাবে। এখন তিথিকে বশে না আনতে পারলে সত্যি কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। সেই সবুজ নিঃসঙ্গ প্রান্তরটি কিছুতেই চোখ থেকে তার সরছে না। তিথির সব মাহাত্ম্য সবুজ প্রান্তরে সে গোপন করে রেখেছিল। তাই যদি কেউ দেখে ফেলে তবে আর তিথির ইজ্জত থাকে কী করে!
সে ভারী বিষণ্ণ হয়ে গেল।
গরমের তাপে তার জামাপ্যান্ট শুকিয়ে যাচ্ছে। তার হাফপ্যান্টের নিচে কাদা লেগে আছে। হাতে—পায়ে কাদা। তিথি তাকে কাদায় মাখামাখি করে দিয়েছে আঁচড়ে খামচে দেওয়ার সময়।
সে সোজা জলে নেমে আবার ডুব দিল—নদীর জল এত ঠান্ডা হয়ে আছে নিচে যে উঠতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু তিথির সামনে তার দাঁড়াবার আর সাহস নেই। সে জল থেকে উঠে সোজা দৌড়াতে থাকল। যা হয় হবে। কিন্তু তিথি রাতে আসবে। তখন যদি সে কিছু করে বসে। তার তো আর ইজ্জত ধর্ম কিছু নেই। বাবুদের বাড়ির এঁটোকাঁটা খেয়ে বড় হয়ে উঠেছে যে তিথি, তারও যে এত ইজ্জতবোধ জানবে কী করে!
সে কিছু করেই বসতে পারে।
কিছুটা এসেই মনে হল এভাবে তিথিকে একা ফেলে চলে যাওয়া বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। নদীর চর এখন সামনে পেছনে। নদীর পাড় ধরে ইতস্তত দু—একজন চাষী কিংবা ব্যাপারী মানুষ বাজারের দিকে যাচ্ছে। কোথাও আজ হয়তো হাটবার আছে, চরের পাশে কিছু নৌকায় আনাজ তরকারি উঠছে। কেউ নেমে যাওয়ার সময় বলল, অরুবাবু যে! এত রোদে ঘুরে বেড়াচ্ছেন! গরমে কাহিল হয়ে পড়েছেন দেখছি। মুখ রোদে পুড়ে গেছে। ভুঁইঞামশায় কবে ফিরবেন!
সে বলল, জানি না।
সে মরছে তার আতান্তরে।
কারণ আরও দূরে সেই মেয়েটি কী করছে, দেখারই বেশি বাসনা তার।
তিথি জলে নেমে গেল, ডুবও দিল, তারপর পাড়ে উঠে দৌড়াতে থাকল তার পিছু পিছু।
যাক, মাথা ঠান্ডা হয়েছে।
সে দাঁড়িয়ে গেল।
তিথিও দাঁড়িয়ে গেল।
বোধহয় তিথি তার সঙ্গে ফিরতে চায় না।
সে আবার দাঁড়াল। তিথিও দাঁড়িয়ে গেল।
তিথি কি তাকে মুখ দেখাতে লজ্জা পায়! এতবড় অঘটনের পরে তিথিরও দোষ দেওয়া যায় না। মাথা ঠান্ডা হওয়ায় তার লজ্জায় পড়ে গেছে।
সে আবার হাঁটতে থাকল।
তিথিকে সঙ্গে না নিয়ে ফিরলে, আবার কোথায় কী করে বসবে, তিথিও তাকে যথেষ্ট নির্যাতন করেছে, তিথির মধ্যে প্রবল ক্ষোভ ছিল, এখন মাথা ঠান্ডা হওয়ায় সে নানা ফন্দিও আঁটতে পারে। সে তো তাকে ডাকেনি। ওই যে দোষ তিথির, সব সময় নজর রাখা, কখন সে ঠিক দেখেছে অরুদা নদীর পাড়ের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। বড় বড় সব কড়ুই গাছের নিচ দিয়ে অরুদা তার বাবার পিছু পিছু ঘাটের দিকে যাচ্ছে। তিথি এইসব ভেবেই সুপারিবাগান থেকে বের হয়ে পড়েছিল বোধহয়। তারপর তাকে জলে নেমে যেতে দেখে লোভ আর সামলাতে পারেনি।
কিন্তু তিথির পরনে ইজের ছিল না। তিথির বাবা খুবই গরিব। দস্যি মেয়ের প্যান্ট কিনে দিলেও দু—এক মাসে সেলাই খুলে যায় বোধহয়, ফেঁসেও যেতে পারে। তিথি সেমিজের মতো মার্কিন কাপড়ের ঢোলা জামা গায়ে দিয়ে থাকে—ঝুল আছে অনেকটা, হাঁটুর অনেক নিচে সেমিজ ঝুলে থাকে—তার কি ইজের পরার অভ্যাস নেই! কারণ তার শরীর ঢাকাই থাকে। ইজের না পরলেও চলে যায়, গরিব হওয়ার জন্য তিথি এমন ভাবতেই পারে। বাপের কাছে বারবার ইজের চাইতেও তার সম্ভবত লজ্জাবোধ হয়। সে তো কিছু চাইতেই জানে না। দয়া করে যে যা দেয় তাতেই খুশি মেয়েটা।
তাহলে তিথি তার ঘরে আসে ইজের না পরেই। সে জল তুলে রাখে, ঘরদোর ঝাঁট দেয় ইজের না পরেই। তার কাছে এটা বোধহয় বেআব্রু মনেই হয় না। এত গরিব হলে চলে!
এবং এসব মনে হতেই তিথির জন্য কেমন এক কান্না ভেতরে গোল গোল দলা পাকিয়ে গলার কাছে থমকে গেল।
সে আবার দাঁড়াল। এখান থেকে দূরের প্রাসাদ সব দেখা যায়। কার্নিসের মাথায় পরী উড়ছে। উঁচু লোহার রেলিং দিয়ে বাগান মাঠ এবং পুকুর সব ঘেরা। বৈভব এত চারপাশে, আর তিথি একটা ইজেরের কার্পণ্য করে গরিব বাপের টাকা বাঁচায়।
অরণি আবার পেছন ফিরে তাকাল।
তার কেন যে মনে হল এই অভাগা মেয়েটাকে ফেলে চলে যাওয়া কোনও কারণেই উচিত হবে না।
কিন্তু যা হয়।
তিথিও দাঁড়িয়ে গেছে।
সে আর পারল না। তিথিকে ধরার জন্য এবার সে নিজেই দৌড়াতে লাগল।
বৈশাখের খরতপ্ত বালিরাশিতে দু’জনেই নেমে গেল। কিন্তু তিথির নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। তিথি যে কত বন্য হয়ে উঠতে পারে চরের এই বালিরাশি মাড়িয়ে না গেলে টের পেত না। তার পায়ে ছ্যাঁকা লাগছে। কিছুটা গিয়েই সে আর এগোতে সাহস পেল না। তরমুজের জমিতে উঠে তরমুজের লতাপাতার ওপর দাঁড়িয়ে গেল।
তিথি কিন্তু দৌড়ে চলে যাচ্ছে।
সে খুবই অসহায় বোধ করতে থাকল।
তিথি কোথায় যাচ্ছে! কাকে ডাকবে! কাছারিবাড়ি উঠে গিয়ে কমলদা কিংবা বিশুদাকে খবর দিতে পারে। সে আর তাদের নাম ধরে ডাকে না। কমল অমল বিশুরা তার কাছে সোনাদা, সেজদা, ছোড়দা হয়ে গেছে। সোনাদাকে তিথি ভয় পায়। একদিন কী কারণে সোনাদা তিথির কানও মলে দিয়েছিল। তিথি মাথা নিচু করে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেছে, কিন্তু সোনাদা কানও মলে দিয়েছে বলে কাউকে নালিশ করেনি। তিথিও তার কাজের জন্য বাবুর বাড়ির সবার কাছে প্রিয়। শুধু প্রিয় না, বিশ্বস্তও। ছোটপিসির চিরকুট সে হরিশবাবুকে গোপনে পৌঁছে দেয়। শুধু সেই খবরটা রাখে। তিথি কখনও চিরকুটটি তার হাতে দেয়নি, পড়তেও দেয়নি। ছোটপিসি বালবিধবা। তার যে কত কষ্ট তিথিই বোধহয় একমাত্র টের পেয়েছে। তবু একদিন তিথিকে না বলে পারেনি, চিরকুটে কী লেখা থাকে জানিস?
তিথি সরল বিশ্বাসে বলেছিল, স্বপ্নের কথা লেখা থাকে। ও চিঠি পড়তে হয় না। পড়লে পাথর হয়ে যেতে হয়।
তিথিও কি কোনও স্বপ্নের চিঠি নিয়ে ছুটছে! সে কাছে থাকলে জোরজার করে পড়ে ফেলতে পারে ভয়েই কি ছুটছে! পড়লে সে পাথর হয়ে যেতে পারে—সে পাথর না হয়ে যায়, কারণ সে যে তার সবকিছু দেখে ফেলেছে। অরুদা পাথর হয়ে গেলে সে কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে!
অরণি বুঝতে পারে নদীর চরায় তিথি ক্রমে বিন্দু থেকে বিন্দুবৎ হয়ে যাচ্ছে। সব আজগুবি চিন্তায় সে মাথা ঠিক রাখতে পারছে না।
তিথি শেষে কিছু করে বসবে না তো!
এখুনি বাড়িতে গিয়ে খবর না দিলেই নয়।
কারণ নদীর পাড়ে তিথি অদৃশ্য হয়ে গেছে, সেখানে কি কোনও অরণ্য আছে, অথবা কোনও স্পৃহা থেকে, এমনকি তাকে লোভে ফেলে দেওয়ার জন্যও যে ছুটছিল না তারই বা ঠিক কি!
কিছুক্ষণ সে তরমুজের জমিতে দাঁড়িয়ে থাকল।
চাষি মানুষটি পাতার আড়াল থেকে উঠে বলল, আপনি বাড়ি যান বাবু। তিথির জন্য ভাববেন না। ও এরকমেরই। চাষি মানুষটি তো জানে না, আজ নদীর পাড়ে বড় অঘটন ঘটে গেছে তাদের। তিথি তার মুখ কাউকে আর বোধহয় দেখাতে চায় না।
সে বড়ই অস্থির হয়ে উঠছে।
তার পা চলছে না। একবার একটা গাছের গুঁড়িতে ধপাস করে বসেও পড়ল।
তিথি নেই, উত্তপ্ত বালির চড়া ডিঙিয়ে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল তিথি।
কেন গেল?
কী হয়েছিল!
তখন সে কী বলবে?
তাকে মিছে কথা বলতে হবে।
এই করে সে যখন কাছারিবাড়ি পৌঁছাল—সবাই ছুটে এসেছে।
এই তুই কোথায় গেছিলি! কত বেলা হয়েছে, খাবি না! রান্নাবাড়িতে মা বারবার খোঁজ নিচ্ছে, তুই কোথায়! সে তো খেতে এল না!
তার খাওয়ার ইচ্ছা নেই। রোদে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত। চুল উসকোখুসকো। চোখ জবাফুলের মতো লাল। তিথি যে কোথায় চলে গেল, প্রায় কেঁদেই ফেলত—আর তখনই তিথি সুন্দর একটি ফ্রক গায়ে তুলির সঙ্গে হাজির। তুলির কাছ থেকে পাউডার চেয়ে নিয়ে মুখে পর্যন্ত মেখেছে।
তার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেল যেন।
তিথির সঙ্গে একটা কথাও বলল না। তুলি তাকে দেখে মুচকি হাসছে। এতে তার রাগ আরও বেড়ে গেল। দৌড়ে সে কাছারিবাড়ির ঘরে ঢুকে গেল। ঘরের দরজা বন্ধ করে জামাপ্যান্ট ছেড়ে রাখল। তারপর কাচা হাফপ্যান্ট হাফশার্ট গায়ে দিয়ে রান্নাবাড়ির দিকে হাঁটা দিল। সে খায়নি বলে বাবার বউঠান এখনও না খেয়ে আছে।
এই বাড়ির আলাদা যে রুচিবোধ আছে, ভেতরবাড়ি গিয়েই সে টের পেল। সে শুধু খায়নি, আর সবাই খেয়ে নিয়েছে এ বাড়িতে বোধহয় তা হয় না। আসন পাতা আছে পর পর। জলের গেলাস থালা দিয়ে ঢাকা। কাগজিলেবু, নুন, কাচালংকা সাজানো—সে ভেতরবাড়ি ঢুকতেই সোনাদা চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে, বাবু এয়েছেন মা। রোদে কোথায় টো—টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ভুঁইঞাকাকা নেই, তিনিও স্বাধীন। আসুক ভুঁইঞাকাকা, কোথায় যাস!
বাবার বউঠানকে সে জেঠিমা ডাকে। সামান্য স্থূলকায় এবং ফর্সা দেখতে, হাতে চকচক করছে সোনার বালা, পায়ে আলতা, তাঁর বউমাটিও হেঁশেলে অপেক্ষা করছেন, তার জন্য সবারই পাতে বসতে দেরি হয়ে গেল, তিথি কতভাবে যে ভোগাচ্ছে!
জেঠিমা বললেন, কীরে তোর চোখমুখ এত শুকনো কেন! তোর বাবা কাজে বাইরে গেছেন বলে, যেখানে—সেখানে ঘুরে বেড়াবি! কী চিন্তা হচ্ছিল!
তারপর বললেন, বলে যাবি তো! কেউ কিছু বলতে পারল না। তিথিও না।
পা থেকে মাথায় রক্ত উঠে গেল। তিথি এত বেইমান! সারাটা সকাল—দুপুর তাকে ঘুরিয়ে হয়রান করেছেন, সে বলেছে, কিছু জানে না!
তিথির কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। সে সেই আগের মতো পা ছড়িয়ে বসে আছে রোয়াকে। সেই যে আসন পেতে দিয়েছে, গেলাসে গেলাসে জল ঢেলেছে, এবং থালায় কাগজিলেবু, কাঁচালংকা সাজিয়ে রেখেছে, বসে পড়লেই সবার পাতে পাতে সব সে দেবে—অথচ ঘুণাক্ষরেও জানাল না, সে চরে তরমুজের জমিতে তার জন্য কতক্ষণ যে অপেক্ষা করেছে! নিজে কোথা থেকে কীভাবে যে ঠিক উঠে এসেছে, সে কি একবারও দেখতে পায়নি, কেউ তার জন্য নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে! এত শয়তান মেয়েটা! সে তো রাস্তাঘাট ভালো জানে না। বাবা তাঁর কর্মস্থলে নিয়ে এসেছেন। স্কুলে সেই কবে ভর্তি করে দিয়েছেন। সে একা নদীর পাড় ধরে বেশিদূর হেঁটেও যায় না। ভয়, সে না কোথাও হারিয়ে যায়। নদীর ওদিকটায় সে কখনও যায়ওনি। সে জানবে কী করে, আসলে তিথি দৌড়ে একা উঠে আসার জন্যই তাকে নদীর চরে ফেলে রেখে এসেছে।
গরমে চরাচর যেন হাঁসফাঁস করছে। খাওয়া হয়ে গেলে সে কোনওরকমে মাঠ পার হয়ে শেকল খুলে ঘরে ঢুকে গেল। চকির কাঠ পর্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে আছে। রোদে এত তেজ যে বাইরে তাকানো যাচ্ছে না। কাকগুলির কর্কশ চিৎকারে কেমন তার মাথা ধরে যাচ্ছে। জানালা খুলে দিয়ে ভেবেছিল, নদী থেকে ঠান্ডা হাওয়া উঠে আসবে। তাও এল না। গরম বাতাসে মুখ যেন ঝলসে যাচ্ছে। এই ঘরে শুয়ে থাকার অর্থ ভাপে সেদ্ধ হওয়া। কোনও গাছতলায় গিয়ে বসে থাকলেও বোধহয় আরাম পাওয়া যেত। কিন্তু শরীর আর দিচ্ছে না। জামা খুলে বালিশ টেনে শুয়ে পড়তে গিয়ে টের পেল, বালিশ চাদর তোশক সবই তেতে আছে। তার যেন আর নড়ারও ক্ষমতা নেই। সে শুয়ে পড়তেই ঘুমে তলিয়ে গেল।
টিনের ঘর বড় সহজেই গরম হয়ে যায়, আবার ঠান্ডাও হয়ে যায়। ঘুমের মধ্যেই সে টের পেল, তিরতির করে চোরা ঠান্ডা স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, মেঘ গর্জনও শুনতে পেল। বাইরে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়েছে কখন, জানালা দিয়ে ছাঁট আসছে, সে ধড়ফড় করে উঠে বসল। জানালা দিয়ে দেখল, গাছের শাখা—প্রশাখা দুলছে। বেশ জারে হাওয়া দিচ্ছে। টিনের চালে বৃষ্টির জলতরঙ্গ আওয়াজ। কখনও ঝমঝম, কখনও রিনরিন। প্রকৃতির চেহারাই পালটে গেছে। তার শীত শীত করছিল। বিছানার চাদর গায়ে জানালার ধারে অঝোরে বৃষ্টির দাপাদাপি দেখার জন্য সে কেমন পাগল হয়ে উঠল। দুরন্ত তিথি তাকে কিছুতেই ছাড়ছে না—কিংবা তুলি। বারবার তাদের চোখ মুখ শরীরের তাজা গন্ধ বৃষ্টির ছাটে মিলেমিশে গোলমাল পাকিয়ে দিচ্ছে।
আর তিথি তখনই একটা ছেঁড়া ছাতা মাথায় পা টিপে টিপে এসে হাজির। তার জল তোলা আছে, হারিকেনে তেল ভরা আছে, চিমনি মুছে তার সাফসোফ করার কাজও আছে। সে কতক্ষণ ঘুমিয়েছে জানে না। কখন থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে তাও জানে না। মাঠে জল জমে গেছে। জলে কীটপতঙ্গ ভেসে বেড়াচ্ছে, আর বিচিত্র শব্দতরঙ্গ উঠে আসছে—কোথাও জল নেমে যাচ্ছে, কোথাও মাটি পাগলের মতো জল শুষে নিচ্ছে— অজস্র বুড়বুড়ি জলে ভেসে মিলিয়ে যাচ্ছে। পাখপাখালির ওড়াওড়ি বন্ধ—ডালে বসে বৃষ্টির জলে ভিজছে, কখনও পাখা ঝাপটাচ্ছে। তিথি ঘরে কাজ করছে তার, সে তিথির দিকে তাকাচ্ছে না, সেই পড়ে যাওয়ার দৃশ্যটাই তাকে বারবার তাড়া করছে।
তিথিকে এখন ঘাড়ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিলে যেন সারা সকাল—দুপুরের প্রতিশোধ নেওয়া যেত—কিংবা তিথিকে বললে হয়, রাতে আমার ঘরে তোকে শুতে হবে না, রাতে তুই আসবি না। এইসব ভাবতে ভাবতেই তিথি কখন যে চলে গেল, কোনও কথা বলল না, সন্ধ্যাও হয়ে গেল।
তিথির পড়ে যাওয়ার দৃশ্যটা কেমন তার মাথার মধ্যে গেঁথে আছে। তাকে তাড়াও করছে। সে কখনও বিমর্ষ হয়ে যাচ্ছে, কখনও সেই শরীর এক আশ্চর্য সুবাতাস বহন করে আনছে। সে তিথির এই পড়ে যাওয়ার ঘোর থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছে না। কত রাত হয়েছে তাও জানে না। গোলঘরে গিয়েও বসেছিল কিছুক্ষণ। ছুটির দিন বলে দ্বিজপদ সার তাদের পড়াতে আসেননি। সে একটা ছাতা মাথায় বাবার টর্চটি নিয়ে পড়ার ঘরে চলে গিয়েছিল, ঘোর থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য কিছুক্ষণ ক্যারাম পিটিয়েছে, তারপর রাতের খাওয়া সেরে আবার ঘরে ঢুকে গেছে। তিথি আসেনি।
তিথি এলে কী হবে?
সে দরজা বন্ধ করে দিল।
দূরে শেয়ালেরা ডাকছে। এই বিভীষিকাকে সে গ্রাহ্য করতে চায় না।
তিথি একফাঁকে তার বিছানা করে রেখে গেছে। মশারিও টাঙানো। চকির অন্যপাশে বাবার বিছানা গোটানো। তিথি এসে শোবে কোথায়!
তিথি তার আলাদা বিছানাও পেতে রাখেনি। তিথির সঙ্গে তার একটাও কথা হয়নি আর। সে এই ঘরে শুতে নাও আসতে পারে।
কিছুটা হালকা হয়ে গেল। জানালা খোলা আছে—ঝিরঝিরে বৃষ্টির ক্লান্তি নেই—বর্ষা শুরু হয়ে গেল বোধহয়। জোনাকি জ্বলছে ঝোপে জঙ্গলে—কেমন নিথর হয়ে আছে চরাচর। সে শুয়ে পড়ল।
তিথির কথা ভাবতে ভাবতেই সে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে জানে না। তখনই দরজায় টোকা। খুবই সন্তর্পণে।
সে সাড়া দিল না।
তারপর কড়া নাড়ার শব্দ।
সে পাশ ফিরে শুল।
এই অরুদা দরজা খোল। কী হল রে বাবা! কুম্ভকর্ণের নিদ্রা!
সে নাক ডাকাতে থাকল।
দ্যাখ অরুদা সারাটা দিন, অনেক জ্বালিয়েছ, কিছু বলিনি। মটকা মেরে পড়ে আছো, তুমি মনে করো আমি কিছু বুঝি না। কাকা বারবার বলে গেছে, না হলে তোমার ঘরে শুতে আমার ভারী বয়ে গেছে।
সে যেন সাহস পেয়ে গেল এবার। সে বলল, একা শুতে আমার অসুবিধা হবে না। তুই যা। এত রাতে আর জ্বালাবি না।
জ্বালাব না! কে জ্বালায়? আমি না তুমি! দরজা খোলো বলছি। খোলো বলছি।
তিথি দরজা ধাক্কাতে থাকল।
তিথি চেঁচামেচিও শুরু করে দিতে পারে। এত রাত্রে চিৎকার—চেঁচামেচি কেউ শুনতে পেলে কী ভাববে! অবশ্য ঘরটা মাঠের মধ্যে—জমিদারবাবুদের প্রাসাদও কাছে নয়, যে শোনা যাবেই, তবু যদি কেউ শুনেই ফেলে—সে তাড়াতাড়ি মশারি তুলে চকি থেকে নেমে গেল—হারিকেন উসকে দিল। দরজা খুলে অবাক, কোনওরকমে তালিমারা ছাতায় তিথি তার মাদুর বালিশ বৃষ্টির ছাট থেকে বাঁচিয়ে সিঁড়িতে উঠে এসেছে।
নাও ধরো। বলে বগলের মাদুর বালিশ তাকে দিয়ে ছাতাটা বন্ধ করার আগে বলল, এক ঘটি জল দাও। পায়ে কাদা লেগে আছে।
তিথি যা বলছে, অরু বাধ্য ছেলের মতো সব করে যাচ্ছে। তিথির ফ্রকের নিচে যদি ইজের না থাকে—তার মাথাটা ফের কেমন গোলমালে পড়ে গেল।
সেই এলি!
আসব না কেন?
সে আর কিছু বলল না।
তিথি মেঝেতে মাদুর পেতে তারপর বালিশ ঠেলে দিল ওপরের দিকে। সে আলগা হয়ে মাদুরে বসেছে। গামছা দিয়ে পা মুছল।
তিথি আজ আলতা পরেছে পায়ে।
তিথি তার বোধহয় পুজোর ফ্রক গায়ে দিয়েছে। সুন্দর লতাপাতা আঁকা ফ্রকে তিথির স্তন কিছুটা ভেসে উঠেছে। এই প্রথম তিথিকে সে চুরি করে দেখছে। তিথির দিকে তার এতদিন যেন কোনও নজরই ছিল না। এমনকি নদীর জলে তিথিকে সামান্য তিথি বলেই এত ঝগড়া করতে পেরেছে। তিথি যেন সহসা হাওয়ায় বড় হয়ে গেল তার কাছে—ফ্রকটা যে কিছুটা টাইট তাও বুঝতে পারল। সে যে ঢোলা সেমিজের মতো মার্কিন কাপড়ের ফ্রক পরে থাকে—তার কোনও অন্তর্বাস থাকে না, সে চিত হয়ে পড়ে না গেলে কিছুই টের পেত না। পড়ে গিয়েই তাকে এতটা বিপর্যস্ত করে দিয়েছে, এই মুহূর্তে তিথিকে দেখে তাও বোঝা গেল।
তিথি মুখে প্রসাধনও করেছে। তুলির কাছ থেকে ইচ্ছে করলে সবই চেয়ে নিতে পারে। চুল দু’বিনুনি করে মাথায় টেনে বেঁধেছে। হাতে পিতলের চুড়ি পরেছে। নাকে নথও ঝিলমিল করে উঠল। কিন্তু তিথির ফ্রকের নিচে যদি ইজের না থাকে!
তিথি এবার তাকাল। কী হল, বসে থাকলে কেন, শুয়ে পড়ো।
তোর মশারি আনলি না? মশারি টাঙিয়ে না শুলে মশা কামড়াবে।
অতীব এক তির্যক চোখে তার দিকে তাকিয়ে খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, মশা আমাকে কামড়ায় না।
মশা তোকে কামড়ায় না?
না। কামড়ায় না। বললাম তো।
মশারি না টাঙালে শুতে দেব না।
তুমি শুতে দেওয়ার কে? অযথা ঝগড়া করবে না। মশারি টাঙালে কতটা আর আব্রু থাকবে বলো! যা দেখার দেখে ফেলেছ।
কত সহজে কথাটা বলে ফেলল তিথি! এতবড় নির্লজ্জ কথা বলতে বিন্দুমাত্র আটকাল না তিথির।
সেও তেরিয়া হয়ে উঠল, কী দেখে ফেলেছি! আমি কিছু দেখিনি!
দেখেছ! মিছে কথা বলবে না। মিছেকথা বললে আমার মাথা ঠিক থাকে না। রাত হয়েছে শুয়ে পড়ো। হারিকেন নিভিয়ে দিচ্ছি।
না, নেভাবি না।
আলো থাকলে আমার ঘুম হয় না।
তাহলে জেগে শুয়ে থাক।
সেই ভালো। তুমি ঘুমিয়ে পড়লে নিভিয়ে দেব। বলে সে বালিশ টেনে চিত হয়ে শোওয়ার আগে বলল, দুগগা দুগগা। তিথির হাই উঠছে। সে বালিশে থাবড়া মেরে কীসব ঠিক করে নিল। পাকা বুড়ির মতো আচরণ। নিশুতি রাতে কতরকমের আতঙ্ক থাকে, ঠাকুরের নাম করে সেই আতঙ্ক থেকে যেন রক্ষা করতে চাইছে অরণিকে।
অরণি কিছুতেই মশারির নিচে ঢুকছে না।
কী হল, বসে থাকলে কেন!
অরণি গুম মেরে বসে আছে?
ইস আলোটা চোখে কী লাগছে! বলেই উঠে পড়ল তিথি। হারিকেনটা থামের আংটা থেকে তুলে এক কোনায় নিয়ে রেখে দিল।
ঘরের কোনায় দাঁড়িয়ে তিথি বলল, আলোটা একটু কমিয়ে দিলে তোমার অসুবিধা হবে?
হ্যাঁ হবে।
আচ্ছা, ঠিক আছে। এবারে শুয়ে পড়ো।
অরণি এবার তক্তপোশে উঠে সে তার বাবার মশারিটা তিথির দিকে ছুঁড়ে দিল।
নে, এটা টাঙিয়ে নে।
তুমি খেপেছ। কাকার মশারি আমি টাঙাতে পারি। কাকা জানতে পারলে কী ভাববে বলো! মেঝেতে চুপচাপ শুয়ে থাকব, তাও তোমার সহ্য হচ্ছে না! তোমার মনে এত পাপ অরুদা।
পাপ কথাটা এত অশ্লীল লাগে শুনতে অরণি জীবনেও টের পায়নি। পাপ আছে তার মনে। আছে, সত্যি আছে, পাপ না থাকলে, সারাদিন সে তিথির ঘোরে পড়ে থাকবে কেন! তিথি সহজভাবেই যদি সব মেনে নেয়, নিতেই পারে, সে পড়ে গেছে কাদায় পিছলে এবং যা কিছু দেখার দেখা হয়ে গেছে, এখন আর ভেবে কী হবে! তিথি তাকে বোধহয় মনে মনে ক্ষমাই করে দিয়েছে।
সে তাড়াতাড়ি চোরের মতো মশারির ভিতর ঢুকে গেল। চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। ঠান্ডা হাওয়ায় শীত শীত করছে তার। তিথি গায়ে দেওয়ার কিছু আনেনি। তিথিকে মশায় কামড়ায় না, তিথির শীতও করে না বুঝি! মশারি কিছুতেই টাঙাল না। ভাঁজ করে বাবার বিছানার নিচে রেখে দিয়েছে। চাদর দিলেও হয়তো গায়ে দেবে না—বলবে, কী যে করছ না, কাকার চাদর আমি গায়ে দিতে পারি! কত বড় গুরুজন তিনি।
অরণি বিছানায় শুয়ে স্বস্তি পাচ্ছিল না।
অনেকদূর থেকে যেন বলল অরণি, তোর শীত করছে না তিথি।
করছে। হঠাৎ কীরকম ঠান্ডা হয়ে গেল সব কিছু।
চাদর গায়ে দিবি?
তিথি পাশ ফিরে হাঁটু ভাঁজ করে শুল।
অরণি মশারির ভেতর থেকেই তার চাদরটা বের করে বলল, ধর। এটা গায়ে দে।
তুমি কী গায়ে দেবে?
বাবার চাদরটা বের করে নিচ্ছি।
তাহলে দাও। তিথি উঠে বসল। তার ফ্রক হাঁটুর নিচে নেমে গেছে। জঙ্ঘা, ঊরু দেখা যাচ্ছে—সব যেন ফুলের উষ্ণতা নিয়ে ফুটে আছে। তিথির শরীর এত পুষ্ট, এত সাবলীল, এত সুষমা হাতে পায়ে, সে কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছে না। তবে রক্ষা নিচে আজ অন্তর্বাস আছে। ফ্রকের নিচে শরীর যে উদোম করে রাখেনি। তার সব অস্বস্তি শরীর থেকে সহজেই মুছে গেল।
তিথি চাদরটা দিয়ে শরীর ঢেকে শুয়ে পড়ল।
অস্বস্তি থেকে রেহাই পেয়ে হালকা বোধ করল। তিথি চাদরে সারা শরীর ঢেকে নিয়েছে। এমনকি মুখও। মশার কামড় থেকে আত্মরক্ষার এটাই বোধহয় একমাত্র উপায় তিথির।
অরণি যেন কিছুটা নিশ্চিন্তে এবার শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপচাপ। কেউ আর কথা বলছে না। তিথি ঘুমিয়ে পড়তে পারে।
তখনই তিথি বলল, আলোটা নিভিয়ে দিই, চোখে বড় লাগছে।
চোখ কনুইতে ঢেকে শুয়ে আছে অরণি। তিথি যা খুশি করুক, সে কিছু বলবে না। হারিকেন নিভিয়ে দিতে হয় দিক, আলো থাকলে তার ঘুমের যখন ব্যাঘাত হয়—
কি নিভিয়ে দেব?
দে না! আমার কিন্তু ঘুম পাচ্ছে, এত কথা আর ভালো লাগছে না।
তিথি হারিকেন নেভালো না। সে শুয়েই আছে। ঘরের কোনায় হারিকেন। বিছানা থেকে উঠে গেলে, মাদুরের ঘস ঘস শব্দ পাওয়া যেত, কারণ সে বুঝেছে তিথি এপাশ—ওপাশ করলেও টের পাওয়া যায়। বৃষ্টি ধরে গেছে। গাছের পাতা থেকে টুপটাপ ফোঁটা পড়ছে টিনের চালে। এত নিঝুম হয়ে আছে যে হাই উঠলে, কিংবা জোরে শ্বাস ফেললেও টের পাওয়া যায়।
একটা কথা বলব অরুদা?
বললাম তো, আলো নিভিয়ে দে। আবার কী কথা!
তুমি রাতে ওঠো?
ঠিক নেই।
আমি কিন্তু উঠি।
ভয় পেলে ডাকবি। দরজায় দাঁড়াব।
টর্চটা বালিশের পাশে আছে। দেখে নাও।
কথাই বলছে, আলো নেভাচ্ছে না।
সে চিত হয়ে শুয়ে আছে বলে তিথিকে দেখতে পাচ্ছে না। শিয়রের পাশেই মেঝেতে তিথির বিছানা, হাত বাড়ালে নাগাল পাওয়া যায়, তিথি কী করছে দেখতে হলে তাকে উঠে বসতে হয়। তার মনে পাপ আছে, তিথি যে এত সুন্দর এবং এবার থেকে সে রহস্যময়ী নারী হয়ে যাবে—তার ভেতর পাপ আছে বলেই জেনে ফেলেছে। সেও বড় হয়ে যাবে, তিথির সঙ্গে ঠিক আগের মতো কোনও অকপট কথাবার্তায় জমে যেতে পারবে না। নদীর পাড়ে গেলে, কিংবা চরে নেমে গেলে সে তিথিকে কতদিন সঙ্গে নিয়ে গেছে। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকারও নেশা তার কম না। নৌকায় উঠে এক নৌকা থেকে আর এক নৌকায় লাফিয়ে পড়েছে, তিথি সঙ্গে আছে।
নৌকায় বাদাম তুলে দিয়েছে মাঝিরা, তিথি সাঁতরে নৌকায় উঠে গেছে। সেও। কিছুটা দূরে গিয়ে নৌকা থেকে লাফিয়ে পড়েছে, দু’জনেই। স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটে পাড়ে উঠে এসেছে। কখনোই মনে হয়নি সে এত সুন্দর।
তিথি ফের বলল, একটা কথা বলব?
তিথির কথা কি শেষ হবে না! তাকে কি কথার ভূতে পেয়েছে!
সে সাড়া দিল না।
তুমি কি ঘুমিয়ে পড়লে!
সে কিছুতেই সাড়া দেবে না। কারণ সে ভেতরে ভালো নেই বুঝতে পারছে। আশ্চর্য এক কৌতূহল তিথির শরীর নিয়ে—কেমন সে ভেতরে ভেতরে পাগল হয়ে উঠছে। সে জোর করে নিজেকে ঠিক রাখার চেষ্টা করছে। যেন নেমে গেলেই দু’জনের মধ্যে উষ্ণতার ছড়াছড়ি শুরু হয়ে যাবে।
তিথি নিজের মতোই কথা বলছে—তুমি তো আমাকে ভালোবাস। ভালোবাসলে জানো কাচের চুড়ি কিনে দিতে হয়। অষ্টমী স্নানের মেলায় গোবর্ধন দাসের দোকানে তোমাকে নিয়ে যাব। কত রকমের চুড়ি, কী রঙ, কী বাহার! কাচের চুড়ি পরতে আমার খুব ভালো লাগে।
না, সে আর পারছে না। সে উঠে বসল। চোখ জ্বলছে। মুখে ঘাড়ে জল দিতে পারলে ভালো হত।
আর তখনই তিথি উঠে হারিকেনের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। মশারির নিচে সে বসে আছে, তিথি জানে না। তার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিয়ে নিজে শুয়ে পড়েছে। আর এত অন্ধকার যে কিছুই দেখা যায় না। টর্চ জ্বেলে দেখতে পারে। জানালা খোলা—প্রকৃতির আশ্চর্য বাহার—জ্যোৎস্না উঠেছে। এবং আকাশও দেখা যায়। সে কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায় গাছপালা দেখার চেষ্টা করল। তিথির শরীর তাকে পাগল করে দিচ্ছে। সে কিছুতেই অন্যমনস্ক হতে পারছে না। আকাশে তারা ফুটে আছে বোধহয়। জানালায় বসে আকাশে তারা খুঁজে বেড়ালেও শান্তি পেত বোধহয়। কারণ সে আর যাই করুক, তিথির কাছে খাটো হতে পারবে না। প্রকৃতির মতোই তিথির কোনও স্থিরতা নেই। এই চঞ্চল, এই শান্ত, এই বৃষ্টি, এই রোদ। কখন দু’পাড় ভেঙে দ্রুত সব তরঙ্গের মধ্যে নদীর জলে ভেসে যাবে, কখনও জ্যোৎস্নায় চরের কাশফুলে হাওয়ায় দুলে উঠবে, তার কিছুই জানে না অরণি।
সে ধীরে ধীরে নেমে গেল। তারপর টর্চ জ্বালতেই দেখল, তিথি ঘুমোচ্ছে। সত্যি ঘুমোচ্ছে। পাশ ফিরে, দু’হাঁটুর মধ্যে প্রায় মাথা গুঁজে তিথি অসাড়ে ঘুমোচ্ছে। সে তিথিকে ছুঁতে সাহস পেল না।
সে অনভিজ্ঞ। সে কিছুই জানে না, যেটুকু করেছে ভেতরের তাড়না থেকে। শরীর স্পর্শ করার এক অমোঘ তাড়নাতেই সে চকি থেকে নেমে এসেছিল—তার কেন জানি ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়েছিল, তিথির শরীর ছুঁয়ে দিলেই এক আশ্চর্য পৃথিবীতে ঢুকে যাবে এমন মনে হয়েছিল তার। তিথিকে ছুঁয়ে দেখার মতো সাহস নেই তার। ছুঁয়ে দিলেই সে অপবিত্র করে দেবে তিথিকে।