Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নারী এবং নদীর পাড়ে বাড়ি || Atin Bandyopadhyay » Page 3

নারী এবং নদীর পাড়ে বাড়ি || Atin Bandyopadhyay

নদীর ঘাটে নেমে জগদীশ বললেন, পা চালিয়ে এসো। আর বেশি দূর না। সামনেই আমবাগান, সেখানে আমি থাকি। ঐ যে দেখছ, টিনে কাঠের ঘর। দেখতে পাচ্ছ, অন্ধকার হয়ে আছে বলে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আর একটু এগুলেই দেখতে পাবে। বাবুদের সবাইকে মান্য করবে। আমি ওদের কাছারি বাড়িতে থাকি। মেলা দাদা দিদি আছে তোমার। তারা যেন তোমার ব্যবহারে কোনও কারণেই ক্ষুণ্ণ না হয়। কাল দশটায় স্কুলে যাবে। গুরুপদবাবু তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। গুরুপদবাবু স্কুলের হেডমাস্টারই শুধু নন, তিনি একটি আস্ত বিদ্যার জাহাজ।

অরণি বাবার পেছনে পেছনে সেই টিনকাঠের ঘরটার সামনে উঠে যেতেই বুঝল, জায়গাটা যেন কিছুটা পরিত্যক্ত এলাকা। নিশুতি রাতের মতো নিঝুম হয়ে আছে। সিমেন্ট বাঁধানো উঁচু ভিটি, ঘরে ঢোকার সিঁড়িটিও পাকা—বাবা তখন তালা খুলছেন এবং কথা বলেই যাচ্ছেন, স্কুলে ভর্তি হয়ে যাও। এখানেও তোমার মেলা বন্ধুবান্ধব জুটে যাবে। আর বড়বাবু, ছোটবাবুর মতো মানুষ হয় না। দুই শরিকের মধ্যে রেষারেষি আছে ঠিকই তবে তুমি রেষারেষি যতটা পারো এড়িয়ে চলবে। আপাতত বড়বাবুর পালিতে আছি, সেখানেই আমাদের দু—বেলা আহারের ব্যবস্থা। মাসে মাসে পালি বদল হবে। সে থাকতে থাকতে বুঝে যাবে। আপাতত জামাপ্যান্ট ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে নাও। বলে তিনি দরজা ঠেলে দিলেন। অন্ধকারেই হাতড়ে বের করলেন একটা হারিকেন। আলো জ্বেলে একটা থামের তারকাঁটায় ঝুলিয়ে দিলেন।

ঘরটা যে পার্টিশান করা তাও টের পেল অরু। পাশের দরজা ঠেলে দিতেই চোখে পড়ল, মেলা কাঠের র‍্যাক, তাতে পুরনো লাল মলাটের সব খাতাপত্র—কেমন একটা অচেনা গন্ধ বের হয়ে আসছে ঘরটা থেকে। একটা বালতি এবং কাঁসার ঘটি ঘর থেকে বের করে দরজা ফের বন্ধ করে বললেন, দু’মিনিট বিশ্রাম করে হাতমুখ ধুয়ে নাও। পাশেই টিউকল। আমার সঙ্গে এসো, বলে হারিকেন তুলে দূরে টিউকলটি দেখালেন। আমি এখুনি আসছি। ভয়ের কিছু নেই। বউঠানকে খবরটা দিয়ে আসি, আমরা এসে গেছি, রাতে খাব। বড়বাবু হয়তো বৈঠকখানায় অপেক্ষা করছেন, তাঁকেও খবরটা দেওয়া দরকার।

তারপর অরণি দেখল, বাবা অন্ধকারে কোথায় হারিয়ে গেলেন।

সে কিছুটা সন্ত্রস্ত হয়ে যে পড়েছে—তার মুখচোখ দেখেই বোঝা যায়। কোথায় কতদূরে সেই বৈঠকখানা—সে ঘর থেকে যে বের হয়ে যাবে তাও পারছে না। বাবা তাকে সঙ্গে নিয়ে গেলে কতটা কি ক্ষতি হত!

সারাদিনের পথশ্রমে সে যে খুবই কাহিল! দরজা খোলা। বাবা সামনের জানালাও খুলে দিয়ে গেছেন। নদী থেকে ঠান্ডা হাওয়া উঠে আসছে। সে তক্তপোশে বসে আছে। তার আর নড়তে ইচ্ছা করছে না। রাতের বেলা একা থাকতে তার এমনিতেই অস্বস্তি হয়। ভয় ভয় করে। অশুভ আত্মাদের ভয়ও আছে তার। সে বেজায় সাহসীও নয়। চারপাশের গাছপালার মধ্যে একটা মাত্র টিনের ঘর, মানুষের কোনও সাড়াশব্দই পাওয়া যাচ্ছে না। দূরে, বহুদূরে স্টিমারটা যে দুকূল জলে ভাসিয়ে চলে যাচ্ছে, তার গুমগুম আওয়াজ কান পাতলে এখনও শোনা যায়। তক্তপোশের নিচে কী আছে সে জানে না, সে দু—পা উঠিয়ে বসল। উঠে গিয়ে যে তারকাঁটার আংটা থেকে হারিকেনটা তুলে এনে তক্তপোশের নিচটা দেখবে তারও যেন সাহস নেই। কীটপতঙ্গের আওয়াজ উঠছে। গাছপালা থেকে পাতা পড়ছে টুপটাপ, এবং অন্ধকার ভেদ করে সেই শব্দমালার মধ্যে কোনও ভূতুড়ে আওয়াজের মতো টিনের চালে অনবরত কেউ যেন করাত চালিয়ে যাচ্ছে।

তার গলা শুকিয়ে উঠছে।

বাবা কতদূরে গেল!

তক্তপোশে হামাগুড়ি দিয়ে জানালার কাছে উঠে গেল। উঁকি দিল—না শুধু নিশীথের জোনাকি ছাড়া আর কিছুই গোচরে আসছে না।

সে ভেবেছিল, জমিদার বাড়ির সংলগ্ন কোনও গৃহে বাবা থাকেন। বাবা দেশে গেলে নিজের থাকা—খাওয়া নিয়ে মাকে মাঝে মাঝে যেসব খবর দিতেন, তাতে সে বুঝতেই পারেনি, বাবাকে এমন একটা পরিত্যক্ত আবাসে থাকতে হয়। বাবা একা ঘরটায় থাকেন, তবে দু—একজন পাইক কি লেঠেল জমিদারদের থাকবে না, হয় কী করে! এ যে একেবারে ন্যাড়া! কাঠের কড়ি বরগার উপর মুলিবাঁশের আচ্ছাদন, এখানে সেখানে ঝুলকালি, কাঠের একটি তাক এবং সেখানে তোষক বালিশ মাদুর—কোনও মৃত মানুষের মুখও তার চোখে যেন ভেসে উঠল। এই বাড়িতে কোনও এক অপমৃত্যুর দিনে বাবা রাতে টের পেয়েছিলেন, টিনের চালের উপর কারা সব নৃত্য করছে। কারণ সে রাতে টিনের চালে ঝম ঝম শব্দ, ঠিক ঝড়বৃষ্টিতে টিনের চালে যেমন শব্দ হয়ে থাকে, বাবা কোনও অশুভ ইঙ্গিত পেয়ে দিশেহারা যে হয়ে গেছিলেন, তাও সে জানে। বাবা আতঙ্কে সে রাতে ঘুমোতে পারেননি।

সকালে উঠেই ছুটে গিয়েছিলেন জমিদার বাড়ির অন্দর মহলে। রাতে যে তাঁর টিনের চালে অশুভ আত্মারা নৃত্য করে গেছে তারও খবর দিলেন। কেমন অমঙ্গলের আভাস পেয়ে দেবকুমারবাবু গুম মেরে গেছিলেন। বিন্দুমাত্র বৃষ্টি না, শিলাবৃষ্টিও না—শকুন উড়ে এসে বসলেই এমন শব্দ হয়ে থাকে—তারপর বাবাকে ইঙ্গিতে বসতে বলেছিলেন।

তুমি ঠিক শুনেছ, টিনের চালে দাপাদাপি হচ্ছে?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

বের হয়ে দেখলে না কেন?

আজ্ঞে….

মনে হয় রাতে চালে শকুনের পাল উড়ে এসে বসেছিল। ঠিক আছে, আর কাউকে বলতে যাবে না। এতে গোটা বাড়িটাই ত্রাসে পড়ে যেতে পারে। শনি সত্যনারায়ণের পূজার ব্যবস্থা করো। শান্তি স্বস্ত্যয়ন করা দরকার। কিছুই ভালো বুঝছি না। বাড়িতে কেউ কেউ এভাবে অমঙ্গলের আভাস দিয়ে যায়।

বাবার মুখেই শোনা, বাবুর বড় কন্যাটির মৃত্যুর খবর এসেছিল তার ঠিক এক সপ্তাহের মাথায়। কেরোসিন ঢেলে শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। এই পরিবারের এই সব দুর্ঘটনার খবর আগাম কে যে জানিয়ে যায়। ঘরের চালে শকুন উড়ে এসে বসলে এমনিতেই খারাপ লাগে, ভয়েরও কথা, আতঙ্কও কম থাকে না। দিনের বেলাতেই একবার একপাল শকুন উড়ে এসে তাদের কাঁঠাল গাছের মাথায় বসে পড়েছিল—সারা গাঁয়ে হইচই—লোকজন ছুটে এসে গাছের মাথা থেকে শকুন তাড়ানোর দৃশ্যটির কথা তার মনে পড়ছে। শকুন ওড়ে, গাছের মগডালে বসেও থাকে, তবে সবই পরিত্যক্ত এলাকায়, যেমন সিংগিদের পুকুর পাড়ের জংলায় যে বটগাছটা কত যুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে, তার মগডালে সে শকুন বসে থাকতে দেখেছে। প্রভাকরদির বাজারে যাবার রাস্তায় প্রায় একটি জনশূন্য প্রান্তরের গাছটিতে শকুনের বাসা আছে। তবে রাতে সে রাস্তায় কেউ যায় না। বাজার থেকে কেউ ফেরেও না সেই রাস্তায়।

সে ভেতরে ভেতরে ভয়ে যে গুটিয়ে যাচ্ছে টের পেতেই তার মুখ চুন হয়ে গেল।

দরজা খোলা।

সে কোনোরকমে প্রায় টলতে টলতে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল।

ঠিক তখনই তক্তপোশের নিচে সরসর শব্দ।

ঠিক তখনই টিনের চালে কীসের যেন ঘষ্টানোর শব্দ।

তারপর শো শো আওয়াজ।

জানালাটার কাঠ দুটো ঝোড়ো হাওয়ায় ফসকে গিয়ে পাল্লা দুটো দমাস করে বন্ধ হয়ে গেল, এবং সঙ্গে সঙ্গে আবার খুলেও গেল।

হারিকেনের আলো দপ দপ করে জ্বলছে।

সে ঘামছিল।

হারিকেনটা দুলছে।

কোনও এক প্রাগৈতিহাসিক খণ্ড বিখণ্ড উপদ্রবে সে যে পড়ে যাচ্ছে, সে ঘোলা ঘোলা দেখছে সবকিছু, বাবা তাকে ফেলে এভাবে কোথায় চলে গেলেন—সে যেন মূর্ছা যাবে।

আর তখনই জানালায় এক সুন্দর বালিকার মুখ। বড় বড় ফোঁটায় বোধহয় বৃষ্টি হচ্ছে। বালিকার মুখে বৃষ্টির ফোঁটা লেগে আছে। জানালার গরাদ ধরে কিছুটা উপরে উঠে ডাকছে। এই অরুদা, তোমরা কখন এলে!

সে কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এমন একটি পরিত্যক্ত জায়গায় এতটুকুন একটা মেয়ে একা আসতেই পারে না। ফ্রক গায়, দু বিনুনি চুলে, বোধ হয় বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে, একবারও বলছে না, দরজা খুলে দাও। কেবল জানালায় দাঁড়িয়ে বলছে অরুদা, তোমার ভয় করছে না তো। আমি জানি, একা তুমি ভয় পাবে। থাকতে পারলাম না। সারাদিন নদীর ঘাটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি, কখন তুমি আসবে। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকলে কত কিছু যে মনে হয়। আমিতো জানি, স্টিমার সাঁজবেলায় আসে কিন্তু কী যে হয়, সকাল দুপুর যখনই সময় পেয়েছি ছুটে গেছি নদীর পাড়ে। অরুদা আসবে। কাকা যে বলে গেছে, আজ তোমাকে নিয়ে কাকা ফিরবে। তুমি ভয় পাচ্ছো না তো! নতুন জায়গা, ভালো নাই লাগতে পারে। দরজাটা খোলো না। এই কী কথা বলছ না কেন? চোখ গোল করে আমাকে এত দেখছ কেন! আমি বাঘ না ভালুক। দেখছ না বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছি, দরজা খুলে দিতে পারছ না!

মেয়েটা ফের বলল, আমার নাম তিথি। ভুইঞা কাকা আমাকে নটসুন্দরী বলে ডাকে। বাজারে আমার বাবা জিলিপি ভাজে। তুমি দরজাটা খুলে দাও না। কেবল আমাকে হাঁ করে দেখছ!

তখনই দূরে টর্চবাতির আলো জ্বলে উঠল।

আর তিথি লাফিয়ে নেমে গেল অন্ধকারে।

কে রে ছুটে পালাচ্ছিস!

তিথি বলল, আমি ছুটে পালাইনি। তাড়াতাড়ি এসো। অরুদা না, আমাকে দেখতে দেখতে কেমন হিম হয়ে গেছে।

জগদীশ প্রায় দৌড়েই দরজার দিকে ছুটে গেলেন। অরুকে একা রেখে যাওয়া ঠিক হয়নি। ঝড় শিলাবৃষ্টি, আকাশ মেঘলা ছিল ঠিক, তবে এতটা ঝড় এবং শিলাবৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে বুঝতে পারেননি। দরজায় এসে ডাকলেন, অরু দরজা খোল। আমরা ভিজে যাচ্ছি।

অরুর কেমন কিছুটা বাহ্যজ্ঞান লোপ হয়ে গেছিল। সে আবার নিজের মধ্যে ফিরে আসছে। দরজা খুলে দিতেই ঠান্ডা হাওয়ায় তার শরীর কিছুটা যেন তাজা হয়ে গেল। তিথিকে দেখে আবার সাহস পেল বোধ হয়। এতটুকুন মেয়ে প্রায় তারই বয়সি, বিন্দুমাত্র ভয়ডর নেই, ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে তাকে দেখবে বলে চলে এসেছে।

সে কিছুটা লজ্জায় পড়ে গেল।

জগদীশ বললেন, তোর কী হয়েছিল?

কিছু না তো।

তবে তিথিকে দরজা খুলে দিসনি কেন। হাতমুখ ধুয়েছিস?

অরু বলল, না।

তিথি বলল, বালতিটা কোথায়?

তিথি বালতি খুঁজতে দরজা ঠেলে পাশের ঘরটায় ঢুকে গেলে জগদীশ বললেন, ওখানে পাবি না, চকির নীচে আছে দ্যাখ।

হেমন্তে যে মাঝে মাঝে এ সময়ে শিলাবৃষ্টি হয় অরু জানে। ঝড়বৃষ্টি দুপদাপ করে এল, দুপদাপ করে আবার চলেও গেল। তিথি বালতি হাতে বের হয়ে গেল, কল থেকে জল টিপে সিঁড়িতে তুলে রাখল। কাঁসারবাটি এগিয়ে দিয়ে বলল, যাও বাইরে। কাকা তুমি আমাকে টর্চটা দাও তো। দরজায় হারিকেন নেওয়া যাবে না, নিভে যাবে। অরুর দিকে তাকিয়ে বলল, বসে থাকলে কেন? হাতমুখ ধুয়ে নাও। খাবে না। সেই কোন সকালে বের হয়েছ!

জগদীশ জানেন, তিথির কথাবার্তায় বেশ পাকামি আছে। তিথি সবাইকে বড় বেশি নিজের ভাবে। কাছারি বাড়ির এক কোণায় মাঠের ঝুপড়িতে থাকে। তিনিই বাবুদের বলে কাঠা দু’এক জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন। সেখানে ঝুপড়ি বানিয়ে বছর দশেক হল গৌর ওরফে গোরাচাঁদ উঠে এসেছে। বছরখানেকের বয়স ছিল তখন মেয়েটার। কত তাড়াতাড়ি যে বড় হয়ে গেল।

তিথিকে কিছু বলতে হয় না।

যেমন জগদীশের জামাকাপড় কেচে রাখা, জল তোলা এবং বিছানা করার কাজটিও সে করে দিয়ে যায়। জগদীশ এসব পছন্দ করেন না। তবে তিথি তাকে পাত্তাই দিতে চায় না। সে তার মতো কাজ খুঁজে নেয়—শুধু তারই নয়, বড় তরফের ছোট তরফের সবার হেঁসেলেই তার অবাধ যাতায়াত।

তিথি হামাগুড়ি দিয়ে দড়ি থেকে গামছা তুলে এনে অরণির হাতে দিল।

অরুর ইচ্ছে নয়, মেয়েটা এভাবে তার উপর মাতব্বরি করুক। কেমন বিরক্ত হয়ে বলল, রাখো, আমি নিজেই নিতে পারব।

নিজে নিতে পারবে তো, চুপ করে বসে আছো কেন? কাকাকে জ্বালাতে বুঝি খুব ভালো লাগে! কখন থেকে বলছে, হাতমুখ ধুয়ে নে অরু, জামাপ্যান্ট ছেড়ে ফেল, তোমার কোনও গেরাহ্যি আছে।

অরু বুঝে পেল না, মেয়েটাকে কে এত আশকারা দেয়। সে তাকে চেনেই না, বাবাও তিথির কথা কিছু বলেনি, কিন্তু যেভাবে তার পেছনে লেগেছে, শেষে না জানি কী হয়! তারও রাগ কম না। আর কোথা থেকে উদয়! বাবাকে পর্যন্ত সমীহ করে না। তাঁর সামনেই তাকে হেনস্থা করতে চাইছে।

সে এখানে যতটা জলে পড়ে যাবে ভেবেছিল, তিথিকে দেখে সহসা কেন জানি মনে হল, না তাকে বিশেষ অসুবিধায় পড়তে হবে না। তিথি বড়ই সতর্ক তার ভালো মন্দ নিয়ে। সে কিছুটা নরম হয়ে গেল। বলল, কোথায় থাকিসরে তুই?

কোথায় থাকি, সে দিয়ে কি হবে? দয়া করে তুমি হাতমুখ ধুয়ে নাও। আমি দেখছি বড়গিন্নি কী করছে। তোমাদের খাওয়ার কতদূর। তারপরই বলল, এই নাও পাউটি। খালি পায়ে হাঁটবে না বলে দিলাম।

তিথি দরজা দিয়ে মাঠের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যাবার আগে কোথা থেকে একজোড়া পাউটি বার করে রেখে গেল তার জন্য।

তিথি থাকায় তার জামাপ্যান্ট ছাড়তে লজ্জা হচ্ছিল। কখন আবার উঠে আসবে, কে জানে। সে সিঁড়িতে হাত পা ধুয়ে কাঠের পাউটি পরে ঘরে ঢুকে গেল। ভিজা গামছা দিয়ে গা মুছল, টিনের স্যুটকেস থেকে হাফপ্যান্ট হাফশার্ট বের করে নিল। ছাড়া প্যান্ট সার্ট চকিতে রাখলে জগদীশ বললেন, নিচে ফেলে রাখ। চকিতে রাখলে মেয়েটা চোপা করতে পারে।

বাবা দেখছি মেয়েটার কাছে জব্দ। এমন একটা পুচকে মেয়ের কাছে বাবার এত জব্দ থাকার কী কারণ সে বুঝল না। মনিবের মেয়েও নয়, মনিবের বাড়িতে আশ্রিতই বলা চলে। চকির উপর ছাড়া কাপড় রাখলে মেয়েটা ক্ষুব্ধ হতে পারে। এতটাই জব্দ যে সে জামাপ্যান্ট চকির একপাশে রেখে দিলেও বাবা তা নিয়ে ঘরের এক কোণায় রেখে দিলেন। সে কিছু আর বলতে পারল না। দেয়াল ঘড়িতে আটটা বাজে। তার খিদেও পেয়েছে—সারাদিনে সেই বাবা লোকনাথের আশ্রমে সামান্য বাল্যভোগ ছাড়া পেটে ভাত পড়েনি। ভাত না খেলে সে শরীরে জোর পায় না। তার তিনবেলা ভাত চাই।

সেই অরু বসে আছে, কখন তিথি খবর নিয়ে আসবে। কখন খেতে ডাকবে।

বাবা আয়না চিরুনি তাক থেকে নামিয়ে বললেন, মাথা আঁচড়ে নাও।

এখন দরজাও খোলা।

ঠান্ডা হাওয়ায় অরুর শীত শীত করছে। যেন গায়ে একটা চাদর জড়ালে ভালো লাগত।

সে একসময় না বলে পারল না, চালে ঘসটানো শব্দ হচ্ছিল খুব।

ও হয়। হাওয়া উঠলে হয়। আমগাছের একটা ডাল চালে এসে পড়েছে। হাওয়ায় নড়ে।

টিনের চালের এই দোষ। বৃষ্টি হলে ঝম ঝম শব্দ হয়। আবার শকুন উড়ে এসে বসলেও টের পাওয়া যায়। এমনকি কাক শালিখ চালে এসে উড়ে বসলেও কীরকম মৃদু শব্দ পাওয়া যায়। টালির চাল থাকলে এতটা হয় না। খড়ের চাল থাকলে একদম কিছুই টের পাওয়া যায় না। অরু বাড়ির বৈঠকখানায় থাকে। খড়ের চাল—চৌচালা ঘরটা ঠান্ডা রাখার জন্য খড় দিয়ে ছাওয়া।

নতুন জায়গা, ঘরটার কোনদিকে কী আছে সে কিছুই জানে না। তিথিরা কোনদিকে থাকে তাও না। ঘরে যদি কখনও একা থাকতে হয় তবেই মুশকিল। বাবাকে মাঝে মাঝেই আদায়পত্রে বের হয়ে যেতে হয়। মামলা মোকদ্দমার জন্য শহরে যেতে হয়, তখন এই ঘরটায় কেউ থাকে কিনা সে জানে না। না ঘরটা খালি পড়ে থাকে!

অরণি এসব ভেবে খুব কাতর হয়ে পড়ছিল।

বাবা।

বল।

তুমি না থাকলে রাতে ঘরে কে শোয়?

ঠিক নেই। যার যখন সুবিধা সেই থাকে। রাতে ঘর পাহারা দেবার জন্য মাঝে মাঝে তিথিও এসে শোয়। তোমার কোনও অসুবিধা হবে না।

না তা বলছি না।

দরকারে ওর বাবাও থাকে। হরমোহনও থাকে।

হরমোহন কে বাবা?

বাবুদের পেয়াদা।

ওকে দেখছি না!

আছে। সকাল হোক। সব বুঝতে পারবে, কখন রান্না বাড়ি থেকে তিথি আসে দ্যাখ। তাড়াতাড়ি তোমার শুয়ে পড়া দরকার।

তিথিও শোয়। সে একা শোয়, না আর কেউ সঙ্গে থাকে। তিথি সম্পর্কে সে কোনও প্রশ্ন করতে চায় না। সে যে বড় হয়ে যাচ্ছে বাবা কি টের পান না! বড় হয়ে গেলে তার তো একাই এ ঘরে শোওয়া উচিত। সে থাকলে, অন্য কেউ শুতে আসবেই বা কেন!

তিথি সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন করতেই তার সংকোচ হচ্ছিল।

তখনই তিথি বলল, দেরি হবে। এই নাও, ধরো। জল থাকল। সেজদা শিকারে গেছিলেন। বড় বড় দুটো বালিহাঁস শিকার করে এনেছেন। ছাল—চামড়া ছাড়ানো হচ্ছে।

রেকাবিতে ফুলকো লুচি এবং সন্দেশ। আলাদা রেকাবিতে ভাগ করে তিথি বলল, গিন্নিমা অরুদাকে দেখতে চেয়েছে। খেতে তোমাদের দশটা। এখন এই খেয়ে নিতে বলেছে। তুমি খাও অরুদা। পরে এসে নিয়ে যাব। এত বড় হাঁস। ছাল—চামড়া ছাড়ানো হচ্ছে। তুমি যাবে আমার সঙ্গে!

জগদীশ জানে, মেয়েটার বড় উৎসাহ, সারাক্ষণ পাখি ছাড়ানো দেখবে। বউঠান বঁটি নিয়ে বসলে সে থালাবাসন এগিয়ে দেবে। রান্না বাড়িতে জল বাটনা দেবার লোক থাকলেও গিন্নিমা রান্না নিজের হাতে করেন। বামুনঠাকুর পোষার মতো ক্ষমতা কখনোই ছিল না, মাত্র এক আনার শরিক তা আবার দু—তরফের মধ্যে ভাগ। জমিদারির আয়ও কমে গেছে। আদায়পত্র আগের মতো নেই। তিথি বড় বিশ্বাসী বউঠানের। যতক্ষণ বাড়ির খাওয়া চলবে, কিংবা বউঠানের রান্নার সময় সে ছুটে ছুটে ফুটফরমাস খাটবে। তারপর বউঠান যখন বলবেন, তিথি তুইও আমাদের সঙ্গে বসে যা। খেয়ে নে। তিথির কী আনন্দ তখন।

তিনি এই আশায় আশায় সারাদিন বুঝি ছুটে বেড়ায়। সারাদিন কাজ করার উৎসাহ পায়।

মেজদার সব কথাই অরু জানে। ভালো শিকারি, তুখোড় ফুটবল খেলোয়াড়, ঢাকা শহরে ওয়ারি টিমে হাফ ব্যাকে খেলে। বাবুদের খবর বাড়িতে বসেই সে জেনেছে। যে ক’দিন বাড়ি থাকবেন বাবা, দেবকুমার বাবুর পুত্রদের প্রশংসা। সব সোনার টুকরো ছেলে বাবার ভাষায়। ভুইঞা কাকা বলতে অজ্ঞান। বড় দেখতে ইচ্ছে হত মেজদাকে। বড়দির বিয়ে হয়ে গেছে। সেই বড়দি মরেও গেছে। আর আছে ছোড়দি। সে নাকি অরুরই বয়সি। পরীর মতো দেখতে। সারা বাড়িতে সুঘ্রাণ। রোয়াক ধরে হেঁটে গেলে এক এক ঘরের খাট পালঙ্ক দেখলেই নাকি ভিরমি খেতে হয়। বৈঠকখানায় সব বড় বড় মানুষ সমান ছবি। পেল্লাই সব দরজা জানালা। হরিণের শিং, বাঘের ছাল দেয়ালে, সে সবই বাবার মুখে শুনেছে।

তিথি বলল, কী অরুদা যাবে? হাঁসটার পেটে ডিম ছিল জানো!

পাখির মাংস খুব সুস্বাদু। আজ সেই পাখির মাংস হচ্ছে বাড়িতে। তার খুবই খেতে ইচ্ছে করছিল, তবে তিথির সব আগ বাড়িয়ে বলার স্বভাবের জন্যই যেন বলল, তুই যা। আমি পরে যাব।

পরে আর যাবে কখন? ততক্ষণে মাংস রান্না হয়ে যাবে।

আসলে তিথি চায়, অরু তার সঙ্গে সেই রান্নাবাড়িতে যেন যায়।

কারণ, একটা বালিহাঁসের ছালচামড়া ছাড়ানো হয়নি। হাঁসটা বেঁচে আছে। গুলি লেগে হাঁসটার ডানা ভেঙে গেছে। ধরতে গেলে ঠুকরে দিচ্ছে। মেজদাকে ক্লাবের লোক এসে বৈঠকখানায় ডেকে নিয়ে গেছে। কীসব কথাবার্তা হচ্ছে সে জানে না। ওরা চলে না গেলে পড়ে থাকা হাঁসটার ছালচামড়া ছাড়ানো হচ্ছে না। মেজদা বড় নিষ্ঠুর এই সব কাজে। তখন বাড়ির কেউ বড় একটা কাছে ঘেঁষে না।

মেজদারই বড্ড শিকারের নেশা।

মেজদার উৎসাহে মাঝে মাঝে পাখি শিকার করে আনা হয়।

ক্লাবের ছেলেরা চলে গেলেই মেজদা আবার রান্নাবাড়িতে ঢুকে যাবে। জখমি হাঁসটার ছালচামড়া ছাড়িয়ে দেবে। গিন্নিমার কাজ বঁটি নিয়ে বসা। তার কাজ গিন্নিমাকে সাহায্য করা। সে যে এই বাড়ির লোকজনের কাছে কত প্রিয় অরু তার সঙ্গে গেলে টের পেত।

জগদীশই বলল, যা না। বসে থেকে কী করবি। আমি যাচ্ছি। বউঠান তোকে দেখতে চেয়েছে।

অরু যাও যাবে বলে উঠে দাঁড়িয়েছিল, বাবার কথায় তার উৎসাহে যেন জল ঢেলে দিল। বউঠান তাকে দেখতে চেয়েছেন, সেই বউঠানের সামনে সে নিজে গিয়ে একা হাজির হয় কী করে! বাবা না গেলে তার পক্ষে কোনওভাবেই যাওয়া সম্ভব না। তিথির সঙ্গে তো নয়ই।

এই চলো না অরুদা। এক দৌড়ে চলে যাব। বলে তিথি অরুর হাত ধরে টানাটানি শুরু করে দিল।

ইস কী যে করে না!

কী করেছি তোমাকে! গেলে দেখতে পেতে, কত বড় বালিহাঁস! সেজন্যই তো যেতে বলছি।

কেন যে তাকে হাঁসটাকে দেখানোর এত আগ্রহ তিথির, বুঝতে পারছে না। একটা হাঁসের ছালচামড়া ছাড়ানো হয়ে গেছে, আর একটার ছাড়ানো হয়নি, এখনও পড়ে আছে, আহত হাঁসটাকে দেখাতে না পারলে তিথির যেন নিস্তার নেই। বাবা বাইরে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে ঢুকেছেন খড়ম পায়ে। গামছায় শরীর মুখ মুছে বোধ হয় আহ্নিকে বসবেন। বাবা যে সন্ধ্যায় নদীর ঘাটে বসে আহ্নিক সারেন, সকালেও বাবার নদীর জলে প্রাতঃস্নান এবং আহ্নিক সেরে কাছারি বাড়িতে ফিরে আসার স্বভাব সে ভালোই জানে। বাবা বাড়ি গেলে, তার নৈমিত্তিক কাজের বহর সম্পর্কে মাকে বিশদ বর্ণনা দিতে ভালোবাসেন, রাত হয়ে গেছে বলে, হয়তো ঘরেই জপতপ সেরে নেবেন, কিংবা যদি মঠে যান, তাও নদীর পাড়ে। বাবা যে কী করবেন সে বুঝতে পারছে না। আবার যদি তাকে একা ফেলে জপতপের অছিলাতে বাবা বের হয়ে যান তবেই মুশকিল। তখন তিথি সহজেই তাকে কবজা করে ফেলতে পারে।

সে বলল, বাবা তুমি যাবে না?

কোথায়?

এই যে আমাকে নিয়ে যেতে বলল।

ও হ্যাঁ। যাব। তোমাকে দেখার আগ্রহ সবার। বউঠান দু—বার খবরও নিয়েছেন। স্টিমার এত লেট করবে কে জানত!

অরু ফের বলল, তুমি কি আহ্নিকে বসবে!

কেন?

দেরি হয়ে যাবে না।

তিথির সঙ্গে যা না। বলবি, আহ্নিক সেরে আমি যাচ্ছি।

তিথি বলল, হল তো! চলো না অরুদা!

তিথি তার হাত কিছুতেই ছাড়ছে না।

চলো বলছি।

আগে তুই আমার হাত ছাড়।

আমার হাতে কী আগুন আছে? ছুঁলে হাতে কি তোমার ফোসকা পড়বে!

এত আস্পর্ধা হয় কি করে! বাবা কেন যে ধমক দিচ্ছেন না। বাবা তো বলতে পারেন, ঠিক আছে যাবে, হাত ধরা যখন পছন্দ করে না। না ধরলেই পারিস।

জগদীশ খড়ম পায়ে কোথায় আবার বের হয়ে যাচ্ছেন।

অরুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আহ্নিক সেরে আসছি ঘাট থেকে। বেশি দেরি হবে না।

বাবা আর কোনও কথা না বলেই বের হয়ে গেলেন।

তিথির এখন যেন ভারী মজা।

বাবার উপর অরণির ক্ষোভ বাড়ছে। এই অচেনা জায়গায় তার জন্য বাবার যেন কোনও ভাবনা নেই। তার কোনও বিন্দুমাত্র বিপদের আশঙ্কা আছে বলেও বোধ হয় তিনি মনে করেন না।

তিথি এবার গম্ভীর গলায় বলল, কী যাবে? না বসে থাকবে। আমি অত সাধাসাধি করতে পারব না বাপু। একা বসে থাকলে জানো ভূতে ধরে।

কত সহজে তিথি কথাটা বলে ফেলল। তাকে যে ভূতে ধরেছিল তিথি বোধ হয় টের পেয়ে গেছে। সে ঘামছিল, চোখ গোল গোল করে তিথিকে দেখছিল, সে কোনও সাড়া দিতে পারেনি, তিথি জানলায় উঁকি দিয়ে সব টের পেয়েছে।

বাবার খড়মের শব্দও মিলিয়ে গেল।

সে কী করবে বুঝতে পারছে না। যদি তিথি এখন এক লাফে বের হয়ে চলে যায়, যদি বলে ঠিক আছে, ভুইঞা কাকা এলেই যেয়ো, আমি যাচ্ছি। আমার মেলা কাজ। তা হলেই হয়েছে।

তিথি তাকে নিয়ে এখন যে কতরকমের মজা করতে পারে।

তিথির সঙ্গে চলে যাওয়াই ভালো। সে আর এই ঘরটায় একা বসে থাকতে পারবে না। কিছুতেই না। একা থাকলে সত্যি ভূতে ধরে। ভূতের যত ধান্দা রাতে। বিধুখুড়োর কথা। রাতেই তারা ঘুরে বেড়ায়—যত অন্ধকার তত তাদের মজা। সিঙ্গিদের সেই বটগাছটায় যে জোড়া ভূত থাকে, কিংবা খালের পাড়ে সাঁকোর নিচে ভেতো ভূত থাকে, কেবল ভাত চুরি করে খেতে ভালোবাসে বিধু খুড়ো ছাড়া সে খবর কেউ রাখে না। নানাপ্রকারের ভূতের গল্প বিধুখুড়োর পেটে গোলমাল পাকায়। রাতে গোরু—বাছুর গোয়ালে তুলে, বৈঠকখানায় এসে টুলে চিত হয়ে শুয়ে পড়বে, আর গামছা ঘুরিয়ে মশা তাড়ানোর সঙ্গে রাজ্যের যত ভূত এসে তার কাছে হাজির হয়। অরু আর তার ভাইবোন মিলে জপতপ করার মতো বিধুখুড়োর শিয়রে বসে থাকে—তারপর কী হল খুড়ো।

হয়েছে তোদের মাথা। রান্নাঘরে দেখে আয় পাত পাড়তে কত দেরি! তোদের মা কাকিরা সারাদিন কী করে! কখন খাব, কখন ঘুমাব। কত রাত হল টের পাস না।

অরুর তখন এক কথা, তুমি খাও না খাও—আমি একা যেতে পারব না।

রান্নাঘরটা যে তাদের ভেতরের উঠোন পার হয়ে অন্দরের উঠোনের শেষ দিকটায়। ঠিক বাঁশঝাড়ের পাশে। এতটা রাস্তা রাতে জ্যোৎস্না থাকুক, অন্ধকার থাকুক—হারিকেন হাতে থাকুক, টর্চ থাকলেও সে একা যেতে সাহস পায় না। তবু বাড়িতে একরকম, কিন্তু এই অচেনা জায়গায় সে যে কী করে!

তিথির কথারও গুরুত্ব আছে।

ঘরে একা থাকলে ভূতে ধরে।

সে বলল, তিথি একটু বসবি। বাবা আসুক। তারপর আমরা যাব।

হয়ে গেল। ভূতের ভয়ে এত কাবু। কাকার ফিরতে দেরি আছে।

কেন, দেরি কেন?

বারে মঠে শিবলিঙ্গ আছে জানো?

তা থাকতেই পারে।

থাকতেই পারে না, আছে। খুবই জাগ্রত। কাল সকালে আমার সঙ্গে যাবে। সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাব। আটআনা জমিদারবাবুর কত বড় প্রাসাদ দেখতে পাবে। নদীর পাড়ে কাকা ঘাটের স্টেশন মাস্টারের ঘরে বসে খবরের কাগজ না পড়ে ফিরবেন না। আহ্নিক সারা হলেই ফিরে আসবেন, তা হলেই হয়েছে।

মঠে শিবলিঙ্গ আছে জানো না? কেন যে বলল তিথি! জাগ্রত ঠাকুর, সেই না হয় হল। জাগ্রত বলেই বাবার দেরি হবে ফিরতে তাই বা কেমন আবদার। তা হলে কি রাতে তাকে এই ঘরে পাঠ্যবই নিয়ে একাই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে!

বাবা তার আহ্নিকের নামে মঠে যাবেন, জাগ্রত ঠাকুর বলে পরিবারের সবার মঙ্গলের জন্য ধ্যানে বসবেন, তারপর স্টেশন মাস্টারের ঘরে ঢুকে সেজবাতির আলোয় অর্ধসাপ্তাহিক আনন্দবাজার কাগজখানা পড়বেন। পড়া শেষ না হলে আবার পড়বেন—এই অজুহাতে যে বাবা রাতে ঘরে ফিরতে বেশ দেরি করবেন তাও অরু বুঝে গেল। তিথির সঙ্গে তার বরং ভাব করেই চলা দরকার।

অরু কিছুটা চালাকি করে বলল, তোর বাবা কী করে রে?

বাবা জিলিপি ভাজে। কতবার বলব!

কোথায়?

কেন বাজারে।

তোদের বাড়িটা কোন দিকে।

আঙুল তুলে দেখাল, চলো না আমাদের বাড়ি হয়ে যাবে। জানো আমার মা না কোথায় চলে গেছে?

তোর মা বাড়ি থাকে না?

লোকে যে বলে মা আমার জলে ভেসে গেছে।

এইরে, এ যে আর এক ভূতের দোসর।

কী করে জলে ভেসে গেল?

আমি তার কী জানি? ছোট ছিলাম তো। মা’র কথা আমার মনেই নেই।

তোর মা নেই তবে?

তিথি জিভ কেটে বলল, অমন কথা বলো না অরুদা। আমার মা সাক্ষাৎ লক্ষ্মীঠাকরুণ। মা না থাকলে বাবা নাকি বিবাগি হয়ে যেত। ভুইঞাকাকাই জোরজার করে ফের বাবাকে বিয়ে দিয়ে সংসারী করে তুললেন।

তোর ভাইবোন আছে?

হাতের পাঁচ আঙুল তুলে দেখাল।

মানে পাঁচটি ভাইবোন নিয়ে তিথি বিমাতার সংসারে থাকে।

তিথির কথা ভেবে অরুর খারাপই লাগল।

আসলে সে যে চালাকি করে তিথির বাবা—মার কথা বলে আটকে রেখেছে বুঝতেই দিল না। কথা বললে মেয়েটা নড়তেই চায় না। শিকারের সেই মৃত হাঁসটা দেখানোর আগ্রহ যেন আর তিথির মধ্যে নেই। তাঁকে সামান্য ভালোবেসে কথা বললে, এমন চোখে তাকিয়ে থাকে যে কিছুতেই আর অবহেলা করা যাবে না।

তিথি ঠিক অরুর পাশের চকিতে বসে পা দোলাচ্ছে। রোগা এবং কিছুটা লম্বা, অরুর মতোই লম্বা হবে, সংকোচ সংশয় কোনওকিছুই যেন তার মধ্যে নেই। চোখ দুটো বড় তাজা। খুবই ফর্সা, মুখের গড়নটা সরল সুন্দর এবং কিছুটা গম্ভীর। মেয়েটা চুপচাপ থাকলে দেবী বিসর্জনের বাজনা বেজে ওঠে। চুল কোঁকড়ানো, কপাল বেশ চওড়া এবং ঘন চুলে নারকেল তেলের গন্ধ।

অরু দেখল, সামান্য কথাবার্তা বলায় তিথি খুব খুশি। তারপরই কেন যে বলল, তুমি ওঠো তো। বিছানাটা একেবারে করে দিয়ে যাই। খেয়ে এসে শুয়ে পড়বে। বালিশ চাদর ওয়াড় সব কেচে রেখেছি। কাকার মশারিটা ছোট। দু’জনের হয় না। বলে কয়ে কাকাকে দিয়ে তোমার আলাদা মশারি আনিয়েছি। কাকার শুতে শুতে অনেক রাত হবে।

এখন বিছানা করতে হবে না। বাবা আসুক।

তিথি বলল, তা হলে আমি যাই। বলেই সিঁড়ি ধরে লাফিয়ে নেমে গেলে অরু দৌড়ে দরজার কাছে চলে গেল।

এই যাস না। আমি তোর সঙ্গে যাব।

এসো না। আমি তো দাঁড়িয়েই আছি।

কোথায় দাঁড়িয়ে আছিস! দেখতে পাচ্ছি না!

নেমে এসো, দেখতে পাবে।

দরজা বন্ধ করে দেব।

শিকল তুলে দাও না!

অরু শিকল তুলে দিতেই তার চারপাশ রাতের অন্ধকার ঘিরে ধরল। কিছুই চেনে না। বড় বড় আমগাছের ছায়ায় জায়গাটা কীভাবে কতটা ছড়িয়ে আছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। জানালা দিয়ে সামান্য আলো এসে বাইরে পড়েছে। সেদিকে তাকিয়েও কিছু বুঝতে পারল না। একবার ভাবল দরকার নেই তিথির সঙ্গে গিয়ে, কোথায় দাঁড়িয়ে আছে বুঝতেই পারছে না, সে ঘাবড়ে গেলে তিথি আরও মজা পেয়ে যাবে।

সে সিঁড়িতে উঠে শিকল খুলতে গেলেই, তিথি কোথা থেকে ডাকল, এই তো আমি। তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ না!—ঠিক যেখানে জানালার আলো এসে পড়েছে, তিথি সেখানে দু—হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে।

সে ফের ঘরে শেকল লাগিয়ে জানালার আলোর দিকে এগিয়ে গেল।

না, তিথি নেই।

পাশেই সাড়া পাওয়া গেল, এসো।

অরু অন্ধকারে খুঁজছে তিথিকে। কোনও গাছের আড়াল থেকে যেন কথা বলছে। যতই অন্ধকার হোক, আবছামতো কিছু তো দেখা যাবেই। একটা কুকুর দৌড়ে গেল। ঘেউ ঘেউ করছে।

অরুর মহা মুশকিল। এখন ইচ্ছে করলেই সে যেন আর ঘরে ফিরতে পারবে না। আমবাগানের এলাকাটা যে অনেকটা জায়গা জুড়ে তিথিকে খুঁজতে গিয়ে টের পেল। কোনও আলো পর্যন্ত চোখে পড়ছে না। শুধু তিথির এক কথা, আমি তো তোমার সঙ্গেই আছি। এসো না।

তুই আমার সঙ্গে নেই? গাছের আড়াল থেকে কথা বলছিস! কতদূর! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাকে তুই ভয় দেখাবি না বলে দিচ্ছি।

সামনে একটা সুপারি বাগান পড়বে। বাগানটা নদীর পাড়ে চলে গেছে। রাস্তা হারিয়ো না অরুদা। আমার পিছু পিছু চলে এসো। আমি ভূত নই, আমাকে ভয় পাবার কিছু নেই।

মেয়েটি ভারী বজ্জাত। তাকে বেকুব বানাবার তালে আছে। জমিদারবাড়ি বিশাল এলাকা নিয়েই হয়ে থাকে সে জানে। যেমন এই আমবাগান কিংবা সুপারিবাগানের ভেতর দিয়ে যেতে যেতেই হয়তো কোনও সাদারঙের বাড়ি আবিষ্কার করে ফেলবে। কারণ স্টিমারের আলোতে সুপারিবাগানের ভেতর দিয়ে সে যেন সত্যি একটা সাদারঙের বাড়ি দেখে ফেলেছিল।

বাবা তাকে কোথায় এনে তুললেন! সে কার পাল্লায় পড়ে গেল! মা নদীর জলে ভেসে গেছে, বাপ বাজারে জিলিপি ভাজে—তিথির ভাইবোনও আছে, কোন দিকটায় তিথি তার বাবার সঙ্গে থাকে তাও সে বুঝতে পারছে না। চারপাশে গাছ, কোথাও জঙ্গল, সুপারির গাছগুলো সোজা দাঁড়িয়ে আছে। সামান্য ঝড়বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় টুপটাপ পাতাও ঝরছে না, দু—একটা মরা ডাল পায়ে লাগতেই সে উবু হয়ে বসে পড়ল। তিথি তাকে যেন কোনও অশরীরী আত্মার পাল্লায় ফেলে দিচ্ছে।

এই অরুদা, বসে পড়লে কেন।

যেন একেবারে পাশ থেকে বলছে।

বিশাল একটা গাছের কাণ্ড তার সামনে রাস্তা রুখে দাঁড়িয়ে আছে। সে এগোতে পারছে না।

এত পাঁচিল। ঐ তো দরজা।

অরু বলল, তুই কোথায়?

এই তো আমি।

তিথি একেবারে সামনে এসে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

এই ছাড়। কী হচ্ছে।

কিছু হচ্ছে না। তুমি এত ভীতু। নদীর জল কল কল শব্দ—শুনতে পাচ্ছ না। সুপারিগাছের ফাঁক দিয়ে দেখ না, ঘাটে নৌকায় কত লণ্ঠন জ্বলছে।

তুই আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?

নদীর পাড়ে।

কেন?

এমনি এমনি।

আমি যাব না। তোর ইচ্ছে হয় তুই যা। বাবা আসুক, সব না বলছি তো। তুই না আমাকে অন্দরে নিয়ে যাবি বললি। গিন্নি মা আমাকে দেখতে চেয়েছেন, পাখি শিকার, মেজদা, রান্নাবাড়ি কত কিছু না বললি!

আমি তো তোমাকে সেখানেই নিয়ে যাচ্ছি।

এত দূর!

দূর, কী বলছ! ঐ তো দেখা যাচ্ছে। সাদামতো বাড়ি দেখতে পাচ্ছ না আবছামতো। বৈঠকখানায় সেজবাতি জ্বলছে। রকে হারিকেন জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। দেখতে পাচ্ছ না! নদীর পাড় ধরে গেলে তুমি খুব খুশি হতে অরুদা। সেখানে কত বড় আকাশ, কত নক্ষত্র আকাশে, কত সব জেলে ডিঙ্গি নদীর ঢেউ—এ ভাসছে, আমার যে কেবল মনে হয় খুব বর্ষায় কোনও ডিঙ্গিতে নদীর ঢেউয়ে ভেসে যাই। ঝড়বৃষ্টি নদীর ঢেউ ফুলেফেঁপে উঠবে, লম্বা ছিপনৌকায় আমি বসে থাকব। চারপাশে ঘন আঁধার, ঝিরঝির করে কুয়াশার মতো বৃষ্টি ঘিরে থাকবে আমাকে, কেউ দেখতে পাবে না, কেউ না, তুমি ছাড়া।

তিথি এত সুন্দর কথা বলে! কে বলায় তাকে! কেমন এক আশ্চর্য প্রকৃতির মধ্যে তিথি বড় হয়ে উঠতে উঠতে বোধহয় কখনও সে কোনও স্বপ্নের দেশ আবিষ্কার করে ফেলে! সে তো সবে এসেছে, সে এখানেই থাকবে। এও বুঝতে পেরেছে, বাবা আদায়পত্রে বের হলে এই মেয়েটার সাহচর্য তার সম্বল।

পাঁচিলে শ্যাওলার গন্ধ। অরণি ভেতরে ঢোকার সময় গন্ধটা পেল। দরজা দিয়ে ঢোকার সময় তিথি বলল, তুমি আমার হাত ধরো।

কেন? তোর হাত ধরব কেন?

কিছু এখানটায় দেখা যায় না।

কেন দেখা যায় না?

দুটো চালতা গাছ আছে। নালা নর্দমা আছে বাড়িটার। পড়ে যেতে পারো।

বাস্তবিক জায়গাটায় পা বাড়াতেই ভয় করছিল অরুর। প্রায় অন্ধের মতো পার হয়ে যাচ্ছে জায়গাটা। তিথি তার হাত ধরে রেখেছে। এবং রকে তুলে দিলে বুঝল, তার আর হাঁটতে অসুবিধা হবে না। মেলা মানুষজন বারান্দায়, বৈঠকখানাও সে দেখতে পেল। সেখানে চার—পাঁচজন প্রৌঢ়মতো মানুষ পাশা খেলায় ব্যস্ত।

তিথি বলল, গিন্নিমা, অ গিন্নিমা, তুমি অরুদাকে দেখবে বলেছিলে, এই তো অরুদা দাঁড়িয়ে আছে।

মৌমাছির মতো মানুষজন যেন উড়ে আসছে। গুঞ্জন।

এই ছোড়দি—তিথি কাকে যেন ডাকল।

ছোড়দি ছোড়দি করছিস কেন? ওকে ঘরে নিয়ে বসা।

তিথি কোন ঘরে নিয়ে যাবে! বড় বউদির ঘরে, গিন্নিমার ঘরে, মেজদার ঘরে—সে ঠিক বুঝতে পারছে না বলেই রোয়াকে দাঁড়িয়ে আছে।

অরু বড়ই অসহায় বোধ করছে। বাবার সঙ্গে এলে বোধ হয় এতটা অস্বস্তি হত না।

গিন্নিমা ডাকলেন, তিথি, তুই তো আচ্ছা মেয়ে, কোথায় যাস, কোথায় থাকিস, ডেকে ডেকে সাড়া পাচ্ছি না। কখন থেকে খুঁজছি।

বারে তুমি যে বললে, অরুদাকে দেখবে!

কখন বললাম!

বললে না, জগদীশকে বলবি, অরুকে যেন নিয়ে একবার আসে।

বলেছি বুঝি। কোথায় ছেলেটা! কোথায় দাঁড়িয়ে আছে! আমি যাই কী করে—হাত জোড়া আমার। এখানে নিয়ে আয়। সব ঘরগুলোর সামনেই লম্বা রোয়াক অথবা বারান্দা বলা যায়, বারান্দা পার হয়ে তিথি বলল, দাঁড়িয়ে থাকলে কেন অরুদা, সবাইকে প্রণাম করতে হয়।

অরু রোয়াকে দাঁড়িয়েই আছে।

পাকাবাড়ি বুঝি এমনই হয়ে থাকে। একতলা বাড়িটা এতবড় ভেতরে না ঢুকলে সে বুঝতে পারত না। বাড়ির মানুষজন সবাই বড় সুপুরুষ। ঘরের ভেতর পালঙ্কে শুয়ে সুন্দরমতো মেয়েটা কে সে জানে না। বালিশে ভর করে তাকে দেখছিল। সাদা ধবধবে বিছানা, পালঙ্কের পায়ায় সিংহের থাবা। চকচকে লাল মেঝে এবং ছাদে ঝাড়বাতি ঝুলছে। হাওয়ায় রিন রিন করে বাজছিল। বয়স্ক এক মহিলা তাকে কাছে টেনে আদর করতে চাইলে সে কেমন জড়ভরত হয়ে গেল। তিথি বলল, ছোটপিসি, ভয় কি অরুদা।

ছোটপিসিকে সে কেন যে বয়স্ক ভাবল বুঝতে পারছে না। সাদা ধবধবে থান পরনে। হারিকেনের আলোতে আবছামতো মুখ। ভালো করে নজর করতেই বুঝল, সাদা থান পরলেই বয়স্ক হয়ে যায় না। তার চেয়ে কিছু বড় হতে পারে। কাকিমার বয়সিই হবে। ছোটকাকার বিয়ের কথা তার মনে আছে। সে বরযাত্রী গিয়েছিল। বালিকা বয়সে ছোট কাকিমা যদি তাদের বাড়িতে আসে, তবে এখন তার কতই বা বয়স হতে পারে।

ছোটপিসি থুতনি ধরে বলল, আয় আমার ঘরে।

অরু কিছুতেই যেতে চাইল না।

আর আশ্চর্য তিথির হাতে সেই হাঁসটা। ছালচামড়া ছাড়ানো হয়নি। হাঁসটা মৃতও নয়। তবে ভালোমতো জখম হয়েছে। তিথি হাঁসটাকে প্রায় বুকে করে ধরে রেখেছে।

পাকা ঝাপটাচ্ছিল হাঁসটা।

কিন্তু উড়তে পারছে না। জোরজার করে তিথি চেপে রেখেছে কোলে।

হাঁসটা যে আদৌ মরে যায়নি, শিকারের পাখি এমনই হয়ে থাকে, খোঁড়া হতে পারে, কিংবা পাখায় ছররার গুলি লাগতে পারে, বোধহয় হাঁসটার ডানা ভেঙে গেছে, বড়ই কাতর চোখে হাঁসটা মাথা তুলে হারিকেনের আলোতে উড়ে যাবার চেষ্টা করছে, পারছে না, বৃথাই চেষ্টা—তখনই ছোটপিসি বলল, তোর কি তিথি ঘেন্নাপেত্তা নেই। বুকে তুলে রেখেছিস। নিয়ে যা। আমি সহ্য করতে পারছি না।

অরুও কেমন দমে গেল।

এই জখমি হাঁসটা যেন না দেখলেই ভালো হত।

অরু বলল, আমি যাই।

তিথি বলল, একা যেতে পারবে, কাছারিবাড়িতে! রাস্তা হারিয়ে ফেলতে পারো।

অরুর মনে হল, সে সত্যি একা যেতে পারবে না। তিথি রাস্তা চিনিয়ে না নিয়ে গেলে, রাতের অন্ধকারে গাছপালার ছায়ায় কাছারিবাড়িটা যেন কখনোই আর খুঁজে পাবে না।

।চার

জগদীশ পাঁচটা না বাজতেই ঘুম থেকে উঠে পড়েন। খড়ম পায়ে বাইরে বের হয়ে সূর্য প্রণাম, তারপর নুয়ে এই বসুন্ধরা এবং যাকে তিনি জগজ্জননী ভাবেন তাঁর উদ্দেশ্যে চোখ বুজে কিছুক্ষণ ধ্যান, ফের ঘরে ঢুকে পেতলের গাড়ুটি হাতে নিয়ে হাঁটা দেন—সামনের সুপারিবাগানে ঢুকে যান, কিছুদূর হেঁটে গেলেই ঝোপের মতো জায়গায় তিনি অদৃশ্য হন। তারপর নদীর জলে অবগাহন, স্তোত্রপাঠ এবং ফেরার পথে মঠের শিবলিঙ্গের মাথায় একটি ধুতুরা ফুল এবং নদীর জল ঢেলে শিবস্তোত্র পাঠ করেন।

এত সকালে তার পুত্র অরণির ওঠার অভ্যাস নেই। দেশের বাড়িতে মাইনর পাশ করে বসেছিল, গতকাল তাকে নিয়ে তিনি তাঁর কর্মস্থলে চলে এসেছেন। স্থানীয় স্কুলে ভর্তি করে দেবার ব্যবস্থাও হয়ে গেছে। রাতে পথশ্রমে অরণির বোধ হয় ভালো ঘুম হয়নি। সারারাতই ছটফট করেছে। বাড়ি ছেড়ে থাকারও কষ্ট কম না। ভোররাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়ায় তিনি তাকে এখনও ডেকে তোলেনি। মনে মনে স্তোত্রপাঠ করছেন, এবং খড়ম পায়ে হাঁটাহাঁটি করলে অরণির ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে—যতক্ষণ না হরমোহন নাজিরখানার দরজা খুলে দেবে, তিনি ঘর ছেড়ে যেতেও পারেন না।

অরণিকে তাঁর কিছু বলার আছে। তাকে ঘুম থেকে তোলাও দরকার। ডাকতে কষ্ট হচ্ছিল, অঘোরে ঘুমোচ্ছে, অথচ সব না বলে গেলেও চলবে না। তাকে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে বগলে বই নিয়ে জমিদারবাবুর পুত্রদের ঘরে চলে যাওয়া দরকার। সেখানে মাস্টারমশাই তাদের পড়াতে আসেন। অরণিও তাদের সঙ্গে পড়বে।

একবার, ভাবলেন ডাকেন। বলেন, অরু উঠে পড়ো। কারণ সকাল হয়ে গেছে। হাতমুখ ধুয়ে নাও। তোমার দেরি দেখলে বিশু চলে আসতে পারে। এ—বাড়িতে কেউ এত দেরি করে ওঠে না।

বাড়ি থেকে খুব সকালে রওনা হয়ে, কিছুটা পথ হেঁটে, বাকি পথ স্টিমারে যখন এই কাছারিবাড়িতে এসে উঠেছিলেন তিনি, তখন রাত হয়ে গেছিল। স্টিমারের আলোতে সুপারিবাগান এবং জমিদারদের খানিকটা প্রাসাদ ছাড়া অরণির চোখে কিছুই দৃশ্যমান ছিল না। আমবাগানের পরিত্যক্ত কাছারিবাড়িতে অরণিকে একা থাকতে হবে ভেবে সে খুবই মনকষ্টে ছিল। কিছুটা আতঙ্কও চোখেমুখে লক্ষ করেছেন তিনি।

এখন ঘুম থেকে উঠেই দেখতে পাবে, সুপারিবাগান পার হয়ে নদীর জল কলকল ছলছল—নদীর পাড়ে গেলে ছবির মতো দেখতে জমিদারবাবুদের গ্রামটিও সে দেখতে পাবে। প্রাসাদগুলির জাঁকজমক অরণিকে অবাক না করে পারে না। নদীটি এত বিশাল আর নদীর চর, পাখির ওড়াউড়ি নিয়ে এত ব্যস্ত যে নদীটিকে দেখলেই ডুব দিতে ইচ্ছে হয়। তিনি এক আনা জমিদার দেবকুমারবাবুর আমলা। প্রাসাদ, দিঘি সহ নদীর পাড়ে তাঁর এলাহি ব্যবস্থা। ফুলের রকমারি বাহারও কম নেই বাড়িটাতে। অরণি ঘুম থেকে উঠে হাই তুললেই দেখতে পাবে সামনের সুপারিবাগান পার হয়ে পুণ্যতোয়া নদীটির জল, জলে ঢেউ, পালতোলা সব নৌকা।

গ্রামের পাশে নদী থাকলে স্থানমহিমা যে কত বেড়ে যায়, অরণি ঘুম থেকে উঠলেই বুঝতে পারবে।

তখনই তিথি জানালায়—ও বাব্বা, অরুদা তুমি ঘুমোচ্ছ, তুমি কি গো। কত লোক কত দূর দেশে চলে গেল, এখনও তোমার ঘুম ভাঙল না।

জগদীশের মনঃপূত নয়, তিথি তাকে ডেকে জাগিয়ে দিক—কিন্তু, এতই চঞ্চল, আর হতভাগ্য মেয়েটি, যে তাকে তিনি কোনও কড়া কথাই বলতে পারেন না। আর এত কাজের, আসলে সে চলে এসেছে, বিছানা তুলে ঘর ঝাড় দিয়ে চলে যাবে। অরণি আসায় এ—ঘরে তার যেন দায়িত্ব আরও বেড়ে গেছে। ওর বাবা গোরাচাঁদকে বাড়িঘর করার মতো কিছুটা জমি পাইয়ে দেওয়ার পর থেকে গোরাচাঁদের বউ যমুনার কৃতজ্ঞতার শেষ ছিল না। আগে যমুনা করে দিত, তিথি বড় হয়ে যাওয়ায় সে এখন করে দেয়। জিলিপি, তেলেভাজার দোকানের জায়গাটিও তিনি ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বাজারের ওই একফালি জায়গা নবকুমারবাবুকে বলে ব্যবস্থা না করে দিলে গোরাচাঁদ একপাল ছেলেপিলে নিয়ে অথৈ জলে পড়ে যেত। তবে জগদীশের পছন্দ নয়, তিনি আগে মানাও করতেন, তাতে যমুনা কিংবা গোরাচাঁদের দুজনের মুখই ভারী ব্যাজার হয়ে যেত। ভুঁইঞামশায়ের মর্জিতেই জমিদারি চলে, তিনি এটুকু সেবা না নিলে, তারা কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে।

তিনি আর তারপর থেকে, কাজ করে দিলে মানা করেন না, কাজের কথা ভুলে গেলে ডেকে মনেও করিয়ে দেন না। নিজেই করে নেন। কোনওদিন তিথি হয়তো সকালেই নদীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ঘাটে পুণ্যস্থান থাকলে, নদীর জলে ডুব দিয়ে হয়তো পয়সা তুলছে। পয়সা সংগ্রহের উত্তেজনায় মনেই নেই, সকালে এক বালতি জল ভুঁইঞাকাকার ঘরে তুলে রাখতে সে ভুলে গেছে।

জগদীশ তখন নিজেই জল তোলেন।

জগদীশ তখন নিজেই ছাড়া জামাকাপড় ধুয়ে তারে মেলে দেন। এসব কাজের জন্য তিথি কিংবা যমুনার উপর নির্ভর না করে নিজে করে নিতে পারলে কিছুটা আত্মতুষ্টিতেও ভোগেন।

তারপরই হয় মুশকিল।

গোরাচাঁদ শুনে খেপে যায়, কোথায় তিথি, কোথায় গেছে। ভুঁইঞামশাই তারে কাপড় মেলছে, সারাদিন ছুক ছুক করে বেড়ানো, তোর এত লোভ! বউকেও বলবে, তুমি খেয়াল রাখতে পারো না, তিথি ছেলেমানুষ, তার দোষ কি! ইস কী যে হবে!

জগদীশের কানেও কথা উঠে আসে।

ইস, মেয়েটাকে গোরা গোরু খোঁজা খুঁজছে।

কেন? ও কী করেছে! অন্দরে থাকতে পারে। গোরাকে ওখানে খোঁজ নিতে বলো।

না, ওখানে নেই।

ওখানে না থাকলে, নদীর চরে শালুক তুলতে যেতে পারে।

না, সেখানেও যায়নি!

তবে গেল কোথায় মেয়েটা! এক দণ্ড চুপ করে বসে থাকতে পারে না। নদীর ঘাটে পুণ্যস্নান, মেলার চরে পালতোলা নৌকার ভিড়। মানুষজনও মেলা। পায়ে হাঁটা পথে, স্টিমারে কেউ কেউ এসে নেমে থাকে। মাঠের চারপাশে ভিড় থাকে, তারপর মানুষজন নদীর ঘাটে পুণ্যস্নান সেরে চলে যাবে বাজারের দিকটায়। সড়ক ধরে, একপাশে বিশাল সব প্রাসাদ ফেলে সোজা হেঁটে গেলেই বাজার—চরের উপর দিয়েও হেঁটে যাওয়া যায়, তারপর বিন্নির খই লালবাতাসা খেয়ে যে যার নৌকায় কিংবা হাঁটাপথে বাড়ির দিকে রওনা হবে। অষ্টমী স্নানেই বেশি ভিড়, ছোটখাটো পুণ্যস্নানও বছরে যে কিছু না থাকে—তাও নয়। তিথির তখন কেমন দিশেহারা অবস্থা। নদীর জলে ডুব দিয়ে পয়সা তুলবে। দুটো পাঁচটা যা পায়, সেই দিয়ে সেও বিন্নির খই লালবাতাসা কিনে কোঁচড়ে নিয়ে খাবে আর নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়াবে। আর নদীর পালতোলা নৌকা, যেমন কাঁঠালের কিংবা আনারসের, তালের নৌকাও থাকে, এই সব নৌকার দিকে তাকিয়ে আপন মনে নদীর সঙ্গে কথা বলবে। নৌকার ব্যাপারীদের সঙ্গে কথা বলবে।

এই তিথি!

সে অবাক হয়ে তাকাবে।

তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস? কী খাচ্ছিস?

কী খুশি তিথি! সে তার কোঁচড় খুলে দেখাবে।

যা বাড়িতে, খাওয়া তোর বের করবে।

তিথির চোখ মুখ শুকিয়ে যায়।

জগদীশ জানেন, গোরাচাঁদের ওই এক দোষ। বড় চণ্ড রাগ তার। মাথা গরম হয়ে গেলে সে ভালোমন্দ বোঝে না, মেয়েটার সজল চোখও তাকে আটকাতে পারে না। বড় নির্মম হয়ে ওঠে।

জগদীশের এই হয়েছে মুশকিল। মেয়েটাকে ধরতে পারলেই গোরাচাঁদ টেনে হিঁচড়ে বাড়ি নিয়ে আসবে।

তুই মার খেয়ে খেয়ে মরবি! ভুইঞামশাইর ঘরে জল তুলে রাখিসনি! ছাড়া কাপড় কেচে তারে মেলে দিসনি। তোর এত নোলা।

জগদীশ এই সব জানেন বলেই, তিথিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না শুনলেই কিছুটা হতভম্ব হয়ে গিয়ে বলেন, কোথায় গেল! তারপর নিজেই খুঁজতে বের হয়ে যান। গোরাচাঁদের ভয়, মেয়েটার জন্য তার সব না শেষ হয়ে যায়। বাবুদের অনুগ্রহে জমিদারিতে তার আশ্রয়। একখানা নোটিস ঝুলিয়ে দিলেই তার সব গেল। তিথি তার সর্বনাশ না করে ছাড়বে না।

জগদীশ সুপারিবাগানের এক কোণায় গিয়ে ডাকবেন, গোরাচাঁদ, গোরা আছিস?

আজ্ঞে উনি তো তিথিকে খুঁজতে গেছেন।

যমুনা দরজার বাইরে একগলা ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ওকে বলবে, তিথির গায়ে যেন হাত না তোলে। হাত তুললে খুব খারাপ হবে। আমার মনে হয় মঠের ঘাটে গেছে। পুণ্যস্নান হচ্ছে, মেলা বসেছে, তালপাতার বাঁশি বাজছে, মেয়েটার মন ঘরে টিকবে কেন!

মেলায় নেই।

তা হলে জলে আছে। আমি যাচ্ছি, দেখছি খুঁজে পাই কি না।

আর তখনই তিনি ঠিক দেখতে পান গোরাচাঁদ নদীর পাড় থেকে মেয়েটাকে হাতে ধরে টেনে আনছে। নদীর জলে সারা সকাল যে ডুবে ডুবে পয়সা খুঁজছে, চোখ দেখেই বোঝা যায়। তারপর পাড়ে উঠে নদীর হাওয়ায় ফ্রক শুকিয়েছে, তাও বোঝা যায় শুকনো ফ্রক দেখে, বিন্নির খই, লালবাতাসা কোঁচড়ে নিয়ে নদীর পাড়ে ঘুরে ঘুরে কিছুটা খেয়েছে, বাকিটা ভাইবোনদের জন্য লুকিয়ে নিয়ে আসার মতলবে ছিল, তাও বোঝা যায় ওর এক হাতে কোঁচড় ধরে রাখার চেষ্টায়। হাত টানাটানিতে না আবার কোঁচড়ের মুঠি ফসকে যায়, যতই গোরাচাঁদ তার মেয়েকে টেনে আনার চেষ্টা করুক না, তিথি তার কোঁচড় ছাড়ছে না।

গোরাচাঁদ জগদীশকে দেখেই থমকে গিয়েছিল। তিথির হাতও ছেড়ে দিয়েছিল।

ভুঁইঞামশায় আমার কী হবে! যমুনা খবর পাঠাল, আপনি তারে কাপড় মেলছেন, তিথি সকালে বেপাত্তা। চরণকে বসিয়ে ছুটে এসেছি। এই দেখুন কী কাণ্ড!

দেখছি। কি রে তিথি কটা পয়সা হল।

তিথির সব ভয়ডর নিমেষে জল।

সে মুচকি হেসে বলল, পাঁচ পয়সা।

এত জল ঘাঁটলে জ্বর হবে যে! বাবার কথা শুনিস না কেন!

তিথি বড় বড় চোখে তাকিয়ে শুধু তাঁকে দেখছিল।

কোঁচড়ে কী আছে?

খুবই আহ্লাদের গলায় বলল, খই বাতাসা। বলে, কোঁচড় মেলে দেখাল।

যা বাড়ি যা। বাড়ি থেকে গেলে বলে যাবি। তুই বড় হয়ে যাচ্ছিস বুঝতে পারিস না।

বড় হয়ে যাওয়ার কথায় তিথির কী লজ্জা! সে প্রায় পড়িমরি করে ছুটতে থাকল। কোঁচড় দু—হাতে সামলে, সেই মুলিবাঁশের বেড়া দেওয়া ঘরটার দিকে ছুটতে থাকলে তার ভাইবোনগুলো বের হয়ে এল প্যাক প্যাক করতে করতে।

গোরাচাঁদ আফসোসের গলায় বলল, বলেন, এই কর্মনাশা মেয়েকে নিয়ে আমি কী করি! কোথায় যাই।

তিথিকে দেখতে দেখতে জগদীশের পলকে মনে পড়ে যায় সব। চোখের সামনে বড় হয়ে উঠছে। ছেঁড়া ফ্রকে তাকে খারাপও দেখায় না। মেয়েটার দস্যিপনায় তার বাবা অস্থির। নতুন ফ্রক কিনে দিলে দু—চার মাসও যায় না। ওর বাবাও পেরে ওঠে না। বউঠান, তুলির পুরনো ফ্রক থাকলে মাঝে মাঝে ওকে ডেকে দেন। কী খুশি তখন। ফ্রকটা ছোড়দি গায়ে দিত, সেই ফ্রক সে গায়ে দিচ্ছে। আর যা হয়, তখনই তার কত আবদার সবার কাছে, গাছপালা, জীবজন্তু, পাখপাখালি সবাই তার বন্ধু হয়ে যায়। সে যেন ফ্রকটা গায়ে দিয়ে ইচ্ছে করলে উড়ে বেড়াতেও পারে।

তখন সর্বত্র তার চোখ।

কে রে? কে সুপারির বাগানে ঢুকেছিস।

সে তেড়ে যায়।

গরিবগুর্বো মানুষেরা এই সব ভূস্বামীদের উচ্ছিষ্ট খেয়ে যে বেঁচে থাকে জগদীশ ভালোই জানেন। সুপারির খোল বাগানে পড়ে আছে, কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে, তিথির জ্বালায় তা নিয়ে যাওয়া কঠিন। বাবুদের বাড়ির সবকিছুর উপরই তার যেন হক আছে।

সুপারির খোল নেবে সাধ্য কি!

তার চেঁচামেচির শেষ থাকে না।

অমলদা, দ্যাখো এসে আমাদের সুপারির বাগানে কে এসে ঢুকেছে।

কারও সাড়া না পেলে সে খোল নিয়ে গরিব মানুষটির সঙ্গে টানাটানি শুরু করে দেবে।

এটা আমাদের, তুই মেঘা কোন সাহসে বাগানে ঢুকলি! ভুইঞাকাকাকে দাঁড়া খবর দিচ্ছি।

এই হয়, সুপারির বাগানে হাওয়ায় পাকা সুপারি ঝরে পড়ে। গাছের ডগা থেকে খোল খসে পড়ে। যাওয়া আসার রাস্তায় গরিব মানুষদের চোখ কান শকুনের মতো সজাগ। শব্দ হলেই হল, তাল পড়তে পারে, নারকেল পড়তে পারে, সুপারির খোল পড়তে পারে, এতবড় মহলার মধ্যে কোথায় কী পড়ে থাকে কারও খেয়াল থাকার কথা না, কিন্তু তিথির সব খেয়াল থাকে—বিশাল এলাকায় আম জাম জামরুল গাছেরও অভাব নেই—তিথির মতো কেউ খবর দিতে পারে না, কোন গাছে কী ফল ধরে আছে, কোন গাছে কত আম পেকে আছে। তিথির জ্বালায় গাছের ফল পাকুড় কুড়িয়ে নিয়ে কারও হাওয়া হয়ে যাবার ক্ষমতাই নেই। সে কেড়েকুড়ে সব এনে বউঠানের কাছে জিম্মা দেবে।

আর নালিশ, জানো, নিয়ে পালাচ্ছিল। বাতাবি লেবুটা গাছের নীচে কখন পড়ে আছে, আমিও জানো খেয়াল করিনি। শ্রীশ ধরের ব্যাটা নিয়ে পালাচ্ছিল। আমাকে দেখে ফেলে দৌড়োছে।

তিথি ঘরে ঢুকে গেছে ততক্ষণে। সে তাঁর বিছানা মশারি গুটিয়ে কাঠের তাকে তুলে রাখছে। তিথির ডাকাডাকিতে অরু বিছানায় উঠে বসল। নতুন জায়গা—এটা একটা কাছারিবাড়ি কিছুই বোধহয় তার মনে ছিল না। চোখ কচলে হাত পা ঝাড়া দিতেই বুঝল সে তা বাবার কর্মস্থলে—তিথিকে দেখে তার সব মনে পড়ল—রাতের অন্ধকারে কেমন সব কিছু রহস্যাবৃত ছিল, এই সকালবেলায় সে বিছানা ছেড়ে নামার সময়ই, দেখল সামনে সুপারিবাগান, তার ভেতর দিয়ে নদীর পাড়, চড়া, সাদা কাশফুলের ওড়াউড়ি। বাবার স্নান জপতপ সারা। কারণ বাবা একটি ফতুয়া গায়ে দিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছেন আয়নায়। সে কিছুটা যে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে বোঝা যায়। দরজায় দাঁড়াতেই বুঝল, চারপাশে বড় বড় সব আমগাছ, তার ডালপালায় কাছারিবাড়িটা তপোবনের মতো।

তিথি বলল, দাঁড়াও জল এনে দিচ্ছি।

অরুর ভীষণ হিসি পেয়েছে। সে তিথির কথার তোয়াক্কা করছে না। সিঁড়ি ধরে নীচে নেমে গেলে টের পেল মেলা ঝোপজঙ্গলও আছে কাছারিবাড়ির চারপাশে। তারপর বেশ বড় মাঠ, বাঁশের বেড়া, সেখানে ফুলের সব গাছপালা, সাদা রঙের ছোটখাটো প্রাসাদও চোখে পড়ল। সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যেন নদীর পাড় ধরে যতদূর চোখ যায়, সবই বড় সুন্দর করে সাজানো গোছানো।

জগদীশ বের হবার সময় বললেন, তুমি গোলঘরে চলে যাবে অরু। হাত মুখ ধুয়ে নাও। বইখাতা নিয়ে যাবে। অমল কমলের ঘরে পড়বে।

রাতে খেতে বসে সবাইকে সে দেখেছে। অমলদা তার চেয়ে বেশ বড়ই হবে। ক্লাশ নাইনে পড়ে। কমল তার বয়সি কমলদা ঠিক বলা যায় না, সমবয়সিকে সে দাদা বলতে রাজি না। সবাই অবশ্য এখানে বাবু হয়ে আছে। অমলবাবু, কমলবাবু, কারণ জমিদারি যতই সামান্য থাক, ঠাটবাট আছে পুরো মাত্রায়।

খেতে বসেই টের পেয়েছে বাড়িটায় আশ্রিতজনেরও অভাব নেই। লম্বা রান্নাঘরে আসন পেতে সারি সারি পাত পড়েছে। ঝি—চাকরেরও অভাব নেই। একটা ধিঙ্গি মেয়েকে কোলে করে তুলে এনেছে—ঘুম থেকে তুলে খাওয়ানোর ফ্যাসাদও সে টের পেয়েছিল। কোল থেকে নামিয়ে দিলে সে বুঝেছিল ইনিই সেই ছোড়দি, গায়ে সাটিনের ফ্রক, ফ্রকের ফাঁক দিয়ে হাতির দাঁতের মতো দুটো লম্বা ঠ্যাং বের হয়ে আছে। মাথায় লাল রিবন বাঁধা, কিছুতেই চোখ খুলছে না—আসনে বসিয়ে দিলেও ঢুলছে। সবাই তাকে খাওয়াবার জন্য যে বড়ই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, এবং সে না খেলে বাড়িতে মহামারি শুরু হয়ে যাবে যেন, আহ্লাদ আবদারের শেষ ছিল না।

এই তুলি, কী হচ্ছে! ইস জলের গেলাসটা দিলি তো ফেলে। এ কি রে বাবা, কিছুতেই মুখে দিচ্ছে না।

পাশে যিনি বসে তুলিকে খাওয়াবার চেষ্টা করছেন, তাকে সে চেনে না। পরে অবশ্য তিথি বলেছে, বড়বাবুর সম্পর্কে মাসি হয়—এই বাড়িতেই থাকেন।

তারা যখন খাচ্ছিল—তিথি রোয়াকে বসেছিল, নুন জল লেবু সে পাতে পাতে দিয়েছে। কাঁচালংকা দিয়েছে। পায়ে আলতা পরা বউটিকে বাবার বউঠান, ভাতের টাগারি এগিয়ে দিচ্ছেন পরিবেশনের জন্য। সারাক্ষণ বউমা বউমা করছেন। এই নাও মাছভাজা। বড় বড় কইমাছ ভাজা পাতে পাতে। ডাল পাতে পাতে। আলু পটলের ডালনা, পাখির মাংস, আর ছোট বাটিতে এক বাটি দুধ সবার। ঘোমটায় ঢাকা মুখ, আর নিষ্প্রভ হারিকেনের আলোতে বউটির মুখ সে দেখতে পায়নি, তবে আলতা পরা পা দু—খানি তার এত সুন্দর, একেবারে দুধে আলতায় যার রঙ সে যে খুবই সুন্দরী তাতে তার কোনও সন্দেহ ছিল না। সে মাথা নিচু করে বাবার পাশে চুপচাপ খাচ্ছিল, আর তুলির আবদারে বিরক্ত হচ্ছিল।

কী দিয়ে খাবি?

খাব না।

পাখির মাংস দিয়ে খা।

না খাব না।

তবে কী দিয়ে খাবি?

কিছুই খাব না।

দুধ মেখে দিচ্ছি।

দাও।

দু—গ্রাস খেয়েই কেমন ওক তুলে দিচ্ছে।

অরুর বলতে ইচ্ছা হচ্ছিল, মারব থাপ্পড়।

তিথির বয়সিই হবে। সারা বাড়ির মানুষজন, একটা পুঁচকে মেয়ের খাওয়া নিয়ে যেন অস্থির হয়ে পড়েছিল। আদরে আদরে যে মাথাটি গেছে অরুর বুঝতে অসুবিধা হয়নি।

তিথি রাতে খেয়েছে কি না জানে না।

খেতেও পারে, নাও পারে।

তার বাবা জমিদারবাবুর আশ্রিত। বাড়ির কাজে কিংবা গিন্নিমার ফুটফরমাস খেটে না দিলে যে তাদের সবই যেতে পারে।

তিথি কি সেই আতঙ্কেই থাকে!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *