নারী এবং নদীর পাড়ে বাড়ি – দুই
বাবার হাতে ফুল—তোলা টিনের স্যুটকেস, বগলে পুঁটুলি—তিনি পাটাতনের শেষ মাথায় প্রায় চলে গেছেন—সেও দৌড়তে পারত, কিন্তু কোথায় স্টিমার, গুমগুম আওয়াজও শুনতে পাচ্ছে না, সে দাঁড়িয়েই আছে। সারাটা রাস্তা বাবা কিছুতেই স্যুটকেসটা তার হাতে দেননি—এমনকি বোঁচকাটিও নয়, সে কি এতই ছেলেমানুষ! এই সব ভেবেই তার এত রাগ হচ্ছিল যে, স্টিমার না দেখে যেন এক পা—ও নড়বে না সে। আর বাবা কেন যে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তাও সে বুঝতে পারছে না। স্টিমারটা কি তাদের ফেলে চলে যেতে পারে!
বাবা ডাকছেন, অরু আয়, দাঁড়িয়ে থাকিস না। আগে উঠতে না পারলে বসার ভালো জায়গা পাবি না। কতদূর আমাদের যেতে হবে!
তখনই সাদা রঙের স্টিমার নদীর বাঁকে ঢুকে গেছে। ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। ক্রমে স্টিমারটা এগিয়ে আসছে। কী বিশাল, যেন নদীর জল তোলপাড় করে সিটি বাজাতে বাজাতে সবাইকে সতর্ক করে দিচ্ছে—নদীর পাড়ে এসে বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছিল। নৌকাগুলি দুলছিল—নদীর দু’পাড় জলময় হয়ে যেতে যেতে কখন যে স্টিমার থেকে সিঁড়ি নেমে গেল, তাও যেন অরুণ খেয়াল নেই। কেমন এক বিস্ময় তার মধ্যে নিয়ত খেলা করে বেড়াচ্ছিল।
হঠাৎ সে দেখল বাবা তার কাছে ছুটে এসেছেন।
কী হল! আয়।
অরু বুঝল তাকে যে স্টিমারে উঠে আরও অনেক দূরে চলে যেতে হবে—যেন মনেই নেই। যেন নদীর পাড়ে সে বেড়াতে এসেছিল, কোথাও যাবার কথা ছিল না তার, স্টিমার দেখে সে বাড়ি ফিরে যাবে—বাবা এসে তার হাত ধরে টানতেই তার খেয়াল হল সে পাটাতনের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। যাত্রীরা সব উঠে যাচ্ছে সিঁড়ি ধরে, সে তাড়াতাড়ি বাবার হাত ছাড়িয়ে দৌড়তে থাকল। আর স্টিমারে উঠে যাত্রীদের ভিড় ঠেলে সিঁড়ি ধরে আপার—ডেকে উঠে গেল। রেলিং—এ ঝোলানো সাদা রঙের গোল গোল লাইফবয়া পরম কৌতূহলে সে দেখছে।
বাবাকে দেখেই প্রশ্ন, এগুলো কী!
পরে সব জানতে পারবে। আগে আমার সঙ্গে এসো। জাহাজের সারেঙসাবের সঙ্গে দেখা করে আসি। তিনি তোমাকে দেখতে চেয়েছেন। সুলতানসাদির বাজারের কাছে এককালে তাঁর বাড়ি ছিল। তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি শুনেই বললেন, কর্তারে নিয়া আসেন, দেখি। আশরাফ মিঞার নাম নিশ্চয়ই শুনেছ।
আশরাফ মিঞার নাম সে কখনোই শোনেনি। সে জানে বাবার এই স্বভাব, যে—মানুষ এতবড় স্টিমারটা চালিয়ে নিয়ে যায়, তার নাম না জানলে হবে কেন! ঝড়জলে কিংবা প্লাবনে, অথবা জলের ঘূর্ণি যার এত চেনা, সে মানুষটার নাম না জানা খুবই অন্যায়, এমনও মনে হল বাবার মুখ দেখে। তা ছাড়া মানুষটা যখন তাদের এলাকার মানুষ।
সে ডেক—ছাদের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। এটা যে স্টিমারের নিষিদ্ধ এলাকা, তার জানা নেই। পাশের ঘরটা হুইল রুম। একটা লোক সেখানে দাঁড়িয়ে চাকার মতো দেখতে জিনিসটাকে ডাইনে—বাঁয়ে ঘোরাচ্ছে। রঙ—বার্নিশের গন্ধ উঠছে। দু’পাড়ে নদীর চড়া, সামনে নদীর জল, মাথার ওপর আকাশ দিগন্ত প্রসারিত যেন। গাছপালা, নদীর তীর এবং সামনের জলরাশি—সব মিলে তাকে কিছুটা কেন জানি উন্মনা করে দিয়েছে। জায়গাটা ছেড়ে চলে যেতে তার ইচ্ছে হচ্ছে না।
জগদীশ বললেন, কী হল, এসো! দাঁড়িয়ে থাকলে কেন?
এখন আমার যেতে ইচ্ছে করছে না বাবা।
তাঁর সঙ্গে তোমার দেখা করা উচিত। তাঁরই স্টিমারে তুমি যাচ্ছ, আমি তো সব সময় তোমার স্কুলের ছুটিছাটায় সঙ্গে আসতে পারব না। আশরাফের স্টিমারে উঠিয়ে দিলে, সে—ই তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। আমাদের এলাকার লোক, সবাই তাকে চেনে।
আমার ভালো লাগছে না বাবা।
কেন ভালো লাগছে না! কী হয়েছে? মোয়ামুড়ি আছে, খিদে পেলে খেতে পারো।
ভালো না লাগারই কথা। বাড়ি ছেড়ে এই প্রথম দূরদেশে যাচ্ছে। বাড়ির কাছাকাছি কোনও হাইস্কুল নেই বলেই, তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া। মন খারাপ হতেই পারে। বাড়িতে তার জননীও কান্নাকাটি করেছে আসার সময়।
আসলে অরুর মনে হচ্ছিল, সেই নির্বাসিত দেশে সে যাচ্ছে। সেখানে কে আছে জানে না, যতক্ষণ দেখা যায়। এই দু’পাড়ের মানুষজন ছেড়ে গেলেই যেন সেই নির্বাসিত দেশটায় ঢুকে যাবে। যতক্ষণ পারা যায়, দেখা। ঘরবাড়ি, মানুষের পদচিহ্ন এত আগ্রহ সৃষ্টি করে, সে জীবনেও টের পায়নি!
সে রেলিং—এ ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে।
স্টিমারটা গতি পেয়ে গেছে—দু’পাশের চাকাদুটো ঘুরছিল—কেমন ঝমঝম শব্দ। তার কাছে সবকিছুই একটা নতুন গ্রহের মতো। পরনে হাফপ্যান্ট, হাফশার্ট গায়, মাথার চুল উড়ছিল, সে জানেই না বাবা তার পাশে এখনও দাঁড়িয়ে আছেন। সামনে যতদূর চোখ যায় দেখা, এবং যখন টের পেল বাবা তাকে নিয়ে যাবেনই, সে বলল, ওটা কী বাবা?
ওটা নবাব ঈশাখাঁর কেল্লা। এখন ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছে। এই কেল্লা থেকেই নবাব, চাঁদ রায় কেদার রায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
নবাব ঈশাখাঁর নাম সে জানে। চাঁদ রায় যাত্রাপালায় নবাব ঈশাখাঁ, সোনাই এবং সেই ঝলমলে তরবারিটির কথাও তার কেন জানি এ সময় মনে পড়ল। কেন যে এসব মনে পড়ে তার! তার নিজের বাড়িঘর, পুকুর, গোপাট, পুকুরপাড়ের অতিকায় তেঁতুলগাছটিও তার চোখে ভেসে উঠল। বাড়িতে ভাইবোনেরা, দাদা বাড়ি নেই বলে কিছুটা ছন্নছাড়া, সে বোঝে। ছোটকাকা হয়তো এখন বিগ্রহের সেবায় ঠাকুরঘরে ঢুকে গেছেন। মা বিগ্রহের পূজার আয়োজনে ব্যস্ত। কাকিমা রান্নাঘরে। হালের বলদ দুটিকে বিধুদা খড় কেটে দিচ্ছে। বৈঠকখানা ফাঁকা। তার পড়ার টেবিল—চেয়ার ফাঁকা। বই, খাতাপত্র কিছুই পড়ে নেই। গৃহশিক্ষক সমতুল সার ছুটিতে দেশে গেছেন। ফিরে এলে তিনি একাই রাতে বৈঠকখানায় শোবেন। মাথার কাছে একটা হারিকেন জ্বলবে। বাড়ি থেকে কেউ চলে গেলে কতটা ফাঁকা লাগে গৃহশিক্ষক ফিরে এলে ঠিক টের পাবেন। সে রাতে বৈঠকখানায় শুত। একটা তক্তপোশে সমতুল সার। পাশের তক্তপোশে সে। সামনের জানলা খুলে দিলে গরমেও ঠান্ডা হাওয়া উঠে আসত গোপাট থেকে।
এখন থেকে সমতুল সার তার ভাই—বোনদের নিয়ে তক্তপোশেই হয়তো গোল হয়ে বসবেন। মাইনর স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক সমতুল সার তাদের বাড়িতেই থাকেন, খান। তাদের পড়াশোনার সব দায়িত্ব তাঁর। সে নেই। সে আর সন্ধ্যায় হারিকেন জ্বেলে বৈঠকখানায় সারের সামনে গিয়ে পড়ার জন্য বসতে পারবে না।
স্টিমারে উঠে এই সব অতি—তুচ্ছ ঘটনাই এত বেশি তাকে পীড়া দিচ্ছে যে সে আশরাফ মিঞার সঙ্গে দেখা করার কোনও উৎসাহই পাচ্ছে না।
আশরাফ মিঞা কখন তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, সে টের পায়নি। বাবা তার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই গেলি না, আশরাফ নিজেই উঠে এসেছে।
আপনারা এখানে!
অরু আর কী করে!
সে নদীর দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারল না। বাবার সেই অসামান্য মানুষটি তাদের খোঁজে ডেক—ছাদে চলে এসেছে। সে পেছন ফিরে তাকাতেই আশরাফ বলল, কী—গ কর্তা, মন ব্যাজার কেন এত! মানুষ কি কখনও এক জায়গায় থাকে! পড়ালিখা করতে যাচ্ছেন, কত সুখবর বোঝেন না! ব্যাজার মুখে দাঁড়িয়ে থাকলে হয়? বড় হয়েছেন না!
অরু দেখল, লুঙ্গি পরে ফতুয়া—গায়ে লোকটি প্রায় আত্মীয়ের মতো কথা বলছে। তাকে আশ্বস্ত করছে, বাড়ির খবর ইচ্ছে করলে রোজই পেয়ে যাবেন। মা—র জন্য মন খারাপ করবেন না। রোজ না পারি, এক—দু’দিন অন্তর বাড়ির খবর দিয়ে আসব। আসেন আমার সঙ্গে। স্টিমারটা ঘুরে দ্যাখেন—কত মজা আছে ইঞ্জিন—ঘরে ঢুকলে বুঝতে পারবেন।
আশরাফ তাকে নিয়ে আপার ডেক থেকে লোয়ার ডেকে নেমে গেল। জগদীশ সঙ্গে গেলেন না—আশরাফ দেশের লোক, সে নদীতে স্টিমার চালায় বলে কর্মস্থল যেতে আসতে নানা সুবিধাও থাকে। আশরাফের সঙ্গে তাঁর খুবই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক—একটাই মুশকিল, আশরাফের আদর—আপ্যায়ন একটু বেশি মাত্রায়—যেমন সে আলাদা বন্দোবস্ত করে জগদীশকে খাওয়াতে চায়। লস্করদের একজন জগদীশের স্বজাতি—সেই আসন পেতে চিঁড়ে—মুড়ি অথবা দই দিয়ে ফলারের বন্দোবস্ত করে দেয়। এতে জগদীশ যে খুবই বিব্রত বোধ করেন, আশরাফ কিছুতেই বুঝতে চায় না। স্টিমারে আশরাফের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার এই একটা বিড়ম্বনা আছে। যাত্রীবোঝাই স্টিমারটিতে পা ফেলার জায়গা থাকে না। যে যেখানে পারছে আসন পেতে বসে থাকে। দূরের যাত্রীরা বিছানাপত্রও তুলে আনে। তিনি একা থাকলে আশরাফের কেবিনের দিকে সহজে পা মাড়ান না। যতটা পারেন আশরাফকে এড়িয়ে চলেন।
কিন্তু এবারে কী যে মনে হল তাঁর, অরুকে নিয়ে যাচ্ছেন, আশরাফের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা খুবই জরুরি। এই ভেবেই তিনি লোয়ার ডেক ধরে ইঞ্জিন—রুম পার হয়ে কেবিনে ঢুকে গেছিলেন। অরু তখন দৌড়ে কোথায় যে সিঁড়ি ধরে উঠে গিয়েছিল!
পরে ডেক—ছাদে খুঁজে পেলে তাকে নিয়ে যেতে চাইলেন, অথচ অরু কিছুতেই গা করল না। আশরাফ মনে মনে কী না ভাবল!
তিনি আর ডেক—ছাদ থেকে নামলেন না। আসন পেতে বসে থাকলেন। জায়গাটি নিষিদ্ধ এলাকা হলেও তার এখানে বসে থাকতে অসুবিধা হয় না। হুইল—ঘরের লোকটিও জানে কর্তার সঙ্গে আশরাফ সারেঙের দোস্তি আছে।
পাঁচুডাঙ্গার পাশ দিয়ে স্টিমার যাচ্ছে। এখানকার পাটালি গুড়ের সুখ্যাতি আছে খুব। আশরাফ মাঝে মাঝে তার কাছারিবাড়িতে পাটালি গুড়ও ভালো পেলে দিয়ে আসে। এমনকি স্টিমার ছাড়তে দেরি থাকলে আশরাফ তাঁর সঙ্গে কাছারিবাড়িতে দেখা করেও যায়। সেই আশরাফ এখনও ফিরছে না অরুকে নিয়ে। স্টিমারে বসে থাকলে ঘরবাড়ি, গাছপালা, মানুষজন কেমন আলগা হয়ে যায়, মাঝে মাঝে মনে হয় সম্পর্ক সব শিথিল হয়ে যাচ্ছে, উদাস লাগে। তিনি নিজেও তখন ভালো থাকেন না।
তিনি জানেন, অরুর অজস্র কৌতূহল, একবার যদি আশরাফের আশকারা পেয়ে যায়, তবে তাকেই হয়তো শেষ পর্যন্ত নিচে নেমে যেতে হবে অরুকে খুঁজতে। কাছারিবাড়ি পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে, আহারের বন্দোবস্ত বলতে চিঁড়াগুড়, কিছু মুড়কি এবং মোয়া জলে ভিজিয়ে খাওয়া। রাতে কখন পাত পড়বে, যদিও বড় শরিকের তরফের বউঠান জানেন, অরু আসছে। শুধু বউঠান কেন, বড় শরিক দেবকুমারবাবুর অনুমতি না পেলে তিনি অরুকে নিয়ে সেখানে তুলতে পারতেন না। তিনিই আশ্বাস দিয়েছেন, দেশে পড়ার বন্দোবস্ত করতে না পারো এখানে নিয়ে চলে এসো। তোমার সঙ্গেই না—হয় থাকবে। থাকা—খাওয়ার যখন কোনও অসুবিধা নেই, তুমি এত সঙ্কোচ করছ কেন, জগদীশ বুঝছি না।
নদী এখানে তার কিছুটা বিস্তার হারিয়েছে।
দু’পাড়ের গ্রাম মাঠ ঘরবাড়ি ফেলে স্টিমার এগিয়ে যাচ্ছে।
গোপালদির ঘাটে কিছু যাত্রী নামিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে, স্টিমারে ভিড় এখন বেশ হালকা। এরপর আসমানদির চরে যাত্রী নেমে যাবে। নবিনগর পার হলেই আর ঘণ্টাখানেকের পথ। এই নদীনালায় বেষ্টিত দেশটির জন্য জগদীশ খুবই গর্ববোধ করেন। অরুকে সঙ্গে নিয়ে তিনি যাত্রা করেছিলেন, দুশ্চিন্তাও আছে, অরুর শেষ পর্যন্ত মন টিকলে হয়! তবে আশরাফের জিম্মায় চলে যাওয়ায় তিনি যেন কিছুটা নিশ্চিন্ত। যেমন একবার অরু ডেকে গেল, বাবা, আশরাফ চাচা গোপালদির ঘাট থেকে দই—মিষ্টি আনিয়েছে। অরুর সঙ্গে উদ্ধবও হাজির। কলাপাতায় দই চিঁড়া মুড়ি সযত্নে রেখে বলেছে, আপনি খেতে বসেন কর্তা। বেলা তো পড়ে আসছে। ইস, আশরাফ যে কী করে! মোয়া মুড়ি চিঁড়া সবই অরুর মা পুঁটুলিতে দিয়েছে। কী যে করে না আশরাফ!
কে শোনে কার কথা! আশরাফও ওপরে উঠে এসেছে। তার কাজ—কাম মেলা জাহাজে। ইচ্ছে করলেই সে সব সময় হাজির থাকতে পারে না। জগদীশ কিছু বলতেও পারেন না। ডেক—ছাদে আসন পেতে ফলার খাওয়ার মজাও কম না। অরু খেয়েছে কি না জানে না। আশরাফ সামনে হাজির। অরুকে জিজ্ঞেসও করতে পারছে না সে খেয়েছে কি না। বললে যেন আশরাফকে ছোট করা হবে।
জগদীশ গণ্ডূষ করে কলাপাতার চারপাশে জল ছিটিয়ে দেওয়ার সময় বললেন, তোমাদের খাওয়া হয়ে গেছে আশরাফ!
কর্তা আহারপর্বটি আপনার সারা না—হলে মুখে দানাপানি দিই কী করে।
জগদীশ বললেন, এই ভয়েই তোমার স্টিমারে উঠি না আশরাফ। উঠলেও গা ঢাকা দিয়ে থাকি। দশ ক্রোশ হেঁটেই ছুটি পেলে দেশে চলে যাই। কাজ—কাম ফেলে আমাকে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়লে চলে!
আপনি খান তো!
অরু বলল, ক্ষীরের চমচম দারুণ। পাতক্ষীরও খেয়েছি। হাঁড়িতে কলাপাতায় বেঁধে দিয়েছে বাকিটা।
গোপালদির পাতক্ষীরের খ্যাতি আছে খুব। ক্ষীরের চমচমেরও। আশরাফ অরুকে এমন সুস্বাদু খাবার না খাইয়ে ছাড়ে কী করে! শুধু খাইয়েই তৃপ্তি নেই তার, সঙ্গে ক্ষীরের চমচম, পাতক্ষীর হাঁড়িতে আলাদা কলাপাতায় বেঁধে দিয়েছে। গোপালদির ঘাটে স্টিমার ভিড়ল, অথচ অরুকে তা খাওয়ানো গেল না, আশরাফের মতো মানুষ তা মানতে রাজি না। আশরাফ যে এককালে পিতাঠাকুরের আমলে তাদের বাড়িতেই মানুষ হয়েছে—অরু সে খবরও রাখে না। অনাথ আশরাফ বৈঠকখানায় থাকত, জগদীশ আর সে একই সঙ্গে বড় হয়েছে, আশরাফ তারপর কিছুদিন নিখোঁজ হয়ে থাকল, পিতাঠাকুর বেঁচে থাকতে নিখোঁজ আশরাফ একবার দেখা করেও গেল, কারণ পিতাঠাকুর, আশরাফ না বলে না কয়ে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ায় বড়ই আন্তরে পড়ে গিয়েছিলেন, খোঁজাখুঁজিও কম হয়নি। শেষে পিতাঠাকুর হাল ছেড়ে দিয়ে একদিন কেন যে বলে ফেললেন, বেইমান। দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছিলাম। ছোবল মেরে পালিয়েছে।
সেই আশরাফ যখন ফিরে এল তখন তাকে চেনাই যায় না। বাবরি চুল, পাজামা পাঞ্জাবি পরনে, পায়ে রাবারের জুতো, বাড়ি ঢুকেই হাঁকডাক, জ্যাঠাবাবা। কোথায়! অরু তখন হয়নি। সবে জগদীশের বিয়ে দিয়েছেন, কল্যাণীকে বালিকাই বলা চলে, একজন অপরিচিত লোকের ভেতর বাড়িতে ঢুকে যাওয়ায়, কিছুটা কল্যাণী বিরক্তও হয়নি বলা যায় না, সেই ডেকে বলেছিল, বাবা একটা লোক উঠোনে দাঁড়িয়ে কাকে জ্যাঠাবাবা জ্যাঠাবাবা করছে।
পিতাঠাকুর ঠাকুরঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখতেই, কেমন আহ্লাদে পূজা—আর্চার কথা ভুলে বাইরে বের হয়ে বলেছিলেন, তুই, তুই আশরাফ না।
জি!
জি তোমার বের করছি। বেরো বাড়ি থেকে। বেরো—বলছি। বলা নেই কওয়া নেই, চলে গেলি! তুই কিরে।
তারপর যা হয়, পিতাঠাকুর কেঁদে ফেলেছিলেন, ঠাকুর তুমি আমার মুখ রক্ষা করেছ। আশরাফ আবার ফিরে এসেছে।
জগদীশের জননী পুকুরঘাট থেকে ছুটে এসেছিলেন, আশরাফ ফিরে এসেছে। তারপর যা হয়, আশরাফের উপর কড়া হুকুম জারি হয়ে গিয়েছিল, বাড়ি থেকে না বলে কয়ে বের হলে ঠ্যাঙ ভেঙে দেওয়া হবে।
আশরাফ হাসতে হাসতে বলেছিল, জ্যাঠাবাবা আমার কাজ ফেলে থাকি কী করে। বাড়ি থেকে বের হতে না দিলে আমার মনিব মানবে কেন! কিছু একটা করে খেতে হবে বলেই বের হয়ে গেছি। লসকরের কাজ নিয়েছি জানতে পারলে তখনই যে খড়মপেটা করতেন। আমার কী দোষ বলেন!
আশরাফের কাজ হয়েছে শুনে পিতাঠাকুর কিছুক্ষণ গুম মেরে বসেছিলেন। তারপর বলেছিলেন, এলি যখন, দুটো দিন থেকে যা। তুই না থাকায় বাড়িটা আমার কত খালি হয়ে গেছে বুঝবি না আশরাফ!
আশরাফ জ্যাঠাবাবার কথা ফেলে কী করে! সে থেকে গেল। পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরল, পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে গেল, দোয়া ভিক্ষা করল, এবং সে যে একসময় বাড়ির ভালোমন্দের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল, বাড়িটা ঘুরে ঘুরে সব ঠিক আছে কিনা দেখতে গিয়ে না বলে পারল না, ঘাটের জামগাছটা নেই কেন?
ঝড়ে পড়ে গেছে।
গোপাটের জমিতে তামাকপাতার চাষ বন্ধ কেন?
কে করবে! কে এত খাটবে।
বাগানের সব বাঁশ দেখছি সাফ হয়ে গেছে।
বিক্রি করে দেওয়া হল। অজন্মার বছরে বাঁশ আর রাখা গেল না। সংসার চলবে কী করে! খাব কী দিয়ে!
পুকুরপাড়ের কয়েতবেল গাছটাও নেই?
সেবার প্লাবন হল, জলে ডুবে গেল পুকুরপাড়। গাছটা মরে গেল।
আশরাফ যে বাড়িরই একজন, হম্বিতম্বি করতে ছাড়ল না। বিধুভূষণকে বলল, বিধু তুই যখন তখন গামছা পেতে শুয়ে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমাস, গোরুর খোঁটা পালটাস না, তোকে রেখে হবেটা কী!
জগদীশের সবই মনে পড়ছিল—কিঞ্চিৎ ম্রিয়মাণ তিনি। তবু কেন যে তাঁর মুখে সামান্য হাসি ফুটে উঠল। কোথাকার আশরাফ এককালে তাদের বাড়ি এসে উঠেছিল, সেই আশরাফ স্টিমার চালিয়ে নদী ধরে কতদূরে চলে যায়, বন্দরের কাছে নদীর পাড়ে বাড়িও করেছে, আশরাফের সংসার হয়ে যাওয়ায় সে আর দু ক্রোশ হেঁটে বারদীতে নেমে তাঁর বাড়ির সঙ্গে কোনোই যোগাযোগ রাখতে পারে না—দেখা হলে আপ্যায়নের শেষ থাকে না—বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় অথবা তিনি দু ক্রোশ রাস্তা ধরে অরুকে নিয়ে যে হেঁটে এলেন, একবারও কেন যে আশরাফের কথা মনে হয়নি ভেবেই হেসে দিয়েছেন। ম্রিয়মাণ হাসি—আশরাফ ঠিকই বলেছে, এক জায়গায় কেউ থাকে না।
অরু হয়তো নিজের মতো একদিন তার পৃথিবীটাকে খুঁজে নেবে। বাড়ির সঙ্গে সেও তার নাড়ির সম্পর্ক হারিয়ে ফেলতে পারে। স্টিমারে সে যে তাঁর সঙ্গে দূরদেশে যাচ্ছে কে বলবে? সারাটা দিন স্টিমারের এ—মাথা ও—মাথায় দৌড়াচ্ছে। লাফালাফিরও শেষ নেই। রেলিং—এ ভর দিয়ে সিঁড়ি ধরে আপার—ডেকে উঠে গেছে। আবার লোয়ার—ডেকে নেমে গেছে। তার বাবা স্টিমারে আছে, না তাকে ফেলে নেমে গেছে, নেমে যেতেই পারেন, ভুলভাল তো মানুষেরই হয়, অরুর সে ব্যাপারে কোনোই ভ্রূক্ষেপ নেই। জগদীশ অরুকে নিয়ে যতটা দুশ্চিন্তায় ছিলেন এমনকি, হাঁটাপথে তাকে যতটা ক্লান্ত দেখাচ্ছিল, এখন দেখলে মনে হয় না সে ক্লান্ত। আশরাফ কিছুতেই অরুকে তার কেবিনে নিয়ে যেতে পারেনি। কেবিনের বাঙ্কে ইচ্ছে করলেই গড়াগড়ি দিতে পারত, অন্তত আর কিছু না হোক, অরুর বিশ্রাম হত কিছুটা, অরু ওর কেবিনে ঢুকেছে, বাঙ্কে শুয়ে ঘুমিয়ে নিতে বললে, সে আবার লাফিয়ে বের হয়ে এসেছে। কখনও বিশাল চিমনিটার পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছে চুপচাপ, অথবা ইঞ্জিন রুমে যে লোকটা কয়লা মারছিল বয়লারে তার বলিষ্ঠ শরীর এবং আগুনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে লোকটা, সোজা কথা—সে কিছুতেই তার পাশ থেকে সরে আসতে চাইছিল না।
একসময় মদনগঞ্জ ঘাটও চোখে ভেসে উঠল দূর থেকে।
সেখানে একটিমাত্র থামের উপর বড় গ্যাসবাতি জ্বালিয়ে রাখা হয়। রাতে সেই গ্যাসবাতির আলোতে স্টিমারটা চিনতে পারে, কাছে এসে গেছে মদনগঞ্জের ঘাট।
নদীর দু—পাড়ে অন্ধকারে টিমটিম করে আলো জ্বলছে। কোথাও কুপির আলো, কোথাও বা হারিকেনের আলো। মদনগঞ্জের সড়ক ধরে মানুষজন যে হেঁটে যাচ্ছে বোঝা যায়। লোকজন রাস্তায় বের হলে সঙ্গে হয় টর্চবাতি, না হয় হারিকেন হাতে রাখে। অন্ধকারে গাছপালার ছায়ায় রাস্তার কিছুই দেখা যায় না। সড়কের সুরকির রাস্তা বড়ই এবড়োখেবড়ো। বাবুদের প্রাসাদ এখনও চোখে পড়ছে না—স্টিমার তার গতি কমিয়ে দিয়েছে। এতক্ষণ পুবের দিকে মুখ ছিল স্টিমারের এখন তার মুখ উত্তরদিকে ঘুরে গেছে। শান বাঁধানো নদীর পাড়ে স্টিমারটা এবার ভিড়বে।
আলোগুলো জ্বালিয়ে দিতেই মনে হল জগদীশের একটা জ্যান্ত শহর হয়ে গেছে যেন স্টিমারটা। উজ্জ্বল আলোর নিচে যাত্রীরা তাদের লটবহর গুছিয়ে নিচ্ছে। অরু যে কোথায়! এবার তো নামতে হবে।
তিনি ব্যস্ত হয়ে অরুকে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিলেন। আশরাফ বোধহয় নোঙরের ঘরে ঢুকে গেছে। তার দায় মেলা। সে যে কেবিনে নেই জগদীশ জানেন। আর তা ছাড়া আশরাফ খুবই ব্যস্ত মানুষ, তাকে অরু সম্পর্কে কোনও কথা বলতেও সঙ্কোচ হচ্ছিল। স্টিমারের এদিকটায় মুরগির মাংসের গন্ধ উঠছে। স্টিমারে উঠলে তার কেন জানি গন্ধটা সহ্য হয় না। লোয়ার ডেকের শেষ দিকটায় তিনি সেজন্য কখনই যান না। ইলিশ মাছের ঝোল ভাত প্লেটে করে নিয়ে যাচ্ছে কেউ। কোনওরকমে নাকে রুমাল দিয়ে কিচেনের দিকটা পার হয়ে গেলেন। যদি কৌতূহল বশে অরু গেরাফি ফেলার ঘরটার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। না সেখানেও নেই। কিছুটা সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন—তারপর না পেরে ফরোয়ার্ড পিকে উঠে গেলেন। যেখানটায় স্টিমারের সার্চলাইট নদীর জল ঘেঁষে দূরে চলে গেছে, অবাক হয়ে দেখলেন, সার্চলাইটের ঠিক নিচে অরু দাঁড়িয়ে আছে। নদীর বুকে আলো পড়ে যে রহস্য তৈরি হয়েছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাই দেখছে অরু।
এই উজ্জ্বল আলোর উৎস অরু জীবনেও প্রত্যক্ষ করেনি। সার্চলাইটের আলোতে নদীর পাড়, গাছপালার সব যেন ভেসে যাচ্ছে। অজস্র পাখি ওড়াউড়ি করছিল এবং কোথাও কোনও গাছের ডাল থেকে একঝাঁক বাদুড় উড়ে গিয়ে ঘুরে ঘুরে গাছটা প্রদক্ষিণ করছে। ইঞ্জিন বন্ধ করে দেওয়ায় বাদুড়ের কিচমিচ শব্দ পর্যন্ত শোনা যাচ্ছিল। ঘাটে মানুষের ভিড়। আলোতে সব কিছু এত বেশি উদ্ভাসিত হয়ে আছে যে অরু নড়তে পারছিল না।
এই অরু!
হুঁ।
চল, আমাদের নামতে হবে।
অরু যেন কিছুটা ঘোরে পড়ে গেছে। সে দাঁড়িয়েই আছে।
জগদীশ বোঝেন, জীবনের এই সব নতুন অভিজ্ঞতায় অরু কিছুটা বোধহয় ধন্দে পড়ে গেছে। সে ভাবতে পারে এমন আশ্চর্য এক গ্রহের খোঁজ স্টিমারে না এলে পেত না।
জগদীশ টের পেল গেরাফি নেমে যাচ্ছে। গড় গড় করে অতিকায় গেরাফিটা জলের অতলে নেমে যাচ্ছে। মোটা রশি দিয়ে পাটাতনের থামের সঙ্গে বেঁধে ফেলা হচ্ছে স্টিমারটিকে। যাত্রীদের ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেছে। অরুর কিছুতেই হুঁশ ফিরে আসছে না যেন!
সবাই নেমে যাচ্ছে। অরু বলল।
আমরা নামব! হ্যাঁ। এতক্ষণ কী বলছি তোমাকে।
অরুর মধ্যে আবার সেই বিষণ্ণতা, সে যেন কিছুতেই উৎসাহ পাচ্ছে না। প্রায় জোর করেই ধরে নিয়ে যাচ্ছেন জগদীশ, আশরাফকে এই সময় খোঁজা অর্থহীন—কোনওরকমে নেমে যাওয়া দরকার। টিনের স্যুটকেস, মিষ্টির হাঁড়ি এক হাতে, অন্য হাতে অরুকে ধরে রেখেছেন। পাড়ে লেগে গেলে স্টিমারটা দুলে উঠল। জগদীশ নিজেকে সামলে, অরুকে সামলে নেমে যাচ্ছেন, তখনই দেখলেন আশরাফ ছুটে আসছে। অরুকে বলল, সাবধানে নামবেন। বাবার কথা শোনবেন। বাড়ি ছেড়ে বিদেশ—বিভুঁইয়ে পড়াশোনা করতে চলে এলেন—তারপর বড় হয়ে দূরদেশে যখন যাবেন, আমারে সঙ্গে নিবেন, মন খারাপ করলে চলে! কেউ তো এক জায়গায় থাকে না।
অরু কিছু না বলে শুধু হাত তুলে দিল।