নামে ও কাজে উত্তম
আমি তাঁর ছবি দেখতে শুরু করেছি তাঁর মৃত্যুর পর কলকাতা দূরদর্শনের মাধ্যমে। প্রতি বছর জুলাই আর সেপ্টেম্বর মাসে এক সপ্তাহ ব্যাপী তাঁর ছবি দেখতাম।তাঁর ছবিতেই তাকে চিনেছি। মৃত্যুর ৪১ বছর পরেও তাঁকে নিয়ে সবাই উত্তেজিত। তিনি রয়েছেন সবার উপরে। তাঁর কথা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ব্যাপী।
উৎপলা সেন ও সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তার হৃদ্যতার সম্পর্ক।দুজনেই তার পরম শ্রদ্ধা ভাজন। মহানায়ক প্রায়দিন রাতে শুটিং শেষে ফোন করতেন তাঁর উৎপলাদিকে ।দিদিও ভাইএর আবদার শোনার অপেক্ষায় থাকতেন। ভাই বলতেন “দিদি আমার প্রিয় গানটা একটু শুনতে চাই।”তখনই খালি গলায় “আমি তোমায় ছাড়া আর কিছু হায় ভাবতে পারি না যে’ এই গানটি দিদি গেয়ে শোনাতেন তাঁর স্নেহের ভাইকে।
তাঁর অত্যন্ত প্রিয় সতীনাথদা বেসিক গান বেশি পছন্দ করতেন ।মহানায়ক সৃষ্ট শিল্পী সংসদের প্রযোজনায় বনপলাশীর পদাবলী ছায়াছবিটিতে মহানায়কের অনুরোধে সতীনাথ মুখোপাধ্যায় দুটি গানের সুর দিয়েছিলেন ।
যেহেতু মহানায়ক সতীনাথ মুখোপাধ্যায়কে ভাইস প্রেসিডেনট করেছিলেন শিল্পী সংসদের এবং নিজে ছিলেন প্রেসিডেন্ট।
ঠিক হয় কোন এক রবিবার স্টুডিওতে বনপলাশীর পদাবলী ছায়াছবির দুটি গান রেকর্ডিং হবে উৎপলার কন্ঠে “বহুদিন পরে ভ্রমর এসেছে পদ্মবনে” আর সতীনাথের কন্ঠে ” এই তো ভবের খেলা”
সেদিন সকালে উৎপলা সতীনাথ, যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পীরা এবং মহানায়ক উত্তম কুমার নিজে সময়মতো টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে পৌঁছে গেছেন।
স্টুডিওতে সবাই অপেক্ষা করছেন রেকর্ডিস্ট সত্যেন চ্যাটার্জির জন্য। এমন সময় খবর এলো উনি অসুস্থ আসতে পারছেন না। সুতরাং সেদিনের রেকর্ডিং বাতিল করতে হবে ।চিন্তায় পড়লেন সবাই। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়কে সমস্ত নোটেশন তুলে রাখতে দেখে মহানায়ক বললেন “সতীনাথদা, আপনি সব রেডি করুন আজ রেকর্ডিং হবে আমি ব্যবস্থা করছি” প্রথমে উৎপলা গাইবেন তারপর সতীনাথ। উৎপলা মনে মনে বেশ চিন্তিত নতুন রেকর্ডিস্টের হাত কেমন হবে জানা নেই। কন্ঠস্বর ঠিক যদি না আসে গান কেমন শোনাবে। খানিকক্ষণ পর উওমকুমার বললেন ” উৎপলাদি রেকর্ডিস্ট রেডি তুমি নিশ্চিন্তে গান শুরু করে দাও”. কোন রেকর্ডিস্ট এলেন দেখতে উৎপলা একরাশ টেনশন নিয়ে তাকাতেই ওঁনার চক্ষুস্থির….এতো তার পরিচিত। তাঁর অত্যন্ত প্রিয় স্নেহের ভাই উত্তমকুমার নিজেই রেকর্ডিস্টের আসনে। অসম্ভব দক্ষতা এবং ধৈর্যের সাথে গান দুটি রেকর্ড করেছিলেন মহানায়ক নিজে …যেটা আমরা ছায়াছবিতে বহুবার শুনেছি। তাই বলতেই হয় যিনি প্রকৃত শিল্পী তিনি শিল্পের মধ্যে দিয়ে সর্বদা তার প্রতিভা ছড়িয়ে যান আর তার বিনিময়ে কোনো বাহবা বা প্রশংসাও আশা করেন না। মহানায়ক তোমাকে জানাই শতকোটি প্রণাম।
১৯৬৭ সালের ১৬ই এপ্রিল উত্তমকুমার হৃদরোগে আক্রান্ত হন । সেই সময় ইনটেনসিভ কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিটের কোনো অস্তিত্ব ছিলনা কলকাতায় । ১৯৭১ সালে বেলভিউ নার্সিং হোমে কলকাতার প্রথম আই সি ইউ ওয়ার্ড চালু হয় ।
প্রথমবার হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার কিছুদিন পরেই সুস্থ হয়ে উঠে পুরোপুরি ভাবে কাজের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন । তিনি ভাবতেই চাইলেন না যে তাঁর কোনো গুরুতর অসুখ শরীরে বাসা বেঁধেছে।সেই সময় কাজ যেন তাঁকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল।
১৯৮০ সালের ১৭ ই জুলাই, উত্তমকুমারের মৃত্যু ঘন্টা শুনতে পেয়েছিলেন ডাক্তার সেন । বম্বেতে ‘ দেশপ্রেমী ‘ ছবির শুটিং করে কলকাতায় ফিরে মহানায়ক তাঁর ইংরেজি শিক্ষককে দেখাতে নিয়ে আসেন বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা সুনীল সেনের কাছে ।শিক্ষককে দেখবার পর ডঃ সেন উত্তমকুমারকে ক্যাজুয়ালি চেক করতে গিয়ে চমকে ওঠেন । ডাক্তার বলেন : আপনার গ্যালপ হচ্ছে । আপনি এখুনি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যান । উত্তমকুমার রাজিও হয়ে গেলেন কিন্তু বাড়িতে ফেরবার পর মত পাল্টে ফেলেন । জানালেন, পয়লা আগস্টের আগে ভর্তি হতে পারবেন না ।
এলো সেই ভয়ঙ্কর রাত । ২৩ শে জুলাই, ১৯৮০ সাল। ২৩ শে জুলাই শুটিংয়ের পরে বাড়ি ফিরে বলেছিলেন আমার শরীর খারাপ । হয়তো আর বাঁচব না । জিজ্ঞেস করা হয় ডাক্তার সেনকে , তাঁকে কী সত্যি আর কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখা যেতনা ? ডাক্তার সেনের অভিমত হল , উত্তমকুমার তাঁর ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি পরিশ্রম করতেন । ‘ওগো বধূ সুন্দরী ‘ ছবিতে শুটিংয়ের সময় তাঁর শরীর খারাপ হয় । তা সত্ত্বেও রাতের পার্টিতে যোগ দিতে যান ।
তারপর মাঝরাতে ডাক্তার সেন এসে দেখলেন সারা শরীর দিয়ে জলের বন্যা বইছে ।জ্ঞান ছিল শেষ পর্যন্ত । হাতটা ধরে বারবার বলেছেন : সুনীলদা, আমায় ছেড়ে চলে যাবেন না । লাস্ট ডেট অবধি আমি কাজ করে যাব । ডাঃ দেখলেন ম্যাসিভ অ্যাটাক। বেলভিউ নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয় রাত পৌনে তিনটের সময় । পরের দিন প্রসাবও বন্ধ হয়ে গেল। জ্ঞান ছিল শেষ পর্যন্ত । চলে গেলেন রাজার মতো ২৪ শে জুলাই ১৯৮০ সাল।