নামাবলী
প্রথমে নাম ছিল কালাচাঁদ হুই। সবাই কালাচাঁদ নামেই ডাকত। কাছাকাছি নিকটজন, পাড়াপ্রতিবেশী অবশ্য বলত কালু, কেউ কেউ আদর করে কেলো।
গুছাইতগঞ্জের নয়নচাঁদ হুইয়ের একমাত্র ছেলে কালাচাঁদ। সাত মেয়ের মধ্যে একমাত্র ছেলে। সাত ভাই চম্পার ঠিক উলটো আর কি! সাত ভাই চম্পা এক বোন পারুল না হয়ে এক ভাই চম্পা সাত বোন পারুল।
পারুল বোনেদের যথাসময়ে যথাস্থানে বিয়ে হয়ে গেছে। তাদের নিয়ে আমাদের কোনও চিন্তার কারণ নেই।
আমাদের এই গল্পে সমস্ত সমস্যা ওই এক ভাই চম্পা কালাচাঁদ হুইকে নিয়ে।
নয়নচাঁদের উপযুক্ত সন্তান কালাচাঁদ। গুছাইতগঞ্জের হুইবংশের নয়নমণি, শিবরাত্রির সলতে কালাচাঁদ হুই তার এই সাদামাটা নাম নিয়ে জীবনের প্রথম সতেরো আঠারোটা বছর বেশ নির্বিবাদেই অতিবাহিত করেছিল।
নামের মধ্যে যে কোনও রকম নতুন-পুরনো, খারাপ-ভাল থাকতে পারে এ ধারণা কালাচাঁদের মাথায় ঢোকেনি ওই আঠারো বছর বয়েস পর্যন্ত।
মুশকিল হল কলেজে ভরতি হয়ে। গুছাইতগঞ্জ হাইস্কুলে কেই বা মাথা ঘামিয়েছে কালাচাঁদের নাম নিয়ে, আর যারা মাথা ঘামাবে তাদের নামেরই বা কী ছিরি। যজ্ঞলাল অথবা গজেশ্বর কী করে বুঝতে পারবে কালাচাঁদ নামটা তাদের থেকে খারাপ, না ভাল।
গুছাইতগঞ্জের লোকেদের নাম প্রায় সকলেরই এই রকম। হেডমাস্টারমশায় ধনুকনাথ কাঞ্জিলাল আর পঞ্চায়েত সভাপতি ভাবল পাল মশায়ের নাম দুটো শুনলেই বাকি আপামর গুছায়েতগঞ্জবাসীর নাম সম্পর্কে মনে কোনও সংশয় থাকে না।
মাধ্যমিক পরীক্ষার বছর প্রিটেস্টের আগে শ্রাবণ মাসে কালাচাঁদ কলকাতায় মামার বাড়ি এসেছিল মামাতো বোনের বিয়েতে। সেখানে কালাচাঁদ হুই নামটা নিয়ে তাকে খুব ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। নব জামাতা অর্থাৎ মামাতো জামাইবাবুর সঙ্গে বাসরঘরে পরিচয় হতেই ঠাট্টা করে বলেছিলেন, এটা নিশ্চয় তোমার নাম নয়, তোমার নামের ওরফে। এরকম নাম তো ছদ্মনাম না হয়ে যায় না।
নতুন জামাইবাবুর এই মন্তব্য শুনে বাসরঘর-ভরতি ফাজিল মেয়েরা হই হই করে হেসে উঠেছিল। লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল কালাচাঁদ।
নতুন জামাই লোকটি খারাপ নয়। তার ওই মন্তব্যে এই গ্রাম্য, সরল ছেলেটি একটু আহত হয়েছে। এটা ভেবে সে পরদিন বাসিবিয়ের সকালে কালাচাঁদের সঙ্গে যেচে আলাপ করে। তারপর পরামর্শ দেয়, তুমি তো এখনও মাধ্যমিক পরীক্ষাই দাওনি। এখন তো নাম পাকাপাকি হয়নি। টেস্টের পরে। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফর্ম পূরণ করার সময় নিজের পছন্দমতো নাম বেছে বসিয়ে দিলেই হবে।
কথাটা খুব ভাল লেগেছিল কালাচাঁদের। তবে সে বুদ্ধিমান ছেলে বলে গুছাইতগঞ্জে গিয়ে নাম বদলানোর ব্যাপারটা নিয়ে কারও সঙ্গে কোনও আলোচনায় যায়নি।
যথাসময়ে টেস্টে অ্যালাউ হল কালাচাঁদ। কালাচাঁদ খারাপ ছাত্র নয়, ভালভাবেই অ্যালাউ হয়েছে। তারপর এল সেই মোক্ষম দিন, পরীক্ষার ফর্ম পূরণ করার দিন।
এই কয়েক মাস ধরে অনবরত ভেবেছে কালাচাঁদ। একা একাই ভেবেছে, কারও সঙ্গে পরামর্শ করার সাহস হয়নি। মাঝে মধ্যে অভিধানের পাতা খুলে উলটোপালটা নাম খুঁজেছে। স্কুলের অফিস ঘরে একটা পুরনো টেলিফোন ডিরেক্টরি আছে তার মধ্যে চোখ বুলিয়েছে। খবরের কাগজের আর ঢাউস শারদীয়া সংখ্যার সূচিপত্রে, তা ছাড়া যাত্রা-থিয়েটার আর সিনেমার রকমারি বিজ্ঞাপনে সে চোখ রেখেছে মনোমতো নামের জন্য।
কালাচাঁদের সামনে সবচেয়ে বড় সমস্যা, শুধু নামটাই পালটাবে না কি সেই সঙ্গে পদবিটাও। এখানে তার সংস্কারে বাধছে, চৌদ্দ পুরুষের পদবি, গুছাইতগঞ্জের বিখ্যাত হুইবংশের সে আপাতত শেষ বংশধর, হুই পদবিটার প্রতি তার দুর্বলতা অপরিসীম, রক্তের কণায় কণায়।
কিন্তু হুই-ফুই যে আজকের দিনে চলবে না সেটাও বোঝার মতো বুদ্ধি আছে কালাচাঁদের। অনেক রকম ভেবেচিন্তে অবশেষে সে সিদ্ধান্ত নিল–হয় এসপার নয় ওসপার, নাম পদবি দুইই বদল করবে।
এইবার শুরু হল আসল বিপদ। শুধু নাম নয়, নাম আর পদবি একসঙ্গে মিলেমিশে কত রকম সুন্দর নাম আছে।
প্রথমে দেখতে হবে ছোট নাম চাই, না বড় নাম। নাকি মোটামুটি মাঝারি সাইজের হলে ভাল হবে।
কত ভাল ভাল ছোট নাম হতে পারে–রবি দে, শক্তি দা, ইন্দু ঝা, বেনু সি। এগুলো যেন রেলগাড়ির জানলা দিয়ে দেখা টুকরো টুকরো ছবির মতো।
অন্যদিকে বড় নামগুলি রজতরঙ্গন বসু রায় চৌধুরী, গোপিজনবল্লভ পদরেণু উপাধ্যায় অথবা কৃষ্ণচন্দ্র হুই মজুমদার, কী অপূর্ব জমজমাট।
বলা বাহুল্য ওই শেষ নামটি কালাচাঁদের স্বকপোলকল্পিত, নিজের যোজনা। কালাচাঁদ থেকে সাধুভাষায় কৃষ্ণচন্দ্র আর হুইয়ের সঙ্গে মজুমদার দ্বন্দ্ব সমাস করে হুই মজুমদার।
এরপর বহুবিধ ভেবেচিন্তে কালাচাঁদ শেষ নামটির হুই অংশটি বাদ দিয়ে নিজের নাম কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার করার সিদ্ধান্ত মনে মনে গ্রহণ করল।
বিপদ হল ফর্ম জমা দেয়ার পরে। হেডমাস্টারমশাই ধনুকনাথবাবু নিজের হাতে একটার পর একটা ফর্ম মিলিয়ে নিচ্ছিলেন, কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার নামে এ ছেলেটি কোথা থেকে এল। গুছাইত। হাই স্কুলে মাত্র সাড়ে তিনশো ছাত্র, শুধু তাদের প্রত্যেকের নাম নয় তাদের বাপ ঠাকুরদা চৌদ্দপুরুষের নাম ধনুকনাথবাবুর জানা। সুতরাং কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার দেখেই তিনি হুংকার দিয়ে উঠলেন, এই কৃষ্ণচন্দ্র আবার কে এল?
ভয়ে ভয়ে কালাচাঁদ হেডমাস্টারমশায়ের কাছে গিয়ে হাতজোড় করে দাঁড়াল। হেডমাস্টারমশায় অবাক হয়ে কালাচাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলেন, কেউ যে স্বেচ্ছায় পিতৃদত্ত নাম পালটাতে পারে এরকম তিনি ভাবতেই পারেন না।
ধনুকনাথবাবুর বিস্ময়ের ভাবটা কাটতেই একটা ধমক দিলেন, তুমি কালাচাঁদ আবার কৃষ্ণচন্দ্র হলে কবে? আর সাতপুরুষের হুই উপাধিটা পালটে মজুমদার হয়ে গেল? ছিঃ ছিঃ তোমাদের এত নামকরা হুইবংশ! তুমি এত বড় কুলাঙ্গার হয়েছ তলে তলে! ছিঃ ছিঃ! তোমার বাবা কি জানেন?
এরপর হেডমাস্টারমশায় ফর্মের নীচে এক জায়গায় আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, এখানে যে গার্জিয়ানের স্বাক্ষর লাগবে, তোমার বাবা দেবেন সই এতে? আর মাধ্যমিক বোর্ড রাজি হবে কেন, হুইয়ের ছেলে মজুমদার, তারা তোমাকে পরীক্ষাই দিতে দেবে না। অ্যাডমিট কার্ড পাবে না।
ঘটনার আকস্মিকতায় এবং হেডমাস্টারমশায়ের ঝোড়ো বাক্যবাণে বিপর্যস্ত হয়ে কালাচাঁদ বিমর্ষচিত্তে কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার পরিত্যাগ করে পুনরায় কালাচাঁদ হুইয়ে ফিরে গেল।
এর কিছুদিন পরে পরীক্ষায় পাশ করে কালাচাঁদ জেলা সদরে এল গ্রাম থেকে। সেখানে বোর্ডিংয়ে থেকে কলেজে পড়াশুনা করবে।
কলেজে ভরতি হয়ে কালাচাঁদ হুই নামটা তার পদে পদে বাধা হয়ে দাঁড়াল। প্রথমদিন বাংলার অধ্যাপক রোল কল করার পর সবাইকে কোন স্কুল থেকে এসেছে এবং কার কী নাম বলতে বলল। যে মুহূর্তে সে দাঁড়িয়ে বলল, কালাচাঁদ হুই, গুছাইতগঞ্জ নকুলেশ্বর পাল মেমোরিয়াল হাই স্কুল সমস্ত ক্লাসে ছেলেমেয়েদের মধ্যে হাসির সোরগোল পড়ে গেল।
এরকম বিপদ কালাচাঁদের জীবনে বহুবার ঘটেছে। এর জন্যে সে মোটামুটি প্রস্তুত ছিল। কিন্তু এরপর সব সময় প্রায়ই ছোটখাটো উৎপাত লেগে রইল।
বোর্ডিংয়ে কালাচাঁদের ঘরের দরজায় কে যেন চকখড়ি দিয়ে লিখে রাখল,
কালাচাঁদ হুই
গুছাইতগঞ্জে ভুঁই
এই ঘরে শুই।
মনের দুঃখে কালাচাঁদ মাঝে মধ্যে বোর্ডিংবাড়ির দোতলার ছাদে উঠে একা একা পায়চারি করত। একদিন ছাদে উঠে ঘুরছে, শুনল, হেঁড়ে গলায় কে যেন সিঁড়ির ওপর থেকে গান গাইছে,
চলো যাই ছাদ
হুই কালাচাঁদ।
মনের দুঃখে কালাচাঁদ কলেজ ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাবে কি না ঠিক করতে যাচ্ছে এমন সময়ে তার সঙ্গে গোপাল দাস নামে এক সুবোধ যুবকের আলাপ হল। মামার বাড়িতে থেকে সেও কালাচাঁদের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে।
গোপালের মামা স্থানীয় আদালতের পেশকার। তিনি গোপালের মুখে কালাচাঁদের নির্যাতনের ঘটনা শুনে বললেন, এতে কী হয়েছে, আদালতে এফিডেবিট করে নাম বদলে নিলেই হয়। এই তো আমাদের নন্দ দলুই, সেদিন নাম পালটে সুনন্দ রায় হয়ে গেল। হামেশাই হচ্ছে।
গোপাল এসে কালাচাঁদকে এসব তথ্য জানাতে সে যেন সত্যিই হাতে চাঁদ পেল।
এর পরের ঘটনা অতি সংক্ষিপ্ত এবং সাদামাটা।
বাড়িতে কিংবা গ্রামের কাউকে কিছু না জানিয়ে গোপাল এবং গোপালের মামার সহযোগিতায় সে জেলা আদালতে এফিডেবিট করে নিজের নাম কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারে রূপান্তরিত করেছে।
গ্রামের লোকেরা কিছু জানে না। ছুটিছাটায় দেশের বাড়িতে গেলে এখনও তাকে গ্রামের লোকেরা কালাচাঁদ, কালু বা কেলে বলে ডাকে।
কখনও কখনও কালাচাঁদের সঙ্গে তাদের গ্রামে হিরন্ময় চৌধুরী নামে এক স্মার্ট, হাসিখুশি বন্ধুও যায়। গ্রামের লোকেরা তাকে হিরন্ময়বাবু বলে সম্বোধন করে।
তবে তার নাম কেউ না জানুক, আমরা জানি, এই হিরন্ময়বাবুই কালাচাঁদের ভাল বন্ধু গোপাল দাস। মামার সাহায্যে কালাচাঁদের সঙ্গে সেও এফিডেবিট করে নিজের নাম বদলে ফেলেছে।