০৬-১০. মরে গেলুম হুজুর
০৬.
ওঃ, মরে গেলুম হুজুর, আহ, আরেব্বাপ, অঁক, ছেড়ে দিন স্যার, আমি কিচ্ছু জানি না স্যার, উঃ বাপরে, আঃ, বাবাগো, আআআআঃ।
আদিত্যর জন্যে বহুক্ষণ অপেক্ষারত অরিন্দম অসুস্হ বোধ করছিল ক্রমশ, লকাপ থেকে ছিটকে-আসা আর্তচিৎকারে। বমি-বমি আসছিল। অরিন্দমের কাহিল প্রতিক্রিয়া উপভোগ করছিল টেবিলের ওদিকে মিটিমিটি তাগড়া ভুঁড়িদাস পুলিশ অফিসারটা, বোধয় সিআইডি ইন্সপেক্টার। অনেকবার এসেছে বলে মুখ-চেনা, বলল, আপনি বরং নিচে গিয়ে গেটের কাচে টাটকা হাওয়া নিন। আসলেই পাঠিয়ে দোবো।
অরিন্দম উঠে পড়ল ব্রিফকেস নিয়ে। অরিন্দমকে ওর অফিস থেকে দশ কুড়ি পঞ্চাশ একশো টাকার টাটকা প্যাকেট এনে দিতে বলেছিল আদিত্য। বোনের বিয়ের যৌতুক, তাই করকরে টাটকা নোট চাই, জানিয়েছিল আদিত্য। থোক টাকা থাকলে উঁচু জাতের ভালো চাকরে পাত্র পাওয়া সহজ, পাত্রী যে জাতেরই হোক না কেন। এই একগাদা টাকা নিয়ে বাড়ি যেতে চায় না অরিন্দম। মা, ছোটো ভাই বা তার বউ জেনে ফেললে কেলেঙ্কারি। পাটনায় থাকতে হঠাৎই একবার ও মাসকতকের জন্যে পাগল হয়ে গিসলো বলে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব।
গেটের কাছে দাঁড়িয়ে প্রায় ঘন্টাখানেক হয়ে গেল। পা ব্যথা করছিল। এই শহরের চতুর্দিকব্যাপী নিনাদে হারিয়ে যায় ব্যক্তিগত আর্তনাদ আর অসহায় কাতরানির ছোট্টো-ছোট্টো শব্দকণা। আক্রমণ আর আত্মরক্ষার জৈব ও যান্ত্রিক উপস্হিতি সারাটা শহরের চরাচর জুড়ে।
পুরুষকর্মীদের চাউনি রুমাল দিয়ে মুখের ওপর থেকে পুঁছতে-পুঁছতে বাড়ি ফিরছে আলগা চটকের গৃহবধু কেরানি। সঙ্গিনীর সাথে আলোচনার বিষয়বস্তু গণেশঠাকুরের শুঁড় ডানদিকে শুভ না বাঁদিকে। ক্ষীণস্বাস্হ্য সরকারি বাস চলে গেল, নাগরিক বোঝাই, ফোঁটার মতন মানুষ ফেলতে-ফেলতে, জিরোবে গিয়ে ঘণ্টাখানেকের জ্যামে। বাসে উঠলেই লোকে বসতে চায় এ শহরে, যুবকরাও, যাতে কাঁধে কাঁধ না মেলাতে হয়। কাঁধে কাঁধ কেবল ছাপার অক্ষরে।
দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে অভ্যাসমতন পথচারিণীদের ওপর চোখ বোলাচ্ছিল অপ্রস্তুত অরিন্দম। খিনখিনে ট্যাক্সির কাতার। ভেজাল ডিজেলের নাকজ্বালানো ধোঁয়া। ধোঁয়া-ধুলোয় মুখ ভার করে আছে ক্লান্ত আকাশ।
অফিসে আবার এলেন কেন অরিন্দমদা? পেছন ফিরে আদিত্যর থমথমে চেহারা দেখতে পেল অরিন্দম। মানুষকে নিজে হাতে পেটানোর আহ্লাদ থেকে, মুখের আনন্দময় প্রতিভা থেকেই বেশ বোঝা যাচ্ছে, আর কোনও দিন মুক্তি পাবে না আদিত্য। প্রতিনিয়ত ওর দরকার পড়বে প্রহারযোগ্য দেহ, সারাজীবন। রিটায়ার করলে কী করবে ও? ক্রিমিনাল ইনভেসটিগেশান বিভাগে চলে যেতে পেরেছে তার মানে, কাঠখড় পোড়াবার ব্যবস্হা করে।
তোমায় তো বাড়িতে পাওয়া যায় না।
তা নয়। এসব করকরে টাকাফাকা অফিসে রাখতে চাই না। দেখলেই তো হিংসে।
কোয়ার্টারে নিয়ে গিয়ে রেখে দাও। ছুটি তো? এখন?
কী যে বলেন না, এখনও কবুলতি লেখানো হয়নি। চলুন ওফুটে চায়ের দোকানটায় একটা ছেলে আছে আমাদের গ্রামের। ওর হাতে পাঠিয়ে দেব। আদিত্য বিব্রত বোধ করে অরিন্দমের সারল্যে। নোটগুলো কোথা থেকে এলো, বড়ো মাপের নোট কেন, কিছুইকি সন্দেহ করে না অরিন্দমদা? টিকে আছে কী ভাবে অমন অনর্থক বোকামি নিয়ে, এই মারিকাটারি সমাজে!
বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট ব্লকের ধর্মশিবপুর গাঁয়ে, অজয় নদের তীরে, আদিত্য বারিকের বাস্তুভিটে। ঝিলুট থেকে কাঁচা রাস্তা আছে গ্রামে যাবার, তৃণমূল-কংরেস-সিপিয়েম মকদ্দমাবাজিতে আধখ্যাঁচড়া। সপ্তম পাঁচসালায় রাস্তাটা হবার আগে গাঁয়ে ফুলপ্যান্ট পরে ঢোকা যেত না বর্ষাকালে। কাঁধে বেলবটম, বাঁহাতে জুতোজোড়া, আন্ডারওয়্যার পরে ঢুকতো কলকাতা-বর্ধমানের কুটুমরা। ওদের গ্রামটা বাদে আশপাশের গ্রামগুলো মুসলমান চাষিদের। জোতদার বর্গাদার কামলা সবাই মুসলমান। ধর্মশিবপুরে আজ যাদের বাস, সেসব শীল, কাঁসারি, বারিক, কর্মকার, সাহা, শূর, পাল, কুণ্ডু, দাঁ, সাঁপুই, বায়েন, গায়েন, সরদার, পোড়েল পরিবার এসেছিল গঙ্গারাজা তৃতীয় অনঙ্গভীমের মন্ত্রী বিষ্ণু সিংহের রাঢ়দেশ অভিজানে সঙ্গী হয়ে। সেসব গৌড়ীয়দের প্লেস অব ডোমিসাইল এখন রাঢ়।
র্যাডক্লিফ সায়েবের ভয়ে নেয়ামত মণ্ডল পালিয়েছিল পাকিস্তানে। পরে হাওয়া বুঝতে এলে নরহরি মণ্ডল নেয়ামতের একশো ছেচল্লিশ বিঘে জমি কিনে নিয়েছিল পচা আলুর দরে, মহাফেজের দলিলে তারিখের গোলমাল করে। পাকা দলিল হয়নি, তাই রেজেস্ট্রি হয়নি। এর মধ্যে একশো বিঘে ছিল খোদখামার আর ওয়াকফ চিরাগি জমি, যা নরহরির ছেলে সত্যসাধনকে দিয়ে খাস লিখিয়েছিল ভূমিসংস্কার দপ্তর, আর যা রাঢ়ের লোক পায়নি। চাষবাস না করেও তার অনেকটা পেয়ে গেসলো সন্তোষ দাসের মামাতো ভাই। সন্তোষ দাস এ-তল্লাটে লাল-পার্টি করার জন্যে এসেছিল সত্তর সনে। বে-থা করে থেকে গেল। নিজেদের এখন দাশ লেখে, বলে কায়েত।মনুসংহিতা থেকে কেউ বেরোতে পারে না, তা সে লাল পার্টি হোক বা নীল পার্টি বা সবুজ পার্টি।
প্রথমে মুসলমান গাঁয়ে-গাঁয়ে বকবক বকবক করে গান্ধির কোল থেকে মার্কসের কোলে চাষিগুলোকে তুলে নিয়ে গিসলো সন্তোষ জেঠু। মুসলমানগুলো তো চালাক কম নয়, আগাম টের পায়। ওরা সদাসর্বদা শাসকের সঙ্গে আছে। কি লাটসায়েব, কি ফজলুল হক, কি নাজিমুদ্দিন, কি সুরাবর্দি, কি বিধান রায়, কি জ্যোতি বসু, কি মমতাদিদি। হলে হবে কী! কোথ্থেকে একদল কিশতিটুপি-পরা লিগি এসে ফিসফিস-গুজগুজ চালালে যে মুসলমানগুনো আর সাউ সরদার নাইয়া ঘরামি পদবি রাখতে চায় না। সউদির রিয়ালে মেটে মসজিদগুলোকে ওব্দি সবুজ তেলরঙে ছুপিয়ে ফেলেচে।
প্রতিভা ছিল বটে সন্তোষ জেঠুর, বুঝলেন অরিন্দমদা, নইলে সহদেব মন্ডলের ছেলেটা নকশাল হয়ে ওর মুন্ডু কেটে লটকে দিত না, নিজের গ্রামে অরিন্দমকে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে বলেছিল আদিত্য। শৈশবে দেখা সেই দৃশ্য আজও, সময় বুঝে, আদিত্যকে কাবু করে। বুঝলেন অরিন্দমদা, আমার মামার বাড়ি ছুতোর-গাঁ গ্রামের পরামাণিক শ্মশানসাধুরা মানুষের মুণ্ডু ঝুলিয়ে চোত সংক্রান্তির ভোরে যে নাচ দেখাত, তার চে ভয়ের দৃশ্য ছিল বাঁশের খুঁটিতে টাঙানো সন্তোষ জেঠুর কাটামুণ্ডু। সারারাত শিশিরে-ভেজা জলজ্যান্ত মুণ্ডুটা চোখ রাঙাচ্ছিল, যে দেখতে গেছে তাকেই।
সেই কবে, ছোটোবেলাকার কথা, পরের বছর শ্মশানসাধুদের হাতে ঝোলানো মুণ্ডুগুলোর মধ্যে দুটো ছিল সহদেব মণ্ডলের দুই ছেলের। ছোটোটা পূর্বস্হলী, ওই যে, গেছেন তো আপনি, ওখানে গুলি খেয়ে মরেছিল। বড়োটার ধড় পাওয়া গিসলো হুগলির শেষপুকুর গ্রামে। বুঝলেন অরিন্দমদা, সাধুরা অনেক দিন ধরে মাথাগুলো মাটিতে পুঁতে রেখেছিল তেল-সিঁদুর মাখিয়ে, গাজনাতলায় নাচবে বলে। এখন তো কাটামুণ্ডু বেআইনি হয়ে গেছে বলে সাধুরা কুলি দিয়ে কাজ চালায়, দুধের বদলে ঘোল, আর কি। তার ওপর নাপতেরা আর কেউ সাধু হতে চায়না। তার চেয়ে গেরুয়া পরে মেড়োর টাকায় হিন্দু পলিটিক্স করলে তবু কিছু পয়সাকড়ি হয়। চলুন না মামার বাড়ি, ব্রামভোন অতিথি পেয়ে মামামামিদের আনন্দই হবে।
আমার তো গায়ে পৈতে-ফৈতে নেই।
আরে ও তো পুরুতমশাইকে সকালে অর্ডার দিলে বিকেলে সাপ্লাই দিয়ে দেবে। পুরুতটা আবার বিজেপি, আগে সিপিয়েম করত। সিপিয়েমের পুরুত আসে কালনা থেকে। লোকটা স্টেট ব্যাংকে সিকিউরিটি গার্ড। চলুন না, জিপের ব্যবস্হা করি থালে।
চলো যাওয়া যাক, ওয়েস্ট বেঙ্গলের অত ইনটিরিয়রে যাইনি কখনও।
খড়্গেশ্বরী নদীর ধারে ছুতোর-গাঁ গ্রামে আদিত্যর মামার বাড়ি। ঈশানেশ্বরের খেসসা গান, ফোকলা দাঁতে, আদিত্যর দিদিমার উদ্ভাসিত কন্ঠে, পুলকিত করেছিল অরিন্দমকে। দুই মামা মিলে বর্ধমানে ফার্নিচারের দোকান খুলে, বেতাহাশা কাঁচা পয়সা করেছে, জমিজিরেত, ট্রলিট্র্যাক্টর, চারাকাটার যন্তর, বিলিতি গাই, দুটো শ্যালো, আড়াই বিঘের পুকুর। আদিত্য যখন বাবার কাঁধে চেপে মামার বাড়ি যেত, মামারা এত সচ্ছল ছিল না। কোচবিহার থেকে কাঠের টানামালের ব্যাবসা করে দিন ফিরিয়ে নিয়েছে। দহরম আর মহরম উঁচু মহলে। এফিডেভিট করে রায় পদবি নিয়েছে। মেয়েদের জন্যে ফরসা উদারচেতা বর পেয়েছে, মোটা টাকা যৌতুক দিয়ে।
বুঝলেন অরিন্দমদা, ছোটোমামা দৌড়ঝাঁপ না করলে, এ এস আয়ের ইনটারভিউটা গুবলেট হয়ে যেত। দুরাত্তির ওর মামারবাড়িতে থেকে, অরিন্দমের মনে হয়েছিল, আদিত্যর মামারবাড়ির সবায়ের গা থেকে র্যাঁদামারা কাঁচা কাঠের গন্ধ বেরোয়। সত্যি। বড়োমামার শালকাঠ, বড়োমামির সেগুনকাঠ, ছোটোমামার নিমকাঠ, ছোটোমামির শিশুকাঠ। মাতুলালয় যেন ছালছাড়ানো গাছের জঙ্গল।
কোচবিহারে তুফানগঞ্জে, মানসাই গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান তো মামাদের, মানে আমার মায়ের, মামাতো ভাই। একবারটি ওখানেও নিয়ে যাব আপনাকে, বলেছিল আদিত্য । লুকিয়ে-লুকিয়ে আসাম থেকে কাঠ আসে। অবশ্য কাকেই বা লুকোনো। বনকর্মীরা ব্যবস্হা করে, মাস মাইনে পায়।
তোমাদের শিডুল হপ্তা আর ওদের শিডুল মাস?
বিক্কিরি বাবদ তোলা দিতে হয় আলফা আর বোড়োদের, সোনার বাংলা থেকে চিনের আর পাকিস্তানের বোমাবন্দুক আনার জন্যে। একটু ইদিক-উদিক হলেই ডুয়ার্সে এলেমজি চলে। কুমারগ্রাম, বকশির হাটে ছানবিন হয়। হাঃ হাঃ, পুলিশকেও তো দিতে হবে। ছোটোমামা নিজেকে টিম্বার মাফিয়া হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসে, কিন্তু কাঠের ব্যাপারিরা সে স্বীকৃতি দিতেই চায় না।
কলকাতায় না থাকলে কোনো কিছুতেই স্বীকৃতি মেলে না। স্বীকৃতিরও কতোরকমের চাহিদা, চাইলেই পাওয়া যায় না।
ছুতোর-গাঁ’র মুসলমানগুনো ধর্মশিবপুরের মুসলমানগুনোর চে ফরসা। করিম মুনশি আর ফরিদ মোল্লার বাড়ির সবাই ফরসা আর ঢ্যাঙা। দাদু বলে ওরা সব খাঁটি আর আমাদের গাঁয়ের কেলটেগুলো পাতি, জানেন তো পাতি মানে নমোশুদ্দুর থেকে যারা নেড়ে ধর্ম নিয়েচে। ফরসা না হলে আমেদ মামুদ করিম জালাল নামগুলো ঠিক মানায় না। বুঝলেন অরিন্দমদা, ছুতোর-গাঁ’র নাম পালটে রায়গ্রাম রাখার দৌড়ঝাঁপ চলছে। বড়োমামা বলছিল, ছুতোর-গাঁ’র কুসুমেটে তেঁতুলে, দুলে, বাগদি, হাড়িয়া সব এফিডেভিট করে রায় হয়ে গেছে। মামাদের চেয়ে উঁচু পরিবার বলতে উগ্রক্ষত্রিয় মন্ডলরা আর ব্রামভোনরা।
কর্নওয়ালিসের ছাপ্পামারা জমিদাররা যখন ছিল, তখন বাড়ি-ঘর-মন্দির-মসজিদের স্হাপত্য বলে একটা ব্যাপার ঢুকেছিল গ্রামগুলোয়।
এখন তো গ্রামে-গ্রামে তোমার মামাদের মতন পয়সাওলা লোক কম নয়, বলেছিল অরিন্দম। অথচ কোনো নতুন স্হাপত্য দেখা দিল না উত্তরঔপনিবেশিক পশ্চিমবঙ্গের পল্লিসমাজে। গরিব সাজাটাই এখন গ্রামবাংলার স্হাপত্য। পেল্লাই উঠে গেছে বাড়ি, এদিকে প্রলেতারিয়েত জুগ জুগ জিও, শাল্লাহ।
ভাগ্যিস অর্ডার দেওয়া পৈতেটা পরেছিল অরিন্দম। আদিত্যর দিদিমা-মাইমা-ছোটো বউদির কাছে ওটার জন্যে অনাস্বাদিত খাতির চলছে। অরিন্দমের চেয়ে বয়সে ঢের বড়ো ওর দিদিমা আর মামিরা চান সেরে এসে হঠাৎ পায়ের কাছে মেঝেয় ঢিপ-ঢিপ। এই জন্যেই গ্রামে যেতে অস্বস্তি হয়। জাতিপ্রথা বেশ জেঁকে টিকে আছে ভেতরে-ভেতরে, নানা জাতের মানুষ এখনও এক সারিতে খেতে বসতে চায় না, তিরিশ বছরের বামপন্হী রাজনীতির শেকড়ের ফ্যাঁকড়া ছড়ালেও । ইশকুলের ফ্রি খাওয়ার খিচুড়ি রাঁধতেও বামুন বউ দরকার হয়। অবশ্য ছোটো ভায়ের বিয়ের সময়েও পরতে হয়েছিল রেডিমেড পৈতে।
তোমার বড়ো মামার ছেলে-বউকে দেখলুম না?
বড়দা-বউদি ফিবছর পুজোয় চাইবাসায় শ্বশুরবাড়ি চলে যায়। ওখানে দশজন জামাই মিলে খুব হইহল্লা হয়। সত্যি, আরে স্ট্রাইক করেনি আগে। পনেরো বছর বিয়ে হয়েছে বড়দার, কিন্তু কোনও বার পুজোয় নিজের মা-বাপের কাছে থাকেনি।
তুমি বিয়ে করে কী করো দেখা যাক।
পুলিশে কাজ করে বিয়ে করার ঝামেলা আছে। আপনি করে ফেলুন না বিয়েটা। ব্রামভোন বাড়িতে কুচ্ছিত মেয়েরও রূপ থাকে। ছুতোর-গাঁয়ে ব্রামভোনরা সব ঈশানেশ্বরের পুজুরি, বুঝলেন তো। স্বাধীনতার পর সব মন্দিরের দখল নিয়ে নিয়েছে ব্রামভোনরা। দুলেদের ধর্মরাজের মন্দিরটা নিয়েছে। দেয়াসি তাঁতিরা বুড়ো-গাছতলায় কালাচাঁদ মন্দিরের সেবায়েত ছিল ; তাদের হটিয়ে সেটাও হাতিয়েছে। ব্রামভোনগুলোই দেশটাকে ডোবাল। জহোর্লাল তো ব্রামভোন ছিল, তাই না?
একটা মন্দিরের মধ্যেই অতগুলো পুতুল ডাঁই করে রাখা দেখলুম, অনেকগুলোর রঙ চটে গেছে। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ চলছে নাকি? শ্রীহীন দেবতাদের গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার অবশিষ্টাংশ!
আপনাদের আজগালকার ব্রামভোনদের ঠাকুর-দেবতা সম্পর্কে বড্ডো অচ্ছেদ্দা। ওগুলো ধর্মঠাকুরের মূর্তি। মামারবাড়ির এদিকটায় অনেক-অনেক মন্দির ছিল আগে। এখন আর কে দেখাশোনা করবে বলুন? সেসব ঠাকুরের থান থেকে এনে রেখেছে ওই মন্দিরে। কত মূর্তি তো চুরি হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে গেল । অবশ্য বিদেশে গিয়ে যত্ন-আত্তি পায় মূর্তিগুলো, সেও তো একরকম পুজোই, বলতে গেলে। সেবায়েতরা আজগাল দুর্গাপুর, আসানসোল, বর্ধমানে রিকশা চালায়, হকারি করে। বর্ধমানে দেখলেন তো, ঠেলায় চাউমেন বেচছে, আমায় যে ডাকলে, ও ছেলেটা তাঁতি বাড়ির।
আদিত্য ওর ইতিহাস-ভুগোল বজায় রাখে, আমাদের ধর্মশিবপুর গাঁয়ের অনেকে পাততাড়ি গুটিয়ে রানিগঞ্জ, আসানসোল, নিরসা, গোবিন্দপুর, ধানবাদ গিয়ে দুপুরুষ কয়লাখনিতে কুলিগিরি করছে। এমন সাতবাষ্টে হাড়গিলে চেহারা করে ফেলেছে, যে দেখলে টের পাবেন না বাঙালি না বিহারি, হিন্দু না মুসলমান। আমরা তো ঠাকুদ্দার জন্যে পার পেয়ে গেলুম, নইলে কী দশা যে হতো। তল্লাটের মুসলমানগুনো তো সোশালিস্ট ছেড়ে মুসলিম লিগে ঢুকে পড়েছিল, বুঝলেন, তার মধ্যেই ঠাকুদ্দার দৌলতে আমাদের ফ্যামিলির নামডাক ছড়িয়ে পড়েছিল সেই ভেদিয়া বেরাণ্ডা ছাড়িয়ে নিগন কৈচর উজানি কোগ্রাম ওব্দি। ঠাকুদ্দা তো বাবাকে ওয়ার্ধা আশ্রমে নিয়ে গিসলো। জহোর্লালের কোলে-বসা বাবার ফোটো আছে। তখনও টাক পড়েনি জহোর্লালের। সেসব এখন বাক্সবন্দি। আর বোধয় বেরুবে না।
তোমার পুলিশে চাকরি এবার অন্যরকম ইজ্জত এনে দিয়েছে, কী বলো?
ধুৎ, ইজ্জত-টিজ্জত নয়। ভয় পায় লোকে। বেশ ভাল্লাগে লোকেদের ভয় পাওয়াটা। শ্রদ্ধার ভালোলাগার থেকে ভয়ের ভালোলাগাটা সুপিরিয়র। হাঃ হাঃ।
তুমি ছুতোর-গাঁ, ধর্মশিবপুর, মঙ্গলকোটের অ্যাতো গল্প জানলে কোথ্থেকে? ঠাকুদ্দার কাছে?
না-না। ইশকুলে আসলাম স্যারের কাছে। ভুগোল পড়াতে-পড়াতে লোকাল ইতিহাস পড়িয়ে দিত। নিজেকে বলত রাঢ়ীশ্রেণি পাঠান। পূর্বপুরুষ কে একজন মোহম্মদ শামিম খান নাকি আলিবর্দি খাঁর সেনাদের সঙ্গে আরবি ঘোড়ায় চেপে বর্গিদের তাড়াতে-তাড়াতে এসে পৌঁছেছিল কাটোয়ায়। গঙ্গারাম নামে একজন কবি ছিল আগেকার কালে, তার লেখা মহারাষ্ট্রপুরাণে আছে নাকি গল্পটা। আসলাম স্যার তো কুচকুচে কালো। আর ঘোড়াটার টাট্টু বংশধররা এখন মন্তেশ্বর কিংবা দাঁইহাটে এক্কা টানে। হাঃ হাঃ, এক্কাও উঠে গিয়ে চাদ্দিকে ভ্যান রিকশা অটো ম্যাক্সি-ট্যাক্সি চলছে। আসলাম স্যার আজও ভূগোলের ক্লাসে ইতিহাস পড়ায়। ইতিহাস তো গপপো, বানিয়ে নিলেই হল। ভূগোল তো তা নয়।
এখনও পড়াচ্ছেন? স্কুলমাস্টাররা তো শুনি রিটায়ার করে পাঁচসাত বছর ওব্দি পেনসন পাচ্ছে না।
টাকের ওপর টুপি পরে আঙুল দিয়ে সাদা ধবধবে দাড়ি আঁচড়ায় আর দুপুরে ছেঁড়া আসন পেতে দেয়ালমুখো নামাজ পড়ে টিচার্স রুমে। এখন তো টিচার্স রুম বলতে পশ্চিমের নোনা ইঁটের স্যাঁতসেঁতে ঘরটা, প্রায়ই ঠান্ডা খড়ামারা মেঝের ওপর দিয়ে গোখরো সাপ এদিক থেকে ওদিক নিশ্চিন্ত মনে ফণা গুটিয়ে চলে যায়। ছাত দিয়ে জল পড়ে। এখন তো একটাও ক্লাসঘরে দরোজা-জানলার আড়কপাট নেই।
আদিত্যর মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল অরিন্দম। নিজেকে ঘিরে গ্রেটনেসের বুদবুদ তৈরি করতে চাইছে ও, আদিত্য। সবাই, ওর চেয়ে ছোটো, দরিদ্র, নিকৃষ্ট, দুস্হ, শ্রীহীন, অবহেলিত। অনেক মানুষ প্রেমহীনতাকে ভালোবাসে।
অরিন্দম বলল, তুমি তো নিজেই স্কুলে মাস্টারির চেষ্টা করেছিলে, বলেছিলে একবার।
ওঃ, সে এক কেলো হয়েছিল বটে। মুর্শিদাবাদের সাগরপাড়া হাইস্কুলে গিসলুম ইন্টারভিউ দিতে। এগারোজন প্রার্থী ছিল, বুঝলেন। চৈতন্য খামরুই বলে এক প্রার্থীর তো পাঞ্জাবির তলায় ছেঁড়া গেঞ্জি ওব্দি দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু গুজগুজ ফিসফিস হাসাহাসি থেকে দশ মিনিটেই আমরা টের পেয়ে গিসলুম যে স্কুল কমিটি ওই পদের জন্যে আগে থাকতেই লোক ঠিক করে ফেলেছে। ইন্টারভিউটা লোকদেখানে।
আমরা তো ইন্টারভিউ না দিয়ে বাস ধরার জন্যে ফিরে গিয়ে গ্যাঁজাচ্ছিলুম রাস্তার ধারে। হঠাৎ না, হইহই করতে-করতে তিরিশ চল্লিশজন লোক এসে ঘিরে ধরে কিল চড় লাথি থাপ্পড় কঞ্চিপেটা আরম্ভ করে দিলে। আমি ভাবলুম আমাদের ডাকাত ভেবে গণপ্রহার আরম্ভ হল বুঝি। আজগাল গ্রামে শত্রুপেটানোর এটা সবচে সহজ আর সস্তা কায়দা বেরিয়েছে। ভাবলুম আর বোধহয় বাঁচার উপায় নেই। সব তো পাঁচ ফিটের গাঁইয়া বাঁটকুল। তিনটেকে দিলুম একটা করে পাঞ্চ, বুঝলেন। কেঁউয়ে কুকুর হয়ে কাৎ।
তখন ওদের নেতামতন লোকটা হুকুম ঝাড়লে যে ইন্টারভিউ না দিয়ে ফেরত যেতে পারবে না কেউ। ঘাড় ধরে হিড় হিড় করে, জামা খামচে, পেছন থেকে ঠেলে, স্কুল ওব্দি ধাক্কা দিয়ে-দিয়ে নিয়ে গিসলো আমাদের, পেছন-পেছন গ্রামের প্রায় একশো হাফল্যাংটো কচিকাঁচার দল, নেড়ি কুকুরের ঘেউ ঘেউ, একদল পাতি হাঁস গোঁতা খেয়ে নেবে গেল পুকুরে, তাইতে তিন-চারটে রুই-কাতলা লাফিয়ে উঠল, উড়িসশালা, সে গাঁড়েগোবর অভিজ্ঞতা ভোলা যাবে না। কয়েকজন চাষি বউ মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসছিল। ইন্টারভিউ-ফিন্টারভিউ কিসসু নয়। হেডমাস্টারের ঘরে একটা রেজিস্টারে সবাইকে দিয়ে সই করিয়ে নিলে। ইন্টারভিউ না দিয়ে সবাই বাড়ি ফিরে গেলে তো শিক্ষক বাছাই বাতিল হয়ে যেত। তাই অমন হেনস্হা। কয়েকটা লোকের মুখ মনে রেখেছি। কখনও যদি পেয়ে যাই কলকাতায় কোথাও তো পোঁদের চামড়া তুলে ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখব।
এক্ষুনি লকাপে সেই কাজটা করছিলে বুঝি? কী করে পারো? আমার তো গলা শুকিয়ে বুক ধড়ফড় করতে লাগল বলে বেরিয়ে এলুম। তোমার সঙ্গে এবার বোধহয় আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে। বলার পর, অরিন্দমের খেয়াল হল যে এই কমবয়সি আদিত্য ছাড়া ওর আর বন্ধু নেই কোনও ; এমন কেউ নেই যার কাছে গিয়ে গল্প করা যায়। নানারকমের গোলমালে আক্রান্ত হয়ে উঠেছে অপরিহার্য অস্তিত্ব।
আরে, এই ক্রিমিনালগুলোকে আপনি জানেন না। মহাফেজখানা থেকে কিছু গুণ্ডা ফাইল বের করিয়ে দেবো আপনাকে পড়তে, তাহলে টের পাবেন। আদিত্যর মুখময় ঘুরঘুর করছিল বিমূর্ত অভিভাবকত্বের গর্ব। তাস যেভাবে তার তুরুপ লুকিয়ে রাখে, সেভাবে হাসির মৃদুতা ঠোঁটের কোণে লুকিয়ে রেখেছিল আদিত্য।
অরিন্দম যেন হেমন্তের স্মৃতিভারাক্রান্ত কাঠফড়িং। বলল, জবাবদিহির সুরেই বলল, করেছে কী লোকটা? শুনি।
তিলজলার গোলাম জিলানি খান রোডের নাম শুনেছেন? গেছেন ওদিকে কখনও? র্যাফ নেমেছে। দুটো পাইপগান, রামদা, আর একগাদা বোমা পাওয়া গেছে। পুলিশের ওপর বোমা চালিয়েছে, অ্যাতো বুকের পাটা। কন্সটেবল গোপাল দাসকে তো চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে ভরতি করতে হয়েছে। শঙ্কর ঘোষ, কুমার দত্ত, এরশাদ খান, শঙ্করনারায়ণ পাণ্ডে, ওদেরও অল্পবিস্তর চোট লেগেছে। আসল দুটো খুনে হাওয়া হয়ে গেছে বোমার ধোঁয়ায়। চারটে হারামজাদাকে ধরেছি আমরা।
তিলজলা? অরিন্দমের মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত।
কেন? তিলজলায় আবার কী আছে?
তিলজলায় একজন থাকে। আমি তাকে কখনও দেখিনি। তার বিষয়ে জানিও না কিছু। এমনকী নামও জানি না। আমি তাকে বিয়ে করতে চাই। মনের ভেতর প্রেমের ফাঁকা জায়গাটায় বসিয়ে রেখেছি তাকে।
আদিত্য স্তম্ভিত। রেশ কাটলে বলল, আপনাদের এইসব ন্যাকান্যাকা কাব্যি-কাব্যি পারভারটেড কথাবাত্রা শুনলে আমার পিত্তি জ্বলে যায়।
.
০৭.
নিঃস্ব, সন্ত্রস্ত, অভুক্ত ভবেশকাকা কাঁধে খুশিদিকে চাপিয়ে বর্ডার স্লপি হাতে বনগাঁ হয়ে শ্যালদা প্ল্যাটফর্মে উঠেছিল। জহোর্লাল ওদের মাটি থেকে ওদের উপড়ে ওদের দুরবস্হা দেখতে গিসলো নিজের চোখে। শ্যালদা থেকে চটকলের গুদামে। সেখান থেকে বালিগঞ্জের যশোদাভবন ক্যাম্প। তারপর কলকাতার দক্ষিণে ধানখেত আর জলাজমিতে যে যেমন ঠাঁই নিতে পারে।
যিশুর দাদুর অনেক ধানিজমি ছিল ওদিকে। মুসুলমান ভাগচাষিদের বাস ছিল। এখন তো সেসব জলাজমির নাম হয়েছে সূর্যনগর, আজাদগড়, নেতাজিনগর, শ্রীকলোনি, গান্ধি কলোনি, বাঁশদ্রোণি, বিজয়গড়, রামগড়, বাঘাযতীন, কত কী। যিশুর দাদুর ইংরেজ বন্ধুরা ডিঙি চেপে পাখি শিকারে যেত সেসব জলাজমিতে।
আচমকা মানুষের ঢলে ভরে যেতে লাগল দিগন্ত ওব্দি ধানখেত আর জলাজমি। ঠ্যাঙাড়েরা রাতবিরেতে তুলে দেবার চেষ্টা করত লোকগুলোকে। যিশুর দাদুও ভাড়াটে লেঠেল আর তাগড়া সব বৌবাজারি গুণ্ডা লাগিয়েছিল, গল্প করেছিল ভবেশকা। ভবেশকারা যে জায়গাটায় থাকত, লেঠেল-গুণ্ডাদের অনেকদিন ঠেকিয়ে জিতেছিল বলে জায়গাটার নাম দিয়েছিল বিজয়গড়। বারোভূতের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিল জিতে। নিজেরা ভারি-ভারি রোলার টেনে রাস্তা বানিয়েছিল ভবেশকারা। রাত্তিরে পাহারা দিত দল বেঁধে।
সেসব রাস্তায় সাইকেলে ঘুরেছে যিশু, দিনের বেলায়। বাঘাযতীন, বিদ্যাসাগর, শান্তিপল্লি, চিত্তরঞ্জন, রিজেন্টপল্লি, বিবেকনগর, দাশনগর, আদর্শপল্লি, রামকৃষ্ণ উপনিবেশ, বাপুজিনগর, বঙ্গশ্রী, নেলিনগর, শহিদনগর, মিত্রবাস, পোদ্দারনগর, মনেও নেই সব।
এখন গিজগিজ করছে মানুষ, উঁচুউঁচু ফ্ল্যাটবাড়ি, ধনীদের আবাসন, চেনাই যায় না।
ভবেশকা ছিল অসাধারণ নেতা। চলে আসার সময়ে রাজশাহী গভর্নমেন্ট কলেজে ছিল ফার্স্ট ইয়ারে। পোড়-খাওয়া তাঁমাটে পেশি, ড্যাংডেঙে হাত-পা, চওড়া ছাতি, কোঁকড়াচুল ভবেশকা রোজই বেরিয়ে যেত আন্দোলন করতে। খুশিদিকে যিশুর মায়ের কাছে রেখে যেত।
এরকম নেতাকে হাতে রাখা ভালো, এই ভেবে বাবা বলেছিল, যিশুর সঙ্গে খুশিও যাক না স্কুলে, টিউটর রেখে নিচ্ছি না হয়। প্রস্তাবে ভবেশকার কীইই রাগ। বললে, তাহলে আর আপনাদের বাড়ি আসব না। মিতালিদের বাড়ি রেখে যাব।
ট্র্র্যামের ভাড়া যখন এক পয়সা বাড়ল, প্রথম ট্র্যামটায় ভবেশকাই আগুন ধরিয়েছিল, পুলিশ রেকর্ডে আছে। পাকিস্তানি ওপার বাংলা থেকে তখন সত্তর হাজার লোক এসে কলকাতায় ফ্যা-ফ্যা করছে, অথচ রোজগারপাতির কাজ নেই। তখনও কলোনিগুনো পশ্চিমবঙ্গে ছিল, কলকাতা হয়নি। নিত্যিদিন কলকাতায় গিয়ে পিকেটিঙ, ট্র্যাম জ্বালানো, বাস পোড়ানো, ব্যারিকেড, বোমা, অ্যাসিড বালব, মিছিল, র্যালি। বোমা বানাতে গিয়ে ভবেশকার কড়ে আঙুল উড়ে গিসলো। খুশিদির কান্নাই থামে না। কাঁদলেই টোল পড়ত থুতনিতে।
তেসরা জুলাই জ্যোতি বসু, গণেশ ঘোষ, জ্যোতিষ জোয়ারদার, সুবোধ ব্যানার্জি গ্রেপ্তার হতে, কালিঘাট ট্র্যাম ডিপো, শোভাবাজার-চিৎপুর ক্রসিং, একডালিয়া বাজার, শ্যামবাজারে তুলকালাম হয়েছিল। রাত্তিরে বাড়ি ফেরেনি ভবেশকা। টিয়ারগ্যাসের শেল কুড়িয়ে এনে দিত ভবেশকা। খুশিদির মোটে ছাব্বিশটা জমেছিল। যিশুর আটচল্লিশটা। দুটো আজও আছে ডাইনিং টেবিলে নুন-গোলমরিচ রাখার কাজে। ভবেশকা ইউসিআরসি আর ট্র্যামভাড়া বৃদ্ধি কমিটি, দুটোতেই ছিল। অক্টারলোনি মনুমেন্টের গোড়ায় দাঁড়িয়ে রোজ বক্তৃতা দিতে যেত আর তারপর ভিড়ভাঙা মিছিলে শ্লোগান। বক্তৃতা দিতে-দিতে অল্প সময়েই কলকাতার কথা বলার টান রপ্ত করে ফেলেছিল।
পনেরো জুলাই হয়েছিল সাধারণ ধর্মঘট। সেই প্রথম বাংলা বন্ধ। উৎসব। পশ্চিমবাংলার বাঙালির জীবনের মূল্যবোধ পালটে গেল। কর্মসংস্কৃতি পালটে গেল। বন্ধ। নতুন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
একদিন বিকেলে বাবার হাত ধরে গড়ের মাঠের মিটিং দেখতে গিসলো যিশু। দ্রোহের জ্যোতিতে মথিত ভবেশকার মুখ মনে পড়ে। ষোলোই জুলাই কলকাতার রাস্তায় সেনা নেমে গেল। তখনকার দিনে র্যাফ ছিল না। শোভাবাজারে ভিড়ের ওপর গুলি চলেছিল আঠেরো তারিখে। প্রফুল্ল সেন ভয়ে এমন কেলিয়ে গিসলো যে বিদেশে আরাম আদ্দেক বাকি রেখে তিরিশ জুলাই তড়িঘড়ি ফিরতে হয়েছিল বিধান রায়কে। জহোর্লালের তো তখন কানে-তুলো চোখে-ঠুলির রোগ, ভবেশকা বলেছিল। আইন ভাঙা ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু সবাই মিলে আইন ভাঙলে, ভাঙা আইন আর জোড়া লাগে না। যত আইনই তৈরি হোক পশ্চিমবঙ্গে, সেই থেকে, ভেঙে-ভেঙে ঝনঝন করে পড়ে যায়। আদালতের জজকে চটি ছুঁড়ে মারে। টেলিফোনে হুমকি দেয়। উপায় নেই। উপায় যে ঠিক কী, কেউই জানে না। চায় না জানতে।
চিনের সঙ্গে যুদ্ধের সময়, ভারতরক্ষা আইনের প্যাঁচে যখন টালিগঞ্জ থানার সেপাইরা অশোকনগরে পঁয়তাল্লিশটা আস্তানা ভাঙতে এলো, তখন ছুটি হয়ে গেসলো নাকতলা স্কুলে, যাতে ছাত্র আর টিচাররা প্রতিরোধে শামিল হয়। সন্তোষ দত্তর চেলা ছিল ভবেশকা। যুগান্তর বলতে যেটুকু টিকে ছিল, তা-ই করত দুজনে। পুনর্বাসন মন্ত্রী আভা মাইতিকে ওনার অফিসে গিয়ে ধমকে ছিল ভবেশকা। কী রোয়াব, ওহ, দ্যাখে কে!
বিধান রায়ের আমলে যে খাদ্য রায়ট হয়েছিল, তা আবছা মনে আছে যিশুর। তখন তো বর্গা আইনও হয়নি, পিএল চারশো আশির ল্যাং খেয়ে সবুজ বিপ্লবও হয়নি।
ধানচালের কেনাবেচা সরকারি আওতায় নিয়ে গিয়ে গুবলেট করে ফেললে বিধান রায়। বাজার থেকে উবে গেল চাল-গম। খাবার খুঁটতে কলকাতার ফুটপাথ ভরিয়ে ফেলেছিল গাঁয়ের লোকে, যে লোকগুলো কানিতে মাটির রং নিয়ে জন্মায়। ভবেশকা বিধান রায়কে মুখের ওপর বললে, সংগ্রহ বিতরণ তদারকির জন্যে গণসমিতি গড়া হোক পাড়ায়-পাড়ায়।
বিধান রায় ভাবল, অ, বিরোধী দল পেছনের দরজা দিয়ে সেঁদোতে চাইছে। খাদ্যমন্ত্রী তখন প্রফুল্ল সেন। তিরিশ হাজার পুলিশকে ধানচাল যোগাড়ের তদারকির কাজে লাগিয়ে দিলে। দাম বাঁধার হুকুম আর লেভি অর্ডার তুলে নেওয়া সত্ত্বেও, চাল গম ডাল তেল মশলার দাম বাড়তে লাগল। হু হু। হু হু। বিধান রায়ের বুকের ব্যারাম ধরিয়ে দিলে প্রফুল্ল সেন আর অতুল্য ঘোষ। খাদি-খদ্দর জামাকাপড় তো উঠেই গেল পশ্চিমবঙ্গে।
গোলমাল আঁচ করে শুরু হল ভবেশকাদের ধরপাকড়। সেই নিয়ে তেইশবার জেল। গোলমাল কী আর সহজে থামে। ছাপোষার পেটে দানা নেই। আগস্টের শেষ দিনে, ডালহাউসি স্কোয়ারে, হাজার লোকের মিছিলের মাথায় ভবেশকা। ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিট আর এসপ্লানেড ইস্ট ঘিরে রেখেছিল পুলিশ। একশো চুয়াল্লিশ চলছে। কী ভিড়, কী ভিড়।
লাউডস্পিকারের দরকারই হতো না তখনকার দিনে। মিছিল ভাড়াও করতে হতো না, ট্রাক ভাড়া করে ময়দানে লোক জড়ো করতে হতো না। মহাসমাবেশের পোস্টার দিতে হতো না। রাস্তার ওপরেই বসে গিয়েছিল বউ-ঝি, পোলাপান, মরদরা। হাতাহাতি আর ঢিল ছোঁড়াছুড়ি ছড়িয়ে পড়ল ধর্মতলা, চৌরঙ্গি, সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ, কলেজ স্ট্রিট। ট্র্যামের লাইন নিজের হাতে উপড়ে ফেললে ভবেশকা। ড্রাইভারের ফেলে-পালানো বাসটায় আগুন ধরিয়ে দিলে। পুলিশের সোঁটা ভবেশ মন্ডল, অমর বসু, রাম চ্যাটার্জি, চিত্ত বসু, মাখন পাল, মোহিত মৈত্র কাউকে রেয়াত করলে না।
পরের দিন ভোর পাঁচটায় খুশিদিকে মায়ের জিম্মায় দিয়ে বিধান রায়ের বাড়ির সামনে ছাত্রদের জড়ো করে ফেলেছিল ভবেশকা। মাথা-গরম টাটকা সভা-ভাঙা মিছিলটা যখন এগুচ্ছে, প্রিন্সেপ স্ট্রিট থেকে রইরই করে এসে হামলে পড়েছে পুলিশ। খণ্ডযুদ্ধ। সুযোগ বুঝে গুণ্ডা-মস্তানরাও ফাঁকতালে নেমে পড়েছিল। তোড়ে বৃষ্টি এসে কিছুক্ষণের বিরতি দিলে কী হবে, ভবেশকা আশুতোষ বিল্ডিঙে ছাত্রদের জড়ো করে, ঠেলাগাড়ি আর বিদ্যুৎ বিভাগের মই এনে রাস্তা জ্যাম করে দিলে। পুলিশের হাত থেকে বেটন ছিনিয়ে নিয়েছিল ভবেশকা। সন্ধে নামতে, রাস্তায়-রাস্তায় আলো ভেঙে ফেলার নেতৃত্ব দিলে।
অন্ধকারে জ্বলেছে গাড়ির টায়ার, ট্র্যাম-বাস। ঠেলাগাড়ি দমকল অ্যামবুলেন্স। মরে ছাই হয়ে গেল সনাতন কলকাতিয়াদের তিলোত্তমা মোহনবাগানি কলকাতা, জীবনানন্দ দাশ নামে এক কবির কলকাতা। গোবিন্দ বল্লভ পন্হের মাথা-কাঁপানো অনুমতি নিয়ে গুলি চালালে পুলিশ। ভবেশকার বাহুর মাংস খাবলে শিস দিয়ে চলে গিয়েছিল গনগনে বুলেট।
ভবেশকা তোমার সেই গুলি লাগার দাগটা আছে?
না হে, অ্যাতো দিন থাকে নাকি! কবেই মিলিয়ে গেছে। পুকুরের জলে মুখ ধুয়ে গোরুর গোয়ালের দিকে চলে গেল ভবেশকা। এই সাত সকালেই গেরুয়া আলখাল্লা পরে আছে, সত্য সাঁইবাবার ডুপলিকেট। ওটা পরেই শোয় বোধয়।
ভবেশকা বলত, কংরেসের জন্য, শিশুর জন্য, কাশ্মীরের জন্য, হিন্দির জন্য, এডউইনার জন্য, কৃষ্ণমেননের জন্য, আনন্দভবনের জন্য, জহোর্লালের প্রাণ কাঁদে। আমাদের দুর্গতির জন্য কাঁদে না। এখন ভবেশকাও জন্যকে বলে জন্যে, বাঙাল থেকে ঘটি হয়ে গেছে নিজের অজান্তে।
কিন্তু দোসরা সেপ্টেম্বর জহোর্লাল আর ওনার খাদ্যমন্ত্রী এস কে পাতিলের টনক পঙ পঙ করে নড়ে উঠতে, পশ্চিমবঙ্গে ট্রেন-ভরতি চাল-গম পাঠিয়েছিল কেন্দ্রিয় সরকার। তেসরা সেপ্টেম্বর সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়ে রেখেছিল মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি। ভবেশকা এই কমিটিতেও ছিল।
হাওড়ার খুরুট থেকে বামনগাছি ওব্দি ধোঁয়াক্কার হয়ে গিসলো দড়িবোমায়। দাশনগরে চটকলের গুদোমে আর মজদুরদের ঝুপড়িতে আগুন ধরিয়ে দিল ভবেশকা। দাউ দাউ দাউ দাউ দাউ দাউ। জগাছা, বামনগাছি, মালিপাঁচঘরায় গিয়ে আম-জনতাকে উদ্বুদ্ধ করতে লাগল ভবেশকা। ধর্মঘটকে সফল করে তুলেছিল সুভাষ মুকুজ্জের পদ্য গেয়ে-গেয়ে। কমরেড তুমি নবযুগ আনবে নাআআআআআ? খবরের কাগজের প্রথম পাতায় তখন প্রায় রোজই নাক-ফোলানো ভবেশকা।
আর এখন? স্বাধীনতার ষাঠ বছর পর, দেয়ালে লেখা থাকে, দেখেছে অরিন্দম, বহু গ্রামে, “কমরেড তুমি আর গাঁড় মারবে না।”
সকাল হতে না হতে শোভাবাজার আর বিডন স্ট্রিটে শুরু হয়ে গেল ভবেশকাদের হ্যাঙ্গাম। মায়ের কাছে খুশিদিকে সোপর্দ করে সেখানেও পৌঁছে গেছে চটি আর ধুতি-শার্ট পরা উশকোখুশকো ভবেশকা। রাত্তিরে মানিকতলা থানা আক্রান্ত। নেতৃত্বে ভবেশকা। ঢাকুরিয়ায় পুলিশ আউটপোস্টে বোমা। ভবেশকার কাঁধে বোমাভরা ব্যাগ। খিদিরপুর, টালিগঞ্জ, কালীঘাট, ভবানীপুর, বেলঘরিয়ায় ভবেশকার খ্যাপানো জনতার ওপর গুলি চালালে পুলিশ। বেহালার বাসের গুমটি আর ট্র্যাম ডিপোয় আগুন ধরিয়ে দিলে রাগি জনতা। নেতৃত্বে ভবেশকা।
ভবেশকার মগজ থেকে প্রতিদিন নতুন-নতুন প্রতিবাদের শব্দ, শব্দবন্ধ, ভাষা বেরোচ্ছে। বনধ, হরতাল, অবরোধ, ঘেরাও, ধরনা, র্যালি, মিছিল, সমাবেশ, পথসভা, গেটসভা, পিকেটিং, মোড়মিটিং। ভুল বানানে ছেয়ে গেছে শহরের দেয়াল।
চৌঠা সেপ্টেম্বর তো যারই মুখে রাগি-রাগি ভাব দেখেছে, তাকেই গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। কতজন যে মরেছিল কে জানে। মর্গে লাশ ল্যাংটো করার সেই শুরু। লাশ লোপাটের গণিতের ম্যাজিক তো আগেই শিখিয়ে গিয়েছিল ইংরেজরা। পুলিশকেও নিজের হাতে গড়ে-পিটে পুলিশ বানিয়েছিল ব্রিটিশরা। দুশো বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে।
কলকাতা আর শহরতলির অবস্হা একটু-একটু করে থিতোল।
সেবার তবু সামলেছিল। ষাটের মাঝামাঝি আর পারল না প্রফুল্ল সেন। একে বিধান রায় নেই, তার ওপর ভারতজোড়া ঘাটতি। আলু তো বাজার থেকে একদম লোপাট। প্রফুল্ল সেন বললে, তাতে কী, কাঁচকলা খাও, আপেল খাও। ধানের লেভি হুকুম জারি করলে সরকার। মানে, চালকলগুলোর পুরো মাল চলে গেল সরকারের একচেটিয়ায়।
ভবেশকা বলেছিল, বুড়ার মাথা খারাপ হইয়া গিয়াসে।
ব্যাবসাদাররা রেগে কাঁই। কলকাতার বড়োবাজারকে চটিয়ে দিলে কোনো সরকার টেকে না। তাদের বিকিকিনি তো লাটে। সরকারিদর আর বাজারদরের মধ্যেকার গভীর খাদে পড়ে গেল বেচারা কংরেস। ধান পাকার আগেই তুলে নিয়ে বিহার আসাম পাকিস্তানে চালান করে দিতে লাগল জোতদাররা। রেশনের দোকান ফাঁকা। মাছিরাও ডানা গুঁজড়ে গুমুচ্ছে।
লোকে বলে সেটা ছিল তিতকুটে ফসলের শীত। খবরের কাগজের ক্রোড়পত্রে ভবেশকা।
চাষিবাড়ির খেতমজুর বউ-ঝিরা চালপাচারের মজায় সেই যে ফেঁসে গেল, সংসার করার কায়দাই পালটে ফেললে। সংসারের ঝক্কি নেই, কাঁচা ট্যাকা, ট্রেনের গুলতানি, একদিনের টিকিটে প্রতিদিন যাতায়াত, রাত্তিরটা হাজতে কখনওবা, হোমগার্ড আর পুলিশের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি। মোড়লদের বানানো এতকালের বেড়াগুলো ছেদরে গেছে সেই থেকে।
আগেরবার বিধান রায় তড়িঘড়ি দার্জিলিং থেকে ফিরে তুলে নিয়েছিল লেভি অর্ডার। এবার বুড়োহাবড়া কংরেসের তলানিরা টেরই পায়নি যে পথে-পথে নেমে পড়েছে কচি ছোকরার রাগি দল।
ভবেশকা বললে, পচা গাছডারে শিকড়সুদ্ধ উপড়াইয়া ফেলার এই-ই সুযোগ। এবিটিয়ে, ওয়েবকুটা, বারো জুলাই, এসেফাই, পিয়েসিউ, এয়াইয়েসেফ, ডিয়েসো, সিটু, কোঅর্ডিনেশান, কিসান সভা, এসপ্লানেড ইস্টে মিলে-মিশে একাক্কার।
বিবাদি-পাড়ার সরকারি আর সওদাগরি অফিসের চাকরেরা আওয়াজে-আওয়াজে কালা হয়ে যেতে লাগলো বলে ওখানে লাউডস্পিকার বাজানো বন্ধ করে দিয়েছে হাইকোর্ট। তা সত্ত্বেও চাষাভুষোরা মহাকরণে কাজে এলে কেরানিরা তাদের অনুরোধ-উপরোধ আর শুনতে পায় না। স্ফিংকসের মতন বোঁচা-নাকে বোসথাকে।
তখন ভবেশকার গড়নপেটনের আদলে দিকে-দিকে শ্রমিক-কৃষকের ছবি এঁকেছিল বড়ো দেবুদা। সেই থেকে লালশালু হলে দেয়াল-পেন্টাররা ওরকমই শ্রমিক আঁকে। এমনিতেও, যদিও বাঙালি শ্রমিকগুলো প্যাংলা, বেঁটে আর রুগ্ণ।
আবার এরকম ছবিও আঁকা হয়েছিল, মঞ্চে মাইকের ডান্ডা বাঁ হাতে আর আকাশের দিকে ডানহাত, বক্তৃতা দিচ্ছে ভবেশকা। অবস্হান, অনশন, ফেস্টুন, শ্লোগান, ওঃ, সরকারের ধনুষ্টঙ্কার হয়ে গেল।
ভবেশকার গরিমা তখন দ্যাখে কে। বসিরহাটে মহকুমায় হামলা। নেতৃত্বে ভবেশকা। কৃষ্ণনগরে স্টেশনে আগুন। নেতৃত্বে ভবেশকা। মদনপুর, পায়রাডাঙা, বিরাটির এলআইসি, স্কুল পর্ষদ, উদবাস্তু পুনর্বাসন দপ্তর তছনছ। নেতৃত্বে ভবেশকা। রামরাজাতলায় বম্বে মেল থামিয়ে আগুন। নেতৃত্বে ভবেশকা।
কৃষ্ণনগরে পুলিশের গুলিতে মরা আনন্দ হাইতের শব মর্গ ভেঙে বের করে মিছিলের আগে-আগে ভবেশকা। ভবেশকার নির্দেশে, যে যেখানে মরেছিল, রাস্তায় গলিতে পার্কে মাঠে, লাল সিমেন্টের দেড় বাই আড়াই ফুটের শহিদ বেদি বানানো হচ্ছিল সেদিনকেই। অনেক জায়গায় শহিদ বেদির বদলে রাস্তায় হাম্প তৈরি হয়েছিল।
তারপর ব্যাস, ছেষট্টির খাদ্য আন্দোলনের একদিন সকালে পাড়ার সবাই টের পেল, ভবেশকা রাত্তিরে ফেরেনি। কিন্তু খুশিদিও বাড়িতে নেই। আগের দিন সন্ধে থেকেই দেখা পাওয়া যায়নি ওদের। কলোনির লোকেরা কত জায়গায় খুঁজল ওদের। কোথাও ওদের লাশ পাওয়া গেল না ; হাসপাতালে, থানায়, মর্গে।
কত জায়গায় সাইকেলে চেপে খোঁজ করেছিল যিশু, দিনের পর দিন। ভোরে তিলকনগর, সকালে পোদ্দারনগর, দুপুরে নেলিনগর, বিকেলে বাপুজিনগর। না, কেউ ওদের খবর জানে না। কেউ দেখেনি ওদের। অমন চটক আর গা-গতর, কেউ তুলে নিয়ে যায়নি তো খুশিদিকে, মা বলেছিল বাবাকে। খুঁজতে-খুঁজতে, নিজের প্রগাঢ় অনুভূতির ক্ষত আবিষ্কার করে কেঁদে ফেলেছিল যিশু, একা-একা দাশনগরের কাঁচা রাস্তায় দাঁড়িয়ে।
আর ভবেশকা-খুশিদি কিনা এখানে, কলকাতার এত কাছে, মুণ্ডেশ্বরী নদীর ধারে এই শেষপুকুর গ্রামে, সেই থেকে। কলকাতা থেকে টানা গাড়িতে সারাতি, তারপর ভ্যান রিকশায় গোপের হাট। চাঁপাডাঙা ওব্দি ট্রেনে এসে ম্যাক্সিট্যাক্সিতে সারাতি আসা যায়। ভবেশকা কিনা এখানে। কলকাতায় যায় নিশ্চই। প্রথম পোড়ানো ট্র্যামের ছাই মেখে বাঙালির যে নতুন সৎসমাজ, ভবেশকা আজ তার অগুন্তি সন্তানদের একজন।
কীইইইইরে, রোদ উঠে গেল, ক্যাঁদরা গায়ে দাঁড়িয়ে আছিস ঠায়, যা দাঁত মেজে নে।
কন্ঠস্বরের জলতরঙ্গে ধ্বক করে উঠেছিল যিশুর হৃৎপিণ্ড। চ্যাটা খোঁপায় যিশুদি। হ্যাঁ, সকাল বেলাকার, রোদ্দুরে তার প্রাতঃভ্রমণ সেরে ফেলেছে। পুকুরে ভাসছে মাদুরকাঠির মতন চিকচিকে রোদ। পাঠরত স্কুলবালকের মতন দোল খাচ্ছে সুপুরি গাছের ঝাঁকড়া মাথা। যিশু বলল, তোমার গলার আওয়াজ অবিকল সেরকমই আছে খুশিদি ; তুমি একটুও বদলাওনি। চলো না, আজকেই চলে যাই।
না না না না না না না না। খুশিদি স্পষ্টত আতঙ্কিত।
অ্যাতো কীসের ভয় খুশিদি। এই বয়সেও ভয় পাও!
ভয় তোর জন্যে। আমি বড্ডো অপয়া। তোর যদি বিপদ হয়। বৈশাখী পূর্ণিমার মেলার ভিড় যেদিন থাকবে, অনেক লোকের ভিড় হয়, তখন যাওয়াই ভালো। টের পাবে না কেউ। কলকাতা থেকে টানা গাড়ি আনিস। ঘোমটা দিয়ে নেব।
এখন তোমার গা থেকে তোমার মতন গন্ধ বেরুচ্ছে না। ভয় পেয়েছ বলে।
আমার মতন গন্ধ? আছে বুঝি? পঞ্চায়েত প্রধান আচে না? অসীম তালোধি ওর মেয়ের ভুতের ব্যারাম আচে। দাদা ওষুদপথ্যি করে। রোগবালাই ঝাড়ার জন্যে রাসপা ত্রিফলা হিং রসুন শুঁঠ নিসিন্দে কুঁচিলা বেড়ালা হোত্তুকি চিতেমূল সব বাটছিলুম একসঙ্গে। বোধয় তারই গন্ধ পাচ্ছিলি। বাটতে-বাটতে কালকের মন্তরগুনো, যেগুনো আমার জন্যে বলছিলিস, মনে পড়ে গেল। তাই দেকতে এলুম অ্যাতোক্ষুণ ধরে ঘাটে কী কচ্চিস।
ভবেশকা ঝাড়ফুঁক করে বুঝি? অদ্ভুত। কোথায়, ভবেশকা?
দাদা তো বেরিয়েচে। কাজ ছিল কি? দুপুরের আগে ফিরবে না।
তাহলে এসো। খুশিদির হাত শক্ত করে ধরে যিশু। এসো আলচাষির আর চাষের গল্প করি। অভিভূত হাতের পর্যটনপ্রিয়তার কাছে সমর্পিত, স্পর্শে অবহিত হয়ে ওঠে দেহ। মুগ্ধ যিশু গলা নাবিয়ে বলল, যদি জানতুম তুমি এই গ্রামে আছ, তাহলে বাঁকুড়া বীরভূম বর্ধমান মেদিনীপুরে অযথা সময় নষ্ট করতুম না। এসো।
.
০৮.
শেষপুকুরের হিমঘর কখনও মুসুলমান মালিকের ছিল। শাজাহানের তাজমহলের মতন হিমঘরটাকে দ্বিতীয় বেগমের স্মৃতিমন্দির করেছিল লোকটা। হিমঘরের পেছনের মাঠে স্বামী-স্ত্রীর কবর, ইঁটের দাঁত-বেরোনো, ছাগলছানারা ওটায় চড়ে লাফ খেতে শেখে। লোকটার ছেলে দেশত্যাগের কাটাকাটির সময়ে গায়ে হাতে পায়ে ছোরাছুরির চোট নিয়ে পাকিস্তানে ভৈরব নদীর ধারে পালিয়েছিল। ভবেশকার সঙ্গে ওর যোগাযোগটা ভবেশকার নাছোড় অধ্যাবসায়ের ফসল।
বর্ধমান থেকে আরামবাগ হয়ে সারাতি পৌঁছেছিল যিশু। আসার দিনই দেখেছিল, তারকেশ্বর-আরামবাগ রোডে চারটে করে আলুর বস্তা সাইকেলে চাপিয়ে সার বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে প্যাংলা গলদঘর্ম ছেঁড়ালুঙ্গি খালি-গা চাষিরা।
চাষির কাছ থেকে ফ্যালনা দামেও আলু কেনার লোক নেই। চাষি ধারে বেচবে ছোটো আড়তদারকে, ছোটো আড়তদার বড়ো আড়তদারকে, বড়ো আড়তদার শ্যালদার কাঁচাবাজার কিংবা বড়োবাজারের পাকাবাজারকে।
চাষিরা আর ছোটো আড়তদাররা কবে যে টাকা পাবে তার ঠিক নেই। আলুর চেয়ে খড়ের আশি আঁটির দাম বরং বেশি। আলু বিকোচ্ছে না। এদিকে খড়ের দাম চড়ছে। আলু বিকোয়নি বলে চাষিরা বীজ আলুর ঋণ শোধ করতে পারেনি। ছোটো আড়তদাররা বীজ আলুর টাকা আদায় করতে না পেয়ে অসহায়। ধরট নিতে চাইলেও এগিয়ে আসছে না কেউ।
প্রশ্ন তুলে উত্তরটা লিখে নিতে দেখলে, কুন্ঠিত-সঙ্কুচিত হয় গাঁয়ের লোক। লেখালিখিকে সন্দেহ করে সবাই। বুকপকেটে একটা ছোটো টেপ রেখেছে যিশু যাতে কেউ টের না পায়। যারা অভিযোগ জানাতে চায়, তাদের জিগ্যেস করতে হয়। কোন চাষির দুঃখের বোতাম কোথায়, আঁচ করে টিপলেই, গল-গল করে বেরোতে থাকে ক্রোধ কষ্ট দুর্দশা হতাশা গ্লানি অভিশাপ।
চাষির অভিশাপ একদিন ফলবেই, চাষিরাই বলে সেকথা।
বড়োতাজপুরের মামুদ মাফুজ। আগে তো লোডিঙের সময় থেকেই আলুর দর চড়ত। বণ্ডের ব্যামো ধরিয়ে দর কমিয়ে দিলে। আমরা কিচু বুঝিনে? ঘোড়ার ঘাস খাই? ওই তো, আলু চাষের জন্যে ঋণ নেয়নি শ্বেতলেশ্বর গাঁয়ের সমবায় সমিতি। তাদের সদস্যরা বণ্ড পেলে কী করে? হাঃ। আমাদের কাচ থেকে সংরক্ষণ বাবদ বাড়তি ট্যাকা আদায় হচ্ছে। অথচ মহাজন আর ফড়িয়া দালালরা চাষি সেজে বণ্ড পেয়ে গেল। ভক্তিপদ কুণ্ডুর চার হাজার প্যাকেট ঢোকানো হয়েচে, ইদিকে এক ডেসিমাল জমিও নেই। হাতে-পায়ে কুঠ হয়ে মরবে যত বেজন্মার দল, এই আমি বলে রাকচি।
খিলগাঁয়ের ক্ষুদিরাম ঢাং। এবছর শীত পড়েছিল টানা, না কী গো? বিষ্টিবাদলা ঝড়ঝাপটা হয়নে। হাওয়াটাও শুগনো ছিল এবার। তা বোরো চাস তো হবে নে। আর গেল বছর আলুর দাম উটেছিল ভালো। ভেবেছিলুম, আলু তুলে সব ধার-দেনা মিটিয়ে দিতে পারব এবার, ওই যে দেকুন না, ওই চালটাও সারিয়ে নিতুম, মেজো মেয়্যাটার বিয়ের জন্যিও জমাতে পারব কিছু ট্যাকা। কিচ্ছু হল নে। আমাদের দেকার কেউ নেই। আমাদের কতা শোনার কেউ নেই। কীটনাশক খেয়ে মরতেও ভয় করে গো বাবু।
বেলসলিয়ার আচেরুদ্দি মল্লিক। দেখেন না কেন, বাড়িতে সকাল থেগে উটে কাজ হয়েচে পচা আলু আর ভালো আলু আলাদা করার। নিত্যি দিন। আলুর তো পাহাড় জমে গেচে।পচা বাছতে বেলা হয়ে যায়, তাপপর দাগ ধরলিই কেটে-কেটে গরু-ছাগলকে খাওয়াচ্চি। গরুগুনোও আর আলু খেতে চায় না। আগে তো টানের সময়ে দাগি আলুও কাঁচাবাজারের মহাজন নিয়ে যেত। রাত্তিরে আলুর পাহারাও হয়েচে ঝকমারি। ছেলে দুটোর রাত জেগে-জেগে শরীর বেগতিক হয়ে গেল। ওর মায়ের হাত দুটো দেকুন। দেকাও হাত দুটো, দেকাও, দেকাও না, লজ্জাশরমের কী, উনি তো হালিম-কালিমের চেয়েও ছোটো। দেকুন, পচা বেছে-বেছে হাতময় দানা বেরিয়ে গেচে।
হালিম মল্লিক। আমাদের গাঁয়ে পচা আলুর নাম হয়েচে কলিমালু, নেতার নামে। আলুর গোলমালের জন্যে মুখ্যমন্ত্রী ওনাকে ওননো বিভাগে পাটাচ্চেন শুনলুম।
বাদলাপুরের দেবেন জানা। চল্লিশ বছর আগে দার্জিলিঙের বিজনবাড়িতে আলুর ধসা রোগ হয়েছিল, বুঝলেন বিশ্বাসদা। কেন্দ্র সরকার তখন পশ্চিমবঙ্গ থেকে অন্য রাজ্যে আলু পাঠানো বন্ধ করে দেছলো। তা সে অর্ডার তোলবার কারুর খেয়াল হল না অ্যাদ্দিনেও। তেনারা পোঁদে তেল দে ঘুমুচ্চেন। ইদিকে অন্ধ্র উড়িষ্যা থেকে তো ফি বছর আলু এসছে এখানের বাজারে। এখান থেকে নুকিয়ে-নুকিয়ে গেছে সিকিম ভুটান আসাম। লাগ-লাগ টন আলু পচার পর এখুন অর্ডার তোলার কাগজ বেরুচ্চে বলে শুনিচি। কেন্দ্র সরকারে জহোর্লালের টাইম থেকে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের লোক নেই। জহোর্লাল দিনকতকের জন্যে চারু বিশ্বাসকে মন্ত্রী করেছিল, তাও ফ্যালনা। নেতাগুনোর বাপের দুটো করে বিয়ে। তাই বিমাতা-বিমাতা করে নাকে কাঁদে।
খাগড়াপাড়ার সত্যনারায়ণ সামান্ত। আমি স্যার দিসি উপায় করিচি। এই বটগাছতলায়, ওই যে, ওখেনটায়, আড়াই ফুট গত্তো খুঁড়ে প্রথমে বালি, তার ওপর কীটনাশক ছড়িয়ে আট কুইন্টালটাক আলু রেকিচি। তার ওপর আড়াআড়ি-লম্বালম্বি খড় বিছিয়ে আবার ওষুদ ছড়িয়ে দিইচি। ওই ইঁটের পাঁজা চাপিয়ে ঢেকে দিইচি। তিনচার মাস তো অন্তত থাগবে। তারপর কপাল। ঠাকুরের যা ইচ্ছে তাই হবে। কত দৌড়োদৌড়ি কল্লুম। এক প্যাকেট মতনও জায়গা পেলুম না। পঞ্চায়েতের কোটাও পেলুম না, সরকারি কোটাও পেলুম না। আর কত দাম ধরে মালিকের কোটা নিতে গেলে আমাদের মতন চাষির পুষোবে না। জেলাসদরে বল্লে, মন্ত্রীর ঠেঙে চিটি আনো, থালে সরকারি কোটা পাবে। কাকে ধরি? বলেন। তাই এই উপায় করিচি। ইদিকে সেলসিয়াস আবার চল্লিশে চড়তে চলেচে।
গুপ্তিপুরের বুড়ি। আলু-পচা আন্ত্রিকে নাতি মারা গেচে। নিববংসো হবে, অ্যাই বলে রাগলুম। যমে নেবে, যমে নেবে।
খড়ি নদীতে জোড়া-নৌকোর মাচানে দাঁড়িয়ে কুতিরডাঙার অক্ষয় ঘোষাল। আলু পুরটসুন্দরদ্যুতি কদম্ব সন্দীপিতঃ সদ্য পকেটকন্দরে স্ফূরতুবঃ হিমঘরনন্দনঃ।
বড়োপলাশনের শ্যামদাস প্রামাণিক। দশ প্যাকেট আলুর জন্যে মাসে এক প্যাকেট সুদ। অতিষ্টো করে মাল্লে। পাপের ভোগান ভুগতিই হবে।
ষাটপলনের কেষ্ট দেবনাথ। দাদা সিপিয়েম করে, আমি ফরোড ব্লক করি, ভাবছি এবার তৃণমূলে যাবো। আমি না পেলে দাদা। দাদা না পেলে আমি। কেউ তো বন্ড পাবো। তাছাড়া কৃষি বিপণন আর সমবায় তো সিপিয়েম দলের হাতে। আমাদের অসুবিধা তেমন হয় না।
জমিরাগাছির অনন্ত কুণ্ডু। আপনি একবার ভেবে দেখুন স্যার। ধান আর গমের বেলায় সংগ্রহমূল্য বছর-বছর বাড়িয়ে দিলে বলোরাম জাখড়। আলু কি জাখড়ের অ্যাঁড়, অ্যাঁ? তা কেন সংগ্রহ করবে না সরকার? তার কেন সংগ্রহমূল্য হবে না? বলুন আপনি। আলুও তো ক্যাশ ক্রপ। আসলে পঞ্জাব আর হরিয়ানার বেলায় দরোজা হাট করে খোলা। আমাদের বেলায় পোঙায় লাতি।
এর আগে অনেক প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থেকেছে যিশু। কত কারখানা আর ব্যবসা দাঁড় করিয়ে দিতে সাহায্য করেছে মোদি গোয়েঙ্কা মল্ল ভারুচা খান্না খৈতান লালওয়ানি কেশওয়ানি মাহিন্দ্রা শিল্পপতিদের। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের। স্রেফ মগজ খাটিয়ে। এরকম অভিজ্ঞতা হয়নি আগে। পেরু না বোলিভিয়া কোথ্থেকে এসে বাঙালি জীবনে ঢুকে পড়েছে নির্বিকল্প আলু, পর্তুগিজদের অবদান।
আলুহীন পৃথিবী ভাবাই যায় না। বেলে কিংবা পলি দোআঁশ অল্প-টোকো জমিতে মখমল মাটির লেপ চাপা দিয়ে কেমন ডিম্বাশয় গোলগাল, তিন থেকে পাঁচ মাসের মধ্যে গভীর আয়ত চোখে ভূমিষ্ঠ হয় চন্দ্রমুখী আলু। ভূমিষ্ঠ হয় জ্যোতি অলঙ্কার কুন্দন সিঁদুরি নবীন সফেদ কুমার বংশের খোকাখুকু যুবকযুবতি। এদের অনেকে চন্দ্রমুখীর সদবংশের নামে পৌঁছোয় বাজারে। ভিজে হাওয়া আর কুয়াশা সহ্য হয় না ওদের। নাবি, ধসা, ভুষা, সাঙ্কোষপোরা রোগে ধরে। বড্ডো সুখী ওরা, তাই উই পোকা, পিঁপড়ে, কাটুই পোকা, লাল বিটল, জাব পোকা, থিপস, সাদা গ্রাব, সুতলি পোকার দলবল সুযোগ পেলেই ওদের শীতের রাত্তিরে জাপটে ধরে। ওদের আঃ উঃ লক্ষ্মীটি পায়ে পড়ি, প্রাণে মেরো না, বাঁচাও-বাঁচাও নিঃশব্দ চিৎকার মাঝরাতে মাটিতে কান পেতে শুনতে পায় আলমপুর গ্রামের কাশীনাথ মাইতি। টাকার মতন আলুও বহুবল্লভা।
সে আলু, পচলে যে আটদশ কিলোমিটার পর্যন্ত বাতাসের দখল নিয়ে নেবে, নানা রকমের মাছি আর উনকিকে দূরদূর দেশ থেকে নেমন্তন্ন করে ডেকে আনবে, সোহাগ পেতে, সে অসহ্য দুর্গন্ধের সঙ্গে গতবছর বৈশাখে পরিচিত হল যিশু, পরপর কয়েকটা হিমঘরের তথ্য যোগাড় করতে গিয়ে। ওফ, নরক, নরক।
শীতযন্ত্র বিকল হয়ে গিয়েছিল পোলবা দাদপুরের বালিকুখাড়ি সমবায় হিমঘরে। পচে জল হয়ে গেল আলু। পাঁচ হাজার চাষি পরিবার সর্বস্বান্ত, রিপিট, সর্বস্বান্ত, লিখে রেখেছে যিশু। চাষিরা হিমঘরের সামনে গিয়ে ধরনা দিচ্ছিল বলে একশো চুয়াল্লিশ জারি হল। একদিকে হিমঘরের লোকেরা আরেক দিকে চাষিরা। সে কী হাতাহাতি মারামারি লাথালাথি। চুঁচড়ো থেকে বিরাট পুলিশপার্টি গিয়ে লাঠিপেটা করে বাগে এনেছিল। দিনদুপুরে মশারির মধ্যে বসে ল্যাপটপ খুলেছিল, অ্যাতো মাছির ঝাঁক। না খেয়ে ছিল বারোঘন্টা, নিরম্বু। তারপর পালিয়েছে। কত জনের যে হাঁপানি ধরে গেল কে জানে। চারটে চাষির বাড়িতে সাতটা বাচ্চা মরেছিল আন্ত্রিকে। অনেকের গা-ময় দাগড়া দাগ বেরিয়েছে, গাঁয়ের বদ্যিরাও তার ওষুধ জানে না।
দুর্গন্ধ সৃষ্টি করায় মানুষের জুড়ি নেই। যত উন্নতি, তত আবর্জনা, তত নোংরামি, তত দুর্গন্ধ।
গোস্বামীমালপাড়ার হিমঘরে সাতষট্টি হাজার প্যাকেট নষ্ট হয়েছিল। গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য হালিম মাজেদ ছিল জেলাশাসকের আপিসে, কোনো কাজে। বললে, বিমার টাকা উশুল করেও হিমঘর সমিতি বিমা করায়নি। চোত মাসে বিমা কোম্পানির লোক এসেছিল, কিন্তু কম ভোল্টেজে যন্তর বিকল হয়ে আলু পচার ভয়ে বিমায় রাজি হয়নি। বেলমুড়ি থেকে বিজলি আসে টিমটিম করে। দুটো জেনারেটর, তা দুটোই পড়ে আচে ভেঙে। হিমঘরের সহসভাপতি মহম্মদ জাকারিয়া বলেছিল, কিচু আলু বাঁচানো যাবে। তা বাঁচানো যায়নে কিচুই। নির্বাচন এসে পড়েছিল বলে মজুর-কামলা-মুটিয়া পাওয়া যায়নে। এলেকশান এলে কিচু পয়সার মুখ দেখতে পায় ওরা।
পচে হালুয়া হয়ে গিসলো আলু। অমন সুন্দরী চন্দ্রমুখী কন্দ নিজেরা পচেছে, থলেগুলোকেও পচিয়েছে। আলুর পাহাড় থেকে আগ্নেয়গিরির পচা লাভাস্রোত। আশপাশের ভাদিলপুর, দেপুর, কেয়োলপার গাঁয়ের লোকেদের পাতলা পায়খানা আর ভেদবমি থামতেই চায় না। প্রাণ একেবারে অস্হির, আইঢাই, কাহিল। সরকারি স্বাস্হ্যকেন্দ্র এই আলুপচা রোগ সারাতে বিফল। হিমঘরের বাইরে পচা আলুর কাই কেঁখে ব্লিচিং পাউডার ছড়ানো হয়েছিল। দুর্গন্ধ আর একরোখা মাছি যায়নি তবু। পচা আলুর গ্যাস বের করতে ছেঁদা করা হয়েছে দেয়াল। তবু হিমঘরে গুমরে মরছে পচা আলুর শবের বদগন্ধ।
কলকাতায় তখন বিদেশি সিনেমার উৎসব চলছে। বিটকেল নামের পরিচালকদের হাফল্যাংটো ছবি দেখার জন্যে হাড়হাভাতে বিদ্বানদের দাঁতকেলানে লাইন।
আর আলু যেটুক বেরোতে পেরেচে, বলেছিল বালিকুখাড়ির লুৎফর রহমান, এমনভাবে চাষিবাড়ির ছেল্যামেয়্যার পেচনে লেগেচে বাবু, যে ওঝা ডেকেও ছাড়চেনে। বিষ্টি পড়লে আর দেকতে হবেনে। আলুর গুয়ের বান ডাকবে। নিমাই ঢোলের মিষ্টির দোকান একমাস বনদো।
কালনার বংশীধর হিমঘরে বীজ আলু পচে গেছে। হিমঘরের ভাড়া জমা দিয়ে গেটপাস পাবার পরও বীজ আলু দিলে না। অ্যাতোটা পথ এসে চোপোররাত হয়রানি। একদিন তো চারঘন্টা রাস্তা অবরোধ হল। হয় বীজ দাও নইলে দাম দাও। হিমঘরের চাকরেবাবুরা গণপিটুনির ভয়ে টেবিলে খোলা কলম ফেলে হাওয়া। শয়ে-শয়ে চাষি জড়ো হচ্ছে আর গলার শিরা ফোলাচ্চে। ভবভূতি কপালি জমি তৈরি করে, ছেলেকে বীজ আনতে পাঠিয়েছিল। শক্তি সরকার পাওয়ার টিলার ভাড়া নিয়ে, জমিকে দিন দশবারো পতিত রেখে, জল কমপোস্ট রেড়ির খোল নিমের খোল দিয়ে, জো বুঝে মাটি ভেঙে আলু বোনার নালা কেটে ফেলেছিল। অলড্রিন আর ব্রাসিকল এনে রেখেছে। তারপরই বজ্রপাতের মতন সর্বনাশা খবর। আলুর মড়কে বীজ নষ্ট। দিন দশের মধ্যে না পাতলে ফলন হবে না।
দুজনেরই করোনারি থ্রমবোসিস, আলুপচা রোগে, বললে সদর হাসপাতালের ডাক্তার।
মুটিয়া মজুর সর্দারদের ভাগা আর কমিশন থেকে কাটমানির নিষ্পত্তি না হওয়ায় বীজের আলু বাইরেই পড়েছিল টানা পনেরো দিন। বীজ আলু হল চাঁপা ফুলের পাপড়ি। অযত্ন ওদের সহ্য হয় না। তিন নম্বর চেম্বারে তিরিশ হাজার প্যাকেট বীজ আলু নষ্ট হল। এক চাষির বীজ অন্যকে দিয়ে যদ্দিন চলে চালিয়েছে। দিতে-দিতে ফুরিয়ে গিসলো। আলুর অদৃষ্ট, চাষির অদৃষ্ট।
কিন্তু আলুর গপ্পো নিয়ে তুই কী করবি রে? বলল খুশিরানি মণ্ডল।
ভবেশকা অ্যাতো সম্পত্তি আর টাকা নিয়ে কী করবে, বলো তুমি, অ্যাঁ? সেই ভবেশকার এমন ভুঁড়িটুড়ি, ঠাকুরদেবতা, ঝাড়ফুঁক, দলাদলি, আলখাল্লা, ওফ, আমি তো ভাবতেই পারি না। ট্র্যামের ভাড়া এক পয়সা বেড়েছিল বলে, আর আলু পাওয়া যাচ্ছিল না বলে, কী-ই না করেছিল ভবেশকা। ভবেশকাকে দেখছি আর মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। গেরুয়া, বাবরিচুল, সত্যসাঁইবাবা, মাদুলি, গোমেদের আঁটি, জলপড়া। আধুনিক লোকটার তো দফারফা। কেন, অ্যাঁ, কেন?
যিশু জানে খুশিদি অবোধ, নিষ্পাপ, অজ্ঞান, তাই নির্বাক।
তোমার জন্মের সুবর্ণ জয়ন্তীতে ভবেশকা তোমায় একটা ভারি কালো লোহার শেকলে আষ্টেপৃষ্টে আগলে রেখেছে, রুমালে চোখ বেঁধে। কত চাষির আলু নিশ্চিন্তে পচিয়ে ফেললে ভবেশকা। পঞ্চায়েতের যে পঁচাত্তর শতাংশ বন্ড তা-ও গোলমাল হয়েছে, কালোবাজার হয়েছে, আর মালিকদের কুড়ি শতাংশ তো সোজা বেচে দিয়েছে পাকাবাজারে। এমনকী চাষির বন্ডেও ভবেশকার সই না থাকলে হিমঘরে তোলা যাবে না। সেই ভবেশকা, ভাবতে পারো তুমি! বুকের মধ্যে চব্বিশঘন্টা বারোভুতের মেলা চলছে ভবেশকার।
জানি। খুশিদির চোখের পাতা কাঁপে।
খুশিদি কেঁদে ফেলবে। যিশুর হৃৎপিণ্ডের কপাটক ফরফর শব্দ করে নিঃশব্দে। ভবেশকার প্রসঙ্গ পালটায়। বুঝলে, বীরভূমে ষাটপলসা হিমঘর চালানো নিয়ে সে কী খেওখেয়ি। হিমঘর সমবায় সমিতির চেয়ারম্যান বিশ্বনাথ দাশ আর বাদবাকি সদস্য রেবতী ভট্টাচার্য, অম্বিকা দত্ত, জনার শেখ এরা হল ফরোয়ার্ড ব্লকের, কিন্তু আরেক সদস্য মিনতি ঘোষ, যিনি পঞ্চায়েত প্রধান, তিনি সিপিয়েমের, এখন পালিয়েছেন তৃণমূলে। সমবায়ের পাঁচ লাখ টাকার হিসেব মিলছে না অভিযোগ তুলে বিশ্বনাথ দাশ বরখাস্ত করলে সহকারি ম্যানেজার শিশির ঘোষ আর ক্যাশিয়ার বৈদ্যনাথ মণ্ডলকে। ব্যাস, আর দ্যাখে কে ; বেঁধে গেল দু-দলের কাজিয়া। ময়ূরেশ্বরের সিপিয়েম সভাপতি ত্রিপুরেশ্বর মণ্ডল দখল নিলে চেয়ারম্যানের কুরসি। আদালতের হুকুমে বিশ্বনাথ দাশ ফিরে পেয়েছে চেয়ার। এই আলুমন্হনের বিষের ভাগটা চাষিদের।
জানি, এখানেও সিপিয়েম, তৃণমূল, কংরেস আর বিজেপি হয়েচে। সবাই মিলে একটা নাম নিলেই তো হয়। চাপা কান্নায় খুশিদির অন্যমনস্ক কন্ঠস্বরে ভাঙন।
গল্পের রেশ থামলে খুশিদির আপ্রাণ ধরে রাখা অশ্রুবিন্দু টপ করে ঝরে পড়বে আর যিশু চেতনায় ঘটে যাবে বিস্ফোরণ।
কথা বলা বজায় রাখে ও, যিশু। পুরশুড়ার হরপার্বতী হিমঘরে কী হয়েছে জানো না? দেড় কোটি টাকার আলু পচিয়ে, বিদ্যুৎ পর্ষদের কয়েক লক্ষ টাকার বিল না মিটিয়ে, পুরোনো মালিকরা নতুন এক ব্যাবসাদারকে চুপচাপ হিমঘর বেচে দিয়ে পালিয়েছে। চাষিদের ক্ষতিপূরণ যে কে দেবে বা আদৌ দেবে কিনা, কেউ জানে না।
নতুন মালিক পচা আলু বাইরে বের করে পোড়াচ্ছিল। সেই তেল-চিটচিটে ধোঁয়ায় গোলাপজাম আর জামরুল ওব্দি পাকা জামের মতন কালো হয়ে গেছে। পুরশুড়া পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পতিতপাবন জানা শেষে গিয়ে আলু পোড়ানো বন্ধ করলে।
খুশিদির ম্লান মুখাবয়বে তবু পরিবর্তন নেই।
যিশু বলল, এবছর মোহনবাটির হিমঘরে অ্যামোনিয়ার ট্যাঙ্ক ফুটো হয়ে সোমথ্থ পাটগাছগুলো অজ্ঞান হয়ে গিসলো।
খুশিদির ভাব পাল্টাচ্ছে না দেখে যিশু দুবাহু ধরে চোখে চোখ মেলে জানায়, মিছেই এসব গল্প করছি। তুমি কি কিছু বলবে? খুশিদি? বলবে কিছু?
.
০৯.
সন্ধ্যা। চাঁপাডাঙা লোকাল থেকে হাওড়ায় নেমেই সুটকেস হাতে দৌড় লাগাতে চাইছিল যিশু। পারছিল না। রাস্তা আটকে ধিরে-ধিরে হাঁটছে ফণাতোলা সাপের মতন সতত উদ্যত নিতম্ব, একগাদা, নানা আদল আর আদরায়। সামান্য ফাঁক পেতেই পাশ কাটিয়ে আবার দৌড়োয়।
একজন ষণ্ডা পুলিশ অফিসার আচমকা ওর বাহু আঁকড়ে থামাতে, রক্ত চলকে ওঠে হৃৎপিণ্ডে। পায়ের পাতা, আঙুলসুদ্দু, শিরশির করে ওঠে মোজার ভেতরে, ভয়ে, গলায় শ্লেশ্মা উথলোয় হঠাৎ। কোনো অপরাধ না করেও অপরাধের বোধ মগজে ঘুরঘুর করে ওর, মুহূর্তে মনে হল যিশু বিশ্বাসের।
সম্বিতস্হ হয়ে যিশু থ আর ক্রুদ্ধ। আদিত্য। সঙ্গে অরিন্দম, বিটকেল জুটি।
আদিত্যর ভিড়-জমানো অট্টহাস্য, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ ওফ ভয় পান পুলিশকে! কী কেলেঙ্কারি করে ফিরছেন দাদা? অ্যাগবারে চোখকান বুজে দৌড়োচ্ছিলেন। তা কই, কোনো কেটলিবাই বা খুন্তিসুন্দরীকে তো দেখছি না। ওপাশ দিয়ে সটকিয়ে দিয়েছেন?
হাত ঝাঁকিয়ে ছাড়ায় যিশু। শ্যাঃ, এরকম ইয়ার্কি ভাল্লাগে না। অরিন্দম, তুমি আবার অপর্ণা সেনের মতন মার্কেটেবল হাসি দিচ্ছ কেন?
আদিত্য পাছায় দুহাত, পেছনে ঝুঁকে, জিভের ডগা মুড়ে কথা বলার কায়দা, পুলিশে চাকরি পেয়ে শিখেছে, বজায় রাখে। ওঃ হোঃ হোঃ হোঃ, নির্ঘাৎ কিছু গোলমাল করে ফিরছেন আটপুর জাঙিপাড়া থেকে, বলে দিন দাদা, বলে দিন, আমরাই বাঁচাব, আমরাই হলুম গে রোকখোক আর ভোকখোক।
আরে ট্যাক্সি ধরতে ছুটছিলুম, কেঁচিয়ে দিলে। চলো, একটা ট্যাক্সি পাইয়ে দাও। সুটকেস প্ল্যাটফর্মে রেখে, সিগারেট বের করে ধরায় যিশু, তারপর খেয়াল হওয়ায়, এগিয়ে দ্যায় আদিত্যর দিকে।
অ্যাতো টাকা রোজগার করেন, একটা গাড়ি কেনেন না কেন?
গাড়ি? বাবা-মায়ের বিয়ের দিনেই গাড়ি কিনে দিয়েছিল দাদু, সেটা চুয়াল্লিশ সন। সে গাড়িতে চেপে শ্রীরঙ্গমে শম্ভু মিত্তির বিজন ভট্টাচার্যের নবান্ন দেখতে গিসলো দুজনে, প্রথম দিনের শো। পরে তো শ্রীরঙ্গমের নাম হয়েছিল বিশ্বরূপা, এখন কাছাকাছি পার্ক করা যায় না। তা হল থেকে বেরিয়ে দেখলে গাড়ি হাপিস। আর পাওয়া যায়নি গাড়ি। বাবা আর গাড়ি ছোঁয়নি। আমিও বাবাকে ফলো করছি। গাড়ি রাখা আর চালানো কলকাতায় ঝকমারি, এমন তোদের গিরগিটি এসট্যাবলিশমেন্ট।
মানে? অন্য দিকে তাকিয়ে অন্য কিছু খোঁজায় মনস্ক, ধোঁয়ার টুসকি ঝেড়ে জানতে চায় আদিত্য।
গিরগিটির মাথা কখনও লাল, কখনও সবুজ, কখনও কমলা রঙের হলেও, গিরগিটিটা গিরগিটিই থাকে। তুই এসব বুঝবি না। অরিন্দম এখানে কেন? কেউ আছে-টাসছে নাকি?
হ্যাঁ, অরিন্দমদা অফিস থেকে দুদিন ছুটি নিয়ে বিহার থেকে আসা সব গাড়ি আমার সঙ্গে অ্যাটেন্ড করছে। অরিন্দমদার অফিসের এক পুরোনো বন্ধুর কলকাতায় আসার কথা আছে। লোকাল ট্রেনটা এখনও বিয়োচ্ছে, তাই চেঁচিয়ে কথাগুলো বলে আদিত্য।
অরিন্দমের বন্ধু তো তোর তাতে কি?
এককালে অরিন্দমদার সহকর্মী ছিল লোকটা। চাকরি ছেড়ে এখন গয়া পালামউ জাহানাবাদ হাজারিবাগে খেতমজুর খেপিয়ে বিপ্লব করছে। সে ব্যাটা ব্রামভোন।
তা করুক না ; তোর চাকরিতে তো বাধ সাধছে না।
আরে কলকাতায় আসছে অ্যাসল্ট রাইফেল বোমাফোমা কিনতে। শালা আর জায়গা পেলে না। লোকালের টুপটাপ বিয়োনো শেষ। নিত্যযাত্রীদের পচা কর্মসংস্কৃতির ঘেমো গন্ধ। মমমম।
ওওওওহ। তাই ফুল ড্রেসে চোর ধরতে বেরিয়েছিস, আর অরিন্দম এসচে খোচরগিরি করতে। যিশু কাঁধ নাচিয়ে হাসে।
আদিত্যর জিভের ডগা এখনও মোড়া। আরে এই সাবভারসিভ এলিমেন্টগুলো দেশের কাঠামোটাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে দিচ্ছে না। আগে তবু রঞ্জিত গুপ্ত, দেবী রায়, রুণু গুহনিয়োগীর মতন দায়বদ্ধ অফিসাররা ছিল। সেরকম ডেডিকেটেড অফিসার আর আজগাল কোথাআআআয়।
অরিন্দম গম্ভীর, নিরুত্তর। এরকম অনেকবার হয়েছে ওর। ওর উপস্হিতিতে ওর উদ্দেশে করা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে আরেকজন। লোকালটা বিইয়ে শেডে ফেরার ভোঁ।
বাড়ি ফেরার তাড়া, তার ওপর ক্লান্ত, দৌড়ে ট্যাক্সি ধরার ধান্দায় কুলি নেয়া হয়নি ; যিশু স্টেশানের ভিড়ে বিরক্ত। বলল, বেশি-বেশি পোঁদপাকামি করিসনি, বুঝলি। মরবি শেষকালে। ভদ্রেশ্বর থানার ওসি ভোলানাথ ভাদুড়ি, ডোমকলের কন্সটেবল তপন দাস, জয়নগরের এস আই অশোক ব্যানার্জি, ওদের মতন বেঘোরে মরবি। আর ডেডিকেশান সাবভারসান এসব কপচাসনি ফালতু। এই তো জুন মাসে, রায়গঞ্জ থেকে খড়-বিচুলি নিয়ে একটা ট্রাক শিলিগুড়ি যাচ্ছিল, তার ড্রাইভার অরুণ দাস তো ইসলামপুর থানার বেরাদরদের তোলা দিতে পারেনি বলে ওকে আর খালাসিটাকে আড়ংধোলাই দিয়ে ওদের রক্ত জবজবে মুখে মুতলেন তেনারা। ইটস আ ফ্যাক্ট, আই অ্যাম নট জোকিং। আমি তখন ইসলামপুরে ছিলুম। অন্য লরি ড্রাইভাররা জানতে পেরে যখন একত্রিশ নম্বর হাইওয়ে অবরোধ করল, তখন কেস গুবলেট করার জন্যে তোর ব্রাদাররা খালাসিটাকে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিলে পাশের চোপড়া থানায়। আমার কাছে খাপ খুলিসনি, বুঝলি। দুশো পাতার প্রজেক্ট রিপোর্ট প্যারা বাই প্যারা মুখস্হ বলতে পারি। ভুলে যেও না ইন্দিরা গান্ধি যে অভিশাপ কুড়োল তাতে নিজে তো গেলই, ছেলে দুটোও অপঘাতে মারা গেল। আর তোদের তো হেমেন মণ্ডল, শ্রীধর দাস, রাম অবতার, জয়চাঁদ শৈঠিয়া, রশিদ খান, বালা ভাগানি, রমেশ সিংদের মতন দায়বদ্ধ ক্যারেক্টার না হলে চলে না। যিশু, সংলাপের অস্বাভাবিক দ্রুততায় হতবাক করে ওদের দুজনকে।
ওদের ঘিরে বেগতিক জনতার আগ্রহ শুরু হওয়ায়, অপ্রস্তুত আদিত্য বলল, আপোষের স্তুতিময় কন্ঠে, আরে চটছেন কেন, চলুন-চলুন, ট্যাক্সি পাইয়ে দিচ্ছি। দেশভাগের পর আর ফলে, উত্তরঔপনিবেশিক ভিড়ের ঠ্যাঙাড়ে, খামখেয়াল, প্রতিদ্বন্দ্বীর যে কোনও একটা পক্ষকে গণশত্রুর ছাপ দিয়ে দিতে চায়। কাউকে শত্রূ ঘোষণা করার মধ্যে ঘোষকের আত্মপ্রসাদের হুকুমনামা থাকে।
বাঙালিজীবনে এখন শত্রু না থাকাটা অবক্ষয়। প্রেম, তার মানে, শুধু ঈশ্বরের জন্যে, পাথরের দেবী-দেবতার জন্যে, প্রকৃতির জন্যে।
অরিন্দম বিব্রত। গণশত্রু শব্দটা খাঁটি বাঙালির নয়। বলল, আর রাষ্ট কোনো নেড়েকে ধরলেই সন্দেহ হয় আজকাল, নির্ঘাত ফাঁসাচ্ছে।
পাশাপাশি হাঁটতে-হাঁটতে আদিত্যর যিশুকে প্রস্তাব, অরিন্দমদা আপনার আবিষ্কার-করা কেটলিউলির সঙ্গে পরিচয় করতে চাইছিল।
কেন? ওর কি নিজের মুখ নেই কথাটা পাড়ার? যিশুর পক্ষে রাগ করাটা ওর স্বাস্হ্যের পক্ষে জরুরি। কারুর দিকে না তাকিয়ে বলল, আগের নিজের বন্ধুদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করুক, মুচলেকা দিক, ধরিয়ে দিক, ভারতরত্নটত্ন পাক।
যিশুদা আপনি আমায় জানেন, তবু এমন কথা বলছেন কেন? আসার আগে আদিত্য আমায় কিছুই বলেনি। অরিন্দম স্বার্থপর আম-জনতা আর ফিচেল হাবড়ুস নিত্যযাত্রীর ধাক্কা, এড়াবার চেষ্টা সত্ত্বেও, খেতে-খেতে, যিশুর সুটকেস আদিত্যর হাতে, ট্যাক্সিস্ট্যান্ড পর্যন্ত তিনজন চুপচাপ হাঁটে। আদিত্যকে দেখে একজন সাদাপোশাক ভিকিরি বেঁকানো শিরদাঁড়া সোজা করে সেলাম ঠুকল। পোশাকের রাষ্ট্র-ক্ষমতার দাপটে আদিত্যকে জায়গা ছেড়ে দেয় লোকে। হাঁটেও সেভাবে আদিত্য। উত্তরআদর্শবাদী নবযুগের কমিসার।
কিউ-এর চেঁচামেচিকে দাবড়ে, আদিত্যর দরজা খুলে দেয়া প্রথম ট্যাক্সিটায় বসে, অরিন্দমের দিকে স্মিত তাকিয়ে, প্রশমিত যিশু জানায়, কেটলিউলি ঘৌড়দৌড় দেখতে চায় অরিন্দম, পরিচয় করিয়ে দেব, নিয়ে যাবেনখন রেসকোর্সে। নিজে গেছেন তো কখনও? না গিয়ে থাকলে রাসেল স্ট্রিটে খোঁজ নিয়ে শিখে নিন। ওখানে প্যাংলা আর পাঁড়মাতাল রেসুড়েদের কাছে ভালো টিপস পাবেন।
যিশু হাত নেড়ে চলে গেলে, আদিত্য অসংকোচে বলল, আচ্ছা অরিন্দমদা, আপনি তো ক্যানসারে বুককাটা প্রেমিকাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, সে এপিসোড শেষ, নাকি? না, মানে এমনিই জিগেস করছিলুম।
অফিস এক বছরের জন্যে ম্যানিলায় আমাকে ট্রেনিঙে পাঠিয়েছিল, জানো তো? এক বছরের ছাড়াছাড়িতে ব্যাপারটা কেমন যেন আপনা থেকেই চুকে-বুকে গেছে। আমি যখন ছিলুম না তখন অফিসে এ নিয়ে এমন ফিসফিস-গুজগুজ হয়েছিল যে ওর পক্ষে পিছোনো ছাড়া উপায় ছিল না। বেশিদিন বাঁচবে না, লিখেছিল আমাকে। সত্যিই বোধয় বাঁচবে না। রুগণ চেহারা হয়ে গেছে। আর তো কথাবাত্রাও হয় না। ও-ও এড়িয়ে যায়, আমিও এড়িয়ে যাই। একই অফিস বলে খুবই এমব্যারাসিং। ট্রান্সফার নিয়ে লখনউ চলে যাব ভাবছি। এখানে একদম ভাল্লাগে না। অরিন্দমের কন্ঠে পরাজয়বোধ। অসহায়তার ঘূর্ণিপাকে বুঁদ হয়ে সদাসর্বদা প্রেমে পড়ে থাকতে চায় ও। একজন নারীকে ছেড়ে আরেকজন নারীর কাছে পৌঁছোনো ওব্দি ও ছটফট করে, আতঙ্কের ঘোরে থাকে। থিতু হতে পারে না কোনও নারীতে। বয়স বেড়ে যাচ্ছে। ছোটো ভাই বিয়ে করে নিয়েছে। মা চিন্তিত। ম্যানিলায় গিয়েও মালয়েশিয়ার যুবতী প্রশিক্ষার্থীর সঙ্গে সম্পর্কে পাতিয়ে ফেলেছিল।
অরিন্দমের কথা শুনে আদিত্য বলে ওঠে, আরে না-না, এখন যাবেন না। আগে লোকটাকে শনাক্ত করে দিন। কেরিয়ারের ব্যাপার। সিগারেটের বোঁটা মাটিতে ফেলে সরকারি জুতো দিয়ে মাড়ায় আদিত্য। ভিড়ের মধ্যে দিয়ে আবার প্ল্যাটফর্মে তাড়াতাড়ি ফিরতে অসুবিধা হচ্ছিল ওদের। পাজামা-পাঞ্জাবি-লুঙ্গিতে একদল ক্লান্ত পুরুষের জটলা লক্ষ করে আদিত্যর মন্তব্য, এই মালগুলোকে দেখছেন, সব বর্ডার পেরোনো ঢাকাইয়া পাতি-নেড়ে, রাতারাতি ঢুকে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গের গাঁয়ে-গাঁয়ে, সবকটা লিগি, অ্যান্টি ইনডিয়ান এলিমেন্ট। ধমমো-শিবপুরেও জুটেছে। এগুলো আর ওই বাঙালগুলো, আমাদের পুরো পশ্চিমবঙ্গটাকে নষ্ট করে দিলে। আর ভারতবর্ষকে ডোবালো ব্রামভোনগুনো।
আদিত্য যে কতরকমের অ্যান্টিবডি খুঁজে বেড়াচ্ছে, কে জানে, মনে হল অরিন্দমের। মুসলমানরাও নিজেদের মধ্যে আলোচনায় কেউ-কেউ এভাবে নিজের চরিত্রকে ব্যাখ্যা করে হয়তো। ও বলল, কিন্তু ওরা এখানে চিত্তরঞ্জন দাসের বেঙ্গল প্যাক্টও করতে আসেনি, আর তোমার কর্মসংস্হান কেন্দ্রে নাম নথি করে কাঁদতেও আসেনি। ওরা জানে পশ্চিমবঙ্গে লক্ষ-লক্ষ কাঙালির কাজ ফাঁকা পড়ে আছে। সেই কাজগুলো করতেই আসছে ওরা। খাটবে-খাবেদাবে, বাচ্চা বিয়োবে, সাধ-আহ্লাদ করবে, মরে যাবে। কেন, বিহার-উড়িষ্যা থেকেও তো বছর-বছর লোক আসছে, কাজ পাচ্ছে, কাজ করছে, থেকে যাচ্ছে, নয়তো ম্যানহোলে নেমে পরিষ্কার করার কাজ কে করবে?শুধু এখানকার বাঙালিদেরই দেয়াল-জোড়া ন্যাকা-শ্লোগান প্যানপ্যানানি আর বুকনি।
আদিত্যর পছন্দ নয় এরকম যুক্তি। ঘরে-ঘরে কত বেকার ছেলেমেয়ে, দেশ রসাতলে যাচ্ছে, কেন্দ্র সরকার বঞ্চনা করছে, আইনশৃঙ্খলার সমস্যা, সমাজের অবক্ষয় নিয়ে বক্তব্যের রেকর্ড বাজায়। অরিন্দমকে বহুক্ষণ চুপচাপ থাকতে দেখে বলল, রসিক পাসওয়ান লোকটা বুড়ো হলে কী হবে। সহজে মুখ খোলেনি, বুঝলেন। চারদিন সময় নিয়েছে ভাঙতে। বাকিগুলোকেও আমরা ধরবই।
অরিন্দম ভিন্ন খেয়ালে। ও যখন পাটনা অফিসে এইচ আর ডিতে কাজ করত, অতনু চক্রবর্তী আর সুশান্ত ঘোষ দুই জিগরি বন্ধু ছিল ক্যাশ ডিপার্টমেন্টে। টাকাকড়ি পরীক্ষক, কয়েন-নোট এগজামিনার। চাকরি ফেলে রেখে, কাউকে কিছু না বলে, দুজনেই পর-পর দুম করে উধাও। বাড়ির আরাম আর স্বজনজ্ঞাতির সংস্রব ছেড়ে এভাবে কেন চলে যায় মানুষ! তারা কি কারুর বা কোনও কিছুর সোহাগ-বঞ্চিত? ওভাবে উধাও হবার সাহসকে আসলে ও ঈর্ষা করে। নয়তো আদিত্যর সঙ্গে কাল আর আজ দুটো ছুটি নষ্ট করছে কেন! পচা টাকার উপত্যকায় দিনের পর দিন কাজে হাঁপিয়ে উঠেছিল বোধয় ওরা দুজনে। এখানে যেমন রোজকার দশ কিলো-কুড়ি কিলো কয়েন ওজন করার চাকরিতে বিরক্ত হয়ে পুলিশে আদ্দেক মাইনেতে ঢুকে গেছে আদিত্য।
প্রথমে সুশান্তটা উধাও হয়ে গিসলো। দুশো একর জমি আর সাত একর ফলবাগান আর রোববারি হাট ছিল ওর দাদুর, মুঙ্গেরের পিপারিয়া গ্রামে। ফাঁসির হুকুমপ্রাপ্ত জোতদার ব্যাজনাথ সিংকে উচ্চ আদালতে বাঁচিয়ে দেবার পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিল ওর উকিল-ঠাকুদ্দা। যতদিন যাদব ক্রিমিনালদের দৌরাত্ম্য ছিল পিপারিয়ায়, সুশান্তরা গোপ বলে, ফসলের বখরা আর হাটের খাজনা পেতে ওদের অসুবিধা হয়নি। বস্তা-বস্তা চাল ডাল গম সরষে রাখা থাকত পাটনায় ওদের গর্দানিবাগের বাড়িতে। কজ্জল ধানুকের দৌরাত্ম্যে সুশান্তর বাপ জ্যাঠা কাকা পরে আর পিপারিয়া-মুখো হতে পারেনি। ধানুক, বিন্দ, ভূমিহাররা তখন একদিকে আর যাদবরা আরেক দিকে। যাদবদের নিত্যিদিন খুন করত ধানুকরা।
তারিণী মণ্ডল নামে আরেকজন নির্মম ক্রিমিনালের সাহায্যে, ওই সব জমিজমা আবার দখল করার উদ্দেশ্যে, কাউকে কিছু না বলে, কিছু টাকা জমিয়ে সুশান্ত গিসলো নওয়াগাছির কাজি-কোরাইয়ায়। ওই মণ্ডলরা এককালে হুগলি জেলার বাঙালি চাষি ছিল, থেকে গেছে দিয়ারায় গিয়ে।
আরেকজন মানুষের যা কিছু ভালো, সে সদগুণ আমার নেই, সেই দুর্বলতার খাতিরে আমি, আমরা, তাকে আক্রমণ করি, ভাবছিল অরিন্দম। প্রথমে সুশান্তকে আটকে রেখে মণ্ডলরা ওর বাবা-জ্যাঠার কাছে দশ লাখ টাকা ফিরৌতি বা ক্ষতিপুরণ চেয়েছিল। অত টাকা কোথ্থেকেই বা দেবে। সুশান্তকে পছন্দ হওয়ায় তারিণী মন্ডল নিজের চোদ্দো বছরের মেয়ের সঙ্গে সুশান্তর বিয়ে দিয়ে দিলে। আর ফিরতে পারেনি সুশান্ত, হয়তো চায়ওনি ফিরতে। অপরাধীদের সঙ্গে দিনভর আর তাদের মেয়ের সঙ্গে রাতভর কাটাতে-কাটাতে অপরাধকেও ভালোবাসতে অভ্যস্ত এখন ও, সুশান্ত। বাপ জ্যাঠা কাকার বিশাল একান্নবর্তী ছিল সুশান্তদের। ওর জন্যে সব পাঁকমাটি।
লালু যাদব মুখ্যমন্ত্রী হবার পর যাদব ক্রিমিনালরা তাদের হৃতরাজ্য ফিরে পেয়েছে, লড়ে দখল করে নিয়েছে। অপরাধের জাতীয়করণ হয়ছে অনেক গাঁয়ে-গঞ্জে, এমনকী শহরেও। জেলাশাসককেই পিটিয়ে মেরে ফেলেছে হাজিপুরে। পিপারিয়ার দুশো একর জমি আর সাত একর ফলবাগান ফিরে পেয়েছে সুশান্ত। পাটনায়ও গিয়েছিল তারপর, নিজের বাড়িতে, গর্দানিবাগে। পারিবারিক অন্তরালকে ভাঙা, হয়ে গেছে অসম্ভব। বাংলা কথাবাত্রাও আর গড়গড় করে বলতে পারে না, গাঁইয়া হিন্দি মিশিয়ে বাংলা বলে। দূরত্ব বরং বেড়ে গেছে সম্পর্ককে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টায়। ফিরে গেছে শ্বশুরের দেশে। দিয়ারা-দুপুরের উড়ন্ত রুপোলি বালিয়াড়িতে।
সুশান্তর পর উধাও হয়ে গেল অতনু। একদম বেপাত্তা। কতরকমের যে গুজব রটেছিল ওর নামে। একজন লোক যতদিন বাঁচে, তার নামে কতরকমের গল্প হয়। মরে গেলে গল্পগুলোও মরে যায়। কেউ যে বেঁচে আছে তাকে নিয়ে রটনাগুলোই তার প্রমাণ। একা থাকত অতনু। নিজেদের বাড়ি। সব ছিল। সংসার পাতলেই মিটে যেত। সাজানো বাড়ি ছেড়ে আচমকা নিরুদ্দেশ। হাওয়া। পালঙ্ক, বিছানা, হাফ-তোলা মশারি, ডাইনিং টেবিলে চায়ের কাপ, মিউজিক সিসটেম, বিছানায় টেপে এনরিকো কারুসোর ক্যাসেট, টিভি, ডিম-মাখন, সবজি, কোল্ড ড্রিংকস ভরা থকথকে বরফ-ঝোলা ফ্রিজ, মিক্সার-গ্রাইণ্ডার, থালা-বাসন, জামাকাপড়, বাংলা-ইংরিজি হাজারখানেক বইপত্তর, পড়ে রইল যেমনকার তেমন, যেন ফিরবে এইমাত্তর, বাজারে গেছে। ওর প্রতিবেশি পদমদেও সিনহার বিধবা স্ত্রী দরোজায় তালা দিয়ে খবর দিয়েছিলো উদবিগ্ন বন্ধু-বান্ধদের, অতনুর অফিসকে।
কতরকম জনশ্রুতি পাক খেয়েছে অতনুকে নিয়ে। পাগল হয়ে গেছে। আত্মহত্যা করেছে। সাধু হয়ে চলে গেছে নেপালে। ড্রাগ অ্যাডিক্ট হয়ে বেঘোরে মরেছে। শেফালি বাউরি নামে এক হাফ-গেরস্তর সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে সংসার পেতেছে। শেষে কিনা, আশ্চর্য, অরিন্দম ওকে দেখতে পেল হাজারিবাগের ঘন জঙ্গলে। মাওবাদি কমিউনিস্ট সেন্টারের নিখোরাকি খেতমজুরের ছেলেমেয়েদের অনাড়ম্বর গণবিবাহে। রেড বুক থেকে ইংরিজিতে মন্তর পড়ে বিয়ে দিচ্ছিল। চিনাভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা, চিনে ছাপানো রেড বুককে বিয়ে দেবার বই করে ফেলেছে! দেড়-দুশো হতদরিদ্র, ময়লা, স্নানহীন, হাফল্যাংটো গ্যাঞ্জামে বিয়ে শেষে অতনুর দিকে ভিড় ঠেলে এগোবার আগেই লোপাট হয়ে গিয়েছিল। দেখতে কি আর পায়নি অরিন্দমকে? এড়িয়ে গেল। স্রেফ উপেক্ষা করল। অদ্ভুত। অতনুর জীবনে অরিন্দমের জন্যে আর এক চিলতেও পরিসর নেই।
পাটনা অফিসের চাপরাশি রসিক পাসওয়ানই নিয়ে গিয়েছিলো ওই জঙ্গলে। পাটনা থেকে অসীম পোদ্দারের ডিজেল অ্যামবাসাডর গাড়িটা কিনে কলকাতায় চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল অরিন্দম। অনেককে বলেছিল সঙ্গে যেতে। রসিক রাজি হল। দুজনে পালা করে চালিয়ে কোন্নোগর আসার পর রসিক পাসওয়ান বাসে করে চলে গেল হাওড়ায় ওর জেলার লোকের কাছে। আশ্চর্য, এই দেড় বছর চাকরি থেকে বেমালুম নিরুদ্দেশ ছিল রসিক। ভোটবাগানেই ধরেছে ওকে পুলিশ। ধরেছে গুণ্ডাদের দেওয়া তথ্যে। লোহার বাবরির সরকারি মান্যতাপ্রাপ্ত ক্রিমিনালদের সাহায্যে বন্দুক-টন্দুক জোগাড় করছিল। ও যে ভোটবাগানে লুকিয়ে রয়েছে, সেই চিঠিটা, অরিন্দমকে আদপে সত্যিই কে যে লিখেছিল, সে সন্দেহ আরও গভীর হয়ে যাচ্ছে। আদিত্যর কি হাত আছে তাতে?
সমাজ কাউকে নিরুদ্দিষ্ট থাকতে দেবে না। খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে খুঁজে বের করবেই। এবার টেনে বের করতে চায় অতনুকে। লোকচক্ষু নামের একটামাত্র চোখের এই সমাজ। জিভ তার অনেক। আদিত্য সেদিন বলছিল, লেকচার ঝাড়ছিল, যে, সমাজ যাদের সহজে খুঁজে পায় না, তারাই যতরকমের গোলমাল বাধায়। লুকোছাপা, গোপনীয়তা, প্রায়ভেসি দেখলেই তাকে উপড়ে ফেলতে হবে, হিঁচড়ে বের করতে হবে সবার সামনে। রঞ্জিত গুপ্ত, দেবী রায়, রুণু গুহনিয়োগীর দায়বদ্ধতার সেটাই ছিল চাবিকাঠি। আদিত্য সেই আদিম বুনো চাবিটা প্রায় করায়ত্ত করে ফেলেছে।
অধ্যাপকের দামি উন্নাসিকতার আদলে বলেছিল আদিত্য, এই এখন যদি রুণু স্যার গোয়েন্দা বিভাগে থাকতেন তাহলে অ্যাতো মার্ডার হত না। জানেন, গত বছর, এক হাজার আটশো আটত্রিশটা মার্ডার হয়েছিল, আর তার আগের বছর এক হাজার সাতশো পাঁচটা, যখন কিনা মেয়েদের ওপর অত্যাচার গত বছর হয়েছিল সাত হাজার তিনশো উনআশি আর তার আগের বছর সাত হাজার তিনশো একাত্তরটা। ওই যে বললুম, ডেডিকেটেড অফিসার নেই। আগে ডিসি বিভূতি চক্রবর্তীর মতন লোক ছিল। অফিসারদের আর কত নাম করব? রবীন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি, রাজকুমার চ্যাটার্জি, নীহার চৌধুরী, রবি কর, উমাশংকর লাহিড়ি, অরুণ ব্যানার্জি, আদিত্য কর্মকার, দীপক কর, আশিস মুখার্জি, তারপর আপনার পাঁচুগোপাল মুখার্জি, বুঝলেন, এসব নাম বাঙালির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। পিওর গোল্ডে। এরা না থাকলে নকশাল মিনেস ইর্যাডিকেট হত না পশ্চিমবঙ্গে।
তা থাকবে। অন্যমনস্ক বলে, অরিন্দমের খেয়াল হল যে, সোনার বাংলা অক্ষর সত্যিই দ্যাখেনি ও আজ ওব্দি। এবারে ছোটোভাইয়ের বউয়ের জন্মদিনে একটা ভারি সোনার গিনি গড়িয়ে দেবে। বাংলা হরফ থাকবে তাতে, ‘সোনার বাংলা’। চাঁদ সদাগরের মুখ? বল্লাল সেনের মুখ? না, মুখ্যমন্ত্রীর মুখ। কিন্তু কোন মুখ্যমন্ত্রী?
আজগাল তো পদ্য লিকিয়েরাও পুলিশ কমিশনার হয়ে যাচ্চে। জিভের ডগা মুড়ে জানায় আদিত্য। রুণু স্যার ঠিকই বলেছিল, পদ্য লিকে-লিকে কলকাতা পুলিশের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল তুষার তালুকদার।
তুমিও লেখো না। তুমি পারবে। ধর্ষণকে বলতে হবে নিগ্রহ বা নির্যাতন।
অরিন্দমের খোঁচাটা সূক্ষ্ম হয়ে গেল বোধহয়, মর্মার্থ বুঝতে পারল না আদিত্য। বলল, পাগল নাকি। পদ্য লেকে বলে দীপক রুদ্র আর পার্থসারথী চৌধুরী সুপারসিড হয়ে মুখ্য সচিব হতে পারল না, দেখছেন না। প্রত্যুষপ্রসূন ঘোষ তো পদ্য লেকে বলে প্রোমোটি আই এ এস হতে পারেনি। তারাপদ রায় অবশ্য হয়েছিল মজার-মজার পদ্য লিকতো বলে। চাকরিটা খাবেন দেকছি। পদ্য নাটক-ফাটক লিকে মন্ত্রী-টন্ত্রী হওয়া যায় বটে। কিন্তু সিরিয়াস সরকারি কাজে ওসব চলে না। আদিত্য নিজে নিজের জন্যে স্তোকবাক্যের বুজকুড়ি কেটে মাথামুণ্ডু বকে যায়।
নিজের ভাবনায় মশগুল হবার দরুন, হাওড়া স্টেশানের অখিল ভারতীয় কচকচানি অরিন্দমের চারিপাশে শ্রুতির অবুঝ পার্টিশান তোলে। যিশুকে ওভাবে ধরে একটা ড্রাই রান দিলে আদিত্য। বর্ধমানের কোন-এক ধর্মশিবপুর গ্রামের, যেখানকার মানুষ এই একুশ শতকেও মাঠে হাগতে যায়, সেখানের এই স্বাস্হ্যবান যুবক একদিন মহিলাদের সামনে-পেছনে রুল ঢুকিয়ে রাষ্ট্রের আইন সামলাবে। যাকে ইচ্ছে ধরে তার পায়ের আর হাতের নখ উপড়ে নেবে, এক-এক করে। মারতেই থাকবে, মারতেই থাকবে, কিল চড় ঘুষি লাঠি লাথি, মারতেই থাকবে, মারতেই থাকবে, মারতেই থাকবে, মারতেই থাকবে, মারতেই থাকবে, যতক্ষণ না পেশি থেঁতলে লোকটা হেদিয়ে পড়ে। লোকটার ধড় সাপের লেজের মতন ছটফট না করা পর্যন্ত মুণ্ডু জবরদস্তি চুবিয়ে রাখবে জলে। ফেটে রক্তাক্ত অজ্ঞান না-হওয়া ওব্দি পায়ের পাতায় অবিরাম লাঠির বাড়ি মারবে ; কড়িকাঠ থেকে উল্টো ঝুলিয়ে। যতক্ষণ না শব্দ ওঠা বন্ধ হয়, হাতের গাঁটে পায়ের গাঁটে রুল পেটাবে। চুলের মুঠি ধরে, একবার এদেয়ালে একবার ওদেয়ালে মাথা ঠুকে দেবে। শিশ্নে মারতে থাকবে ফুটরুল দিয়ে। হাত-পা বেঁধে শুইয়ে বুটজুতো পায়ে উরু মাড়াবে। সিগারেটের টুকরোর ছ্যাঁকা দেবে, মেয়েদের নরম জায়গায়। ফাঁকে-ফাঁকে অশ্রাব্য গালিগালাজ করবে মা-বাপ তুলে। পালাতে বলে, জলজ্যান্ত গুলি করবে পেছন থেকে ; মরে গেলে চ্যাংদোলা করে এক-দুই-তিন বলে ফেলে দেবে হাসপাতালের আঁস্তাকুড়ে।
এসবই ব্রিটিশের কাছ থেকে কংরেসিরা পেয়ে, দিয়ে গেছে বামপন্হীদের ; তারা আবার পরের কর্তাদের দিয়ে গেছে, অম্লানমগজে। সমাজ বোধহয় কোনোকালেই বদলায় না। অধঃপতনের যাত্রাপথকেই বোধহয় প্রগতি বলে। কিন্তু যতই যাই হোক, যিশু বিশ্বাসের কথাটাই ঠিক। ‘প্রান্তিক চিরকার ক্ষমতার বিরুদ্ধে সংঘর্ষ চালিয়ে যায়।’
অরিন্দম দেখল, জি আর পির চারজন কন্সটেবল তিনটে দেহাতিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আদিত্যকে সেলাম ঠুকলো কন্সটেবলগুলো। আদিত্য, কী রে জবাই করতে যাচ্ছিস, বলায়, একজন অম্লপিত্তকফে ভোগা কন্সটেবল চোখ টেপে, গাঁইয়াগুলা মহিলা কামরায় চাপতাসিলঅঅ।
অরিন্দমের প্রশ্নবাচক ভুরুর উদ্দেশে আদিত্য রসিক হয়ে ওঠে। ওরা ওই দেহাতিগুলোকে জি আর পি থানায় ঢুকিয়ে একটাকে বলবে জামিনদার খুঁজে আনতে। এই বিদেশ-বিভূঁয়ে এসে টপ করে তো আর পাবে না জামিনদার। থানার দরোজার সামনে, দেখগে যাও, উবু হয়ে বসে আছে হুদো-হুদো হবু জামিনদার। ছাড়ান পাবার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠবে দেহাতিগুনো। কত রকমার কেস যে সারাদিন ধরছে তার ইয়ত্তা নেই। জি আর পির সঙ্গে বেশ ভালো বোঝাপড়া আছে জামিনদারদের। রেস্ত খসালেই ছাড়া পেয়ে যাবে লোকগুনো। জামিন, জামিনদার, জামিনের কাগজ সব ভুয়ো। রেস্ত পাওয়া হয়ে গেলেই ছিঁড়ে ফেলে দেবে ওসব কাগুজে প্রমাণ-টমান। অনেক দেহাতি-পার্টি তো হাতে হেভি মালকড়ি নিয়ে কলকাতায় আসে। আমাদের ওদিকের কালনার শৈলেন ঘটক জামিনদারি করে এক বছরেই সাত বিঘে দোফসলা জমি কিনে ফেলেছে। অবশ্যি উবু হয়ে বসার ওই জায়গাটুকু অনেক দাম ধরে পেতে হয়েছিল শৈলেন ঘটককে।
প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়ি-অভিমুখী যাত্রী-ঠাসা লোকাল ট্রেনের চকিত-করা ভোঁ বেজে ওঠে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর ঘটকালি মন্দ নয়, বলল ও, অরিন্দম।
ট্রেনটা ঘট করে শব্দ করে ছাড়তেই, আদিত্যকে ভ্যাবাচাকায় ফেলে, তাতে উঠে পড়ল অরিন্দম। টা-টা।
.
১০.
বাড়ি ফিরলেও অশান্তি। ছোটো ভাইটার বউ মধ্যশিক্ষা পর্ষদে কেরানি। অ্যামবাসাডরে পাশে বসিয়ে, সুপর্ণাকে ওর অফিসে নামিয়ে, অরিন্দম চলে যায় বি-বা-দী বাগে নিজের দপ্তরে। তাড়াতাড়ি গাড়ি চালাতে ভয় করে। ভাইয়ের অনুযোগ যে, ইচ্ছে করে গাড়ি আস্তে চালায় অরিন্দম। জ্যামহীন হরিশ মুখার্জি দিয়ে যাবার বদলে সিগনালের অজস্র ব্যারিকেড-বাধা গাড়িকন্টকিত আশুতোষ-শ্যামাপ্রসাদ দিয়ে যায়। দুজনে বেসে প্রায় ঘেঁষাঘেঁষি। চলন্ত গাড়িতে হাসাহাসি করে ভাসুর-ভাদ্দরবউ। অনেকে নিজের চোখে দেখেছে। পাড়ার বেকার ফুটপাতবাজরা পর্যন্ত আকৃষ্ট হয়েছে ওদের হাসির আদান-প্রদানে, ছি ছি। পাড়ার মোহোল্লা কমিটির নেত্রী অঞ্জনা হাজরার একমাত্র মেয়ে বলে খাপ খোলে না কেউ। কই, বাড়ি ফিরে তো হাসাহাসি হয় না।
কী ঘোর বিপদ অরিন্দমের। হঠাৎ কী করেই বা বলবে, এই সুপর্ণা, কাল থেকে তুই বাসে যাস। ঘড়ির ব্যাপারে পাগলামি আছে সুপর্ণার। টেবিলে-টেবিলে, প্রতিটি ঘরের দেয়ালে-দেয়ালে, বিভিন্ন বাজনার গোল লম্বাটে চারকোণা ছকোণা ঘড়ি ঝুলিয়েছে। বৈঠকখানার দেয়ালে টাঙিয়েছে হরিণ-শিং বিদেশি ঘড়ি, আধঘন্টা অন্তর পাখি বেরিয়ে ডাকে। একঘন্টা অন্তর সমস্ত ঘড়িগুলো বাজতে থাকলে নিভৃত আ্লাদ হয় অরিন্দমের, বিগ বেনের স্মৃতি যেন। অবশ্য সব ঘড়িগুলোই দিনের বেলায় বাজে ; অন্ধকার হলেই তারা বোবা। সাতদিনের জন্যে অরিন্দম ওকে সাতরঙা হাতঘড়ি কিনে দিয়েছে বলেও উষ্মা।
ভাদ্রবধুর অফিসে প্রশ্নফাঁস, জাল মার্কশিট, ফেলকে পাশ করানো, নম্বর বাড়ানো কেলেংকারির দরুন সেদিন অরিন্দমের টেবিলের সামনে বসে হিঁয়াঃ হিঁয়াঃ হিঃ হিঃ হিঃ খিক খিক হিঁয়াঃ ইঁয়াঃ করে হাত-পা-মাথা নাড়িয়ে-নাচিয়ে হাসি উপহার দিয়ে গেল পাটনা অফিসের মহাত্যাঁদোড় নোটপরীক্ষক মোহন রাজবংশী, যেন ওসব নোংরামির জন্যে অরিন্দমই দায়ি। ব্যাটা তো কোনও কাজ করে না অফিসে। নোটের প্যাকেট গোনার বদলে বাঁ পাশ থেকে ডানপাশে নিয়ে সই মেরে দিত। তারপর সারাদিন কোনো অফিসারের ছেলেমেয়েকে কোথায় ভরতি করাবে, ডোনেশানের দরদস্তুর, পরীক্ষায় ভালো নকল ছেলেকে বসানো, ইনভিজিলেটারের সঙ্গে রফা, এইসব সমাজসেবা করে বেড়ায়, আর তার জন্যে কমিশন খায়।
পাটনায় থাকতে একবার প্রচ্ছন্ন টিটকিরি মেরেছিল অরিন্দম, লালু যাদব আর জাতপাতের রাজনীতি নিয়ে। তার প্রতিশোধ নিয়ে গেল।
অরিন্দম ভাবছিল যে ওর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সবায়ের সমস্যা। সেই ছাত্রজীবন থেকে একের-পর-এক প্রেমাস্পদার সঙ্গে ও সম্পর্ক গড়েছে আর তা ভেঙে গেছে। গড়া-ভাঙার মাঝখানটা ঘিরে একটা করে দূষিত গল্প ছড়ায়। বিশ্বাসযোগ্যতায় দূষণ ঘটে। শেষ গল্পটা তুলি জোয়ারদারকে নিয়ে। যারা কখনও প্রেম করেনি, তারা মনে করে প্রেমের জন্যে বুঝি মেয়েমানুষটাই সবকিছু। তা তো নয়। নেশায় যেমন নেশাটাই মুখ্য, ড্রাগটা তো গৌণ।
ম্যানিলায় একবছর ট্রেনিঙে ছিল বলে, অরিন্দমকে নিয়ে নারীসঙ্গ বিষয়ে অনুমানভিত্তিক কথা ও কাহিনি ছড়িয়েছে অফিসে। ডলার বাঁচিয়ে হংকং আর ব্যাংককের লাল-আলো এলাকার সুমসৃণ মোঙ্গল-ত্বক আদর করার উত্তেজক জিভ-ভেজা গল্প।
ছোটোভাইটাও অরিন্দমের নানা গল্পগাছায় ছোটোবেলা থেকে প্রতিপালিত। তার কাছে বিশ্বাস্য হয়ে ওঠা অসম্ভব।
শ্যাওড়াফুলি লোকালে উদ্দেশ্যহীন উঠে পড়েছিল অরিন্দম। কোন্নোগরে নামল না, ছোটোকাকার শ্রাদ্ধে যাওয়া হয়নি। হিন্দমোটরে নামল না, অ্যাতো রাতে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে পড়বেন মেজোকাকা। স্মৃতির ঝাঁপি খুলে এমন সমস্ত কেউটে গোখরো লাউডগা অজগর শঙ্খচূড় কিরাইত চিতি চন্দ্রবোড়া কানড় ময়াল বের করে-করে কামড় খেতে থাকবে যে রাতভর ঘুমোতে দেবে না। প্রতিটি কামড়ের আগে বলবে, গল্পটা হল এই ; অথচ তা গল্প নয়, তাঁর জীবনের দুঃখকষ্টের চিলতে।
লাটের পর লাট ঘামে পচা নিত্যযাত্রী উঠছে-নামছে, কোথাও না কোথাও যাবে। তীর্থযাত্রীর মতন একটা উদ্দেশ্যময় নির্ধারিত গন্তব্য তো আছে। বাড়ি, পরিবার, দিনানুদিনের যৌনতা, রুটিনবদ্ধ কর্মসূচি। খুঁটিতে টাঙানো পোশাকের ঘাম, পকেটে নিত্যযাত্রীর মাসিক টিকিট। এটাই তো সুখপ্রদ আধুনিক জীবন।
ট্রেনটার শেষ স্টেশান শ্যাওড়াফুলিতে, নেমে পড়ল অরিন্দম। মাকে টেলিফোন করে দিল, পিসিমার বাড়ি যাচ্ছে, পরশু অফিস হয়ে ফিরবে।
অন্ধকারের অন্ধিসন্ধিতে পঁকপঁক তুলে এগোয় রিকশা। খোঁদল-কানা টিমটিমে রাস্তায় বৃষ্টির আবেগ-মাখা কাদা। দুপাশের হামলে-পড়া দোকানদারিতে নোনাডাঙা রোডটা অনোন্যপায়। বৃষস্কন্ধ ট্রাক চোখ বুজে র্যাশান পাচার করাচ্ছে। পাঁঠার শিড়িঙে মরদেহের অবশিষ্টাংশ ঝুলে আছে একাকী উদাসীন কসায়ের চ্যাঁচারি-চিলমনের আবডালে। শহুরে বর্ষার অকাল-ছপছপে গলিতে রিকশা থামল।
ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে যতটা চোখ মেলা যায়, থিতু হয়ে জিরোচ্ছে কৃষ্ণপক্ষের সজল মেঘ।
পিসিমা যে পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন তা পৌঁছে টের পেল অরিন্দম। পিসতুতো ছয় ভাই, ইঁটের অর্ধেক তৈরি দাঁত-বেরোনো বাড়িতে ঢুকে দেখল ও, আলাদা-আলাদা মিনি সংসার বানিয়ে ফেলেছে যে-যার ছাদ-পেটানো নানান মাপের খুপরি-ঘর ফ্ল্যাটে। আজকে বড়ো বউদির জন্মের সুবর্ণজয়ন্তীতে, ওদের একত্রে মদ খেতে বসার দরুন, স্কচ হুইস্কির ভরাযৌবন বোতলদুটো পিসিমা-পিসেমশায়ের উপস্হিতির কাজ করল। নয়তো অরিন্দম ঠিক কোন ভায়ের অতিথি, সে সমস্যা এক অপ্রস্তুত ঝামেলায় ফেলে দিত এই বাদলা রাত্তিরে। দুই বোন আর তাদের স্বামীসন্ততিও হাজির।
গ্রামীণ প্রকৃতি-পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন প্রতিটি পরিবার নিজের বাড়ির মধ্যেই মেলা বসাচ্ছে এ-যুগে। পাঁঠাবলির বিকল্প ব্রয়লার। নাগরদোলা আর ফকির-বাউলের বদলে ভিসিপি-ভিসিআর এনে বা কমপিউটারে হিন্দি সিনেমার জগঝম্প। একান্নবর্তী এ-যুগে একবোতলবর্তী। হয়তো একসঙ্গে বসে ইনটারনেটের ট্রিপল এক্স পানু।
সত্যিকারের বাউল-ফকিররা বোধহয় আর টিকবে না বেশিদিন। লালন থাকবে ইশকুল-কলেজের পুঁথিপত্তরে, সীমান্তের ওই পারে থাকবে হাছন রাজা, বিদ্যায়তনিক রমরমায়। টিভি আর নাটক-মাচানে থাকবে পূর্ণদাস বাউল।
অফিসের কাজে একবার মুর্শিদাবাদ গিয়েছিল অরিন্দম। তাঁতিদের কীভাবে সাহায্য করা যায় যাতে মুর্শিদাবাদি সিল্কের শাড়ি কর্ণাটক আর তামিলনাডুর শাড়ির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিততে পারে তা খতিয়ে দেখতে ধরমপুর, কুমিরদহ, ছয়ঘড়ি, নতুন হাসানপুর, দুর্লভপুর, গুধিয়া, হাসানপুর, হরিহরপাড়া, বাগড়ি, আলিনগর অঞ্চলে ঘোরাঘুরির সময় ফকির-বাউলের হেনস্তার অভিযোগ পেয়েছিল অরিন্দম।
বোঝলেন বাবু, আমরা নাকি কাফের, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদা করি না বলে আমরা নাকি আল্লার বান্দা নই, আমাদের গানবাজনা নাকি হারাম, রোজা রাখি না বলে ইন্তেকালের পর জান্নাতে আমাদের জায়গা নেই। বলেছিল সিরাজ ফকির। আড়াই হাজার ট্যাকা দিতে হয়েচে গান করি বলে। কংরেস সিপিয়েম ফরোড ব্লক তৃণমূল কেউ বাঁচাতে আসলেনে।
স্বাধীন বাংলাদেশ হলে কী হবে, পাকিসতানি জামাত আছে সেখানে লুক্যে। কুষ্টিয়া রাজশাহি পাবনা থিক্যা আসসা বুল্যে যায় ফকির যেন কাফেরের মতন দোল না খ্যাল্যে, যেন নুন না খায় কাফেরের ভোজে। পরামাণিক ঘরামি কলু মোহন্ত মাঝি পদবি বাদ না দিল্যা তার ঘর্যে সাদি-নিকা বন্ধ করা হব্যে। বিয়া আকিকা ইদ বকরিদে লালনের গান গাইবা না। কাজেম মোহন্তর মেয়্যের সোহরের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি আর তার আবার বিয়া কাফেরদের মতন দিল্যা, তাই লবণচল বন্ধ। রইসুদ্দি ফকির, একবাল হোসেন, কাজেমালি দোতারা নিয়্যা নেচেছিল। তেনাদের হুমকি দিয়্যা গেছে পূববাংলা মানে ওপারের তবলিগ। কিসের রাষ্ট্র যে ওপারের লোক এসে হুমকি দিয়ে যায়, অ্যাঁ, বলেন । পাসপোট-ভিসা লাগ্যে নাই তবলিগঅলাদের।
আমরা আল্লার বান্দা না পাকিস্তানের বান্দা বল্যেন আপনে। জানতে চেয়েছিল ফজলু ফকির।
এমন অবস্হায় বালুচরি শাড়িকে ঢাকার বাজারে আর প্রবাসী ধনী বাংলাদেশিদের কাছে জনপ্রিয় করা শক্ত। বাঁকুড়া জেলায় বিষ্ণুপুর মহকুমার মাধবগঞ্জে মহাজন আর তাঁতিরা গোঁ ধরে আছে যে হিন্দু মোটিফ পালটাবে না। মুর্শিদাবাদি তাঁতিকে বালুচরি বোনা শিখতে হলে প্রথমে মাধবগঞ্জের মোটিফ শিখতে হবে। চাঁদ তারা উট তাঁবু খেজুরগাছ মিনার এসবের নকশা জ্যাকার্ডে তুলে যে সরকারি কম্পিউটারবিদ বিষ্ণুপুরে প্রচার করতে গিসলো তাকে তাঁতিরা আর মহাজনরা প্রচণ্ড মার দিয়েছিল।
অরিন্দমের মনে হয়েছে এ তো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অতীত এক দুর্বোধ্য সমাজ, এর জট পাকাতে-পাকাতে দড়ির মুখ খোঁজাকে অপ্রয়োজনীয় করে ফেলেছে। অথচ মুর্শিদাবাদের বালুচর গ্রামেই জন্মেছিল বালুচরি।
হতভম্ব অরিন্দম বলেছিল, কিন্তু জেলা সদরে যে শুনলুম বাউল ফকির সংঘের সভাপতি শক্তিনাথ ঝা, তারপর কলকাতার সব গণ্যমান্য লোকেরা, মহাশ্বেতা দেবী, আবুল বাশার, প্রকাশ কর্মকার, মনোজ মিত্র, আজিজুল হক, কবির সুমন, সুজাত ভদ্র, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ওনারা মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে দরবার করেছেন।
সিরাজ ফকির : ওই কলকাতায় গান-গপপো-থেটার করেন, তেনারা?
অরিন্দম : হ্যাঁ হ্যাঁ।
সিরাজ ফকির : তা তেনারা থাকে কলকাতায় আর নাসিরুদ্দি ছায়েব ভোটে জেতে হেথায়।
অরিন্দম : ওহ।
সিরাজ ফকির : খেতে জল দিচ্ছিল জব্বার ফকির। ওর পাম্প তুলে নে গিয়ে রেখে দিলে পঞ্চায়েতের ছইফুদ্দি সরকারের বাড়ি। যে-ই জব্বারের জন্যে তদবির করেছে সে-ই জরিমানা দিয়েছে। তুঁত খেত আর পলু চাষ লাটে উটেচে গো। আর আপনে এসেচে মুরশিদাবাদি শাড়ি বাঁচাতে।
অরিন্দম দেখেছে, বাহকরাও বলেছে, মহাকরণে মন্ত্রী আর সচিবরাও জানে, চিন আর কোরিয়ার উন্নতমানের রেশমসুতো চোরাপথে আসছে মালদা মুর্শিদাবাদ নদিয়া বাঁকুড়ায়।
আহা, করে খাচ্চে গরিব মুটেরা। বড্ডো দুঃখুগো কুষ্টিয়া কোটচাঁদপুর কুমিল্লায়। বিদেশি সাম্যবাদী দেশের সরকার তাই স্মাগলিঙে নিয়োজিত। বাঁকুড়ায় দেখেছিল অরিন্দম, তাঁতি আর মহাজনের আড়ংধোলাই-খাওয়া কম্পিউটারবিদ দেখিয়েছিল, বালুচরি শাড়ির মফসসলি দিকটা এদেশি রেশম, আর শাড়িটার সদর পিঠে কোরিয়ার সিল্ক।
এখানের রেশমচাষিরা পড়ে-পড়ে মার খাচ্চে। দিনকতক পর দড়িদঙ্কা হয়ে মরবে। আমাদের কিছু করার নেই স্যার। আমরা স্মঅঅঅঅল ফ্রাই। হ্যান্ডলুম অফিসার, নস্যি-নাকি হুতাশ জানিয়েছিল, অনুকুলচন্দ্র বসাক। আর তুঁত-চাষি হাজি ইসরাইল বলেছিল, পাশের মালদা জেলায় অবস্হা আরও খারাপ। আমরা লাভজনক দাম পাই না। ভালো জাতের ডিমও পাই না আজ্ঞে। কাজের সময়ে বিদ্যুৎ থাকে না। সেচের জল বাড়ন্ত। সারের দাম বেড়েই চলেছে। আমাদের কতা কেউ ভাবে না। আমাদের দেখার কেউ নেই। এই আপনারা কলকাতা থেকে আসেন, লিখে নিয়ে চলে যান। বিহিত হয় না। এই অ্যাতোক্ষুণ আপনার সঙ্গে কতা বলে কত সময় নষ্ট করলুম। আজকে হাটবার ছিল। আগে আমরা বছরে চারবার পলুপোকা পুষতুম। এখুন একবার পোষা দায়।
আছেরুদ্দি মহাজন, দাড়িপাকা, গোঁফকামানো, বললে, বাঁ পা চেয়ারের হাতলে তুলে, পায়জামা নামিয়ে হাঁটু চুলকোতে-চুলকোতে, সরকার তো পাওয়ারলুম বসাতে দিতে চায় না, যাও বা রেশমসুতো হয়, তার বেশিটা নিয়ে চলে যাচ্ছে ভাগলপুর বেনারস মোবারকপুরের ফড়ে। অঙ্গুলিহেলন জানেন তো? আপনাদের কলকাতার বড়োবাজার সুতোর দাম বেঁধে দিচ্ছে ষড় করে। অঙ্গুলিহেলন-কমরেডদের সঙ্গে ষড় করে। সঅঅঅঅব সমস্যা কলকাতার তৈরি। মুর্শিদাবাদি রেশমশাড়ির দিনকার ফুরুল। জানি না তৃণমূল কিছু করবে কিনা।