নবাবী মোহর
লায়লা আর মুনমুন দুই বোন। লায়লার বয়স বাইশ, মুনমুনের আঠারো। মুর্শিদাবাদ নবাব বংশের যে সব শাখা বিহারের রাজমহল থেকে মুঙ্গের পর্যন্ত নানা জায়গায় একসময় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল, ইংরেজের আমলে ক্রমশ তারা বিত্তহীন হয়ে পড়ে এবং ভাগ্যের সন্ধানে আবার অন্য জায়গায় চলে যায়। শুধু থেকে যায় একটি মাত্র পরিবার। গড় ঝিনখণ্ডে। লায়লা মুনমুন সেই পরিবারের মেয়ে। তাদের বাবা মীর্জা সৈয়দ ইকবালের চলে যাওয়ার কারণ পূর্বপুরুষের জমিদারির সূত্রে পাওয়া কয়েকশো একর জমি। স্বাধীনতার পর সেই জমির অনেকটাই বেদখল হয়ে যায়। তবু যা আছে, তা দিয়ে কয়েক পুরুষ হেসে-খেলে কাটানো যাবে। মীর্জারা দুই ভাই ছিলেন। কিন্তু ছোট ভাই মীর্জা সৈয়দ জালাল যৌবনেই মোটর সাইকেলে অ্যাকসিডেন্ট করে ধনুষ্টঙ্কার রোগে মারা যান। তার স্ত্রী ইংরেজ মহিলা। মীর্জা জালাল অক্সফোর্ডে পড়তে গিয়ে তাকে শাদী করে বাড়ি ফেরেন। স্ত্রীর নাম মেরী এবং ধর্মে খ্রীস্টান। কিন্তু মেরীকে শরীয়ত অনুসারে ধর্মান্তরিত করতে হয়নি, যদিও তাকে বেগম মরিয়ম নামে ডাকা হয়। বেগম মরিয়ম এখনও খ্রীস্টান। মুসলিম শরীয়ত অনুসারে খ্রস্টান ও ইহুদী ধর্মের মেয়ে বিয়ে করলে তাকে মুসলিম ধর্মে দীক্ষিত করা আবশ্যিক নয়। কারণ মুসলিম মতে, খ্রীস্টান ও ইহুদী ধর্মও ইসলাম ধর্মের অন্তর্ভুক্ত এবং তাদের প্রফেটরাও মুসলিমদের কাছে সম্মানীয় প্রফেট। তবে মুসলিম ধর্মে ওই দুটি ধর্মের সম্প্রদায়কে বলা হয়, পথভ্রষ্ট।
মেরী মুসলিম হতে চাননি। তাই তাঁর স্বামী মীর্জা জালাল তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর খাটাননি। যদিও মেরীর মুসলিম হওয়াটা সমাজের কাছে বাঞ্ছনীয় ছিল।
তাহলেও মেরী মুসলিম সমাজে অপাংক্তেয় অচ্ছুত হননি। কারণ, তিনি শ্রদ্ধেয় পয়গম্বর ইসা অর্থাৎ যীশুর সম্প্রদায়ভুক্ত। অবশ্য বিয়ের পর দুই ভাই পৃথগন্ন হন এবং বিশাল প্রাসাদের একাংশে ছোট মীর্জা মেরীকে নিয়ে বাস করছিলেন। ওই অংশের নাম ছোটিমহল। বড় মীর্জার অংশের নাম বড়িমহল।
মীর্জা জালালের একমাত্র সন্তানের নাম ইউসুফ-যা বাইবেলী ভাষায় ‘যোসেফ’। মেরী বা বেগম মরিয়ম তাকে ডাকেন যোসেফ বলে। আর সবাই বলে ইউসুফ। সেও বাবার মতো অক্সফোর্ডের চাত্র। সম্প্রতি খ্রীস্টমাসের ছুটিতে বাড়ি ফিরেছে। চাচাতো বোন লায়লার সঙ্গে তার শাদীর কথা চলছে। বেগম মরিয়মের আপত্তি ছিল না। কারণ, ভাসুরের মেয়ে লায়লাকে তিনি খুবই স্নেহ করেন। লায়লা আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে এম. এ. দিয়েছে। একজন প্রখ্যাত অধ্যাপকের তত্ত্বাবধানে ভারতে ইসলামী সংস্কৃতির ওপর গবেষণা করছে। এই বয়সেই অত বিদ্যা বুদ্ধি নিয়ে গড় কিনখণ্ডের এই নবাব পরিবার খুব গর্বিত।
কিন্তু আপত্তি ইউসুফের। সেটাই ভাববার কথা। তার মানসিকতা সম্পূর্ণ আধুনিক। লায়লাকে সে বোন, হিসেবে দেখে আসছে। স্ত্রী বলে ভাবতে তার খুবই লজ্জা হয়। এ ব্যপারটা তাকে এবার ভীষণ ক্রুদ্ধ করেছে। সে শামিয়ে লেছে, এখনই এই সব কথাবার্তা বন্ধ না করলে সে বাড়ি থেকে চলে যাবে এবং আর কোনদিন ফিরবে না। ইংরেজ মহিলার রক্ত বেগম মরিয়মের। তাই অবশেষে ব্যাপারটা বুঝে তিনি পিছিয়ে আসার কথা ভাবছেন। সত্যি তো! তিনিই বা কেমন করে এতদিন ভাসুর এবং বড়-জায়ের কথার সায় দিয়ে এসেছে! মরিয়ম এখন এজন্যে লজ্জিত এবং অনুতপ্ত। কিন্তু সে কথা প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছেনসংকোচবোধ হচ্ছে। বড় মীর্জা খুব জেদী এবং গোঁয়ারগোবিন্দ লোক। যেমন অহঙ্কারি তেমনি মেজাজী উনি। তাঁর স্ত্রী বেগম আফরোজও তাই। দজ্জাল মেয়ে।
সাতাশে ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সবে বিশাল চাঁদ উঠেছে পাহাড়ী এলাকায়। গঙ্গা নদী নবাবী প্রাসাদের নিচে বয়ে যাচ্ছে। প্রচণ্ড শীত। কুয়াশা ঘনিয়েছে। চাঁদটা উঠেছে একটু দূরে গড় বা দুর্গের মাথায়। দুর্গ বলতে এখনও একটা ধ্বংসাবশেষ। গঙ্গার বুক থেকে খাড়া উঠে গেছে পাথরের পাঁচিল। কোথাও কোথাও তা ভাঙনে ধসে গেছে। তিনদিকের গড়-খাই বুজে ভুট্টা ও যবখেত হয়েছে। তাই তিনদিকের পাঁচিলও ভাঙা। দুর্গের ভেতর ঘরবাড়ি আর কিছু নেই। ধ্বংসাবশেষের ওপর ঘন জঙ্গল রয়েছে। ওদিকে দিনদুপুরেও কেউ পারতপক্ষে পা বাড়ায় না। ভূতপ্রেত বুনো জানোয়ার আর সাপের আড্ডা।
গঙ্গার ধারে এই নবাববাড়ি। বাড়ির পর বিরাট বাগান। আজকাল আর যত্ন হয় না! বাগানের শেষে চওড়া পাথুরে ধাপ। গঙ্গার জল সেই ধাপের নিচে বয়ে যাচ্ছে। বর্ষার সব ধাপ ডুবে যায় এবং জল বাগানের পাঁচিল ছোঁয়। তবে সেকেলে স্থপতি ও ইঞ্জিনিয়ারদের বাহাদুরি–এখানটায় কোন ভাঙন নেই এবং বন্যাও কেন কে জানে একটা স্তর পর্যন্ত গিয়ে থেমে থাকে। বাড়িটা অবশ্য যথেষ্ট উঁচু। হয়তো তাই ডোবে না। কিন্তু এখানটা যে ভাঙবে না, সে আমলে কী ভাবে টের পাওয়া গিয়েছিল কে জানে!
বাগানে কয়েকটা প্রতিমূর্তি আছে। প্রতিমূর্তি রাখা ইসলাম ধর্মে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু মীর্জা ইকবাল ও সৈয়দ জালালের বাবা নাস্তিক প্রকৃতির এবং আধুনিক চিন্তাধারার মানুষ ছিলেন। প্রতিমূর্তিগুলো তার আমলেই ইউরোপীয় ভাস্কররা তৈরি করেছিলেন।
প্রতিমূর্তি আছে মোট তিনটি। একটি হচ্ছে কাল্পনিক–ডানাওয়ালা পরীমূর্তি। তার একহাতে সোরাহী। পরী একটু ঝুঁকে ফুলগাছে জল সিঞ্চন করছে। দ্বিতীয়টি ব্রিটিশ রানী ভিক্টোরিয়ার। তৃতীয়টি বড় মীর্জার দাদুর। সিংহাসনসদৃশ আসনের দু’পাশের হাতলে দুহাত রেখে সামনে একটু ঝুঁকে বসে রয়েছেন। বাঁ পা একটু বাড়ানো-~-যেন এখনই নেমে আসবেন এবং মুখে একটা তীব্র ধরনের। অভিব্যক্তি। তীক্ষ্ণ নাক, ক্রুর চাহনি, কপালে ভাঁজ। বড়মীর্জার বাবা নিজের জন্মদাতার এই অভিব্যক্তি-সমন্বিত মূর্তি গড়তে কেন বলেছিলেন কে জানে? ওই নবাব ভদ্রলোক নাকি প্রচণ্ড হঠকারী দোর্দণ্ডপ্রতাপ আর খামখেয়ালি জমিদার ছিলেন। তাঁর নামে এখনও বিচিত্র কিংবদন্তি চালু আছে। তবে সব নারীধর্ষণ খুনখারাপি আর অত্যাচারের কাহিনী। তার নৃশংসতা নাকি ছিল তুলনাহীন। বড় মীর্জার বাবা ছিলেন একেবারে উলটো প্রকৃতির মানুষ। দয়ালু, পরোপকারী, দাতা। বাবার সব দুষ্কর্মের প্রায়শ্চিত্ত তিনিই করে যান। বড় মীর্জা সৈয়দ ইকবালের মধ্যে নাকি দাদুর কিছু ব্যাপার এসে পড়েছে। তবে সে দিনকাল তো আর নেই।
সাতাশে ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সবে চাঁদ উঠেছে। গড়ের জঙ্গলে কুয়াশা ধন হয়েছে। বাগানে লায়লা আর মুনমুন একটা পাথরের আসনে বসে বিকেল থেকে। চাচাতো ভাই ইউসুফের কাছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প শুনছে। সন্ধ্যা, শীত, শিশির আর কুয়াশার কথা ভুলে দুই বোন তন্ময়। মুনমুন সবে আলিগড়ে ভর্তি হয়েছে। তার কৌতূহলটা বেশি।
কথা বলতে বলতে হঠাৎ ইউসুফ মুখ তুলে কী দেখতে থাকল। লায়লা বলল কী? মুনমুনও বলল কী? কিন্তু ইউসুফ কোন জবাব না দিয়ে ফের কথা শুরু করল।
একটু পরে ফের সে থেমে গেল এবং মুখ তুলে কী দেখতে থাকল। ওরা ফের বলল–কী দেখছেন ভাইজান?
ইউসুফ একটু অবাক হয়ে অস্ফুট স্বরে বলল, আমার যেন মনে হল… দু’দুবার…ভারি অদ্ভুত তো..যেন…
এ বাড়িতেও ভূতের উপদ্রব নিয়ে একশো গল্প চালু আছে বিশেষ করে এই বাগান নিয়েই। দুই বোন একটু ভয় পেয়ে ঘনিষ্ঠ হল। চাপা গলায় বলল, কী? কী মনে হল ভাইজান?
ইউসুফ একটু হাসল।…চোখের ভুল হতেও পারে। ওই স্ট্যাচুটা–মানে বাবার দাদুসাহেবের স্ট্যাচুটা যেন উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিল। আমি চোখের কোনায় নড়াচড়া দেখে মুখ তুলতেই থেমে গেল। কিন্তু দু’দুবার। বডি বেশ খানিকটা উঠেছে, আর চোখ পড়তেই কী অবাক!
তখন লালয়া হেসে উঠল।–আপনার চোখেরই ভুল। ছেড়ে দিন।
মুনমুন ভয় পাওয়া গলায় বলল, থাক গে। চলুন ভাইজান। ঘরে গিয়ে শুনব। বড্ড শীত করছে!
ইউসুফ তাকিয়ে ছিল প্রতিমূর্তিটার দিকে। সে হঠাৎ নড়ে উঠে বলল—আবার! আবার! অসম্ভব! এ ভুল হতেই পারে না। নিশ্চয় কিছু একটা ঘটেছে।
দুই বোন এবার প্রচণ্ড ভয় পেয়ে কাঠ হয়ে গেল! মাত্র হাত পনের-কুড়ি দূরে প্রতিমূর্তিটা রয়েছে। তিনটে ধাপের ওপর বেদি। বেদির ওপর মীর্জা সৈয়দ গোলাম জানীর মূর্তি। লায়লা আর মুনমুনের ওদিকে তাকাতেই ভয় করছিল। ওরা বিড়বিড় করে বলল, ও কিছু না। কিছু না।
কিন্তু ইউসুফ উঠে দাঁড়াল। তারপর হনহন করে এগিয়ে গেল। দুই বোন এবার তার দিকে তাকিয়ে রইল। জ্যোৎস্না কুয়াশায় কিছু নিষ্প্রভ। তাহলেও মোটামুটি দেখা যাচ্ছে প্রতিমূর্তিটা। ওরা দেখল, ইউসুফ ধাপের নিচে দাঁড়িয়ে রয়েছে–মূর্তিটার সামনা-সামনি। সে যেন খুঁটিয়ে দেখছে মূর্তিটা। তারপর সে পা বাড়িয়ে ধাপে উঠল।
এরপর যা ঘটল, তা অবিশ্বাস্য এবং ভয়ঙ্কর। দুই বোনই দেখল, ইউসুফ এক ধাপ উঠতেই মূর্তিটা আসন থেকে উঠে দাঁড়াল এবং ইউসুফের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। পরক্ষণে স্তব্ধ নিঃঝুম শীত সন্ধ্যার বাগান কাঁপিয়ে ইউসুফের আর্তচিৎকার শোনা গেল। তারপর একটা গোঙানি।…
তারপর আবার সেই স্তব্ধতা নেমে এল। সঙ্গে সঙ্গে দু’হাতে মুখ ঢেকেছিল লায়লা। মুনমুন দিদির বুকে মুখ গুঁজে দিয়েছিল।
কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই লায়লা মরিয়া হয়ে উঠল। সে বোনকে সরিয়ে দিতে দিতে চেঁচিয়ে ডাকল–ভাইজান!
কোন সাড়া এল না। মূর্তিটা তেমনি ঠিক বসে রয়েছে। আরও বার দুই ডাকার পর লায়লা আরও মরিয়া হয়ে উঠল। মুনমুনের হাত ধরে টেনে বলল, আয় তো আমার সঙ্গে! নিশ্চয় ভাইজান তামাশা করছেন আমাদের নিয়ে।
দু’জনে অবশ্য ভয়ে-ভয়েই এগোল মূর্তিটার দিকে। কয়েক পা এগোতেই লায়লার চোখে পড়ল মূর্তির পায়ের কাছে সিঁড়িতে কেউ পড়ে আছে। সে দৌড়ে গিয়ে ঝুঁকে ব্যাপারটা দেখল। মুনমুনও দৌড়ে গিয়েছিল দিদির সঙ্গে। সেও দেখল।
ইউসুফ পড়ে রয়েছে। নিঃসাড়। বিস্ফারিত চোখ–ঠেলে বেরিয়েছে জ্যোৎস্নায় চক্ করছে চোখ দুটো। জিভটাও বেরিয়ে রয়েছে। কী ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে ইউসুফকে!
দুই বোনের ভয়ার্ত চীৎকারে শীতসন্ধ্যার স্তব্ধ বাগান কাঁপতে থাকল।
পূর্বরেলের মোহনপুর জংশন থেকে একটি শাখা উত্তর বিহারের ঝিন্দাগড় পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। পুরনো নাম গড় ঝিন্দানখণ্ড! কালক্রমে হয়ে উঠেছে ঝিগড়। কিছুকাল থেকে এই জনপদ বিহারের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকেন্দ্র বলে গণ্য হচ্ছে। এখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কয়েকটি বড় কারখানা হয়েছে। ফলে লোকসংখ্যা বেড়েছে। তিন-চার পুরুষ ধরে অনেক বাঙালিও এখানে বাস করছেন।
ঘটনার তিনদিন পরে আমি আর কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বিকেলের ট্রেনে ঝিন্দাগড় স্টেশনে গিয়ে পৌঁছলুম। আমার আসার উদ্দেশ্য ছিল নিছক বেড়ানো। সেইসঙ্গে দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা-আমি যার অন্যতম রিপোর্টার, তার জন্য কিছু ফিচার জাতীয় লেখার বিষয়বস্তু সংগ্রহ।-জয়ন্ত চৌধুরীর ফিচার লোকে আগ্রহের সঙ্গেই পড়ে।
কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে যারা চেনেন তারাই জানেন, এই বৃদ্ধ ভদ্রলোক বেসরকারি ঘুঘু গোয়েন্দা এবং খামখেয়ালিও। প্রকৃতিতত্ত্বে প্রভূত আগ্রহ নিয়ে পাহাড়-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান। পাখি প্রজাপতি পোকামাকড় গাছ ফুল লতাপাতা বিষয়ে বিজ্ঞানীর মতো অনুসন্ধিৎসু। আবার ঐতিহাসিক জায়গা এবং ধ্বংসাবশেষ সম্পর্কেও পুরাতাত্ত্বিকদের মতো কৌতূহল পোষণ করেন। বাইরে গেলেই সঙ্গে বাইনোকুলার, প্রজাপতি-পোকা-মাকড় ধরা জাল, ইত্যাদি হরেক সরঞ্জাম নিয়ে যান। ঝিন্দাগড়ে ওঁর আসার পিছনে, এবার একটি মাত্র কারণ ছিল। তা হল সম্প্রতি স্টেটসম্যানে প্রকাশিত একটি প্রকৃতিবিষয়ক নিবন্ধ–যাতে দুর্লভ প্রজাতির পাখির উল্লেখ ছিল। এই পাখি নাকি ‘ঝিন্দাগড়ের’ গড়ের জঙ্গলে সম্প্রতি দেখা গিয়েছে।
ট্রেন থেকে নেমে চারদিক দেখে মনে হল, শীতে বেড়াবার পক্ষে জায়গাটা ভাল হবে। ছোট বড় পাহাড় রয়েছে অজস্র। যতদূর জানি এই পাহাড়শ্রেণী দক্ষিণে ওড়িশা পেরিয়ে বিন্ধ্যপর্বতমালার সঙ্গে গিয়ে মিশেছে।
অল্পস্বল্প মোটঘাট রেলকুলির সাহায্যে আমরা নিয়ে গেলাম। কর্নেল একটু হেসে বললেন, জয়ন্ত! টাঙায় ওঠা যাক। ঐতিহাসিক জায়গায় গিয়ে প্রাচীন স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাতে হলে এর চেয়ে উৎকৃষ্ট কিছু আর থাকতে নেই! চোখ বুজে তুমি অনায়াসে কল্পনা করতে পারবে যে আমরা প্রাচীন যুগে ফিরে গেছি।
বুড়ো বড্ড রোমান্টিক। অতএব সায় দিলাম। টাঙাওয়ালার নাম ইব্রাহিম। সরকারি ডাকবাংলোয় যাবো শুনে সে আমাদের বিরাট সরকারি অফসর’ ধরে নিল এবং খুব সমীহ করে কথা বলতে থাকল। আর কর্নেল দেখতে বিলিতি সাহেব এবং সবার সঙ্গে ভাব জমাতে ওস্তাদ। নানান প্রশ্ন করে ঝিন্দাগড়ের নানান খবরা-খবর জেনে নিলেন। আমাদের ডানহাতে উত্তরদিকে গঙ্গা। মাঝে মাঝে তার বিস্তীর্ণ জলধারা দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ঘরবাড়ি ও গাছের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে। পাটনাগামী হাইওয়ে দিয়ে কখনও চড়াই কখনও উত্রাই ভেঙে এক-ঘোড়ার টাঙা এগিয়ে চলেছে। পিচের ওপর ঘোড়ার নালে তালেতালে আওয়াজ উঠছে ক্লপ ক্লপ ক্লপ! মাঝেমাঝে ইব্রাহিম ঘণ্টা বাজাচ্ছে টংলং। একখানে ডানধারে মস্তো পাঁচিলঘেরা পুরোনো গড়নের একটা বাড়ি দেখিয়ে ইব্রাহিম বলল, এই সেই নবাববাড়ি স্যার। ওদিকটায় নদীর ধারে আছে সেই বাগান, যেখানে দিনতিনেক আগে এক দুষ্ট জিন ছোট নবাবজাদার গলা টিপে মেরেছে।
আমি চমকে উঠে কর্নেলের দিকে তাকালাম। ওঁর চোখে চমক দেখা গেল। বললেন, দুষ্ট জিন গলা টিপে মানুষ মেরেছে! বলো কী ইব্রাহিম?
এর জবাবে ইব্রাহিম টাঙাওয়ালা যে কাহিনী বলল, তা আগের অধ্যায়ে মোটামুটি লিখেছি। ওর গল্প শেষ হল ঝিলাগড়ে একেবারে শেষ প্রান্তে–গড়ের জঙ্গল আর নবাববাড়ির মাঝামাঝি একটা টিলার মাথায় সরকারি ডাকবাংলোর গেটে। টিলার উত্তর দিকে গঙ্গানদী চোখে পড়ল। পশ্চিমে গড়ের জঙ্গলটা পুরো দেখা যাচ্ছিল। নবাববাড়ি এবং সেই বাগানটাও দেখতে পাচ্ছিলাম।
ইব্রাহিমকে ভাড়া ও বখশিশ দিতে দিতে কর্নেল প্রশ্ন করলেন, বেগম মরিয়ম কি পর্দানসীনা, নাকি বাইরে বের হন?
ইব্রাহিম জানাল, সাহেব! উনি তো খ্রীস্টান মেমসাহেব। পর্দার ধার কোনকালেই ধারেন না। তবে শাড়ি পরেন। মাথায় ঘোমটা দেন না। কঁধঅব্দি চুল ছাঁটা। এখনও ঠোঁটে রঙ মাখেন। হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে এমনি গটগট করে হেঁটে যান, কারুর তোয়াক্কা করেন না।…ইব্রাহিম বেগমসায়েবার হাঁটাও দেখিয়ে দিল সকৌতুকে। ফের বলল, তবে স্যার, আমাকে খুব পছন্দ করেন। ওনার একটা মোটরগাড়ি ছিল। ওটা বেচেই ছেলের পড়ার খরচ পাঠিয়েছিলেন বিলেতে। বড় নবাবের কাছে হাত পাততে যাননি, তাছাড়া সম্পত্তিও ভাগ হয়ে গেছে। নিজের অংশের সম্পত্তি দেখাশুনা করতে লোক রেখে দিয়েছেন। সেই লোকের নাম। ফৈজুদ্দিন। মীরসাহেব না থাকলে মেমসাহেবের খুব মুশকিল হত স্যার।
কনেল বললেন, ফৈজুদ্দিন সাহেব কি নবাববাড়িতেই থাকেন?
জী হাঁ। ইব্রাহিম গর্বের সঙ্গে জানাল।…এতো যে রিকশো, ট্যাক্সি, টাঙা রয়েছে ঝিন্দাগড়ে। উনি আমার টাঙা ছাড়া আর কিছুতে চাপবেন না, বেরোতে হলে আমার কাছে খবর পাঠাবেন। আমি তখন স্যার একশো সওয়ারি ফেলে ওনার খিদমতে (সেবায়) হাজির হব। আসলে আমার ঘোড়াটা দেখুন স্যার। মোটর গাড়ির রেস লড়িয়ে দিন না! বহৎ খান্দানী ঘোড়া।
ইব্রাহিম তার বিশাল বাদামী ঘোড়াটার গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করল। বাংলোর চৌকিদার সেলাম ঠুকে দাঁড়িয়ে ছিল। কর্নেলের এতক্ষণে হুঁশ হল। বললেন, হ্যাঁ জয়ন্ত। তুমি জিনিসপত্র নিয়ে ওর সঙ্গে গিয়ে ঘর দেখে নাও।
কর্নেল ইব্রাহিমের সঙ্গে কথা বলতে থাকলেন। আমারও কৌতূহল হচ্ছিল। কিন্তু চৌকিদার জিনিসপত্র নিয়ে এগোচ্ছে। অগত্যা পা বাড়ালাম। টের পেলাম, বুড়ো ঘুঘুটি খুনখারাপির গল্প পেয়ে নড়ে উঠেছেন। যা স্বভাব বরাবর। শকুনের যেমন মড়ার গন্ধ পেয়ে টনক নড়ে এবং খাই খাই করে দূর থেকে ডানা মেলে ছুটতে থাকে, তেমনি ওঁর অবস্থা! এর ফলে মুশকিল হবে এই যে ওঁর প্রকৃতিতত্ত্ব আর আমার ভ্রমণের সব আনন্দ এবারও যথারীতি মাঠে মারা পড়বে! কপালে কী যে দুর্ভোগ ঘটবে জানি না। বেঘোরে কাদের পাল্লায় পড়ে এই বিদেশে প্রাণটা খোয়াতে হবে কি না তাই বা কে জানে। কতবার তো নেহাত অল্পের জন্য বেঁচে গেছি।
বাংলোর পরিবেশ অতি চমৎকার। উত্তরের জানলা খুলে দেখলাম, ঢালু হয়ে সবুজ ঘাসে ভরা এই টিলা নেমে গেছে এবং তারপর উঁচু ঘাসের জঙ্গল–তার শেষে নদী। গঙ্গা এখানে অন্তত এক মাইলের বেশি চওড়া। তার ওদিকে চর দেখা যাচ্ছে। পুবের জানালায় দাঁড়িয়ে নবাববাড়ি, বাগান ও ঘাট দেখতে পেলাম। সেই মূর্তিগুলো আবছা দেখা যাচ্ছিল। গা শিউরে উঠল।
একটু পরে কর্নেল ফিরে এলেন। সব দেখেশুনে বললেন, বাঃ। খাসা!
বললাম, কর্নেল! আগেভাগে বলে রাখছি, যদি নবাড়ির ব্যাপারে নাক গলাতে যান, আমি সঙ্গে সঙ্গে কেটে পড়ব কিন্তু।
কর্নেল হো হো করে হেসে মাথা দোলালেন। না, না ডার্লিং! জাস্ট একটা কৌতূহল। তবে যাই বলো, ঘটনাটা খুবই অদ্ভুত নয় কি? প্রবল প্রতাপান্বিত জমিদার মীর্জা সৈয়দ গোলাম জানির আত্মা নিজের ব্রোঞ্জ প্রতিমূর্তির মধ্যে আত্মপ্রকাশ করে নিজের প্রপৌত্রকে গলা টিপে মেরে ফেললেন! তোমার অবাক লাগছে না কি?
স্বীকার করতে হল, লাগছে। কিন্তু আপনাকে তো কেউ নাক গলাবার অনুমতি দেয়নি! কেন যেচে পরের ঝামেলায় ঢুকবেন, শুনি?
কর্নেল গম্ভীর হয়ে বললেন, না না। ঝামেলায় ঢুকব কেন? তবে কথা হচ্ছে…
-কোন কথা নয়। আপাতত আলো জ্বালা যাক। পাঁচটা বাজতে না বাজতে দেখছি অন্ধকার হয়ে গেল।..বলে আমি সুইচ টিপলাম। কিন্তু আলো জ্বলল না।
জানালাগুলো সব বন্ধ করে বেরিয়ে গেলাম চৌকিদারের সন্ধানে। বারান্দা ঘুরে কিচেনে যেতেই ওকে দেখতে পেলাম। কেরোসিন কুকার জ্বেলে চায়ের কেটলি চড়িয়েছে। সেলাম করে বলল, হুজুর। রাতের খাওয়াটা কিন্তু আপনাদের বাইরে গিয়েই খেতে হবে। কর্নেল সাহেবকে সেকথা বলেছি। ওনার খাতিরে শুধু চা করে দিয়েই আমি চলে যাব।
–সে কী! তুমি থাকবে না রাতে?
সে মাথা নাড়ল জোরে। বাড়িতে বিমারী, হুজুর। আমাকে যেতেই হবে।
–ঠিক আছে। মোমবাতি থাকলে দাও দিকি বাবা! তোমাদের আলোর যা অবস্থা।
চৌকিদার দুটো মোমবাতি বের করে দিল। বলল, আলো এখনই এসে যাবে। ভাববেন না। অন্যদিন তো দুচারমিনিট পরেই জ্বলে। আজ দেরি করছে।
ফিরে এসে মোমবাতি জ্বালালাম। চৌকিদারের ব্যাপারটা শুনে কর্নেল টু হাসলেন। বললেন, হ্যাঁ। ও আসলে এ বাংলোয় রাতে থাকতে ভয় পায়। সম্ভবত নবাববাড়িতে ভূতের হাতে ওই খুনখারাপির ফলেই বেচারা এত ভয় পেয়েছে। ঠিক আছে। আমরা বাইরে গিয়ে খেয়ে আসব। একটু হাঁটতে হবে–মন্দ কী?
বেজার হয়ে বললাম, এই শীতের রাতে হাঁটাহাঁটি এক সমস্যা। তার ওপর প্রায় আধমাইল উত্রাই ভেঙে হোটেলে যাওয়ার পর ফিরে আসার সময় চড়াই ভাঙতে হবে। কার মুখ দেখে বেরিয়েছিলাম, কে জানে!
কর্নেল সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ডার্লিং জয়ন্ত! হিন্দু শাস্ত্রেই আছে–চরৈবেতি। চলো, চলো! চলাই জীবনচলাই অমৃত। অতএব চলতে শেখো। চলতে ভয়। পেয়ো না।…
কর্নেল এই দার্শনিক বাক্যগুলি সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে যেতে থাকলেন। আমি আর কান দিলাম না। তারপর চৌকিদার চায়ের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল। ট্রে রেখেই সে সেলাম দিয়ে বলল, তাহলে স্যার আমি যাই। বাড়িতে অসুখ। কাল সক্কালবেলা এসে হাজির হবো, ভাববেন না। কিচেনে তালা দিয়েছি। এই রইল সব ঘরের চাবি। সেলাম হুজুর।
দ্বিতীয়বার সেলাম দিয়েই সে কেটে পড়ল। একটু পরে দেখলাম, একটা লণ্ঠন আর লাঠি নিয়ে লোকটি হনহন করে লন পেরিয়ে চলে গেল।
চা খেতে খেতে আলো জ্বলে উঠল। তখনই মেজাজ ভাল হয়ে গেল। আঃ! আলোর মধ্যে জাদু আছে। আলোয় যেন সভ্য মানুষের প্রাণশক্তি দ্বিগুণ হয়ে ওঠে।
চা খেতে-খেতে দেখলাম, কর্নেল যেন অন্যমনস্ক হয়ে রয়েছেন। উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, নবাববাড়ির ঘটনা নিয়ে আবার ভাবতে বসেছেন নিশ্চয়?
কর্নেল হঠাৎ লাফিয়ে উঠলেন। কোনার দিকে তাকিয়ে বললেন, জয়ন্ত, বাংলোয় ফোন রয়েছে। কী আনন্দের কথা!
এতক্ষণে চোখে পড়ল ফোনটা। কোনায় নিচু টুলে চমৎকার লাল রঙের একটা ফোন। হেসে বললাম খেলনার ফোন নয়তো?
পরীক্ষা করা যাক। বলে কর্নেল গিয়ে ফোন তুললেন। তারপর পকেট থেকে একটা নোটবই বের করে কী একটা নাম্বার দেখে ডায়াল করতে থাকলেন। তাজ্জব হয়ে বসে রইলাম। এখানেও ওঁর চেনাজানা কেউ আছেন দেখছি! তার নাম্বারও সঙ্গে নিয়ে এসেছেন।
তারপর ওঁকে ইংরেজিতে বলতে শুনলাম : মি. মাধব শর্মা হা হা। বলুন, ডাকবাংলো থেকে কর্নেল সরকার। হ্যাঁ, বললেই বুঝবেন। প্লিজ! মি. শর্মা? হ্যালো হ্যালো হ্যালো! কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। হ্যাঁ, কিছুক্ষণ আগে এসেছি। কেমন আছেন?–দ্যাটস ফাইন।আমার কথা ভাবছিলেন? হাউ অ্যামেজিং-ওঃ মাই! মাই! না, না। জাস্ট দৈবাৎ এসে পড়েছি। ও, নো নো। কোন অ্যাসাইনমেন্ট নয়। জাস্ট এমনি। হ্যাঁ, চলে আসুন খুব খুশি হবো। আর ইয়ে–একটা ছোট্ট অনুরোধ মি. শর্মা। চৌকিদার কেটে পড়েছে। দয়া করে মোটামুটি ভাল কোন হোটেলের নাম্বার জানা থাকলে বলুন।..না না, আপনাকে ঝক্কি পোয়াতে হবে না। আপনিও তো আমার মতো বুড়ো ব্যাচেলার। থ্যাংকস হাঁ, বলুন। সাত আট। আটাত্তর? ঠিক আছে। আমিই ম্যানেজ করছি। থ্যাঙ্কস। আসুন।
ফের ডায়াল করলেন। তারপর বোঝা গেল, কোন হোটেল থেকে ডিনার পাঠাবার ব্যবস্থা করে ফেললেন। যাক গে! শীতে হাঁটাহাঁটি থেকে বাঁচা গেল।
উনি ফোন রেখে উঠে এলে বললাম, আপনার এই শর্মাটি কি পুলিশ?
কর্নেল হাসলেন। জয়ন্ত, পুলিশের যত বদনামই থাক, ওরা না থাকলে মানুষের কী অবস্থা হত, নবাব বাদশাদের আমলের ইতিহাস পড়ে দেখো। ব্রিটিশ ভারতে যে কয়েকটি উৎকৃষ্ট কাজ করে গিয়েছে, তার অন্যতম এই পুলিশি ব্যবস্থা।
বিরক্তি দেখিয়ে বললাম, এক্ষেত্রে পুলিশ মানেই নবাববাড়ির ঘটনায় আপনার নাক গলানো। কে ওই মাধব শর্মা?
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, পুলিশ সুপার। কেন? গত বছর প্রতাপগড়ে তুমিও তো ছিলে–সেই যে ভুতুড়ে ছবির কেসটা!
তখনই খুশি হয়ে বললাম, ওঃ হো। তাই বলুন। উনি ঝিলাগড়ে বদলি হয়ে এসেছে তাহলে?
কর্নেল বললেন, কোন নতুন জায়গায় যাবার আগে আমার অভ্যাস, আগে জেনে নিই–সেখানে চেনাজানা কেউ আছেন কি না। যাক গে, দেশের উন্নতি এতদিনে সত্যি হয়েছে। বাংলোয় ফোন দেখে আমার কী যে আনন্দ হচ্ছে, জয়ন্ত।
বলে কর্নেল বেরিয়ে বারান্দায় গেলেন। বুঝলাম, শর্মার আসার অপেক্ষা করতে গেলেন।
কিন্তু ক্রমশ আমার মনে একটা অস্বস্তি জাগতে থাকল। নিয়তিই যেন চক্রান্ত করে আবার খুনখারাপির রহস্যে জড়িয়ে ফেলতে চায়। নাঃ, এই ঘুঘুটির সঙ্গ এবার ছেড়ে দেবো। নতুন জায়গায় বেড়াবার আনন্দ এভাবে কতবার যে নষ্ট হয়েছে, তার সংখ্যা নেই।
মনমরা হয়ে বসে রইলাম। একটু পরে জিপের শব্দ শোনা গেল। তখন উঠে বাইরে গেলাম। গিয়ে দেখি, কর্নেল গেটে চলে গেছেন এবং সবে আকাশে একটা বিশাল চাঁদ উঠছে।
পুলিশ সুপার মাধব শর্মা খুব ভদ্র, অমায়িক এবং হাসিখুশি মানুষ। প্রতাপগড়ে গতবছর আমার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। এসেই জমিয়ে তুললেন একথা সেকথায়। তারপর অনিবার্যভাবে এসে পড়ল নবাববাড়ির রহস্যময় হত্যাকাণ্ডের কথা। ঘটনার যা বর্ণনা দিলেন, তার সঙ্গে ইব্রাহিম টাঙাওলার গল্পের কোন গরমিল নেই। এই কেসে সন্দেহক্ৰমেও কোন গ্রেফতার হয়নি। মিঃ শর্মা বললেন, কাকে গ্রেফতার করব, বলুন? ঝিন্দাগড়ে নবাব ফ্যামিলির সঙ্গে কারও এতটুকু শত্রুতা নেই। তাছাড়া ইউসুফ ছেলেবেলা থেকে বাইরে কাটিয়েছে। কদাচিৎ বছরে দু-একবার দু-চারদিনের জন্যে বাড়ি এসেছে। এবার সে অক্সফোর্ড থেকে এসেছে ছাব্বিশে ডিসেম্বর দুপুরে। খুন হল পরদিন সন্ধ্যায় সাড়ে ছটা নাগাদ। সে বাইরে কারও সঙ্গে মিশত না। মেশার সুযোগই ছিল না। খানদানী নবাববাড়ির ছেলে। যদ্র খোঁজ নিয়েছি, খুব সচ্চরিত্র, শান্ত আর ভদ্র ছেলে ছিল সে। ড্রিঙ্কও করত না!
কর্নেল বললেন, তার বাবা মীর্জা সৈয়দ জালালও নাকি তাই ছিলেন।
মি. শর্মা বললেন, হ্যাঁ, তিনি পঁচিশ বছর বয়সে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যান শুনেছি। তখন ইউসুফের বয়স মোটে সাত মাস।
কর্নেল বললেন, ধনুষ্টঙ্কার রোগেই তো?
খবর নিয়েছেন তাহলে!…বলে মি. শর্মা একটু হাসলেন।…যাক গে, যা বলছিলুম। ইউসুফের মা মিসেস মেরী; লোকে বলে বেগম মরিয়ম, একমাত্র ছেলের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন। কিন্তু উনি কাকেও সন্দেহ করার কথা বলেননি। বলছেন, কিছু বুঝতে পারছিনে।
আমি বললাম, ইউসুফের কাকা বড় মীর্জাসাহেব সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?
মি. শর্মা জবাব দিলেন, উনি তো একমাস যাবৎ পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী। বাঁদিক সম্পূর্ণ অবশ। সারাক্ষণ শুয়ে থাকেন!
কর্নেল বললেন, ইউসুফের মৃত্যুতে লাভবান হবেন কে? সম্পত্তির ব্যাপারে! মিসেস মেরী মীর্জা। মি. শর্মা বললেন…ছোট নবাব মৃত্যুর আগে সজ্ঞানে সেই মতো উইল করে গেছেন। যেন টের পেয়েছিলেন আর বাঁচবেন না। কিন্তু সম্পত্তির স্বার্থ দেখলে তো তাহলে ছেলেকে খুনের দায়ে মাকে গ্রেফতার করতে হয়!
কর্নেল বললেন, দ্যাটস রাইট। এবার বলুন, পোস্টমর্টেম কী বলছে!
মি. শর্মা জবাব দিলেন, তীক্ষ্মধার ব্লেডজাতীয় কোন অস্ত্রে শ্বাসনালী কেটে দেওয়া হয়েছিল! মুসলিমরা যেভাবে প্রাণী জবাই করে, অবিকল সেইভাবে।
কর্নেল চমকে উঠলেন। আমিও কর্নেল বললেন, কিন্তু আমি যে শুনলুম, গলা টিপে মারা হয়েছে।
মি. শর্মা একটু হাসলেন।…ওটাই রটেছে। কারণ, মীর্জা গোলাম জানির স্ট্যাচু উঠে এসে নাতিকে যখন খুন করেছে, তখন ওটাই তো গল্পের সঙ্গে খাপ খায়। ভূতপ্রেত বা জিন ছুরি পাবে কোথায়? সবাই ধরে নিয়েছে, বরফের মতো ঠাণ্ডা। ব্রোঞ্জের হাতই হল খুনের অস্ত্র! বিশেষ করে লায়লা আর মুনমুন দুই বোন আমাদেরও সেই বর্ণনা দিয়েছিল। কিন্তু পরে ওরা এবং নবাববাড়ির সবাই স্বচক্ষে দেখেছে, ইউসুফকে কেউ জবাই করেছে জায়গাটা রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। তাছাড়া, নবাববাড়িতে তো বাইরের কারও ঢোকা অসম্ভব। তাই বাইরের কেউ ব্যাপারটা দেখেনি এবং যথেচ্ছা রটিয়েছে। এর ফলে কী হয়েছে জানেন? সূর্যাস্তের পর এ তল্লাটে আর কেউ পা বাড়াচ্ছে না।
কর্নেল বললেন, লায়লার সঙ্গে নাকি ইউসুফের বিয়ের কথা চলছিল?
মি. শর্মা বললেন, হ্যাঁ। চলছিল তবে শেষদিকে মিসেস মেরী মীর্জা নানা ছলছুতো করে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। ছেলের অমত ছিল। লায়লার মা বেগম আফরোজেরই তাগিদ ছিল বেশি। বেগম আফরোজ শুনেছি খুব দজ্জাল প্রকৃতির মহিলা। স্বামীর চেয়েও এককাঠি সরেস। কিন্তু তাই বলে ওই কারণের জন্যে ইউসুফকে খুন করে ফেলবেন, একথা ভাবা যায় না। সেটা অবিশ্বাস্য অযৌক্তিক। তাই নয় কি?
কর্নেল মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললেন, ঠিকই বলেছেন। আচ্ছা মি. শর্মা, মিসেস মেরী মীর্জার প্রপার্টি দেখাশোনা করেন যে ভদ্রলোক কী যেন নাম…
মীরসায়েব তো? মীর ফৈজুদ্দিন।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওঁকে সন্দেহ করার মতো কিছু নেই?
নাঃ। মিসেসের খুবই বিশ্বাসভাজন। তাছাড়া ঝিন্দাগড়ে উনি একজন ধার্মিক মুসলমান হিসেবে খ্যাত।
বয়স কত ওঁর?
বৃদ্ধ বলা যায়। ষাটের বেশি তো বটেই। তবে কর্মঠ। স্বাস্থ্যবান মানুষ। মিসেস মেরী মীর্জাকে উনি মেয়ের মতো দেখাশোনা করেন।
নবাববাড়িতে দুই পরিবারে লোকসংখ্যা কত এবং তাদের সম্পর্কে কিছু বলবেন কি মি. শর্মা? তাছাড়া বাড়ির বর্ণনা দিলেও খুশি হবো।
কর্নেলের এই প্রশ্নের জবাবে মিঃ শর্মা বললেন, বাড়িটা বিশাল। এখন মাঝামাঝি দুই অংশে বিভক্ত। প্রকাণ্ড উঠোন রয়েছে–তার মাঝামাঝি পার্টিশান করা হয়েছে ইটের। বারান্দা অব্দি উঠে গেছে সেই পাঁচিল। কিন্তু দোতলায় এক পরিবার থেকে অন্য পরিবারে যাতায়াতের অসুবিধে নেই। ওপরের বারান্দার বর্ডার-স্বরূপ যে দেওয়াল করা হয়েছিল, পরে ছোট নবাবের মৃত্যুর পর সেখানে একটা দরজা বসানো হয়েছে। কপাট আছে। তবে নাকি কপাটটা সবসময় ভোলা থাকে। দুই পরিবারের লোকেরা যাতায়াত এবং মেলামেশা করে।
বলে মি. শর্মা একটা কাগজে বাড়ি ও বাগানসমেত চৌহদ্দির নকশা এঁকে দিলেন। কর্নেল সেটা হাতে নিয়ে বললেন, এবার লোকজনের কথা বলুন।
মি. শর্মা বললেন, বড় নবাব মীর্জা সৈয়দ ইকবাল, তার স্ত্রী বেগম আফরোজ, দুই মেয়ে লায়লা ও মুনমুন–এদের কথা আপনি ইতিমধ্যে শুনেছেন। এবার বলি বড় নবাবের ফ্যামিলির অন্য লোকজনের কথা। ওঁর প্রাইভেট সেক্রেটারি আছেন একজন। তার নাম আতাউল্লাহ বেগ। ব্যাচেলার। বয়স বত্রিশ-তেত্রিশ। থাকেন বাড়ির শেষদিকের ঘরে। একতলায়। অন্দরে ঢুকতে মানা নেই ওঁর। সাত বছর রয়েছেন। বাড়ি দিল্লিতে। সুশিক্ষিত। বিলাসী যুবক। বিশ্বস্ত। আর আছে জনা তিন চাকর বা বান্দা। আগে নাকি তিনশো জন ছিল।
মি. শর্মার হাসি শুনে কর্নেলও হেসে বললেন, স্বাভাবিক। তবে বেগমের সংখ্যা এক–এটাই অদ্ভুত!
মি. শর্মা বললেন, বড় মীর্জার বাবা ছিলেন আধুনিক মনের মানুষ। তাই একাধিক বিয়ে করতে দেননি, নিজে তো করেনইনি। তাছাড়া দুই ছেলেই তো বিলেতে শিক্ষাদীক্ষা পেয়েছে। বড় নবাব মীর্জা সৈয়দ ইকবালও অক্সফোর্ডের এম. এ.। ঝিলাগড়ের নবাব ফ্যামিলি পুরুষপরম্পরা অক্সফোর্ডের ছাত্র। লায়লা মুনমুন মেয়ে বলে অতদূরে পাঠানো হয়নি। যাক গে, যা বলছিলুম। বান্দাদের নাম হাসিম, ইসমাইল আর জর্জিশ। পুরুষানুক্রমে বান্দা। বাইরের দিকে তাদের পরিবার বউ-ছেলে-মেয়েরা রয়েছে। তিনজনের বউই বাঁদী। তাদের মেয়েরা ও ছেলেরাও বান্দা ও বাদী হতে পারে–যদি এই অবস্থা বরাবর টিকে থাকে। এবার বলি মিসেস মেরী মীর্জার ফ্যামিলির কথা। মীরসায়েবের কথা আগেই বলেছি। তবে তিনি ফ্যামিলি নিয়ে থাকেন ঘড়িঘরের কাছে চকবাজারে। ভোরে আসেন। অনেক রাতে বাড়ি ফেরেন। খাওয়াটা নবাববাড়িতেই হয়। মিসেস মেরীর বাবুর্চি কাম-পরিচারিকা মিসেস মিশেল। তিনিও কিন্তু কত্রীর মতো এদেশী পোশাক অর্থাৎ শাড়ি পরে থাকেন।
কর্নেল বললেন, খ্রীস্টান নিশ্চয়?
হা। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহিলা। মিসেস মেরী এ বাড়ি আসার সময় কলকাতা থেকে সঙ্গে এনেছেন। কত্রীর চেয়ে বয়স বেশি। রীতিমতো গর্জেন। আর রইল চাকর বা বান্দা। তাদের সংখ্যা দুই। বান্দার নাম হাতেম। বাঁদির নাম মায়মুনা। হাতেমের ফ্যামিলি আছে। মায়মুনা একা। ছোট মহলের বাইরের দিকে আলাদা থাকে। এ ছাড়া বাইরের বাড়িতে তো আত্মীয়স্বজনও অনেক বাস করছেন।
আমার ঘুম পাচ্ছিল। হাই তুললাম। কর্নেল বললেন, বাস! এ যে মহাভারত!
হা কর্নেল। নবাবী ব্যাপার আর বলে কাকে? …মি. শর্মা হাসলেন। …যাই হোক। এই বিরাট ব্যাপারের মধ্যে ইউসুফের মৃত্যুরহস্য আঁচ করা খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতো কঠিন। আমরা অবশ্য প্রত্যেককে পুঙ্খানুপুঙ্খ জেরা করেছি। প্রত্যেকের বিবৃতি নিয়েছি। ইচ্ছে করলে আপনি তাতে চোখ বুলোতে পারেন। ফাইলে একটা কপি রয়েছে। এনেছি। আপনার অনুমতি পেলে গাড়ি থেকে নিয়ে আসব। কিন্তু এটা প্রেস্টিজের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। নবাব ফ্যামিলির প্রভাব আছে সরকারি মহলে। মিসেস মেরী মীর্জা তো মন্ত্রীমহলেও ধরেছে শুনছি। ডি. এম. আমার সঙ্গে ঘন-ঘন কনফারেন্সে বসছেন। এ অবস্থায় আপনাকে পাওয়া মানে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া!
আমার ঘুমটুকু কেটে গেল। যা আশঙ্কা করেছিলাম, তাই হতে চলেছে। কর্নেলের ইচ্ছে থাক বা না থাক, মি. শর্মার অনুরোধে ওঁকে চেঁকি গিলতেই হবে। উদ্বিগ্নভাবে কর্নেলের মুখের দিকে তাকালাম।
কর্নেল দু-তিন মিনিট কিছু ভাবলেন। তারপর বললেন, দেখুন মি. শৰ্মা আমি এখানে এসেছিলাম স্টেটসম্যানের একটা খবর পড়ে। না, না–এ খবর নয়। গড়ের জঙ্গলে একরকম দুর্লভ প্রজাতির পাখি নাকি দেখা গিয়েছে। তার একটা ফোটো নেওয়াই আমার একান্ত উদ্দেশ্য। এজন্য সারা শীতকালটাও প্রয়োজনে এখানে কাটাতে আমি রাজি। কিন্তু কথা হচ্ছে, কেসটা আমারও ধারণা খুবই গোলমেলে। সম্ভবত এর পিছনে নবাব ফ্যামিলির কোন পুরনো ঘটনা জড়িয়ে আছে। আমি তাই সম্পূর্ণ বাইরে থেকে বরং আপনাদের পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতে পারি। আপনারা তদন্তসূত্রে যেসব তথ্য পাবেন, আমায় জানালে আমি হয়ত পরামর্শ দিতে পারব। কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। কারণ, ওই পাখির ব্যাপারটা আমাকে অন্য কাজে মন লাগাতে দেবেই না।
আমি আশ্বস্ত হলাম। মি. শর্মা একটু হেসে বললেন, অগত্যা তাই। আপনার পরামর্শও আমাদের পক্ষে মূল্যবান হবে। কিন্তু নবাব ফ্যামিলির কোন পুরনো ঘটনা বলতে আপনি কি কিছু জানেন কিংবা অনুমান করছেন?
কর্নেল ঘাড় নেড়ে বললেন, না। স্রেফ অনুমান। তবে ভুল হতেও পারে। প্রাচীন অভিজাত সব ফ্যামিলিতেই কোনো না কোনো কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি অথবা কোন গুপ্ত ব্যাপার থাকেই। তার জের স্বরূপ বহুকাল ধরে পুরুষপরম্পরা অনেক ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে। এরকমটি নিশ্চয় আপনার অভিজ্ঞতায় দেখেছেন?
মি. শর্মা বললেন, হ্যাঁ। যেমন ধরুন, হিরণ্যগড়ের রাজ ফ্যামিলির কেসটা।
কর্নেল বললেন, শুনেছি। একটুকরো হীরের জন্য তিনপুরুষে বাইশটা খুনখারাপি হয়েছিল। এক্ষেত্রে অবশ্য মোটে একটা….।
হঠাৎ থেমে কর্নেল কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, আচ্ছা মি. শর্মা, ছোট নবাব মোটর সাইকেল অ্যাকসিডেন্টে মারা যান কতদিন আগে?
মি. শর্মা হিসেব করে জবাব দিলেন, ওঁর মৃত্যুর সময়ে ইউসুফের বয়স ছিল মোটে সাত মাস। এখন ইউসুফের বয়স বাইশ বছর প্রায়। তাহলে বলা যায় বাইশ-তেইশ বছর আগে।
কর্নেল বললেন, ১৯৫১ অথবা ১৯৫২ সালে।
মি. শর্মা বললেন, মিসেস মেরী মীর্জার কাছে জেনে বলতে পারি ঠিক কোন বছর উনি মারা যান।
আমি বলে উঠলাম, গোরস্থানে গেলেও জানা যায় সেটা।
কর্নেল সপ্রশংস দৃষ্টে এবং সস্নেহে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ ডার্লিং। দ্যাটস দা কারেক্ট অ্যান্ড সায়েন্টিফিক ওয়ে!
মি. শর্মা বললেন, তাও তো বটে। ওঁদের প্রাইভেট ফ্যামিলি গ্রেভ ইয়ারড রয়েছে বাগানের একপাশে। বংশের সকলেরই কবরের গায়ে মার্বেল ফলকে নাম আর জন্মমৃত্যুর তারিখ খোদাই করা রয়েছে। আমি দেখেছি। এক পাশে উর্দু, অন্যপাশে ইংরেজি। তবে আমি তো উর্দু পড়তে পারি। কারণ আমি উত্তর প্রদেশের লোক। উর্দু কতকটা মাতৃভাষা বলতে পারেন।
হঠাৎ কর্নেল কান পেতে শুনে বললেন, মনে হচ্ছে হোটেল থেকে আমাদের ডিনার নিয়ে লোক আসছে।
উঠে দরজায় উঁকি মেরে দেখলাম, দুজন লোক টর্চ জ্বেলে সাইকেল ঠেলে বাংলোর গেট-বরাবর চড়াই ভেঙে উঠছে। ফিরে গিয়ে বললাম, হ্যাঁ। দুটো লোক আসছে বটে।
কর্নেল বললেন, না দেখে এলেও টের পেতে। কারণ ওরা গান গাইতে গাইতে আসছে। কেন গাইছে বোঝাই যায়। সাহস অর্জনের জন্য।
তিনজনে জোরে হেসে উঠলাম। তারপর কর্নেল বললেন, ওদের আরও সাহস দেবার জন্য আমরা বাংলোর লনে গিয়ে দাঁড়াই। বাইরে জ্যোৎস্না ফুটেছে মনে হচ্ছে। শীতের জ্যোৎস্নার চেয়ে হত্যাকাণ্ড বেশি রহস্যমঃ নয়। কী বলেন মি. শর্মা?
মি. শর্মা সায় দিলেন। তিনজনেই বেরিয়ে গেলাম। লনে পৌঁছবার সময় দেখলাম ওরা গেটের কাছে জিপ দেখে দাঁড়িয়ে কিছু বলাবলি করছে। কর্নেল ডাকলেন, চলে এস ব্রাদার! আমরা ক্ষুধার্ত।
ওরা গেট খুলে পা বাড়িয়েছে, হঠাৎ সেই মুহূর্তে এই টিলার পূর্ব-দক্ষিণ কোণে নিচে এবং অনেকটা দূরে এক ঝলক আলো ঝিলিক দিয়ে নিভে গেল এবং একটা তীব্র চেরা গলার আর্তনাদ-সম্ভবত আধ মিনিটের বেশি নয়, শোনা গেল–ভালভাবে শুনতে না শুনতেই মিলিয়ে গেল সেটা। আমরা তিনজনেই চমকে উঠেছিলাম এবং ওই লোক দুটিও কারণ তারাও সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। তারপর মি. শর্মা বললেন, কী ব্যাপার!
কয়েক মুহূর্ত সবাই চুপ। আমার মতো হয়তো প্রত্যেকেই ভাবছে, কানের ভুল নয় তো? তারপর কর্নেল বলেন, আমার মনে হল আর্তনাদ আর আলোটা নবাববাড়ির বাগানে।
মি. শর্মা বললেন, আমারও তাই মনে হয়।
সবাই সেই দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম। কুয়াশায় ওদিকটা অস্পষ্ট। গাছপালাও আছে। সব একাকার মনে হচ্ছে। তারপর একটা স্থির আলো–তার পিছনে আরেকটা একই রকমের আলো দেখা গেল। আলো দুটো এদিক-ওদিক নড়াচাড়া করতে থাকল। একটু পরে আরও দুটো স্থির আলো দেখা গেল। তারপর কেউ টর্চের জোরালো ছটা এদিক-ওদিক ফেলতে থাকল। এবার আবছা গোলমালের শব্দ ভেসে এল।
তখন মি. শর্মা লাফিয়ে উঠে বললেন, নবাবদের বাগানেই আবার কিছু ঘটেছে কর্নেল! আমি চললাম। আপনি কি আসবেন?
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, প্লিজ মি. শর্মা! এ বুড়োকে এই শীতে আর কষ্ট দেবেন না। সম্ভব হলে আজ রাতেই কিংবা কাল সকালের দিকে যদি ফোন করেন, খুশি হবো।
মি. শর্মা আর দাঁড়ালেন না। তক্ষুনি হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গিয়ে জিপে উঠলেন। জিপটা চলে গেলে কর্নেল হোটেলের লোক দুটিকে বললেন, তোমরা কি টিফিন কেরিয়ার এখনই নিয়ে যাবে?
ওরা মাথা দোলাল। তখন লক্ষ্য করলাম, দুজনেই কমবয়সী।
ঠিক আছে। এস কর্নেল এগোলেন। যেতে যেতে বললেন, জয়ন্ত, কিচেন খুলে দাও। চলো, ওখানে বসেই খাওয়াটা সেরে নিই।
হোটেলের ছোকরা বয়দুটোর অবস্থা দেখে মনে হল, তাদের একমাত্র ভাবনা, কী ভাবে ফিরে যাবে। বিল দিয়ে একজন বলল, স্যার, একটা কথা বলব?
কর্নেল বলল, নিশ্চয় বলবে।
আপনারা এই বাংলো ছেড়ে কালই চলে যান, স্যার!
কেন বল তো? ভূতটুত আছে নাকি?
কর্নেল সিরিয়াস হয়েই কথা বলছিলেন। দ্বিতীয়জন বলল, নিজের কানে এক্ষুনি তো শুনলেন! তবে বাংলোয় নেই স্যার। আশেপাশে আছে। এখানে এক রাতের বেশি কেউ থাকতে পারে না স্যার!
কর্নেল একবার একটু হাসলেন। …তাই বুঝি আমরাও এক রাতের বেশি থাকব না। তো ইয়ে, তোমরা যাবার সময় কিন্তু জোরে গান গাইতে গাইতে যেতে ভুলো না। কেমন?
দুই ছোকরা হোটেল বয় করুণ মুখে সায় দিয়ে বলল, তা আর বলতে স্যার?
বিহার–বিশেষ করে উত্তর বিহারের শীতের দাপট ভয়াবহ। ভাগ্যিস, আমরা দুটো কম্বল সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। বাংলোর সরকারি কম্বলের তলায় সেই নিজস্ব কম্বলদুটো জুড়ে চমৎকার ওম পাওয়া যাচ্ছিল। ফলে ঘুমটা গাঢ় হয়েছিল। কর্নেলের ডাকে যখন ঘুম ভাঙল, তখন সাড়ে আটটা বেজে গিয়েছে। রোদ ফুটেছে, কিন্তু কুয়াশাও প্রচুর রয়েছে। ইতিমধ্যে কর্নেল তার অভ্যাসমতো প্রাতভ্রমণ সেরে এসেছেন। মাথায় হনুমান টুপি, গায়ে ওভারকোট এবং হাতে ছড়িও দেখা যাচ্ছিল। কিচেনে ঢুকে কফিও তৈরি করে ফেলেছেন। আমাদের সঙ্গে কফি, জমানো দুধ, চিনি আছে। প্রচুর স্ন্যাকও এনেছি। মনে মনে বুড়োর অনন্ত পরমায়ু কামনা করে উঠে বসলাম এবং কোন কথা না বলে দ্রুত বাথরুমে ঢুকলাম।
বাথরুম পর্ব সেরে বেরিয়ে দুজনে কফি খেতে বলসাম। কর্নেল বললেন, গড়ের জঙ্গলে গিয়েছিলাম। ভেতরে ঢোকার অসুবিধে নেই। উড-ডাক নামে সেই দুর্লভ পাখির দেখা অবশ্য পাইনি। তবে জায়গাটা দেখেশুনে মনে হল, ওই হাঁসজাতীয় পাখির পক্ষে পরিবেশটা অনুকূল। হাঁস শুনে ভাববে, হাঁস তো জলচর পাখি! এই হাঁস কিন্তু জঙ্গলবাসী।
বললাম, সক্কালবেলা উড-ডাক নিয়ে আমার কোন কৌতূহল নেই।
সরি, ডার্লিং! কর্নেল একটু হাসলেন। তোমার কৌতূহল কিসে টের পাচ্ছি। হ্যাঁ, রাত সাড়ে এগারোটায় মি. শর্মা ফোন করেছিলেন, তখন তোমার নাক ডাকছে।
আমার নাক ডাকছে? অসম্ভব।
জয়ন্ত, কেউ নিজের নাক ডাকা শোনার জন্যে জেগে থাকে না। যাইহোক, নবাববাড়ির বাগানের সেই প্রতিমূর্তি গত রাতে আবার একটা মানুষ খুন করেছে। কাকে খুন করেছে জানো? বড় নবাবের প্রাইভেট সেক্রেটারি আতাউল্লা বেগকে।
সর্বনাশ! বলেন কী!
নবাবজাদা ইউসুফের মতো তারও শ্বাসনালী কেটে জবাই করা হয়েছে।
আমার শরীর নিঃসাড় হয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর বললাম, সে ওখানে কী করতে গিয়েছিল?
কর্নেল বললেন, পুলিশ কিছু অনুমান করতে পারছে না। নবাববাড়ির লোকেরাও অবাক হয়েছে। আতাউল্লা ওখানে কেন ওই সময় বেমক্কা- হাজির হল, তার সঙ্গত কৈফিয়ত কারও মাথায় আসছে না। আচ্ছা জয়ন্ত, গতরাত্রে আমরা যে আর্তনাদ শুনলাম, তোমার মনে আছে তো? কীরকম?
আপনিও তো শুনেছে। কতকটা এরকম : আঁ–আঁ–আ…
ঠিক, ঠিক ওই রকমই। আমি নিজের শোনাটা যাচাই করে নিলাম জয়ন্ত! কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ্য করো। আর্তনাদটা যেন জান্তব। তার মানে, আতাউল্লা ‘বাঁচাও কিংবা বাপরে মেরে ফেললে রে’ ইত্যাদি কোন চিৎকার না করে গোঙিয়ে উঠেছিল। এর একটাই মানে হয়। সে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিল। ভয় এবং বিস্ময়। মারাত্মক রকমের বিস্ময় আর ভয় থেকেই স্বভাবত মানুষের গলায় ওই আর্তনাদ বেরোতে পারে। তাহলে কি সত্যি সত্যি প্রতিমূর্তি জ্যান্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার ওপর?
কিন্তু প্রতিমূর্তির জ্যান্ত হওয়াটাই তো উদ্ভট!
নিশ্চয়, নিশ্চয়। তা আর বলতে!..বলে কর্নেল কী যেন ভাবলেন! ভেবে বললেন, মুশকিল হয়েছে এটাই যে ঘটনাটা ঘটেছে রাত্রে এবং মূর্তির কাছে কোন পায়ের ছাপ থাকলে অন্তত রাতের বেলায় তার ছবি নেওয়ার কোন ব্যবস্থা জিন্দাগড় পুলিশের নেই। সারা রাত শিশির পড়ার ফলে ছাপ লেও সকালে তা ধুয়ে মুছে যাবার কথা। মূর্তির নিচে চারপাশে ঘন ঘাস। সেখানে ছাপ পড়লেও কিছু করা যায় না। যাক গে, আপাতত নিজের চরকায় তেল দেওয়া যাক। মনে হচ্ছে, চৌকিদার এসে গেছে। ব্রেকফাস্ট আমরা বাইরে গিয়ে সেরে নেব। ও শুধু লাঞ্চের ব্যবস্থা করে রাখবে। ব্যস।….
চৌকিদারকে সব বলে টলে একটু পরে আমরা বেরোলাম। কর্নেল ক্যামেরা, বাইনাকুলার ইত্যাদি সঙ্গে নিতে ভুললেন না। আমি স্রেফ খালি হাতেই গেলাম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখা ছাড়া আর কীই বা করব।
আমাদের বাংলোর পশ্চিমে গড়ের জঙ্গল, পুবে নবাববাড়ি। কর্নেল কিন্তু ঘোরালো চড়াই-উত্রাইয়ের রাস্তা ছেড়ে টিলার গা বেয়ে সোজা উত্তরে গঙ্গার দিকে পা বাড়ালেন। ঝোঁপজঙ্গল পাথর পেরিয়ে আমরা গঙ্গার ধারে পৌঁছলাম। সামনে উঁচু ঘাস শর আর নলখাগড়ার ঝোঁপ জল অবধি নেমেছে। কর্নেল সেখান থেকে পুবে এগোলেন। বললাম, এদিকে কোথায় যাচ্ছেন? নবাববাড়ির বাগানে নয় তো?
না, না…বলে কর্নেল হাঁটতে থাকলেন।
ওঁকে প্রশ্ন করা বৃথা এখন। আমি দাঁড়িয়ে পড়লেও উনি থামবেন না। অতএব পা বাড়াতে হল। একটু পরেই ফুট চার-পাঁচ পাথরের পাঁচিল বাধা দিল এগোতে। ঝোঁপ ও গাছপালা এখানে ঘন। কর্নেল বললেন, এক মিনিট! তুমি অপেক্ষা করো। আসছি। …বলে উনি অনায়াসে পাঁচিলে উঠলেন এবং ওপাশে চলে গেলেন। এক টুকরো পাথরে উঠে ওঁকে দেখতে পেলাম। হ্যাঁ, এটাই নবাবদের প্রাইভেট কবরখানা। কর্নেল তাহলে ছোট নবাব মীর্জা সৈয়দ জালালের জন্ম-মৃত্যুর তারিখ দেখতে গেলেন! এটা কি মিঃ শর্মার কাছে জানা যেত না?
কবরগুলো স্পষ্ট হয়ে দেখা যাচ্ছিল। কোনটা সাদা অর্থাৎ মার্বেলের। কোনটা কালো অর্থাৎ কষ্টি পাথরের। কর্নেল হঠাৎ একটা সাদা কবরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন যেন। হেসে ফেললাম। চোট লাগেনি তো? যেমন কর্ম তেমনি ফল পাকা বুড়ো।
না, পড়েননি। আসলে ঝুপ করে বসে পড়েছেন। কিন্তু তারপরই আমার চোখ ঝলসে গেল বলা যায়। ভেতরদিকের গেট খুলে দুটি তরুণী ঢুকল। শালোয়ার-কামিজ-উড়নী পরা টকটকে ফর্সা অসাধারণ রূপবতী এই দুটি তরুণী সেই দুই বোন লায়লা আর মুনমুন না হয়ে যায় না। তারা কর্নেলকে দেখতে পাচ্ছিল না। কাবণ উনি একটা কবরের আড়ালে বসেছেন এবং একটা ফুলের ঝোঁপ রয়েছে। তারা হনহন করে এসে দুটো ফুলের তোড়া বের করল উড়নীর তলা থেকে। একটা কষ্টি পাথরের কবরের ওপর তোড়া দুটো রেখে দুই বোনে বুকের কাছে দুহাত প্রার্থনার ভঙ্গিতে তুলে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইল। দেখলাম, তাদের গোলাপী ঠোঁট কাঁপছে এবং গাল জলে ভেসে যাচ্ছে। কার কবরে প্রার্থনা এবং কান্নাকাটি করছে ওরা?
এই দৃশ্যে পবিত্রতা ছিল। অভিভূত হয়ে দেখতে থাকলাম। সকালের রোদে দুটি অসাধারণ সুন্দরীর অশ্রুভেজা মুখ এবং নীরব প্রার্থনা আমার এক দুর্লভ
অভিজ্ঞতাই বলা যায়। নবাব বাদশাহদের আমলে ফিরে যাইনি তো?
তারপর দেখি, কর্নেল উঠে দাঁড়িয়েছেন। কী দুঃসাহস! আমার প্রতি মুহূর্তে ভয় হতে থাকল যে এক্ষুনি তরুণী দুটি হাততালি দিয়ে কালান্তক হাবসী প্রহরীকে ডাকবে এবং তীক্ষ্ণধার খঙ্গে বুড়োর মুণ্ডটি যাবে।
কর্নেল কয়েক পা এগোতেই ওদের প্রার্থনা শেষ হল। দুহাত মুসলমানী প্রার্থনার রীতিতে মুখে ঘষে ওরা ঘুরতেই দুপক্ষে মুখোমুখি।
অন্তত তিরিশ গজ দূরে এবং বাতাস আমার দিকে আসছে না, তাই পরস্পর কী কথা হচ্ছে, শোনা গেল না। প্রথমে লায়লা মুনমুনের চোখে তীব্র একটা ভাব এবং জোর ঠোঁট নড়া দেখছিলাম, ক্রমে সে ভাব শান্ত হয়ে এল। তারপর দেখি কর্নেল হাসিমুখে অঙ্গভঙ্গি করে কথা বলছেন। ওরাও হাসছে–তবে চেষ্টাকৃত এবং অম্লান সেই হাসি।
বুড়োর এই ক্ষমতা অসংখ্যবার দেখেছি। এবারও দেখলাম। প্রায় কুড়ি মিনিট ওদের কথাবার্তা চলতে থাকল।
আমি অধৈর্য হয়ে পড়লাম। ওদের কাছে যাবার লোভ সম্বরণ করতে পারলাম না। কিন্তু পাঁচিলের কাছে গিয়ে মুণ্ডু বাড়াতেই কর্নেলের চোখ পড়ল এবং তক্ষুনি ইশারায় নিবৃত্ত করলেন। দুই বোন ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকায় আমাকে দেখতে পেল না।
তেতো মুখে সরে এলাম। কর্নেলকে মনে মনে অভিসম্পাত দিতে থাকলাম। সেই পাথরে উঠে দেখলাম, তিনজনে গেট খুলে বাগানে ঢুকল। তারপর ঝোঁপ ও গাছের আড়ালে অদৃশ্য হল। তখন রেগেমেগে পাথর থেকে নামলাম এবং সটান যে পথে এসেছি, সেই পথে বাংলোর রাস্তায় চলে এলাম।
কর্নেল এমন স্বার্থপর, অ্যাদ্দিন একটুও জানতে পারিনি। রাগ এত বেশি হল ওঁর সম্পর্কে, যে অকথা কুকথা অভব্য সবরকম অভিযোগ তুলেও শান্ত হওয়া গেল না।
উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে লাগলাম। সমতলে নেমে নবাববাড়ির সদর ফটকের সামনে দিয়ে যাচ্ছি, দেখি একটা জিপ আর একটাপুলিশভ্যান দাঁড়িয়ে রয়েছে। হনহন করে এগিয়ে গেলাম। রাস্তার একধারে চুনসুরকির গোলা, অন্যধারে পোড়ো জমি– তারপর জলের ট্যাঙ্ক। ট্যাঙ্ক পেরিয়ে বাঙালি-টোলা। সেখানেই একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়লাম। ব্রেকফাস্ট খাওয়া যাক্ এবং বুড়ো গোল্লায় যাক্।
রেস্তোরাঁর মালিক বাঙালি। নাম সত্যসুন্দর চক্রবর্তী। তিন পুরুষের বাসিন্দা। তার সঙ্গে ঝিন্দাগড়ের দ্রষ্টব্য নিয়ে কথাবার্তা হল। উনি বললেন, তবে সবচেয়ে অবাক হবোর মতো কিছু যদি দেখতে চান স্যার, সোজা গড়ের জঙ্গলে চলে যান। ওখানে একটা কষ্টি-পাথরের কবর আছে দেখবেন। কবরের গায়ে আটটা গুলির দাগ আছে। প্রত্যেকটা দাগ থেকে দেখবেন যেন রক্তের ধারা নেমেছে। দেখে বিশ্বাস করতেই পারবেন না নিজের চোখকে।
কার কবর ওটা?
মীরকাশিমের এক সেনাপতি আলি ইব্রাহিমের। ব্রিটিশ সৈন্যেরা এসে ইব্রাহিমকে জ্যান্ত না পেয়ে রাগের চোটে ওর কবরে গুলি করেছিল। যেই না গুলি করা, অমনি মশাই, কবর থেকে রক্ত বেরোতে লাগল। সেই রক্তের ছোপ এখনও আছে। ঘষে মুছে দিন। ফের ফুটে উঠবে।…
অতএব সেই অত্যাশ্চর্য কাণ্ড দেখতে তক্ষুমি রিকশোয় চেপে বসলাম। ফের নবাববাড়ির সামনে দিয়ে আমাদের ডাকবাংলোর নিচের পথে সোজা পশ্চিমে গড়ের জঙ্গলের কাছে গিয়ে নামলাম। রিকশাওলা চলে গেল। নির্জন জায়গা। গড়ের জঙ্গল উঁচুতে। সরু পায়েচলা পথ রয়েছে অজস্র। পাথর ও ইটের স্তূপের ওপর দিয়ে গেছে। দু’ধারে ঘন ঝোঁপঝাড় আর প্রকাণ্ড পাথর বা ইটের পাঁচিলের টুকরো পড়ে আছে। রিকশাওলার নির্দেশমত বটগাছ লক্ষ্য করে এগোলাম। বটগাছের তলায় সেই কবরটা দেখতে পেলাম। ধূপধুনো ও সাঁঝবাতির ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে। লোকেরা খুব ভক্তি করে বোঝা গেল।
সত্যি, এ অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কষ্টি-পাথরের কবরে এক-দেড় ইঞ্চি গর্ত– গুলির দাগ ছাড়া আর কিছু নয়। আর প্রতিটি দাগ থেকে লালরঙের ছোপ ছয় থেকে আট ইঞ্চি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখলাম কিছুক্ষণ। পরে মনে হল, নাঃ-এর মধ্যে নিছক কারিগরি চমৎকারিত্ব ছাড়া কোন অলৌকিক ব্যাপার থাকতেই পারে না। এই কবরের লোকটি নিঃসন্দেহে সুরসিক ছিলেন। লোকের সঙ্গে মজা করার জন্যে মৃত্যুর আগেই নিজের কবরের পাথরে সেরা কারিগর দিয়ে এই সব দাগ আর লাল রঙের ছোপ রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন।
একটু পরে আবার মনে হল, উঁহু! এর মনস্তাত্ত্বিক কোন কারণ থাকাও সম্ভব। লোকটির জীবনে নিশ্চয় প্রচণ্ড কোন দুঃখবেদনা ছিল। কবরে রক্ত ঝরা দিয়ে তাই প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। আলবাৎ, কোন বিরহী প্রেমিক ছিলেন ভদ্রলোক।
এইসব ভাবতে-ভাবতে হঠাৎ চোখ গেল উত্তর-পূর্ব কোণে। দেখি, উজ্জ্বল গৌরবর্ণ অভিজাত চেহারার এক মুসলমান ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। একটু দাঁড়িয়ে থাকার পর তিনি হঠাৎ বসে পড়লেন ঝোপের আড়ালে। একটু বিস্মিত হলুম। এতদূরে পায়খানার কাজ সারতে আসে কি কেউ? জল আছে নিচের নদীতে। কিন্তু গড়ের খাড়া পাঁচিল থেকে নদীর জলের দূরত্ব প্রায় পঞ্চাশ ষাট ফুট। তাহলে?
ব্যাপারটা দেখতে হয়। বটগাছের গুঁড়ির আড়ালে চলে গেলাম। দীর্ঘ পনের কুড়ি মিনিট পরে ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন এবং এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগলেন। উনি গড়ের জঙ্গল থেকে নিচে নেমে গেলে আমি হন্তদন্ত সেই জায়গায় গিয়ে হাজির হলুম। কিন্তু তেমন কিছু চোখে পড়ল না। তাহলে কী করছিলেন এখানে?
বসে পড়লাম। খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। জমাট সুরকি, পাথর, ইট, আর ঘাসের মধ্যে কোন অস্বাভাবিক চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল না। হঠাৎ আমার বাঁপাশে কয়েকটা ঘাসের শিষের দিকে চোখ পড়ল। শিষগুলো সোজা হয়ে উঠছে ক্রমশ। তার মানে এখানেই উনি বসেছিলেন। একটু ঝুঁকে সেই ঘাসের ওপাশে দেখি একটুকরো জমাট সুরকি পড়ে রয়েছে। সেটা সরাতেই থরথর করে কেঁপে উঠলাম। একটা ভাজ করা ক্ষুর রয়েছে, ক্ষুরটা জমাট রক্তে মাখামাখি হয়ে রয়েছে।…
রক্তমাখা ক্ষুরটা যেমন ছিল, ঢাকা দিয়ে প্রায় দৌড়ে গড়ের জঙ্গল থেকে বেরোলাম। নামতে নামতে দেখি সেই ভদ্রলোক ধীরে সুস্থে সমতল রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছেন। সামনাসামনি ওঁর মুখটা দেখব এবং চিনে রাখব ভেবে নিচে নেমে জোরে হাঁটতে লাগলাম। কিন্তু পঞ্চাশ-ষাট গজ তফাতে থাকতেই একটা খালি রিকশো এসে পড়ল এবং ভদ্রলোক সেটা থামিয়ে তাতে উঠে বসলেন। রিকশোটা ঘুরে যেদিক থেকে আসছিল, সেদিকে অর্থাৎ ঝিন্দাগড় শহরের দিকে এগোল।
হতাশ হয়ে হাঁটছি। এই সময় আমার পিছনের দিক থেকে একটা টাঙা এসে পড়ল। টাঙায় একজন যাত্রী সম্ভবত গ্রামাঞ্চল থেকে খন্দের বস্তা নিয়ে বসে রয়েছে। বলে কয়ে টাঙাটা দাঁড় করানো গেল। বললাম, যদি জোরে যেতে পারো, দু’টাকা বখশিশ পাবে! টাঙাওয়ালার ঘোড়াটা রোগা। তবু যথাসাধ্য দৌড়তে চেষ্টা করল। আমাদের বাংলো পেরিয়ে টাঙা এগোতে থাকল।
নবাববাড়ির ফটকে সেই রিকশোটা সবে ভদ্রলোককে নামিয়ে ঘুরছে, আমি টাঙা থামিয়ে লাফ দিলাম। বখশিশ ও ভাড়া দিয়ে রিকশোওয়ালাকে ডাকলাম। সে রিকশো থামাল। তার সঙ্গে শহর ঘোরা নিয়ে মিছিমিছি দরাদরি শুরু করলাম। তার ফাঁকে বললাম, এই তো সওয়ারী আনলে কত পেলে শুনি? নিশ্চয় অনেক দূর থেকে বয়ে আনতে হল। কত পেলে? বিদেশী পেয়ে ঠকাতে চাও?
রিকশোওলা মেজাজ দেখিয়ে বলল, নবাববাড়ির সওয়ারীর সঙ্গে তুলনা করবেন না বাবুজী। ওনাদের মতো পয়সা দিতে হলে জমিদারি বিকিয়ে যাবে। এই দেখুন না, মীরসাহেবকে গড়ে কাছ থেকে আনলাম–পুরো এক টাকা দিলেন। অন্য লোক হলে চার আনা দিত।
মীরসাহেব আবার কে?
মীর ফৈজুউদ্দিন সাহেব। ছোটী বেগমের সেরেস্তেদার।
শুনেই স্তম্ভিত হয়েছি। কিছু ভাবনার ভান করে বললাম, না ভাই। পারলাম না।
রিকশোওলা শেষ কথা বলে জবাব শোনার অপেক্ষা করে তেতো মুখে চলে গেল। আমি ততক্ষণে ভেতরে-ভেতরে অস্থির। মীর ফৈজুদ্দিনই তাহলে দু দুটো খুন করে দিব্যি ভালমানুষ সেজে বেড়াচ্ছেন! কর্নেলকে কথাটা বলার জন্যে ছটফটানি শুরু হয়েছে। পুলিশের জিপ ও ভ্যানটা ফটকের সামনে তখনও রয়েছে। কিন্তু কর্নেলকে আগে না জানিয়ে কোন তথ্য কস্মিনকালে পুলিশকে আমি জানাইনি। কর্নেলের সঙ্গে আমার বরাবর এই সমঝোতা রয়েছে। তাই শেষ অবধি আবার যেদিক থেকে এসেছি ঘুরে সেদিকে চললাম। বাংলোয় গিয়ে কর্নেলের অপেক্ষা করা যাক।…
দীর্ঘ তিন ঘণ্টা পরে কর্নেল ফিরলেন। জীবনে এমন দীর্ঘতর এবং অস্বস্তিকর সময় কখনও কাটাইনি।
কর্নেলের ওপর আগের সব রাগ ভুলে এক নিশ্বাসে গড়ের জঙ্গলের ঘটনাটা বলে ফেললাম। কিন্তু আশ্চর্য, কর্নেল শুধু বললেন, তাই নাকি? ভালই তো!
অবাক হয়ে বললাম, মি. শর্মাকে এক্ষুনি ফোন করুন। ক্ষুরটা এখনও..
কর্নেল বললেন, ছেড়ে দাও।
হতভম্ব হয়ে বললাম, সে কী!
কর্নেল একটু হাসলেন।..দেখ জয়ন্ত। আমি স্রেফ উড-ডাকের ছবি তুলতেই ঝিন্দাগড়ে এসেছি।
ঝাঁঝালো স্বরে বললাম, হ্যাঁ। তাই নবাবদের গোরস্থানে ঢুকেছিলেন এবং বড় নবাবের দুই মেয়ের সঙ্গে এতক্ষণ গল্প-সল্প করে কাটিয়ে ফিলেন।
কর্নেল হেসে ফেললেন হো হো করে। তারপর বললেন, তোমার নিশ্চয় ঈর্ষা হয়েছে, ডার্লিং। সত্যি! যুবক হয়ে যুবতীদের এক বুড়োর সঙ্গে মেলামেশা করতে দেখলে, তা স্বাভাবিক।
মোটেও না। কথা ঘোরাবেন না।..আরও রাগ দেখিয়ে বললাম।
কর্নেল বললেন, ধৈর্য ধরো বৎস। আজ বিকেলেই নবাব নন্দিনীরা আবার এই বুড়োর কাছেই আসবে। তখন যদি তোমার প্রতি তাদের অনুগ্রহ হয়, তোমার সঙ্গেও গল্প-সল্প করবে। অতএব অপেক্ষা করে থাকো।
কিন্তু খুনীর কথা জেনেও তাকে গ্রেফতার করতে বলবেন না?
কর্নেল সে কথার জবাব না দিয়ে উঠে গেলেন এবং বাইনাকুলার চোখে রেখে জানালা থেকে গড়ের জঙ্গল দেখতে থাকলেনবাংলোর পশ্চিমে। আমি একটু আশা পেয়ে পাশে গিয়ে বললাম, একটা বটগাছ দেখতে পাবেন। বটগাছটার তিরিশ ফুট দূরে বুনো গোলাপঝাড়–তার ওপাশেই কাশঝোপের তলায় ক্ষুরটা লুকানো আছে।
কর্নেল বাইনাকুলার নামিয়ে বললেন, চলোস্নান করা যাক। বড় দেরি হয়ে গেল। কাল কিন্তু সকালেই স্নান সেরে নেব। বুঝলে? শীতকালে প্রাতঃস্নান। স্বাস্থ্যকর।…
স্নানাহার শেষ হতে একটা বাজল। কর্নেলের আচরণে এমন ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম যে ওঁর সঙ্গে ভালভাবে বাক্যলাপই করলাম না। উনি রোদে কিছুক্ষণ চেয়ার পেতে বসে চুরুট খেলেন। তারপর বললেন, জয়ন্ত! ঘণ্টা দুয়েকের জন্য বেরোচ্ছি। তুমি ইচ্ছে করলে ঘুমটুম দিয়ে নাও, অবশ্য এখন ঘুম শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর।
উনি চলে গেলে অপমানিত বোধ করছিলাম। আমাকে এভাবে অগ্রাহ্য করে চলবেন, কখনও কল্পনা করিনি। কাল সকালেই, অতএব একা কলকাতা চলে যাব।
রোদে বসে থাকতে থাকতে ঘুম পেল। তখন উঠে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।
চৌকিদার কথামতো চা তৈরি করে যখন আমাকে জাগাল, তখন বেলা চারটে বেজে গিয়েছে। কর্নেল ফেরেননি। তাতে কিছু যায় আসে না। বুড়ো গোল্লায় যাক।
চা খেতে খেতে হঠাৎ মাথায় এল, হত্যার অস্ত্র এবং হত্যাকারীকে আবিষ্কার করেও কথাটা পুলিশকে না জানানো আইনের দিক থেকে তো বটেই, নৈতিক দিক থেকেও একটা অপরাধ নয় কি? কর্নেলকে বাহাত্তুরে ধরেছে। খামখেয়ালি মেজাজের লোক। আমি তো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ। আমার নিজস্ব বিবেক এবং যুক্তিজ্ঞান রয়েছে।
অতএব ফোন গাইড খুঁজে পুলিশসুপার মাধব শর্মার ফোন নাম্বার বের করলাম। ডায়াল করার পর ওপ্রান্তে রিং হল। বললাম, এস পি মি. শর্মাকে চাই।
আমার পিছনদিকে দরজার কাছে আওয়াজ হল–মি. শর্মাকে এখন পাবে না ডার্লিং।
ঘুরে দেখি, কর্নেল হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন।
ফোন তবু ছাড়লাম না। ওপ্রান্তে যে ফোন ধরেছিল হয়ত–তাই ফের বললাম, মি. মাধব শর্মা প্লিজ।
সাহেব কুঠিতে এখন নেই। কখন ফিরবেন, বলে যাননি।
মনে হল, ওঁর বেয়ারা কিংবা ওইরকম কেউ ফোন ধরেছিল! ফোন রেখে উঠে এলাম। তখন কর্নেল হাসতে হাসতে আমার দুই কাঁধে হাত রেখে মিঠে গলায় বললেন, ডার্লিং!তুমি বড্ড অধৈর্য হয়ে উঠেছ বুঝতে পারছি! এই বৃদ্ধকে ক্ষমাঘেন্না করে উৎকৃষ্ট পোশাকে সুসজ্জিত হও। কারণ নবাবনন্দিনীরা এখনই, এসে পড়বেন।…হ্যাঁ, ওই যে গেটের কাছে ইব্রাহিম টাঙাওলা এসে দাঁড়াল। ডার্লিং ঝটপট সেজে নাও। বাইরে লনে আমরা বসব! দেরি কোরো না কিন্তু।….
উনি বেরিয়ে গেলেন। আমি জানালায় উঁকি মেরে দেখলাম, সকালে দেখা সেই তরুণী দুটি টাঙা থেকে নামছে। শেষবেলার আলোয় চোখ ঝলসে গেল আবার। এই অপরূপ সৌন্দর্য কল্পনা করা যায় না। মানুষ আকাশের পরীর কল্পনা করেছিল এমন মেয়েদের দেখেই–তাতে কোন ভুল নেই।
বুড়োর জন্যে নয়, নিছক এই মেয়ে দুটির সৌন্দর্য এবং আভিজাত্যের খাতিরেই আমি আমার একটি উৎকৃষ্ট পোশাক পরে ফেললাম। তবে বিলিতি পোশাক নয়, সম্পূর্ণ দেশী। ধুতি, জরিদার মুগার পাঞ্জাবি, কাশ্মীরি সাদা শালও চড়ালুম।
আমাকে দেখে কর্নেল খুশি হয়ে বললেন, এস এস জয়ন্ত! আলাপ করিয়ে দিই। উঁহু হুঁ নমস্কার নয় ডার্লিং। এদেরই পিতৃপুরুষ একসময় ছিলেন সুবে বাংলা-বিহার উড়িষ্যার শাসনকর্তা। সামনে ঝুঁকে ডানহাত কপালে তিনবার ঠেকিয়ে কুর্নিশ করো–ঠিক এইভাবে। উনি ভঙ্গিটা দেখাতে দেখাতে বললেন, মুখে বলল, বন্দেগী বড়ি নবাবজাদী! বন্দেগী ছোটি নবাবজাদী! গোস্তাফি মাফ কিজিয়ে।
দুই বোন গাম্ভীর্য ভেঙে খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ল। আমি থতমত খেয়ে প্রায় ওইভাবেই কুর্নিশ করতে যাচ্ছিলাম, ওদের হাসিতে সামলে নিয়ে নমস্কারই করলাম। দুই বোন হাসি থামিয়ে অবাঙালি হিন্দু প্রথায় পালটা করজোড়ে নমস্কার করে বলল, নমস্তে। তারপর বড়বোন বিশুদ্ধ ইংরেজিতে বলল, কর্নেল আপনার কথা আমাদের বলেছেন। আমাদের এখানে আসার কথা ছিল জাস্ট সাড়ে তিনটেয়। অনেক দেরি করে ফেলেছি। ইব্রাহিম আসতে দেরি করল। তাছাড়া, বুঝতে পারছেন বাড়িতে কী অবস্থা চলছে।
কর্নেল সস্নেহে বললেন, তা তো বটেই। ইয়ে জয়ন্ত, তুমি হয়তো ভাবছ বাড়ি থেকে বাংলো জাস্ট পাঁচ মিনিটের রাস্তা–হেঁটে এল না কেন? আমি তোমায় বুঝিয়ে দিই। নবাব ফ্যামিলির কিছু রীতিনীতি এখনও মেনে চলতে হয়।
লায়লা বলল, হ্যাঁ, ওই এক ঝামেলা। অবশ্য আমি এতটা মেনে চলি না। তবে এখন যে ইব্রাহিমের টাঙায় এলাম, এর কারণ ইব্রাহিম টাঙাওলা আগে আমাদের বাড়ির নোকর ছিল। ওরা বডিগার্ড ছিল আমাদের পূর্বপুরুষের। বাবার আমলে ওদের ছাড়িয়ে দেওয়া হয়। এখন টাঙা চালিয়ে রোজগার করে। যখনই আমাদের বাড়ির মহিলারা বাইরে বেরোন, ওর টাঙা চাই-ই। কেন বলবেন তো? ও টাঙা চালাবে, ইজ্জতের হানি ঘটতে দেবে না, বডিগার্ডের কাজও করবে।
লায়লা হেসে উঠল। মুনমুনও। কর্নেল এবং আমিও হাসিতে যোগ দিলাম।
এরপর সে নবাব ফ্যামিলির অনেক পুরনো এবং অদ্ভুত অদ্ভুত আদব-কায়দা ও রীতিনীতির গল্প করতে থাকল। তাতে মুনমুনও যোগ দিল। এক ফাঁকে কর্নেল আমাকে ইশারায় অতিথি সৎকারের ব্যবস্থা করতে বললেন। খুব আদবকায়দা দেখিয়ে আমি উঠে গেলাম এবং চৌকিদারকে কফির আয়োজন করতে বললাম। স্ন্যাক্স ইত্যাদির প্যাকেট বের করে ওকে দিয়ে এলাম।
গেটে ইব্রাহিম টাঙা রেখে ঘোড়ার গায়ে হাত বুলোচ্ছে আর মাঝেমাঝে উদাস দৃষ্টে এদিকে তাকাচ্ছে।
সূর্যাস্ত হয়ে গেল খুব শিগগিরই। বাংলোর সামনের আলোটা চৌকিদার জ্বেলে দিল। কফি ও স্ন্যাক্স নিল ট্রেতে। খেতে খেতে নবাবী কাণ্ডকারখানা শুনতে থাকলাম। এসময় হঠাৎ লায়লা বলল, কর্নেল! আমার চাচী আম্মা বেগম মরিয়ম কিন্তু খ্রীস্টান জানেন তো? ওঁর আয়া মিসেস মিশেলও কিন্তু খ্রীস্টান।
কর্নেল বললেন, জানি।
লায়লা বলল, আলাপ করবেন চাচী আম্মার সঙ্গে? উনি তো নবাবী আদব কায়দার ধার ধারেন না।
কর্নেল হেসে বললেন, করবখন। তা ইয়ে মিস লায়লা, তুমি আলিগড় যাচ্ছ কবে? মুনমুনও তো যাবে?
লায়লা দুঃখিত মুখে বলল, হ্যাঁ–যেতে তো হবেই। বাড়িতে একদম থাকতে ইচ্ছে করছে না। থার্ড জানুয়ারি যাবার কথা। দু-চারদিন দেরি হবে হয়তো।
আমার প্রবল ইচ্ছে, ২৭ শে ডিসেম্বর এবং গত সন্ধ্যার ওই মর্মান্তিক ঘটনার বিবরণ ওর মুখ থেকে শুনি। দু-একবার কথাটা তুললামও কিন্তু কর্নেল কথা ঘুরিয়ে আজবাজে প্রসঙ্গে নিয়ে গেলেন। নবাববাড়ির নানান ব্যাপার–বিশেষ করে ওদের ছেলেবেলার স্মৃতি নিয়ে প্রশ্ন করে গেলেন। সেগুলো তেমন কিছু শোনার মতো নয়। একসময় ঘড়ি দেখে ওরা উঠে দাঁড়াল। লায়লা বলল, ভাগ্যিস আপনার সঙ্গে আলাপ হল কর্নেল–তাই অনেকটা মনমেজাজ ভাল হয়ে গেল। যে কদিন আছেন, আসার চেষ্টা করব। আপনি কিন্তু কাল সকালে একবার যাবেন। বাবা আপনাকে যেতে বলেছেন। অপেক্ষা করবেন। চাচী আম্মার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। আর মিঃ চৌধুরী, আপনিও যাবেন কিন্তু। আলাপ হয়ে খুব খুশি হলাম। নমস্তে।
কর্নেল বললেন, এস জয়ন্ত, ওদের গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।
গেটে যেতেই ইব্রাহিম টাঙাওলা আদাব দিয়ে একগাল হেসে বলল, আমি ইব্রাহিম হুজুর! কাল আপনাদের স্টেশন থেকে নিয়ে এলাম।
কর্নেল চমকে ওঠার ভান করে বললেন, তাই বুঝি? বাঃ!
ওরা চলে গেলে দুজনে ঘরে এসে বসলাম। চৌকিদার তখনই সব ঝটপট সামলে লণ্ঠন জ্বেলে কেটে পড়ল। আজ রাতের রান্নাটা সে করে রেখে গেল।
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, ছটা পাঁচ। জয়ন্ত, আমরা ঠিক সাড়ে সাতটায় বেরুব।
কোথায়? নিস্পৃহ ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলাম। উড-ডাকের ছবি তুলতে বুঝি?
সেও কি অসম্ভব কিছু জয়ন্ত? কর্নেল হাসলেন। তুমি তো জানো, আমার এই ক্যামেরায় রাতের অন্ধকারেও ছবি তোলা যায়–ওর মধ্যে ইলেকট্রনিক যে সিস্টেম রয়েছে, তাতে এক্সরের সাহায্যে ছবি ওঠে। ফ্ল্যাশটা চোখে দেখা যায় না। যাক গে, এখন এস। দুজনে কিছুক্ষণ দাবা খেলে নিই।
অবাক হয়ে বললাম, দাবা! আপনি দাবা জানেন? কখনও দেখিনি খেলতে।
কর্নেল ওঁর কিটব্যাগ থেকে দাবার ছক আর গুটি বের করে বললেন, কখনও খেলিনি নয়–খেলেছি। তবে তোমার সঙ্গে খেলিনি। কারণ, তুমি দাবা জানো বলে মনে হত গ। এখন হঠাৎ মনে হল, তুমি দাবা খেলতে জানো। অবশ্যই জানো।
কী ভাবে মনে হত যে আমি দাবা খেলতে জানি?
কর্নেল বললেন, তখন তুমি হঠাৎ একটা উপমা ব্যবহার করলে–ওটা স্প্যাস্কির একটা প্রিয় চালের নাম। যাক গে, কথা বাড়িও না! চলে এস।
কর্নেল দাবাতেও ধুরন্ধর। দুবার কিস্তি মাৎ করে হঠাৎ ঘড়ি দেখে বললেন, মাই গুডনেস! করছ কী? ওঠ জয়ন্ত, বেরোতে হবে। ধুতি-পাঞ্জাবি ছেড়ে বিলাতি পোশাক পরে ফেলো ঝটপট। কারণ বনবাদাড় ভাঙতে হবে। রবারের সোলওলা জুতো পরবে কিন্তু। আছে তো সঙ্গে? মেক হেস্ট!
এই সময় দরজায় টোকা পড়ল। কর্নেল উঠে গিয়ে দরজা খুলে বললেন, পাঁচ মিনিট লেট। যাক গে! আমরা প্রায় তৈরি।
দেখি মিঃ শর্মা। রীতিমতো ইউনিফর্ম পরেছেন এবং রিভলভার রয়েছে কোমরে। মৃদু হেসে বললেন, পায়ে হেঁটে চড়াই ভাঙতে হল। বয়স হয়েছে। টের পাচ্ছি আজকাল।
উত্তেজনায় রক্ত গরম হয়ে গেল। তাহলে প্রতিমূর্তি রহস্যের ব্যাপারেই আমরা বেরোচ্ছি! দু’মিনিটের মধ্যেই দরজায় তালা এঁটে আমরা বেরোলাম।
টর্চ থাকা সত্ত্বেও কেউ জ্বাললেন না। বাংলোর উত্তর দিকে নামতে থাকলাম আমরা। তখন চাঁদটা সবে উঠেছে। শিশিরে পা হড়কাচ্ছে তিনজনেরই। সতর্কভাবে নামছি।
কিছুক্ষন পরে নবাবদের গোরস্থানের পাঁচিল পড়ল সামনে। তিনজনে পাঁচিলে উঠে সাবধানে ওপাশে নামলাম। সেই সময় কোথায় দুবার শিসের আওয়াজ হল। মিঃ শর্মাও শিস দিলেন–তিনবার। আমার বুকে হাতুড়ি পড়তে থাকল। এবার কর্নেল ও মিঃ শর্মা হামাগুড়ি দিলেন। আমিও দিলুম। এইভাবে কবরের ফাঁক দিয়ে এগিয়ে আবার ছোট একটা পাঁচিল পড়ল। সেটা আগের মতো ডিঙিয়ে সম্ভবত বাগানে পড়লাম। ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে তিনজনে এগিয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় গিয়ে বসে পড়লাম। ততক্ষণে জ্যোৎস্না ফুটেছে। কুয়াশামেশা জ্যোৎস্নায় সামান্য দূরে যে কালো উঁচু জিনিসটা দেখা যাচ্ছে, ওটা কোন স্ট্যাচু–তাতে কোন ভুল নেই। ওটাই কি সেই রহস্যময় প্রতিমূর্তি? আতঙ্কে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলাম ওটার দিকে।
কতক্ষণ পরে হঠাৎ দেখি, সাদা মতো একটা মূর্তি নবাববাড়ির দিক থেকে এগিয়ে আসছে। মূর্তিটা প্রতিমূর্তির কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়াল। তারপর এদিক ওদিক ঘুরে কিছু দেখে নিয়ে পা বাড়াল। কর্নেল ও মিঃ শর্মা বসে থাকা অবস্থায় হামাগুড়ি দিয়ে সামনে একটা হাঁটুসমান উঁচু গুল্মের পিছনে গেলেন। আমিও ওঁদের অনুসরণ করলাম।
এবার প্রতিমূর্তির আদলটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। সামনে এক পা বাড়িয়ে বসে থাকা নবাবী পোশাক পরা প্রতিমূর্তির দুটো হাত দুই হাঁটু অবধি ছড়ানো রয়েছে। আর সাদা কাপড় পরা জ্যান্ত মূর্তি অর্থাৎ কোন লোক দু ধাপ উঠে দাঁড়িয়েছে তার মাথা প্রতিমূর্তির চিবুক অবধি উঠেছে।
তারপর নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। প্রতিমূর্তিটা নড়ে উঠল। সোজা হয়ে বসল। তার কালো হাত দুটো হাঁটু থেকে উঠল এবং লোকটার দু পাশ থেকে এগিয়ে আসতে থাকল।
না, না। অসম্ভব এ দৃশ্য! আমার চোখের ভুল ছাড়া কিছু নয়।
তারপরই দেখি কর্নেল আর মিঃ শর্মা এক সঙ্গে গর্জন করে উঠলেন– খবর্দার! এবং সঙ্গে সঙ্গে টর্চ জ্বলে উঠল। তারপর এপাশ ওপাশ থেকে আরও কয়েকটা টর্চ জ্বলল। কাদের পায়ের শব্দ শোনা গেল।
আর সেই আলোয় দেখলাম..
প্রতিমূর্তিটা ঠিকই বসে আছে। তার সামনে ভূষকালো একটা ভূতের মতো চেহারার লোক থমকে দাঁড়িয়েছে নিচের ধাপে সাদা পোশাক পরা লোকটাও স্থির দাঁড়িয়ে আছে।
মাত্র দু’ তিন সেকেন্ডের দৃশ্য এটা। তারপর কর্নেল ও মিঃ শর্মা এক লাফে কাছে চলে গেছেন। দুজনের হাতেই রিভলভার এবং জ্বলন্ত টর্চ। কর্নেল গর্জে বললেন, খবর্দার! এক পা নড়লে গুলি করব।
চারদিক থেকে জ্বলন্ত টর্চ নিয়ে পুলিশ অফিসার এবং কনস্টেবলরা দৌড়ে এসে কালো ভুতুড়ে চেহারার লোকটাকে ধরে টানতে টানতে নামিয়ে আনল। তখন সম্বিৎ ভেঙে কাছে চলে গেলাম।
প্রথমে চোখ পড়ল সাদা পোশাক পরা লোকটার দিকে। কী আশ্চর্য! এ যে সেই মীরসাহেব–যাকে রক্তাক্ত ক্ষুর লুকোতে দেখেছিলাম!
স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কর্নেল কাছে এসে বললেন, জয়ন্ত কি ওই নকল প্রতিমূর্তিটাকে চিনতে পারছ? গায়ে মুখে রঙ মাখলেও তো চিনতে ভুল হবার কথা নয়। ভাল করে দেখতো!
এবার চিনতে পেরে অবাক হয়ে বললাম, আরে! ও যে সেই ইব্রাহিম টাঙাওলা!
হা–ইব্রাহিমই বটে। কর্নেল একটু হেসে বললেন। এবং ওর হাতে কী ছিল, তা দেখতে হলে স্ট্যাচুর তৃতীয় ধাপটা লক্ষ্য করো।
তাকিয়ে দেখি, একটা ক্ষুর পড়ে রয়েছে। কর্নেল আমার হাত ধরে বললেন, ব্যাটার ক্ষুরটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হাত থেকে পড়ে গেছে। মীরসায়েবের গলাটা জবাই করতে পারলে ও খুশি হত। দেখছ না মীরসায়েবের দিকে কী ভাবে এখনও তাকাচ্ছে?
মিঃ শর্মা এসে বললেন, আসুন কর্নেল। আমরা বড় নবাব সায়েবের সঙ্গে দেখা করে আসি। ভদ্রলোক অস্থির হয়ে পড়েছেন এতক্ষণে। কই মীরসায়েব, চলুন। আসুন জয়ন্তবাবু।
কর্নেল বললেন, একমিনিট মিঃ শর্মা। আজ সারারাতের জন্যে এই স্যাচুটা কিন্তু পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে। খুব বিশ্বস্ত এবং কর্তব্যপরায়ণ প্রহরী চাই কিন্তু।
মিঃ শর্মা অবাক হয়ে বললেন, স্ট্যাচুটা পাহারা দিতে হবে? কেন বলুন তো?
মীরসায়েব বললেন, হ্যাঁ স্যার। ওর ভেতর……
কর্নেল দ্রুত ওঁকে ইশারায় নিষেধ করলেন। বললেন, পরে শুনবেন মিঃ শর্মা।
মিঃ শর্মা তক্ষুনি একজন অফিসারকে ডেকে সেই মতে আদেশ দিয়ে বললেন, এবার চলুন, কর্নেল। ওঁরা আসামী লকআপে নিয়ে যাবেন। আমাদের আর করার কিছু নেই।
একটা প্রশস্ত ঘরে আমরা বসলাম। মনে হল, এটা নবাববাড়ির স্টাডিরুম। অনেক আলমারি ভরা বই রয়েছে। দেওয়ালে পেন্টিং রয়েছে। একটু পরে লায়লা ও মুনমুন দুই বোন একটা চাকাওয়ালা চেয়ার ঠেলতে ঠেলতে ঘরে ঢোকাল–সেই চেয়ারে প্রৌঢ় এক ভদ্রলোক বসে রয়েছেন। তার চেহারায় ব্যক্তিত্ব এবং আভিজাত্য প্রকট। বুঝলুম, উনিই মীর্জা সৈয়দ ইকবাল। আমরা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে সামনে একটু ঝুঁকে আদাব দিলুম। উনি কপালে হাত তুলে আদাব দিলেন। তারপর লায়লাকে উর্দুতে বললেন, তোমার চাচী আম্মাকে ডেকে নিয়ে এস। নিজের কানে সব শুনুন। মনের সংশয় দূর হবে।
লায়লা চলে গেল। মিঃ শর্মা উর্দুতে বললেন, কী সংশয় নবাবসাহেব?
মীর্জা ইকবাল একটু হেসে ইংরিজিতে বললেন, ওঁর দোষ নেই মিঃ শর্মা। ফিমেল লজিক বলে একটা কথা আছে। উনি ইউরোপিয়ান মহিলা হলেও ঈশ্বরের পৃথিবীতে মহিলা মানে মহিলা। ওঁর ধারণা, আমাদেরই কোন চক্রান্ত আছে এ ব্যাপারে। কী চক্রান্ত আছে না আছে, সব কর্নেলসাহেব এবং আপনিই ওঁকে বলুন। আমাদের স্বামী-স্ত্রীর খুব ইচ্ছে ছিল, ইউসুফকেই জামাই করি। বাপহারা ছেলে। তো……যাকগে।
নবাবসাহেব বিষণ্ণভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করলেন। কর্নেল বললেন, আচ্ছা নবাবসাহেব! ইব্রাহিম কী ভাবে আপনার দাদুর স্ট্যাচুর ব্যাপারটা জানতে পারল বলতে পারেন?
নবাবসাহেব বললেন, সেটাই তো অবাক লাগছে। তাকে এবাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি গত বছর সেপ্টেম্বরে। ভীষণ চুরিচামারি করত। এ ঘরের দেওয়ালে আরও কত বিখ্যাত অরিজিনাল সব পেন্টিং ছিল। সব ব্যাটা চুরিচামারি করে বেচে দিয়েছে। হাতেনাতে ধরা অবশ্য পড়েনি। কিন্তু পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য বিস্তর ছিল। যাইহোক, ওকে ছাড়ানোতে কিন্তু আমার বেগমসাহেবা বেজার হয়েছিলেন। আমার ভ্রাতৃবধূও ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। কারণ, ইব্রাহিমকে ওঁরা পছন্দ করতেন। ইব্রাহিমের ওই তো চালাকি! মানুষকে গলিয়ে দিতে ওস্তাদ। ওকে তাড়ানোর কিছুদিন পরে জানতে পারলাম, ব্যাটা আমার অজান্তে বাড়ি আসে। বেগমসাহেবাদের কাছে বকশিস নিয়ে যায়। বকাবকি করেও কোন ফল হয়নি।
মীরসাহেব বললেন, ইব্রাহিম টাঙা চালাবার আগে কসাই হয়ে মাংসের দোকান খুলেছিল। মাংস দিয়ে যেত বরাবর। আমি আপত্তি করতাম। কিন্তু করলে কী হবে? বাড়ির দুই গিন্নিই ওকে আস্কারা দিতেন। ব্যাটা বড্ড বেহায়াও বটে।
কর্নেল বললেন, ইব্রাহিমের কসাই হওয়া কথাটাই কিন্তু প্রথম একটা অস্পষ্ট ক্লু হিসেবে আমার মাথায় এসেছিল। যে-ভাবে দু’দুটো খুন হয়েছে বোঝাই যায়কসাইদের হাতের কাজ ছাড়া কিছু নয়।
এই সময় লায়লার সঙ্গে দুই শাড়িপরা মেমসাহেব ঢুকে নমস্কার করে একটু তফাতে বসলেন। পরিচয় করিয়ে দিল লায়লা। মিসেস মেরী মীর্জা এবং মিসেস মিশেল। নবাবসাহেব ভ্রাতৃবধূর উদ্দেশে বললেন, মরিয়ম! সব শুনেছ ইতিমধ্যে। এবার ডিটেলস শুনে নাও। এঁরাই সব বলবেন।
মিসেস মেরী মীর্জা আস্তে এবং মুখ নামিয়ে বললেন, এবার সব বুঝতে পেরে গেছি। আমি যেন টের পেয়েছিলাম–অথচ তলিয়ে ভাবিনি।
কর্নেল বললেন, কী টের পেয়েছিলেন মিসেস মীর্জা?
মিসেস মেরী মীর্জা বললেন, সাতাশে ডিসেম্বর বিকেলে ইব্রাহিমকে বাগানে ঢুকতে দেখেছিলাম। দোতালার ঘর থেকে দেখতে পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, তাহলে সত্যি কি চুরি-চামারি করতে চায় কিছু? একটু পরে তাকে আর দেখতে পেলাম না। পরে ওর কথা ভুলেই গেলাম।
কর্নেল নবাবসাহেবের উদ্দেশে বললেন, নবাবসাহেবের কাছে আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি। ইব্রাহিম কী ভাবে দাদুর স্ট্যাচুর ব্যাপারটা জানল?
নবাবসাহেব বললেন, দেখুন–ব্যাপারটা শুধু আমি আর আমার ছোটভাই পরলোকগত ছোটনবাব মীর্জা সৈয়দ জালাল জানত। সম্ভবত জালাল তার স্ত্রীকে বলে থাকবে।
মিসেস মেরী মির্জা বললেন, হ্যাঁ–কিন্তু আমি তো কাউকেও বলিনি।
কর্নেল বললেন, ভালভাবে স্মরণ করে দেখুন তো মিসেস মীর্জা! মুখ ফসকে দৈবাৎ কখনও বলেছিলেন কি না? যদি বলে থাকেন, তখন কে উপস্থিত ছিল?
মিসেস মেরী মির্জা ভাবতে লাগলেন। হঠাৎ মিসেস মিশেল বলে উঠলেন, স্ট্যাচুর মধ্যে সোনার মোহরের কথা তো? মেরী! সাতাশে ডিসেম্বর সকালে যোসেফ আমি আর তুমি গল্প করছিলাম। যোসেফ টাকার কথা তুলল। তখন তুমি ঠাট্টার সুরে বললে, তোর দাদু বিস্তর সোনার মোহর রেখে গেছেন, ভাবিসনে। যোসেফ বলল, কোথায় আছে সেই মোহর? তখন তুমি বললে, তোর দাদুর বাবার স্ট্যাচুর মধ্যে। যোসেফ আর আমি দুজনেই অবাক হয়ে গেলাম। ভাবলাম, তামাশা করছ! তুমি সিরিয়াস হয়ে বললে, না–তামাশা নয়, সত্যি। তোমার বাবা বলে গেছেন।
মিসেস মেরী মীর্জা নড়ে বসলেন।…..হ্যাঁ, হ্যাঁ। মনে পড়েছে। কিন্তু তখন ইব্রাহিম তো ছিল না।
মিসেস মিশেলও বললেন, হ্যাঁ–ইব্রাহিম তখন তো ছিল না।
কর্নেল বললেন, কথা হচ্ছিল কোথায়?
মিসেস মেরী মীর্জা বললেন, কিচেনে।
কাছাকাছি বাঁদী বা বান্দা উপস্থিত ছিল কি?
হা–ছিল। একজন বাঁদী ছিল। তবে কিচেনের মধ্যে নয়। পাশের ডাইনিং রুমে প্লেট গোছাচ্ছিল। সে কিছু শুনেছিল বলে মনে হয় না। আমরা চাপা গলায় কথা বলছিলাম।
কে সে?
অমনি মিসেস মিশেল বলে উঠলেন, ও মেরী! তুমি কী বোকা মেয়ে! বাঁদী মায়মুনা বুড়ি, ইব্রাহিমের বিধবা দিদি না?
ঘরে একটা চাপা ধরনের সাড়া পড়ল। কর্নেল বললেন, বোঝা গেল সে তাহলে ভাইকে কথাটা পাচার করে দিয়েছিল!
নবাবসাহেব অস্ফুটভাবে বললেন, বলছিলাম না মহিলা ইজ মহিলা?
মিঃ শর্মা বললেন, মায়মুনা কি এ বাড়ি থাকে, না বাইরে কোথাও থাকে?
মিসেস মিশেল বললেন, বাড়িতেই থাকে। বাড়ির ওপাশে সারবন্দী ঘর আছে। সেখানে থাকে। কিন্তু ও তো ২৮ শে ডিসেম্বর থেকে নেই। কোথায় এক বোনের বাড়ি গেছে। বোনের নাকি অসুখ। ছুটি নিয়ে গেছে।
কর্নেল বললেন, ব্যাপারটা বোঝা গেল। স্ট্যাচুর মধ্যে মোহর আছে শুনে ইব্রাহিম মরিয়া হয়ে উঠেছিল। ইউসুফ সম্ভবত স্ট্যাচুর কাছে কোন নড়াচড়া দেখে এগিয়ে যায় এবং মারা পড়ে। এবার আসছে আতাউল্লা বেগের কথা। গতকাল সন্ধ্যায় আতাউল্লাও সম্ভবত সন্দেহজনক নড়াচড় লক্ষ্য করে স্ট্যাচুর কাছে যায় এবং মারা পড়ে। একই হত্যাপদ্ধতি! ইব্রাহিম কাউকে আসতে দেখলে স্ট্যাচুর কোলে বসে পড়েছে–গায়ে কালো রঙ মেখে এসেছে। শীতের জ্যোৎস্নায় কুয়াশা বড্ড অস্পষ্টতার সৃষ্টি করে। ফলে ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য অলৌকিক মনে হওয়া স্বাভাবিক। ইব্রাহিমের বুদ্ধি প্রখর। ক্ষুর দিয়ে সহজে মানুষ মারার ক্ষমতাও কসাইগিরির ফলে আয়ত্তে এসেছিল। যাই হোক, আজ যে তার জন্যে ফাঁদ পাতা রয়েছে, সে টের পায়নি।
মীরসাহেব বললেন, আপনার কথামতো তখনই বেরিয়ে আমি ওর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। বাকিটা তো আপনি জানেন। নবাবসাহেবও জানেন।
কর্নেল বললেন, আর সবাই জানেন না। আপনি বলুন। গোড়া থেকেই বলুন।
মীরসাহেব বললেন, লায়লা আর মুনমুনের সঙ্গে বাগানে আপনাকে কথা বলতে দেখে তো এগিয়ে গেলাম। আপনি বললেন, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দফতর থেকে আপনাকে তদন্তে পাঠানো হয়েছে। তখন এস. পি. সাহেব বাড়ির মধ্যে নবাবসাহেবের সঙ্গে কথা বলছেন। আপনার কথার সত্যিমিথ্যা পরীক্ষা করতে আপনাকে নিয়ে গেলাম। দেখলাম, এস. পি. সাহেব আপনাকে চেনেন। বাড়ির লোকজন সম্পর্কে খুঁটিয়ে জিগ্যেস করছিলেন আমাকে। ইব্রাহিমের ছবিচুরি– তারপর আস্তাবলের মেঝের খোঁড়াখুঁড়ির কথা সব বললাম।
এসময় বড়নবাবু বললেন, হ্যাঁ। ও বেটা রাতদুপুরে আস্তাবলের মেঝে খুঁড়ছিল। মারধর খেয়েছিল। ওর ধারণা, নবাবপ্যালেসে গুপ্তধন গিজিগিজ করছে। ব্যাটা শয়তান আহাম্মক। শরীর চললে ওকে গুলি করে মারতাম!
মীরসাহেব ফের শুরু করলেন, যাই হোক। আপনার কথামতো তক্ষুনি গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করে বললাম, ভাই ইব্রাহিম! একটা গোপন কথা বলতে এলাম। ইব্রাহিম সবে তখন নাস্তা খাচ্ছে। ব্যাটা টাঙা নিয়ে বেরোয় তো বেলা নটা গড়িয়ে। চোরের একটা মুখোশ ওই টাঙা। ইব্রাহিম হকচকিয়ে বলল কী, কী? বললাম, গতকাল সন্ধ্যাবেলা তোমার কীর্তি তো সব দেখেছি ভাইজান। ব্যাটা কিছুতেই পাত্তা দিতে চায় না। অনেক কথা খরচ করার পর শেষে বললাম, আতাউল্লা বেগের লাশের কাছে রক্তমাখা ক্ষুর ফেলে এসেছ। এই দেখ, সেটা এনেছি। তুমি খুব বোকা লোক। যাক গে, যা হবার হয়েছে। মোহরের কথা। আমিও জানি! কিন্তু সাহস পাইনি। আর ওই স্ট্যাচু ভেঙে মোহর বের করা সহজ কথা নয়। একার কাজও নয়। আমরা আজ সন্ধ্যাবেলা দু’ভাই মিলে বাগানে গিয়ে স্ট্যাচু ভাঙব–আমিই ভাঙব। জোড়ের মুখ কোথায়, তা আমিই জানি। অমনি ইব্রাহিম বলল, আরে সে আমিও জানি! স্ট্যাচু বানাবার সময় হাজির ছিলাম না? আসলে একটা বড় শাবল দরকার। দুবারই ছোট শাবল নিয়ে গেলাম–কাজ হল না। তুমি যখন জেনেই ফেলেছ আর কথা নেই। দুজনে আধাআধি বখরা নেব। এ বরং ভালই হল। হঠাৎ একটু আওয়াজ পেয়ে সন্দেহবশে কেউ বাড়ি থেকে বাগানে আসছে কি না, তুমি লক্ষ্য রাখবে। তেমন দেখলে শিস দেবে…একবার। ওর কথা শোনার পর বললাম, কাজ সারতে হলে আজই। কারণ, মোহরের কথা বড়নবাব জানেন। শুনলাম কালই স্টাচু ভেঙে মোহর সরানো হবে। আজ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার পর তুমি বাগানে ঢুকবে। ওই ঘড়িঘরের ঘড়িতে সময়টা দেখে বেরুবো। ব্যস!
মীরসাহেব একটু দর্ম নিয়ে বললেন, ব্যাটার চোখে লোভ চকচক করে উঠল। বলল, খোদা যা করেন, ভালই করেন। আপনি থাকলে আর কোন অসুবিধা নেই। নিশ্চিন্তে অনেকটা সময় নিয়ে কাজ করা যাবে। অত বড় মূর্তি ভাঙতে সময় লাগবে। আওয়াজও হবে। আপনি সব সামলাবেন। পরে আমার সঙ্গে দেখা করবেন ফুরসৎ মতো। আল্লার কসম এক মোহরও গাপ করব না। বখরা ঠিকই পাবেন। তখন আমি বললাম, তা হলে ক্ষুরটা কী হবে? ইব্রাহিম বলল, আর ক্ষুরের দরকারটা কী? সামলে দিন। আমি বললাম, ঠিক আছে, সাড়ে সাতটায় বেরোবে কিন্তু বলে চলে এলাম। কিছুদূর আসার পর দেখি, কর্নেল সাহেব যা বলেছিলেন তা ঠিক ব্যাটা আমাকে টাঙা নিয়ে ফলো করছে। তখন গড়ের জঙ্গলের দিকে পা বাড়ালাম। ক্ষুরটা সত্যি না লুকোলে ও আমায় সন্দেহ করবে। তাই গড়ের জঙ্গলে ঢুকে একজায়গায় পুঁতে ফেললাম। নেমে গিয়ে দেখি শয়তানটা টাঙা নিয়ে জোরে বেরিয়ে গেল। নজর রেখেছিল। যাবার সময় হেসে ইশারায় বলে গেল, ঠিক করেছেন।
মি. শর্মা বললেন, কিন্তু ও আপনাকেও খুন করত। আরেকটা ক্ষুর নিয়ে যেতে ভোলেনি কিন্তু।
কর্নেল বললেন, তা তো করতই। বখরা দেওয়ার ব্যাপার আছে। তার ওপর আছে ব্ল্যাকমেলিং এর আতঙ্ক। তাই মীরসাহেবকে খতম করার মতলব নিয়েই এসেছিল আসলে। আজ ইব্রাহিম মোহর বের করার জন্যে স্ট্যাচু ভাঙতে আসেনি। কারণ, সঙ্গে কথামতো শাবল আনেনি।
মীরসাহেব বললেন, হ্যাঁ। আমার গলায় প্রায় চালিয়ে দিয়েছিল ক্ষুর। প্রতি সেকেন্ডে আমি ভাবছি, আপনারা আলো জ্বেলে লাফিয়ে পড়বেন। যাই হোক। আমিও তৈরি ছিলাম।..বলে পকেট থেকে একটা ছোরা বের করে দেখালেন।..ও হাত তুলেছিল, কিন্তু তখন আমি ছোরাটাও বাগিয়ে ধরেছিলাম।
নবাবসাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সবই হল। কিন্তু যারা যাবার তারা চলে গেল! আতাউল্লা আর ইউসুফকে ফিরে পাওয়া যাবে না। ওঃ! দাদুসাহেবই যেন নিজের হিংস্র স্বভাব এভাবে চরিতার্থ করলেন। হিন্দু হলে বিশ্বাস করতাম, দাদুসাহেবের আত্মাই যেন ইব্রাহিম হয়ে জন্মেছিল!
মিসেস মেরী ও মিসেস মিশেল রুমালে চোখ মুছলেন। লায়লা ও মুনমুন নতমুখে নিঃশব্দে অশ্রুপাত করতে থাকল। ঘরে শোকের স্তব্ধতা জাগল কিছুক্ষণের জন্যে। তারপর মি. শর্মা উঠে দাঁড়ালেন। আমরা এবার আসি নবাবসাহেব।
নবাবসাহেব ব্যক্তভাবে বললেন, না না। সামান্য অতিথিসেবার আয়োজন করতে বলেছি। আপনারা দয়া করে একটু বসুন।