নবান্ন – বাংলার প্রাণের উৎসব
হেমন্তের ফসল কাটাকে কেন্দ্র করে নবান্ন উৎসবের সূচনা হয়! নবান্ন অর্থাৎ নতুন অন্ন। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শস্যউৎসব হল এটি। বাংলার কৃষিজীবী সমাজের শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব আচার অনুষ্ঠানও উৎসব পালিত হয় নবান্ন তার মধ্যে অন্যতম। নবান্ন হলো নতুন আমন ধান কাটার পরে সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব। যা সাধারণত অঘ্রাণ মাসে আমন ধান পাকার পর অনুষ্ঠিত হয়। নতুন চালের গুঁড়ি দিয়ে ফিরনি পায়েস ,পিঠে তৈরি করে উপাস্য দেবদেবীকে এবং আত্মীয়-পরিজন বন্ধুবান্ধবকে পরিবেশন করা হয়!
হেমন্ত হলো ষড়ঋতুর চতুর্থ ঋতু– কার্তিক ও অঘ্রান মাসের সমন্বয়ে গঠিত। শরৎ শেষে এ ঋতুর আগমন শীতের পূর্বাভাষ। কৃত্তিকা ও আদ্রা নক্ষত্রের নাম অনুসারে এই দুই মাসের নামকরণ হয়েছে কার্তিক-অগ্রহায়ণ। “মরা”কার্তিক এরপর আসে সর্বজনীন লৌকিক উৎসব নবান্ন! অগ্র ও হায়ণ এই দু অংশের অর্থ ধান ও কাটার মৌসুম। হেমন্ত ঋতুর শান্ত সৌন্দর্য কবিদের কলমে সুন্দর চিত্রিত হয়েছে। কবিগুরুর –“-হিমের রাতের ওই গগনের দীপগুলিরে
হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে”—- কবি সুফিয়া কামালের ছড়া-কবিতা হেমন্ত—-
“সবুজ পাতার খামের ভেতর
হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে
কোন পাথারের ওপার থেকে
আনল ডেকে হেমন্তকে—“–
ফসল কাটার পর কৃষিজীবী গৃহস্থরা পালন করে এই নবান্ন উৎসব! গ্রামীণ মানুষ নতুন চালের ও নতুন গুড়ের তৈরি সামগ্রী গৃহদেবতার সঙ্গে সঙ্গে “কাক” কেও দান করে। এই বিশেষ লৌকিক প্রথাকে বলে “কাক বলী”! লোক বিশ্বাস যে কাকেদের মাধ্যমে এই খাদ্য পরিবারের মৃত পূর্বপুরুষদের কাছে পৌঁছে যায়! নবান্নের সাথে মিশে আছে হাজার বছরের বাঙালিয়ানার ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি! সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল উদাহরণ এই নবান্ন উৎসব! জাতি-ধর্ম-বর্ণ উপেক্ষা করে এক সামাজিক মেল বন্ধনের উৎসব! যান্ত্রিকতা ছোঁয়ায় এখন আর এই উৎসবের আনন্দঘন পরিবেশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে তবুও হাজার বছরের পুরনো এই উৎসবটি এখনও গ্রাম বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় সর্বজনীন লৌকিক উৎসব। বাংলাদেশ নবান্নে জামাইকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় মেয়েকেও বাপের বাড়িতে “নাইওর” আনা হয়।
এক সময় বাংলায় বছর শুরু হতো হেমন্তে। কারণ ধান উৎপাদনের ঋতু হেমন্ত। বর্ষার শেষে বোনা আমন শরতে বেড়ে ওঠে আর হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকে ধান পরিপক্ক হয়। সম্রাট আকবর অগ্রহায়ণ মাস কে বছরের প্রথম মাস বা খাজনা তোলার মাস ঘোষণা করেছিলেন ।
কবি জীবনানন্দের কবিতায় বারবার উঠে এসেছে নবান্নের চিরায়ত বাংলার রূপ—
” আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঠাঁলছায়ায়।”,
হৈমন্তী বাতাসে ভেসে বেড়ায় নবান্নের আনন্দের সুর। নতুন ফসলে উথলে ওঠা মাঠ কোঠায় মা লক্ষ্মীর আসন বিছানো হয়। প্রতি বছরই ঘুরে ঘুরে আসে এই চিরায়ত উৎসবের দিন । ভূমিপুত্রদের মনের কোনে আনন্দ স্মৃতি হয়ে থাকেএই উৎসব ।
তথ্যসূত্র– লোকভাষ, গুগোল