নববর্ষের হাল হকিকৎ
বিভিন্ন ঐতিহাসিক বাংলা সনের ইতিহাস সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ মতবাদ করেছেন। কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বহুকাল আগে থেকেই সৌর বছরের প্রথম দিন বাংলা, আসাম, কেরালা, মণিপুর, নেপাল ইত্যাদি বিভিন্ন ভারতীয় প্রদেশে মূলত ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে নববর্ষ পালিত হতো।
অন্যদিকে আবার বহু ঐতিহাসিক মনে করেন যে বাংলা বর্ষপঞ্জিকার পরিমার্জন এর মাধ্যমে খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা কে একটি সুষ্ঠু রূপ দেওয়ার জন্য মুঘল সম্রাট আকবর সৌর পঞ্জিকা এবং হিজরি সনের মেলবন্ধন ঘটিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জিকার প্রচলন করেন। কিন্তু বহু ঐতিহাসিক আবার এই দাবিকে নস্যাৎ করে দিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জিকে হিন্দু ঐতিহ্যের দিনপঞ্জীর সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করেন।
একথা সত্য যে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে আকবরের শাসনকালের বহু আগেও বাংলা বর্ষপঞ্জিকা এবং নববর্ষ উদযাপনের নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। সেজন্য আকবরকে বাংলা বর্ষপঞ্জির উদ্ভাবক বলে ধরে নেওয়া যুক্তিসম্মত মনে করেন না তারা। আধুনিক গবেষণার ফলে মনে করা হয় গুপ্তযুগীয় বঙ্গসম্রাট শশাঙ্কের শাসনকালেই বঙ্গাব্দের সূচনা হয়।
নববর্ষ উদযাপনের তাৎপর্য
বাঙালীর নববর্ষ উদযাপনকে স্বাভাবিক আপাতদৃষ্টিতে অগণিত উৎসবের একটি সুষ্ঠু সমাহার বলে মনে হলেও বাঙালীর জীবনে নববর্ষ উদযাপনের সার্বিক গুরুত্ব অপরিসীম। সমগ্র একটি বছর ধরে মানুষের জীবনে যে মানসিক ক্লান্তি, গ্লানি ও হতাশা জন্ম নেয় সেগুলি থেকে মুক্তির পথ অন্বেষণেই উৎসবের সার্থকতা। বাঙালীর নববর্ষ উদযাপন এক্ষেত্রে কোনো ব্যতিক্রম নয়।
বিভিন্ন উৎসবের মধ্য দিয়ে নববর্ষ পালন করে বাঙালীরা পুরনো বছরের সকল ক্লেদ, গ্লানি এবং জীর্ণতাকে বিসর্জন দিয়ে প্রকৃতপক্ষে নতুন জীবনের আশ্বাসকেই বরণ করে নেয়। তাছাড়া নববর্ষ উদযাপনের মধ্য দিয়ে সকল বাঙালীর মধ্যে গড়ে ওঠে এক অপূর্ব স্বাজাত্যবোধ, বেঁচে থাকে বাঙালীয়ানা। বিভিন্ন উৎসবের পালনের মধ্যে দিয়ে বাংলার অগণিত মূল্যবান লোকসংস্কৃতি বিশ্বের দরবারে পরিচিতি পায়। পৃথিবীজুড়ে সকল বাঙ্গালীর মধ্যে ঐক্যগত মেলবন্ধনের সেতু রচিত হয়।
আধুনিক নগরজীবনে নববর্ষ
বর্তমান যুগে বাইরে থেকে আমদানিকৃত বিদেশী সংস্কৃতির আধিপত্যজনিত বাড়াবাড়িতে বাংলা নিজস্ব সংস্কৃতি প্রায় লুপ্ত হতে বসেছে। বাঙালীর জাতীয় সত্তার এই সংকটকালে বাংলা নববর্ষ উদযাপন বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে। তবে দুঃখের বিষয় এই যে আজকাল বিভিন্ন স্থানে বাঙালীর নববর্ষ উদযাপনের মধ্যেও অপসংস্কৃতির ছোঁয়া লক্ষ্য করা গেছে।
এই অপসংস্কৃতি থেকে বাঙালীর স্বাজাত্যবোধ এবং নিজস্ব জাতীয় চরিত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে অনতিবিলম্বে আত্মসংস্কৃতির প্রতি যত্নবান হওয়া একান্ত প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে বর্তমান নগরজীবনে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা দ্বারা আয়োজিত সাংস্কৃতিক উৎসব, মিলন মেলা, গ্রাম বাংলার সংস্কৃতিকে জনসমক্ষে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা প্রভৃতি উদ্যোগের সার্থকতার কথা উল্লেখ করতেই হয়।
নববর্ষে বাঙালী
নববর্ষ প্রতিটি বাঙালীর জীবনের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনটিতে বাঙালী পৃথিবীর যে কোনেই থাকুক সে তার জাতীয় ঐতিহ্য উদযাপন করতে মেতে ওঠে। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে সর্বস্তরের বাঙ্গালীদের মধ্যে কিছু বিশেষ প্রথা প্রচলিত রয়েছে। যেমন এই দিনে বাঙালী পুরুষেরা সাধারনত পাঞ্জাবী ও ধুতি পরে এবং মহিলারা নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক শাড়িতে সেজে ওঠে।
তাছাড়া এই দিনে বাঙালী ঘরে ঘরে পান্তা-ইলিশ বিভিন্ন রকমের ভাজা খাওয়ারও প্রচলন রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ তথা বাংলাদেশ এই দিনটিকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে মহা আনন্দ সহকারে পালন করা হয়ে থাকে। চারিদিকে পরম আনন্দের পরিবেশে বিভিন্ন মেলা ও উৎসবে বাঙালী জাতির মানুষ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। তাছাড়া সংস্কৃতিপ্রিয় বাঙালী জাতির কাছে এই দিনটি নিজেদের সংস্কৃতি চর্চার জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন।
পয়লা বৈশাখ
বাংলা নববর্ষের কথা বলতেই সর্বপ্রথম যে দিনটির কথা আমাদের মনে আসে তা হল পহেলা বৈশাখ। এই দিনটি বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম দিন। এই দিনে দেশ ধর্ম নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালী জাতি নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার আনন্দে মেতে ওঠেন। পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ তো বটেই তার সাথে ত্রিপুরা এবং আসাম রাজ্যের কিছু অংশেও বাংলা নববর্ষ মহা ধুমধাম সাথে পালন করা হয়।
সাধারণভাবে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জী অনুসারে প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল বাংলাদেশে নববর্ষ পালিত হয়ে থাকে। বাঙালি এই সময়ে মেতে ওঠে নানা প্রকার উৎসবে। হালখাতা, বিভিন্ন শোভাযাত্রা, নানা ধরণের মেলা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে দিনটি উদযাপন করা হয়। একে অপরকে ‘শুভ নববর্ষ’ অভিবাদন জানিয়ে সকলের মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করে বাঙালীরা বছর শুরু করে।
বৈশাখী মেলা
বাংলা লোকায়ত সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে বাংলার বিভিন্ন উৎসব। সেই সকল উৎসবের মধ্যে বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে কেন্দ্র করে আয়োজিত বৈশাখী মেলা অন্যতম একটি উৎসব। বাংলাদেশের নগরায়নের পরিবেশেও এখনও এই মেলা আয়োজিত হয়।
বিভিন্ন গ্রাম থেকে শিল্পীরা তাদের আঞ্চলিক শিল্পকে সকলের সামনে তুলে ধরার জন্য এই মেলায় নিয়ে আসেন। বাংলার গ্রামীণ পটচিত্র, তথা বিভিন্ন লোকগান, লোকনৃত্য ইত্যাদি এই মেলাতে স্বকীয় মর্যাদা লাভ করে। নববর্ষের আনন্দ উদযাপনের মাধ্যমে বাংলার হারিয়ে যেতে বসা আঞ্চলিক সংস্কৃতিকে মর্যাদা দান এবং পুনরুজ্জীবনের প্রয়াস এই মেলার মধ্যে দিয়ে লক্ষ্য করা যায়।
হালখাতা
বাংলা নববর্ষ উদযাপনের আলোচনায় বাঙালীর হালখাতা পালনের কথাও উল্লেখ করা বিশেষভাবে বাঞ্ছনীয়। নববর্ষের এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বাঙালীর উন্মাদনা বিশেষভাবে চোখে পড়ার মতো। প্রকৃতপক্ষে এই উৎসবটির তাৎপর্য হলো বর্ষবরণ-এর শুরুতে ব্যবসায়িক হিসাবগত খাতার হাল-হকিকত যাচাই করে নেওয়া।
তবে এই উৎসবটি সকল ব্যবসায়ী মহলেই পরম রসনার সঙ্গে পালন করা হয়। সকল আমন্ত্রিত ক্রেতাকে করানো হয় মিষ্টিমুখ। ক্রেতারাও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীর কাছে নিজেদের ধার বাকি মিটিয়ে পরস্পর এক শুভ বন্ধনে আবদ্ধ হয়।
ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গেও অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে বাংলা নববর্ষ পালিত হয়ে থাকে। যদিও গ্রাম বাংলার চরিত্র মূলত দুই বাংলাতেই একরকম, তবে উৎসবগুলির চরিত্র কিছু কিছু ক্ষেত্রে আলাদা হয়ে থাকে।
যেমন পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন জায়গায় পালিত হয় চড়কের মেলা, লোকগানের আসর, বাউল মেলা ইত্যাদি। আবার পশ্চিমবঙ্গের বাঙালী সংস্কৃতি চর্চার পীঠস্থান কলকাতায় নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তাছাড়া নববর্ষ উপলক্ষে পহেলা বৈশাখের আগে থেকেই বাজারে চলতে থাকে চৈত্র সেল।
আদিবাসীদের নববর্ষ
সাধারণ বাঙালিদের পাশাপাশি উভয় বাংলা সংলগ্ন বিভিন্ন আদিবাসীদের মধ্যেও বাংলা নববর্ষ পালনের প্রথা বিশেষভাবে প্রচলিত রয়েছে। নববর্ষের সূচনালগ্নে এই সকল আদিবাসীরা নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে উদযাপন করে থাকে।
প্রান্তিক অঞ্চলের এই সকল নৃগোষ্ঠী গুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ছোটনাগপুর, পুরুলিয়া, মালদা এবং মুর্শিদাবাদ এবং অন্যদিকে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতি গুলির নববর্ষ উদযাপনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
উপসংহার
বাংলা নববর্ষ হল বাঙালির বাঙালীত্বকে উদযাপন করার সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির মধ্যে যাতে কোনোভাবেই অপসংস্কৃতির কুপ্রভাব প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে প্রতিটি স্তরে সকল বাঙালিকে সচেতন হতে হবে।
নববর্ষ উদযাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালীর বাঙালীত্ব বিশ্বায়িত হোক, বাঙালী সংস্কৃতি মর্যাদা পাক বিশ্বের দরবারে, আধুনিক ভোগবিলাসমূলক জীবন দর্শন ত্যাগ করে আপন আত্মা ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধির দিকে বাঙালী যত্নবান হয়ে উঠুক এটুকু আশা করা যায় নিশ্চয়ই। নববর্ষে বাঙালীত্ব এবং বাঙালী সংস্কৃতির পবিত্র উদযাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালী জীবনের সকল অন্ধকার দূরীভূত হয়ে নতুন জীবনের আশার আলোয় নতুন বছর ভরে উঠুক।
“অসতো মা সৎ গময়,
তমসো মা জ্যোতির্গময়,
মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়,
ওঁ শান্তিঃ।। ওঁ শান্তিঃ।। ওঁ শান্তিঃ।।”