Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নতুন প্রহসন || Ashapurna Devi » Page 2

নতুন প্রহসন || Ashapurna Devi

পরদিন স্নান করে

পরদিন স্নান করে এসে প্রথম চমক লাগল আরশির সামনে দাঁড়িয়ে।

বিয়ে হয়ে গেছে ইলার। অথচ সিঁথিতে এখনও কুমারীর নির্মল শুভ্রতা।

সিঁদুর এক প্যাকেট এনেছিল কুমকুম, বলেছিল বাইরে এসে সম্বুদ্ধ আংটি করে লাগিয়ে দেবে–আভাসে।

ইলা রাজী হয়নি। বলেছিল, জীবনে প্রথম সিঁদুর পরব যেখানে সেখানে? বলেছিল, থাক, ওই শুভরাত্রি না কি ওই দিনই যা হয় হবে।

তবু আজ সিঁথিটা দেখে মনটা কেমন করে এল। ইলার যদি সহজ স্বাভাবিক বিয়ে হত, আজ ইলার চেহারায় লাগত কী অপূর্ব রঙের ছোঁয়াচ। লাল শাড়িতে মহিমান্বিত নববধূ মূর্তির সিঁথির সেই অরুণ-রাগ, সারা মাথাটাই যাতে লালে লাল হয়ে গেছে, সেই মূর্তিটার বিরহ লাগল যেন ইলার। ইলা তাই আবার স্নানের ঘরে গিয়ে চোখে জল দিয়ে এল চোখের জল ঢাকতে।

ছবিখানা এখনও পড়ে আছে টেবিলে।

উলটো করে রেখে দিয়েছে ইলা।

খুলে রেখে মনে হচ্ছিল, ও যেন ইলার মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গ-হাসি হাসছে।

এখন আর দেখতে পাচ্ছে না, তবু রাস্তায় হঠাৎ দেখতে পেলে ঠিক ওকে চিনে ফেলতে পারবে ইলা। ছবির মুখের প্রত্যেকটি রেখা যেন মুখস্থ হয়ে গেছে ইলার।

ইলার নিজের কোনো সিঁদুর কৌটো নেই।

মায়ের ঘরে এসে কৌটোটায় হাত দিল। লুকিয়ে চুলের মধ্যে পরবে নাকি একটু!

ধ্যেৎ। প্রথম সিঁদুর নিজে নিতে আছে নাকি!

তর তর করে দোতলা থেকে নীচে নেমে এল ইলা, মাকে বলল, মা, কুটনো কোটা হয়ে গেছে তোমার? আমায় কেন ডাকলে না?

মা বললেন, তুই অনেক রাত অবধি পড়াশোনা করছিলি, তাই আর ডাকিনি। ভারী তো কুটনো, ও আর আমার কতক্ষণ।

কথাটা সত্যি।

অমলার দরকার হয় না মেয়ের সাহায্য নেবার।

ভারী পরিশ্রমী অমলা।

নিপুণ হাতে সংসার করেন। স্বামী-সন্তানদের প্রতি যত্নের অবধি নেই।

ইলা ভাবল মা-র বিয়েটা গতানুগতিক প্রথাতেই হয়েছিল। প্রেমে পড়ার যে কী রোমাঞ্চ, কী অনির্বচনীয় অনুভূতি, এ-সবের স্বাদ জানেন না মা।

অথচ মা সুখী, সন্তুষ্ট, আনন্দময়ী।

মা আর বাবা দুজনেই পরস্পরের প্রতি কী রকম সর্বাত্মক ভাবে নির্ভরশীল।

মা একদিন বাপের বাড়ি গিয়ে থাকতে পারেন না। বলেন সংসারের কাজের ভাবনায়, ওটা বাজে কথা। বাবাকে ছেড়ে একটা দিনও থাকতে পারেন না মা। বাবাও তাই। বাবার বন্ধু পরেশবাবু ছুটি হলেই একা এখান-সেখান বেড়াতে বেরিয়ে পড়েন, বাবাকে কতবার বলেছেন, বাবা যেতে চাননি।

ইলা জানে ওই একই কারণ।

ইলা জানত। কিন্তু এমন স্পষ্ট করে ভাবত কি কোনোদিন?

আজ মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ যেন নতুন করে মনে পড়ল ইলার, মা চিরদিন সন্তুষ্ট আর সুখী। চিরদিন শান্তিময় জীবন মা-র।

তারপর উঠল প্রবল কম্পনোচ্ছ্বাস।

মা-র এই চিরশান্তির প্রাণে আগুন জ্বালল ইলা, চির সুখের প্রাণে বাজ হানল।

এর পর আর কোনোদিন অমন প্রসন্ন প্রশান্ত মুখোনি নিয়ে ছোটাছুটি করে সংসার করে বেড়াবেন না অমলা।

ইলা নামের এই মেয়েটার ভয়ানক বিশ্বাসঘাতকতার খবর পাবার পর মন ভেঙে যাবে তার। ক্লিষ্ট হয়ে যাবেন, ক্লান্ত হয়ে যাবেন। পৃথিবীর প্রতি বিশ্বাস হারানো একটা কঠিন কঠোর মুখ নিয়ে সংসার করে যাবেন।

বাইরের লোকের সামনে মুখ দেখাতে পারবেন না অমলা আর অরবিন্দ। আত্মীয়দের কাছে। পারবেন না কথা বলতে। মুখ লুকিয়ে বেড়াবেন। দেখা হলেই তো প্রশ্নে মুখর হয়ে উঠবে ওরা।

বলবে, হ্যাঁ গো, ইলা নাকি…?

হারে ইলা না কি? যখন তখন এই শব্দটা ঘুরবে লোকের মুখে মুখে।

রাশি রাশি মেয়েই তো এ রকম করছে আজকাল।

নিজেকে বোঝাল ইলা, বহু বারের পর, আর একবার। বরং তাদের মা-বাপ পরে সুবিধে বুঝে একদিন আবার বিয়ে বিয়ে নাটকটা অভিনয় করে।

গহনা-কাপড় দেয়, লোকজন খাওয়ায়। আলো জ্বালে, বাজনা বাজায়। চিঠি ছাপিয়ে নিমন্ত্রণ করে। কিন্তু হ্যাঁ এই ভেবেই মনে বল পায় না ইলা, তারা হয়তো আস্তে আস্তে মনকে প্রস্তুত করে নেবার সময় পায়।

ইলার মা-বাপ পেলেন না।

এ-কথা তুলেছিল ইলা। আগে একদিন বলেছিল, ওঁরা প্রস্তুত হতে সময় পাবেন না।

সম্বুদ্ধ বলেছিল, পেলেই দেবেন ভেবেছ? ঘোষের ছেলের হাতে কন্যা সম্প্রদান করবেন? তোমার বাবা? যিনি এখনও ধুতির ওপর কোট আর কোটের ওপর উড়ুনি চাপান।

তা সত্যি, এ রকম সেকেলে সাজই করেন অরবিন্দ।

নীলা ইলা কত ঝগড়া করে, অরবিন্দ হাসেন। বলেন, এই পোশাকে কর্মজীবন শুরু করেছি, এই পোশাকেই শেষ করব সে-জীবন…তারপর দেখিস কি ফুলবাবুটি না সাজি। গিলেকরা পাঞ্জাবি, চুনটকরা ধুতি—

মেয়েরা হেসে অধীর হয়।

রিটায়ার করে সাজবে তুমি ওই রকম করে?

না সাজলে?অরবিন্দ হাসেন, তোদের মেয়েদের পছন্দ হবে কেন আমাকে?

হা-হা করে হাসেন আবার।

এই রকম সাদাসিধে পুরনো ধরনের মানুষ অরবিন্দ। ঠাট্টা-তামাশা কথাবার্তা সবই চিরকেলে। আধুনিকতার ছাপ পড়েনি সেখানে।–

কিন্তু অরবিন্দ কি কখনও কাউকে ঠকিয়েছেন? কারও মনে কষ্ট দিয়েছেন? কারও সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন?

করেননি।

ইলার বাবা নয়, মা নয়, দিদি-জামাইবাবু কেউ নয়। ওঁরা জানেন না খুব ভয়ানক একটা মিথ্যাচরণ করেও এমন হাসিমুখে ঘুরে বেড়ানো যায়।

ইলা জানে। ইলা এ-সব পারে। ইলা তাই করেছে।

আর এখন ইলাকে ততদিন ধরে তাই করতে হবে, যতদিন না সম্বুদ্ধর মাইশোরে যাবার ব্যবস্থা পাকা হয়।

.

আচ্ছা, আজ যদি ইলা সম্বুদ্ধর কাছে না যায়?

মেয়ে হয়ে রোজ রোজ যদি সে যেতে না পারে? ইলার তো একদিন জ্বর হতে পারে? অন্তত কোনোরকম শরীর খারাপ?

ভয়? কেন? কাকে? সম্বুদ্ধকে?

কেন ভয় করবে? সম্বুদ্ধ অভিমান করবে বলে?

করুক না একটু। দাম বুঝুক ইলার। রাগ করবে? করুক! রাগ করে বিয়ে ভেঙে দিতে পারবে? পারবে না। একখানি দলিলের বন্ধনে বাঁধা পড়ে গেছে সম্বুদ্ধ।

বেশ একটা বুকের বল নিয়ে বাড়িতেই রয়ে গেল ইলা।

অথচ আগে পারত না। আগে পর পর দুদিন সম্বুদ্ধর সঙ্গে দেখা না করতে পারলেই ভয় পেত। মন হত, ও যদি বিরূপ হয়ে সরে যায়।

আজ আর তা মনে হল না।

বাড়িতেই রইল। বই পড়ত লাগল।

দিদি এল দুপুরে।

জামাইবাবু ছাড়া একা।

এ দৃশ্য প্রায় দুর্লভ।

এসে বলল, তোর জামাইবাবুর খিদমদগারি করতে করতে মলাম।..দে ফটোখানা। কেমন লাগল বল?

ইলা বলল, খামোকা একটা ভদ্রলোকের ছবি ভালো লাগা না-লাগার প্রশ্ন কেন?

ন্যাকামি রাখ! বিয়ে করতে হবে না? তবু তো তোদের আমলে সব কত হয়েছে। আমরা তো সেই শুভদৃষ্টির আগে চক্ষেও দেখিনি লোকটা কানা না হাবা।

এখন তো চক্ষে হারা হচ্ছ রাতদিন।

থাম, খুব ফাজলামি হয়েছে। চলোম, লাগিয়ে দিতে বলি গে। মা তো একেবারে মূৰ্ছিত।…আর সত্যি কথা বলি, তোর একখানা ছবি ছিল আমার কাছে, সেটা দিয়েছিলাম ওদের কাছে, ওরাও বিগলিত। ঠিক এই রকমটিই নাকি চেয়েছিল তারা।

ইলার মাথার মধ্যে যেন কারখানার রোল ওঠে। ইলার চোখের সামনের আলোটা ঝাঁপসা লাগে।…

ইলা কি বলে ফেলবে এই সুযোগে?

বলতে যায়। বলতে পারে না। বোকার মতো যা বলে, তা হচ্ছে এই—এত তাড়াতাড়ি কি আছে?

বলে ফেলে নিজেরই লজ্জা করে।

বুদ্ধি-সংবলিত একটা কথা বলতে পারল না ইলা। এই সুযোগে বলে ফেলতে পারল না।

দিদি বলল, কেন, বাইশ বছর বয়েসটা বুঝি বিয়ের বয়েস নয়? পেটে খিদে মুখে লজ্জার দরকার কিছু নেই। যাচ্ছি আমি। বলব গিয়ে তোর জামাইবাবুকে সারারাত ধরে তোমার শালী তোমার বন্ধুর ভাইপোকে দেখেছে। ছবিতে, স্বপ্নে।

আঃ দিদি! ভালো হবে না বলছি।

দিদি ওর রাগ দেখে আরও ক্ষ্যাপায়, আরও ঠাট্টা করে, অবশেষে বিদায় নেয়।

অথচ আশ্চর্য, যেটা করতে এসেছিল সেটাই ভুলে চলে যায়। ছবিটা পড়েই থাকে।

তা পড়েই যদি থাকে, আর একবার উলটে নিয়ে দেখতে দোষ কি।

দিনের আলোয় তো দেখাই হয়নি।

কিন্তু কী হবে দিনের আলোয় দেখে? এ-প্রশ্ন করে না ইলা নিজেকে! ছবিটাই মুখস্থ করে।

আর সেটাকে ঘিরেই প্রশ্ন করে।

শুনলাম হিন্দুস্থান রোডে বাড়ি।

সে তো এই কাছেই। ওদের দোকান-বাজার মানেই গড়িয়াহাটের বাজার। যে-কোনো সময় আসতে পারে। আর ইলাও তো রাতদিন যায় ওখানে। দেখতে পেলে ঠিক চিনতে পারবে। আর ও? ওর আর পারতে হয় না।

সবাই কি ইলার মতো তীক্ষ্ণদৃষ্টিসম্পন্ন?

ইলা একবার দেখলে ভোলে না।

হঠাৎ এক সময় মনে পড়ল ইলার, কাল থেকে ইলা সম্বুদ্ধকে একবারও ভাবেনি।

চোখের উপর হাত চাপা দিয়ে শুয়ে পড়ল। ইলার বিবেক এখন ইলাকে তীক্ষ্ণ দাঁতে কামড়াবে।

.

সন্ধ্যার সময় কুমকুম এল। বলল, কী ব্যাপার? কাল থেকে একেবারে ডুব মারলি যে? আমি সম্বুদ্ধবাবু আর অসীম, তোর অপেক্ষায় বসে থেকে—হল কি? শুয়ে আছিস যে?

শরীরটা ভালো নেই।

হু, বিরহ জ্বর। তার দাওয়াইয়ের ব্যবস্থা হচ্ছে। তোর মাকে বলে এলাম, কাল তোর আমাদের কাছে নেমন্তন্ন।…এমনিতে ভদ্রমহিলা এত সরল, কিন্তু তোর এই বাইরে যাবার ব্যাপারে যেন উকিল। কী জেরা বাবা! কেন, কী বৃত্তান্ত, উঃ বাবা! চাপা হাসি হেসে গড়ায় কুমকুম।

যাক ম্যানেজ করা গেছে এক রকম। বলেছি খাইয়ে-দাইয়ে নাইট শোয়ে সিনেমা দেখিয়ে ফেরত দিয়ে যাব। তাও প্রশ্নবাণ কে-কে যাবে সিনেমায়, অত রাত্রে কে পৌঁছতে আসবে—

অন্যদিন হলে,কি ইলা ওই বাবা শব্দটার সঙ্গে নিজের অসহিষ্ণুতাও যোগ দিত না? বলত না কি, আর বলিস না ভাই, প্রায় নজরবন্দী আসামী। জীবন মহানিশা হয়ে গেল? বলত। অন্যদিন হলে বলত।

আজ বলল না। আজ বরং ঝঙ্কার দিয়ে বলে উঠল, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। মা জানেন, মা-র কুমারী মেয়ে।

কুমকুম অপ্রতিভ হয়ে বলে, তা বটে। তারপর বলে, বলে রাগ করিস না, দৃষ্টিভঙ্গিটা বড়ো সেকেলে। আচ্ছা, তাহলে ওই কথাই রইল?

কুমকুম চলে যায়।

আর এতক্ষণ পরে প্রথম সম্বুদ্ধর কথা মনে পড়ে।

সম্বুদ্ধ রাগ করেছে। ক্ষুব্ধ হয়েছে। কাল সব রাগ জল করে দিতে হবে। পুরুষমানুষের রাগ ক্ষণস্থায়ী।

ক্ষণস্থায়ী।

তবু রাগ দেখাতে ছাড়ল না সম্বুদ্ধ।

বলল, অবাক হয়ে গেলাম কাল! ভাবতেই পারিনি তুমি আসবে না। না আসা সম্ভব।

ইলা গম্ভীরের ভান করে, আমিও অবাক হয়ে ভেবেছি, লোকটা এমনি আক্কেলহীন, একবার ভাবল না, খোঁজ নিই মানুষটা বাঁচল কি মরল।

না বাঁচার কি হল?

আহ্বাদেও হার্টফেল করতে পারি।

ঠাট্টা রাখ। এলে না কেন তাই বল?

মাথা ছিঁড়ে পড়ছিল।

হেতু? হঠাৎ কী ঘটল মাথায়?

ঘটল? কী ঘটল?ইলা দুষ্টুমীর হাসি হেসে বলে, কাল তো প্রায় আমার পাকা দেখা ঠিক।

কী ঠিক?

পাকাদেখা, পাকাদেখা।

পাকাদেখা কি?

জান না? বিয়ের আগের নোটিস। ফিরে দেখি দিদি একেবারে পাত্রের ফটো নিয়ে এসে হাজির।

মধুরাত্রির মিলন-মুহূর্তে এ-পরিহাস বিশেষ কৌতুক-মুহূর্ত সৃষ্টি করতে পারে না। সম্বুদ্ধর যেন রাগ ধরে যায়। চড়া গলায় বলে, খুব আপশোস হচ্ছে নিশ্চয়?

নিশ্চয়।

অবাক হয়ে যাচ্ছি।

অবাকের কি আছে?

মেয়ের বিয়ে খুঁজছেন এখন।

ইলা ওর রাগে মজা পায়। বলে, তা, তারা তো আর জানেন না ইতিমধ্যেই ঘটনাটা ঘটে গেছে। এবার জানানো উচিত।

তাই ভাবছি। ও-সব লুকোচুরি অসহ্য লাগছে। চল না, বীরের বেশে গিয়ে দাবি জানিয়ে, রাজ-সমারোহে নিয়ে এস আমায়।

নিয়ে এস, নিয়ে এস!

এই এক কথা ইলার।

বিয়ের আগে থেকে এই কথাই বলছে। কই, একবারও তো বলছে না, এস।

বলছে না, এস, আমি তোমার জন্যে আদরের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছি, আমার আপনার লোকদের বুঝিয়ে!

সম্বুদ্ধ তাহলে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বাঁচত। তা নয়, তুমি সাহস করো, তুমি নিয়ে চল। তা না হলে আমায় থাকতে দাও আমার পুরনো কৌমার জীবনের মধ্যে।

এটা স্বার্থপরতা।

সম্বুদ্ধ ভুলে যায় বিয়ের আগে সম্বুদ্ধই বারণ করেছে। বলেছে বাধা আসবে। আমাদের কূলে-আসা তরী বিশবাঁও জলে গিয়ে পড়বে।

ক্ষেত্র প্রস্তুত করবার তবে অবকাশ পেল কই ইলা?

অথচ এখন সম্বুদ্ধ অধীর হয়ে উঠছে। কাল বিয়ে হয়েছে, আজই ভাবতে শুরু করেছে ইলার চেষ্টা নেই। ইলা যেন শুধু বিয়ের দলিলে সই করেই ধন্য করেছে সম্বুদ্ধকে। সম্বুদ্ধও তবে সেই দলিলের জোর ফলাবে।

.

আজ তোমার যাওয়া হবে না।

যাওয়া হবে না?

না, আজ এই নিরালা হোটেলের নিরালা ঘরেই স্থিতি।

বেশ। কাল তাহলে নিজে গিয়ে পরিচয়পত্র দেখিয়ে পৌঁছে দিও।

ঠিক আছে, তাই দেব।

বাবা যদি বলেন, আমরা বাড়িতে তোমার স্ত্রীর জায়গা হবে না—আবার এইখানেই ফিরিয়ে আনবে?

উঃ!

সম্বুদ্ধ হতাশ গলায় বলে, উঃ! আজকের দিনেও সেই অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা? সেই টাকা-আনা পাইয়ের হিসেব? কই, এতদিন তো মনে হয়নি তুমি রক্তমাংসের মানুষ নও, পাথরের?

এতদিন রক্ত-মাংসের খোঁজ করনি বলেই হয়তো টের পাওনি।

ঠিক আছে। তোমার বাবা যদি মেয়েকে তাড়িয়ে দেন—

ইলা বলে, ভুল বলছ, বাবার মেয়েকে নয়, তোমার স্ত্রীকে।

তর্কটা বাধা পেল।

কুমকুম আর অসীম এসে পড়ল হইচই করে। এল আর কজন বিবাহিত, অবিবাহিত বন্ধু। ফুল নিয়ে, উপহার নিয়ে। বিছানার ছড়িয়ে দিল গোলাপের পাপড়ি, ইলার খোঁপায় পরাল গোড়ে মালা। আরও দুগাছা মালা রইল মজুত বদলের জন্যে।

সম্বুদ্ধর খরচে খেল সবাই।

তারপর বলল, গুডবাই।

কুমকুম চুপিচুপি বলে গেল, চলে যাব চলে যাব বলে পাগলামী করিস না। থেকে যা। সকালে আমার ওখানে যাবি, পৌঁছে দেব তোকে। আর রাত্রে যাহোক কিছু একটা খবর দিয়ে দেব তোদের বাড়িতে।

ইলাও বলল, পাগলামী করিস না। নাইট শোয়ে সিনেমা দেখার টাইমটা হাতে আছে, ওই বেশ।

ওই বেশ? সম্বুদ্ধ রেগে বলে, তুমি এমন ভাব করছ যেন সবটাই অবৈধ।

কি করব? মনের মধ্যে বৈধের সুর বাজছে না যে! বাড়ি ঢুকব কি করে সেইটাই মনের মধ্যে প্রধান হয়ে উঠছে।

বললাম তো কাল সকালে গিয়ে সব প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়ে নেব।

বেশ!

বেশ। সম্বুদ্ধ ওকে কাছে টেনে নিয়ে বলে, এত হিসেব কসার পর আবেগ-ইচ্ছে, বাসনা কামনা সব ডানা মেলে উড়ে যায়।

বলে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তার পরিচয় দেয় না। প্রবল বাসনার প্রচণ্ড আবেগে ইলাকে গুঁড়ো করে ফেলবার জেদ ধরেছে যেন।

ইলা মরে যাচ্ছে।

ইলা হারিয়ে যাচ্ছে।

ইলা তার ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান সব একাকার করে ফেলছে।

এখন যা করবে সম্বুদ্ধ। সব ভার তার, সব চিন্তা তার। ইলার নিজস্ব কোনো সত্ত্বাও বুঝি রইল আর। নিজস্ব চিন্তাশক্তি।

.

কিন্তু সম্বুদ্ধই নতুন চিন্তায় এল।

দেখ, এখন মনে হচ্ছে তোমার বুদ্ধিটাই ঠিক হয়েছিল।

ইলা আস্তে বলল, কি?

মানে আর কি ফিরেই যাওয়া। এখনও সময় রয়েছে। পৌনে বারোটা বেজেছে। নাইট শো ভাঙছে।

আমি পারব না।

আহা, বুঝছ না–

আগে তো বুঝছিলাম, এখন বুঝতে চাই না।

সম্বুদ্ধই তখন বোঝাতে চেষ্টা করে। কে বলতে পারে রাত কাবার করে সকালে ফিরতে দেখে ইলার বাবা পাড়া জানাজানি করে যাচ্ছেতাই করবেন কি না।…অপমানের শেষ থাকবে না তখন। বোঝাতে তো সময় লাগবে।

এখন এতরাত্রে নিশ্চয় তা করবেন না। আর তাড়িয়ে দিতেও পারবেন না।

এখনই ঠিক, এখনই সুবিধে।

তার মানে তুমিই তাড়িয়ে দিচ্ছ?

ক্লান্ত চোখ তুলে বলে ইলা।

সম্বুদ্ধ অবশ্য এ-প্রশ্নের উত্তর যথাযথ দেয়। তারপর বলে, যক্ষের অভিশাপের দিন কটা শেষ হতে দাও একবার।

ইলা শিথিল গলায় বলে, মা ঠিক ধরে ফেলবেন।

কেন? না না, অকারণ ভয় পাচ্ছ। গাড়ির মধ্যে কে আছে না আছে এত রাত্রে কে দেখেছে? তুমি একটু গলা তুলে বলবে, কুমকুম, তোর আর এত রাতে নামবার দরকার নেই, বাড়ি চলে যা।

ইলা ঝেঁজে ওঠে।

মানে, তোমার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার খেসারত দিতে অবিরত অভিনয় করে চলি?

সম্বুদ্ধ বলে, লাঠি না ভেঙে যদি সাপটা মারা যায়—

অথচ খানিক আগে লাঠিটাই ভাঙছিলে—

সম্বুদ্ধ একটু করুণ করুণ গলায় বলে, আমি তোমার মতো পাথরের দেবতা নই ইলা।

.

এইভাবেই ইলার ফুলশয্যার শয্যা থেকে বিদায়-গ্রহণ।

বাড়ি ফেরার সময় যথারীতি অভিনয়টা করতে হল। কুমকুম আর কুমকুমের দাদা গাড়িতে আছে, নামিয়ে দিয়ে গেল ইলাকে। ইলার সর্বাঙ্গে ফুলের গন্ধ জড়ানো, ইলার সর্বদেহে বিবশ শিথিলতা।

ইলা কি ওই অভিনয়টুকু করেই পার পেয়ে যাবে? দরজা খোলার মুহূর্তে প্রস্তুত হয়ে থাকে ইলা ঝড়ের মুখে পড়বার জন্যে। নিশ্চয় বাবা দরজা খুলবেন, আর তীব্র ভর্ৎসনা করবেন। প্রশ্ন করবেন কোন্ হলে ছবি দেখতে গিয়েছিল তারা। ইলা এই সৌরভে-আকুল দেহটা নিয়ে দাঁড়িয়ে কি উত্তর দেবে বাবাকে?

যদি তেমন অপমানের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় ফিরে আসবে ইলা, এই ঠিক করা ছিল?

গাড়িটা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে সম্বুদ্ধ রাস্তার এ-ধারে।

নিয়ে চলে যাবে ইলাকে।

পরদিন সম্বুদ্ধ দেখিয়ে যাবে দলিল। শুনিয়ে যাবে দুকথা।

মানে সেটা সম্বুদ্ধর মত।

এ-সবই যদির উপর ছিল।

কিন্তু দরজা খুলে দিলেন মা।

আর ইলা ঢুকতেই বলে উঠলেন, বন্ধুর বুঝি জন্মদিন ছিল? কই, কিছু তো নিয়ে গেলি না?

ইলা আস্তে বলে, জন্মদিন নয়।

তবে? শুধু শুধুই? বড়োলোকদের যা সাধ হয় মেটাতে পারে। খোঁপার মালাটা কুমকুমই দিয়েছে বুঝি? কী চমৎকার গন্ধ! ঢুকলি যেন একটা বিয়ে-বাড়ি নিয়ে এলি সঙ্গে করে।

ইলা চমকে তাকাল।

না, অমলার মুখে কোনো অভিসন্ধির ছাপ নেই। সেই তাঁর সবেতেই খুশিভাব নিয়েই কথা বলছেন, আস্তে আস্তে চল। এইমাত্র ঘুমিয়ে পড়েছেন উনি। বারবার দেখছিলেন, আমিই বকে বকে ঘুমোতে পাঠালাম। বলি যে, তোমার ইচ্ছাশক্তির প্রভাবে কি সিনেমা এগারোটার আগেই ভেঙে যাবে?..ভাগ্যিস ঘুমিয়ে পড়েছেন! রাতও কিন্তু তোদের বড় হল। খুব বড়ো বই বুঝি?

এরপরও কি ইলার ভিতরের আবেগ চোখের কিনারায় ফেটে পড়তে চাইবে না?

এই মা।

স্বপ্নেও ধারণা করতে পারবেন না কতবড় ঠগ-জোচ্চোর তার ছোটো মেয়ে।

কী নির্মল স্নিগ্ধ সরল বিশ্বাস!

ইলা যা বলেছে, তাছাড়া যে আর কিছু করবে, একথা অমলা ভাবতে পারছেন না।

কুমকুম বলেছিল জেরা।

জেরা নয়, ছেলেমানুষের মতো কৌতূহল আছে মা-র। জিজ্ঞেস করে করে সেই কৌতূহল মেটান। নইলে এই এত রাত্রে বলেন, তারপর? বল শুনি কী কী খেলি বন্ধুর বাড়িতে?

ইলা এই সরল বিশ্বাসের কাছে হার মানে। ইলা বলে উঠতে পারে না, মা, তুমি যা ভাবছ তা সব ভুল। আমি যা বলেছি, তা সবই মিথ্যে। আমি প্রতারণা করে চলেছি তোমার সঙ্গে।

ইলা ঝুপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে বলে, কাল শুনো সব, ভীষণ ঘুম পেয়েছে। শুয়ে পড়ে।

তার এতদিনের একক শয্যায়। নির্মল, সুন্দর, পবিত্র।

কিন্তু ঘুম কি আসে অমলার ভীষণ-ঘুম-পাওয়া মেয়ের?

একদিকে মায়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার যন্ত্রণা, আর একদিকে এক নতুন মাদকতার স্বাদ পাওয়া রোমাঞ্চিত দেহ-মনের অতৃপ্ত ক্ষুধার যন্ত্রণা, যেন দীর্ণ-বিদীর্ণ করতে থাকে ইলাকে।

তীব্র ক্ষুব্ধ অভিমানে সম্বুদ্ধর উপর বিদ্রোহী হয়ে ওঠে সেই অতৃপ্ত মন।

সাময়িক বাসনার প্রয়োজন মিটিয়ে সম্বুদ্ধ তাকে বিদায় দিয়েছে, ঠেলে দিয়েছে আশঙ্কার মুখে, অপমানের মুখে।

হয়তো এমনিই করতে থাকবে সে, করতে চাইবে। সমস্ত দুঃখময় পরিণামের দিকে ইলাকে ঠেলে দিয়ে নিজের দাবি জানাবে। বৈধ স্বামীর দাবি।

হ্যাঁ, এই জন্যে সম্বুদ্ধ বিয়ে বিয়ে করে অধীর হয়ে উঠেছিল, দাবিটাকে বৈধ করে নেবার জন্যে।

নির্ঘাত এরপর সম্বুদ্ধ যখন-তখন এই গোপন অভিসারের স্বাদ চাইবে।

চাইবেই। সেই লোভ আর লোলুপতার ছাপ দেখেছে ইলা তার স্বামীর চোখের দৃষ্টিতে।

স্বামী।

ইলার স্বামী।

যে-স্বামী রাত দুপুরে বিছানা থেকে তুলে নিয়ে গাড়ি করে পৌঁছে দিয়ে যায় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে।

যন্ত্রণাপীড়িত ইলার ঘুম আসে প্রায় শেষরাত্রে। ঘুমিয়ে থাকে বেলা অবধি।

অমলা মায়া করে ঘুম ভাঙান না।

হ্যাঁ মায়াই। অমনিই মায়া অমলার। নেমন্তন্ন খেয়ে আর সিনেমা দেখে রাত করে ফিরেছে মেয়ে, তবু অমলার ঘুম ভাঙাতে মায়া হয়েছে।

হঠাৎ ঘুম ভাঙে দিদির গলার শব্দে।

দিদি সকালবেলা!

ওঃ, আজ রবিবার, সকালবেলা আসে দিদি। কিন্তু এত সকালে? কটা বেজেছে?

ঘরের জানলা-দরজা ভেজানো, আকাশের আলোর চেহারা ধরা যাচ্ছে না, ঘাড় ফিরিয়ে দেওয়ালে ঝোলানো ঘড়িটা দেখল। চমকে উঠল।

নটা বাজে।

চমকে উঠল, কিন্তু উঠে পড়ল না। অলস কান পেতে শুয়ে রইল।

আর সেই কানে এসে ঢুকতে লাগল, যাই বল মা, এবার কিন্তু তোমার মেয়ের ওপর একটু রাশ টানা উচিত। হোক বন্ধুর বাড়ি, তাহলেও, রাত বারোটায় বাড়ি ফিরবে—

অমলার গলা শোনা যায়, আহা, খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই মিলে আমোদ করে সিনেমা যাবে বলে গিয়েছিল তো।

দিদির প্রখর গলা মুখর হয়ে উঠছে, তা বেশ, যা করেছে করেছে, আর অত স্বাধীনতা দিও না বাপু যতই হোক মেয়ে। কখন কার সঙ্গে কি ঘটিয়ে বসবে কে জানে।

অমলার হাসি শুনতে পাচ্ছে ইলা।

অমলা বলছেন, আমরা মেয়ে অমন নয়। তোকে কি আমি কম স্বাধীনতা দিয়েছিলাম? তুই ঘটিয়েছিলি কিছু?

দিদির গলা একটু খাদে নেমেছে, তবে নীলার খাদের গলাও পাশের বাড়ি থেকে শোনা যায়, এই যা। নীলা বলছে, আহা, সে তো আরও পাঁচ-সাত বছর আগে গো। যত দিন যাচ্ছে, তত বুকের পাটা বাড়ছে ছেলেমেয়েদের। তোমার জামাই বলছিল, কে নাকি বলেছে ওকে, একটা ফরসা মতন ছেলের সঙ্গে মাঝে মাঝে মুকুল কেবিন কোথায় চা খেতে দেখেছে।

আবার অমলার হাসি শোনা যায়, সে তো বাপু রাতদিনই দেখা যায়, সবাইয়ের ঘরে ঘরেই। মেয়ে বলে কি আর কিছু আটক বাঁধন আছে আজকাল? মেয়ে ছেলে সমান হয়ে উঠেছে।

নীলা বলে ওঠে, সমান হয়ে উঠেছে বলেই তো সমান নয় মা! বিধাতাপুরুষ যে জব্দ করে রেখেছে। তার ওপর কলম চালিয়ে জিতে গিয়ে কত মেয়ে কত মরণ-বাঁচন কাণ্ড ঘটাচ্ছে, কত বিপদ ঘটাচ্ছে, খবর রাখ না তো।

এবার আর অমলার হাসি শোনা গেল না।

অমলা গম্ভীর হয়েছেন।

বলছেন, তা কি করব বল? সেকালের মতো যখন ঘরে পুরে রাখা চলছে না, তখন ওদের বুদ্ধি-বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিতে হবে, ওদের সততার ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। ছেলেমেয়েকে রাতদিন সন্দেহ করতে হলে মানুষ বাঁচবে কি করে?

ইলা কি মরে যাবে?

এই বিছানায় শুয়ে শুয়ে?

ইলার ঘরে কোনো বিষ নেই? ঘুমের ওষুধ? মালিশের ওষুধ?

সেকালে নাকি রাজপুতের মেয়েরা বিষপাথরের আংটি হাতে রাখত, হঠাৎ ভয়ানক কোনো লজ্জা-অপমানের মুখোমুখি হয়ে পড়লে সেই আংটি চুষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত।

(এই রকম সব পড়েছে ইলা।)

তেমন আংটি কেন একটা নেই ইলার?

ইলার তাহলে আর মাকে মুখ দেখাতে হয় না।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress