মানুষগুলো
০৬.
মানুষগুলো সব সমান।
সামনাসামনি খালি হাতে লড়ার সাহস নেই। সবসময় আড়াল থেকে লড়ে। মানুষগুলোকে বাঘটা ঘৃণা করে।
সেদিনের কথা বেশ ভালো মনে আছে বাঘটার। গরমের দিন–কোনো তল্লাটে জল নেই–। হাতির দল মহানদীর দিকে চলে গেছে। সারাদিন শুধু আগুনের হলকা আর ধুলোর ঝড়। ধনেশ পাখিগুলোসারাদিন পাহাড়ের মাথায় কোনো গাছে একটু ছায়া খুঁজে মাথা গুঁজে বড়ো বড়ো হাঁ করে করে নিশ্বাস ফেলেছে। চিতল হরিণগুলো দল বেঁধে শুকনো মুখে কোনো গভীর নালার ছায়ায় শুয়োরের দলের সঙ্গে গা-ঘেঁষাঘেষি করে সমস্ত দুপুর বসে থেকেছে আর ঝিমিয়েছে!
সন্ধে হব হব–দিনের শেষ ময়ূরের ডাক শোনা গেছে, বাঘটা গুহা ছেড়ে বেরিয়ে ডুঙরি পাহাড়ের পাশের নালার দিকে এক-পা এক-পা করে সাবধানে এগোচ্ছিল। এখনও ভালো করে পা ফেলা যাচ্ছিল না–পাথর মাটি সব আগুনের মতো তেতে আছে। টিলাটা পেরোলেই বাঘটা জল দেখতে পেল। একটুখানি জল, লাল কাদার মাঝে মাঝে জমে রয়েছে। কতকগুলি ঝিনুক-ঝিঁঝি জলে জলছড়া দিয়ে এদিক ওদিকে দৌড়ে যাচ্ছে। একটু আগে বোধ হয় একটা বাইসন জলে নেমেছিল। তার গালা-গোব্দা পায়ের গর্ত এখনও কাদায় অটুট আছে। জল চুঁইয়ে পড়ছে তাতে।
বাঘটা গুঁড়ি মেরে বসে চারদিক দেখে নিল, তারপর জলে নেমে এল। নেমে এসে চক চক-চকচক করে মাথা নীচু করে জল খেতে লাগল। এমন সময় কোথা থেকে একটা বাজপড়ার মতো আওয়াজ হল, আর কী একটা জিনিস হঠাৎ তার মাথা থেকে দু-হাত দূরে একটি পাথরের চাঁইয়ে এসে লাগল। একটুকরো পাথর ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে আগুনের ফুলকি ছিটিয়ে জলে ছিটকে এসে পড়ল। বাঘটার তৃষ্ণা নিবল না। ভীষণ অবাক হয়ে ও একলাফে আবার পেছনের দিকে ঢুকে গেল–বেশ অনেকখানি এসে, টিলাটির ওপরে কিছুক্ষণ আড়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে ভালো করে নজর করে দেখল, জলের পাশে একটি গাছ থেকে দুটি মানুষ নেমে এল-অদ্ভুত পোশাক পরা, এমন পোশাক এই বাঘমুন্ডা কুরাপ টুম্বকা পূর্ণাকোট টিকরপাড়ার কোনো লোককে সে পরতে দেখেনি। তাদের হাতে লাঠির মতো কী দুটি চকচকে জিনিস। তারপর তারা ফিরে গেল।
সেদিন থেকে বাঘটা মানুষদের ঘৃণা করে–বিশেষ করে অমন পোশাক পরা এবং হাতে ওইরকম চকচকে লাঠি নেওয়া মানুষদের।
বাঘটা গুহার বাইরে সামনে দু-থাবা ছড়িয়ে বসেছিল। শীতের সূর্য একটু পরে অস্ত যাবে। পাহাড়ের ওপরের গুহা থেকে বাঘমুন্ডা গ্রামটা দেখা যায়। পোকার মতো লোকগুলো ঘুরঘুর করে। মাঝে মাঝে ধুলো উড়িয়ে জঙ্গলের কনট্রাকটরের ট্রাক আসে–ফটাং ফটাং আওয়াজ করে বাঁশ না কাঠ লাদাই করে তারপর ফিরে যায়।
এখন শেষ বিকেল। এখন ওসব কোনো শব্দটব্দ নেই। মাঝে মাঝে মোরগের ডাক শোনা যাচ্ছে–ময়ুর ডাকছে ডুঙরি পাহাড়ের দিক থেকে। পশ্চিমের দিকের জঙ্গল পাহাড় কেমন বাঘিনির পায়ের মতো নরম সোনালি আলোর বালাপোশে মুড়ে রয়েছে। এমন সব মুহূর্তে বাঘটার ভীষণ একা একা লাগে। ন-মাসে ছ-মাসে কোনো বাঘিনির সঙ্গে দেখা হয়–বাঘটা বাঘিনিদের বয়েস জানে না। বাঘিনিদের কোনো বয়েস হয় না–বাঘটার কাছে কোনো বাঘিনি আসে–কিছুদিন থাকে–বনে-পাহাড়ে, চাঁদনি রাতে নদীর বালিতে, নরম সবুজ ঘাসে ওরা দুজনে দাপাদাপি ঝাঁপাঝাঁপি করে বেড়ায়-বাঘিনিকে দেখিয়ে দেখিয়ে চিতল হরিণীর নরম গ্রীবা থাবার একঘায়ে ভেঙে দেয়। এমনি করে দেখে ও দেখিয়ে, দেখতে দেখতে কটা দিন কেটে যায়। তারপর তার তলপেটের সমস্ত উত্তাপ, তার গায়ের গন্ধ, তার হাতের জোর, তার চোখের আগুন সব চুরি করে নিয়ে একদিন বাঘিনিটা পালিয়ে যায় কিন্তু আসলে পালাতে পারে না। বাঘটা বাঘিনির শরীরে, মনে, অণুতে অণুতে ছড়িয়ে থাকে -তার নাভিমূলের সঙ্গে ঝুলতে থাকে–তার রক্তের সঙ্গে দৌড়োত থাকে। বাঘটা বাঘিনির শরীরময় অনেকগুলো বাঘ হয়ে ঘুমিয়ে থাকে, তারপর একদিন কোনো গহন গাছের ছায়ায় অথবা কোনো গভীর গুহায় বাঘটা কতকগুলি ক্ষুদে ক্ষুদে নরম ডোরাকাটা শরীরে নতুন করে আত্মপ্রকাশ করে।
কিন্তু এই বেঁচে থাকা-মনে-মনেই বেঁচে থাকা। এ জীবনে বেঁচে থাকা নয়। বাঘটার বড়ো একলা লাগে। দিনের পর দিন বাঘটা একা থাকে, মাসের পর মাস। খিদে পায়, খিদে মেটানোর জন্যে শিকার ধরে, ধারালো দাঁতে মাংস চিবোয়–রক্ত চোষে-পেট আই-চাই করে, জল খায়, তারপর চার-পা তুলে তলপেটে রোদ লাগিয়ে আরামে শীতের দুপুরে ঘুমিয়ে থাকে। কিন্তু বাঘটার মন কেমন করে। বাঘটাকে দেখে বনের পশু-পাখি পথ ছেড়ে দেয়–ভয়ে পালায়-বাঘটা বনের রাজা-অথচ তবু বাঘটার সবসময় হাতে-পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে আড়ালে আড়ালে চোরের মতো গিয়ে তার প্রজাদের কাছে পৌঁছোতে হয়। অন্য রাজারা প্রজাদের মঙ্গল করে–বাঘটা তার প্রজাদের বিনাশ করে। বাঘটার ভালো লাগে না। মোটেই ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে বাঘটার পাহাড়ের চুড়ো থেকে নীচের পাথরভরা নদীতে লাফিয়ে পড়ে মরে যেতে ইচ্ছে করে। বেঁচে থাকলে বাঘের বাচ্চার মতো বাঁচতে হয়, খালি পেট ভরাবার জন্য খিদে পেলে খাবার জন্যে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না, বাঘটা ভাবে। মাঝে মাঝে বাঘটার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে।
কী যেন সেই লাইনটা, শ্রুতি, তোমাদের রবীন্দ্রনাথের? শ্রুতির পাশে হাঁটতে হাঁটতে অর্জুন বলল।
রাকেশ বলল, তোমাদের রবীন্দ্রনাথ মানে?
মানে, আমার কলেজের এক কবিবন্ধু ছিল–সে আমাকে শিখিয়েছিল যে, রবীন্দ্রনাথের প্রভাবমুক্ত না হলে জীবনে কিছুই করা যাবে না। ও বলত, সবসময় বলবি তোমাদের রবীন্দ্রনাথ, নইলে আমাদের রবীন্দ্রনাথ বলতে বলতে রবীন্দ্রনাথের ওপর দুর্বলতা জন্মে যাবে। আমি সেকথা বরাবর মেনে চলেছি।
শ্রুতি একটু ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, রবীন্দ্রনাথের প্রভাবমুক্ত যে হয়েছ এ তোমার বড়ো শত্রুও স্বীকার করবে। কিন্তু অন্য কোনো কবির লেখা কি পড়েছ?
অর্জুন বলল, না। টাইম পাইনি। ভাগ্যিস পাইনি। কবিতা পড়ে যে কী হয় তার দু-একটি দৃষ্টান্ত আমার দেখা আছে। যাক আসল কথাটা ভুলে যাচ্ছি, কী যেন লাইনটা শ্রুতি–?
শ্রুতি বলল, মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে।
অৰ্জুন বলে উঠল, ও লালা,–ও লালা। জব্বর লাইন। মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে–আমিও মরতে চাই না। তোমরা কেউ মরতে চাও? শ্রুতি, রাকেশদা?
শ্রুতি বলল, আমি অনেক অনেকদিন বাঁচতে চাই–মরবার কথা আমি ভাবতেই পারি না। আমার মনে হয় জীবনে এখনও কতকিছু করা হল না, দেখা হল না, শোনা হল না, এরমধ্যে মরে কী করব? রাকেশদা আপনার মরতে ইচ্ছে হয়?
রাকেশ বলল, আমার সবসময় মরতে ইচ্ছে হয়। এটা কোনো বাহাদুরির কিছু নয়–কিন্তু যখনই ভাবি যে বেঁচে থাকলে মানুষের মতো, সত্যিকারের মানুষের মতো বাঁচা উচিত, মানুষের মতো কিছু করা উচিত, নইলে বেঁচে যে থাকতেই হবে–রোজগার করতেই হবে, পেট ভরাতেই হবে, দুপুরে অফিস যেতেই হবে, রাতে খাবার পর মশারি ফেলে ঘুমিয়ে পড়তেই হবে–এইসব নিয়মগুলো যে মানতেই হবে-দিনের পর দিন, প্রতিদিন, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ-এটা ভাবলেই আমার দম বন্ধ হয়ে যায়। বাঁচার মতো যথেষ্ট অনুপ্রেরণা না থাকলে, আমার মনে হয় মিছিমিছি এই ওভার-পপুলেটেড পৃথিবীতে ভিড় না বাড়ানোই ভালো। সত্যি-সত্যিই আমার খুব মরে যেতে ইচ্ছে করে।
অর্জুন বলল, ইচ্ছের জোরে কী না হয়? আপনি জীবনে যা যা পেয়েছেন সবই তো ইচ্ছে করেছিলেন বলেই? তবে ইচ্ছে করলে মরতেও পারেন।
রাকেশ হঠাৎ একটু আহত এবং অবাক মুখে অর্জুনের দিকে চাইল। শ্রুতি লজ্জায় কুঁকড়ে গেল, তারপরই চোখে আগুন হেনে অর্জুনের দিকে মুখ ফেরাল।
অর্জুন একটুও না ঘাবড়ে বলল, কী বলুন রাকেশদা, ভুল বলেছি?
রাকেশ বলল, না। ঠিকই বলেছ। ইচ্ছা করলে মরাও যায়।
তব্বে? বলে, উটকো হাসি হাসল অর্জুন।
ওরা হাঁটতে হাঁটতে বাংলো থেকে অনেক দূর চলে এসেছিল–আলোও প্রায় পড়ে এসেছে।
অর্জুন বলল, চলুন, এবার ফেরা যাক। যা জংলি জায়গা।
চলো। রাকেশ বলল।
শ্রুতি বলল, না, এখন ফিরব না–আরও কিছুটা সামনে যাব। আমার হাঁটতে খুব ভালো লাগছে।
অর্জুন বলল, তবে তুমি যাও রাকেশদার সঙ্গে–আমি ফিরছি।
শ্রুতি বলল, তাহলে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে যাও–সূর্য তো ডুবে গেল–তোমার বন্ধু অপেক্ষা করছে।
অর্জুন অবাক হল। বলল, কে বন্ধু?
শ্রুতি সামনে চলতে চলতে মুখ না ঘুরিয়েই বলল, হুইস্কি।
অর্জুন একা একা বাংলোয় ফিরে আসতে লাগল। ও হাঁটতে হাঁটতে অনেক কথা ভাবতে লাগল–ভাবতে ভাবতে ওর চোয়াল দুটি শক্ত হয়ে এল–মনে হল শক্ত হয়ে মুখ থেকে বাইরে বেরিয়ে আসবে, মুখ থেকে খুলে পড়ে যাবে। অর্জুন একবার ডান হাতের তেলো দিয়ে ওর চোয়ালে হাত বোলাল। একটা নিষ্ঠুর নিস্তব্ধ হাসি ওর মুখে ছড়িয়ে গেল।
একটি নেকড়ে বাঘ, দৌড়ে পথের ডানদিকের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে বাঁ-দিকের জঙ্গলে ঢুকল। অর্জুন ভয় পেল। বাকি পথটি ও দৌড়োতে দৌড়োতে এসে বাঘমুন্ডার বাংলায় পৌঁছোল।
শ্রুতি সামনে সামনে হাঁটছিল-রাকেশ পেছন পেছন।
রাকেশ বলল, আর এগিয়ো না শ্রুতি, ফিরতে রাত হয়ে যাবে, সঙ্গে টর্চ নেই।
শ্রুতি বলল, না থাকল–অন্ধকার হলেও পথ তো দেখা যাবে।
তা যাবে–একটি আবছা সাদা শাড়ির মতো দেখাবে–মনে হবে দু-পাশের অন্ধকারের মধ্যে বিছানো আছে।
ওরা দুজনে কেউ আর কোনো কথা বলল না। দুজনে পাশাপাশি আসন্ন সন্ধ্যার বিষণ্ণতামাখা বনে হাঁটতে লাগল।
এমন সব মুহূর্ত প্রত্যেকের জীবনেই আসে যখন মোটে কথা বলতে ইচ্ছে করে না, বরং সমস্ত জীবনে যে এত কথা, এত অবান্তর কথা বলে এসেছে তার জন্যে নিজের ওপর অনুশোচনা হয়।
ওরা দুজনে দুজনের কথা ভাবতে ভাবতে হাঁটতে লাগল। ওদের চেতনার ক্যানভাসে নানারঙা জলরং খুশির তুলিতে বুলিয়ে বুলিয়ে ওরা দুজনে আলাদা আলাদা ছবি আঁকতে লাগল। অথচ ওরা দুজনেই মনে মনে জানে যে, ছবি আঁকা হয়ে গেলেই ম্যাজিক স্লেটের ছবির মতো সে ছবি মুছে যাবে–একে অন্যের ছবি দেখতে পারবে না, অন্যকে নিজের ছবি দেখাতে তো পারবেই না। অথচ তবু ওরা দুজনে মনে মনে রঙিন ছবি এঁকে চলল।
দেখতে দেখতে রোদের লালিমা কখন মুছে গেল–শীতের বন থেকে একটি সোঁদা সোঁদা ঠাণ্ডা ভাব উঠতে লাগল–সমস্ত বনস্থলি রাতের নাটকের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠল।
রাকেশ ডাকল, শ্রুতি!
উঁ!
ফিরবে না?
শ্রুতি উত্তর দিল না। চুপ করে চলতে লাগল।
হঠাৎ বলল, আচ্ছা রাকেশদা, সায়ান্ধকার পথে এরকম হাঁটতে হাঁটতে কোনোদিন ধীরে ধীরে গাঢ় অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া যায় না? জাস্ট ফেড আউট করে যাওয়া যায় না? আমার ভারি ইচ্ছে করে আমার কোনো ভীষণ সুখের মুহূর্তে এমন সুন্দর কোনো পথে হাঁটতে হাঁটতে কোনোদিন আমি জাস্ট ফেড-আউট করে যাব। তারপর আমাকে কেউ ডাকলেও আমি ফিরব না–আমি নিজে–ডাকলেও আমি আর সাড়া দেব না। অথচ আমি আমার চারপাশের অন্ধকারেই ছড়িয়ে থাকব–ঝিঁঝির ডাক হয়ে থাকব, জোনাকি হয়ে থাকব–তারার আলোয় দ্যুতিমান শিশিরবিন্দু হয়ে থাকব, ঝরাপাতা হয়ে থাকব–অথচ শরীরে–এই স্কুল রক্ত মাংসের শরীরে আমি থাকব না। বেশ হয় তাহলে। না?
রাকেশ কোনো উত্তর দিল না।
ওরা বাংলোর দিকে মুখ করে হাঁটতে লাগল। শ্রুতি বলল, কী? কথা বলছেন না যে?
রাকেশ হাসল, বলল, এইজন্যেই বলি মেয়েদের কখনো বেশি লেখাপড়া করা উচিত নয়! মাঝে মাঝে কী যে সব ভূতুড়ে ভূতুড়ে কথা এল, বুঝতে পারি না।
শ্রুতি ওর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, সত্যিই পারেন না।
সত্যিই পারি না।
তাহলে বুঝতে হবে আপনার মাথায় গ্রে-ম্যাটার কম আছে।
রাকেশ দাঁড়িয়ে পড়ে পাইপটা ধরাল, তারপর হাসল। কিন্তু মুখে কিছু বলল না।
অন্ধকার হয়ে গেছিল। ওরা হাঁটছিল– বাংলো এখনও প্রায় তিন ফার্লং মতো হবে।
শ্রুতি বলল, এদিকে যদি হাতি চলে আসে?
না, এদিকে আসবে না।
ইশ, আপনি সব জানেন! যেন আপনার পোষা হাতি? সব আপনার কথা শোনে।
তা তো বলিনি।
তবে?
মানে এদিকে কোনোদিন আসার চিহ্ন পাইনি–তবে এসে পড়তে পারে–বিশ্বাস নেই। রাকেশ বলল।
অন্ধকার করা উচিত হয়নি আমাদের।
আমরা যা কিছু করি সবই কি করা উচিত?
তুমি আজ উকিলের মতো কথা বলছ শ্রুতি, তোমার সঙ্গে কথায় পারব না।
পারবেন তো নাই-ই-বলেই হঠাৎ শ্রুতি চেঁচিয়ে উঠল উঃ বাবা বলে এবং সঙ্গে সঙ্গে হোঁচট খেয়ে পথের ধুলোর পড়ে গেল। একটি কাঠের কালভার্টের ওপর দিয়ে ওরা যাচ্ছিল –নতুন কাঠের স্লিপার উঁচু হয়েছিল। তাতে অন্ধকারে হোঁচট খেয়ে শ্রুতি পড়ে গেল।
রাকেশ দৌড়ে গিয়ে ওকে হাত ধরে তুলল। বলল, খুব লেগেছে?
শ্রুতি বলল, উঃ!
ঠিক হয়েছে। আরও ঝগড়া করো। ভগবান বলে কি কিছুই নেই?
শ্রুতি বলল, উঃ বাবা। আছে আছে। বড্ড লেগেছে।
এসো–এটুকু রাস্তা আমার হাত ধরে চলো।
হাত ধরে?
হ্যাঁ। হাত ধরে চলো, তা নইলে আবার কোথাও পড়ে হাত-পা ভাঙবে, তারপর অর্জুনের কাছে জবাবদিহি করতে হবে আমায়।
শ্রুতি বলল, ঠিক আছে। তাই চলুন।
কিছুটা পথ ওরা দুজনে চুপচাপ হাঁটল অন্ধকারে। হাত ধরে।
হঠাৎ শ্রুতি বলল, দারুণ গেয়েছেন গানটা না, প্রতিমা ব্যানার্জী?
রাকেশ বলল, কোন গান?
আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা, আমি যে পথ জানি না।
রাকেশ বলল, দারুণ! বলেই চুপ করে গেল।
আর কিছুদূর যেতেই ওরা বাংলোর হ্যাঁজাকের আলোর আভা দেখতে পেল।
রাকেশের হাত ধরে শ্রুতি হাঁটতে লাগল। ছোটোবেলায় বাবার হাত ধরে বেড়োলে যেমন আশ্বস্ত লাগত, নির্ভয় লাগত, ভাবনাহীন মনে হত, রাকেশের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বহুদিন পর শ্রুতির ঠিক তেমনি মনে হতে লাগল।
রাকেশ বলল, জোড়হাটের কথা মনে আছে শ্রুতি?
শ্রুতি বলল, আছে। আমি, আপনি, ধীরেনদা, রামুকাকা, বাবা সবাই গেছিলাম ওখান থেকে কাজিরাঙার গণ্ডার দেখতে–মনে আছে।
রাকেশ বলল, আমি সেকথা বলছি না। সেই জোড়হাটের সার্কিট-হাউস থেকে আমরা বিকেলে বেরিয়ে তোমাদের যেন কোন এক আত্মীয়ের বাড়ি গেলাম। সেখানে কত কী কথা হল, গোলাপি লণ্ঠনের আলোয়–আমার সেসব কিছু মনে নেই-তোমার সেই দূর সম্পর্কের মামা না কে, কার যেন নিন্দা করলেন। তারপর ফেরার পথে সেই নির্জন রাস্তা দিয়ে আমরা ফিরে আসছিলাম–সুন্দর চাঁদ উঠেছিল, হাওয়ায় হাওয়ায় সজনে গাছের পাতা ঝরছিল–মনে আছে?
শ্রুতি বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে আছে–গরমের দিন ছিল, তাই না?
রাকেশ বলল, মনে আছে? তুমি জেদ ধরলে, আমি রাকেশদার হাত ধরেই যাব–আর কারও হাত ধরব না। সেকথা শুনে ধীরেন বলল–দুর পেতনি, তোর হাত কে ধরবে রে? সবসময় ঘামে।
শ্রুতি হো হো করে হেসে উঠল। অনেক পুরনো কথা মনে পড়ে গেল। বলল, আচ্ছা, তারপর ধীরেনদা গান গাইল না?
রাকেশ বলল? হ্যাঁ হ্যাঁ, কী যেন গানটা?
দাঁড়ান দাঁড়ান, মনে করছি-ওই যে ওই–চোখের জলে লাগল জোয়ার দুখের পারাবারে।
রাকেশ বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, দারুণ গেয়েছিল গানটা। এখনও মনে আছে। মনে লেগে আছে।
শ্রুতি বাঁ-হাত নেড়ে বলল, বাবাঃ সে কী টপ্পার কাজ। স্বর যত কাঁপে, ঘাড় তার চেয়েও বেশি কাঁপে।
রাকেশ হাসতে হাসতে বলল, তুমি খালি ওর পেছনে লাগতে। আসলে গাইত ও ভালোই।
শ্রুতি বলল, হ্যাঁ। আপনারই মতো।
তারপর কিছুক্ষণ ওরা আবার চুপচাপ হাঁটল।
শ্রুতি বলল, তখন আমি কত ছোটো ছিলাম, না?
এখনও আছ।
তখন আমার একটা হাইল্যাণ্ডারস স্কার্ট ছিল–মনে আছে? লাল সবুজ আর হলদে, খোপ খোপ–ইশ, এখনও মাঝে মাঝে স্কার্টটার স্বপ্ন দেখি। বেশ ছিল ছোটোবেলার দিনগুলো, না রাকেশদা? আমার সেই স্কার্টটার মতো!
রাকেশ কোনো উত্তর দিল না, মাথা নাড়ল।
বাংলোর কাঠের গেটটা খুলে একপাশে দাঁড়াল। শ্রুতি ঢুকলে, নিজে ঢুকে, গেটটি আবার টেনে দিল।
.
০৭.
অর্জুন স্নান করছিল। জানলার তাকে একটি গেলাসে জিন অ্যাণ্ড লাইম রেখে স্নান করছিল। সাবান মাখছিল–জল ঢালছিল গায়ে–আর মাঝে মাঝে গেলাস থেকে চুমুক দিচ্ছিল। বাথরুমের জানলা দিয়ে ঝুপরি আমগাছটা দেখা যাচ্ছিল। কতগুলো পাখি পাতায় ডালে হুড়োহুড়ি করছিল।
শ্রুতি স্নান সেরে বাইরের বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসেছিল। চুল খুলে। বাথরুমে শ্রুতির ছাড়া-কাপড়জামা এককোণে জড়ো করা ছিল। সকালে পরা শাড়ি, শায়া, ব্লাউজ, ভেতরের জামা–সব। অর্জুন শ্রুতির শাড়িটা তুলে নিয়ে নিজের সাবান মাখা শরীরে পরল। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজে নিজেই বলল, splendid; তারপর নিজের মনে বিড়বিড় করে বলল, বা:, Nothing for nothing; And damn all for six pence.
নিজেই বলল, বেশ দেখাচ্ছে তোলরেন্স অফ অ্যারাবিয়ার–পিটার ওটুলের মতো–
তারপর অর্জুন শাড়িটা খুলে ফেলে ভালো করে চান করল। সাবানের ফেনা নিয়ে জল বয়ে যাচ্ছিল নালা বেয়ে। সেদিকে চেয়ে ছিল অর্জুন। সাদা সাদা সরের মতো ফেনা, মাকড়সার সাদা জালের মতো ফেনা, বয়ে যাচ্ছিল নালা বেয়ে–একটানা মিষ্টি শব্দে বাইরে পড়ছিল। সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ অর্জুনের মনে হল–রাকেশ রায়কে ভালো করে শিক্ষা দিতে হবে–This chap thinks that he is too smart. কিন্তু যাই হোক, শ্রুতি তার বিবাহিতা স্ত্রী। সেও কিছু ফেলনা ছেলে নয়। শ্রুতিকে বিয়ে করে সে শ্রুতিকে ধন্য করা ছাড়া অধন্য করেনি। তা সত্ত্বেও Whats all these? রাকেশ কি মনে করে অর্জুন ঘাসে মুখ দিয়ে চলে? অর্জুন ভালো করে শিখিয়ে দেবে রাকেশ রায়কে কত ধানে কত চাল। কিন্তু কী করে শেখাবে? তার এই নিষ্ফল ক্রোধকে সে কী করে চরিতার্থ করবে?
ওসব ভালোবাসা-টালোবাসা বাংলা ছবিতে চলে। জীবনে ওসব চলে না। এখানে শুধু হিসেব। হিসেব ছাড়া আর কিছু নয়। এ ডেবিট মাস্ট অলওয়েজ হ্যাভ এ ক্রেডিট। বিয়ে করলে আমাকে–আর প্রেম দেখাবে রাকেশ রায়কে, ওসব অর্জুনের মাথায় আসে না। অর্জুনের মনে হয় আজকাল, সব সময় মনে হয় যে, শ্রুতির সঙ্গে রাকেশের একটা গভীর অ্যাফেয়ার আছে। সে অ্যাফেয়ার ঠিক ব্যাখ্যা করার মতো নয়। এবং অর্জুন কক্ষনো শ্রুতিকে যা-খুশি তাই করতে দেবে না। She just cant have the cake and eat it as well.
কী করা যায়–কী করা যায়? অর্জুন খুব ভাবতে লাগল। ভেবে ভেবে যখন মাথায় কিছু এল না–তখন একঢোকে জিনের গেলাসটি শেষ করে ফেলল। তারপর বাথরুম থেকে বেরিয়ে পড়ল।
জামাকাপড় পরে বারান্দায় এসে আর একগ্লাস গিমলেট নিয়ে বসল অর্জুন। শ্রুতি কিছু বলল না, একবার তাকাল শুধু ওর দিকে। বিরক্তি নয়, উদাসীনতার চোখে।
চারিদিকে চাইল অর্জুন। চতুর্দিকে খালি জঙ্গল আর জঙ্গল-পাহাড় আর পাহাড় একঘেয়ে–ড্রাব, মনোটনাস।
সকালে ঘুম থেকে ওঠো–রাকেশ রায়ের জ্ঞান শোনো–শ্রুতির বাণী শোনো, দুটি ডিমের পোচ এবং চারখানি টোস্ট খাও। তারপর বাংলোর কম্পাউণ্ডে সুপার অ্যানুয়েটেড সরকারি কর্মচারীর মতো সামনে ঈষৎ ঝুঁকে, পিঠে হাত দু-খানি রেখে (রবীন্দ্রনাথের আলখাল্লা পরা চেহারার পোজে) পায়চারি করো। তারপর?
আর এক চুমুক খেয়ে নিল অর্জুন। তারপর স্যাঁতসেতে ছাগলনাদির মতো গন্ধভরা বাথরুমে ঠাণ্ডা কনকনে জল ঢেলে চান করো–তারপর খাও। তারপর ঘুমোও। তারপর ওঠো। তারপর বসো। তারপর খাও। তারপর ঘুমোও। কিংবা শ্রুতিকে আদর করো এবং তারপর ঘুমোও।
আদর-টাদর আজকাল খেতে চায় না শ্রুতি। কেমন বুনো ঘোড়ার মতো জেদি হয়ে উঠছে। যদি ডাইনে যেতে বলে অর্জুন তো বাঁয়ে যায়। কী যে ব্যাপার, বুঝছে না। দিল্লিতে তো এরকম করত না। এখানে আসাই ওদের ভুল হয়েছে। সেখানে অর্জুনের ফ্ল্যাটের আরাম আর আয়োজনে, ওর চাকরির চাকচিক্যে ওর বন্ধু-বান্ধবী পার্টি-পিকনিকের ঘন ও নিবিড় নিরবচ্ছিন্নতায় শ্রুতির ভেতরের বুনো ঘোড়াটা লাগাম বাঁধা ছিল। কখনো ক্লান্তিতে তার মনের ঠোঁটের কোনা বেয়ে ফেনা গড়িয়েছে কি না জানতে যায়নি অর্জুন, কিন্তু এটুকু এখন বুঝতে পাচ্ছে যে, এখানে এসে রাকেশ রায়, তার এই হরিবল জঙ্গলপ্রীতি-ধনেশ পাখি–বাঘ্বডুম্বা (my foot!) এইসব মিলে শ্রুতির ওপর এল এস-ডি খাবার এফেক্ট হয়েছে।
শ্রুতি কেমন নেশাগ্রস্ত হয়ে গেছে। কী ভাবে কী করে; ও যেন সবসময় কীসে ভোর হয়ে আছে; ভরে আছে।
ক্যাসু নাটসের একটি নতুন টিন কেটে এনে, সামনের বেতের চেয়ারে পা দুটি তুলে দিয়ে, নাটস মুখে দিতে দিতে অর্জুন আর এক চুমুক দিল।
বড়ো বড়ো থামগুলোর ছায়া পড়েছিল চওড়া বারান্দায়। ঝিরঝির করে হালকা হাওয়া বইছিল। একটি কমলা-রঙা প্রজাপতি ফিনফিনে পাখা নেড়ে উড়ে উড়ে ফুলে পাতায় বসছিল। হাওয়ায় তার পাখা কাঁপছিল।
সুব্বল রোজকার মতো বাঘের জন্যে বাঁধা মোষের তত্ত্বাবধান করতে গেছিল। রাজুয়াড় বাবুর্চিখানায় ছিল। রাকেশ কুয়োতলায় চান করতে গেছিল। শ্রুতি আর অর্জুন চুপ করে বসেছিল। দুজনে দুজনের ভিন্ন ভাবনাগুলি নিয়ে খেপলা জালের মতো ছুঁড়ে ছুঁড়ে অবকাশের বিলে ফেলছিল। ওরা নিথর হয়ে বাইরের রোদে ভরা বনের দিকে চেয়ে বসে ছিল।
অর্জুন ভাবছিল শ্রুতির কথা। কত বদলে গেছে আজকাল শ্রুতি। এক বিষয়ে সে ব্রিচ অব কন্ট্রাক্ট করেছে তার সঙ্গে। এমন কথা ছিল না। খাও-পিয়ো–মৌজ করো–এই তিনটি কথা ছাড়া অন্য কিছুতে অর্জুন বিশ্বাস করে না-করেনি কোনো দিন। এসব গালে হাত দিয়ে বসে ভাবা–এসব তার কস্মিনকালেও আসে না–যাদের আসে, তাদের পেছনে পয়েন্টেড জুতো পরে লাথি মারতে ইচ্ছে করে।
শান্তনুকে মনে পড়ে অর্জুনের। শ্রুতির হেভি অ্যাডমায়ারার ছিল, কবিতা লিখত। গালে হাত দিয়ে ভাবত। প্রেমে পড়েছিল–একেবারে হেড ওভার হিলস। করলবাগে থাকত– চাকরির জন্যে–আসলে কলকাতার যাদবপুরের ছেলে-অর্জুনের স্কুলের বন্ধু। শান্তনু সবুজরঙা খদ্দরের পাঞ্জাবি পরত। সরু শীর্ণ ঘাড়ে পাঞ্জাবিটা লটকে থাকত–কাকতাড়ুয়া যেমন লটকে থাকে বাঁশের ডগায়।
ও আবার পার্টি-ফার্টিও করত–কীসের পার্টি তা কেউ জানে না। কেউ কেউ বলত কংগ্রেসের দালাল, আবার কেউ কেউ বলত কমিউনিস্টদের বশংবদ। অর্জুনের দৃঢ় বিশ্বাস পার্টি-ফার্টি সব বোগাস। শালা পারমিট বাগানো কি ভাই-ভাইপোকে চাকরি দেওয়ার মতো ভেবেছিল, পার্টির ভাঁওতা মেরে শ্রুতিকেও বাগাবে।
ও যখন ওর সবুজ ঢোলা পাঞ্জাবির মধ্যে দিয়ে সরু শিরা বের করা মুঠিবদ্ধ হাত বের করে, নাড়িয়ে–রাজনৈতিক খিচুড়ির হাঁড়িতে হাতা নাড়ার মতো–বক্তৃতা দিত–তখন অর্জুনের মজা লাগত; অর্জুনের মায়াও লাগত, কারণ প্রিহিস্টরিক ডাইনোসরসকে পুজো করাও যা, আজকাল কোনো মতবাদকে পুজো করাও তা।
পুজো করার মতো আজকের জীবনে কী আছে? নীতি-ফীতির কথা ছেড়েই দিল। নীতি তো কেবল মোটা মোটা বইয়েই লেখা থাকে। নীতি তো কোনোদিন বড়ো হয়নি– নীতিবাগীশরাই হয়েছে। শান্তনুর বৃথা কালক্ষয়; ওদের এবং শ্রুতিকে বৃথা ইম্প্রেস করার চেষ্টা দেখে, অর্জুনের হাসি পেত। শান্তনুর নেতা হওয়ার খুব সাধ ছিল।
অথচ কেমন মিইয়ে গেল শান্তনুটা। তখন ও কেমন সব ভোলা সোডার বোতলের মতো ভুসভুসে ঝাঁঝ-ভরা ছিল। হেভি এন্থ ছিল তখন। ও এখন যা হয়েছে তা শ্রুতির ঠাণ্ডা ব্যবহারে হয়নি–ও নিজে-নিজেই ঠাণ্ডা মেরে গেছে। ওর বোতলের ঝাঁঝ সব শেষ হয়ে গেছে। ও এখন জলপাইগুড়ির চা-বাগানের স্টোরসকিপার। জলহস্তীর মতো কেলে-ভুচুং একটি খাণ্ডার মেয়েকে বিয়ে করেছে–ভদ্রমহিলা কম ময়ান দিয়ে ভালো লুচি বানাতে পারেন–তিন-তিনটি ছেয়ে-মেয়ে ইতিমধ্যেই হয়েছে। শান্তনু রেগুলার স্টোরস থেকে মাল ঝেড়ে বাজারে বেচছে। মহাসুখে আছে। গোরুর মতো পান চিবোচ্ছে দু-বেলা পেট ভরে ভাত খাচ্ছে, রোগা রোগা দুবলা হাতে আড়াই-মনি গোল স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে ভসভস করে ঘুমোচ্ছে। শালা বেঁচেও মরে আছে।
শ্রুতিও ভাবছিল, অর্জুন আর আগের অর্জুন নেই। কত অন্যরকম ছিল ও আগে। কত ন্যায়-অন্যায় বোধ ছিল, কত বিবেচক ছিল, কত মজার ছিল। এখন খালি ড্রিঙ্কস আর ড্রিঙ্কস, ফুর্তি আর ফুর্তি। স্থিতি বলে কোনো কথা আর অর্জুনের জীবনে নেই। শ্রুতি যেন অর্জুনের সঙ্গে কোনো সদাকম্পমান দ্রুতগতি ট্রেনের কুপেতে বসে আছে। ঝড়ের মতো চলে যাচ্ছে–কত সুন্দরী পাহাড়তলি, কত নদী, কত গাছ, কত ছায়া, কত মোষের পিঠে বাঁশি বাজানো রাখাল ছেলে–সব ফেলে–সব ফেলে–এক অজ্ঞানতা থেকে অন্য অসীম অজ্ঞানতার দামি টিকিট কেটে ওরা দুজনে উড়ে চলেছে। কোথাও থামা হচ্ছে না, দাঁড়ানো হচ্ছে না, ভাবা হচ্ছে না।
ওদের এই বঙ্কিম দ্রুতগতি, ঝাঁকুনিসর্বস্ব জীবনকে মাঝে মাঝে ট্যুইস্ট নাচের মতো মনে হয় শ্রুতির। মাইনে ছাড়াও আজকাল অর্জুন অনেকরকম উপরি রোজগার করছে–তা শ্রুতি বুঝতে পারে। অথচ, অর্জুনের সতেরোশো টাকা মাইনে এবং অন্যান্য পারকুইজিটে ওদের দুজনের স্বচ্ছন্দে চলে যাওয়া উচিত ছিল। আরও টাকার কী দরকার জানে না শ্রুতি। এইরকম টাকার বিনিময়ে এ জীবনের কী দরকার?
বাচ্চা পছন্দ করে না অর্জুন। একেবারে পছন্দ করে না কি না বুঝতে পারে না। তবে আপাতত করেই না। বলে, কী দরকার, ঝুট-ঝামেলায়? খাও-পিয়ো-মৌজ করো–ঝাড়া হাত-পা। যেখানেই যাও, প্লেনে আজকাল ফিফটি পারসেন্ট ভাড়া বাচ্চাদের, জানো? ফিফটি পারসেন্ট মানে আরও দু-দিন কোনো ভালো হোটেলে থাকা। যতদিন যৌবন থাকে, মস্তি থাকে, মেজাজ থাকে, মৌজ করে নাও। যৌবন ফুরিয়ে গেলে তারপর দুজনে কোমরে কাপড় বেঁধে গান গাওয়া যাবে—
ছিঃ ছিঃ এত্তা জঞ্জাল
ছিঃ ছিঃ হরদম লাগাতে ঝাড়ু
তব ভি অ্যায়সা হাল।
অথচ শ্রুতির ভালো লাগে না। বিয়ের পর চার বছর হয়ে গেছে। এই লম্ফঝম্ফ আর ভালো লাগে না। ও একটি নরম নির্জন সুখে ভরপুর জীবন চায়। অর্জুনের জন্যে সে অনেককিছু করতে চায়। অর্জুন সৎ হোক–অর্জুন বড়ো হোক–অর্জুন দশজনের একজন হোক। অর্জুন বড়োলোক তোক এ কোনোদিন শ্রুতি কামনা করেনি। বড়োলোকি তার বাবা মার কাছে অনেক দেখেছে ও, শুধু টাকায় যে কিছু হয় না তাও জেনেছে। কিছু টাকা এবং …। এবং… সেই এবং-ই নেই শ্রুতির জীবনে।
শ্রুতির ইচ্ছে করে, অর্জুন খুব খেটে-টেটে ক্লান্ত হয়ে রোজ ঠিক সময়ে অফিস থেকে ফিরবে–শ্রুতি ওর স্যুট-টাই সব নিজে হাতে তুলে রাখবে–তারপর ও যখন হাত-মুখ ধুতে বাথরুমে যাবে, তখন শ্রুতি নিজে হাতে ওর জন্যে খাবার করবে চিঁড়ের পোলাও বা কিছু, নিজে হাতে চায়ের জল করবে। নিজে হাতে অর্জুনকে খাওয়াবে।
তারপর অর্জুন শাল জড়িয়ে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে বসে কিছু লিখবে কী পড়বে; নয়তো ওরা কোনো ভালো গান শুনবে কিংবা বাজনা–অথবা হয়তো কোনোদিন সপ্তাহে দু-দিন কি একদিন কোথাও বেড়াতে যাবে–কোনো ভালো ছবি দেখবে–কোনো নিভৃত রেস্তরাঁয় যাবে, শ্রুতির সমস্ত সত্তা ঘিরে–কোনো সুগন্ধি আতরের মতো–প্রথম যৌবনের কোনো ভরন্ত ভালো লাগার মতো–অর্জুন–শ্রুতির সমস্ত শরীরে-হৃদয়ে ছড়িয়ে থাকবে।
কিন্তু কিছুই হল না। কিছুই হল না। বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে ভীষণ ভীষণ ভীষণভাবে আদর করার মতো একটি সুন্টুনি-মুন্টুনি বাচ্চা পর্যন্ত হল না। বন্ধ্যা হয়ে গেছে শ্রুতিও বন্ধ্যা হয়ে গেছে শরীরে এবং মনে। ও আর ফল ফলাবার আশা রাখে না–মাঝে মাঝেই একেবারে হতাশ হয়ে পড়ে।
শ্রুতি তার কাছেই বসেছিল–অথচ অর্জুনের মনে হচ্ছিল ও যেন কত দূরে বসে আছে। কটকের গভর্নমেন্ট এম্পোরিয়াম থেকে রাকেশদা ওকে একটি সম্বলপুরি শাড়ি কিনে দিয়েছে –দেখে মনে হয় সিল্ক। সেই শাড়িটি পরেছে শ্রুতি। মাথায় যত্ন করে তেল মেখেছে। একটি মিষ্টি-মিষ্টি গন্ধ বেরোচ্ছে মাথা থেকে। শ্রুতি মুখ ফিরিয়ে সেগুনবনের দিকে চেয়ে আছে– যেখানে বড়ো বড়ো পাতায় হাওয়া এসে ফিসফিস করছে। রোদ ঝিলমিল করছে।
অর্জুনের এসব এক ধরনের ন্যাকামি ছাড়া অন্যকিছু মনে হয় না। পুরুষমানুষ হয়ে নিজে হাতে গিয়ে পছন্দ করে মেয়েদের জন্যে শাড়ি কেনা, ভাবা যায় না। কেন, অর্জুন কি শ্রুতিকে শাড়ি কিনে দেয় না। অনেক দেয়। তবে নিজে হাতে নয়। টাকা ধরে দেয়। কড়কড়ে নতুন একশো টাকার নোটগুলো দিয়ে দেয় ও। বলে, যাও খুশিমতো কেনো গিয়ে। তা নয়, নিজে ঘুরে ঘুরে ভালোবাসার লোকের জন্যে শাড়ি কেনা। পিরিত দেখানো। চলে না। রাকেশবুড়োকে নিয়ে চলে না। অর্জুনের ভীষণ ঘৃণা হয় লোকটাকে।
ওই আসছে। কুয়োতলায় সরষের তেল মেখে শর্টস পরে স্নান করে রাকেশ এল–পিঠের ওপর তোয়ালেটা ফেলা–সামনেটা বুকের দিকে টানা। সুন্দর দুটি সুগঠিত পা। যা হোক বুড়ো চেহারাটা রেখেছে ভালো। অর্জুনের থেকে কমপক্ষে পাঁচ-ছ বছরের বড়ো হবে–সেই তুলনায় চেহারাটা রেখেছে ভালো। শালা ধনেশ পাখি। হেভি এন্তু শালার।
এই এন্থু কথাটা নিয়েই একদিন খুব ঝগড়া হয়ে গেল শ্রুতির সঙ্গে। অর্জুন কলকাতার ছেলে–সেখানে পড়াশুনো করেছে–দুর্গাপূজোর সময় প্যাণ্ডেলের পেছনে বসে রাম খেয়েছে
ট্যাক্সিতে নাইলন-পরা কড়া সেন্ট মাখা মেয়েদের নিয়ে অথবা পাড়ার সম্ভ্রান্ত গার্লফ্রেণ্ডদের নিয়ে এখানে ওখানে ডে-স্পেণ্ড করেছে। অর্জুন লাইফ দেখেছে। অনেক অনেক লোকের সঙ্গে, অনেকরকম লোকের সঙ্গে মিশেছে। ও দেখেছে, ওর বন্ধুবান্ধব সকলেরই এরকম ভাষা রপ্ত হয়ে গেছে। লোকটির হেভি এন্তু–মানে লোকটি খুব উৎসাহী। এন্তু মানে এম্বুজিয়াজম। মিস্টার সেনের হেভি ফাণ্ডা, মানে মিস্টার সেনের ফাণ্ডামেন্টাল জ্ঞান খুব দড়ো।
শ্রুতি এসব শুনলেই বলে, এরকমভাবে কথা বলার কী দরাকর? না ইংরিজি, না বাংলা, না কিচ্ছু।
অর্জুন মনে-মনে হাসল। তারপর মনে-মনেই বলল, ধ্যাৎ শালা-এবার কলকাতা ফিরে গিয়ে কিরি কিরি কিরি কিরি ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ চালু করে দেব। রাকেশ ব্যাটা একটা বাঘড়ম্বা।
আর এক চুমুক খেয়ে ও নিজের মনে বলে উঠল, বাঘ্বডুম্বা।
শ্রুতি বলল, ও কী? কী হল?
অর্জুন বলল, বাঘ্বডুম্বা।
বাঘ্বডুম্বা কী?
অর্জুন বলল, তুমি বিশ্বাস করো বাঘ্বডুম্বা আছে?
বিশ্বাসও করি না, অবিশ্বাসও করি না। তবে মনে হয় এসব জায়গায় এসব থাকা অস্বাভাবিক নয়।
তুমি ভূতে বিশ্বাস করো? তোমার না ছোটোবেলায় মেমসাহেব গভর্নেস ছিল?
শ্রুতি বলল, সে-ই তো প্রথম আমায় ভূতের কথা বলে, ভূত সত্যি।
মাই গুডনেস! সরষের মধ্যেই ভূত!
শ্রুতি বলল, ভূত মানে জানি না, তবে আত্মা বলে কিছু আছে। আত্মা থাকলে-অভিশপ্ত আত্মা থাকাও, আমার ক্ষুদ্রবুদ্ধিতে, অসম্ভব নয়। মানে, এসব গভীর জঙ্গলে-পাহাড়ে এমন অনেক কিছু আছে–বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না।
তারপর শ্রুতি শুধোল, কেন, তুমি ভূত মানো না?
অর্জুন বলল, আমি ভূত মানি না, ভবিষ্যৎও মানি না, আমি কেবল বর্তমান মানি। বলে সিগারেট-ধরা বাঁ-হাতটি শ্রুতির দিকে তুলে বলল, কাছে এসো। আই ক্যান স্মেল এ প্রিমরোজ। কাম মাই ডার্লিং…।
শ্রুতি চোখ দিয়ে ধমক দিয়ে চাপা গলায় বলল, কী হচ্ছে কী? পাশের ঘরে রাকেশদা জামাকাপড় পরছেন না?
অর্জুন হাতটা নামিয়ে দিয়ে বলল, হুম–বাঘ্বডুম্বা।
শ্রুতি বেশ উদবিগ্ন ও রাগত স্বরে, ততধিক চাপা গলায় বলল, কী বলছ কী?
অর্জুন বলল, আমি ভূতে বিশ্বাস করি না, আমি বাঘ্বডুম্বায় বিশ্বাস করি।
শ্রুতি বলল, মানে?
মানে, এ এমন ব্যাপার, বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না। বলেই জোরে প্রায় চেঁচিয়ে বলল, কিরি কিরি কিরি কিরি–ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ।
এমন সময় রাকেশ বারান্দায় এল। একটি ফিকে হলদে হাফহাতা সোয়েটার পরেছে ফুল হাতা ফিকে নীল পপলিনের শার্টের ওপর। পরনে সাদা শর্টস। পায়ে স্লিপার।
রোদে চেয়ারটা টেনে নিয়ে, রাকেশ বলল, কী ব্যাপার, অর্জুন? কিরি কিরি কিরি কিরি–ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ, কী বলছিলে?
শ্রুতি কথা কেড়ে বলল, আমরা বাঘ্বডুম্বার কথা আলোচনা করছিলাম। জানেন রাকেশদা, আপনারা যেদিন চিতাবাঘটি মারলেন সেদিন আমি এই বারান্দায় বসে বাঘৃদুম্বার ডাক শুনেছি।
রাকেশকে খুব চিন্তান্বিত দেখাল, বলল, কখন?
কখন? মানে আপনারা ফিরে আসার অল্প একটু আগে। আমি হেঁটে গেট অবধি গেছিলাম–তারপর ফিরে আসছিলাম–যেই বারান্দায় উঠলাম সঙ্গে সঙ্গে শুনলাম ওই ডাক। আচ্ছা রাকেশদা, আপনি নিজে কখনোও শুনেছেন?
রাকেশ দেখল, অর্জুন একদৃষ্টে ওর মুখের দিকে চেয়ে আছে–চোখের দিকে চেয়ে আছে। রাকেশ চোখের পাতা একটুও না নাড়িয়ে, শক্ত গলায় মিথ্যা কথাটা বলল, নাঃ।
অর্জুন বলল, কিন্তু আমার মনে হয় আছে। রাকেশ বলল, কী আছে?
অর্জুন হাসল-ঘৃণার হাসি, তারপর ওর ঘৃণাটিকে ওর গিমলেটে ভালো করে মিশিয়ে নিয়ে–এ ড্যাশ অফ বিটারস-এর মতো নাড়িয়ে নিয়ে একগালে পুরোটা গিলে ফেলল।
রাকেশ আবার শুধোল, কী আছে? অর্জুন বলল, বাঘ্বডুম্বা।
তারপর মনে মনে বলল, আমি বাঘ, আর তুমি বাঘ্বডুম্বা।
.
০৮.
আজ ঠাণ্ডাটা বেশি। বেশ বেশি। কাছাকাছি কোথাও বৃষ্টি হয়ে থাকবে। হু-হুঁ করে কনকনে হাওয়া ছেড়েছে। ঘরের ভাঙা শার্সির কোণ ডিঙিয়ে শিস দেওয়া আওয়াজ তুলে ফুরফুর করে হাওয়া ঢুকছে ঘরে। শীতে রাকেশের ঘুম আসছে না। কম্বলটাকে ভালো করে কাঁধের নীচে, শরীরের দু-পাশে গুঁজে নিল। তাও শীত করছে।
বাংলোর মধ্যের ঘরে, যে ঘরে ওরা বসে ও খাওয়া-দাওয়া করে, একটি ক্ষীণ-শিখা হ্যারিকেন জ্বলছে। রাকেশের ঘরের দরজার একটি পাল্লা ভেজানো বলে, সামান্যই আলো আসছে এ ঘরে। যতটুকু আলো আসছে তাতে গান-র্যাকে বন্দুক, রাইফেলগুলো চকচক করছে, ব্র্যাকেটে ঝুলিয়ে রাখা টুপি ও ওয়াটার বটলের বিরাট বিকৃত ছায়াগুলি দেওয়ালে ছড়িয়ে আছে।
কোথাও কোনো শব্দ নেই। বাইরে কেবল একটানা ঝুন ঝুন ঝুন ঝুন করে ঝিঁঝিরা নূপুর বাজিয়ে চলেছে। হঠাৎ ফরেস্টারের বাড়ির পেছনে কুলথি খেতে পাহাড় থেকে নেমে আসা একঝাঁক চিতল হরিণ টাঁউ টাউ করে ডেকে সেই অবিচ্ছিন্ন নিস্তব্ধতাকে আরও নিবিড়া করছে।
শ্রুতিরা জেগে আছে। ওঘর থেকে ফিসফাস আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। খাওয়ার টেবল ছেড়ে ওরা বড়োজোর আধঘণ্টা হল উঠেছে।
এইরকম ভীষণ শীতের রাতে রাকেশের রুমনির কথা মনে পড়ে যায়। রুমনি এলাকে নিয়ে আলাদা শুত। এমনি শীতের রাতে রুমনি বলত, আমার বড়ো শীত করছে গো, আমার কাছে একটু আসবে?
রাকেশ বলত, না।
এসো না, please? আমি ঠাণ্ডায় জমে গেছি- please এসো।
কেন, আমি কি তোমার কম্বল?
হ্যাঁ, এই কম্বলে আমার শীত মানছে না, তোমার বুকের কাছে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকলে আমার আর শীত করবে না।
রাকেশ জানে না, এখন রুমি কোথায় আছে। এই শীতে সে না-জানি কোথায় কোথায় বনেজঙ্গলে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে কুয়াশায় একা একা ঘুরে বেড়োচ্ছে। লেখাপড়া শিখে, বিজ্ঞানের নিত্যনতুন অগ্রগতির খবর জেনেও এইসব ব্যক্তিগত দুঃখ, ব্যক্তিগত প্রশ্নের মীমাংসা করতে পারেনি। চাঁদে এরা রকেট পাঠিয়েছে সত্যি, কিন্তু এইমুহূর্তে সত্যি করে, সঠিক করে কেউ বলতে পারে না, তার রুমনি কেমন আছে, কোথায় আছে। সুখে আছে, না দুঃখে আছে–কেউ বলতে পারে না। সবাই অনেক বড়ড়া বড়ো সামাজিক, রাজনৈতিক, বিশ্ববিষয়ক ব্যাপারে ব্যস্ত আছে।
অথচ যতক্ষণ রুমনি ছিল ততক্ষণ তার অস্তিত্বের মতো এমন সর্বৈব সত্য আর কিছু ছিল না। কিন্তু তাকে পুড়িয়ে আসার পরমুহূর্তে জানতে হল, সে যে ছিল একথার মতো সর্বৈব মিথ্যে আর কিছুই নেই। অথচ তার সবকিছু চতুর্দিকে ঘিরে ছিল, ঘিরে থাকবে। তার হাতের লাগানো বোগেনভিলিয়া, তার মমতামাখা মেয়ে এলা, তার পেতে রাখা ম্যাটস, তার আঁকা ছবি, তার শাড়ি, তার জামা, তার সবকিছু। তার দিয়ে যাওয়া, ফেলে যাওয়া অনেক অনেক সরল সুরেলা ক্ষণ। তারা সবাই আছে! এ সব সত্যি।
রাকেশ এইমুহূর্তে যেমন বেঁচে আছে, নিশ্বাস নিচ্ছে, মস্তিষ্কচালিত হয়ে ভাবছে এসব যেমন সত্যি; রুমনির মুখভরা হাসি, রুমনির পাগলামি যে কেবল স্মৃতি রোমন্থনেরই জন্যে মাত্র, এও সত্যি। সে আর কোনোদিন এমন শীতের রাতে কখনো কখনো আদুরে গলায় তার স্বামীকে ডাকবে না, বলবে না, আমার বড়ো শীত করছে, আমার কাছে একটু এসো না গো!
যতদিন ও বেঁচে ছিল ততদিন এইসব নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনাকে, টুকিটাকি কথাকে অত্যন্ত সাধারণ এবং এমনকী কখনো-কখনো বিরক্তিকর বলেও মনে হত। মনে হত টং, বেশি বেশি। কিন্তু আজ আর তা মনে হয় না রাকেশের। আজ তার অল্প যেটুকু ছিল তা হারিয়ে যাওয়ায় রাকেশ বুঝতে পেরেছে, এই নিত্যনৈমিত্তিক টুকিটাকি নিয়েই জীবন। কারও জীবনেই রোজ রোজ কোনো বৃহৎ ও মহৎ ঘটনা ঘটে না। এই অবহেলায় ভুলে থাকা রোজকার অকিঞ্চিৎকর জীবনের জন্যেই সকলের কামনা। এরমধ্যেই সমস্ত সাধ, নিংড়ানো সুখ।
সত্যি কথা বলতে কী, রুমনি যতদিন বেঁচে ছিল, রাকেশের মনে হত, রুমনি তাকে সম্পূর্ণভাবে সুখী করতে পারেনি। মনে হত, অনুক্ষণ মনে হত, রুমনিকে বিয়ে করে সে ভুল করেছে। রুমনিও বলত যে, রুমনিরও তাই মনে হত। এমনকী ওরা কোনো-কোনোদিন কোনো মর্মান্তিক মনোমালিন্যের পর দুজনে দু-পক্ষের উকিলের মতো আশু ডিভোর্স সম্বন্ধে আলোচনাও করত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, দেখা যেত সেই রাতেই দু-পক্ষেরই ডিভোর্সের স্থির ও অনড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর রুমনি রাকেশের বিছানায় ঘন হয়ে শুয়ে ফিসফিস করে বলত, ইশ, কত সাহস! ডিভোর্স করবেন! এল তো, আমাকে ছাড়া একদিনও চলবে তোমার? আমি বলে তোমার সঙ্গে রয়েছি-নইলে অন্য কোনো মেয়ে থাকত না। আমি মরে গেলে তোমার একদিনও চলবে না। ডিভোর্স করবেন, কত বড় সাহস! তারপর রুমনি রাকেশের কানের কাছে মুখ এনে বলত, এই লোকেরা কী করে ডিভোর্স করে বল তো। তারা নিষ্ঠুর হয়, না? রাকেশ তাড়া দিয়ে গম্ভীর মুখে বলত, কী করে করে দেখাচ্ছি, কালই আমি সলিসিটারের কাছে যাব। তারপরই রুমনিকে জড়িয়ে ধরে রিচার্ড বার্টনের মতো চুমু খেত রাকেশ। রুমনি হাত-পা ছুঁড়ত, অস্ফুটে বলত, ওরে আমার মিঠুয়ারে, উনি করবেন ডিভোর্স, করলে বাঁচতাম।
রুমনি প্রায়ই বলত, সে মরে গেলে রাকেশের একদিনও চলবে না। মানে তার এত অসুবিধে ও কষ্ট হবে যে, সে বাঁচবেই না। কিন্তু সেকথা সত্যি হয়নি। রুমনির মৃত্যুর পর আজ অবধি অনেকবার তাদের বিয়ের তারিখ ফিরে এসেছে–তবু রাকেশ ঠিকই আছে। বছরের পর বছর কেটে গেছে। বিয়ের তারিখে অফিস ছুটি নেওয়ার জন্যে রুমনি আর ঝগড়া করেনি, রুমনির জন্যে রাকেশ আর কিছু কিনে আনেনি, আর ওরা সেই দিনটিতে বাইরে কোথাও খায়নি। সত্যি কথা বলতে কী, রুমনির মৃত্যুর পর ওদের বিয়ের তারিখকে সকলে যেন ভয়াবহ একটা ঘটনার স্মারক হিসেবে ভুলে গেছে, রাকেশসুদ্ধ।
একমাত্র শ্রুতি। শ্রুতি একমাত্র মনে করে রেখেছে বরাবর, বরাবর। প্রতিবার নিজের কাজের ক্ষতি করেও রাকেশের কাছে এসেছে। সমস্ত দিন রাকেশের কাছে থেকেছে। রাকেশকে ভুলিয়ে রেখেছে। গতবছর ওদের বিয়ের তারিখে শ্রুতি এসেছিল সন্ধেবেলা। রাকেশ কী ভেবে একটি মুক্তোর দুল কিনে নিয়ে এসেছিল। ওপরের খোলা বারান্দায় বসে ওরা চা খাচ্ছিল। রাকেশ দুল দুটি শ্রুতিকে পরাতে যেতেই শ্রুতি অবাক হয়ে বলেছিল, ও কী, রাকেশদা?
রাকেশ বলেছিল, রুমনির অভাব যদি কেউ আংশিকভাবেও ভরিয়ে থাকে আমার জীবনে তা হয়তো তুমি। একমাত্র তুমিই। যেমন এটা সেই ঋণের স্বীকৃতি। সব ঋণ তো এ জীবনে শোধ করা যায় না, যেমন মা-বাবার ঋণ; কেবলমাত্র স্বীকার করা যায়। সেইটুকু আমাকে করতে দাও।
শ্রুতির মুখ কালো হয়ে গেছিল। মুখ নীচু করে বসেছিল, বলেছিল, আমার কাছে আপনার কীসের ঋণ? রাকেশ হেসে বলেছিল, তুমি অনেককিছু দিয়েছ শ্রুতি–অনেক কিছু। মনে মনে বলেছিল, আমার মনের শৈত্য, আমার স্যাঁতসেতে পিচ্ছিল নৈরাশ্যকে তুমি এক স্বর্গীয় আশায় ভরে রেখেছ অনুক্ষণ–তুমি জানো না তুমি আমাকে কী দিয়েছ। যেদিন এই শরীর ছাড়িয়েও বাঁচতে শিখব, সেদিন হয়তো তোমার যথার্থ সম্মান করতে পারব। তবু নিজেকে এই যে সবসময় একটি বিড়ালে খাওয়া কবুতরের মতো ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত রিক্ত করছি– যা চেয়েছি তা ভুলে গিয়ে যা পেয়েছি তাই নিয়েই সব সময় সন্তুষ্ট হতে বলছি–এও কি কিছু নয়? শ্রুতি কেবল বলত, রাকেশদা, আমার এসব ভালো লাগে না। নইলে আমার কী আছে যা আপনাকে দিইনি। যা দিইনি তা আমার কাছে নিতান্তই মূল্যহীন। আমি হয়তো একটু অন্যরকম। কিন্তু আমার ভালো লাগে না রাকেশদা, আমার ওসব ভাবতেও ভালো লাগে না।
শুয়ে শুয়ে রাকেশ ভাবছিল, সত্যিই শ্রুতি অন্যরকম। অন্যরকম না হলে হয়তো রাকেশের তাকে এমন করে ভালোও লাগত না। এবং ভাগ্যিস সে একটি অসাধারণ মেয়েকে এমন করে ভালোবাসতে পেরেছিল, নইলে রুমনির মৃত্যুর পর তার এই একা একা চরা চল্লিশে সে অনেকানেক সাধারণ কাজ করে ফেলত–মানে, হয়তো না করে উপায় থাকত না –সেইসব মেয়ের হাসিতে ভুলত, যারা বাড়ি ফিরে তাদের হাসি ধুয়ে ফেলে। ছোকরা কনট্রাকটর, উঠতি কবি ও বুড়ো বিড়ি পাতার ব্যাবসাদারের প্রেমিকাও তার প্রাণের প্রেমিকা হয়ে যেত। প্রতিবার তাদের কাছে যেত, আর রুমনির প্রেতাত্মা তাদের পরচুলার ফাঁকে ফাঁকে কোনো বিষাক্ত বাতাস হয়ে ঘুরে বেড়োত। ফিসফিস করত।
না:, শীতটা বেড়েই চলেছে। শুয়ে থাকা যাচ্ছে না আর। রাকেশ উঠে পড়ল, জানলার ভাঙা শার্সির কাছে ওয়াটার-বটলটাকে এনে দাঁড় করিয়ে রাখল। তারপর বাথরুমে গেল। বাথরুমের বাইরের দিকের দরজাটা খোলাই ছিল। চৌকিদার জল দেওয়ার পর কেউ আর ভেতর থেকে বন্ধ করেনি। রাকেশ দরজাটা টেনে বন্ধ করতে গিয়ে একবার বাইরে তাকাল।
বাইরে জমাট-বাঁধা কালো অন্ধকার–বোবা অন্ধকার। রাকেশ বাইরে এসে দাঁড়াল। আকাশে তারারা সারি সারি আলোকঝারির মতো সবুজ সান্ত্বনার আলো ছড়াচ্ছে। হঠাৎ একটা কোটরা ডেকে উঠল কুরাপের দিক থেকে–বাঘ কি চিতা দেখে থাকবে। এমন সময় ওই ঘরের বাথরুমে কী একটা আওয়াজ হল। কেউ বাথরুমে গেছে।
অর্জুন আর শ্রুতি এতক্ষণ কী ফিসফিস করছে, জানতে ইচ্ছে করে রাকেশের। রুমনি বুকভরা সুখের স্বাদ নিয়ে কিন্তু সুখী না হয়েই বিনা নোটিশে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। রাকেশ সুখের সন্ধানে অনুক্ষণ ফিরছে, কিন্তু সুখ কাকে বলে জানেনি। ওর ইচ্ছে করে, কোনো যুবতীর কবুতরি কবোষ্ণ বুকের মতো মুঠিভরে কোনোদিন সুখকে ধরবে–নাড়বে চাড়বে, জলতরঙ্গের মতো বাজাবে। কিন্তু যতবারই সুখকে ধরতে গেছে, সুখের জলে থাবড়ো মেরেছে, আঁজলা বেয়ে জলের মতো সবটুকু সুখ গড়িয়েই গেছে–রয়েছে শুধু যা ভরামুঠি দীর্ঘশ্বাস
রাকেশের বড়ো জানতে ইচ্ছে করে শ্রুতি সুখী হয়েছে কি না। শ্রুতির পক্ষে সুখী হওয়াই স্বাভাবিক। ওর এত বুদ্ধি নিয়ে, ওর এত বিবেচনা নিয়ে, ও যাকে বিয়ে করেছে তাকে নিয়ে ও নিশ্চয়ই সুখী হয়েছে। সবদিক দিয়ে সুখী হয়েছে।
হঠাৎ রাকেশের অসীম সাধ হল ও গিয়ে উঁকি মেরে সুখকে দেখে আসে। সে সুখ কী তা ও জানে না। শ্রুতি আর অর্জুন যে সুখের সৃষ্টি করেছে–যে সুখে ভরপুর আছে ওরা, সেই সুখের সূত্র একবার আবিষ্কার করে আসে। একথা মনে হতেই রাকেশ পা টিপেটিপে ওদিকে ঘরের দিকে এগোতে থাকল বাংলোর পেছন দিয়ে।
ওদের ঘরের হ্যারিকেন বেশ উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছিল। একটি শার্সি ভাঙা ছিল, কিন্তু তাতে শ্রুতি একটি বই দিয়ে আড়াল করে রেখেছিল। সেই ভাঙা শার্সির কাঁচটি তেলচিটে হয়েছিল।
রাকেশ ধীরে ধীরে সেদিকে এগিয়ে গেল। তারাভরা আকাশ এবং গহন বন তার দিকে এক অসীম নিঃশব্দ কৌতূহলে চেয়ে রইল। একটি টিটি পাখি অন্ধকারে উড়ে উড়ে বলতে লাগল–ডিড ইউ ডু ইট? ডিড ইউ ডু ইট? ডিড ইউ ডু ইট?
রাকেশ জানলায় সেই তেলচিটে স্বচ্ছ জায়গায় ডানচোখ ছোঁয়াল।
ঘরে শ্রুতি নেই। অর্জুন ডানহাতে সিগারেট ধরে দুটি হাত খাটের বাইরে টান-টান করে ঝুলিয়ে দিয়ে শুয়ে আছে। বুক অবধি কম্বলটা টানা। অর্জুন একমনে সিগারেট টানছে–শুয়ে শুয়ে ধোঁয়ার রিং ছুড়ছে।
শ্রুতি বাথরুমের দরজা ঠেলে এল। একটি হালকা সবুজ কটসউলের নাইটি পরেছে। বুকে ও কাঁধে ফ্রিল দেওয়া। পায়ের পাতা অবধি ঝুল। ওই লণ্ঠনের কাঁপা-কাঁপা আলোয় চাঁপাফুলের মতো রঙের স্বচ্ছ কটসউলের নাইটির রং মিশে গিয়ে কেমন এক স্বর্গীয় আভা ফুটে বেরোচ্ছে।
শ্রুতি রাকেশের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে ওর হ্যাণ্ডব্যাগ থেকে ক্রিম বের করে মুখে মাখতে লাগল দু-হাত দিয়ে ঘষে ঘষে। ওর সুন্দর মরালী গ্রীবায় সোনালি আলো ছড়িয়ে রইল। সেইমুহূর্তে শ্রুতির গ্রীবায় আলতো করে একটি চুমু খেতে ওর খুব ইচ্ছে করল।
এমন সময় শ্রুতি বলে উঠল, আমি ঘেন্না করি।
রাকেশ চমকে উঠল। তারপরই বুঝল যে, শীতের রাতে তার উপস্থিতি কেউ টের পায়নি।
শ্রুতি বলল, তোমাকে আমি ঘেন্না করি।
অর্জুন ওইভাবেই শুয়ে শুয়ে বলল, কেন?
অনেক কারণে।
কী কারণ?
বলে লাভ?
অর্জুন বলল, সেকথা সত্যি। কারণ তা জেনেও আমার লাভ নেই। তা ছাড়া তুমি আমাকে কতটুকু ঘেন্না করো, আমি আমাকে তার চেয়ে অনেক বেশি ঘেন্না করি।
মানে?
মানুষ নিজেকে যত তীব্রভাবে ঘৃণা করতে পারে, অন্য কি কেউ তা পারে?
তা আমি জানি না। কিন্তু তুমি আমাকে কোনো বিষয়েই সুখী করতে পারোনি।
সব বিষয়ে যে সুখী করতে হয়েই এমন কোনো ওয়ারান্টি বণ্ডে সই করে তো আমি তোমায় বিয়ে করিনি। কথা ছিল দুজনে চেষ্টা করব দুজনকে সুখী করার।
শ্রুতি বলল, সে চেষ্টা কি তুমি করেছ?
অর্জুন সিগারেটটা খাটের পাশের অ্যাশ-ট্রেতে খুঁজতে খুঁজতে বলল, সার্টেনলি। তোমার কি তাতে কোনো সন্দেহ আছে?
সন্দেহ আছে কি নেই সেটা অবান্তর–তবে চেষ্টা করলেও পারতে কি না অজানা আছে আমার। কীসে লোকে সুখী হয়, সে সম্বন্ধে তোমার কোনো ধারণাই নেই।
কীসে সুখী হয়?
তোমাকে বলার আমার কী দরকার? প্রয়োজন মনে করলে নিজেই এতদিনে জেনে নিতে।
অর্জুন এবার চিবিয়ে চিবিয়ে কেটে কেটে বলল, তোমাদের মন-ফন ইমোশনাল সেন্টিমেন্টাল ব্যাপার বুঝি না, তবে এটুকু বলতে পারি এর চেয়ে বেশি সুখী তোমাকে কেউ করতে পারত না। শারীরিক ব্যাপারে তো বটেই।
শ্রুতি বলল, শারীরিক ব্যাপারের তুমি কী বোঝো?
তার মানে? এবার অর্জুনের গলা বেশ উত্তেজিত শোনাল।
তার মানে, কী করে যে কোনো সদবংশজাতা মেয়েকে আদর করতে হয় তা তুমি জানোই না।
আমি জানি না তো কে জানে, তোমার রাকেশদা?
শ্রুতি ক্রিম মাখা থামিয়ে অর্জুনের দিকে ঘুরে দাঁড়াল।
পাশ থেকে নাইটি-পরা শ্রুতিকে সেই স্বল্পালোকিত ঘরে কী এক পবিত্র দেবীপ্রতিমার মতো মনে হতে লাগল। ও বলল, অর্জুন, মুখ সামলে কথা এল–তুমি লিমিট ছাড়িয়ে যাচ্ছ।
হঠাৎ অর্জুন একলাফে কম্বল ছেড়ে, বিছানা ছেড়ে নামল। বলল, না, তোমাকে বলতে হবে কে জানে। তোমার রাকেশদা? তুমি নিশ্চয় আগে তার আদর খেয়েছ?
শ্রুতি আক্রান্ত একটা শজারুর মতো ঝমঝম করে বেজে উঠল, বলল, হ্যাঁ, খেয়েছি। তাতে কী হয়েছে? তুমি কি আমায় বিয়ে করার আগে কাউকে আদর করোনি? তোমাদের ডিফেন্স কলোনির একজন পাঞ্জাবি মেয়েকেও?
রাকেশের ইচ্ছে হল, ও শার্সিতে ঘুসি মেরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে-মিথ্যে কথা অর্জুন, মিথ্যে কথা। শ্রুতিকে আমি কোনোদিন আদর করিনি–কোনোদিন। শ্রুতি যে তার ভাবী স্বামীর জন্যে তার শরীরকে একটি শরৎ সকালের শিউলির মতো নিষ্পাপ, শ্বেতপবিত্রতায় বাঁচিয়ে রেখেছিল–ও তো কোনোদিন কোনো অন্যায় করেনি। কাউকে ওর স্নিগ্ধ শরীরের সুবাস দেয়নি!
অর্জুন শ্রুতির দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে এল–মুখে হিন্দি সিনেমার ভিলেইন-এর ভাব ফুটিয়ে রাকেশ পরিষ্কার দেখতে পেল, শ্রুতি যা বলছে তার পেছনে সত্য আছে, আর সেই সত্যকে ঢাকবার জন্যে অর্জুন মুখেচোখে নাটকীয় ভয়াবহতা এনে শ্রুতিকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছে–রাকেশ বুঝতে পারল যে, অর্জুন খালি ভয় দেখাচ্ছে–এবং এও বুঝতে পারল যে, শ্রুতি সত্যিই হেরে গেছে ওর নিজের দম্ভের কাছে। অর্জুন তির কাছে এসে দু-হাতে ওর দু-কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি শ্রুতি, ভবিষ্যতে এরকম কথা তোমার মুখ থেকে যেন আর না শুনি।
শ্রুতি রাজহাঁসের মতো গ্রীবা উঁচিয়ে বলল, তোমাকেও সাবধান করে দিচ্ছি, এসব কথা যেন আর না শুনি।
অর্জুন কিছু না বলে শ্রুতিকে কেবল একটি ঝাঁকুনি দিয়ে ছেড়ে দিয়ে নিজের খাটে উঠে পড়ল। শ্রুতিও হ্যারিকেনের শিখাঁটি সামান্য কমিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে ওর বিছানায় এসে উঠল। তারপর এ পাশে, জানলার পাশে–মুখ ফিরিয়ে শুল।
রাকেশের চোখ থেকে মাত্র একহাত দূরে শ্রুতির সুন্দর নরম মুখটি কাঁধ অবধি ঢাকা গোলাপি কম্বলের ওপর দেখা যেতে লাগল। রাকেশ দেখল, শ্রুতির দু-চোখ বেয়ে জলের ধারা বইছে–সমস্ত গাল জলে ভিজে যাচ্ছে। রাকেশের খুব ইচ্ছে করল যে, সে বইয়ের আড়ালটি সরিয়ে ভাঙা শার্সির মধ্যে দিয়ে তার হাতটি বাড়িয়ে শ্রুতির চোখের জল মুছিয়ে দেয়, ওর অশান্তি শুষে নেয়। যে তাকে কোনোদিন আদর করতে দেয়নি–সেই গরবিনীর গলিত গরবে নিজের চোখ ভেজায়।
নিঃশব্দে রাকেশ সরে এল। ওর মুখটি তেতো-তেতো লাগতে লাগল। চোখ ভিজে উঠল। একটু আগে ও নিজের সুখ, নিজের অসুখ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত ছিল–কিন্তু এই মুহূর্তে শুধু শ্রুতির কথা ভেবে তার দু-চোখের কোণ জলে ভরে এল।
বাথরুমের পেছনের দরজা দিয়ে ওর ঘরে ঢুকতেই শুনল, কুটুর কুটুর করে শব্দ হচ্ছে ঘরে। ঘরে পা দিয়েই রাকেশ দেখল, চৌকিদারের দুঃসাহসী কুকুরটা চিতাবাঘের ভয় অগ্রাহ্য করে এসে পেছনের দু-পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে টেবলের ওপরে রাখা ক্রিমক্র্যাকার বিস্কিট খাচ্ছে কুটুর কুটুর করে।
রাকেশের হঠাৎ রাগ চড়ে গেল মাথায়। রাকেশ মনে মনে বলল, তুইও কি সুখের সন্ধানে ঘরে উঁকি মারতে এসেছিলি? বলেই স্লিপার-পরা অবস্থায়ই একলাথি মারল কুকুরটার পেছনে কুকুরটা কেঁউ কেঁউ করে উঠল–বিস্কিটগুলো ছড়িয়ে পড়ল ঘরময়।
ওঘর থেকে শ্রুতি চেঁচিয়ে শুধোল, রাকেশদা, কী হল?
রাকেশ বলল, ঘরে কুকুর ঢুকেছে।
শ্রুতি আবার বালিশে মাথা রেখে মনে মনে বলল–আমার ঘরেও।
.
০৯.
গাড়িতে যাওয়ার পথ নেই। গাড়ি ছেয়ে প্রায় একমাইল পায়ে-চলা-পথে হাঁটতে হয়। তবু ভালো, বাঘে মোষ মেরেছে। নইলে এ যাত্রা বাঘের সঙ্গে মোলাকাতই হত না। জিপগাড়ি থেকে আলো ফেলে ফেলে রাতে অনেকে শিকার করেন–রাকেশও আগে আগে করেছে কিন্তু তাকে শিকার বলে না। তাতে কোনোরকম মজাই নেই। আইন অমান্য তো করা হয়ই, তা ছাড়া সেরকম শিকার কোনো স্পোর্টসই নয়। আজকাল ভাবলেও খারাপ লাগে রাকেশের।
শ্রুতি বলেছিল সঙ্গে আসবে, কিন্তু ওকে নিবৃত্ত করেছে কোনোক্রমে। তা ছাড়া বাঘে-মারা মোষকে দেখার মতো কিছুই নেই। জিবটা বেরিয়ে থাকবে। ঘাড়ের কাছে দুটি ফুটো, পেছন থেকে খেয়ে যাবে আগে। চাপ চাপ রক্ত জমে যেতে থাকবে চারপাশে। কতগুলি মাছি ভনভন করবে। আর মৃত্যু পরিপূরক এক অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা চারিদিকে ঘিরে থাকবে।
পথে একটি ঝরনা পড়ল। তা এমনি পেরোনো গেল না। জুতো মোজা খুলতে হল। শর্টস পরেছিল বলে ট্রাউজার খোলার ঝামেলা রইল না।
তখন সকাল এগারোটা হবে। সমস্ত বন পাহাড়ে শীতের শান্ত রোদ ঝিলমিল করছিল। মাথার অনেক ওপরে একটি পাহাড়ি বাজ ঘুরে ঘুরে উড়ে উড়ে চতুর্দিক নিরীক্ষণ করছিল। পথের ডানদিকের বাঁশঝাড়ে একটি বনমোরগ কঁ-র-কঁ-র-ক-ক-কঁ করে দূরের হারেমকে কাছে আসতে বলছিল।
একটি টিলায় উঠতে হল, টিলা পেরিয়ে সেগুন আর শালবনে প্রায় দু-ফার্লং গিয়ে আর একটি পাথরময় টিলা পাওয়া গেল। তার নীচে রাস্তাটি ডাইনে বাঁক নিয়েছে।
রাকেশ বলল, এতদূরে বেঁধেছিল কেন মোষ?
কী করব, এটাই যে যাতায়াতের রাস্তা ছিল বাঘের।
কাছাকাছি গাছ আছে? দেখেছ?
হ্যাঁ, বাবু। একটা কুচিলাগাছ আছে, আর একটা অশোকগাছ। যেখানে মাচা বাঁধতে বলবেন সেখানেই বাঁধব।
সামনের সেই টিলার নীচে পৌঁছে ডাইনে মোড় ঘুরতেই দেখা গেল সতেজ হলদে-সবুজ ঘন ঘাসের মধ্যে মোষটিকে টেনে নিয়ে গেছে বাঘটি। ঘাসের মধ্যে পরিষ্কার ড্যাগ মার্ক আছে। নরম মাটিতে বাঘের পায়ের দাগও পাওয়া গেল।
থার্টি-ও-সিক্স রাইফেলটি কাঁধে ঝোলানো ছিল এতক্ষণ। কাঁধ থেকে নামিয়ে তিনটি গুলি লোড করল রাকেশ–তারপর রেডি পজিশনে ড্যাগমার্ক দেখে আগে আগে যেতে লাগল। সুব্বল ও বাঘ্বডুম্বা গ্রামের চারজন লোক দা এবং দড়ি নিয়ে পেছন পেছন আসতে লাগল।
প্রায় হাত পঁচিশেক গিয়েই মড়ি পাওয়া গেল।
বেশ অনেকখানি খেয়ে গেছে বাঘটা–শক্ত হয়ে যাওয়া চার পা টান-টান করে শুয়ে আছে মোটা, একটা বেঁটে ঝাঁকড়া শিশুগাছের ছায়ায়। শকুনের চোখের বাইরে। একদিকের পেটের পাঁজর বেরিয়ে রয়েছে। তখনও টুপ টুপ করে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। রাকেশ চোখ থেকে সানগ্লাসটি খুলে চারিদিকে ভালো করে ঘুরে ঘুরে জমি নিরীক্ষণ করতে লাগল। দেখল, বাঘটি ভোরে উত্তরের ঘাসবন পেরিয়ে, বাঁশের জঙ্গল পেরিয়ে, নালা টপকিয়ে টিলাটির পাশ দিয়ে যে পথে এসেছিল সেই পথেই ডুঙরি পাহাড়ের দিকে চলে গেছে।
খুব ভালো করে দেখল রাকেশ, গাছগুলি এবং মড়িটি কোথাও নিয়ে গিয়ে বেঁধে রাখা যায় কি না, তাও ভেবে দেখল। সুঝলের সঙ্গে ফিসফিস করে পরামর্শ করল।
মুশকিল হচ্ছে যে, দুটি মাচা বানাতে হবে। অথচ এসব জিনিস রাকেশ মোটেই পছন্দ করে না। রাকেশের এই স্বল্প অভিজ্ঞতাতেও এমন বহুবার হয়েছে যে, অন্য লোকে মাচাতে থাকতে বা অন্য লোকের অধৈর্য বা মূখামির জন্যে বাঘ মারা হয়নি। কারণ মাচায় বসা এক সবিশেষ দুঃসাধ্য কাজ। অথচ শ্রুতি নাছোড়বান্দা। সে রাকেশের সঙ্গে বসবেই, বাঘ শিকার দেখবেই এবং অর্জুনও বলেছে যে, শ্রুতি গেলে সেও যাবে। সে কি এখানে ভেরেণ্ডা ভাজতে এসেছে? অথচ একমাচায় তিনজন বসা যাবে না, সেজন্য দুটি মাচা করতে হবে এবং দুটি মাচা করলে অর্জুনকে একমাচায় বসানো যাবে না। কারণ বাঘের উপস্থিতিতে কার কখন কী অবস্থা হয় তা ভগবানও বলতে পারেন না। অতএব অর্জুনের সঙ্গে সুব্বলকে বন্দুক দিয়ে বসাতে হবে। এ যে যাত্রা পার্টি হয়ে গেল। ভাবল রাকেশ। কিন্তু উপায় নেই। শ্রুতি এমন কথাও বলেছে যে, মাচায় নাই যদি বসতে দেবেন তো নিয়ে এলেন কেন এত কষ্ট করে এত দুরের জঙ্গলে।
অশোকগাছটি যে জায়গায় আছে সেখান থেকে ঘাসবন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বাঘ খুব সম্ভব আসবে কুচিলাগাছের নীচের পথ বেয়ে।
রাকেশ ঠিক করল, মোষটিকে অন্য কোথাও সরাবে না। যদিও অন্ধকার রাত, তবু বাঘ এলে ঘাসে তার আসার শব্দ পাবেইঘাসগুলি বেশ বড়ড়া বড়ো হয়েছে–বাঘ যেদিক দিয়েই আসুক মড়িতে ঘাস পেরিয়ে নিঃশব্দে সে আসতে পারবে না। ও আর শ্রুতি কুচিলা গাছে বসবে, অর্জুন আর সুব্বল বসবে অশোকগাছটায়।
কতখানি উঁচুতে মাচা হবে তা দেখিয়ে দিয়ে রাকেশ সুব্বলকে বলল, দূর থেকে কাঠ ও পাতা কেটে আনতে, যাতে এখানে শব্দ না হয়। বাঘ হয়তো যেখান থেকে এসেছিল সেই পাহাড়েই গেছে, কিন্তু কিছু বলা যায় না, কাছাকাছি কোথাও শুয়ে থাকতেও পারে।
ওরা চলে গেল। রাকেশ অশোকগাছটির নীচে একটি শুকনো ভাঙা ডালের ওপর বসে পাইপটা ভরতে লাগল। কতগুলো ছাতারে পাখি পেছন থেকে ছ্যা-ছ্যা-ছ্যা–ছ্যাছ্যাছ্যাছা করে শুকনো পাতার ঝোপেঝাড়ে নড়েচড়ে বসতে লাগল।
এরকম একেবারে একা থাকলেই ওর মনে সেইসব ভাবনাগুলি ভিড় করে আসে। তার অভিমান, তার কান্না, তার জ্বালা–সব ভিড় করে আসে। তারা একদল অবাধ্য ল্যাটা মাছের পোনার মতো, পুকুরঘাটে ডুবিয়ে রাখা এঁটো বাসনের মতো রাকেশকে ঠুকরে মারে। ও তখন হাসতে হাসতে হেরে যেতে থাকে।
একা থাকলেই রাকেশের মনে পড়ে যায় যে, বরাবর রাকেশের ভালোবাসাকে–তার অশেষ নিরুপায় ভালোবাসাকে কোনো এক বিশেষ ধান্দা বলেই জেনে এসেছে শ্রুতি। একথা মনে হলেই মনটা ব্যথায় ভরে ওঠে রাকেশের। যে আগুনে রাকেশ জ্বলত, সে আগুনের জ্বালাকে সস্তা নামেই ডেকেছে শ্রুতি। রাকেশ শ্রুতিকে বোঝাতে পারেনি যে, আগুন মাত্রই ভয়াবহ নয়। ভালোবাসার চমৎকার চকমকিতেও আগুন জ্বলে, আবার শুধু দেহসর্বস্ব মাংস-রসিকের দীন দেশলাই দিয়েও আগুন জ্বালানো যায়।
অবশ্য আজ শ্রুতির দাহ্য শরীরও আগুনের আহুতি হয়েছে। দগ্ধ হয়ে গেছে। অর্জুনের জ্বালা সে নির্বাপিত করছে। ভাবলেও অবাক লাগে যে, একদিন যে শ্রুতি চুমু খেতে চাইলেই চমকে চমকে উঠত–আমার ওসব ভালো লাগে না, ভালো লাগে না বলত, সেই শ্রুতিই শিগগিরি একদিন ব্যবহৃত, ব্যবহৃত ব্যবহৃত হয়ে শুয়োরের মাংস হয়ে যাবে।
জীবনের সব ধনই ফেলা যায়। সমস্ত সযত্নরক্ষিত পরম ধনই বোধ হয় একদিন ধুলায় অবহেলিত হয়।
রাকেশ পাইপটাকে নতুন করে ভরতে লাগল কিংবা নিজের মনের পোড়া গন্ধ শূন্যতাকে। ও জানে না।
সুব্বল তার দলবল নিয়ে হলুদ গাছের ডাল কেটে ঝুপরি ঝুপরি কচি কুচিলা ও অশোকের ঝাড় কেটে ফিরে এল। তারপর কুচিলা গাছটিতে আগে মাচা বাঁধতে আরম্ভ করল। মাথার ওপর পাতার ছাউনি দিতে হবে, নইলে হিমে বসা যাবে না। মাচাটিও শক্ত হওয়া চাই। সারারাত বসতে হবে হয়তো, শ্রুতি এতক্ষণ সোজা হয়ে নাও বসে থাকতে পারে।
ওরা গাছের ওপরে দড়ি আর হলুদ-এর ডাল নিয়ে উঠে গেল। প্রথমে মাচা বেঁধে তারপর মাথার ছাউনি ও পাশের আড়াল তৈরি করল কুচিলার পাতা দিয়ে–কুচিলা গাছে আড়াল কুচিলা পাতারই হওয়া চাই। নইলে বাঘ সন্দেহ করবে। সামনেটাও ঢেকে দিল, কেবল সামনে এবং ডানপাশে বেশ বড়ো বড়ো দুটি ফাঁক রাখল, যা দিয়ে রাইফেল গলিয়ে রাকেশ গুলি করতে পারে।
মাচা বাঁধা হয়ে গেলে ওরা নেমে এসে অশোকগাছে গিয়ে উঠল মাচা বাঁধতে–তখন রাকেশ কাটা গাছের ডালের তৈরি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল। মাচাটি পর্যবেক্ষণ করার জন্য।
না, বেশ বড়ো ও প্রশস্ত হয়েছে। ইচ্ছে করলে শুয়ে থাকাও যায়। রাইফেলটি ঘুরিয়ে দেখে নিল, ভালো করে ঘোরানো যাচ্ছে কি না। না, এমনিতে সব ঠিক আছে। এখন শ্রুতি যদি মাচায় বেশি আওয়াজ-টাওয়াজ না করে এবং বাঘ যদি ফেরে–তা হলেই হয়।
মাচায় বসে নালাটির একটি অংশ দেখা যাচ্ছে। টিলাটিও দেখা যাচ্ছে। নালা বেয়ে জল যাবার ঝিরঝিরানি শব্দও কানে আসছে। এইটেই রাতে অসুবিধের কারণ হবে, কেননা রাতের নিস্তব্ধতায় এই শব্দই বহুগুণ জোরে শোনা যাবে এবং সেই শব্দে নিঃশব্দপদসঞ্চারী বাঘের আওয়াজ ঘাসের মধ্যে শোনা না গেলেই মুশকিল।
সুব্বলদের মাচা বাঁধা হয়ে গেলে ওরা নেমে এল। রাকেশও নেমে এল। তারপর ওরা একত্র হয়ে সিংগল ফরমেশানে জঙ্গলের আলোছায়ায় ভোরাকাটা প্রভাতি পথে বাঘমুন্ডার দিকে ফিরে যেতে লাগল।
এখন মনে হচ্ছে এ যাত্রা বাঘটি মোষ না মারলেই ছিল ভালো। কেন জানে না, ভারি ক্লান্তি লাগছে রাকেশের। সব মিলিয়ে এ-ই বনে আসার দোষ। বেশিদিন এখানে এসে একসঙ্গে থাকলেই সভ্যতার সংস্কারের আবরণে মরচে পড়ে যায়। তখন নিজেকে ভয় করতে থাকে। তার চেয়ে দিল্লির রোজকার একঘেয়ে জীবনও ভালো মনে হয়। এই ডাইনি বনের জাদু ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয়ে পড়ে মনে মনে–সমস্ত ক্ষুরধার বুদ্ধি যুক্তি কেমন ভোঁতা হয়ে যায়–কেমন এক সর্বৈব মানসিক স্থূলতা এসে সত্তা অধিকার করে বসে। রাকেশ এই প্রকৃতি যেমন ভালোবাসে, তেমন একে ভয়ও পায়। এই ভয়টা সব সময় হয় না, মাঝে মাঝে, কখনো-কখনো–হঠাৎ একসময় এই ভয়টা সমস্ত মন ব্যাপ্ত করে ফেলে। সংস্কার যত হালকা হতে থাকে, এই ভয়টা পাতায়, ফুলে, প্রজাপতির ডানায় ততই ফরফর করে কাঁপতে থাকে।
হাঁটতে হাঁটতে সুব্বল শুধোল, বাবু, কোন রাইফেল নিয়ে বসবে রাতে? থার্টি-ও-সিক্স?
আর কী করব বল? বড়ো রাইফেলটির তত দু-ব্যারেলের মধ্যে ডান ব্যারেলে ফায়ার হচ্ছে না! ওরকম ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। বাইসন মারতে গিয়ে কী অবস্থা হল দেখলে না?
সুব্বল মাথা নাড়িয়ে বলল, সেকথাটা ঠিক।
তারপর রাকেশ প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলল, থার্টি-ও-সিক্স আমার হাতের রাইফেল। তা ছাড়া ক্ল্যাম্প ফিট করা আছে। বাঘ যদি চেহারা দেখায় একবার তাহলে মারতে অসুবিধে হবে বলে মনে হয় না। অবশ্য গুলি যদি ঠিক জায়গায় লাগাতে পারি।
সুব্বল সায় দিয়ে বলল, আজ্ঞে সেটাই আসল কথা। গুলি ঠিক জায়গায় লাগলে বাঘ মরবে না, এ একটা কথা?
হাঁটতে হাঁটতে রাকেশ বাঘটির কথা ভাবছিল। মদ্দা বাঘ-পায়ের দাগ দেখে মনে হয় বেশ বড়ো সাইজের। সাড়ে নয় থেকে দশ ফিটের মধ্যে হবে। দেখা যাক কী হয়।
বাংলোর কাছাকাছি এসে গেল ওরা। এদিকে বারোটা প্রায় বাজে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে শ্রুতি আর অর্জুন বারান্দার রোদে বসে আছে। ঘন হয়ে বসে আছে। ওরা কী যেন বলাবলি করছে। শ্রুতি মাঝে মাঝে হেসে ঢলে পড়ছে।
অবাক লাগল রাকেশের-তবে কি কাল রাতে সে সত্যিই সুখকে আবিষ্কার করেছিল? তাহলে সুখের কি কোনো নিজস্ব চেহারা নেই? সুখ কি জলের মতো? যে পাত্রে রাখা যায় সেই পাত্রের রূপ নেয়?
অর্জুন আর শ্রুতিকে এইমুহূর্তে দেখে কে বলবে যে, কাল ওরা দুজনে দুজনের প্রতি এক দুর্মর ঘৃণায় বেঁকে গিয়ে শীতের রাতে কেঁচোর মতো শুয়েছিল? এখন ওরা হাসছে, গল্প করছে, খুনসুটি করছে–সরষেখেতের দুটি হলদে-হাসিনী প্রজাপতির মতো ভালোবাসায় কাঁপছে।
এই ভালো, ভাবল রাকেশ, এই ভালো। ওরা সুখী হোক, সুখী থাকুক, ওরা দুজনে চিরদিন সুখে থাকুক। রাকেশের বোঝা রাকেশ একরকম করে বইতে পারবেই–যেমন করে বয়ে এসেছে। শ্রুতি সুখী হোক। অর্জুন সুখী হোক।
আহা, অর্জুন ছেলেমানুষ! পুরুষের শরীরও শরীর, মেয়েরা তা কখনো বোঝে না। ভালো সেতারি হলেই কি কেউ রোজই ভালো বাজাতে পারে? কোনো কোনো দিন সেতারের দোষেও তো বাজনা খারাপ হতে পারে। সেতাররা কোনোদিন তা স্বীকার করে না। বাজনা ভালো না হলেই–আঙুল দেখায় সেতারিকে। বলে, তুমি, তুমি, তুমি; তুমি জানোই না কী করে আলাপ করতে হয়, কী করে আদর করতে হয়।
শ্রুতিটা একটা পাগলি। রুমনি যেমন ছিল।
এই রোদভরা পাখির ডাকভরা আশাভরা সুগন্ধি সকালটিকে বড়ো ভালো লাগতে লাগল রাকেশের। তাহলে এখনও সুখ আছে পৃথিবীতে–এখনও সুখী লোক আছে–ধরতে পারুক আর নাই পারুক, এই জানাটাই মস্ত জানা যে, ইচ্ছে করলে সুখকে মুঠিভরে ধরা যায়।
ভীষণ ভালো লাগতে লাগল রাকেশের। সেই পবিত্র স্বাধিকারে সবুজ জঙ্গল কোনো রঙিন ফুলে-ছাওয়া গাছের নীচে নতজানু হয়ে বসে, উদ্দীপ্ত আদিগন্ত সূর্যদেবের কাছে আয়ুভিক্ষা করতে ইচ্ছে করল রাকেশের। জোড় করে বলতে ইচ্ছে করল, আমাকে অনেক দিন বাঁচিয়ে রাখো–অনেক দিন বাঁচিয়ে রাখো, হে সূর্য, হে সুপুরুষতম সুপুরুষ, হে আনন্দের আনন্দ। আমাকে আরও অনেক দিন, অনেক দিন তোমার আলোয় ভরা পৃথিবীতে, তোমার পাখিডাকা বনে বনে একটি মুগ্ধ ভক্ত অনাবিল মন নিয়ে সুন্দরের খোঁজে খোঁজে ফেরাও। আমাকে রোজ সকালে, আজ সকালের শ্রুতি আর অর্জুনের সুখী ছবির মতো কোনো সুন্দর সুখের দৃশ্যের সম্মুখীন করো। আমাকে বাঁচিয়ে রাখো-বহুদিন, নিশিদিন, অনুক্ষণ-অনুক্ষণ।
পৃথিবী যতদিন বাঁচবে, গাছে গাছে যতদিন ফুল ফুটবে, নির্জন ঘাসে যতদিন কাঁচপোকা গুনগুনিয়ে ফিরবে, আমাকে ততদিন বাঁচিয়ে রাখো হে সূর্য–আমাকে ততদিন প্রাণদান করো। বিহ্বল হয়ে বলল রাকেশ।
ওরা বাংলোর হাতায় ঢুকে পড়ল।
শ্রুতি বলল, রাকেশদা, আপনার নলাপোড়ার সব আয়োজন সম্পূর্ণ। এখন বাঁধলেই হয়।
রাকেশ রাইফেলটা রেখে এসে ভালো করে দেখল বাঁশটিকে। একটি মোটা কচি বাঁশের টুকরো টেবিলে রাখা হয়েছে। দুটি গাঁট-ই অক্ষত আছে। বাঁশটির সবুজ গা থেকে একটি মিষ্টি মিষ্টি সোঁদা সোঁদা গন্ধ বেরোচ্ছে। রাকেশ দু-হাতে বাঁশটি তুলে নিয়ে বলল, মাংস কোথায়?
শ্রুতি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলুন বাবুর্চিখানয় আছে, রাজুয়াড়কে বলেছি ধুয়ে রাখতে।
বাঁশটি বগলে নিয়ে রাকেশ বাবুর্চিখানার দিকে চলল শ্রুতির সঙ্গে। কাল বিকেলে সুব্বল একটি কোটরা মেরেছিল। রাকেশ বলেছিল ওদের যে, বাঁশপোড়া করে খাওয়াবে।
রাজুয়াড় মাংস ছোটো ছোটো টুকরো করে কেটে রেখেছিল। একটি সসপ্যানে হলুদ এবং পেঁয়াজ ও আদা বাটা মাখিয়ে ভালো করে মাংসগুলি মাখল রাকেশ। তারপর বাঁশের টুকরোটির একপাশের বন্ধ মুখ ছুরি দিয়ে ফুটো করল। দেড়ইঞ্চি মতো ফুটো করে সেই ফুটো দিয়ে মেখে রাখা মাংসের টুকরোগুলি সব ঢুকিয়ে দিতে লাগল।
শ্রুতি উৎসুক চোখে দেখছিল, বলল, এ মা, নুন দিতে ভুলে গেলেন?
রাকেশ বলল, নুন দিতে হয় না। নুন দিলে হয়তো বাঁশের ভেতরে যে জলীয় পদার্থ থাকে তার সঙ্গে মিশে কোনো রাসায়নিক প্রক্রিয়া ঘটে, যার ফলে মাংস খেতে বিস্বাদ হয়ে যায়। কক্ষনো নুন দিতে নেই।
তারপর বাঁশের টুকরোটি মাংসে ভরতি হয়ে গেলে, কাদা দিয়ে খোলা মুখটি ভালো করে বন্ধ করে দিল রাকেশ এবং বাঁশটির গায়ে ভালো করে কাদার প্রলেপ দিল। তারপর সুব্বলকে বলল, আগুন জ্বালো সুব্বল। সুব্বল কাঠের আগুন করল বাবুর্চিখানার বাইরের সিঁড়ির সামনে এবং আগুন বেশ গনগনে হয়ে উঠলে সেই বাঁশটি আগুনের মধ্যে গুঁজে দিল সুব্বল।
শ্রুতি বলল, ব্যস, হয়ে গেল?
প্রায়। এখন যেই দড়াম আওয়াজ করে বাঁশটি আগুনে ফেটে যাবে, তক্ষুনি আগুন থেকে বের করে আনতে হবে। বাঁশটি ফাটিয়ে মাংসের টুকরোগুলি বের করে ফেলতে হবে, তারপর প্লেটে প্লেটে দিয়ে সঙ্গে নুন দিয়ে সার্ভ করবে। একেবারে ডিল্লিসস।
শ্রুতি এতক্ষণ উজ্জ্বল চোখে রাকেশের দিকে চেয়েছিল। প্রশংসাসূচক গলায় বলল, বাঃ, বাঃ, আপনি দেখি মোতিমহলে চাকরি পেতে পারেন বাবুর্চি হিসেবে।
রাকেশ বলল, অ্যাপ্লাই করলে হয়তো পেতেও পারি।
শ্রুতিকে সেই সকালে ভীষণ ভীষণ ভীষণ সুন্দরী দেখাচ্ছিল। একটি ছাইরঙা ভয়েল পরেছিল। কোথা থেকে ছাইরঙা একগুচ্ছ জংলি ফুলও জোগাড় করেছিল খোঁপায় পরার।
এরকম কোনো মেয়ে পাশে থাকলে, মনের কাছে থাকলে, যেকোনো সাধারণ পুরুষ অসাধারণ কাজ করে ফেলতে পারে। পরীক্ষায় বৃত্তি পেতে পারে অথবা পাইলট হয়ে শত্রুপক্ষের বিমানঘাঁটি চমকপ্রদভাবে বম্ব করে আসতে পারে। এবং আরও অনেক কিছু করতে পারে। সব মিলিয়ে সকালটি রাকেশের ভীষণ ভালো লাগছিল। হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে রাকেশ শ্রুতিকে শুধোল, কাল রাতে ভালো ঘুম হয়েছিল?
হুঁ। আপনার?
আমার খুব শীত করছিল।
তাই বুঝি কুকুরকে পাশে নিয়ে শুয়েছিলেন?
রাকেশ হাসল, বলল, যা বলেছ। সেই রকমই অবস্থা। কুকুরটা বাথরুমের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়েছিল।
সে কী? ঘরের দরজাও খোলা ছিল নাকি?
ছিল। আমার মনের মতো আমার ঘরের দরজাও সব সময় খোলাই থাকে।
দরজা খোলা থাকা ভালো, কিন্তু তা দিয়ে কুকুর না ঢাকাই ভালো।
রাকেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, আসলে একটু বেরিয়েছিলাম বাইরে।
শিকারে?
না, এমনি।
সে কী! এই না বললেন খুব শীত করছিল, তাহলে বাইরে বেরোলেন কেন?
এমনিই–ভাবলাম, ঘরেই এত শীত তো বাইরে কত শীত দেখি।
কী দেখলেন?
দেখলাম, শীত ঘরেও নেই বাইরেও নেই, শীত আমার মনে।
শ্রুতি বলল, এখনও আছে?
না, এখন নেই। এখন তো রোদ উঠে গেছে। আমার সুখের রোদ। তুমি।
আর রুমনিদি?
সেও আমার সুখ। সুখ ছিল। এখন তার স্মৃতি আছে।
শ্রুতি হাসল, বলল, আপনার তো সুখের শেষ নেই।
রাকেশও ওর দিকে চেয়ে সকালের সোনা-রোদে হাসল, বলল, কথাটা বোধ হয় ঠিকভাবে বলতে পারলে না। এল আমি সুখের ভিখারি।
শ্রুতি একটু দাঁড়াল, বলল, ইশ ভিখারি, আমার ভিখারি!
.
১০.
দুটি ছাতার কানের কাছে ছ্যা: ছ্যা: করছিল।
বাঘটা একবার চোখ খুলে ওদের ধৃষ্টতা দেখে অবাক হয়ে গেল। ও একবার আড়মোড়া ভাঙল। তাতেই কাজ হল। পড়ি কি মরি করে পাখিগুলো ধুলো উড়িয়ে পিটীস জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল। বাঘটার ঘুম ভেঙে গেছিল।
বাঘটা একবার পাতার ঝুপরি দিয়ে বাইরে তাকাল। এখন দুপুর। কাল রাতে খাওয়াটা বেশি হয়ে গেছে। মোযটা খুবই নধর এবং কচি ছিল। আগে দুধের বাঁট দুটো খেয়েছে, তারপর পেছনের একটা থাই এবং অন্যান্য নরম জায়গা। আজ রাতে খেতে খেতে যদি ভোর হয়ে যায় তো যাক, আজ মোষটাকে শেষ করে ফেলবে খেয়ে। তারপর ঝরনার পাশে গিয়ে পেটভরে জল খেয়ে আবার এই ছায়ায় এসে টান-টান হয়ে শুয়ে থাকবে। পরশুর আগে আর গুহায় ফিরবে না।
মোষটা ওখানেই বাঁধা থাকত এ ক-দিন। অন্য একটা মোষকেও দেখেছে কুরাপের রাস্তায়। কী ব্যাপার কে জানে? পথ ভুলে গেছিল নাকি? হবে হয়তো। অত দিয়ে বাঘটার কী দরকার? খিদের সময় খাবার হাতের কাছে কোথায় আর পাওয়া যায়? তা ছাড়া এমন আয়েশ করে খাওয়া।
দিনকয়েক আগে একটা শিঙ্গল শম্বর ধরতে তাকে দু-মাইল পাহাড়ে জঙ্গলে অনুসরণ করতে হয়েছিল। নোনা মাটিতে যখন নুন চাটতে নামল শম্বরটা, তখন ধরবে বলে গুঁড়ি মেরে জায়গামতো পৌঁছোল বাঘটা, ঠিক তখনি একটা কোটরা কী করে বাঘটার গন্ধ পেল– হাওয়ায়। কোটরাটা নিশ্চয়ই বাঘটার পেছনের জঙ্গলে কোথাও ছিল। কোটরাটা ডেকে উঠল দু-বার–ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে ঘাক ঘাক আওয়াজ করে অতবড়ো শিঙ্গল শম্বর লতাপাতা ঠেলে একদৌড়ে পাথরে খুর খটখটিয়ে একেবারে পাহাড়ের মাথায়। তখন তাকে ধরে কে? শিকার ধরা চাট্টিখানি কথা? বাঘটাই জানে কী প্রাণান্তকর পরিশ্রম করে তাকে বেঁচে থাকতে হয়।
রোদটা লতাপাতার ফাঁক দিয়ে এসে গায়ে পড়েছে। ভারি আরাম লাগছে বাঘটার। আকাশের দিকে বাঘটা একবার চোক তুলে চাইল। বাঘিনির চোখের মতো নীলাভ আকাশ। বাঘটা একটা ঢেকুর তুলল, তারপর পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
.
মাথায় ঘসে ঘষে সরষের তেল মাখছিল সুব্বল। দু-তিনটি পাকা চুল পটপটিয়ে টেনে তুলল–অনেক চুল পেকে গেছে সুব্বলের। বয়েস তো কম হল না–পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে –যখন ছোটো ছিল তখন কুড়ি বছর বয়েসের লোকেদেরই কেমন বুড়ো বুড়ো মনে হত– ভাবলে হাসি পায়–আর এখন ওর নিজেরই পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। তবুও তো বেশ ছোকরা আছে ওর বউয়ের তুলনায়। বউটা কেমন দিদিমার মতো বুড়িয়ে গেছে। আগে কেমন জল পাওয়া লাউডগার মতো সতেজ ছিল, কালো রঙের কেমন এক পিছলে-পড়া জেল্লা ছিল– এখন কেমন শুকনো ধুন্দুলের মতো হয়ে গেছে। ওই বড়োজোর মাঝে মাঝে গা-ঘষা যায়। ভালো লাগে না সুব্বলের এত তাড়াতাড়ি সবকিছু ফুরিয়ে যাবে সুব্বল ভাবতে পারেনি।
কুয়োতলায় দাঁড়িয়ে গেরুয়া গামছা পরে ঝুপ ঝুপ করে গায়ে জল ঢালতে ঢালতে সুব্বল বাঘটার কথা ভাবতে লাগল। মনে হয় আজ বাঘটা ফিরবে মড়িতে। এবং ফিরলে চোট হবে। রাকেশবাবুর হাতে রাইফেল থাকতে বাঘ পালাবে এ হবে না।
রাকেশবাবুর মতো যদি দু-একদিনের জন্যে কেউ আসে, ওর রোজকার একঘেয়ে জীবনে তাও যা একটু আনন্দ হয়। সুন্দর সুন্দর মেমসাহেব দেখা যায়, ভালো মন্দ খাওয়া যায়, চকচকে বিলিতি বন্দুক রাইফেল কাঁধে করে সারাদিন সারারাত ঘুরে বেরিয়ে ওগুলোকে নিজের বলেই মনে করা যায়। ওগুলোর ওপর কেমন মায়া পড়ে যায়। ফিরে যাবার সময় যখন আবার বাক্সবন্দি করে যার জিনিস তাকে ফেরত দিতে হয়, তখনই বুকটা মুচড়ে ওঠে। সুব্বল এর পরের জন্মে বড়লোক হয়ে জন্মাবে, লেখাপড়া শিখবে, ইংরেজিতে অনর্গল কথা বলবে, রাকেশের মতো ভালো ভালো বন্দুক রাইফেল কিনবে এবং তারপর জীবনে আর অসুখী হবার কী থাকতে পারে?
শ্রুতি বারান্দায় বেতের চেয়ারে পা টান-টান করে বসেছিল। বেগুনির ওপর জংলা কাজের একটা বাটিক পরেছে শ্রুতি–বেগুনি জামা। হাতাটা ছোটো–হাতার প্রান্তে মোটা করে প্লেট দিয়ে মুড়ে সেলাই করা। এরকম হাতায় শ্রুতির মতো যাদের সুন্দর ছিপছিপে হাত, তাদের দারুণ স্মার্ট দেখায়। রাকেশ হেলান দিয়ে বসে বসে একটা পুরোনো ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে শ্রুতিকে দেখছিল। অর্জুন একটি চেয়ারে বসে অন্য চেয়ারে পা রেখে গ্লাস থেকে বিয়ার সিপ করছিল। পাশের টুলে বিয়ারের বোতল দুটি ছিল। ও-ই প্রথমে কথা বলল। বলল, কে কোন মাচায় বসবে?
রাকেশ বলল, তুমি আর শ্রুতি একসঙ্গে বসবে, অন্যটাতে আমি আর সুব্বল।
শ্রুতি বলল, না রাকেশদা, তা হবে না। আমি শিকার দেখব-আমি আপনার সঙ্গে বসব।
রাকেশ বলল, শিকার তুমি হয়তো অন্য মাচাতে বসেও দেখতে পাবে।
না। দেখতে পাই আর নাই পাই, আমি আপনার সঙ্গে বসব। অর্জুনের সঙ্গেও কারও বসা দরকার। সুব্বল বসতে পারে। মানে সঙ্গে একজন শিকারি থাকা দরকার।
অর্জুন বলল, আমি সুব্বলের সঙ্গেই বসব–তোমার সঙ্গে আমি এমনিতে বসতাম না।
কেন?
কেন কী? তুমি থাকলে তো তোমাকেই সামলাতে হবে, বাঘ দেখব কখন?
ইশ, কী আমার শিকারি রে! নিজেকে কে সামলায় তার ঠিক নেই।
অর্জুন কেমন এক রহস্যময় হাসি হাসল। বলল, শিকারি শিকারি-বড়ো শিকারি! কী জানো তুমি? শিকার না করলে কি শিকারি হওয়া যায় না? তা ছাড়া রাইফেলের মেকানিজমের ওপরে আমার কতকগুলো প্রবন্ধ আমেরিকা ও জাপানের কাগজে বেরিয়েছে, তুমি জানো না বুঝি?
আহা, ও সবই তো জানি। কিন্তু ও তো বন্দুকের কারিগরি। আমি সত্যিকারের শিকারির কথা বলছি।
অর্জুন বলল, অল রাইট, আমি তো তোমার সঙ্গে বসছি না, আর কী চাও?
শ্রুতি রাকেশকে বলল, দেখেছেন রাকেশদা? কেমন একটুতে রেগে যায়? তারপর অর্জুনের দিকে ফিরে বলল, রসিকতা বোঝো না একটুও–সেন্স অফ হিউমার নেই তোমার একফোঁটা।
অর্জুন চকিতে একবার মুখ ঘুরিয়ে শ্রুতির দিকে তাকাল, তারপর একটু বাঁকা হাসি হেসে বলল, সেন্স অফ হিউমার না থাকলে বাঘ্বডুম্বায় বিশ্বাস করি। তারপর ওরা তিনজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
রাকেশ বলল, খাওয়ার কি অনেক দেরি?
শ্রুতি বলল, না, রান্না সব হয়ে গেছে–কেবল ভাতটা নামায়নি, তারপর টেবল সাজাতে যতটুকু সময় লাগে। কেন, আমাদের কি দেরি হয়ে যাবে?
অর্জুন বলল, দেরি হোক না হোক, খাওয়ার পর আজকে সকলেরই একটু বিশ্রাম নেওয়া দরকার।
আমাদের দরকার নেই। রাকেশদা নেবেন। রাকেশদার অনেক পরিশ্রম হয়েছে সকালে রোদে। শ্রুতি বলল।
রাকেশ ম্যাগাজিনটা টেবিলে রাখল। বলল, আমার বিশ্রামের কোনো দরকার নেই।
আবার ওরা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল।
দ্বিতীয় বিয়ারের বোতলটা খুলল অর্জুন–চাবির রিং-এর সঙ্গে বটল-ওপনার ছিল। তারপর গ্লাসে ঢালতে ঢালতে বলল, সেদিন আমি একটি নেকড়ে দেখেছিলাম।
কোন দিন?
যেদিন বিকেলে আমরা হাঁটতে গেছিলাম।
শ্রুতি বলল, তুমি নেকড়ে চেনো? নেকড়ে না ছাই! শিয়াল দেখে থাকবে।
না, আমি নেকড়েই দেখেছি।
শ্রুতি বলল, অনেক সময় নিজের ছায়াকে ওইরকম মনে হয়।
বিশেষ করে আমার ছায়াকে তো নিশ্চয়ই, কী বল?
শুধু তোমার কেন, পুরুষমানুষ মাত্রই নেকড়ে বাঘ।
অর্জুন বলল, হয়তো সব পুরুষ নয়।
শ্রুতি বলল, বলছ বড়ো বাঘও আছে? মানে, বড়ো মনের বাঘ!
আছে। অর্জুন বলল।
আবার বাঘ-ডাঁশাও আছে, যাকে ভাম অথবা খাটাশ বলে। গাছে উঠে পাখির নরম তুলতুলে ছানা খায়–রান্নাঘরে ঢুকে ক্ষীরের হাঁড়িতে মুখ ঢোকায়।
শ্রুতি বলল, তাও আছে–কিন্তু তা দেখে ভয় পাওয়ার কী আছে?
না। অর্জুন বলল, বাঘ-ডাঁশাকে তো ভয় পাইনি, পেয়েছিলাম নেকড়েকে, ভাবলাম সঙ্গে অস্ত্রস্ত্র নেই–যদি তাড়া করে?
শ্রুতি বলল, আচ্ছা নিজেকে তুমি কখনো নিজে তাড়া করেছ?
সব সময়ই তো করছি।
কই, শব্দ শুনতে পাই না তো!
শব্দ পাবে না। স্বপ্নে তাড়া করি। রোজ।
রাকেশ বলল, তোমরা থামবে? কী যে সব সাংকেতিক ভাষায় কথা বলছ–দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আমার।
হবে। আপনার কেন, অন্য সকলেরই হত। আমাদের না হয় এরকমভাবে কথা বলা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে–কী বলো অর্জুন?
অর্জুন বলল, প্রায়।
রাকেশের এত কথা এবং তদুপরি এত ঘোরালো কথাবার্তা ভালো লাগছিল না। ও এখন কনসেনট্রেট করবার চেষ্টা করছিল। বাঘটার বুক, ঘাড় এবং মাথা ছাড়া শরীরের অন্যান্য অংশের কথা একেবারে ভুলে যেতে চাইছিল। রাকেশের গুলি যেন বাঘটার বুক কিংবা ঘাড় ছাড়া অন্য কোথাও না লাগে। মাচা থেকে অ্যাংগুলার শট হবে–অ্যাংগুলার শট রাকেশের পছন্দ নয়–কিন্তু উপায় নেই। রাকেশ মাথায় মারতে চায় না। মাচা থেকে মাথায় মারা কঠিন, তা ছাড়া মাথায় লাইট রাইফেল দিয়ে ও গুলি করার ঝুঁকি নিতে চায় না।
রাকেশ জীবনে একবারই পেটে-গুলি-খাওয়া বাঘের সম্মুখীন হয়েছিল। সেই স্মৃতি খুব মধুর নয়। ডনাল্ড বেকার এবং রুসি আরদেশার সেই শুটে ছিল। আগের দিন মাচা থেকে ডনাল্ড বাঘকে গুলি করে–তিস্তার চরে। বাঘ গুলি খেয়ে চলে যায়। পরদিন আটটি হাতি দিয়ে চরে ওরা বিটিং করেছিল। চমৎকার সকাল-মে মাসের নীল আকাশ। দূর থেকে তিস্তার গর্জন ভেসে আসছে, ফুরফুর করে অ্যালিফ্যান্ট গ্রাসের মাথা দুলিয়ে হাওয়া বইছে– ওরা বিট শুরু করল। রুসির হাতে হল্যাণ্ড অ্যাণ্ড হল্যাণ্ডের থ্রি-সেভেনটিফাইভ ম্যাগনাম। ডাবল-ব্যারেল। ওর হাতিতে হাওদা ছিল না। সামনে মাহুত বসেছিল, পেছনে ও একা। গদির ওপরে দু-দিকে দু-পা দিয়ে বসে, একহাতে গদির দড়ি ধরে আর অন্যহাতে রাইফেল কোলের ওপর ধরে বসেছিল। ওরা একসঙ্গে এগোচ্ছিল।
প্রথম পনেরো মিনিট বাঘের কোনো চিহ্ন দেখা গেল না–এমনকী রাকেশের মনে হয়েছিল–হয়তো ডনাল্ডের গুলি কাল রাতে লাগেনি। কিন্তু ডনাল্ড বলছে যে লেগেছে। এবং ডনাল্ড যেহেতু বলছে সেই হেতু গুলি লাগেনি বলার আগে দুবার ভাবতে হয়েছিল।
এমন সময় বাঁ-দিকের একটা হাতি হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেল। অন্য হাতিগুলোর হাবেভাবে বোঝা গেল বাঘ সামনে আছে। হাতিদের বৃত্ত ধীরে ধীরে ছোটো করে এগোতে লাগল মাহুতরা। সকলে টেনসড় হয়ে রইল।
হঠাৎ বাঁ-দিক থেকে রাণা গুহ গুলি করল–গুলির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে গ্রাণ্ড প্রিক্স রেসে রেসিং কার যেমন করে মোড় নেয়–তেমনি করে কোমর বেঁকিয়ে মোড় নিয়ে প্রচন্ড গর্জন করতে করতে ঘাসের মধ্যে দিয়ে বাঘটা এদিকে আসতে লাগল। রুসি আরদেশার রাইফেল তুলল, গুলি করল, কিন্তু গুলি বাঘের সামনে পড়ে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে বাঘটা এসে হাতির পেট কামড়ে ধরল। রুসি অনেক কিছু করতে পারত–করতও হয়তো, কিন্তু সেদিন সেই সুন্দর সকালে রাকেশদের সকলের চোখের সামনে একটি মর্মন্তুদ দৃশ্য অপেক্ষা করে ছিল– যা ওরা কেউ দেখতে হবে বলে ভাবেনি।
রুসি হঠাৎ কিছুই না করে ওই অবস্থায়ই ভয়ে কান্ডজ্ঞানরহিত হয়ে হাতি থেকে লাফিয়ে পড়ে দিগবিদিক-জ্ঞানশূন্য হয়ে ঘাস ঠেলে দৌড়তে লাগল। ওরা অবাক হয়ে দেখল যে, রাইফেলটাও হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল। বাঘটা তখন হাতির পেট কামড়ে ছিল– হাতিটা সামনের দু-পা ওপরে তুলে সোজা হয়ে আধো-দাঁড়ানো ভাবে দাঁড়িয়ে উঠে বাঘটাকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছিল।
তখনও বাঘটা ওকে দেখে থাকলেও রুসির দিকে নজর দেয়নি।
এমন সময় রুসি ভয়ার্ত গলায় চেঁচিয়ে উঠল, হেল্প মি ইউ সোয়াইনস।
এবং সে চিৎকারের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাঘটা হাতিকে ছেড়ে একলাফে চোখের পলকে ঘাসের মধ্যে ঢুকে অসহায় রুসিকে ধরে ফেলল–ধরে ওর সমস্ত মাথাটা প্রায় মুখে পুরে ফেলল–তারপর আর একলাফে আবার ঘাসের মধ্যে মিলিয়ে গেল। রাকেশরা সকলে স্থাণুর মতো হাতির পিঠে বসে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর সব কটি হাতি দৌড় করিয়ে আবার বাঘকে ওরা খুঁজে বের করল এবং বাঘটি সেদিন পনেরোটি গুলি খেয়েছিল।
প্রতিহিংসার অনর্থক গুলি। অথচ সময়মতো এবং সুযোগমতো একটি গুলি করা গেলে রুসি আরদেশারকে বরাবরের মতো তিস্তার ওই সুন্দর চরে ওরা হারিয়ে আসত না।
কখন যে কী হয় কেউ জানে না। এবং জানে না বলেই যতটুকু আনন্দ এই রাইফেল হাতে ঘুরে বেড়োনোয়। তবু রাকেশ কোনো বাঘের পেটে গুলি করতে চায় না–কেউ ভুল করেও করুক–তাও ও চায় না।
রাজুয়াড় ওঘরে এসে গেছে-টেবিল সাজানোর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে টুং-টাং করে খিদেটাও বেশ চনচনে হয়েছে–এমন সময় সাইকেলে চেপে খাকি পোশাক পরে ফরেস্টারবাবু এসে হাজির।
রাকেশ উঠে বলল, কী খবর ফরেস্টারবাবু?
এই পূর্ণাকোট গেছিলাম রেঞ্জার সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে–আপনার দুটি চিঠি এসেছে, নিয়ে এলাম। বলে বুকপকেট থেকে চিঠি দুটি বের করে রাকেশকে দিল। রাকেশ দেখল মুসৌরির ছাপমারা একটি, অন্যটি শ্রুতির নামে।
শ্রুতি শুধোল, কার চিঠি?
একটি তোমার, অন্যটি আমার–এলা লিখেছে।
অর্জুন বলল, বা : অতটুকু মেয়ের খুব দায়িত্বজ্ঞান তো!
দায়িত্বজ্ঞানের চেয়ে বড়ো কথা, চিঠি লেখার অভ্যেস। শ্রুতি বলল–আমার তো চিঠি লিখতে হবে ভাবলেই জ্বর আসে।
রাকেশ বলল, বসুন বসুন, ফরেস্টারবাবু। কিছু খাবেন? আমাদের সঙ্গে ভাত খেয়ে যান না?
ফর্সা গোলগাল লাজুক-লাজুক ফরেস্টারবাবু বললেন, না না, বাড়িতে রান্না হয়ে গেছে।
শ্রুতি বলল, তাহলে একগ্লাস শরবত খান। বলে শ্রুতি ভেতরে চলে গেল।
ফরেস্তারবাবু বললেন, বাঘে তো মোষ মারল। দেখা যাক, কী হয়! তবে মড়িতে ফিরে আসার chance খুব কম। এ বাঘটাকে আমি যতদিন এই posting-এ আছি ততদিন থেকে চিনি। বাঘটি খুব বেয়াড়া। এরজন্যে মাঝে তো আমার সাইকেলে করে পূর্ণাকোট টিকরপাড়া যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেছিল। যখন কোনো কনট্রাকটরের ট্রাক আসত, তখন ট্রাকে যেতাম –আবার ফেরার সময় অন্য ট্রাক ধরে ফিরে আসতাম।
অর্জুন বলল, কেন, কী করত?
তেমন কিছু করত না–দুপুরবেলাও মাঝে মাঝে বড়ো রাস্তার মধ্যিখানে বসে থাকত।
রিয়্যালি? ভেরি ফানি! অর্জুন বলল।
শ্রুতি একগ্লাস লেমন-স্কোয়াশ ও একটি মালপোয়া এনে ফরেস্টারবাবুকে দিল। ফরেস্টারবাবু লাজুক-লাজুক মুখে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে উঠে পড়লেন। বললেন, এখন আর বসব না, আপনাদের খাওয়া-দাওয়ার সময়। চলি।
ফরেস্টারবাবু সাইকেলে চেপে শোলার টুপি মাথায় চাপিয়ে কাঁকরে কিরকির শব্দ তুলে চলে গেলেন।
শ্রুতি ওর চিঠিটা ফস করে ছিঁড়ে খুলল, বলল, বাবা, আমার কী ভাগ্যি! মা আমাকে চিঠি লিখেছেন।
শ্রুতি চিঠি পড়তে লাগল চেয়ারে বসে পড়ে।
রাকেশ এলার চিঠিটি খুলল। এলার চিঠি এলেই কীরকম ভালো লাগে রাকেশের। এলা যখন পাঁচ বছরের মেয়ে ছিল–টুকটুকে ফর্সা ছিপছিপে মেয়েটা–বুদ্ধিমাখা কথা বলত, তখন থেকেই বুড়ি-বুড়ি, খুব বড়ো বড়ো ভাব। রুমনি মারা যাওয়ার পর ও যেন রাতারাতি আরও অনেক বড়ো হয়ে গেছে। রাতারাতি রাকেশের গার্জেন হয়ে গেছে। এলাকে দেখে রাকেশ বুঝতে পারে, মেয়েদের কাছে বয়েসটা একটা কোনো ব্যাপারই নয়–ওরা যেকোনো বয়েসে যেকোনো লোকের দায়িত্ব এমনভাবে নিতে পারে যে, ছেলেদের পক্ষে তা কল্পনার বাইরে। কোন সময়ে কোন সোয়েটার পরবে-কখন পড়াশুনো করবে–কত রাত অবধি জেগে থাকবে সব এলা রাকেশকে বলে দেয়। ওর স্কুলের মাদার এবং মিস্ট্রেসরা ওকে যা শেখান–এলা সরাসরি তার সমস্ত নতুন শেখা জ্ঞান তার বাবার ওপরে প্রয়োগ করে। রাকেশ যেন এলার মাধ্যমে নতুন করে বড়ো হচ্ছে–সেই ছোটোবেলার হো-হো-হাসির দিনগুলোতে ফিরে গেছে–একটি একবছরের কৃষ্ণচূড়া গাছের মত নতুন সবুজ ফিনফিনে পাতায় ও নতুন করে ভরে উঠছে।
চিঠিটা খুলে ফেলল রাকেশ।
সোনা বাবা,
এতদিনে তোমার প্রথম চিঠি পেলাম।
আমি আমার সব বন্ধুদের বলেছি যে, তুমি বাম্বড়ম্বার ডাক শুনেছ। ওরা বিশ্বাসই করে না। খালি হাসে আর চার-পাঁচজনে একসঙ্গে হলেই বলে কিরি-কিরি-কিরি-কিরি ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ। আমি বলেছি, আমার বাবা কি মিথ্যা কথা বলতে পারে?
এই অবধি পড়ে রাকেশ মনে মনে হাসল। ভাবল, সত্যি, এই বয়েসটাই ভালো–যে বয়সে মন থেকে নির্মমভাবে বিশ্বাস করা যায় যে, কারও বাবা মিথ্যে কথা বলতে পারেন না। তারপর যখন সেই বয়েসে পা দিতে হয়–যখন এক এক করে সব পুরোনো জানাগুলোকে পুরোনো বিশ্বাসগুলোকেশক্ত হাতে রাবার দিয়ে ঘষে ঘষে তুলে ফেলবার দিন আসে–সে বড়ো দুঃখের সময়। তখন নতুন করে জানতে হয় যে বাবা, তার বাবা এবং তার বাবা বরাবর অবহেলায় মিথ্যে কথা বলে এসেছেন এবং বংশপরম্পরায় নিজেরা মিথ্যে কথা বলে ছেলেদের সত্যি কথা বলতে শিখিয়েছেন। এখন এলার সেই বয়েস, যে বয়েসে কেউ বিশ্বাস করে না, করতে পারে না যে, তার বাবাও মিথ্যে কথা বলে। ইশপ ফেবলসের গন্ধ এখনও এই বয়েসের গায়ে লেগে থাকে।
আবার পড়তে লাগল রাকেশ।
বাঘ্বডুম্বার কথায় আমার একটা কথা মনে হয়েছে। মনে হয়ে খুব ভয় করছে। তুমি তো বাঘ মারতে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াও-যদি কোনোদিন তোমার কিছু হয়! মানে, বলতে নেই–ভগবান খুব ভালো–তোমার তেমন কিছু কখনো হবে না–তবুও ভয় লাগে–যদি বাঘের হাতে তোমার কিছু হয় তাহলে তুমিও কি বাডুম্বা হয়ে যাবে? সোনা বাবা, আমার ভীষণ ভয় করে। আমার তো আর কেউ নেই তুমি ছাড়া–তোমার কিছু হলে স্কুলের ছুটিতে আমি কার কাছে গিয়ে থাকব? তুমি না থাকলে আমি কী করব বাবা? মা-র ছবির মতো তুমিও তো আমার কাছে শুধু একটা ফটো হয়ে যাবে। আমি কাঁদলেও, ডাকলেও, আর তো তুমি কথা বলবে না। জঙ্গলে পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়া ভালো বাবা, কিন্তু তুমি আর বাঘ-টাঘ মেরো না। মারবে না তো?
শ্রুতি মাসিকে আমার কথা বোলো। অর্জুন মেসোকেও। তুমি জঙ্গলে রয়েছ। দিল্লিতে জ্যাকির দেখাশোনা ঠাকুর সিং ঠিকমতো কচ্ছে তো? অবশ্য শীতকালে জ্যাকি দিল্লিতে ভালোই থাকে, গরমের সময়েই ওকে নিয়ে মুশকিল।
আজকে এই থাকল। তুমি আবার চিঠি দিয়ে। কাল আমাদের উইকলি পরীক্ষা। পড়তে হবে। চলি।
ইতি তোমার–এলাবুড়ি
রাজুয়াড় ভেতর থেকে ডাকল, বলল, খানা লগা দিয়া।
ওরা সকলে উঠে ভেতরের ঘরে গেল।
যেতে যেতে শ্রুতি বলল, এলা কী লিখেছে?
রাকেশ উত্তর না দিয়ে চিঠিটা শ্রুতিকে দিল।