১১-১২. জেনিভা থেকে টেলেক্স
১১.
জেনিভা থেকে টেলেক্স এসেছে যে, জিষ্ণুদের কোম্পানির প্রোডাক্টের সবচেয়ে বড়ো ইম্পোর্টারের রিপ্রেজেনটেটিভ ভারতে আসছেন। প্রথমে বম্বেতে হেড অফিসে আসবেন, সেখান থেকে এম ডি-র সঙ্গে জিষ্ণুদের সঙ্গে কোম্পানির সব কটি ব্রাঞ্চে। ওই ইম্পোর্টারই ওদের এক্সপোর্ট বিজনেসের সবচেয়ে বড়ো ক্লায়েন্ট। তাই অফিসে একেবারে সাজ সাজ রব পড়ে গেছে।
বম্বে পৌঁছেই মিস্টার শরবেঙ্কো, সুইস-ফ্রেঞ্চ, গোয়াতে যাবেন এম ডি-র সঙ্গে উইক-এণ্ড কাটাতে। সেখান থেকে যাবেন দিল্লি। সেখান থেকে কলকাতা। কলকাতা হয়ে ম্যাড্রাস। কলকাতার থাকবেন না। তিনি তাজ গ্রুপের হোটেল ছাড়া থাকবেন না। আর কলকাতার তাজ বেঙ্গল তো এখনও খোলেনি। ম্যাড্রাস থেকে আবার ব্যাঙ্গালোর। ব্যাঙ্গালোর থেকে সেদিনই বম্বে হয়ে ফিরে যাবেন জেনিভা। তাঁর হেড কোয়ার্টার্সে।
চানচানি জিষ্ণুর ঘরে এসেছিল এককাপ কফি খেতে। কফি খেয়ে পাইপটা ধরিয়ে বলল, যাই এল, জিষ্ণু, আপ্তে কিন্তু বম্বে থেকেই একটি প্যাঁচ মারবার চেষ্টায় আছে।
কীসের প্যাঁচ?
ঠিক ব্যাপারটা কী, তা জানতে পারলে তো হয়েই যেত! বাট আই অ্যাম অ্যাপ্রিহেণ্ডিং সামথিং। ও গুগলি বোলার। ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে খেলত ক্রিকেট। লোকাল টিম-এর হয়ে। ওর বল খেলবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত বোঝা যায় না। ওর সঙ্গে যারা খেলত তারাই বলেছে।
জিষ্ণু হেসে বলল, সেই কবে শেষ ক্রিকেট খেলেছি। চাকরি করতে এসেও প্রতিমুহূর্ত এমন উইকেট গার্ড করা আমার পোষাবে না।
না-পোষালে চাকরিও থাকবে না। শুধু চাকরির বেলাতেই বা কেন? মৃত্যুদিন পর্যন্ত উইকেট গার্ড করে প্যাড ও হেলমেট পরেই বেঁচে থাকতে হবে। আজকের জীবনে, জীবনের প্রতিক্ষেত্রেই একমুহূর্ত ওফ-গার্ড হওয়া মানেই আউট হয়ে যাওয়া। হয় খেলো, নয় খেলতে এসো না। কিন্তু খেলতে যদি আসো তাহলে এমন না করলে মাথা নীচু করে প্যাভিলিয়নে ফিরে যেতেই হবে। ইন-বিটুইন কোনো ব্যাপার নেই।
বলেই, হঠাৎ উঠে পড়ে পাইপ থেকে ছাই অ্যাশট্রেতে ঝেড়ে ফেলেই বলল, চলি। এক্সপেক্টিং আ কল ফ্রম কাশবেকার ফ্রম ব্যাঙ্গালোর।
ম্যানিলা যাচ্ছ নাকি? কনফারেন্সে?
জিষ্ণু শুধোল।
আমি তো ভাবছি এবারে তোমাকেই পাঠাতে বলব।
দু-টি হাত দু-দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, আই অ্যাম টায়ার্ড অফ ট্রাভেলিং। রিয়্যালি টায়ার্ড।
ম্যানিলাতে আমি ইন্টাররেস্টেড নই।
জিষ্ণু বলল।
তবে কি ব্যাংককে?
জিষ্ণু হেসে ফেলল। বলল, না। আমি এবার কন্টিনেন্টে যেতে চাই। স্টেটস আর ইংল্যাণ্ড তো অনেক বারই গেলাম। নর্ডিক কান্ট্রিজ হলেও মন্দ হয় না।
ডান। আই উইল পুট আ ওয়ার্ড টু কাশবেকার।
চানচানি বলল।
জিষ্ণু হেসে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ।
চানচানি চলে গেলে, ইন্টারকম-এ ওর সেক্রেটারি পিপিকে ডাকল একটা নোট ডিক্টেট করার জন্যে। পিপি এসে ঢোকামাত্র বেয়ারা এসে একটি ভিজিটিং স্লিপ দিল। বিরক্ত মুখে স্লিপটা তুলে দেখল জিষ্ণু। বাংলাতে লেখা আছে: পিকলু। ফাঁকা হলে ডাকিস। আমার কোনো তাড়া নেই।
বিরক্তিটা আরও বাড়ল জিষ্ণুর। বেয়ারাকে বলল, ভিজিটার্স রুমমে বৈঠাও সাহাবকো।
বেয়ারা চলে গেলে পিপিকে বলল, ডিকটেশানটা নেওয়া হয়ে গেলে এই ভদ্রলোককে পাঠিয়ে দেবেন। পাঠাবার আগে বলে দেবেন যে, আমরা সবাই জিনিভার পার্টির আসার ব্যাপারে কীরকম ব্যস্ত আছি। পাঁচ মিনিটের বেশি সময় দিতে পারব না। প্লিজ ট্রাই টু ইম্প্রেস হিম বাউট দিস। কেন যে আসবার আগে একবার ফোন করেও আসে না, বুঝি না। সবাইকেই এরা নিজেদের মতো ভ্যাগাব বলে মনে করে।
পিপি জানে যে, পিকলু জিষ্ণুর বন্ধু। জানে বলেই, অভিব্যক্তিহীন মুখে জিষ্ণুর মুখে চেয়ে বলল, ইয়েস স্যার।
হোয়াট ডু ইউ মিন বাই ইয়েস স্যার?
আই উইল টেল হিম প্রিসাইসলি হোয়াট ইউ ওয়ান্টেড মি টু টেল হিম।
গিভ হিম দ্য মেসেজ ওনলি; দ্য হিন্ট। আই ডোন্ট ওয়ান্ট ইউ টু রিপিট ভার্বাটিম হোয়াট আই টোল্ড ইউ।
ইয়েস স্যার। আই আণ্ডারস্ট্যাণ্ড।
পিপি ডিক্টেশান নিয়ে চলে যাওয়ার পরই পিকলু এসে ঢুকল।
পিকলুর মুখের দিকে চাইল জিষ্ণু। ফাস্ট-ইয়ারে পড়া পিকলুর মুখটা মনে পড়ে গেল। নীল টুইলের ফুলহাতা গুটোনো শার্ট আর সাদা ট্রাউজার পরা কালো ছিপছিপে পিকলু যেন দাঁড়িয়ে আছে বইখাতা হাতে কলেজের গেটে জিষ্ণুরই অপেক্ষায়। জিষ্ণু এলে তার পর ঢুকবে একসঙ্গে।
কত্ব ভালোবাসা, কত্ব গল্প, কত্ব কল্পনা, কত্ব সাহিত্যালোচনা, নাটক সিনেমার আলোচনা ছিল সেই দিনে। বাদল সরকারের এবং ইন্দ্রজিৎ দেখে কী তুমুল উত্তেজিত হয়েছিল দুজনে। ফিলম : লা দোলচে ভিতা! টু ডাই উইথ আ ব্যাঙ্গ অ্যাণ্ড নট উইথ আ হুইস্পার।
তখন দুজনে দুজনকে একদিনও না দেখে থাকতে পারত না। না দেখা হলে ফোনে কথা অবশ্যই হত। একাধিক বন্ধুরা বলত, তোরা কি হোমো-সেজুয়াল?
হাসত জিষ্ণু। শব্দটি শুনলেই গা-ঘিনঘিন করত।
আজ জীবনের এবং জীবিকার বিভিন্নমুখী চোরাস্রোত দুজনকে কতখানিই না আলাদা করে দিয়েছে। পরিবেশ, রুচি, পরিচিতর পরিধি, আশা-আকাঙ্ক্ষা, জীবনযাত্রা অনেকই পালটে গেছে দুজনেরই। একদিন যে, তারা অভিন্ন-হৃদয় বন্ধু ছিল সে কথা পিপিরই মতো কেউই আর বিশ্বাস করবে না। বিশ্বাস করবে না হয়তো ওরা নিজেরাও। মানুষ নদীস্রোতে ভেসে যাওয়া কুটোরই মতো অসহায়। এক অনুষঙ্গ ছেড়ে তাকে অতিদ্রুত অন্য অনুষঙ্গে ছুটে যেতে হয়। পিকলু অবশ্য অ্যাডভানটেজ-ই নিয়ে গেছে জিষ্ণুর কাছ থেকে সবরকমের কিন্তু নিয়েও জিষ্ণুকে তার ইনার সার্কল থেকে বের করে দিয়েছে পিকলু নিজে এবং তার বৃত্তর অন্য মানুষেরাও। আ ম্যান ইজ নোন বাই দ্য কামপানি হি কিপস। ওরা দুজনে দু-রকম হয়ে গেছে। এ-জীবনে বোধ হয় একে অন্যর সেই ইনার সার্কল-এ আর ঢুকতে পারবে না।
জিষ্ণুর একমাত্র দোষ ও বড়ো চাকরি করে। ওকে বড়োই ব্যস্ত থাকতে হয়। নষ্ট করার মতো সময় ওর একেবারেই নেই। সত্যিই নেই। জীবনের যে-সময়টা কেরিয়ার তৈরি করবার, পরিশ্রম করবার; সেই সময়টুকুতে জিষ্ণু হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেছে এবং করছে। বারো ঘণ্টা কাজ করছে। পিকলুর চোখে এইসবই জিষ্ণুর দোষ।
পিকলুর মতো সুখী, সাধারণ, গায়ে-হাওয়া লাগিয়ে-বেড়ানো বন্ধুরা সকলেই একে একে ত্যাগ করে গেছে জিষ্ণুকে। আস্তে আস্তে। প্রথমদিকে মনে হত বুক ভেঙে যাবে। তার পর সয়ে গেছে আস্তে আস্তে। সময়াভাবে, কিছুটা অভিমানে এবং দুঃখেও আর ফিরে ডাকেনি তাদের। বিপরীতমুখী স্রোতে ভেসে গেছে ওরা ধীরে ধীরে।
উষ্ণতা তবুও ছিল। কিছু ছিল। উষ্ণতা সবসময়েই যে নৈকট্য-নির্ভর হবে এমন কোনো কথা নেই। একথা অল্প কয়েক বছর আগে অবধি ওরা দেখা হলেই বুঝেছে। উষ্ণতা সহজে মরে না। তাপ থেকে যায় অনেক দিনই একবার সঞ্চারিত হলে। কিন্তু আজ সেইটুকু উষ্ণতাও আর নেই। পিকলুর শেষ তঞ্চকতার পর জিষ্ণু এই পুরোনো সম্পর্কটাকে গলা টিপে মেরে ফেলে নিজে বিবেকের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। এ-সম্পর্ককে গলা টিপে মারতে কতখানি যে কষ্ট পেয়েছিল তা জিষ্ণুই জানে। কিন্তু যা থাকার নয়, তাকে না রাখাই ভালো। যে-সম্পর্কর মধ্যে সত্যতা নেই, আন্তরিকতা নেই; তা তো নেই-ই। আর যা নেই, তা আছে বলে মনে করে আনন্দিত হওয়ারও কিছু নেই। যথেষ্ট বয়েস হয়েছে জিষ্ণুর। একটা মিথ্যে এবং দুষ্ট সম্পর্ককে খুন করতে ও এখন আর অপারগ নয়। ফালতু সেন্টিমেন্ট রাখে না ও আর কারোও জন্যেই। সে পিকলুই হোক আর যেই হোক। শুধু পরিকে নিয়ে কী করবে সেটাই ঠিক করে উঠতে পারেনি ও।
কিন্তু যদিও জিষ্ণু ভেবেছিল পিকলুকে তার জীবন থেকে একেবারেই মুছে ফেলতে পেরেছে কিন্তু পিকলু ঘরে ঢুকতেই তার মুখের দিকে চেয়েই ওর বুকের মধ্যেটা যেন মোচড় দিয়ে উঠল। ও জানত না যে, পুরোনো সম্পর্কর শিকড় অভ্যাস-বটের শিকড়ের মতো বড়ো গভীরে গিয়ে বাসা বাঁধে চুপিসাড়ে।
আন্তরিকভাবে বলল, কী রে! ভালো আছিস?
ভালোই তো আছি। নাথিং টু কমপ্লেইন বাউট।
খুশি কেমন আছে? আর তোর কন্যা?
তুই কেমন আছিস বল?
কথা ঘুরিয়ে পিকলু বলল।
আমি? ভালোই। জিষ্ণু বলল।
দাড়ি কামাসনি কেন?
জিষ্ণু শুধোল।
এমনিই। ভাবছি রাখব।
চা খাবি?
না:। তুই খুব ব্যস্ত শুনলাম। এমনিতে তো ব্যস্ত থাকিসই। জানি। আমি উঠি এবারে।
তাহলে এসেছিলি কেন?
জাস্ট এমনিই। তোকে অনেক দিন দেখিনি। এ-পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম, দেখে যাই তোকে।
বলেই, জিষ্ণুকে আর কিছুই বলার সুযোগ না দিয়েই উঠে দাঁড়াল পিকলু।
বলল, চলি রে।
বলে, সত্যিসত্যিই চলে গেল।
পিকলু চলে যেতেই মনটা হঠাৎ-ই খারাপ হয়ে গেল জিষ্ণুর। ব্যস্ত ছিল ঠিক তবে এমন কিছু ব্যস্ত ছিল না যে, ছেলেবেলার বন্ধুর সঙ্গেও দুটো কথা বলা যায় না। চাকরিতে অনেকই সুবিধে বিশেষ করে মার্কেন্টাইল ফার্মের চাকরিতে। ডাক্তার বা উকিল বা সলিসিটর হলেও না-হয় কথা ছিল। মক্কেলদের গোপন কথা থাকে। নিজস্ব পেশায় খাটুনি অনেক বেশি। চাকরি, সে যে-কোনো চাকরিই হোক না কেন, তাতে বন্ধুকেও দিতে না-পারার মতো সময়ের অভাব কোনো দিনই হয় না। কনফারেন্স মিটিং ইত্যাদি গাল-ভরা শব্দ অপারেটর বা সেক্রেটারিকে দিয়ে অন্যকে বলিয়ে নিজের ইম্পর্ট্যান্স বাড়িয়েও সহজে আড্ডা মারা যায়। প্রাইভেট সেক্টরের অফিসারেরা যতখানি ব্যস্ত থাকেন বলে ভাব দেখান, ততখানি আদৌ থাকেন না যে, তা জিষ্ণু নিজেও জানে।
কী যেন নাম ছিল পাহাড়টার? ডিগারিয়া? মনে পড়েছে। একবার দেওঘরে গেছিল বিকাশ আর পিকলুর সঙ্গে। এই দেওঘরেই গেছিল অনেক ছেলেবেলায় প্রথম বার পরি আর কাকিমার সঙ্গে।
এপ্রিল বা মে মাসে গেছিল ওরা। ঠিক মনে নেই। বিকাশদের বাড়ি ছিল নন্দন পাহাড়ের রাস্তাতে। মস্ত বাগানওয়ালা বাড়ি। নানারকম ছোটো-বড়ো ফুলের গাছ ছিল। পাশের বাড়িতে দুটি অল্পবয়েসি মেয়ে বেড়াতে এসেছিল তাদের দাদু-দিদিমার কাছে। তাও মনে আছে। সন্ধেবেলা সে-বাড়িতে গান-টান হত। পিকলুর গানের গলা ছিল ভারি সুন্দর। আর জিষ্ণু যেরকম লাজুক ছিল, পিকলু ছিল ঠিক তার উলটো। যেকোনো মানসিক স্তরের স্ত্রী-পুরুষের সঙ্গেই ও পাঁচ মিনিটে ঘনিষ্ঠ হতে পারত।
ডিগারিয়া পাহাড়ে গেছিল, দেওঘর শহরের দোকান থেকে দুটো সাইকেল ভাড়া করে। সাইকেল ভাড়া করেছিল বড়োলোকের ছেলে বিকাশও। কিন্তু জিষ্ণুরা গিয়ে পৌঁছোবার পর পেছনে তাকিয়ে অনেক দূরে ওরা দেখল যে, একটি টাঙার ওপরে সেই ভাড়া-করা সাইকেলটিকে উঠিয়ে জমিদারি পেজ-এ হাতের ওপর থুতনি রেখে ঝুমঝুমি-বাজানো দুলকি চালে নাচতে নাচতে আসা টাঙাতে চড়ে বিকাশ আসছে।
খুব ঘূর্ণি হাওয়া ছিল সেদিন। পথের লাল ধুলো আর শুকনো পাতা উড়িয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্রায় দশ মিটার মতো উঁচু এক স্তম্ভর সৃষ্টি করেছিল ঘূর্ণি হাওয়াটা। পিকলু আর জিষ্ণু দুই কলকাতার ছেলে অবাক-বিস্ময়ে দেখেছিল।
একবার বর্ষাকালে দেওঘরে যাওয়ার অনেক দিন পরে তোপচাঁচীতে গেছিল ওরা। তখন জিষ্ণু পড়াশুনো শেষ করে চাকরিতে সবে ঢুকেছে, পিকলুও একটি স্কুলে পড়ায় অন্য একজনের বদলিতে। ধানবাদ শহরের কাছেই তোপচাঁচী। ঝরিয়া ওয়াটারবোর্ডের বাংলোতে ছিল। বিরাট বিরাট ঘরওয়ালা বাংলো, তোপচাঁচী হ্রদের কাছেই। পিকলু গান গাইত গলা ছেড়ে। জিষ্ণু লেখালেখির চেষ্টা করত। সকালে বিকেলে তোপচাঁচী হ্রদের পাশের রাস্তা ধরে পুরো হ্রদটি প্রদক্ষিণ করত দুই বন্ধুতে পায়ে হেঁটে, যৌবনের অশেষ জীবনীশক্তিতে ভেসে। পিকলুই জিষ্ণুকে হ্রদের পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিল সেই বিখ্যাত ইটালিয়ান চিত্র পরিচালকের ছবি লা দোলচে ভিতার কথা। বার্গম্যান, কুরোসাওয়া, ফেলিনি, আন্তোনিওনি, ত্রুফো ইত্যাদি কত পরিচালকের ছবি নিয়ে আলোচনা হত। সত্যজিৎ রায়ের ছবিও।
পিকলুর এক মামাতো ভাই ছিল যে যাদবপুরে তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে এম এ পাস করেছিল। তখন বুদ্ধদেব বসু নেই। নরেশ গুহ ছিলেন। সেই বন্ধু কত জানে, পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য সম্বন্ধে তার কী গভীর জ্ঞান সেইসব বিষয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলত পিকলু। আর জিষ্ণু শুনে ভাবত জীবনটাই বৃথা হয়ে গেল তুলনামূলক সাহিত্যর ছাত্র না হতে পেরে।
পিকলু চলে যাওয়ার পর একা ঘরে বসে অনেকই পুরোনো কথা ভাবছিল জিষ্ণু। কোনো টেলিফোন কল দিতেও মানা করে দিয়েছিল। একসময়ে হঠাৎ-ই পিপি ইন্টারকমে বলল, মে আই কাম ইন স্যার?
ইয়েস।
পিপি ঘরে এসে বলল, আমি কি চলে যাব স্যার? আমাকে কি দরকার হবে আপনার?
কেন? ক-টা বেজেছে?
সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে স্যার।
সাড়ে-পাঁচটা? মাই গুডনেস। কখন? কী করে?
পিপি সিজনড সেক্রেটারি। বস-এর কথার কোনো উত্তর না দিয়ে মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
দেওয়ালের কোয়ার্টজ ঘড়িটার দিকে চেয়ে জিষ্ণু দেখল পৌনে ছ-টা বাজে প্রায়। ও তাড়াতাড়ি বলল, আপনি চলে যান। আজকে আর কোনো দরকার নেই। ফাইল পড়তে পড়তে খেয়ালই ছিল না। পিপি বলল, স্যার।
কী?
যে-ভিজিটর আপনার কাছে এসেছিলেন, মানে আপনার বন্ধু, তিনি ছিলেন, মানে আপনার বন্ধু, তিনি একটা চিঠি দিয়ে গেছেন আমাকে।
হাউ ফানি! এতক্ষণ দেননি কেন আমাকে?
উনি বলে গেছিলেন যে, আমি চলে যাওয়ার সময়েই যেন দিই। আগে দিতে মানা করেছিলেন।
হুম ডু ইউ সার্ভ হিয়ার মিসেস সেন? হিম? অর মি?
আই অ্যাম ভেরি সরি স্যার। এমন করে অনুরোধ করলেন যে, না করতে পারলাম না।
দিন চিঠিটা।
মিসেস সেন ওঁর হ্যাঁণ্ড ব্যাগটি থেকে একটি খাম বের করলেন। বেশ বড়োখাম। এবং রীতিমতো ভারী। খামের ওপরে পিকলুর দুর্বোধ্য হাতের লেখায় জিষ্ণুর নাম।
ওর হাতের লেখা নিয়ে ঠাট্টা করলেই পিকলু জিষ্ণুকে বলত : এফিশিয়েন্ট মেন হ্যাভ ব্যাড হ্যাঁণ্ড-রাইটিং। রবীন্দ্রনাথ ওজ ওয়ান অফ দ্য ফিউ এক্সেপশনস।
পিপি বলল, আমি তাহলে আসছি স্যার?
হ্যাঁ। আসুন।
পিকলুকে জিষ্ণু মুছেই ফেলেছে তার জীবন থেকে। সম্পর্ক একবার মরে গেলে তাকে ঝাড়ফুক করে জাগানো যায় না। গেলেও সে-সম্পর্ককে মনে হয় রক্তাল্পতায় বা ন্যাবায়– ধরা রোগী।
পেছন-ফেরা মিসেস সেনের দিকে চেয়ে রইল জিষ্ণু। বেশ মেয়েটি। প্রিটি। অ্যাণ্ড শি নোজ হাউ টু ক্যারি হারসেল্ফ। কিন্তু পিকলুর চিঠিটা এতক্ষণ না দেওয়াতে রেগে ছিল ও। চিঠিটা এত বড়ো যে পড়া যাবে না অফিসে বসে। কী লিখেছে পিকলু কে জানে? পিকলুর চেহারাটা অবশ্য বেশ খোলতাই দেখাল আজকে। কী ব্যাপার কে জানে?
পিপি মেয়েটি বেশ। বাইরের কেউই বুঝতে পারে না বিবাহিতা কি না! আজকালকার কম মেয়েকে দেখেই বোঝা যায়। জিষ্ণু অবশ্যই জানে। অফিসেরই বিভিন্ন জনের কাছে শুনেছে জিষ্ণু যে, পিপির স্বামীর জীবিকা হচ্ছে পৌনঃপুনিক বেকারত্ব। প্রচন্ড মদ্যপ এবং রেসুড়ে লোক। নাম সুমন্ত্র। একটি বাচ্চাও আছে ওদের। মেয়ে। পিপির ওপরেই সব কিছু। মদ, রেস; সিগারেট। বিবেক বলে কিছুমাত্রই অবশিষ্ট নেই সুমন্ত্রর। ধুয়ে মুছে ফেলেছে অনেকই দিন আগে। বেশ আছে। বিবেকের মতো ইনকনভিনিয়েন্ট ব্যাপার আর নেইও দুটি।
লোকমুখে শুনেছে কাজের মধ্যে সুমন্ত্র তিনটি কাজ করে। সকালে উঠে ঘুমকাতর-চোখে বাসিমুখে সিগারেট ধরিয়ে মাদার ডেয়ারির ডিপো থেকে দুধ এনে দেওয়া এবং মেয়েকে স্কুলে পোঁছে দিয়ে আসা। এবং স্কুল থেকে নিয়েও আসা। মেয়েটা মাকে কম পায় বলেই বাবা ন্যাওটা। সুমন্ত্রও মেয়েকে একমুহূর্ত চোখ-ছাড়া করতে চায় না। পিপি যথেষ্ট সুন্দরী, সপ্রতিভ এবং বুদ্ধিমতী মেয়ে। বুদ্ধি থাকলেই মানুষ তাকে কাজে লাগায়।
জিষ্ণু এও শুনেছে যে, পিপি ডিভোর্স চেয়ে কেস ফাইল করেছে সুমন্ত্রর বিরুদ্ধে। এবং হয়তো পেয়েও যাবে। সুমন্ত্র নাকি বিশ্বাস করেনি একথা। নোটিশ ছিঁড়ে ফেলেছে। বলেছে, মেয়ে তিতিকে। বাজে কথা। পিপি তো আর পাগল হয়নি!
সুমন্ত্রকে কোনো দিন আগে চোখেও দেখেনি জিষ্ণু। দেখার কৌতূহলও ছিল না। একদিন একটি প্রাইভেট ট্যাক্সিতে বাড়ি ফিরছিল সেনগুপ্ত সাহেবের সঙ্গে। শর্ট-কাট করতে ড্রাইভার যখন একটি সরু গলিতে ঢুকিয়েছে গাড়ি তখন সেনগুপ্ত সাহেব বললেন, ওই দেখুন চাটুজ্যেসাহেব। আপনার প্রাইভেট সেক্রেটারির স্বামী।
যে-মানুষটাকে দেখেছিল জিষ্ণু তার সঙ্গে পিপির কোনোরকম মিলই ছিল না। মোড়ে জ্যাম ছিল এবং সামনে অন্য গাড়ি ছিল বলে প্রাইভেট ট্যাক্সিটার স্পিড ঠিক সেইমুহূর্তেই আস্তে হয়ে গিয়ে প্রায় থেমেই গেছিল। একটি মলিন বাড়ির একতলার খোলা দরজার সামনে ছোট্ট তিন-ধাপ লাল-সিমেন্টের সিঁড়ির ওপরের ধাপে একজন মানুষ বসেছিল। তার পরনে লাল-রঙা একটি স্লিপিং-স্যুটের পায়জামা, গায়ে নোংরা হলুদ হয়ে-যাওয়া বোতামহীন একটি সাদা পাঞ্জাবি। নীচে গেঞ্জি নেই। বুকে কাঁচাপাকা চুল দেখা যাচ্ছে। মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। গায়ের রং কালো। মুখটি কুৎসিত না হলেও শ্রীহীন। জুলপির দু-পাশের চুলে পাক ধরেছে। দুটি পা সামনে ছড়িয়ে দিয়ে জগতের তাবৎ নির্লিপ্তি নিয়ে সে বসে বসে হলদে-রঙা ছোট্ট বই থেকে ঘোড়াদের কুলজি-ঠিকুজির সুলুক-সন্ধান করছিল। আগামীকাল শনিবার। ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমার মধ্যে একটি সিগারেট দ্রুত পুড়ে যাচ্ছিল বিকেলের উথাল পাথাল হাওয়ায়।
যেন তার ভবিষ্যতেরই মতো!
কিন্তু মানুষটার মুখে চেয়েই জিষ্ণুর মনে হয়েছিল যে, মানুষটা সম্ভবত ভালো। সে মদ্যপ হতে পারে, বেকার হতে পারে, রেসুড়ে হতে পারে কিন্তু মানুষটা দুষ্ট নয়। খল, ইতর বা কুচক্রী নয়। তঞ্চকনয়। তার মুখে এবং কপালে এইকথাটি বড়ো বড়ো করেই লেখা ছিল। পৃথিবীর কারো বিরুদ্ধেই, এমনকী সম্ভবত পিপির বিরুদ্ধেও সুমন্ত্র নামক মানুষটির বোধ হয় বিন্দুমাত্র অভিযোগ নেই। দু-বেলা দু-মুঠো খেতে পেলেই, চার প্যাকেট সিগারেট এবং প্রতিশনিবারে পঞ্চাশটি টাকা ঘোড়ার মাঠের জন্যে পেলেই, সে প্রচন্ড সুখী।
এতসব ডিটেইলস অবশ্য সেনগুপ্ত সাহেবের কাছেই শুনেছিল। তবে মানুষটিকে দেখে জিষ্ণুর বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছিল যে, এর স্ত্রীই ভুরু প্লাক-করা, স্লিভলেস ব্লাউজ-পরা আপাদমস্তক নিখুঁতভাবে ডি-ওয়াক্সিং করা সুবেশা, সুগন্ধি পিপি তার সেক্রেটারি। কী অমিল স্বামী এবং স্ত্রীর মধ্যে! ভাবা যায় না। মানুষটির আশ্চর্য নির্লিপ্তি এবং অসাধারণ সাধারণত্ব নাড়া দিয়েছিল ভীষণভাবে জিষ্ণুকে।
গাড়িটার স্পিড বাড়তেই সেনগুপ্ত সাহেবকে বলেছিল জিষ্ণু, বুঝলেন, এই ধরনের মানুষেরাই খুব বড়োমাপের দার্শনিক হয়ে উঠতে পারে। সমাজে থেকেও সমাজের প্রতি এদের যে ঔদাসীন্য এটা সাধারণ ব্যাপার বলে মনে করার নয়।
মাই ফুট!
বলেছিলেন সেনগুপ্ত সাহেব।
হি ইজ আ স্কাউড্রেল। ওর স্ত্রী যে সপ্তাহে তিন দিন অন্য লোকের সঙ্গে শুয়ে আসছে তা ও জানে।
কথাটাতে খুব ধাক্কা লেগেছিল জিষ্ণুর।
একটু থেমে সেনগুপ্ত সাহেব বললেন, আই নো ফর সার্টেন যে, পিপি একটি রেসপেক্টবল হোর হয়ে উঠেছে। শি টেকস ওয়ান থাউজ্যাণ্ড ফর বিইং ডাগ ওয়ান্স। নট আ ম্যাটার অফ জোক। মাসে দশ হাজার এক্সট্রা ইনকাম করে। অবশ্য অমন অ্যাকমপ্লিশড সফিস্টিকেটেড মেয়ের পক্ষে ওই তো মিনিমাম রেট। সুমন্দ্রর মতো স্বামী পেয়েছিল বলেই তো সম্ভব হল এমন। এজন্য পিপির অবশ্য কৃতজ্ঞ থাকা উচিত সুমন্ত্রর কাছে। এত এক্সপেনসিভ শাড়ি, জুয়েলারি, মাসের একটি উইক-এণ্ড-এ কোথাও না কোথাও যাওয়া। বছরের ছুটিতে গোয়া, কাঠমান্ডু, কাশ্মীর এসব কি আর এমনিতে হত? তাও তো সঙ্গে ক্লায়েন্ট নিয়েই যায়। একপয়সাও খরচ নেই। সঙ্গে সুমন্ত্র আর মেয়েটাও যায়। সুমন্ত্রর মনে সুমন্ত্র থাকে। রাতে মেয়েকে নিয়ে শোয় অন্য ঘরে। আর পিপি ক্লায়েন্টের সঙ্গে। সত্যি। কতরকম জীবনই থাকে মানুষের। মুখোশ। ভাবা যায় না। মানুষটার কোনো আত্মসম্মান আছে বলে ভাবেন আপনি?
এত খবর আপনি জানলেন কী করে?
জানতে হয়।
মানে?
কাউকে বলবেন না, রিজিয়োনাল ম্যানেজারকে এম ডি রাতে ফোন করেছিলেন কাল। আর এম আমাকে ডেকে বললেন।
কী?
যে ক-দিন ওঁরা কলকাতায় থাকবেন, সে ক-দিন পিপি ইভনিং-এ যেন ফ্রি থাকে। ওকে এখান থেকে ম্যাড্রাস এবং ব্যাঙ্গালোরেও যেতে হতে পারে।
বলেন কী? আমার পি. এস.?
হ্যাঁ। সে ক-দিন আপনার কাজ করে দেবে আর এম-এর পি এস-ই। আজকে ওর কাছ থেকে ছুটির অ্যাপ্লিকেশান পাননি? মানে কপি? পার্সোনেল ম্যানেজারকে অ্যাড্রেস করা?
সেনগুপ্ত সাহেব সর্বজ্ঞ জ্যোতিষীর মতো বলেছিলেন।
জিষ্ণু বলেছিল, হ্যাঁ পেয়েছি।
আগে থেকেই ব্যাপারটাকে ক্যামোফ্লেজ করে রাখা হচ্ছে। বুঝলেন-না? অন্য কালার দেওয়া হচ্ছে। আমার এসবের মধ্যে থাকতে আর ভালো লাগে না মশাই। বুয়েচেন?
আপনি এরমধ্যে কোথায় থাকছেন?
জানছি তো রে বাবা! জানলেও পাপ লাগে। মিডল-ক্লাস মরালিটির মানুষ আমরা। রক্ষণশীল ভদ্র শিক্ষিত বদ্যি পরিবারে জন্ম আমার। লজ্জা লাগে মশায়। এসব জেনেও লজ্জা লাগে।
তাই?
না তো কী? একটি সুন্দরী অল্পবয়েসি মেয়ে, আফটার অল বাঙালি মেয়ে। স্বামী আছে। মেয়ে আছে। চোখের সামনে এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে আর তা আমাদের দেখতে হবে? এটা ভেবে খারাপ লাগেই।
চোখের সামনে একটি পুরো জাত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সেজন্যেই বা কী করতে পারছেন? তা ছাড়া আপনি যা বলছেন তাতে নষ্ট তো সে হয়ে গেছেই। যারা নষ্ট হওয়ার প্রবণতা নিয়ে জন্মায় তাদের নষ্ট হতে কোনো কষ্টই নেই বরং বোধ হয় এক ধরনের আনন্দই আছে।
তাই? কী জানি মশায়। আপনারা কবি-মানুষ আপনাদের দেখার চোখই আলাদা।
সেনগুপ্ত সাহেব বললেন।
আমার তো মনে হয় পিপি ইজ এনজয়িং হারসেল্ফ। চমৎকার সব এয়ার-কণ্ডিশানড গেস্ট হাউস, দিল্লি-বম্বে-ম্যাড্রাস-ব্যাঙ্গালোরের ফাইভ স্টার হোটেলের এফেক্টিভলি এয়ার কণ্ডিশানড ঘরের নরম মসৃণ বিছানা। রথী-মহারথী সব শয্যাসঙ্গী। ও তো সুখেই আছে। ওর সুখের জন্যে আমরা দুঃখ পেয়ে মরতে যাই কেন?
বলেই, বিবেক-দংশন মুক্ত হয়ে একটি সিগারেট ধরালেন।
পাশে-দাঁড়ানো একটা স্টেটবাস এমন ডিজেলের ধোঁওয়া ছাড়ল আর তার সঙ্গে দমকা হাওয়ায় উড়ে-আসা আণ্ডার-কনস্ট্রাকশন একটি মালটিস্টোরিড বাড়ির ধুলো থেকে বাঁচতে দু চোখ বন্ধ করে ফেলল জিষ্ণু।
সেনগুপ্ত সাহেব নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বললেন এ শালার শহরে আর থাকা যাবে না। চারদিকের এই অবস্থা, নোংরা, ধোঁওয়া, কালির মধ্যে মানুষের মতো নিশ্বাস নিয়ে বাঁচাই ভারি মুশকিল মশায়।
বলেই, সেনগুপ্ত সাহেব আবার সঙ্গে সঙ্গে নাকে রুমাল চাপা দিলেন।
উনি পথে বেরোলেই রুমাল চাপা দিয়ে রাখেন নাকে। ধোঁওয়া, ধুলো, জীবাণু, বালি এইসবে ওঁর খুব ভয়। তারা যেন শুধুমাত্র ওঁকেই আক্রমণ করছে সবসময়ে এইরকম বিশ্বাস আছে তাঁর। জিষ্ণু ভাবছিল, সেনগুপ্ত সাহেবের চোখে কি বাইরের ধুলোবালিটুকুই পড়ে শুধু? এই শহরের মানুষদের বুকের মধ্যের, মস্তিষ্কের মধ্যের ধুলোবালি কি ওঁকে পীড়িত করে না? জিষ্ণুকে কিন্তু করে। প্রতিমুহূর্তই করে।
ইন্টারকম পি পি করল।
আজ কী হয়েছে জিষ্ণুর কে জানে! শুধু ভাবনাতে পেয়েছে। কোনো কাজও হল না চানচানি ওর ঘর থেকে চলে যাওয়ার অথবা পিকলুর চলে যাওয়ার পর থেকে। ইন্টারকম আবার পি পি করে উঠল।
সেনগুপ্ত সাহেব ইন্টারকম-এ বললেন, ক্লাবে যাবেন নাকি? আই নিড আ স্টিফ ড্রিঙ্ক।
না আপনিই যান। আমার একটু কাজ আছে।
পার্সোনাল অ্যাণ্ড প্রাইভেট?
ওয়েল, শর্ট সফ।
ফাইন। উইশ ইউ ওল দ্য বেস্ট।
বিরক্ত হয়ে ইন্টারকম-এর রিসিভারটা নামিয়ে রাখল জিষ্ণু। লাল আলোটা দু-বার ব্লিঙ্ক করে নিভে গেল। সবসময়ে বোকা বোকা রসিকতা ভালো লাগে না।
কলিগদের মধ্যে সেনগুপ্ত সাহেবের মতোই বেশি। ওঁরা রোজ ড্রিঙ্ক করেন না। বৃষ্টি যেদিন পড়ে, সেদিন করেন আর যেদিন পড়ে না সেদিন। এবং কোনো সমস্যা, কোনো সমাধান, কোনো আনন্দ অথবা দুঃখ সবেতেই ওঁদের একটি স্টিফ-ড্রিঙ্ক-এর দরকার হয়ই। বেশিরভাগেরই একই কথা, একই রসিকতা, একই অ্যাম্বিশান, একই পরচর্চা। পরচর্চার বৃত্তটিরও কোনোই হেরফের নেই।
অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল জিষ্ণু। ওকে একটি এয়ার-কণ্ডিশানড মারুতি দিয়েছে অফিস থেকে। সস্তাতে। পুষির দুর্ঘটনার পর থেকেই আর এম বার বার বলেছেন, যতদিন ফ্ল্যাট না পাও, গাড়ি আমাদের রিপেয়ারের গ্যারাজেই থাকবে। কিন্তু তোমাকে স্কুটারে আর চড়তে দেব না আমি। তোমাকে কন্টেসাও দিতে পারতাম। কিন্তু তোমার গলিতে তো তা ঢুকবে না। বাড়ি থেকে নিয়ে আসবে ড্রাইভার তোমাকে। আবার ছেড়ে দিয়ে আসবে। গাড়ি চালানোটা শিখে নাও। আজকাল ড্রাইভারদের যা বোলচাল আর ওভারটাইম তাতে ছুটির দিনে নিজে না চালালে মোবিলিটিই থাকবে না।
ফেরবার সময়ে গাড়ি বেশিরভাগ দিনই নেয় না জিষ্ণু। প্রথমত অফিসের ড্রাইভার। ওভারটাইম দিতে হয় পাঁচটার পরই। নিজের দিতে হয় না যদিও। তবু গায়ে লাগে। একটু হাঁটাহাঁটিও হয়। তা ছাড়া, জিষ্ণু পুরোপুরি গাড়ি-নির্ভর হতে চায় না। সব ক্যাপিটালিস্টদের ওই এক কায়দা। যার যোগ্যতা দু-শো টাকার তাকে দু-হাজার দেয়, যার দু-হাজারের তাকে দশ হাজার। ফ্ল্যাট, গাড়ি, আরাম ছুটি সব। তার পর তাকে দিয়ে পাও চাটিয়ে নেয়, হামাগুড়ি দেওয়ায়, অন্যায় কাজ করাতে বাধ্য করে সবরকম। মানুষগুলোরবিবেকগুলোকেও পোষা কুকুরের মতো করে ফেলে। জিষ্ণু দেখছে, দেখে চারদিকে এমনই অনেক মানুষকে। তাই পুরোপুরি পরনির্ভর হতে চায় না ও। এটা না হলে চলে না, ওটা না হলে চলে না-তে বিশ্বাস যাতে না করতে হয় তারই চেষ্টা করে ও। এখনও করে। অবশ্য বিয়ে করলে, মানুষ হিসেবে হয়তো বদলে যাবে। অনেককেই বদলে যেতে দেখেছে। সপ্তাহে গড়ে তিন দিন হেঁটে বা অন্যভাবে বাড়ি ফেরে ও। পথের জনপ্রবাহের সঙ্গে মিশে সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে হাঁটতে ওর খুব ভালো লাগে। টুকরো টুকরো কথা কানে আসে, চকিত চাউনি, চলে-যাওয়া বা এগিয়ে-আসা নারী ও পুরুষের মুখের এক এক ঝলক। এক ধরনের একাত্মবোধ নিমেষে সঞ্চারিত হয়ে যায় তখন ওর মধ্যে।
আজ পথে যখন বেরোল তখনও আলো ছিল। ওদের অফিসের কম্পাউণ্ডের মধ্যেই গেটের দু-পাশের দুটি বড়ো কদম গাছে ফুল এসেছে অজস্র। ঝিম-ধরা গন্ধ পায় একটা। গাছগুলির কাছে এলেই। ফোঁটা কদম নীচে পড়ে রয়েছে। এই কংক্রিটের শহরে এর দাম নেই। কদম ফুল চেনেই বা এখানে কজন?
আকাশে তাকিয়ে আজ হঠাৎ-ই বাড়িওয়ালা তারিণীবাবুর কন্যাসমা মামণির মুখটি মনে পড়ে গেল। আজকের বিকেল বেলার আলোর মতোই স্নিগ্ধ সেই মুখ। অথচ এই ভরা ভাদরের গরমেরই মতো এক ধরনের আদ্র জ্বালাও যেন মিশে আছে। এবারের চলে যাওয়া গরমের মতো পাগল করা এলমেলো হাওয়ার মতোই কিছু। কলকাতার বাইরের চেহারাটাই শুধু বদলায়নি, বদলায়নি স্কাই-লাইন, ভিন-রাজ্যের বাসিন্দাদের ভিড়ে এই শহরের বাঙালিত্ব বদলে গেছে, বদলে গেছে আবহাওয়াটাও পুরোপুরি। কলকাতায় আজন্ম বসবাসকারী কোনো বৃদ্ধও এই গ্রীষ্মের মতো এমন দিনরাত এলমেলো ঝোড়ো হাওয়া দেখেননি। মে মাসে দেখেননি শ্রাবণের বৃষ্টি। সব ওলট-পালট, গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
পুরো নামটি কী? কে জানে, মামণির। তার ছবি ও অন্যান্য বিবরণ, আশা করছে জিষ্ণু, আজকালের মধ্যেই এসে যাবে। এসে যাওয়ার পর কী করবে তা ও জানে না। তখনই ভেবে দেখবে।
টাইয়ের নটটা আলগা করে দিল। বড়ো গরম। কোটের বাঁ-পকেটে পিকলুর চিঠিটা। ভারী চিঠি। বড়ো খামে। পিকলুর কী এমন বলার থাকতে পারে যা ও, মুখে বলতে পারল না জিষ্ণুকে? আশ্চর্য!
পার্ক স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে ওয়ালড-এর সামনে দিয়ে যেতে যেতে সেখানেই ঢুকল। এখন ভিড় নেই। দোতলায় উঠে একটি শার্কস-ফিন স্যুপ, আমেরিকান চপ-স্যুই এবং চাইনিজ টির অর্ডার দিয়ে চিঠিটা বের করল পকেট থেকে। বাড়ি গিয়ে আজ আর খাবে না। পরি এখনও ফেরেনি ব্যাঙ্গালোর থেকে। বাড়িটা আর বাড়ি নেই। শিশুকাল থেকে মাতৃ পিতৃহীন হওয়া সত্ত্বেও পরি আর কাকিমার জন্যে মা-বাবার অভাব কখনো বোধ করেনি। পুষির মৃত্যু এবং কাকিমা ও পরির এই হঠাৎ বিপরীতমুখী পরিবর্তন ওকে বড়ো একলা করে দিয়েছে। পিকলুর খলতাও। পিকলুই বলতে গেলে ওর একমাত্র অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল। এইমুহূর্তে জিষ্ণু যতখানি একলা ততখানি একলা ও কোনো দিনই ছিল না।
মামণির নামটি জানলে আজ একটি চিঠি লিখত তাকে। নাম দিত না নীচে। আজকের এই উজ্জ্বল কদম ফুল-ফোঁটা বিকেলের মতোই হত সেই চিঠি।
পিকলুর চিঠিটা খুলল জিষ্ণু।
বৃহস্পতিবার
১১-৫-৮৮
জিষ্ণু, প্রিয়বরেষু,
ভেবেছিলাম তোর সঙ্গে একলা কোথাও বসে, পুরোনো দিনের মতো অনেক অনেক গল্প করব। তোকে অনেক কিছু বলারও ছিল। যা বলার তা তুই-ই সেদিন আমাকে বলেছিলি। একতরফা। আমার কথা শোনার ধৈর্য তোর ছিল না। বলার মতো মানসিক অবস্থাও অবশ্য আমার ছিল না।
একথা সত্যি যে, আমি রেস-এর মাঠে যেতাম নিয়মিত। কিন্তু তোর কাছে যতবার ধার চেয়েছিলাম রেস-এর মাঠের সঙ্গে তার বিন্দুমাত্রও সম্পর্ক ছিল না। বিয়ের পর পরই খুশির গয়না বন্ধক দিয়ে দিয়ে আমি রেস খেলতাম। এই আশাহীন পৃথিবীতে হয়তো রেসুড়েরাই একমাত্র বিশ্বাস করে যে, আশা আছে। তোর সেক্রেটারি পিপির স্বামী সুমন্ত্রও তাই করে। বড়ো ভালো ছেলে সুমন্ত্র। তোর মতো বা তার স্ত্রীর মতো সাকসেসফুল নয় জীবনে। প্রত্যেক রেসুড়েই বিশ্বাস করে যে একদিন, একদিন কোনো বিদ্যুৎগতি চিকন ঘোড়া স্বপ্নের পক্ষীরাজের মতো তাদের জীবনের সব কিছু স্বপ্ন সফল করে তুলবেই তুলবে।
জিষ্ণু, তোর কাছে টাকা ধার করেছিলাম বহুবার। কতবার যে, তা তুই নিজেই ভুলে গেছিস। বার বার মিথ্যে কথা বলেই নিয়েছিলাম। খুকি হওয়ার সময়ে তুই নিজেই টাকা দিয়েছিলি। আমি চাইনি। তোর কাছে আমি চিরঋণী। কিন্তু টাকা মিথ্যে কাজে লাগেনি। তোর টাকা দিয়েই খুশির যে কটি গয়না বন্ধক দিয়েছিলাম, তা ছাড়িয়ে এনে ওকে ফেরত দিয়েছিলাম। দিতে যে পেরেছিলাম তা আজকে মনে করে ভারি ভালো লাগে। খুশিকে খুশি করার মতো খুব বেশি কিছু করতে তো পারিনি। ওকে শুধু কষ্টই দিয়েছি।
তুই আমাকে যতখানি ভালোবাসতিস সেই স্কুলের দিন থেকে অতখানি ভালোবাসা এ জীবনে খুব কম মানুষের কাছ থেকেই পেয়েছি। তোর কাছে মিথ্যে বলার প্রয়োজন আমার ছিল না কারণ আমি জানতাম যে, তোর কাছে চাইলে এবং তুই দিতে পারলে কখনো না করবি না।
তা ছাড়া, জিষ্ণু, তুই বিশ্বাস কর আর নাই কর, আমি ভাবতাম তুই ছাড়া আমার বিপদে আপদে পাশে দাঁড়াবে এমন আর কেই বা আছে? তোর ওপর আমার যতখানি জোর ছিল। বলে জানতাম ততখানি জোর এ-পৃথিবীতে দ্বিতীয় কারো ওপরেই ছিল না। তাই তোর কাছে কোনো কিছু চাইতে কখনোই কোনো সংকোচ বোধ করিনি। তোর বন্ধু যদিও আমিও ছিলাম একমাত্র কিন্তু তুই জানিস যে, আমার বন্ধু ছিল অগণ্য। কিন্তু তারা ছিল আমার ফুটবলের বন্ধু, তাসের বন্ধু, আড্ডার বন্ধু, রেস-এর মাঠের বন্ধু। তাদের কাছে কিছু চেয়ে যদি না পেতাম তাহলে নিজেকে বড়োই ছোটো লাগত। তাই কখনো চাইতে যাইওনি। তোর ওপরে আমার দাবি সম্বন্ধে আমার কোনো দিনই কোনো দ্বিধা ছিল না। সংশয় ছিল না। তোর কাছেও নিজের সম্মান যে, বিকোতে পারে সেকথা সত্যিই ভাবিনি কোনো দিনও।
আমার বিয়ের পর থেকেই খুশিও কিন্তু ব্যাপারটা বুঝত। বলত, থাকবার মধ্যে তো আছে। এক জিষ্ণুদা। তাকে ছাড়া আর কাউকেই আমি ভরসা করি না। বিপদে আপদে সে যা করেছে, করে, তোমার জন্যে তা আমার কি তোমার বাপের বাড়িরও কেউই করেনি। করবেও না।
যত বার তোর কাছ থেকে আমি টাকা নিয়েছি তত বারই ভেবেছি যে, সময়ে না হলেও পরে তোকে টাকাটা শোধ করে দেব। শোধ করতে যে, পারতাম না এমনও নয়। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি ভেবেছিলাম, সত্যিই ভেবেছিলাম যে, তোকে টাকা ফেরত দিতে গেলে তুই খুব রাগ করবি। বলবি, রাখ, রাখ বেশি ওস্তাদি করতে হবে না।
একবারের জন্যেও বুঝতে পারিনি, ভাবি তো নিই যে, আমার নিজের আত্মসম্মানবোধের কারণেও টাকা প্রতিবারই তোকে ফেরত দেওয়ার কথা আমার বলা উচিত ছিল। তোর আছে বলেই যে সহজে নিতে পারি, এই বোকা-বিশ্বাসে ভর করে তোর সমস্ত শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসাও যে হারিয়েছি এখন তা বুঝতে পারি।
ভুল সকলেরই হয় জিষ্ণু। আমার যেমন হয়, তেমন তোরও নিশ্চয়ই হয়। কিন্তু সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত সকলের একভাবে করতে হয় না। তুই যে জিষ্ণুই, অন্য কেউই নোস, এই। ভাবনাটাই আমাকে প্রথম ভুল করাল।
শেষবার তোর কাছে যে-টাকাটা চেয়েছিলাম তা কিন্তু খুকির মুখেভাতের জন্যে চাইনি। সত্যিই তুই বড়ো ব্যস্ত থাকিস। ওর মুখেভাত হয়ে গেছিল গতবছরই। ও কবে যে হয়েছিল তাও তোর মনে ছিল না। সেই সুযোগটা আমি নিয়েছিলাম। আসলে তুই শেষ কবে আমাদের বাড়ি এসেছিলি তাও আমার মনে পড়ে না। আট দশ বছর তো হবেই। তুই তোর অফিসে কি বাড়িতেই যখন আমাকে ডাকতিস, চিরদিন যেমন ডেকেছিস, গেছি। কখনো অভিমান করিনি। তোকে বলিনি যে, আমি তোর মোসাহেব বা চামচে নই, আমি তোর বন্ধু। বন্ধুত্ব হয় এবং থাকে সমতলেই দাঁড়িয়ে, হাতে হাত রেখে; সসম্মানে। বলিনি বা বলতে চাইলেও পারিনি একথা ভেবে যে, তুই হয়তো দুঃখ পাবি সেকথা বললে। তোর কাছে অনেকভাবেই আমি উপকৃত ছিলাম। ভালোবাসার কথা ছেড়েই দিলাম। ভালোবাসা তো ইনট্যানজিবল ব্যাপার। তার আয়তন কল্পনায় বা অনুমানেই থাকে শুধু।
অনেকদিন আমার বা খুশির কোনো খবর করিসনি বা আমাদের বাড়িও আসিসনি বলেই হয়তো তোর এই ভুল হয়েছিল। আমার বিয়ে হয়েছে সাত বছর। খুকির বয়েস হল এক বছর দশ মাস। আমার মেয়ের নাম যে চুমকি তাও হয়তো তুই জানিস না। যদিও বাড়িতে খুকি বলেই ডাকি। তুই সেইজন্যেই বোধ হয় সব সময় কন্যা বলে উল্লেখ করতিস। আমার বউভাতের পর একদিন মাত্র তুই এসেছিলি আমাদের বাড়িতে। মনে আছে? খুশির গান টেপ করে নিয়ে গেছিলি? তার পর আর নয়। যা বলতে এই চিঠি শুরু করেছিলাম সেটাই বলতে পারছি না। চিঠিটা বড়োই এলমেলো হয়ে গেল।
এপ্রিলের পাঁচ তারিখে খুশি চলে গেছে। ব্রেস্ট-ক্যানসার হয়েছিল। আমি একদিন আদর করার সময়ে একটি লাম্প-এর মতো অনুভব করি।
খুশি বলল, ওটা তো বিয়ের আগে থেকেই ছিল। ব্যথা-ট্যাথা তো কিছু নেই। ও নিয়ে তোমার মাথাব্যথা কেন?
তবু প্রায় জোর করেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। মনীষ রে! আমাদের সঙ্গে পড়ত। মনে আছে? ও দেখেই বলল, ডা. সেনের কাছে নিয়ে যেতে হবে। পরদিন অ্যাপয়েন্টমেন্ট করল। পরদিন যখন নিয়ে গেলাম, বোঁচা সেন বললেন, অপারেশান করতে হবে অবসার্ভেশানে রেখে। নার্সিং হোমে সঙ্গে সঙ্গে ভরতি করে নিলেন।
খুশিকে ভরতি করেই উদ্রান্তের মতো টাকার সন্ধানে বেরিয়েছিলাম। এবং সেই উদ্দেশ্যেই সেদিন বহুদিন পর সাঙ্গুভ্যালির আড্ডায় গেছিলাম। পথেই তোর সঙ্গে দেখা হল তুই যখন পুষির মৃত্যুর কথা বললি, আমি রি-অ্যাক্ট করিনি। কারণ সঙ্গে-সঙ্গেই আমার নার্সিংহোমে ভরতি-করানো খুশির কথা মনে হয়েছিল। কেন যে আমি তোকে খুকির অন্নপ্রাশনের গল্পটা বানিয়ে বললাম তাও জানি না। টাকাটা যখন তুই দিলি না, তখন তো আর অন্য গল্প বানানো যেত না! তা ছাড়া, পুষির মৃত্যু তোকে কেমন আঘাত দিয়েছিল তা লক্ষ করেই খুশির অসুস্থতার খবর তোকে দিতে চাইনি। বিশ্বাস কর আর নাই কর।
মনীষ বলেছিল, বম্বেতে নিয়ে যেতে অথবা দিল্লিতে। তার জন্যে অনেক টাকার দরকার ছিল। আমার না হয় অবস্থা ছিল না কিন্তু খুশির দাদাদের অবস্থা খারাপ নয় তা তুই জানিস। কিন্তু যেহেতু দাদাদের মধ্যে খুশির বিয়ের সময়ে কে কত খরচ করবেন তা নিয়ে মনোমালিন্য হয়েছিল, খুশি দাদাদের কাছ থেকে কোনোরকম সাহায্য নিতেই রাজি ছিল না। গয়না বিক্রি করতেও রাজি ছিল না। মেয়ের জন্যেই রেখেছিল সব। খুকির বিয়ের সময়ে লাগবে বলে। খুশি আবারও বলেছিল, জিষ্ণুদাকে বোলো। সে ছাড়া, আমাদের আপনজন আর কেই-ই বা আছে।
অনেকটা উলটোপালটা লিখলাম তোকে। খবরটা তোকে আগে দিতে পারিনি। আমার অন্য যেসব বন্ধু, অন্য জগতের, তাদের তুই চিনিস না। তারাও তোকে চেনে না। চিনলে তাদের কাছ থেকে আমি পুষির খবর পেতাম, তুই পেতিস খুশির খবর। এ-খবরে আজ তোর আর কোনো ইন্টারেস্ট আছে কি না তাও জানি না।
শ্রাদ্ধর সময়েও ইচ্ছে করেই তোকে চিঠি পাঠাইনি। কারণ, তোর ওপরে খুশির বিশ্বাস বড়ো আহত হয়েছিল শেষমুহূর্তে। মৃত্যুর আগে। যদি তুই একটু সাহায্য করতিস তবে হয়তো ওকে বম্বে-দিল্লি নিয়ে যাওয়া যেত। নিয়ে গেলেই বাঁচত এমন নয়। তবে সান্ত্বনা পেতাম কিছুটা।
যাকগে, তুই জানতিস না যখন, তোকে একটুও দোষ দিতে পারি না। দিইওনি। তুই যে, আমাকে আহত করেছিলি সেজন্যেও মনে কিছু করিনি। মনে হয় এ-জীবনে যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। আর কোনো দিনও তোর কাছে টাকা চাইব না। এবং কথা দিচ্ছি আস্তে আস্তে আজ অবধি তুই যত টাকা আমাকে দিয়েছিলি তার সবই শোধ করে দেব। অবশ্য সুদ দিতে পারব না। এটা আমার ঔদ্ধত্য বলে ভুল করিস না। খুশি যেহেতু শেষমুহূর্তে মস্ত আঘাত পেয়েছিল তার আত্মার শান্তির জন্যেই আমাকে তোর সব টাকা ফেরত দিতেই হবে।
তবে আমি জানি যে, টাকা ফেরত দিলেই সব হবে না। টাকাটা কিছুই নয়। তোর কাছ থেকে এ-জীবনে যা পেয়েছি, তা শোধ করার সাধ্য আমার নেই। কখনো হবেও না।
তুই আমাকে বন্ধু বলে স্বীকার হয়তো কখনো আর করবি না। আমিও হয়তো নাও করতে
পারি। তবু এক সময়ের বন্ধুত্বের প্রমাণ হিসেবে ভেঙেপড়া শ্রদ্ধার পাঁচিল টাকার বাণ্ডিল দিয়ে মেরামত করার অসফল কিন্তু সিরিয়াস চেষ্টা করব শুধু এইটুকুই বলতে পারি তোকে।
ভালো থাকিস।
ইতি–তোর একসময়ের একমাত্র
বন্ধু পিকলু
চিঠিটা যখন খুলেছিল এবং প্রথম কিছুটা পড়েছিল তখন মনে হয়েছিল কেঁদে-টেদে ফেলবে হয়তো জিষ্ণু, চিঠিটা শেষ অবধি পড়ে। কিন্তু চিঠিটা পড়া শেষ হলে চিঠির প্রভাব যে তার ওপর তেমন প্রলংকরী হল না, তা লক্ষ করে নিজেও কম অবাক হল না।
পিকলুটা জালি হয়ে গেছে। দু-নম্বর। ওর চিঠির মধ্যেও একশোটা আপাত-বিরোধী কথা। মিথ্যেকথা। হবেই।
মিথ্যের এই দোষ। একটা বললে দশটা আরও বলে ঢাকতে হয়।
জিষ্ণুর কাছে পিকলু সত্যিই মরে গেছে। আজকে পিকলু যাই বলুক ও লিখুক, ও যে একজন মিথ্যেবাদী, ঠগ, তঞ্চক এবং ও যে এতগুলো বছর ধরে জিষ্ণুর হৃদয়ের উষ্ণতার বিনিময়ে তার সঙ্গে এইরকম প্রবঞ্চনা করে গেছে সেই সত্য জিষ্ণুর বুককে ভেঙে দিয়েছে। যে-তঞ্চক, যে-প্রবঞ্চক বন্ধুত্বের মুখোশ পরে কাছে আসে, এবং শুধু আসেই না, অতিদীর্ঘদিন তাকে জড়িয়ে থাকে স্বর্ণলতার মতো সেই লাউডগা সাপের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই রাখার মতো মানসিকতা জিষ্ণু অন্তত আর রাখে না।
না। তবে ও এক গভীর দুঃখ বোধ করল খুশির জন্যে। মেয়েরা এদেশে স্বামী-নির্ভর জীবনই যাপন করে। এখনও যার যেমন স্বামী, তার তেমন জীবন।
জিষ্ণুকে যারা ভালোভাবে চেনেও তারাও আসলে ওকে পুরোপুরি চেনে না। ওর নরম বহিরাবরণের মধ্যে একটি অত্যন্ত কঠিন কোরক আছে। সেই কোরকের মধ্যে যখন তার মনকে সে লুকোয় তখন সেখানে পৌঁছোনো কোনো ভূত বা ভগবানের পক্ষেও সম্ভব নয়।
খুশি চলে গেছে এই কথাটাও, আশ্চর্য! জিষ্ণুকে তেমন আলোড়িত করল না। করবেই বা কেন? বন্ধুর স্ত্রী। এইপর্যন্তই। কোনোরকম মেলামেশা বা আন্তরিকতা তো ছিল না। হতও না তা জিষ্ণুর সঙ্গে। বউভাতের দিনেই তা বুঝেছিল। পিকলুর বুড়ো বয়সের এই ভুলকে ক্ষমা করতে পারেনি জিষ্ণু। পিকলুর বিয়ের পর দিন থেকেই জিষ্ণুর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল পিকলু অতিদ্রুত। দেখা হলেই পিকলুর মায়ের নিন্দা আর তার স্ত্রীর গুণগান। একটা জলজ্যান্ত শিক্ষিত পুরুষমানুষ যে কী করে এমন মেয়েমানুষ হয়ে উঠতে পারে, তা ভাবতে পর্যন্ত পারত না জিষ্ণু। আজকে ওর অফিসের বেয়ারা রামদীন বা পিপি বা চানচানির সঙ্গে ও যতখানি ঘনিষ্ঠ, পিকলু বা খুশির সঙ্গে গত সাত বছরে তার এককণাও ছিল না। উলটে ক্রমাগত মিথ্যাচারের আর পৌনঃপুনিক নগ্ন স্বার্থপরতায় পিকলু নিজেকে জিষ্ণুর কাছ থেকে অনেকই দূরে সরিয়ে নিয়েছিল।
বিল মিটিয়ে ফুটপাথে নেমে ট্রাউজারের দু-পকেটে দুটি হাত ঢোকাবার আগে পিকলুর চিঠিটিকে কুচি-কুচি করে ছিঁড়ে পথের ডাস্টবিনে ফেলে দিল জিষ্ণু। হাওয়ার তোড়ে দু-এক কুচি উড়ে গিয়ে পড়ল পথে। সারিবদ্ধ গাড়ি তাদের চাপা দিয়ে চলে গেল। একটি গাড়ির টায়ারের সঙ্গে সেঁটে গিয়ে একটি কুচি চলে গেল পার্ক সার্কাসের দিকে।
শুধু কলকাতা শহরটাই বদলায়নি। বদলেছে জিষ্ণুও। অনেকখানিই। একটু অবাকই লাগছিল ওর। এই জিষ্ণুকে, শক্ত নিষ্ঠুর জিষ্ণুকে আবিষ্কার করে।
কী মনে করে আবার ফিরল ওয়ালডর্ফ-এর দিকে।
বলল, মে আই ইউস ইয়োর ফোন?
ইয়েস স্যার।
পিকলুর ফোন নম্বরটা কোনো দিনও ভুলবে না। এত সহস্রবার ডায়ালে সেই নম্বরটা ঘুরিয়েছে। সেই স্কুলের দিনগুলি থেকে। এক্সচেঞ্জ বদলেছে বটে, নাম্বার একই আছে।
পিকলুর সেনাইল বাবা ধরলেন। উনি বড়ো ভালোবাসতেন জিষ্ণুকে। মাও। এখন অবশ্য পিকলু তাকে কোন রঙে রাঙিয়ে তাঁদের সামনে উপস্থিত করে রেখেছে জানা নেই। রাখলেও কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। কিছুদিন হলই এই বেপরোয়া, কুডনট কেয়ারলেস অ্যাটিচুডটা এসেছে জিষ্ণুর মধ্যে। ভালো থাকা, ভালো করে নাম কেনা, কে কী ভাবল, কে কী বলল তা নিয়ে মাথাব্যথা ওর আর একটুও নেই। ভালো হয়েও তো এই পুরস্কারই জুটল।
কাকাবাবুই ধরলেন ফোনটা। বললেন, হ্যাঁ। দিচ্ছি পিকলুকে।
তুমি কেমন আছ বাবা? শুনেছ তো সবই।
কাকিমা ধরলেন তার পর। পিকলুর মা।
বললেন, আমার হয়েছে মুশকিল। সঙ্গীহারা হলাম বাবা। ভেবেছিলাম এক। আর হল আর এক।
পিকলু এসে ফোন ধরল।
কী রে? খবরটা জানাতেও পারলি না সময়মতো? জিষ্ণু বলল।
কী হত?
তা ঠিক। আমি তো তোর ঘনিষ্ঠজনের মধ্যে পড়ি না।
পিকলু চুপ করে থাকল।
শোন, খুকি কী পড়ছে? এখনও দিসনি নিশ্চয়ই কোথাও? আমার দ্বারা কোনো রকম উপকার হলে জানাস। আরও একটা কথা তোকে বলা দরকার। তুই লিখেছিস আমাদের বন্ধুত্ব সমতলের ছিল না। তা নিশ্চয়ই ছিল না। কোনো দিনই নয়। কিন্তু উষ্ণতা ছিল অনেক। অসমতলে দাঁড়িয়ে বন্ধুত্ব বাঁচিয়ে রাখার কৃতিত্ব তোর যেমন ছিল, আজকে বলি যে, আমারও কম ছিল না। তোর হীনম্মন্যতায়, তোর তঞ্চকতায় তাকে যদি তুই অস্বীকার করতে চাস তো করিস। আমিও স্বীকার করব না।
পিকলু বলল, আমার এই মানসিক অবস্থায় তুই এতসব বলছিস কেন আমাকে?
পুষির মৃত্যুর কথা শোনার পরই তো তুই ধার চেয়েছিলি আর আমার স্কুটারটা সস্তায় কিনতে চেয়েছিলি। আর কিছু বলেছিলি। ভুলে গেছিস?
তখন খুশি যে, নার্সিং হোমে … আমার অবস্থা…
সেকথাটাও তো বলিসনি। তবে আর কেন? তোর সঙ্গে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই পিকলু। আর কোনো দিনও টাকা নিতে বা দিতেও তোর আমার কাছে আসার দরকার নেই। তোকে দেখে আমার জীবনে বন্ধুত্বর সংজ্ঞা আমি বদলাতে বাধ্য হয়েছি। সব বন্ধুত্বই, একটা বয়েসের পর, ফ্রেণ্ডশিপ অফ কনভিনিয়েন্স। বন্ধুত্ব থাকে ঘামে ভেজা জার্সি-পরে দৌড়ে যাওয়া খেলার মাঠেই। তার পরও হয়তো কিছুদিন। কিন্তু তার পর আর নয়। অ্যাকোয়েন্টেন্স-ই সব। নিছক অ্যাকোয়েন্টেন্স। বন্ধুত্ব করতে হলে হাতে নষ্ট করার মতো অঢেল সময়ও চাই। মনোমতো মানুষ না পেলে জোর করে বন্ধুত্ব করার মতো মনে হয় না। আমি একা থাকতে ভালোবাসি। অসম্পূর্ণ নই আমি তোর মতো যে, টাইম-কিল করতে হন্যে হয়ে রেসের মাঠ, আজে-বাজে মানুষের সঙ্গে বসে সময়কে মারতে হবে আমার।
ওপাশ থেকে পিকলু কট করে লাইনটা কেটে দিল মনে হল।
লাইন কেটে দিয়েছে। জিষ্ণুর কথাগুলো বড়ো দীর্ঘ এবং বক্তৃতার মতো শোনাচ্ছিল নিশ্চয়ই। প্রবন্ধর মতো?
কী করবে? কথা জমে থাকলে অমন হয়ই। ভূমিকম্পর উৎসারের মতো গরম লাভা হয়ে বেরিয়ে আসে। কথা তখন আর ফেরানো যায় না।
জিষ্ণু ফোনের চার্জ দিয়ে পথে বেরিয়ে ভাবল, ভালোই হল পিকলু ফোনের লাইন কেটে দিয়ে জিষ্ণুর সুস্থ বিবেকে যতটুকু প্রাণ বেঁচেছিল তাকেও মেরে দিল। চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে এল। জিষ্ণু এমন ছিল না। নিষ্ঠুর, খুব নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে ও, দিনে দিনে।
চতুর্দিকে মালটিস্টোরিড বাড়ি উঠছে। আকাশ দেখা যাবে না ক-দিন পরে। গাড়ি চালানো যাবে না পথে। হাঁটা যাবে না। ক্যামাক স্ট্রিটে আর একটাও কৃষ্ণচূড়া গাছ নেই। অথচ কলকাতায় বসন্ত এসেছে তা বোঝা যেত এই রাস্তার কৃষ্ণচূড়ার বাহারেই। বদলে গেছে কলকাতা। বালিগঞ্জের পুরো এলাকা, ল্যান্সডাউন, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড, পুরো পার্কস্ট্রিট এলাকা, আলিপুর, নিউ-আলিপুর কোনো এলাকাই আর চেনা যায় না। কলকাতা বদলে গেছে একেবারে। বাড়ি তো নয় এক একটা পাহাড়। বিহারের মতো লু বয় এখন এই শহরে। বাঙালিপাড়াতে বাংলা কথা শোনা যায় না ফুটপাথ দিয়ে হাঁটলে। এটা আর বাঙালিদের শহর নেই। এই বদলের দিনে জিষ্ণু একাই বা একরকম থাকবে কেন? পিকলু যদি এমনভাবে বদলে যেতে পারে, বুকে-জড়ানো বন্ধু যদি তঞ্চক হয়ে উঠতে পারে, তবে সে-ই বা তঞ্চকের সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করতে যাবে কেন?
না। কোনো সহানুভূতি, সমবেদনা কিছুই নেই ওর বুকে পিকলুর জন্যে, খুশির জন্যে এবং ওদের অদেখা কন্যার জন্যেও। না। নেই।
ক-দিন হল মামণির কথা বড়ো মনে হচ্ছে জিষ্ণুর।
ওর এয়ারকণ্ডিশনড অফিসের জানলার বাইরে অনেকগুলো পনসাটিয়ার গাছ আছে। হালকা ধূসর ফিলম-লাগানো জানলার মধ্যে দিয়ে পনসাটিয়ার ফুল আর পাতাগুলোকে অন্যরকম দেখায়। বাইরে ভ্যাপসা গরম। লোক ঘেমে যায়। হাঁটছে আর ঘাম মুছছে দেখতে পায় আর এদিকে ভেতরে আরাম। জানলা দিয়ে তাকালে মনে হয় স্বপ্ন দেখছে। কাজ অবশ্যই বেশি করা যায় এমন পরিবেশে। তবে যারা এমন পরিবেশ পায় না কাজ করার জন্যে তাদের ওপর অনেক সময়েই অবিচার করা হয়ে যায়। শত ঐকান্তিকতা থাকা সত্ত্বেও দরদর করে ঘামতে ঘামতে বেশি কাজ করা যায় না। মেজাজও খারাপ হয়ে থাকে। খিটখিটে হয়ে যায় স্বভাব।
আজ খুবই ভোরে এসেছিল অফিসে। টেলেক্স মেসেজগুলো দেখতে দেখতেই চোখে পড়ল কাশবেকারের মেসেজ আর এম-এর কাছে। এম ডি ওয়ান্টাস জিষ্ণু টু মিট কাস্টমারস ফ্রম দ্য কন্টিনেন্ট। ট্যুওর এক্সপেকটেড টু লাস্ট ফর আ মান্থ। হি মে টেক হিজ ওয়াইফ ইফ হি ডেজায়ার্স। দ্যাট ট্যু অন দ্য কোম্পানি।
এইবারে ইনকামট্যাক্স অ্যাক্টে এক্সেপোর্টারদের জন্যে যেসব সুযোগসুবিধে দেওয়া হয়েছে। তাতে কোম্পানির ওপরমহল খুবই খুশি। সেই খুশির ছটা ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।
ওয়াইফ-এর কথায় জিষ্ণু একা ঘরে মুখ বিকৃত করল। পুষির কথা মনে পড়ে দুঃখ হল খুব। আর পরির কথা মনে পড়ায় রাগ।
হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ পড়াতে খুবই অবাক হল ও। কাঁটায় কাটায় সাড়ে নটা বেজেছে। পিপি রোজ জিষ্ণু পৌঁছোবার আগেই ঠিক ন-টাতে এসে মেইল দেখে রেখে যায় জিষ্ণুর টেবিলে। সব কিছু ঠিকঠাক আছে কি নেই তাও দেখে। তার পর ঠিক সাড়ে নটাতে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে হেসে বলে, গুডমর্নিং স্যার।
পাঁচ বছর কাজ করছে পিপি ওর কাছে। একদিনও এর অন্যথা হয়নি। পিপির জন্যে এ বছর একটা মোটা ইনক্রিমেন্ট সাজেস্ট করেছে জিষ্ণু বিশেষ করে সেনগুপ্ত সাহেবের কাছে সব শুনে। এখন ও প্রায় আড়াই মতো পায়। পারকুইজিটসও আছে। তবে কাগজ তো টাকাই হয়ে গেল। সত্যিই।
টেলিফোনটা বাজল। ডায়রেক্ট ফোনটা।
ইয়েস।
স্যার?
কান্নাভেজা গলা কোনো নারীর।
কিন্তু কার?
স্যার আমি পিপি। পিপি এই প্রথম বার সকালে জিষ্ণুকে গুডমর্নিং বলল না।
বল পিপি। আই ওয়াজ ওয়াণ্ডারিং। কী হয়েছে? এলে না কেন?
স্যার। আপনি একবার আমার বাড়িতে আসবেন এক্ষুনি?
তোমার বাড়িতে? কেন? কী হয়েছে?
এখানে কথা বলুন স্যার।
একজন পুরুষের গলা শোনা গেল। তিনি রিসিভারটা পিপির হাত থেকে নিলেন বোঝা গেল।
জিষ্ণুর মস্ত দোষ এই যে, ও আগ বাড়িয়ে কথা বলে। ও-প্রান্তর কথা না শুনেই বলল, কে? সুমন্ত্রবাবু? আপনার সঙ্গে তো আমার কোনো দিনই আলাপই হল না আজ পর্যন্ত, একদিন…
পুরুষ কণ্ঠ বললেন, আমি সাব-ইনসপেক্টর ঘোষ বলছি। তালতলা থানার। সুমন্ত্রবাবু হ্যাঁজ কমিটেড সুইসাইড। আপনি মিসেস সেন-এর বস। একবার আপনার আসা দরকার।
টেবিল থেকে পেনসিলটা তুলে নিয়ে কামড়াতে কামড়াতে জিষ্ণু বলল, ঠিকানাটা?
আপনার অফিসে নেই?
এসব তো পিপি, মানে মিসেস সেনের কাছেই থাকে। আপনি একটু বলুন আমি লিখে নিচ্ছি।
একা যেতে ভয় করতে লাগল জিষ্ণুর। শুধুমাত্র থানা-পুলিশের জন্যেই নয়। ইলেকট্রিক
ফার্নেস-এর ওই লাল গরম আভা আর মানুষের মাংস পোড়া গন্ধর কথা মনে হল। এই সেদিনই তো গেছিল। আবার? এত তাড়াতাড়ি? দাহ করার চেয়ে কবর দেওয়া বোধ হয় ভালো। স্মৃতি থাকে। গাছ থাকে বড়ো বড়ো। কবরের ওপরে কিছু লেখা থাকে। সেখানে গিয়ে, তাকে মনে পড়লে, তার জন্মদিনে একটুক্ষণ বসা যায়; ফুল দেওয়া যায়। ফুল ঝরে পড়ে তার ওপরে চারপাশের গাছগাছালি থেকে। কিন্তু জলজ্যান্ত একটা মানুষকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে আসার কথা ভাবলেও গা-টা কেমন কেমন করে। একবার ভাবল, সেনগুপ্ত সাহেবকেও সঙ্গে নিয়ে যায়। তাঁর পি এ কে শুধিয়ে জানল যে, তিনি তখনও আসেননি। হয়তো ওখানেই গেছেন।
আর এম কে বলে জিষ্ণু বেরোল। বাড়িটা তো গাড়ি থেকে দেখাই ছিল একবার। ঠিকানা সঙ্গে নিয়ে নেওয়াতে ড্রাইভার বসন্তর খুঁজে বের করতে অসুবিধে হল না। সময়ও লাগল না। বাড়ির সামনে একটা ছোটো জটলামতো হয়েছে। পুলিশের ভ্যান, ও সি-র জিপ। তা ছাড়াও তিনটি প্রাইভেট গাড়ি। গরিব মরে গিয়েই তার প্রতিবেশীর সম্মান কুড়িয়ে যায় শেষবারের মতো তার মৃতদেহ দেখতে আসা আত্মীয়-বন্ধুদের গাড়ির সংখ্যার ঔজ্জ্বল্যে। মৃতের জীবদ্দশায়, যে বাড়িতে কোনো গাড়ি কখনোই থামেনি, মৃত্যুতে সে-বাড়ির দরজাতেই গাড়ির লাইন পড়ে যায়। ব্যাপারটা একটু বিসদৃশ লাগে জিষ্ণুর চোখে।
জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল এমন একটা গান গাইতেন কাকিমা প্রায়ই! গানটার কথা খাটে না এক্ষেত্রে তবু গানটার কথা মনে পড়ে গেল ওর, গাড়ি থেকে নামতে নামতে।
পিপি একেবারে ভেঙে পড়েছিল। হালকা নীলরঙা নাইটির ওপরে একটা গাঢ় নীল-রঙা হাউসকোট পরা। ও জিষ্ণুর হাত ধরে ওকে শোয়ার ঘরে নিয়ে গেল। দেখে মনে হল ঘরটা কোনো শিশুর খেলার এবং শোওয়ার ঘর।
এই ঘরে?
এই ঘরেই।
কেন এমন হল?
স্যার, ডিভোর্সের রায় পেয়েছি কাল। জজসাহেব ডিভোর্স দিয়েছেন এবং মেয়ের। মালিকানাও আমাকেই দিয়েছেন। আমার উকিল খুবই ভালো ছিলেন।
মেয়ে কোথায়?
মেয়ে?
বলেই পিপি একেবারে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
চেয়ারে বসা ওসি বললেন, মেয়েকে আগে খাইয়ে তার পর নিজে খেয়েছেন। মেয়েকে বুকে জড়ানো অবস্থাতেই ডেডবডি দেখি আমরা।
কী? কী খেয়েছিলেন?
জিষ্ণুর গলাটা শুকিয়ে এল।
হেভি ওভারডোজ অফ স্লিপিং পিলস। মানে, আমরা তাই সন্দেহ করছি। রোজই নাকি উনি খেতেন। ড্রিঙ্ক করার পরও। তবে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে…।
ব্যাপারটা একটু শর্ট-কাট করা যায় না?
কমপ্লিকেটেড কেস। ডিভভার্সের মামলা চলছিল। মেয়েকে কে পাবেন তা নিয়েও।
পিপি ওর শোয়ার ঘরে এসে জিষ্ণুকে বলল, আমিই ডিভোর্স চেয়েছিলাম, মেয়েকেও আমিই চেয়েছিলাম। সুমন্ত্র তো প্রথমে বিশ্বাসই করেনি। আমি নিজে বললেও করেনি। বলেছিল, তুমি ছাড়া বাঁচলেও বাঁচতে পারি কিন্তু তিতি ছাড়া বাঁচব না। তুমি আমার এমন সর্বনাশ কেন করবে? আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি, কোনো কিছুতেই বাধা দিইনি।
বলেই আবার ভেঙে পড়ল কান্নায়।
ফোনটা কোথায়?
ওই তো।
জিষ্ণু হীরুকাকাকে ফোন করল পুলিশে হীরুকাকার যে বন্ধু আছেন তাঁকে বলতে। প্রিয় মেয়ে তিতিকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে ছিল সুমন্ত্র। দুটি শরীরই শক্ত হয়ে গেছিল। মেয়েকে বাবার বুক থেকে ছাড়ানো যাচ্ছিল না নাকি! ওসি বলছেন স্লিপিং ট্যাবলেটস। পিপিও তাই বলছে। রোজ রাতেই খেত ড্রিঙ্কস-এর পরও।
নম্বরটা পেতে সব বলল জিষ্ণু হীরুকাকাকে।
তার পর বলল কাকিমাকে একটু পাঠিয়ে দেবে হীরুকাকা এখানে?
আমি ওঁকে পৌঁছে দেব। মনে হচ্ছে পিপির আত্মীয়-স্বজন কেউই নেই। প্রতিবেশিনী আছেন অবশ্য দু-একজন।
হীরুকাকা একটু চুপ করে থেকে বললেন, আমিই হেমকে পৌঁছে দিয়ে আসছি। কিন্তু এতটুকু মেয়ের আর কেউ নেই কেন? আপনজনদের সুখের দিনে কাছে না রাখলে দুখের দিনেও কেউই থাকে না।
তার পর জিষ্ণু বলল, ছেড়ে দিচ্ছি। আসছ তাহলে। তোমার বন্ধুকে ফোনটা করেই তার পরই বেরিয়ে। আমি মর্গে যাচ্ছি।
ফোনটা ছেড়ে পিপিকে বলল, কাজ করবেন ক-দিনে? চোদ্দো দিনে?
কাজ করার তো কেউ নেই স্যার? কাজ কে করবে?
ছুটি ক-দিনের বলব? অফিসে?
ছুটি? ছুটি দিয়ে কী করব? কালই অফিসে যাব আমি। বাড়িই রইল না। এ-ফাঁকা বাড়িতে একা থেকে কী করব?
কালই?
ইয়েস স্যার।
আমি তাহলে মর্গের দিকে এগোই। পিপি মাথা হেলাল।
অন্যমনস্ক গলায় বলল জিষ্ণু।
মর্গ-এর দিকে অফিসের ভিড়ের মধ্যে শামুকের গতিতে এগোচ্ছিল গাড়ি। জিষ্ণু ভাবছিল, সত্যিই একজন মানুষও বোধ হয় পরিপূর্ণ সুখী নয় এখানে। সুখী হতে দেয় না এই শহর। বড়ো নিষ্ঠুর, ইট-কাঠ-পাথরের কংক্রিটের পাহাড়ে ভরে গেছে এই কলকাতা।
জিষ্ণু পৌঁছোনোর আগেই হীরুকাকার বন্ধু মর্গ-এ ফোন করে দিয়েছিলেন। কেসেও মার্ডারের কোনো গন্ধ ছিল না। তবু পোস্টমর্টেম তো করতে হলই। মর্গ থেকে বেরিয়ে সুমন্ত্রর ছোটোভাই জয়ন্ত, হীরুকাকা এবং জিষ্ণুও ডেডবডি দুটো নিয়ে সোজাই শ্মশানে এসেছিল। অফিসের কেউ কেউ, জিষ্ণুর যে আর্দালি, পিপিরই বলতে গেলে, সে, একজন টেলিফোন অপারেটর, এবং আর এম নিজে এসেছিলেন। আশ্চর্য হল সেনগুপ্তদাকে না দেখে। পিপির মেয়েটি তিতি, ভারি সুন্দরী। একটি পিঙ্ক ফ্রক পরেছিল। ফুলের মতো দেখাচ্ছিল তাকে।
পিপিও শ্মশানে এসেছিল। গাড়িতেই বসেছিল, কাকিমার সঙ্গে। যখন টার্ন এল তখন ওকে ডাকা হল, যদি শেষ দেখা দেখতে চায়। পিপি বলল যাবে না ওখানে। স্বামী অথবা মেয়ে কাউকেই সে দেখতে চায় না। সুমন্ত্রর ভাই জয়ন্ত মুখে আগুন দিল।
ইলেকট্রিক ফার্নেসের দরজা খোলা হল। লাল হয়ে গেল জায়গাটা। উষ্ণতা এবং লালিমার ছোপ লাগল গায়ে-মুখে। তাপ। সুমন্ত্র এবং তার মেয়ে একটি বড়ো এবং একটি ছোটো বাঁশের চালিতে নতুন চাঁদরের ওপর শুয়ে ডোমেদের এক ধাক্কায় যখন আগুনের মধ্যে চলে গেল তার পূর্বমুহূর্তে জিষ্ণু অপরিচিত সুমন্ত্রর মুখে যেন এক চিলতে হাসি দেখতে পেল। মনে হল, সুমন্ত্র যেন বলছে : রেস-এ চিরদিন হারলে কী হয়, এই রেস-এ কেমন জিতে গেলাম, পিপি দেখেছ?
শ্মশান থেকে পিপিকে ওর বাড়ি পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফেরার সময়ে কাকিমা জিষ্ণুকে বললেন, ওর তো কেউই নেই দেখছি। আমিই থাকি ওর কাছে একটা দিন?
জিষ্ণু বলল, থেকে কী করবে? ও তো বলছে অফিস করবে কাল থেকে।
সে কী রে? বলিস কী?
এবারে পুজোতে গোয়া যাওয়ার জন্যে ছুটি নিয়েছে সেটা কমাতে চায় না। বলছিল আমাকে।
কী যে বলিস তুই? আজকালকার মেয়েদের রকম-সকমও আলাদা। বুঝি না ওদের। হীরুকাকা বললেন, ওরা অন্যরকম। সন্দেহ নেই। তা বলে ওরা যে খারাপ সেকথা বলা যায় না।
স্বামী-স্ত্রী কি একঘরে শুত না? মনে তো তেমনই হল। হেম বললেন, কৌতূহলী গলায়।
শুত না বলেই তো মনে হল। জিষ্ণু বলল।
তবে কি ওদের মধ্যে ভালোবাসা…
হীরুকাকা বললেন, ভালোবাসা কি দেখা যায়? না, তা দেখানোর জিনিস?
এবার গাড়িটা একটু থামাতে এল। মুখটা শুকিয়ে গেছে। পান খাব জর্দা দিয়ে। হীরুকাকু বললেন। কত কিছুই দেখতে হল একজীবনে।
তুমি বোসো। বসন্ত নিয়ে আসবে পান।
তা ভালোই। ঠাণ্ডা গাড়িতে একবার উঠে বসলে আর নামতে ইচ্ছে করে না।
তোমাদের দুজনকেই একটা করে দেড়টনের এয়ার কণ্ডিশনার কিনে তোমাদের দুজনের বেডরুমে লাগিয়ে দেব। হীরুকাকার বাড়িতে তো দরকারই। তা ছাড়া তোমাদেরই তো আরাম করার সময় এখন।
পাগল হয়েছিস তুই? হীরুকাকা বললেন। এমনিতেই অমাবস্যা পূর্ণিমায় বাতের ঠেলায় বাঁচি না আবার এয়ার কণ্ডিশনার। সব কিছুরই সুসময় থাকে রে বেটা। সময় চলে গেলে কোনো কিছুরই দাম থাকে না আর। এই দেখ তোদের ওই পিপির স্বামী সুমন্ত্র তো মেয়েটাকে পর্যন্ত নিয়ে সময় থাকতে থাকতেই চলে গেল।
হেম বললেন, কে বলতে পারে? ওর হয়তো সময় হয়েছিল। কখন যে কার সময় আর কার অসময় তা বলা ভারি মুশকিল। মনটা বড়োই খারাপ হয়ে গেছে। আমি ভাবতেও পারছি না যে, পিপি কাল থেকে অফিস করবে।
করবে। কাজের মতো বন্ধু আর নেই। কাজ সব ভুলিয়ে দেয়। তা ছাড়া এখন থেকে ওর অফিসইতো সব হবে। যতক্ষণ যে-মানুষ থাকে তার দাম তো বোঝা যায় না। অতিসস্তা বলে মনে হয়। চলে যাওয়ার পরই বুঝিয়ে দিয়ে যায়, তার দাম কত ছিল।
সুমন্ত্রর কথা। মেয়ের কথাও। সকলের কথাই।
তোমরা তো খাওয়া-দাওয়াও করোনি সারাদিন! তোমাদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আমি একটু অফিসে যাব।
এই অসময়ে? সারাদিন তো খাওয়াও হল না তোর।
অফিসের ধারে-কাছেই খেয়ে নেব কিছু। তবে আজ খাবার ইচ্ছে নেই।
গলি থেকে বেরিয়ে জিষ্ণু ভাবল অফিসে না গিয়ে তারিণীবাবুর বাড়িতেই যায়। এরকম ওর কখনোই হয়নি আগে। পুষির সঙ্গে আলাপ হওয়ার পরেও নয়। মামণি নামক মেয়েটি যেন ওকে একেবারেই পেয়ে বসেছে। অথচ তাকে কতটুকুই বা দেখেছে জিষ্ণু? একঝলকেরই দেখা।
হঠাৎ কী মনে করে জিষ্ণু বলল, বসন্ত, অফিসেই চলল। বুঝলে?
তারিণীবাবুর বাড়ি এমনিতেই যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। মাস ঘুরে এল। ভাবল, পরশু শনিবার ছুটির দিন আছে। সেদিনই যাবে। শনিবার রাতে পরি ফিরবে ব্যাঙ্গালোর থেকে। বলছে যদি রেস-এ যায় তবে রবিবার ফিরবে। ওদের কোম্পানির রেজিস্টার্ড অফিস কলকাতাতে হলেও আসল অপারেশনস ব্যাঙ্গালোরে। ওখানের যে টপম্যান সে ব্যাঙ্গালোরের রেসিডেন্ট। তবে লোক ম্যাঙ্গালোরের। পি কুরুভিল্লা। দারুণ হ্যাণ্ডসাম আর প্র্যাগম্যাটিক মানুষ নাকি সে। শুনেছে, পরির কাছে। কিন রেস-গোয়ার।
পাঁচটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। অফিসে পৌঁছে ডাকটাক দেখে ও একটা ফাইল নিয়ে বসেছিল। সলিসিটরের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল আজই। যাওয়া হল না। নতুন অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে বলেছে ল অফিসারকে। এককাপ কফির অর্ডার করেছে এমন সময়ে হঠাৎ পিপি কিছু না বলেই ওর ঘরে ঢুকল! পিপি বলল, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ স্যার! আপনি এবং আপনার কাকা-কাকিমা যা করেছেন কেউই করে না তা!
আজকে আপনি এলেন কেন?
আমার পনেরো হাজার টাকার ভারি দরকার।
কী জন্যে? শ্রাদ্ধ তো করছেন না।
না। সুমন্ত্রর এক রেস-এর মাঠের বন্ধু টাকা চাইতে এসেছিল। দশ হাজার। আবারও আসবে। বলেছে, ফর ওল্ড টাইমস সেক। টাকাটা সুমন্ত্র নাকি আজই দেবে বলেছিল। ওর কাছে নাকি ধার ছিল। টাকাটা আজ তার চাই-ই। ভদ্রলোকটি সাংঘাতিক।
আপনার চেয়েও বেশি বিপদ?
অবাক হয়ে জিষ্ণু বলল।
আমার চেয়েও
সুমন্ত্রবাবুর সেই রেসের মাঠের বন্ধুর নাম কী?
পিকলু স্যার। আপনারও বন্ধু।
পিকলু? সে আপনার স্বামীর বন্ধু নাকি? কই? আমি তো..।
আর পাঁচ?
আর পাঁচ দিতে হবে সুমন্ত্রর ভাই জয়ন্তকে। আজই রাতের ট্রেনে ও জামালপুরে চলে যাবে। সেখানে সুমন্ত্রর মা আছেন। জয়ন্তদের তো শ্রাদ্ধ করতে হবে।
কী করে এখানে জয়ন্ত?
ওর একটা ছিটকাপড়ের দোকান আছে কলেজ স্ট্রিটের কাছে।
আপনাকে পাঁচ হাজার এক্ষুনি দেওয়ার বন্দোবস্ত করছি। সুমন্ত্রর ভাই জয়ন্তকে দেওয়ার জন্যে। আপনি টাকাটা নিয়ে আমার গাড়ি নিয়েই এক্ষুনি চলে যান আর পিকলুবাবু যদি আপনার কাছে আসেন তো এখুনি তাঁকে এখানেই ওই গাড়িতেই আমার কাছে ফেরত পাঠান। ওঁকে আমি নিজে টাকা দেব।
ইন্টারকম-এ সুব্রহ্মনিয়মকে ডাকল জিষ্ণু।
বলল, একটা আই ও ইউ। আমার নামে ভাউচার করে পাঁচ হাজার টাকা এক্ষুনি আমার ঘরে পাঠিয়ে দিন।
কিছু খাবেন পিপি?
না :
একটা কোল্ড ড্রিঙ্ক?
না স্যার একটু জল খাব।
জিষ্ণু নিজে উঠে গিয়ে নিজের গ্লাস নিয়ে গিয়ে করিডরের ওয়াটার কুলার থেকে জল নিয়ে এসে দিল পিপিকে। যদিও বেয়ারা ছিল এবং তাকে স্বচ্ছন্দেই ডাকতে পারত। আজ একটি বিশেষ দিন। পিপির জন্যে যে ও দুঃখিত সেটা বোঝাল।
তৃপ্তি করে জলটা খেল পিপি।
সুব্রহ্মনিয়ম নিজেই এল ভাউচার সই করাতে।
জিষ্ণু বলল, কাল আমি, আর এম এর সঙ্গে কথা বলব যাতে মিসেস সেনকে এক্স-গ্রাসিয়া কিছু দেওয়া যায়। আফটার অল ওঁর স্বামী তো আর টাইমলি মারা যাননি। বড়োই বিপদে পড়েছেন মহিলা।
ওকে স্যার। বলে, সুব্রহ্মনিয়ম ভাউচার সই করিয়ে নিয়ে চলে গেলেন।
আমি এবার চলি।
যাওয়া নেই। আসুন।
ঠাকুমা দিদিমারা যেমন করে বলেন, তেমন করে বলল জিষ্ণু।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পিপি বলল, স্যার, ইউ আর ভেরি ভেরি কাইও ইনডিড। আপনি আমার জন্যে অনেক করলেন আজ। কোনো দিনও ভুলব না জীবনে।
জিষ্ণু ঘর ছেড়ে গাড়ি অবধি এল। দরজা খুলে উঠিয়ে দিল পিপিকে। ভারি সুন্দর দেখাচ্ছিল ওকে একটি অতিসস্তা কালো পাড়ের কালো আঁচলার তাঁতের শাড়িতে। চান করে এসেছে। সেনগুপ্ত সাহেবের কাছে সব শোনার পর থেকে পিপির সম্বন্ধে ওর দিকে ভালো করে তাকাবার কোনো ইচ্ছেই হয়নি জিষ্ণুর। আজই প্রথম ভালো করে তাকাল ওর দিকে। মেয়েটার চোখে তো কোনো পাপ নেই।
অফিসে ফিরে নিজের জিনিস গোছগাছ করে নিল। আজকে একটু হাঁটা দরকার। মাথাটা ছাড়বে। সুমন্ত্র সেই লাল-রঙা স্লিপিং পায়জামা, আর বোতামহীন নোংরা আদ্দির পাঞ্জাবি আর রবারের চটি পরে যে লাল সিমেন্টে বাঁধানো সিঁড়ির ওপরে পা ছড়িয়ে বসে রেসের বই দেখছিল সেই ছবিটি জিষ্ণুর চোখে চিরদিনের মতো আঁকা হয়ে রয়েছে। কিছু কিছু অনাত্মীয়ের, অতিসাধারণ ঘটনার ছবিও এমনি করে রয়ে যায় মাথার ভেতরে আমৃত্যু। যেমন আছে, শিবুবাবুর স্টেশনারি দোকানের সামনে হেঁটে আসা মামণির ছবি। সকাল থেকে রাতে কত কীই তো দেখে রোজ। কিন্তু সেসব ছবির খুব কমই দেখা যায়।
জিষ্ণু আরও পনেরো মিনিট অপেক্ষা করল। ও জানত যে, পিকলু আসবে না। যে-মানুষ অন্যর মৃত্যুর দিনে কোনো অনাত্মীয় যুবতীর কাছে মিথ্যে ধারের দাবি নিয়ে এসে দাঁড়াতে পারে সে আর মানুষ নেই। ও অনুমান করতে চেষ্টা করছিল, সুমন্ত্রর সঙ্গে পিকলুর যোগাযোগের কথা জেনে যে, ঠিক কতখানি অধঃপতন হয়ে থাকতে পারে পিকলুর। পিপির সঙ্গেও কি ওর… মিনিবাসের ভোঁতকা ড্রাইভারের মতোই পিকলুকেও বোধ হয় এই পৃথিবী থেকে ডিসপোজ-অফ করে দেওয়া দরকার। পিকলু যদি আজ সত্যিই আসে তবে পিকলুর কপালে দুঃখ আছে। জিষ্ণু বড়োই অধৈর্য হয়ে পড়েছে। সহ্যশক্তি আর নেই ওর।
ঠিক সাড়ে পাঁচটার সময়ে ও টেলেক্স মেসেজগুলো দেখে তিনটি ইম্পর্ট্যান্ট টেলেক্সের উত্তর পাঠিয়ে ব্রিফকেস হাতে করে বেরোল। ও যেই অফিস-কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়েছে দেখে বসন্ত ফিরছে গাড়ি নিয়ে। পিকলু পেছনের সিটে বসে।
পিকলু দরজা খুলে নেমে বলল, হাই।
জিষ্ণু একটু অবাক হল। বলল, কী রে!
পিকলু বলল, ইউ আর গ্রেট! টাকাটা জলেই চলে যাচ্ছিল। ভাগ্যিস তুই ছিলি মধ্যে। আমি জানতুম যে, পিপির সঙ্গে তোর বেশ একটা ভালো রিলেশন…। অবশ্য এও জানতুম যে, সেটাই শেষপর্যন্ত বাঁচাবে আমাকে।
ড্রাইভার বসন্তকে ছেড়ে দিয়ে জিষ্ণু বলল, চল এগোই।
টাকাটা?
আমার ব্রিফকেস-এ আছে।
ফাইন।
তুই কি ড্রিঙ্ক করেছিস? পিকলু? গন্ধ পাচ্ছি।
হ্যাঁ। একটু। কেন? ড্রিঙ্ক করা কি অপরাধের? দেখ, প্রথম তো এই প্রায় ব্যাক-ডেট হওয়া টাকাটা ফিরে পাবার আনন্দ। তার ওপর আজ শিশির মঞ্চে একটি কবি সম্মেলন আছে। আমি কবিতা পাঠ করব সেখানে। একটু খেয়ে না গেলে, পা না-টললে লোকে শালা আজকাল কবি বলে মানতেই চায় না। পাবলিক-এর বড়োই অবনতি হয়েছে।
তোর কবিতার নাম কী?
জিষ্ণু।
বাঃ। আমার শ্রাদ্ধ করেছিস তা হলে?
অবিমিশ্র খিস্তি নয়। তবে তোকে নিয়েই লেখা। গুণাবলিও আছে।
কথা ঘুরিয়ে জিষ্ণু বলল, তোর খুকি কী করছে রে?
অনেক খুকিরাই যা করে। ইজের পরে ক্যারাম খেলছে। লুডো খেলছে। কিশলয় পড়ছে। বড়ো হলে পাড়ার লোকের দেওয়া আইসক্রিম খাবে।
থাম তুই।
জিষ্ণু ধমক দিয়ে বলল।
তার পর বলল, চল, ট্যাক্সি নিয়ে তোকে শিশির মঞ্চে পৌঁছে দিই।
গ্রেট। তা পিপিকে কতদিন কেপ্ট রেখেছিলি। আমি শুনলাম তোরই প্ররোচনাতে ও ডিভোর্স চেয়েছিল।
তোকে কে বলল?
জানি রে জানি। সব জানি।
মুখ সামলে কথা বল।
তা তুইও তো কাজ-কর্ম সামলে করলেই পারতিস।
দেখ পিকলু। আমার ক্যারাক্টার-অ্যাসাসিনেট করে তোর লাভ হবে না কোনো।
চরিত্র বলে কিছু আছে এখনও তোর? নিজের বোন, সেক্রেটারি কাউকেই তো ছাড়িস না।
পিকলু, তুই আমার কাছে মার খাবি আজ।
মারটা নিছকই জান্তব শক্তির ব্যাপার। কবি মারকে ভয় পায় না।
তোকে একটা কথা বলছি। তুই কোনো দিনও আর পিপির কাছে গিয়ে তাকে বিরক্ত করবি না।
কেন? তোর রাঁড় বলে?
পিকলু, তোকে আমি সাবধান করছি।
চুপ কর। তোকে আমি থোড়াই ভয় পাই।
ভয় পাবি, যদি কথা না শুনিস। তোকে জেলে ভরব, স্কাউন্ড্রেল সুইগুলার।
পুষিকে যে মিনিবাসের ড্রাইভার মেরে ফেলল তাকেই জেলে ভরতে পারলি না তার আমাকে! ওসব বড়ো বড়ো কথা আমাকে বলিস না।
তোকে আমি খুন করে ফেলব পিকলু।
কর না। জেলে যাবি। খুশিকেই তুই মেরে ফেললি। আমার আর কোনো ভয় নেই।
আমি খুশিকে মেরে ফেললাম?
না তো কী?
পরগাছা, আত্মসম্মানহীন জানোয়ার!
টাকাটা দে। ট্যাক্সি থেকে আমি নেমে যাই।
তুই আমার অনেক টাকা মেরেছিস তঞ্চক। তোকে আর একপয়সাও দেব না। আমার টাকা কি হারামের টাকা? কষ্ট করে রোজগার করতে হয়-না তা?
ছাড়।
ছাড়। ওসব বক্তৃতা অন্যকে দিস। সুমন্ত্রর কাছ থেকে পাওনা টাকা তুই দিবি না তো কে দেবে?
তোকে আমি একপয়সাও দেব না।
পিকলু একদৃষ্টে চেয়ে রইল জিষ্ণুর মুখের দিকে।
তার পর হঠাৎ বলল, তাহলে মাল খাওয়া। চারটে খেয়ে এসেছি। আমার আরও খেতে ইচ্ছে করছে।
ঠিক আছে। অলিম্পিয়ায় চল।
চল।
ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে অলিম্পিয়ায় ঢুকল ওরা।
কী খাবি?
ডিপ্লোম্যাট খাচ্ছিলাম। তাই খাব। হুইস্কি।
খা।
তুই?
আমিও খাব।
তুই কী খাবি?
রাম।
কাটলেট খাওয়াবি না? এখানের কাটলেট বড়ো ভালো।
খা।
অলিম্পিয়া থেকে যখন ওরা বেরোল তখন বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। পিকলু প্রায় আউট হয়ে গেছে। জিষ্ণুও অল্পসময়ের মধ্যে চারটে খেয়ে হাই হয়ে গেছে।
ট্যাক্সি নিল একটা।
জিষ্ণু বলল, তুই শিশির মঞ্চে আজ আর যাস না। বরং আগে চল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে একটু হাঁটি। মাথাটা ভারী হয়ে গেছে।
জিষ্ণুর মাথায় ভূত চেপেছিল।
পিকলু বলল, বাঃ। বেশ পুরোনো দিনের মতো। ভালোই বলেছিস। শিশির মঞ্চে না গেলেও হয়। কী হবে গিয়ে? ধস…।
ট্যাক্সিটা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পেছনের গেটে ছেড়ে দিয়ে ওরা নামল।
জিষ্ণু বলল, চল। ওই দিকে চল। নির্জন আছে।
চল। তুই আমার ন্যাংটোপোঁদের বন্ধু। তুই শালা যেকোনো গর্তে যেতে বলবি যাব।
জায়গাটা বেশ নির্জন। মিনিবাসের ড্রাইভার ভোঁতকা যেখানে গুলি খেয়েছিল তার চেয়েও।
জিষ্ণুর মাথার মধ্যে ভূতটা বলল।
জিষ্ণু বলল, রিলাক্স কর। তুই খুব পেন্ট-আপ হয়ে গেছিস।
তুই শালা কমার্শিয়াল ফার্মে কাজ করে ইঞ্জিরিটা পর্যন্ত ভুলে গেছিস। ইংরিজি অবশ্য শিখেছিলি আমার কাছ থেকেই।
হয়তো তাই। গাছে হেলান দিয়ে বোস।
ঠিক বলেছিস। কিন্তু আমার কবিতা? আমার নম্বর ছিল লিস্টে তেইশ নম্বর।
বাইশজন পড়বেন তবে না তেইশ।
রাইট।
ঘুম ঘুম পাচ্ছে একটু! কিন্তু আমার টাকাটা?
পিকলু বলল।
মোটা টাকা পাবার আগে সকলেরই আরামে ঘুম পায়। ক-টা খেয়ে এসেছিলি আমার কাছে আসার আগে?
চারটে।
তাহলে আটটা খেয়েছিস?
হ্যাঁ।
জিষ্ণু নিজের গলার টাইটা খুলে পিকলুর গলায় পরিয়ে দিয়ে খেলাচ্ছলে একটা ফাঁস লাগাল। গাছে হেলান দিয়ে শুয়েছিল পিকলু।
কী করছিস?
টাইটা তোকে দেব।
আহা! মাঝে মাঝে এমন প্রাপ্তিযোগের দিন আসে। কিন্তু টাকাটা?
টাকাটাও দেব।
টাইয়ের নটটা ঠিকমতো বসতেই জিষ্ণুর যেন কী হয়ে গেল। পুষির মৃত্যু, পরির পাগলামি, পিকলুর তঞ্চকতা, মামণির মুখ এবং পিপির অসহায়তা সব মিলেমিশে গিয়ে ওর দুটি হাতে কোনো অদৃশ্য শক্তি যেন জোর জোগাল আর মাথায় জিঘাংসার আগুন। ওর ব্রিফকেসটা পিকলুর পেটের কাছে রেখে তার ওপর নিজের দু-পা তুলে জোরে টানল। জোরে।
দমবন্ধ হয়ে গিয়ে পিকলু বলল, জিষ্ণু আমি কিন্তু মরে যেতে পারি।
একদিন যাবি।
পিকলু একবার উঁক করে আওয়াজ করল। তার পরই ওর জিভটা বেরিয়ে আসতে লাগল।
জিষ্ণুর, পিপির পিঙ্ক-ফ্রক পরা ফুলের মতো মেয়েটির কথা, তিতির কথা মনে হল। পিকলুর মেয়েটাও কি অমনই সুন্দর?
মনে হতেই হাত ঢিলে করে দিল জিষ্ণু। তার পর ছেড়ে দিল ওকে।
অনেকক্ষণ পর গোঙাতে গোঙাতে অবিশ্বাসের গলায় পিকলু বলল, তুই আমাকে খুন করছিলি?
হ্যাঁ। তুই আমাকে অনেক বার খুন করেছিস। যদিও রক্ত বেরোয়নি বা জিভ বেরিয়ে আসেনি আমার।
বিস্ফারিত চোখে পিকলু বলল, এবারে বেরোবে। তোর বড় বাড় বেড়েছে জিষ্ণু। তোকে আমি খুন করব একদিন।
পিকলু গাছতলাতেই পা ছড়িয়ে বসে রইল। ওর উঠতে সময় লাগবে।
জিষ্ণু যখন উঠে পড়ে চলে আসছে, পিকলু আবারও বলল, টাকাটা দিবি না তাহলে?
জীবনেও নয়। কোনো টাকাই নয়। তুই আমার সামনে আসিস না কোনো দিন। তুই আমাকে নষ্ট করে দিয়েছিস, আমার ভালোত্ব, বিশ্বাস, সব। কোনো দিনও না। আমি মরলে তুই শ্মশানেও আসিস না। শুনেছিস?
হুঁ।
পিকলু বলল।
জিষ্ণু সার্কুলার রোডে এসে একটি ট্যাক্সি ধরল। ট্যাক্সি ধরে পিপির বাড়ির ঠিকানা বলল।
কেন যে, তা ও জানে না। ওর ভয় হল, পিকলু যদি পিপির কাছে যায় এখন? একা বাড়িতে আছে। পিপির জন্যে ভয় হল অথচ পিপি ওর কেউই নয়। আশ্চর্য!
.
১২.
পিপির বাড়ির সব আলোই প্রায় নিভোনো। অথচ রাত মোটে সাড়ে আটটা। একটি মৃদু আলো জ্বলছে বেডরুম থেকে।
কলিং বেল টিপল, লাল সিমেন্টের মেঝের তিন ধাপের ওপরের ধাপের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে।
একটু পর পিপি নিজেই এসে দরজা খুলল।
বলল, আপনি, স্যার? কী বলব, আপনাকে আমি ফোন করতে যাচ্ছিলাম। আমার বড়ো ভয় করছে আজ রাতে। একা একা একা থাকতে।
জিষ্ণু বলল, পিপি। আমি ভগবান নই। আমি সুমন্ত্রর চেয়েও খারাপ। আমি অনেক মদ খেয়ে এসেছি। আমিও একা পিপি। খুব একা। আমারও বড়ো ভয় করে।
পিপি বোধ হয় আবারও চান করেছিল। ভারি গুমোট গরম আজকে। একটু শুধু পাউডার ছড়িয়ে দিয়েছিল গায়ে।
পিপি বলল, পিকলুবাবুকে টাকাটা দিলেন?
না। দিইনি। দেব না। আমি খুন করব ওকে।
তার পরই লজ্জিত হয়ে বলল, আমি মাতাল হয়ে গেছি পিপি। আমি এখন … তোমার মানে, আপনার, তোমার এখন বিশ্বাস করা উচিত নয়।
কী করব? বিশ্বাস কাউকেই করে যে বাঁচাও যায় না।
একটু জল খাব।
পাখাটার নীচে বসুন। এনে দিচ্ছি।
জল খেয়ে জিষ্ণু বলল, তুমি সারারাত একা থাকবে। সরি আপনাকে তুমি বলছি। নেশা হয়ে গেছে আমার।
তুমিই বলবেন। কেন বলবেন না? না। সারারাত একা থাকব না। একটু পরেই পারুলদি আসবেন দোতলা থেকে। আমিই তো ইনডায়রেক্টলি খুন করেছি সুমন্ত্র ও তিতিকে। পাড়ার লোকে কেউ তো আমাকে ভালো বলেননি, বলবেনও না। পারুলদির স্বামীও আত্মহত্যা করে মারা গেছিলেন। পাঁচ বছর আগে। অন্য একটি মেয়েকে ভালোবেসে। পারুলদি একটু আগেই বলছিলেন, আত্মহত্যা করে ভীরুরা।
তাই? কে জানে?
একটু চুপ করে বলল, আমি কি কাকিমাকে নিয়ে এসে তোমার কাছে রেখে যাব?
না না। আমি আজ পারুলদির সঙ্গেই থাকব। আমার ঘুম তো হবে না। তিতি সুমন্ত্র ওদের সঙ্গে অনেক কথা আছে আমার। চমৎকার মহিলা কিন্তু আপনার কাকিমা।
পাশের ঘর থেকে ফুল এবং ধূপের গন্ধ আসছিল।
পিপি বলল, পারুলদি আসা অবধি থাকুন। তাহলেই হবে।
ঠিক আছে।
আপনাকে আমার অনেক কথা বলার আছে। কখনো সুযোগ পাইনি। সেনগুপ্ত সাহেব বহুদিন ধরেই আমার নামে সকলকেই যা-তা বলে বেরিয়েছেন। প্রতিবাদ করব কার কাছে? কেউ তো জিজ্ঞেস করেনি আমাকে কোনো দিন। ওই মানুষটা, আপনার বন্ধু পিকলু আর স্বামী সুমন্ত্র তিনজনে মিলে আমাকে তাদের নানা কাজের টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে চাইত। তাই নিয়েই তো…। সেসব অনেক কথা। আপনাকে বলব সব। মানুষ যখন অমানুষ হয়ে যায় তখন জানোয়ারও তার চেয়ে ভালো। তাই নিয়েই ডিভোর্স। তিতি কোনো দিনই ওর কাছে শুত না। ওকে ভয় পেত তিতি। ও মারত তিতিকে মদ খেয়ে। গতরাতে অনেক অনুনয়-বিনয় করল। ভাবলাম, ডিভোর্স পেয়েছি, তিতিকেও আমিই পাব। ও না হয় পেলই একরাতের জন্যে। কেন যে…
এমন সময়ে বাইরে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল। কলিং বেল বাজল।
জিষ্ণু বলল, পারুলদি?
পারুলদি তো দোতলা থেকে আসবেন। বলেই, দরজা খুলেই পিপি একটি ভয়ার্ত শব্দ করেই চুপ করে গেল।
পিকলুর গলা। জিষ্ণু শুনল, পিকলু বলছে, এই টাইটা জিষ্ণু আমাকে দিয়েছে। তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি আজ।
একটি গোঙানির মতো আওয়াজ ভেসে এল।
জিষ্ণু দৌড়ে গিয়ে পিকলুর কলার ধরে ওকে ঘরের মধ্যে টেনে আনল। জিষ্ণুর টাইটা পিপির গলায় চেপে বসেছিল। পিকলুকে ঘরে টেনে এনে দেওয়ালে ঠেসে ধরল।
পিকলু বলল, তোর সময় হয়ে এসেছে রে জিষ্ণু। তোর পিপিকে আর তোকে একসঙ্গেই ওপরে পাঠাব। তুই চিনিস না আমাকে।
পিকলুকে ছেড়ে দিয়ে জিষ্ণু বলল, বাড়ি যা এখন তুই। গত পঁচিশ বছরে যে-তোকে চিনতাম, সে-তুইও এই নোস। তুইও চিনিস না আমাকে।
পিকলু উঠে পড়ে বলল। ঠিক আছে। আজ যাচ্ছি। বলেই, মাটিতে পড়ে-থাকা টাইটা হাতে তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
যাওয়ার সময়ে বলল, আমার নাম পিকলু। তোরা মনে রাখিস।
মানসিকভাবে বিধ্বস্ত জিষ্ণু বলল, ওর স্ত্রী খুশি ক্যান্সারে মারা গেছে। তারপর থেকেই বোধ হয় ওর এমন মাথার..তার পর গভীর অনুশোচনা ও দুঃখের গলায় বলল, বড়ো কষ্ট হয়। দীর্ঘদিন ও-ই আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ছিল একথা ভাবলে।
পিপি বলল, খুশিদি মারা গেছে একথা আপনাকে কে বলল? মারা গেছে না ছাই। খুশিদিকে পাগল বানিয়ে তো রাঁচিতে পাঠিয়ে দিয়েছে। খুশিদির বাপের বাড়ির অনেক জমিজমা ছিল। খুশিদির বাবা মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু সাকসেকশন অ্যাক্ট অনুযায়ী খুশিদির নামে উকিলকে দিয়ে সব দাবিদাওয়া আদায় করিয়ে নিয়ে তার পর খুশিদির সব কিছু সম্পত্তি নিজের নামে লিখিয়ে তাকে পাগল বানিয়ে রাঁচিতে পাঠিয়ে দিয়েছে। এই পাগল বানাবার জন্যেও একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে হাত করে ঘুস দিয়েছিল। আর আমার স্বামী সুমন্ত্রই পিকলুবাবুকে এই ব্যাপারে সাহায্য করেছিল। আমি সব জানি। এমনকী খুশিদিকে রাঁচিতে পাঠাবার আগে ওদের মেয়েটাকে পর্যন্ত বিষ খাইয়েও মেরেছে। আমি সব জানি।
কী বলছ কী পিপি? তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
প্রায় ভেঙেপড়া গলায় জিষ্ণু বলল।
মাথা আমার খারাপ হয়নি। তবে মাঝে মাঝে মনে হয় যে, যাবে। আপনি আমার অবস্থাটা অনুমানও করতে পারবেন না স্যার। একজন মহিলার স্বামী এবং মেয়ে চলে গেছে চব্বিশ ঘণ্টাও হয়নি অথচ সে, স্বামীর শোকে একফোঁটাও চোখের জল ফেলতে পারছে না। এমনকী ফুলের মতো মেয়ের জন্যে যে শোক করবে তাও পারছে না।
স্যার নয়, জিষ্ণুদা এল। এতসব কথা তুমি আগে এলনি কেন? এল পিপি, তুমি এতসব যে জানতে, তা আগে এলনি কেন আমাকে? তুমি কাজের জন্যে হলেও তো দিনে আমার সঙ্গে প্রতিদিন দশঘণ্টা কাটাতে।
কী করে বলব? সময় আর সুযোগ না হলে বলি কী করে? আপনি যদি বিশ্বাস না করতেন আমাকে তাহলে তো আমার চাকরিটাই যেত। পিকলুবাবু তো আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধুই ছিলেন। চাকরিটা যে আমার কত দরকার জিষ্ণুদা! চাকরিটা চলে গেলে তিতিকে নিয়ে আমাকে আত্মহত্যাই করতে হত।
বড়ো দেরি হয়ে গেল পিপি। সব কিছুরই। বড়োই দেরি হয়ে গেল। জিষ্ণু বলল।
পিপি বলল, জানেন সেদিন পিকলুবাবু আমাকে ভয় দেখিয়েছিলেন। অথচ চিঠিখানার জন্যে আপনি আমাকেই বকেছিলেন। কিন্তু উনি বলেছিলেন, উনি যা-বলছেন তা না করলে বিপদ হয়ে যাবে। বিপদের কমই বা কী হল বলুন? এরকম বিপদের ভয় সুমন্ত্র, সেনগুপ্ত সাহেব এবং পিকলুবাবু আমাকে প্রায়ই দেখাতেন। বলতেন, আরব শেখদের কাছে বিক্রি করে দেবেন।
জিষ্ণু ভাবছিল, ভিক্টোরিয়াতে পিকলুর গলায় লাগানো টাইয়ের ফাঁসটা আলগা করা উচিত হয়নি ওর। ওখানেই বদমাইশটাকে শেষ করে দিলে ভালো হত।
পিপিকে শুধোল, তুমি পুলিশে খবর দাওনি কেন?
পুলিশ?
বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও।
আমাকে জানাওনি কেন? আমার জানাশোনা ছিল ওপরে। অবশ্য হীরুকাকার সূত্রে। অবশ্য জানাশোনা থেকেই বা কী হল? আমার ফিয়াসে পুষিকে যে-মিনিবাস ড্রাইভার চাপা দিয়ে মেরে ফেলল, তারও তো জেল হল না আজ অবধি।
পিপি বলল, সেটা অন্য ব্যাপার। আইনের বিচারে সময় তো লাগেই। এ তো কাজির বিচার নয়। সেটা একটা কেস-এর ব্যাপার। কিন্তু এগুলো? দিনের পর দিন এই ভয়ের মধ্যে দিন কাটানো? আসলে আমি কাউকেই কিছু বলতে পারতাম না তিতির মুখ চেয়েই। সুমন্ত্র একদিন বলেছিল, ওর অনেক টাকার দরকার, তিতিকেও ও আরব শেখের কাছে বিক্রি করে দেবে। একলাখ দাম পেয়েছে। বম্বেতে ওর কনট্যাক্ট আছে। আমি ভয়ে কেঁচো হয়ে থাকতাম। সুমন্ত্র আর পিকলুবাবু মিলে সব কিছুই করতে পারত। ওদের অসাধ্য কিছুই নেই। দেখলেন তো তিতিকে কেমন করে নিয়ে গেল আমার কাছ থেকে। বেচারি তিতি।
বলেই, ডুকরে কেঁদে উঠল পিপি।
আমি ভাবছি, গুণ্ডা-বদমাইশই যদি হবে তবে সুমন্ত্র নিজে আত্মহত্যা করল কেন? অমন মানুষরা তো সচরাচর আত্মহত্যা করে না। আত্মহত্যা করে অন্তর্মুখী, গভীর অথচ খুব সেনসিটিভ মানুষেরা।
উপায় ছিল না। ডিভোর্স-এর মামলার রায় বেরুনোটা একটা ছুতমাত্র। ও আর পিকলু আর সেনগুপ্ত সাহেব মিলে কোনো একটা বড়ো গোলমাল করেছিল শিগগিরই যে-জন্যে একসাইজ ও কাস্টমস-এর লোকেরা ওদের খুঁজছিল। ব্যাপারটা ঠিক কী তা আমি জানি না। ড্রাগ-ট্রাগ-এর ব্যাপারও হতে পারে। ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের লোকেরাও এসে একদিন আমার অফিসে খোঁজখবর করে গেছিল। আমার মনে হয়, ওরা তিনজনেই একটা ভয়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিল। ভীষণ ভয়।
হঠাৎ পিপি একবার ওঘরে গেল। কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এসে বলল, তিতি রোজ ঠিক এই সময়ে খেত। ভোরবেলা স্কুলে যেতে হবে তাই তাড়াতাড়ি খাইয়ে দিতাম। আর কোনো দিন…।
জিষ্ণুর কণ্ঠার কাছে একটা ব্যথা ঠেলে এল। ওর এই দোষ। পরের ব্যথাকে পরের ব্যথা করেই রাখতে পারে না। পৃথিবীর সব ব্যথা, সব মানুষের ব্যথা, হীরুকাকার ব্যথা, কাকিমার ব্যথা, পরির ব্যথা, তারিণীবাবুর ব্যথা, মামণির ব্যথা আর এখন পিপির ব্যথাও ওর বুকের মধ্যে জায়গা করে নিল। পিকলুর কথা মনে পড়ল : আজকাল সেন্টিমেন্টের দিন নয়, টানটান গদ্যর দিন। তুই বড়ো সেন্টিমেন্টাল। তুই মানুষটা যেমন, তোর লেখাও তেমন, ম্যাদামারা। তোর লেখা কেউই পড়বে না।
জিষ্ণু একবার ঘড়ির দিকে তাকাল।
আপনার রাত হয়ে যাচ্ছে না?
না, এখনও তেমন রাত হয়নি বাড়িতে ভাববার মতো। ভাবলে, কাকিমাই ভাববেন। একটা ব্যাপারে বড়ো বাঁচোয়া। আমাকে নিয়ে তেমন চিন্তা করার কেউই নেই।
পারুলদি এসে যাবেন এখনই। আপনি আর একটু বসুন। আমার বড়ো ভয় করছে স্যার।
ভয় কীসের? ভয় নেই কোনো। আমি আছি।
পিপি চুপ করে জিষ্ণুর মুখের দিকে চেয়ে রইল। হঠাৎ ওর দু-চোখ জলে ভরে এল।
জিষ্ণু বলল, তুমি এখন কী করবে পিপি?
আমি? তাই ভাবছি!
তোমার মা-বাবা-ভাই-বোন কেউ নেই?
সকলেই ছিল। আমরা জামশেদপুরের লোক। যুগসালাইতে বাড়ি ছিল আমাদের। বিহারি মুসলমান পাড়ার মধ্যে। উনিশ-শ উনআশিতে দাঙ্গায় বাবাকে-মাকে, ষোলো বছরের বোনকে এবং দশ বছরের ভাইকে মেরে ফেলে ওরা। আমি সেদিন টেলকো কলোনিতে ছিলাম। মারার আগে মাকে… বোনকে…। জন্তু… কুমিল্লা থেকে ঠাকুরদা ও দাদুরা একবার উদবাস্তু হয়ে আসেন উনিশ-শো ছেচল্লিশে। এবং আবারও উদবাস্তু হন জামশেদপুরে। উনিশ শো উনআশিতে।
জিষ্ণু স্বগতোক্তি করে বলল, ভারতবর্ষে!
হ্যাঁ। একদিন হয়তো ভারতবর্ষ থেকেও আমাদের উদবাস্তু হয়ে চলে যেতে হবে। তার পর বলল, সুমন্ত্র এবং ওরা সকলেই জানত আমার অসহায়তার কথা। জানত যে, আমার পেছনে আপনার জন বলতে কেউই নেই। একজনও নয়।
বাইরে বেল বাজল।
পারুলদি এলেন। মাঝবয়েসি মহিলা। মুখে গভীর দুঃখের ছাপ। সেই দুঃখের স্থায়ী বাসা এখন তাঁর মুখেই। কতলোকের কতরকম দুঃখ থাকে। তারা সবাই কেন যে জিষ্ণুর সামনে আসেন?
জিষ্ণু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, নমস্কার।
নমস্কার।
পিপি বলল, আমার অফিসের বস, জিষ্ণু চ্যাটার্জি।
পারুলদি বললেন, এতদিন কোথায় ছিলেন? একদিনও তো দেখিনি। আপনার অনেকই আগে আসা উচিত ছিল পিপির কাছে। আপনার কথা কত যে শুনেছি পিপির কাছে। আপনার সব কথাই আমার জানা হয়ে গেছে। পিপি যে আপনাকে কী চোখে দেখে তা আপনি..
কেন একথা বললেন পারুলদি জিষ্ণু বুঝল না।
পিপি মুখ নীচু করেছিল।
পারুলদির কথায় এবং মুখের ভাবে গভীর আন্তরিকতা ছিল।
বললেন, তোর খাবার নিয়ে আসছে পিপি, পন্টু। কাল থেকে তো অফিস যাবি।
আমি খাব না কিছু।
তুই এই একতলায়, একা বাড়িতে থাকবি কী করে? কিছুক্ষণ আগে একটা চেঁচামেচি শুনলাম। কে এসেছিল রে?
পিকলুবাবু।
এমন একটা দিনেও নিস্তার নেই! বুঝলেন জিষ্ণুবাবু, এ-শহরে আইন নেই, পুলিশ নেই, এমনকী ঈশ্বরও নেই। এখানে পিপির মতো পরিবার-পরিজনহীন সুন্দরী মেয়ের একা একা বাঁচার মতো বিপজ্জনক ব্যাপার আর দুটি নেই। ওকে অন্য কোথাও সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন জিষ্ণুবাবু। এ-বাড়িতে তো ওপরে আমি আর নীচে ও।
জিষ্ণু উঠে পড়ে বলল, আমিও তাই ভাবছিলাম। পিপি তুমি কাল অফিস বেরোবার সময়ে কিছু জামাকাপড় ও জরুরি জিনিস নিয়েই বেরিয়ে। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেব। তুমি আমার কাকিমার সঙ্গেই থাকবে। ক-দিন থাকো। যদি ভালো না লাগে তাহলে তোমাকে তারিণীবাবুদের বাড়িতে রাখার বন্দোবস্ত করব। একটু কষ্ট হবে হয়তো সেখানে কিন্তু নিরাপত্তার অভাব হবে না মনে হয়।
তারিণীবাবু কে?
উনি আমাদের বাড়িওয়ালা। তারিণী চক্রবর্তী। বৃদ্ধ লোক, রিটায়ার্ড। বড়ো দুঃখী। এবারে আমি উঠব।
পিপি এসে দরজা খুলে দাঁড়াল।
বলল, সাবধানে যাবেন।
ওর মুখের একপাশে ভেতর থেকে আলো এসে পড়েছিল। জিষ্ণুর মনে হল, পিপিকে যেন এই দরজায় দাঁড়িয়ে ওকে বিদায় দিতে কতদিন থেকেই দেখছে। কতই যেন চেনা তার! এই পিপি!