ধাত্রী দেবতা : 07
দ্বিপ্রহরে নায়েব ও গোমস্তাদের ডাকাইয়া খাজনা আদায়ের ব্যবস্থার বিষয় পিসিমা পরামর্শ করিতেছিলেন।
নায়েব বলিলেন, সুদ না থাকাতেই প্রজাদের এই মতিগতি। তারা বুঝেছে, খাজনা দিলেই তো বেরিয়ে যাবে। যতদিন টাকাটা তারা নিজেরা খেলিয়ে নিতে পারে, তাই তাদের লাভ। ধরুন, এ বছর দিলেও সেই দশ টাকা দিতে হবে, দু বছর পরেও সেই দশ টাকা। আগে দিলেই এখানে লোকসান। মহলে সুদ চলতি করুন।
পিসিমা বলিয়া উঠিলেন, ছি সিংমশায়!
নায়েব মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে বলিলেন, দোগাছি মহলের কাগজে প্রজাদের কারও চৌদ্দ কারও বিশ বছরের খাজনা বাকি। একজনের দেখলাম ছাপ্পান্ন বছরের খাজনা বাকি। সুদ না হলে—
পিসিমা বাধা দিয়া বলিলেন, আর কখনও আপনি ও প্রস্তাব করবেন না সিংমশায়। বাপপিতামহ যা করেন নি, তা করা হতে পারে না। কিন্তু হরিশ, তোমার মহলে এমনধারা বাকি কেন?
হরিশ বলিল, ছাপ্পান্ন বৎসর যার বাকি, তার খাজনা সামান্য, বছরে চার আনা করে। ওরা বলে, জমিদার যখন আসবেন, তখন একসঙ্গে হুজুরকে দোব—এই আমাদের নিয়ম। বহুদিন তো ওমহলে মালিক যান নি। শুনেছি,–বাবুর পিতামহ—আপনার পিতা-কর্তাবাবু গিয়েছিলেন।
পিসিমা বলিলেন, হুঁ।
তারপর কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন, খাজনা আদায় করতেই হবে। ধরে এনে বসিয়ে রেখে খাজনা আদায় কর। ফসল থাকলে আটক কর; খাজনা না দিলে ফসল তুলতে কি বেচতে দিও না। প্রত্যেক মৌজায় আর একজন করে চাপরাসীর বন্দোবস্ত করে দিন সিংমশায়। গোমস্তাদের বিদায় দেবার সময় আবার তাহাদিগকে বলিলেন, নাবালকের এস্টেট বলে ভয় করে কাজ কোরো না তোমরা। মালিক তোমাদের ঘুমিয়ে আছেন, বিপদে পড়ে ডাকলেই সাড়া পাবে।
সকলে চলিয়া গেল। পিসিমা ভাবিতেছিলেন, শিবুকে একবার মহলে ঘুরাইয়া আনিলে হয়। মালিককে পাইলে গোমস্তাদের ভরসা বাড়ে, প্রজারাও মালিক পাইলে খুশি হয়। অনেক সময় অনাদায় বা প্রজা-বিদ্রোহের মধ্যে গোমস্তাদের চক্রান্ত থাকে। স্কুলের কোনো একটা ছুটি দেখিয়া দিনকয়েকের জন্য মাত্র। তিনি ঝিকে ডাকিয়া বলিলেন, নিত্য, শিবু কোথায় রে?
নিত্য উপরের বারান্দা পরিষ্কার করিতেছিল, সে বলিল, দাদাবাবু নিকছেন পিসিমা।
গোমস্তারা চলিয়া যাইতেই বউটি আসিয়া পিসিমার কোলের কাছে বসিয়া পড়িল। ফিক করিয়া হাসিয়া বলিল, ও পদ্য লিখছে পিসিমা।
পিসিমা ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিল, তুমি গিয়েছিলে বুঝি?
বউ বলিল, আমাকে যে ডাকলে। পড়ে শোনালে আমাকে। অনেক লিখেছে পিসিমা। মায়ের নামে লিখেছে, সে কত কী—পারিজাত ফুল তব চরণের—এইসব!
পিসিমা সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলেন, আর কী লিখেছে?
বউ বলিল, তারপর দেশ দেশ করে কত সব লিখেছে!
পিসিমা বলিলেন, এইটি ওর মাথায় ঢোকালে ওর মা।
বউ এদিক-ওদিক চাহিয়া বলিল, কাল সকালে যে দুজনে কথা হচ্ছিল সব। প্রজাদের দুর্দশা, সেই বিয়ের নজরের টাকা সব ফিরে দিতে হবে। হা পিসিমা, আপনাকে বলে নি, এক টাকা করে খাজনা ছেড়ে দিতে হবে?–
পিসিমা কোনো উত্তর দিলেন না। আবার ফিক করিয়া হাসিয়া বউটি বলিয়া উঠিল, আমার নামেও পদ্য লিখেছে পিসিমা, আমাকে আবার লিখেছে সখি।—বলিয়া সে মুখে কাপড় চাপা দিয়া খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। কিন্তু সে হাসি অকস্মাৎ স্তব্ধ হইয়া গেল। পিসিমার মুখের দিকে চাহিয়া সে ভয়ে বিবর্ণ হইয়া উঠিল। পিসিমাকে আর কিছু বলিতে তাহার সাহস হইল না। সে অতি সন্তৰ্পণে উঠিয়া দিদিমার বাড়ি পলাইয়া গেল।
নিত্য ডাকিল, পিসিমা তোমায় ডাকছেন দাদাবাবু।
শিবনাথ কবিতা লিখিতেছিল, বলিল, হুঁ।
কিছুক্ষণ পরে সে বাহির হইয়া আসিল, বারান্দায় নিত্য তখনও কাজ করিতেছিল। শিবনাথ প্রশ্ন করিল, পিসিমা কোথায়?
নিত্য একখানা কাপড় কুঁচাইয়া তুলিতেছিল, সে বলিল, নিচে দরদালানে।
শিবু আবার প্রশ্ন করিল, গোমস্তারা সব চলে গেছে।
নিত্য বলিল, হ্যাঁ।
শিবনাথ তরতর করিয়া নিচে আসিয়া দরদালানে পিসিমার কোলের কাছে বসিয়া পড়িল। পিসিমা যেমন বসিয়াছিলেন, তেমনই বসিয়া রহিলেন, কোনো সাড়া দিলেন না। শিবনাথ তখনও কবিতা লেখার মেজাজেই ছিল, সে এত লক্ষ্য করিল না। সে বলিল, একটা কথা আছে পিসিমা।
পিসিমা একটু যেন নড়িলেন। শিবনাথ বলিল, এবার আমার বিয়ের জন্যে সমস্ত প্রজাদের। এক টাকা করে খাজনা–
পিসিমা বলিলেন, মাপ দিতে হবে?
শিবু আশ্চর্য হইয়া পিসিমার মুখের দিকে চাহিল।
অতি কঠিন কণ্ঠে পিসিমা বলিলেন, না, সে হয় না।
তাঁহার চোখে অদ্ভুত দৃষ্টি, শিবু ভয়ে চোখ নামাইয়া লইল। পিসিমার চোখের সম্মুখে পৃথিবী অর্থহীন হইয়া গিয়াছে। শিবু মায়ের নামে পদ্য লিখিয়াছে, বধূর নামে লিখিয়াছে, আর তিনি কেউ নন! সমস্ত পৃথিবীটাই আজ মিথ্যা হইয়া যাইতেছে!
বাড়ির সকলে সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিল। শৈলজা-ঠাকুরানী যেন অপরিমিত কঠোর রুক্ষ গম্ভীর হইয়া উঠিয়াছেন। বিষয়-কর্মে কোনো পরামর্শ দেন না, কিন্তু পরামর্শ বা আদেশ না লইয়া কাজ করিলেও রক্ষা নাই। খাজনা মাফ হয় নাই, বরং শাসন-সূত্র কঠোর আকর্ষণে এমন হইয়া উঠিয়াছে যে, স্পর্শমাত্ৰেই যেন টঙ্কার দিয়া ওঠে; পৌষ-কিস্তিতে যে টাকা কম আদায় হইয়াছিল, চৈত্র-কিস্তিতে সে টাকা পূরণ হইয়া উঠিয়া আসিল। পূজায় এখন পিসিমার বেশি সময় অতিবাহিত হয়। সেই সময়টুকুই সর্বাপেক্ষা শঙ্কার সময়। এতটুকু শব্দ বা কথার সাড়া পাইলেই তিনি যেন ক্ষিপ্ত হইয়া ওঠেন, ভৎসনা-তিরস্কারের আর বাকি রাখেন না। বউটি ভয়ে শুকাইয়া উঠিয়াছে।
সেদিন পূজার ফুলের থালা ঘঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া বলিলেন, এরই নাম ফুল বাছা? এই তোমার দুর্বো বাছা হয়েছে? শিবপুজোর বেলপাতায় চক্র রয়েছে।
শিবনাথও সময়ে সময়ে বিদ্রোহ করিয়া ওঠে, তাহার সহিত কোনো কিছু বাধিলেই সে নিরস্তু উপবাস আরম্ভ করিয়া দেয়। একমাত্র শিবনাথের মা হাসিমুখে সম্মুখে দাঁড়াইয়া ছিলেন। সমস্ত কিছু অগ্নারের মধ্যে তিনি স্বেতবরনা গঙ্গার মত সুশীতল বক্ষ পাতিয়া দাঁড়াইলেন। সেখানে পড়িয়া অগ্নিকণাগুলি অঙ্গার হইয়া মিলাইয়া যাইত।
সকল বিষয়েই পিসিমার অসন্তোষ। খাইতে বসিয়া আহার ফেলিয়া দিয়া উঠিয়া পড়েন। পান খাইবার সময়েও বিপদ বাড়িয়া ওঠে। পান মুখে করিয়া ফেলিয়া দিয়া বধূকে তিরস্কার করেন, কিছু শেখ নি মা তুমি? এর নাম পান সাজা? ছি ছি, কাল থেকে পান আর খাব না আমি, তুমি যদি পান সাজ।
এদিকে বধূটিকে লইয়া বিপদ বাড়িয়া উঠিল। সে ক্রমাগতই দিদিমার বাড়ি যাইতে আরম্ভ করিল। বাঁড়ুজ্জেদের খিড়কির পুকুরের পশ্চিম পাড়ের বাড়িগুলির মধ্যে একটা গলি দিয়া সহজেই নান্তির মামার বাড়ি যাওয়া যায়। কিন্তু গলিপথটা আবর্জনাময়, ঘাটে যাইবার অবকাশ পাইলেই সে সেই পথে পলাইয়া যায়।
ক্ৰমে ক্ৰমে শিবনাথের মার হাসির সেই মাধুর্য যেন শান্ত হইয়া আসিতেছিল। পিসিমার উত্তাপ ধীরে ধীরে শীতল হইতেছিল।
জ্যৈষ্ঠ মাস। প্রখর রৌদ্ৰে সমস্ত যেন পুড়িয়া যাইতেছিল, আকাশের নিলীমা বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে। খাওয়াদাওয়ার পর সকলে রুদ্ধ ঘরের মধ্যে ঘুমাইয়া আছে। হুট করিয়া পিসিমার ঘরের
দরজাটা খুলিয়া বউটি বাহির হইয়া আসিল।
কিছুক্ষণ পরে নিঃশব্দে দরজাটা খুলিয়া পিসিমাও বাহির হইয়া এ দরজা, ও দরজা, খিড়কির দরজা দেখিয়া একটু বিস্মিত হইয়া পঁড়াইয়া রহিলেন। দরজাগুলি ভিতর হইতে বন্ধ; কাহারও বাহিরে যাওয়ার লক্ষণ পাওয়া গেল না।
তিনি ধীরে ধীরে উপরে উঠিয়া গেলেন। শিবুর ঘরের জানালার একটা ছিদ্ৰ দিয়া দেখিলেন, বধূ শিবনাথের কাছেই রহিয়াছে।
শিবনাথ তাহাকে আদর করিতেছে, আর সে কাঁদিতে কাঁদিতে বলিতেছে, গোবরডাঙার বাবুদের বাড়িতে বিয়ে হলে এ জ্বালা হত না। দিনরাত পিসিমা বকছে আমায়। দিদিমাও বলছিল তাই।
শিবনাথ মুখ মুছাইয়া সান্ত্বনা দিয়া বলিল, আজ আবার একটা কবিতা লিখেছি, শোন।
বধূর মুখে হাসি দেখা দিল, সে বলিল, পড়, পড়, তুমি বেশ পড় কিন্তু।
শিবনাথ পড়িতে আরম্ভ করিল–
শৈশব সাধ তুই, কাহিনীর কন্যা,
তোর হাসিতে মানিক ঝরে, মতি-ঝরা কান্না।
বউ হাসিয়া বলিল, কার, আমার?—বলিয়া শিবনাথের গায়ে হাসিয়া ঢলিয়া পড়িল। শিবনাথ চট করিয়া তাহার মুখে চুম্বন করিয়া বসিল। নান্তি মুখ মুছিতে মুছিতে বলিল, কী রকম ভাত-ভাত গন্ধ তোমার মুখে। পান খাও না কেন?
শিবু বলিল, তুমি দাও না কেন?
বউ বলিল, খাবে?
শিবু সাগ্রহে বলিল, দাও। কে, কে?
কাহার পদধ্বনি বারান্দায় ধ্বনিত হইয়া সিঁড়ির মুখে মিলাইয়া গেল। উভয়ে উভয়ের মুখের দিকে উকণ্ঠিতভাবে চাহিয়া রহিল। নিচে বারান্দায় পিসিমা ডাকিলেন, নিত্য, নিত্য।
নান্তি সভয়ে জিব কাটিয়া ত্রস্তপদে নিচে গিয়া দরদালানে কৃত্রিম ঘুমে বিভোর হইয়া পড়িয়া রহিল।
সমস্ত অপরাহুটা শিবুর বুক গুরগুর করিতেছিল। কিন্তু বেশ শান্তভাবেই কাটিয়া গেল। রাত্রে বৈঠকখানায় সে পড়িতেছে, এমন সময় নিত্য-ঝি আসিয়া ডাকিল, দাদাবাবু, দাদাবাবু, শিগগির আসুন। পিসিমার ফিট হয়েছে।
শিবু ব্যাকুলভাবে প্রশ্ন করিল, কী করে?
শুয়েছিলেন, মা ডাকতে গিয়ে দেখেন, জ্ঞান নেই, দাতি লেগে গিয়েছে।
কেষ্ট সিং কোথায় গেল? নায়েববাবু, ডাক্তারকে ডাকতে হবে যে?
দূরদালানের ঘরে পিসিমা নিথর অবস্থায় পড়িয়াছিলেন। শ্বাস-প্রশ্বাস অতি মৃদু। শিবনাথের মা নিজে মাথায় ও মুখে-চোখে জলসিঞ্চন করিতেছিলেন। নিত্য বাতাস করিতেছে। শিবনাথ উৎকণ্ঠিত বিবৰ্ণ মুখে কাছে বসিয়া আছে।
ডাক্তার নাড়ি দেখিয়া প্রশ্ন করিল, হঠাৎ এ রকম কেন হল? কখনও কখনও কি এ রকম হয়?
শিবনাথের মা বলিলেন, না। আজ পনের বছরের মধ্যে হয় নি। তবে পনের বছর আগে ফিটের ব্যারাম ছিল ঠাকুরঝির। এক দিনে এক বিছানায় ওর স্বামী আর ছেলে মারা গিয়ে এ অসুখ হয়েছিল। তারপর শিবু হল, সে আজ পনের বছর। শিবুকে পেয়ে–
পিসিমা একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া অল্প একটু নড়িলেন।
শিবনাথের মা ডাকিলেন, ঠাকুরঝি।
ক্লান্ত মৃদুস্বরে পিসিমা সাড়া দিলেন, যাই।