Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

গভীর রাত্রিতেও শিবনাথ বিনিদ্র হইয়া বসিয়া ওই কথাই ভাবিতেছিল। ওদিকে খাটের উপর গৌরী ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। প্রথম কিছুক্ষণ সেও জাগিয়া ছিল, তাহারই মধ্যে কয়েকটা বঁকা কথাও হইয়া গিয়াছে। শিবনাথ বরাবর নিরুত্তর থাকিবারই চেষ্টা করিয়াছে, ফলে অল্পেই পালাটা শেষ হইয়াছে। তারপর কখন গৌরী ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। গৌরীর ঘুমটা একটু বেশি, সেজন্য শিবনাথ ভাগ্যদেবতার নিকট কৃতজ্ঞ। ঘুম কম হইলে শিবনাথ রাত্রির কথা ভাবিয়া শিহরিয়া ওঠে।

অনেক চিন্তা করিয়া করিয়া সে যেন ক্রমে নিশ্চিন্ত হইয়া আসিতেছে। উপায় যেখানে নাই, সেখানে চিন্তা করিয়া কী করিবে? উপায় ছিল—গৌরী যদি তাহার জীবনে নিজের জীবন দুইটি নদীর জলধারার মত মিশাইয়া দিতে পারি, তবে উপায় ছিল। গৌরীর টাকার কথা মনে করিয়াই শুধু এ কথা সে ভাবে নাই। সে যদি শিবনাথের আদর্শকে গ্রহণ করিতে পারি, তবে যে সে প্রপার্টি ইজ থে—এ কথা উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করিয়া গৌরীর হাত ধরিয়া এ সমস্ত বর্জন করিতে পারিত। জীবিকা? এতবড় বিস্তীর্ণ দেশমা-ধরিত্রীর প্রসারিত বক্ষ, তাহারই মধ্যে তাহারা স্বামী-স্ত্রীতে স্তন্যপায়ী শিশুর মত মায়ের বুক হইতে রস সগ্ৰহ করিত। গৌরীর দিকে চাহিয়া সে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। এ কী! গৌরীর গায়ের গহনা কী হইল? এ যে হাতে কয়গাছা চুড়ি ও গলায় সরু একগাছি বিছাহার ভিন্ন আর কিছুই নাই! গহনাগুলি গৌরী খুলিয়া রাখিয়াছে। বোধ করি তাহার দৃষ্টিপথ হইতে সরাইবার জন্যই খুলিয়া রাখিয়াছে, হয়ত বা নিরাপদ করিবার জন্য আমাদের বাড়িতে ম্যানেজারের জিন্মায় রাখিয়া আসিয়াছে।

সহসা সে চমকিয়া উঠিল। নিচে কোথায় যেন একটা শব্দ উঠিতেছে-পাখির পাখা ঝটপট করার মত শব্দ। একটা দুইটা নয়, অনেকগুলা পাখি যেন একসঙ্গে অন্ধকারের মধ্যে অসহায়ভাবে উড়িবার চেষ্টা করিতেছে বলিয়া বোধ হইল। বাড়ির সংলগ্ন ঠাকুরবাড়ির আটচালায় অনেকগুলি পায়রা থাকে, বোধহয় কোনো কিছুর তাড়া খাইয়া এমনভাবে আত্মরক্ষা করিবার চেষ্টা করিতেছে। ঘর হইতে বাহিরের বারান্দায় আসিয়া সে ঠাকুরবাড়ির দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। আটচালার ভিতর গাঢ়তর অন্ধকারের মধ্যে যেন একটা সচল ছায়ামূর্তি সে দেখিতে পাইল। মানুষের মত দীর্ঘ সচল ছায়ামূর্তি। অন্ধকারে যেন একটা প্ৰেত নাচিয়া নাচিয়া ছুটিয়া বেড়াইতেছে। শিবনাথ ঘরে প্রবেশ করিয়া টেবিলের উপর হইতে টর্চ ও দেওয়ালের গায়ে ঝুলানো তলোয়ারখানা খুলিয়া লইয়া নিঃশব্দে নিচে নামিয়া গেল। ঠাকুরবাড়ি ও অন্দরের মধ্যে একটি মাত্র দরজা। দরজাটি সন্তৰ্পণে খুলিয়া সতর্ক পদক্ষেপে আটচালা একটা থামের আড়ালে আসিয়া সাঁড়াইল। মূর্তিটার কিন্তু জ্বক্ষেপ নাই, কোনো দিকে লক্ষ্য করিবার যেন তাহার অবসর নাই। একটা লম্বা লাঠি হাতে সে উন্মত্তের মত ওই পায়রাগুলোকে তাড়া দিয়া দিয়া ফিরিতেছে, বারবার আঘাত করিবার চেষ্টা করিতেছে। ক্রমশই যেন শিবনাথের বিস্ময় বাড়িতেছিল। মূর্তিটা স্ত্রীলোকের। অপটু হাতে লাঠিচালনা, নতুবা এতক্ষণে দুই-চারিটা পায়রা আঘাত পাইত। মূর্তিটা এবার এদিক হইতে পিছন ফিরিতেই শিবনাথ টৰ্চটা জ্বালিয়া তলোয়ারখানা উদ্যত করিয়া তাহাকে আহ্বান করিল, কে?

আলোকের দীপ্তি এবং মানুষের কণ্ঠস্বরের রূঢ় প্রশ্নে মূৰ্তিটা মুখ ফিরাইল, এবং সভয়ে একটা অনুনাসিক আর্তনাদ করিয়া উঠিল, অ্যাঁ–!

শিবনাথ এবার বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইয়া গেল। এ কী, এ যে সেই জীৰ্ণ খোনা মেয়েটা! পরমুহূর্তেই মেয়েটা মাটিতে সশব্দে পড়িয়া গেল; শিবনাথের মনে হইল, মেয়েটা বোধহয় মূৰ্ছিত হইয়া পড়িয়াছে। টর্চ জ্বালিয়া তাহার মুখের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া দেখিল, তাই বটে, সে নিথর হইয়া পড়িয়া আছে। সে ছুটিয়া বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিয়া একটা ঘটি হাতে আবার ফিরিয়া গেল, এ কী! মূৰ্ছিত মেয়েটার মুখের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া একটা কঙ্কালসার পুরুষ চাপা গলায় তাহাকে বারবার ডাকিয়া সচেতন করিয়া তুলিবার চেষ্টা করিতেছে। ও কে? শিবনাথ বুঝিল, এই মেয়েটার সঙ্গী এই লোকটা, বোধহয় কোথাও লুকাইয়া ছিল। তাহাকে গ্ৰাহ্য না করিয়াই শিবনাথ মেয়েটার মুখে জলের ছিটা দিতে আরম্ভ করিল। দুই-একবার ছিটা দিতেই সে চোখ মেলিয়া সভয়ে কাঁদিয়া উঠিল, মেরেন না বাঁবু মাঁশায়।

পুরুষটাও কাঁদিয়া ফেলিল, মেরেন না মাশায় ওকে।

শিবনাথ প্ৰশ্ন করিল, কী করছিলি তুই এখানে?

মেয়েটি জোড়হাত করিয়া বলিল, এঁকটি পাঁয়রা–

পায়রা! মানুষের লোভ দেখিয়া শিবনাথ স্তম্ভিত হইয়া গেল, এই অবস্থাতেও এমনভাবে মাংস খাইবার প্রবৃত্তি!

মেয়েটি আবার বলিল, ডাক্তার উঁয়োকে মাংসেঁর ঝোঁল দিঁতে বঁলেছে, মাঁশায়, লঁইলে উঁ বাঁচবে নাঁ।

ও তোর কে?

মেয়েটা চুপ করিয়া রহিল, পুরুষটা এতক্ষণ বসিয়া কামারের হাপরের মত হাঁপাইতেছিল, সে এবার বলিল, আজ্ঞেন, আমার পরিবার আশায়।

শিবনাথ সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল মেয়েটাকে, ও তোর স্বামী।

অ্যাঁজ্ঞে হ্যাঁ। এঁরতে বঁসেছে মাঁশায়, ডাঁক্তার বললে, মাংসেঁর ঝোঁল–মুঁরগির, নয় তোঁ পাঁয়রার ঝোঁল এঁকটুকুন কঁরে না দিলে উঁ বাঁচবে না।

পুরুষটা বলিল, পঞ্চাশ বার বারণ করলাম, মাশায়, তা শুনলে না। আমাকে বাইরে রেখে ওই জলের নালা দিয়ে ঢুকে–। সে আবার হাঁপাইতে লাগিল। হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, মাগী আমাকে নিশ্চিন্দি হয়ে মরতেও দেবে না বাবু।

মেয়েটা মুহূর্তে যেন স্থান কাল সব ভুলিয়া গেল, সে তিরস্কার করিয়া স্বামীকে বলিল, এঁই দেঁখ, দিনরাত তুঁ মঁরণ কঁরণ কঁরিস না বঁলছি, ভাঁল হঁবে না। সে স্বামীর বুকে হাত বুলাইতে আরম্ভ করিল।

পুরুষটা দম লইয়া আবার বলিল, বাবুদের পায়খানা সাফ করে পয়সা নিয়ে ওষুধ এনে আমার আর লাঞ্ছনার বাকি রাখছে না বাবু। ওষুধ না খেলে আমাকে ধরে মারে। ভিখ করে যা আনবে—ভাত, আচার, মুড়ি সব আমাকে খাওয়াবে। না খেয়ে খেয়ে মাগীর দশা দেখেন কেনে!

শিবনাথ নির্বাক হইয়া দাঁড়াইয়া ছিল। তাহার সমস্ত সন্তর বিপুল তৃপ্তিতে ভরিয়া উঠিয়াছে; কুৎসিত জীর্ণ দেহের মধ্যে জীবনের এমন সুমধুর প্রকাশ দেখিয়া তাহার সকল ক্ষোভ যেন মিটিয়া গিয়াছে। সে বলিল, তোমরা এই মন্দিরের বারান্দায় শুয়ে থাক। কাল থেকে আমার বাড়িতেই থাকবে। ওষুধ-পথ্যির সব ব্যবস্থা আমি করে দোব, বুঝলে?

মনে মনে বিগ্রহের মতই সমাদর করিয়া তাহাদের শোয়াইয়া শিবনাথ বাড়িতে আসিয়া আবার চেয়ারের উপর বসিল। চোখের ঘুম যেন আজ ফুরাইয়া গিয়াছে। সহসা তাহার মনে হইল, দুঃখ, দারিদ্র্য, স্বার্থপরতা, লোভ, মোহের ভার হিমালয়ের ভারের মত মনুষ্যত্বের বুকের উপর চাপিয়া বসিয়া আছে, সেই ভার ঠেলিয়াই মনুষ্যত্বের আত্মবিকাশ অহরহ চলিয়াছে। কঠিন মাটির তলদেশ হইতে মাটি ফাটাইয়া যেমন বীজ অঙ্কুরিত হয়, তেমনই ভাবেই সে যুগে যুগে ঊর্ধ্বলোকে চলিয়াছে, এই ভার ঠেলিয়া ফেলিয়া দিয়াই চলিয়াছে। জানালা দিয়া আকাশের দিকে সে চাহিয়া দেখিল, গাঢ় নীল আকাশ, পুঞ্জ পুঞ্জ জ্যোতির্লৈাকের সমারোহে রহস্যময়। সে সেই রহস্যলোকের দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল। পশ্চিম-দক্ষিণ কোণটা কেবল গাঢ় অন্ধকার; সহসা দীপ্তির একটা চকিত আভাসও যেন সেখানে খেলিয়া গেল। মেঘ! মেঘ দেখা দিয়াছে দক্ষিণপশ্চিম কোণে! শিবনাথ পুলকিত হইয়া জানালায় আসিয়া দাঁড়াইল। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের মেঘ! মেঘ যেন পরিধিতে বাড়িতেছে, বিদ্যুতের প্রকাশ ঘন ঘন হইতে আরম্ভ করিয়াছে। আঃ, দেশ বঁচিবে; চৌচির মাটি আবার শান্ত স্নিগ্ধ অখণ্ড হইয়া উঠিবে। সেই কোমল স্নিগ্ধ মাটির বুকে মানুষ আবার বুক দিয়া ঝাঁপাইয়া পড়িবে স্তন্যপায়ী শিশুর মত। আবার মা হইবেন সুজলা সুফলা মলয়জশীতলা শস্যশ্যামলা কমলা কমলদলবিহারিণী। এ রূপ মায়ের অক্ষয় রূপ, এ রূপের ক্ষয় নাই, শত শোষণে, পরাধীনতার অসহ বেদনাতেও এ রূপের জীর্ণতা আসিল না।

সহসা তাহার মনে হইল, কাছারি-বাড়ির দরজা হইতে কে যেন ডাকিতেছে! সে বাড়ির ভিতরের দিকের বারান্দায় আসিয়া সাড়া দিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কে?

আজ্ঞে, আমি কেষ্ট সিং।

কী বলছ?

আমি এসেছি শিবু, তাই তোকে খবরটা দিচ্ছি। তুই নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমো, আমি উপায় করেছি।

মাস্টার মহাশয়ের কণ্ঠস্বর। শিবনাথ দ্রুতপদে নিচে নামিয়া গেল।

রামরতনবাবু বলিলেন, দিজ মহাজস, শুধু মহাজন কেন, বিষয়ী ক্লাসই একটা অদ্ভুত ক্লাস। বিশ্বাস এরা কাউকে করবে না। এত করে বললাম, তাও না; বলে, নাবালককে টাকা কেমন করে দেব? তখন বললাম, অল রাইট আমাকে জান তোমরা, আমার সম্পত্তিও তোমরা জান, আমাকে দাও টাকা আমার সম্পত্তি মর্টগেজ নিয়ে! তাই নিয়ে এলাম।

শিবনাথ বাক্যহীন হইয়া বসিয়া রহিল। আজিকার দিনটা তাহার জীবনের একটি অমূল্য সম্পদ। এমন দিন আর বোধহয় কখনও আসিবে না। তাহাকে কেন্দ্ৰ করিয়া আজ যেন মানুষের জাগরণের সাড়া পড়িয়া গিয়াছে; আকাশে মেঘ দেখা দিয়াছে।

মাস্টার বলিলেন, আমি সব নোটই এনেছি। সিংমশায় সব গুনে নিচ্ছেন। কিন্তু তুই এমন চুপ করে রয়েছিস কেন? আবার নোব না বলবি না তো? তোকে আমার এক-এক সময় ভয়। করে; এমন সেন্টিমেন্টাল ফুলের মত কথা বলিস! কী বলছিস?

শিবনাথ এবারও কোনো উত্তর দিতে পারি না, নির্বাক হইয়াই সে বসিয়া রহিল। মাস্টার বলিলেন, তোর ঘুম পাচ্ছে, যা তুই, শুগে যা। আমরা সব চালান-টালান লিখে ঠিক করে রাখছি, কাল সকালেই সিংমশায় সদরে চলে যাবেন।

এতক্ষণে শিবু ধীরে ধীরে বলিল, আপনি আমার শিক্ষক-গুরু, আপনার কাছে অনেক পেয়েছি, আজ এই টাকাও আমি নিলাম মাস্টারমশায়—বলিয়া সে বাড়ির দিকে চলিয়া গেল। বাড়িতে তখন নিত্য, রতন উঠিয়াছে; উঠানে কেষ্ট সিং মাস্টার মহাশয়ের সঙ্গী লোকটিকে লইয়া দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাকে জলখাবার দিতে হইবে। শিবনাথ উপরে উঠিয়া গেল। এত সাড়াশব্দের মধ্যেও গৌরী অগাধ ঘুমে আচ্ছন্ন। বিছানার উপর শুইতে গিয়া গৌরীর ঘুমে ব্যাঘাত দিতে তাহার ইচ্ছা হইল না, তাহার ওপর এই গরমে এক বিছানায় দুই জনে শোয়াটাও তাহার বড় অস্বস্তিকর বোধ হইল; ইজিচেয়ারটার উপরেই শুইয়া সে শ্ৰান্তভাবে চোখ বুজিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress