দোলা
যেদিন থেকে বিরাজ শ্রাবন্তীর জীবনে এলো সেদিন থেকেই তার একাকিত্ব জীবনের এক অধ্যায় অতীত হয়ে গেল। এলোমেলো স্বপ্নগুলোর বাস্তব রূপ পেতে বেশী দেরী হল না। উভয়ের মধ্যে এক নিবিড় সম্পর্কের সিঁদুরে আভা ভেসে ওঠায় দিকবিদিক আলোরিত হল। নদীর জলে বুক ভাসিয়ে যুগ্ম রাজহংস যেভাবে অগ্রসর হয়ে থাকে বিরাজ ও শ্রাবন্তীর সম্পর্কও তদ্রূপ নির্মল ভাবে চলতে লাগল। বিরাজকে ঘিরেই তার স্বপ্নের জগৎ। স্বতঃস্ফূর্ত অরণ্যের পাখীটি সমস্ত নীলাকাশ বিচরণ করে যেমন নিজের বাসায় আশ্রয় লয়; শ্রাবন্তীও তার যৌবনের উন্মাদনা সাঙ্গ করে খাঁচায় বন্দি পাখীর ন্যায় বিরাজের পত্নী হয়ে গ্রামে এলো। শহুরে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একটু আলাদা হলেও গ্রাম্য পরিবেশকে আপন করে নিতে সে কোন দ্বিধাবোধ করেনি।
শ্রাবন্তীর মুখটি যেমন মিষ্টি, ঠিক স্বভাব ততটাই নম্র। এতদিন তার ঘুম ভেঙেছে ঘড়ির এলার্ম-এর শব্দে। আর এখানে এসে সেটির প্রয়োজনও বোধ করেনি সে। ভোরের পাখীর ডাকে খুব সহজেই ঘুম ভেঙে যায় তার। ভোরের অন্ধকার ভেদ করে কানে বেজে উঠত কা-কা রব। প্রভাত পাখীর গান, বউ-কথা- কউ পাখীর মিষ্টি ডাক, শালিকের ডাক, শুকনো গাছের ডালে নানান বর্ণে চিত্রিত কাঠ ঠোকরার খটখট্ শব্দ, এমনকি বাড়ীর দক্ষিণধারে সুদীর্ঘ দীঘির উপর অপূর্ব রঙের মাছরাঙা পাখীর আগমনে শ্রাবন্তীর মনের ভিতর পাখীদের প্রতি এক স্নেহের উদয় হলো। বাড়ীর কামরাঙা গাছে ঝাকে ঝাকে টিয়ে লাল ঠোট দিয়ে পাকা ফলগুলি ঠোকর মেরে মাটিতে ফেলে দিলে শ্রাবন্তী সেই দৃশ্য দেখে আনন্দে আস্ফালন করত। প্রকৃতির এই জীবন্ত সম্পদকে কাছে পেতে একদিন সে বিরাজের কাছে আবদার করল যে সে টিয়া পাখীকে পোষা করবে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর এক বিকেলে বিরাজ খাঁচায় বন্দী এক টিয়ে বাড়ীতে এনে শ্রাবন্তীর হাতে দিয়ে বলল : ” এই নাও তোমার সাধের টিয়ে।”
আনন্দে আত্মহারা হয়ে শ্রাবন্তী পাখীটির নাম দিল— ‘দোলা’।
বস্তু সামগ্রীর প্রতি বিশেষ করে নারী জাতির একটি দুর্বলতা লক্ষ্য করা যায়। একটি চাহিদা পূর্ণ হওয়া মাত্রই আরেকটির প্রতি মন ছুটে চলে। কিন্তু শ্রাবন্তীর মনোভাব কখনও লালসায় পর্যবসিত হয়নি। চক্ষুতৃষ্ণা তাহার হৃদয়জাত উদ্যমকে কোন ক্রমেই অতিক্রম করতে পারেনি। তাই খাঁচাবন্দী দোলাকে এক অন্তরঙ্গ সঙ্গী ভেবে চরম আনন্দের স্বাদ উপভোগ করতে আরম্ভ করল।
চিত্ত বিনোদনের এরূপ সঙ্গী খুব কম মানুষের ভাগ্যেই জোটে। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই দোলা মনুষ্য সমাজে প্রচলিত কিছু কথা রপ্ত করে সকলের প্রিয় পাত্র যেমন হলো, আবার আহারেও তার নানাবিধ রুচি জন্মাল। ফলমূল, দুধভাত তার প্রিয় খাবার বলে কথা; একটু দেরী তার আর সয় না। দিনের পর দিন শ্রাবন্তীর কাছে তার আবদার বেড়েই চলল। আদর ও ভালবাসা থেকে অধিকার জন্মায়, অল্পদিনের মধ্যেই এই উপলব্ধি তার বোধগম্যের ভিতরে এল।
এভাবে দিনের পর দিন একটি বনের পাখীর সঙ্গে অত্যধিক মাখামাখী হওয়ায় শ্বাশুড়ী মনক্ষুন্ন হলেন। সকাল সন্ধ্যে অনর্থক পাখীটির চেঁচামেচীতে মাঝে মধ্যেই তার মাথা ধরে যায়। তাছাড়া প্রায়শ গৃহকর্মের ব্যাঘাত হওয়ায় একদিন শ্বাশুড়ী বৌমাকে জোরগলায় বলে উঠলেন, “অনেক হয়েছে। এবার নিজের মনে করে একটু সংসারে মনোযোগী হও। আর ঐ বনের পাখীর মায়া জড়িয়ে কি হবে? এইতো সেদিন খাঁচা থেকে ছাড়া পেয়ে ঠাকুরঘরটিকে একেবারে তছনছ করে দিয়েছে। তাইতো বলি ঐ পাখীটাকে
—না মা, আপনি আমাকে বকুন, আমি সেটা মুখ বুজে সহ্য করব। কিন্তু ঐ অবুঝ পাখীটাকে অন্য কোথাও ছেড়ে আসার কথা ভাবতেই মন যে আমার উদাস হয়ে পড়ে। এক কথায় দোলা আমার অনুপ্রেরণা। অনুপ্রেরণা এই অর্থে, যেভাবে পাখীটি মুক্ত আকাশের বিচরণ থেকে বঞ্চিত হয়ে খাঁচায় আবদ্ধ, অনুরূপভাবে শ্রাবন্তীও শহরের মুক্ত গন্ডি থেকে বেরিয়ে এসে অতি ক্ষুদ্র গ্রামের এক সংসার বন্ধনে আবদ্ধ। বন্দী জীবনের এই দুঃসহ ব্যাথাকে লাঘব করবার জন্যই বোধ হয় ঈশ্বর এই দুই প্রাণীকে এক সংসারে এনে স্থান দিয়েছেন।
বছর দুই অতিক্রম হয়ে গেলে শ্রাবস্তী এক ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। ঠাকুরমা আদর করে নাম দিল ‘স্নিগ্ধা’। সেই থেকেই নবাগতা স্নিগ্ধার লালন পালনে দিনরাত্রী একাকার হয়ে যায়। মাতৃত্ব একদিকে যেমন আনন্দের, তেমনি কষ্টের।
বিনাকষ্টে এই মাতৃত্বে স্বীকৃতি কিংবা প্রতিষ্ঠা খুব কম নারীর ভাগ্যেই জোটে। অন্যদিকে দোলা দিনের পর দিন পূর্বের ন্যায় আদরযত্নের অভাব দেখতে পেয়ে মনক্ষুণ্ন হয়ে থাকত। একদিন চীৎকার করে বলে উঠল, “ক্ষিধে পেয়েছে, খেতে দাও।” অমনি শ্রাবন্তী তরিঘরি করে দুধভাত নিয়ে খাঁচার ভিতর নিয়ে এল। কিন্তু কি আশ্চর্য প্রায় আধঘন্টা পার হয়ে গেল তবুও পাখীটি মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে ঘুরে রইল। এক গ্রাস খাবারও তার মুখে যায়নি। এতদিনের যে অধিকার এই বনের পাখীটি সঞ্চয় করেছে তা সে সহজেই হাতছাড়া করতে চায় না। শ্রাবন্তী বুঝতে পেরেছে যে দোলা আদরের অভাবে রাগ করেছে। তাই শ্রাবস্তী কষ্ট করে হলেও খাঁচার সামনে গিয়ে দুদন্ড দাঁড়িয়ে কিছু মিষ্টি কথা বলার পর পাখীটি খেতে আরম্ভ করল। শ্রাবন্তীর অকাতর স্নেহ ও যত্নের ফলেই দোলার মনে এই অভিমানের সৃষ্টি।
অন্যদিকে স্নিগ্ধা ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠায় সকলের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়াল। মাঝে মধ্যেই হামাগুড়ি দিয়ে ঠাকুরঘরের ফলমূল ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখত। ঠাকুরমা পূজো সারতে গিয়ে দেখতেন গোপাল-ঠাকুর আসনে নেই। এমনকি ঘন্টাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এসবের কোনটিতেও ঠাকুরমার মনে কোনরূপ বিরূপ ভাব নেই। অথচ অবুঝ পাখীটি এসে যখন ঠাকুর ঘরটি লন্ডভন্ড করেছিল তখন তার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গিয়েছিল। দ্বিধাযুক্ত মনে কার স্থান কখন কোথায় হবে, তার পূর্বাভাষ পাওয়া বড়ই কঠিন।
এক সকালে বিরাজ তার টেবিলের উপর রাখা দরকারী কাগজ খুঁজে না পেয়ে অতিশয় মনক্ষুন্ন হল। কি করে সেই কাগজ উধাও হয়ে গেল তা জানতে চাইলে শ্রাবস্তী বলল, “সারাটা দিন স্নিগ্ধাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ি। গতকাল দোলা ছাড়া পেয়ে এঘরে এসেছিল। হতে পারে দোলা সেই কাগজটি বাইরে ফেলে দিয়েছে।”
বিরাজ একটু রাগ করে বলে উঠল, “এর আগেও দোলা নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ঘর থেকে ফেলে দিয়েছে। তাতে আমি বিশেষ আপত্তি করিনি। কিন্তু এটা যে আমার অফিসের অত্যন্ত দরকারী কাগজ। কি যে করি? দিনের পর দিন দোলার আবদার বেড়েই চলেছে। মনে হয় আর বেশীদিন তাকে এভাবে এখানে রাখাটা ঠিক হবে না।”
এই কথাগুলি শ্রাবন্তীর প্রাণে গেথে গেল। আজ পর্যন্ত বিরাজকে কখনও এভাবে রুক্ষসুরে কথা বলতে দেখেনি। যে হৃদয় স্নেহের প্রলেপে এতদিন ঢাকা ছিল সামান্য রুক্ষ কথার আঁচড়েই তা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। শ্রাবন্তীর মুখপানে অবসাদের এক কালোছায়া দৃষ্ট হল। হঠাৎ একদিন শ্রাবন্তী মুর্ছা গেলে বিরাজ তাকে এক অভিজ্ঞ ডাক্তারের কাছে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দূরারোগ্য ব্যাধির সন্ধান পেল।
কালক্রমে শরীরে নানাবিধ উপসর্গ দেখা দিলে সেরা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব হল না। অবশেষে একদিন শ্রাবন্তী সকলের সান্নিধ্য থেকে মুক্তির পথে চলে গেল।
দোলা অনেকদিন শ্রাবন্তীকে দেখতে না পেয়ে উদাস হয়ে থাকত। নিরর্থক চেঁচিয়ে সকলকে কাছে ডাকার অভ্যাস প্রায় এক প্রকার বিলুপ্ত। যার যত্নে দোলা মনুষ্য সমাজের দু-চারটি কথা বলতে শিখেছিল সেই স্নেহশীলা শ্রাবন্তীর অবর্তমানে তাও লোপ পেল। বিরাজ মনে অনেক কষ্ট নিয়েও শ্রাবন্তীর সখের দোলাকে একদিন বহু দূরের এক অরণ্যের মধ্যে নিয়ে এল। খাঁচা থেকে তাকে বের করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “শ্রাবন্তীর মতো তোকে আমরা যত্ন করতে পারলাম না। আমাদের ভুল বুঝিস নে। এই নীল আকাশে উড়ে যা।” এই বলে তাকে উড়িয়ে দিতেই দোলা মুহুর্তেই আকাশ পথে হারিয়ে গেল।
বিরাজ এক দুপুরে বিষন্ন মনে জানালার বাইরে তালগাছ গুলিতে বাবুই পাখীর বাসার দিকে দৃষ্টি রেখে গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিল। এমন সময় স্নিগ্ধা দৌড়ে এসে বাবাকে ডেকে বললে, “বাবা, তাড়াতাড়ি বাইরে এসো, আমাদের দোলা বাড়ীতে এসেছে।”
মাত্র তিনদিন হল এই পাখীটিকে দূরের অরণ্যে ছেড়ে এসেছে। এরই মধ্যে আবার বাড়ীতে এসে হাজির। সেকি বাড়ীর মায়া ছাড়তে পারেনি। বিরাজ তাড়াতাড়ি মেয়েকে কোলে তুলে বারান্দার দিকে ছুটল। স্নিগ্ধা আঙুল তুলে বাবাকে দেখিয়ে বলল, “ঐ দেখ বাবা, খাঁচার উপর আমাদের দোলা বসে আছে।”
বিরাজকে দেখা মাত্রই দোলা জোড়ে চাৎকার করে উড়ে এসে তার ডান কাধের উপর বসে পড়ল। অমনি তাকে হাতে তুলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগল, “তোকে আদর করার জন্য শ্রাবন্তী এখন আর বেঁচে নেইরে। আমার শুষ্ক প্রাণের স্নেহ কি তোর ভাল লাগবে? কোথায় ছিলি এতদিন। ক্ষিধে পেয়েছে বুঝি? তোর জন্য দুধভাত নিয়ে আসি।” এই বলে বিরাজ নিজ হাতে দুধভাত সামনে রেখে দিতেই মুহূর্তের মধ্যেই সব খেয়ে ফেলল। বিরাজ বলল, “ভয় কিসের, তোকে তো আর খাঁচায় বন্দী করে রাখব না? তোর দিদিমনি মুক্ত হয়ে চলে গেছে— তুইও মুক্ত গগনে উড়ে যা।” দোলা কিছুক্ষণ এঘর ওঘর খোঁজাখুজি করে টি-টি চীৎকার করে নীল গগনে উড়ে চলল।
বিরাজের মনের বিষণ্নতা দূর করার লক্ষে ও সাংসারিক প্রয়োজনে মা তাকে কয়েকটি মাস পরেই বিয়ে করিয়ে দিলেন। দুটি প্রাণকে সজীব করে রাখা যে বড়ই প্রয়োজন। এই পরিবর্তনশীল সংসারে বিরাজকে তার অতীত ভুলে বর্তমানকে আপন করাই হবে জীবনের পাঠ।
প্রায় তিন মাসের মাথায় এক বিকেলে দোলা শ্রাবন্তীর শয়নকক্ষে ঢুকে নতুন বৌকে শ্রাবন্তী ভেবে টি-টি চিৎকার শুরু করে দিল। সেই সময় কানন একলা বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম করছিল। বিরাজ ও শ্রাবন্তীর সংসারে এই অচেনা পাখীটির যে এক বিশেষ গুরুত্ব ছিল তা কানন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেনি। পাছে কিছু অনিষ্ট করে এই ভেবে সে পাখীটিকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল। দোলা বুঝতে পারল যে বিরাজের সংসারে নতুন মানুষ এসেছে বটে কিন্তু শ্রাবন্তীর পুরানো সম্বন্ধকে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠার সৎ ইচ্ছা তার মাঝে গড়ে উঠে নি । মনের দুঃখে দোলা ডানা মেলে উড়ে গেল।