দৈবের বশে
একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল অরিসেন। ঘাড় ফিরিয়ে আর-একবার দেখল নীলাদ্রির দিকে। পরম নিশ্চিন্তে নীলাদ্রির দু-চোখ বোজা। মাথাটা যত্ন করে বসানো গ্যাসের উনুনের ওপরে। যেন আসন্ন কোনও বিশেষ মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছে নীলাদ্রি সেন।
রান্নাঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নীলাদ্রির চেয়ারের কাছে ঝুঁকে এল অরি। চেয়ারটাকে ঠেলে উনুনের আরও কাছে এগিয়ে দিল। নাঃ, দৃশ্যটা এখন বেশ স্বাভাবিক-স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। কিন্তু অরির হাতে এখন প্রচুর কাজ। প্রথমত, কাজগুলো সম্পূর্ণ নিখুঁত হওয়া চাই। এবং দ্বিতীয়ত, অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় ওকে কাজ করতে হবে। নিখুঁত খুনের গোটাকয়েক কাহিনি ও পত্র-পত্রিকায় পড়েছে। তাতে খুনটাকে দুর্ঘটনা বা আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টাটাই বেশি। কিন্তু একটা স্বাভাবিক-সহজ-ধারালো পথকে সকলেই এড়িয়ে গেছে। তা হল, মৃত ব্যক্তির সঙ্গে খুনির যে কোনও সম্পর্ক নেই, সেটাকে সামনে তুলে ধরা। অর্থাৎ, নীলাদ্রি সেন নামে কোনও লোককে যে জনৈক অরিসেন রায় কোনওদিন চিনত সেটাই পুলিশ প্রমাণ করতে পারবে না। উপরন্তু আত্মহত্যার দৃশ্যসজ্জা তো আছেই!
নীলাদ্রিকে খুন করার যুক্তিসঙ্গত কারণের সংখ্যা ক্রমশ এত বেড়ে যাচ্ছিল যে, অরির পক্ষে আর অপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি। গতমাসে নীলাদ্রির একটা গুরুত্বপূর্ণ চিঠি হাতে আসার পরই অরিসেন মনে-মনে ছকে ফেলেছে নীলাদ্রি-নিধনের পরিকল্পনা। চিঠিতে লেখা ছিল:
নিয়তি যখন পরিহাস করছে, তখন তাকে হাসিমুখে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কী? লোকের চিরটা জীবন তো আর সুখে কাটে না! সুতরাং পা হলেও এই পথই বেছে নিলাম।
ইতি—
নীলাদ্রি
নীলাদ্রি অবশ্য টাকার ইঙ্গিত দিয়ে অরিকে কিছুটা ব্যঙ্গ করেছে চিঠিটায়। অর্থাৎ, ওর নিয়তি যখন হাসিমুখে ওকে পরিহাস করছে (নীলাদ্রির মাধ্যমে) তখন সে-পরিহাস মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কী! (সামান্য ক’টা টাকা পাঠানোর তো ব্যাপার)! লোকের (অরিসেনের) চিরটা জীবন তো আর সুখে কাটে না! এখন যেমন নীলাদ্রিকে টাকা দিতে হচ্ছে মাসে-মাসে! সুতরাং পাপ হলেও (ব্ল্যাকমেইল করা নিশ্চয়ই পাপ!) এই পথই বেছে নিলাম (মানে, নীলাদ্রি ব্ল্যাকমেইল করার পথ বেছে নিয়েছে)।
না, চিঠির অর্থ ভুল বোঝেনি অরিসেন। কিন্তু একইসঙ্গে বুঝেছে, এই চিঠিটাই প্রযুক্তিবিদ্যার দক্ষতায় হয়ে দাঁড়াবে নীলাদ্রির মৃত্যুর সরল ব্যাখ্যা। তাই সবেধন নীলমণি করে চিঠিটাকে সযত্নে রেখে দিয়েছিল অরিসেন। আজ সময় হওয়ায় সেটা ও পকেটে করে নিয়ে এসেছে। এই চিঠিটাই হবে নীলাদ্রি সেনের আত্মহত্যার একমাত্র সাক্ষী।
নীলাদ্রির বাড়িতে আজ যখন ও এসে ঢুকল, ওকে দেখে অবাক হলেও নীলাদ্রি বসবার ঘরে সারিকে আদরে আহ্বান জানিয়েছে। অরির অনুরোধে সদর দরজা ভেতর থেকে খিল এঁটে বন্ধ করে দিয়েছে নীলাদ্রিই। তারপর ওর মুখোমুখি বসে জানতে চেয়েছে অরির আসার কারণ।
কী ব্যাপার, হঠাৎ এ সময়ে?
তোর এ-মাসের কিস্তির টাকাটা দিতে এলাম।—বলতে-বলতে পকেট থেকে একগোছা পাঁচটাকার নোট বের করল অরিসেন: কিন্তু একটা কথা বলতে পারিস?
কী কথা?—মুচকি হেসে জানতে চাইল নীলাদ্রি। হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিল।
কবে তোর এই লুকোচুরি খেলা বন্ধ হবে?
মানে?
মানে, আর কতদিন এভাবে আমাকে টাকা দিতে হবে?—অরিসেনের স্বর কঠিন হল।
মানুষ ভুল যখন করে, তখন মাশুলের কথা ভাবে না।—একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে রাখল নীলাদ্রি। তাতে আগুন ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছাড়ল: যেমন তোর পঁচিশবছর বয়েসের ভুলের মাশুল তুই আজও শুধে চলেছিস।
ভুল?
ভুলটার কথা আর-একবার মনে পড়ল অরির। তখন ওর বয়েস হয়তো পঁচিশই হবে। ও আর নীলাদ্রি গাড়ি করে যাচ্ছিল রানাঘাটের দিকে। তখন ওর সুখে-দুঃখে বন্ধু বলতে একমাত্র নীলাদ্রি।
রাত প্রায় দশটার সময় নৈহাটির কাছাকাছি ওদের গাড়ির তেল ফুরোল। নির্জন রাস্তায় সাহায্য চাওয়ার মতো কেউ ছিল না। গাড়ি থেকে নেমে এদিক-ওদিক চাইতেই ওদের চোখে পড়ল একজন লোক একটা সুটকেস হাতে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে।
লোকটা কাছে আসতেই ওরা অবাক হল। কারণ, তার চোখে-মুখে আতঙ্কের বিশ্রী ছাপ। ওদের দেখেই, বলল, কাইন্ডলি আমাকে একটা লিফট দেবেন?
লিফট দেওয়ার ব্যাপারে ওরা আপত্তির কিছু দেখেনি। কিন্তু ওদের তেলের দূরবস্থার কথা জানিয়েছিল। লোকটি সে-কথা শুনে অতি উৎসাহী হয়ে সুটকেস রেখে একটা ক্যান নিয়ে তেল আনতে ছুটল।
সে চলে যেতেই স্বাভাবিক কৌতূহলবশে নীলাদ্রি সুটকেসের কাছে এগিয়ে গেল। ওটা তুলতে চেষ্টা করল। তখনই ও বুঝল, সুটকেসটা প্রচণ্ড ভারী।
সুটকেসটা লক করা ছিল। কিন্তু একটু টানাটানি করতেই লকটা খুলে গেল। একমুহূর্তও দেরি না করে সুটকেসের ডালা খুলে ফেলল নীলাদ্রি। সঙ্গে-সঙ্গে চকচকে আলোর ছটায় ওর চোখ ধাঁধিয়ে গেল। সুটকেসে সুন্দর করে সাজানো অনেকগুলো সোনার বিস্কুট।
তাড়াতাড়ি ডালাটা আবার কোনওরকমে আটকে দিয়েছিল ওরা।
লোকটা ফিরে এসে সুটকেস খোলার ব্যাপারটা মোটেই বুঝতে পারল না। সুতরাং তেল ভরে গাড়ি যখন নতুন করে রওনা হল, তখন ওদের দুজনের মাথাতেই ঘুরছে একই চিন্তা— ভাগ্য ফেরানোর এমন সুযোগ ওরা বোধহয় আর পাবে না।
অতএব পায়রাডাঙ্গায় লোকটি যখন নামবে বলল, তখন নীলাদ্রি ও অরিসেন মনে-মনে একই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। মুহূর্তের মধ্যে ওরা হিংস্র নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই স্মাগলারের ওপরে। মিনিটকয়েক পর যখন ধস্তাধস্তি থামল তখন বুঝল লোকটাকে ওরা খুন করে ফেলেছে। সুতরাং, তার মৃতদেহটা রাস্তার ধারে আগাছার জঙ্গলে ফেলে দিয়ে সুটকেস নিয়ে ওরা উধাও হল।
এ-ঘটনার মাসদুয়েক পরে নীলাদ্রি ধরা পড়ল পুলিশের হাতে। কীভাবে ওর হাতের আংটি অকুস্থলে খুলে পড়েছিল ও বুঝতে পারেনি। যেহেতু সোনা-ভরা সুটকেসটা ওকে বাঁচাতে হবে তাই খুনের দায় ও একা নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিল। বিচারে ওর সাজা হল বারোবছর সশ্রম কারাদণ্ড। সাময়িক উত্তেজনাবশে খুনটি ঘটে যাওয়ায় মৃত্যুদণ্ড থেকে ও রেহাই পেয়েছিল। কিন্তু চোরাই সোনার কথা পুলিশ জানতে পারেনি। সেগুলো লুকোনো ছিল অরিসেনের কাছে।
এরপর দিন-মাস-বছর ঘুরতে সময় লাগেনি। ধীরে-ধীরে অরিসেনের অবস্থা গ্যাসভরা বেলুনের মতো ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। ওদিকে জেলে বসে হাত কামড়েছে নীলাদ্রি। সোনার ব্যাপারটা ও না পেরেছে গিলতে, না পেরেছে ওগরাতে।
এইভাবে বছরদশেক কেটে যাওয়ার পর একদিন ছাড়া পেল নীলাদ্রি।
জেল থেকে বেরিয়ে প্রথমেই ও খুঁজে বের করল প্রাণের বন্ধু অরিসেনকে। শুরু হল এতদিনের ক্রোধ আর ঘৃণার ফল—ব্ল্যাকমেইলিং। রক্তচোষা বাদুড়ের মতো চুষে-চুষে ও অরিসেনকে ক্রমশ ঝাঁঝরা করে তুলেছে। হঠাৎ-উত্তেজনায়-করে-বসা ভুলের মাশুল অরিসেন আজও শোধ করে চলেছে নীলাদ্রির কাছে।
চিন্তার ধোঁয়াটে জল ছিঁড়ে গিয়ে হঠাৎই বাস্তবে ফিরে এল অরি, জিগ্যেস করল, একটু হুইস্কি হবে?
হাসল নীলাদ্রি: তুই আমার বড় মক্কেল। তোকে হুইস্কি খাওয়াব না তো কাকে খাওয়াব?
উঠে গিয়ে একটা বোতল আর দুটো গ্লাস নিয়ে এল নীলাদ্রি। এনে টেবিলের ওপরে রাখল। গ্লাসে হুইস্কি ঢালা শেষ হতেই ওর পিছনের একটা ফটোর দিকে তাকানোর ভান করে চড়া গলায় চেঁচিয়ে উঠল অরি, আরে, মেয়েটাকে যেন চেনা-চেনা মনে হচ্ছে?
ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকাল নীলাদ্রি: কে? ও—। ওটা আমার ওয়াইফের ফটো। আমি জেলে থাকার সময়ে মারা গেছে।
আচমকা নীলাদ্রির স্বর ভারী হয়ে এল।
কিন্তু ওই একমুহূর্তের মধ্যেই নিজের কাজ সেরে ফেলেছে অরি। হোমিওপ্যাথি ওষুধের শিশি উপুড় করে ম্যানডেক্স ট্যাবলেটের গুঁড়োটা পুরোটাই নীলাদ্রির গ্লাসে ঢেলে দিয়েছে ও। সুতরাং গ্লাসের হুইস্কিটুকু শেষ করেই ঝিমোতে শুরু করল নীলাদ্রি।
একটু পরেই ও কপাল চেপে ধরে লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে। আর সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করল অরিসেন।
প্রথমেই নীলাদ্রির জামার পকেট ক’টা হাতড়ে নিল…এ কী? নীলাদ্রির পকেটে তারই নাম লেখা একটা চিঠি! কী করে ওর পকেটে এল চিঠিটা? তা হলে কি পিয়ন ভুল করে অরিসেনের চিঠিটা নীলাদ্রির ঘরে দিয়ে গেছে? হতেও পারে। পাশাপাশি বাড়ি তো! (জেল ছাড়ার পর অরির পয়সায় অরিরই বাড়ির পাশে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল নীলাদ্রি—বোধহয় অরিকে চোখে-চোখে রাখার জন্য) একমুহূর্ত দেরি না করে চিঠিটা নিজের পকেটে চালান করল অরিসেন। তারপর নীলাদ্রির জামাকাপড় ঘেঁটে বিপজ্জনক আর কিছু পেল না।
এবার হুইস্কির গ্লাস দুটো তুলে নিয়ে ও গেল রান্নাঘরে। ওগুলো ভালো করে ধুয়ে-মুছে একটা গ্লাস তাকে তুলে দিল। তারপর নিঃশব্দে (কারণ, অরিসেন প্রথম থেকেই ঘরে মোজা পরে চলাফেরা করেছে, যাতে পুলিশ ঘরে ওর কোনওরকম পায়ের ছাপ না পায়) অন্য গ্লাসটা নিয়ে ফিরে এল বসবার ঘরে। গ্লাসটা টেবিলের ওপরে রেখে তাতে কিছুটা হুইস্কি ঢেলে দিল। নির্জীব নীলাদ্রির ডানহাত অতি সন্তর্পণে চেপে আঁকড়ে ধরাল গ্লাসটার ওপরে—যাতে পুলিশ গ্লাসের গায়ে শুধু নীলাদ্রির হাতের ছাপই পায়।
এইবার পকেট থেকে একজোড়া দস্তানা বের করে পরে নিল অরিসেন। তারপর পকেটের সেই বিশেষ চিঠিটা ভাঁজ করে রাখল টেবিলের ওপরে—একপাশে। যাতে সহজেই লোকের নজরে পড়ে।
নীলাদ্রির অজ্ঞান দেহটা একবার পরীক্ষা করল অরি। নাঃ, ওর অনুমান ভুল নয়: নীলাদ্রি এখনও বেঁচে আছে। চটপট ওকে টানতে-টানতে রান্নাঘরে নিয়ে গেল ও। বসবার ঘর থেকে একটা চেয়ার নিয়ে তার ওপর নীলাদ্রিকে বসাল। তারপর চেয়ারটা টেনে নিয়ে গেল গ্যাসের উনুনের কাছে…।
রান্নাঘরের দৃশ্যসজ্জা শেষ হয়ে যেতেই অরিসেন শোওয়ার ঘর আর বসবার ঘর আঁতিপাঁতি করে খুঁজল। নীলাদ্রিকে ওর লেখা ব্যক্তিগত চিঠি থেকে শুরু করে অরিসেন নামাঙ্কিত যে-ক’টা কাগজ পেল সবক’টাই পকেটস্থ করল।
যখন ও নিশ্চিত হল যে, নীলাদ্রির সঙ্গে ওর সম্পর্ক আবিষ্কার করার কোনও নিশানাই ঘরে নেই তখন ও স্বস্তি পেল। পুলিশ যেন নীলাদ্রির সঙ্গে তার সম্পর্কটাকে নিছক প্রতিবেশীর সম্পর্ক বলেই বিচার করে। কারণ, অ্যালিবাইয়ের ব্যাপারটা অরিসেন ঠিক পছন্দ করে না। অপরাধজগতে যদি চরম অনিশ্চিত কোনও ব্যাপার থাকে, তা ওই অ্যালিবাই। অ্যালিবাই জাল করলেও লোকে ধরা পড়ে। আবার সত্যি হলে তখন তার কোনও জুতসই সাক্ষী পাওয়া যায় না।
অরিও তাই করবে। বলবে, ও একা-একা গঙ্গার পাড়ে হাওয়া খাচ্ছিল! শুধু-শুধু একটা অ্যালিবাই তৈরি করতে গিয়ে ও নিজের বিপদ ডেকে আনতে চায় না। প্রতিবেশীর মৃত্যুর তদন্তে পুলিশের লোক হয়তো ওর কাছে আসবে—তারপর জিজ্ঞাসাবাদ করবে। তবে সে নিছকই তদন্তের খাতিরে ছকবাঁধা প্রশ্নমালা।
সুতরাং, সবকিছু আরও একবার যাচাই করতে রান্নাঘরে ঢুকল অরিসেন। গ্যাসের উনুনের ভালভটা পুরোটা খুলে দিল। একপলক নীলাদ্রির মুখের দিকে চেয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর নীলাদ্রির বাড়ির দরজা খুলে মিলিয়ে গেল রাতের অন্ধকারে। যাওয়ার আগে নীলাদ্রির পকেট হাতড়ে পাঁচটাকার বান্ডিলটা তুলে নিতে ভুলল না। এখন শুধু ভোরের অপেক্ষা।
অরির পরিকল্পনামাফিক যদি সবকিছু হয় তা হলে ময়না তদন্তের রিপোর্ট বলবে গ্যাসের উনুনে মাথা দিয়ে আত্মহত্যা করেছে নীলাদ্রি সেন। কারণ ম্যানডেক্সের পরিমাণ মাপমতোই ব্যবহার করেছে অরি—যাতে মানুষ মারা না যায়, অথচ ঘণ্টাকয়েকের জন্য অচেতন হয়ে পড়ে। সুতরাং, অজ্ঞান অবস্থাতেই নীলাদ্রির ফুসফুসে গ্যাসের কাজ শুরু হবে…তারপর…।
তিনদিন পর সন্ধেনাগাদ অরিসেন রায়ের দরজায় হঠাৎই টোকা পড়ল। দরজা খুলতেই অরিসেন এক যুবকের মুখোমুখি হল। অল্প বয়েস, পরনে পুলিশি পোশাক, সজীব চেহারা, কোমরে ঝোলানো আগ্নেয়াস্ত্র।
এরকম পরিস্থিতির জন্য নিজেকে এ ক’দিন ধরে প্রস্তুত করেছে অরি। সুতরাং বিন্দুমাত্রও অবাক না হয়ে ও সাগ্রহে তাকে ভেতরে আহ্বান জানাল, আসুন অফিসার, ভেতরে আসুন—। কী ব্যাপার বলুন তো?
অফিসার হাসলেন। সোফায় বসে পকেট থেকে একটা ছোট্ট নীল ডায়েরি আর একটা চিঠি বের করলেন।
উৎকণ্ঠায় সোজা হয়ে বসল অরিসেন। কী ওটা? ডায়েরি না? কার ডায়েরি?
মিস্টার রায়, আপনি বোধহয় আপনার পাশের বাড়ির নীলাদ্রি সেনের ব্যাপারটা শুনেছেন?
হ্যাঁ, লোকজনের মুখে শুনেছি। খুব স্যাড ব্যাপার।
আচ্ছা, ওঁর সঙ্গে আপনার কীরকম পরিচয় ছিল?
সামান্যই। ওই পাড়াপড়শির সঙ্গে যেমন পরিচয় থাকে আর কী!
দেখুন তো, এই ডায়েরিটা চিনতে পারেন কি না?—নীল ডায়েরিটা অরির দিকে এগিয়ে ধরলেন অফিসার।
অরির বুকটা ধক করে উঠল। ডানহাত নিজের অজান্তেই প্যান্টের পকেটের ওপর গিয়ে থামল। কারণ, সেদিন রাতে এরকমই একটা ডায়েরি ও পকেটে ভরেছিল। তখন খুলে পড়েও দেখেনি ওর ভেতরে কী লেখা ছিল। তা হলে কি শেষ পর্যন্ত মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল ওটা? নাকি ভুল করে ফেলেই এসেছিল ও?
অরি হাত বাড়াল ডায়েরিটার দিকে। ওর গলা যেন হঠাৎ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
ডায়েরিটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বেশ কয়েকবার নেড়েচেড়ে দেখল অরি। ডায়েরিটার ব্যাপারটা কি ও অস্বীকার করবে, নাকি…?
অফিসার তখন বলে চলেছেন, আর এই যে চিঠিটা—এটা মিস্টার সেনের ঠিকানায় এলেও আপনারই নামে লেখা। যে-পিয়োন সন্ধের ডাকে চিঠি দেয়, সে-ই ভুল করে যে এ-কাজটা করেছে সেটা আমরা জানতে পেরেছি। সে আরও বলেছে, গত বৃহস্পতিবার (যেদিন নীলাদ্রিকে ও খুন করেছে—ভাবল অরি) এরকম ভুল সে আরও একটা করেছে—মানে, আপনার চিঠি সেদিনও সে ভুল করে নীলাদ্রির ঠিকানায় দিয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, সে-চিঠিটা আমরা তন্নতন্ন করেও খুঁজে পাইনি। তা ছাড়া বৃহস্পতিবার রাতে এক ভদ্রলোক কী যেন ব্যাবসার কাজে মিস্টার সেনকে ডাকতে গিয়ে দেখেন দরজা ভেতর থেকে বন্ধ—কোনও সাড়া নেই। পুলিশে খবরটা তিনিই দেন। আমরা গিয়ে যা দেখলাম…।
থামছেন কেন, অফিসার?—অধৈর্য হয়ে মনে-মনে বলল অরি। এ উৎকণ্ঠা আর সহ্য করতে পারছি না আমি, প্লিজ।
…তাতে অবাক হওয়ারই কথা। কারণ, রান্নাঘরের আলো জ্বলছে। বাড়ির খিড়কি দরজা খোলা, এবং গ্যাসের উনুনে মাথা গুঁজে পড়ে আছেন নীলাদ্রি সেন। ব্যাপারটা নিয়ে আমরা খুব একটা মাথা ঘামাতাম না, কিন্তু আপনি বোধহয় জানেন না, মিস্টার সেন কিছুদিন আগেই জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন—তাই ঘরগুলো সার্চ করতে গিয়ে আমরা এই ডায়েরি আর চিচিটা পেলাম। ডায়েরিটায় মিস্টার সেনেরই নাম লেখা, কিন্তু এতে কোথাও তাঁর আত্মহত্যার ইচ্ছের কথা লেখা নেই—যেমন একটা চিঠিতে আমরা সে-ইচ্ছের কথা দেখেছি। তারপর…।
আপনার কি এভাবে না থামলেই চলছে না, অফিসার? প্রচণ্ড বিরক্তিভরে ভাবল অরি। কেন, এখন কি ওর কিছু একটা বলা দরকার? কিন্তু কাঁপা ঠোঁটে স্থির দৃষ্টিতে ও তাকিয়ে রইল অফিসারের মুখের দিকে।
…আমরা ভেবে দেখলাম, ব্যাপারটা একটা অ্যাক্সিডেন্টও হতে পারে। আবার এ-ও হতে পারে, মিস্টার সেন হয়তো কোনও কারণে ডায়েরিতে সে-ইচ্ছের কথা লিখতে ভুলে গেছেন।
তার মানে? আর কী লেখা আছে এই হতচ্ছাড়া ডায়েরিটায়?—ভাবল অরিসেন।
কিন্তু সেসব ছাড়াও আর-একটা ব্যাপারে আমরা যথেষ্ট অবাক হয়েছি। তাই ভাবলাম আপনি হয়তো আমাদের সাহায্য করতে পারেন। আমি ওই গ্যাসের উনুনটার কথা বলছি—মানে, ব্যাপারটা অনেকটা আত্মহত্যার মতোই ঠেকছে আমাদের কাছে…।
আমারও তাই ধারণা।—দৃঢ় স্বরে জবাব দিল অরিসেন।
কিন্তু সেখানেই তো গোলমালটা বাধছে।—অর্থপূর্ণ চোখে হাসলেন অফিসার: মিসটার সেনের টেবিলের ওপরে একবোতল হুইস্কি ছিল—আর একটা কাচের গ্লাস। গ্লাসে মিস্টার সেনেরই হাতের ছাপ পাওয়া গেছে। জানি না, ওই হুইস্কি খাওয়ার জন্যেই…।
তা হলে কি কোনও গন্ডগোল হয়ে গেছে? আসল ব্যাপারটা লোকটা খুলে বলছে না কেন?
যাই হোক, হুইস্কির জন্যেই হোক, বা পাগলামির জন্যেই হোক, মিস্টার সেনের তখন জ্ঞান ছিল না। নইলে কোনও লোক কখনও সব জেনেশুনে গ্যাসের উনুনে মাথা দিতে পারে?
অরিসেনের সপ্রশ্ন দৃষ্টির উত্তর দিতে দেরি করলেন না অফিসার, বললেন, কারণ, ওঁর তো অন্তত জানা উচিত ছিল যে, গত কয়েকদিন ধরে গ্যাসের লাইন খারাপ থাকায় ওঁর উনুনে কোনও গ্যাসই বেরোয় না! যাই হোক, মিস্টার সেন এখনও সে-রাতের ঘটনা আমাদের কিছুই বলতে পারছেন না। একেবারে বেবাক সবকিছু ভুলে বসে আছেন! তাই ভাবছি, ওর মেমারি লস হল কী কারণে?…ও কী মিস্টার রায়, কী হল আপনার…?
অফিসারের চোখের সামনেই চোখ উলটে হুমড়ি খেয়ে পড়ল অরি।
নাড়ি দেখলেন অফিসার। না—এতবড় আঘাতটা অরিসেন আর সামলে উঠতে পারেনি। পুলিশ ঠিকই অনুমান করেছিল, তাই একটা মিথ্যে গল্প ফাঁদতে হল গ্যাসের উনুন নিয়ে। কারণ, কোনও জোরালো প্রমাণ পুলিশের হাতে আসেনি—তাই একটা কনফেশানের দরকার ছিল। কিন্তু মিস্টার রায় যে হঠাৎ হার্টফেল করবেন সেটা অফিসার ভাবতে পারেননি। নাঃ, খুনিদের নার্ভ দেখছি খুব দুর্বল হয়—ভাবলেন তিনি।
অরি জানল না, নীলাদ্রি সত্যি-সত্যিই গ্যাসের উনুনে মাথা দিয়ে সেই রাতেই মারা গেছে!