দেবীপক্ষে বা মাতৃপক্ষে বোধনের তাৎপর্য
মহাষষ্ঠীর সন্ধ্যায় মা দুর্গাকে জাগিয়ে তোলা।
মা দুর্গার মুখের আবরণ উন্মোচনই এই রীতির প্রধান কাজ।
পুরাণমতে সর্বপ্রথম এই কাজটি করেছিলেন রাজা রামচন্দ্র।
বোধনের একটি নির্দিষ্ট পৌরাণিক তাৎপর্য-ও রয়েছে। মনে করা হয় এই নিয়মের দিনেই মা দুর্গা স্বর্গ থেকে মর্ত্যলোকে পদার্পণ করেন। সঙ্গে আসেন তার চার সন্তান লক্ষী, গণেশ, কার্তিক, সরস্বতী। মায়ের ভক্তগণ ঢাকের বাদ্যি মা দুর্গা ও তার ছেলে মেয়েদের অভিবাদন জানান। মা দুর্গার মুখের আবরণ উন্মোচনই এই দিনের প্রধান কাজ হিসাবে গন্য হয়। বোধনের আগে কল্পারম্ভ এবং বোধনের পরে আমন্ত্রণ এবং অধিবাস নামে আরও কয়েকটি ছোটখাটো নিয়ম পালন করা হয়ে থাকে। মনে করা হয় বোধনের পর প্রতিমার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই নিয়মের পরেই সকল দেব-দেবী এবং তার সঙ্গে মহিষাসুরেরও পুজো করা হয়।
বোধনকে অনেকে অকাল-বোধনও বলে থাকেন। হিন্দু শাস্ত্রমতে সকল দেব দেবী সূর্যের দক্ষিণায়ন শুরু হলে ছয় মাসের জন্য নিদ্রিত অবস্থায় থাকেন। যেহেতু দুর্গাপুজো এই ছয় মাসের মধ্যের সময়ে হয়ে থাকে তাই বোধনের মাধ্যমে আগে দেবীর ঘুম ভাঙ্গানো হয়। পুরানমতে সর্বপ্রথম এই কাজটি করেছিলেন দশরথ পুত্র রাজা রামচন্দ্র। অকালে মা দুর্গাকে জাগিয়ে তোলা হয়েছিল বলেই অনেক বিশেষজ্ঞ একে অকাল বোধন বলে থাকেন।
দুর্গাপূজাকে কেন বলা হয় অকালবোধন,
অকালবোধন কথাটির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এর অর্থ। অকালবোধন অর্থাৎ অসময়ে দেবীকে আহ্বান করা। অকালবোধনের সঙ্গে জড়িত রামায়নের অধ্যায়। সীতাকে লঙ্কাপতি রাবণের হাত থেকে উদ্ধারের জন্য শরৎকালে দেবীকে জাগ্রত করেন রামচন্দ্র। তাই সেই থেকেই শরৎকালে দেবীর পুজো অকালবোধন নামে পরিচিত। তবে এই অকালবোধন প্রথার পিছনে রয়েছে পৌরাণিক কাহিনী।
শ্রীরামচন্দ্র, সীতা ও লক্ষণের বনবাসে থাকাকালীন লঙ্কার রাজা রাবন একদিন সীতাকে অপহরণ করেছিলেন এবং অশোক বনে লুকিয়ে রেখেছিলেন তাঁকে। রামের সঙ্গে যুদ্ধের কারণে এক এক করে লঙ্কার সব বীর মারা পড়েন। তাই লঙ্কাপুরী সামলানোর দায়ভার থাকে রাবণের হাতে। ফলে ক্রমেই ভয় পেতে থাকেন লঙ্কাপতি। শেষে দেবী অম্বিকার স্তব করেন রাবণ। রাবণের কাতর স্বরে মা কালী রূপে সাড়া দিয়ে অভয় দেন রাবণকে। সেটা জানার পর সীতার হরণ হওয়ার কারণেও বিভিন্ন দেবীর শরণাপন্ন হয়েছিলেন রাম। তবে সেইসময় স্বর্গের দেবদেবীগণ নিদ্রামগ্ন ছিলেন। তাই ভগবান ব্রহ্মা শরৎকালের শুক্লাষষ্ঠী তিথিতে রামকে মা দুর্গার উপাসনা করার কথা বলেন।
রাম সেইমত শরৎকালেই দেবী দুর্গার পুজোর আয়োজন করেন। নিজহাতে দেবীর মূর্তি তৈরি করে শুরু করেন দুর্গাপজো। যথাসময়ে বোধন ও পুজো শুরু হয়। সন্ধিপূজার প্রধান উপকরণ ছিল নীলপদ্ম। তাই ১০৮ টি নীলপদ্ম দিয়ে সন্তুষ্ট করা যাবে দেবীকে। তবে সমস্যা হল অন্যদিকে। নীলপদ্ম সহজে পাওয়া যায় না মর্তে। তাই অনেক খোঁজার পর অবশেষে ব্রহ্মসরোবর থেকে জোগাড় করা হয় নীলপদ্ম। অন্যদিকে রাবণও মা দুর্গার নিত্য পূজারী। তাই দু’জনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ভক্ত পরীক্ষা করতে আসেন মা দুর্গা নিজে। রামের নিয়ে আসা ১০৮ টি পদ্মের মধ্যে একটি পদ্ম লুকিয়ে রাখলেন। পুজোর সব আয়োজন করে যখন রাম আসনে বসেন তখন দেখেন একটি পদ্ম কম রয়েছে। তবে এত কম সময়ের মধ্যে আর একটি পদ্ম নিয়ে আসা অসম্ভব। তখন নিরুপায় হয়ে তিনি নিজের চোখ দিয়ে পুজো সম্পন্ন করতে যান। তা দেখে বিচলিত হয়ে মা দুর্গা দর্শন দেন দশরথ পুত্রকে। তাঁর ভক্তিতে প্রসন্ন হয়ে তাঁকে যুদ্ধ জয়লাভের বর দেন।
শাস্ত্রমতে দুর্গাপুজোর উপযুক্ত সময় বসন্তকাল। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে সূর্যবংশীয় রাজা সুরথ বসন্তকালে চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী ও নবমী তিথিতে দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন। তাই এই পুজো বাসন্তীপুজো নামে পরিচিত।